।। রওশন সালেহা।।
রওশন সালেহার ‘আমার এক নদীর জীবন’ বাংলা আত্মজৈবনিক সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অধীন অবিভক্ত বাংলা এবং পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাংলার নানা খণ্ডচিত্র উঠে এসেছিল এই গদ্য সাহিত্যে। বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় নোয়াখালী, ঢাকা ও কলকাতার সমাজ জীবন, রাজনীতি, শিক্ষাপ্রসার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ, ইতিহাসের নানা বাঁক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি মুসলিম পরিবারের ভিতর থেকে আত্মজৈবনিক কথনের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছিলেন রওশন সালেহা। এই রচনার দ্বারা বাংলা সাহিত্যে রওশন সালেহা শক্ত স্থান দখল করে নেন। এছাড়াও ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত। আমরা ‘আমার এক নদীর জীবন’ নামক আত্মজৈবনিক এই গদ্য সাহিত্যকে কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রতিপক্ষ’-এ পুনরায় প্রকাশ করেছি। এটি শেষ পর্ব। এই পর্বে রয়েছে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যু এবং ওই ঘটনার সমান্তরালে রওশন সালেহার স্বামীর মৃত্য, বৈধব্য পরবর্তী জীবনে নতুন করে লেখকের শিক্ষাক্ষেত্রে জীবন সংগ্রাম, কর্মজীবনে অবসর এবং নিজের জীবনের উপলব্ধি। এই পর্বের শেষের অংশেই রয়েছে পূর্ববর্তী সাতটি পর্বের লিঙ্ক। আপনারা চাইলে প্রথম থেকে এই আত্মজৈবনিক কথাসাহিত্য পুরোটা পড়ে ফেলতে পারেন।
এর সঙ্গে শেষ হোল ‘আমার এক নদীর জীবন’।
আমার এক নদীর জীবন (শেষ পর্ব)
আমার সকল দুঃখের প্রদীপ
সংসারের অমূলক দুঃখের সাথে বিরোধ আমার বহুদিনের। বন্ধ জানালার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে স্কুলে যেতাম, আসতাম। এর মধ্যে কোনো এক অনিরুদ্ধ মুহূর্তে হাজির হতাম অরুণ স্কুলের ছাত্রীদের মিটিঙে, আলোচনায় ঢুকে পড়তাম। বই পড়ার আগ্রহ ওদের থেকে পাই। পর্দানশীল ছাত্রীর ঐটুকু বিরোধিতা আড়ালে আবডালে অতি সন্তর্পণে হতো। তারপর এলো একচল্লিশ, শুরুতে এক অপরিণত বয়সী মেয়ের ঘাড়ে সোনা-রূপার সুতোয় বুনট বেনারসী শাড়ির ভার আর পিঠে চাবির গোছার চাপ, কেঁদে কেটে বয়ে নিলাম। উপায় ছিল না।
মুসলমান মেয়েদের জন্য এত ভাগ্য, সমাজে আমার বাবাকে সকলে বাহবা দিচ্ছিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার তো এ নয়! তবুও দুঃখ দুঃখ করি কেন? আমি একটি শিক্ষিত পিতামাতার সন্তান, ঘরে লেখাপড়ার। জন্য পরিবেশও তারা রেখেছিলেন। এর মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখতাম, বড় হবো, কলেজে যাব, ইউনিভার্সিটিতে পড়বো, একজন ভাল শিক্ষক হবো। হিন্দুদের মেয়ের সাথে মিশে আমার এই স্বপ্ন এত কঠিন শপথ জাতীয় কিছু ছিল কখনও বুঝিনি। আমার বাবা-মাও বুঝতে পারেননি। খুব জাঁকজমকের সাথে নামাজী অবিবাহিত যুবক পেয়ে বিয়ে দিলেন। যুবকটির বয়স কত? এ বিষয় সম্পর্কে সেকালে কেউ ভাবতো বলে মনে হয় না। বিয়েতে ছেলেমেয়ের বয়স’ কোন ইস্যু তখন ছিল না। আরও প্রাধান্য পেত না ছেলে কত রোজগার করে, কি পেশায়, তার পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবে। সাধারণ জীবনযাত্রার জন্য সেকালে কেউ অর্থের কথা তেমন ঠাঁই দিত না। ভাত-মাছ খেয়ে কোনোমতে দিন গেলেই সন্তুষ্টি। আমার বাবাও খুব সাধারণভাবে চলতে উপদেশ দিতেন আমাদের। সে জন্যই বিয়ে ঠিক করতে গিয়ে তিনি একটিবারও ভাবেননি, একজন কেরানির সাথে বিয়ে দিলে কি অসুবিধা। গ্রাজুয়েট ছেলে ‘ল’ পড়ছে পাস করে কলকাতায় প্রাকটিস শুরু করে দিলেই হবে। বাবা এত সহজ-সরল মানুষটি ছিলেন যে,যা ভেবেছেন তার উল্টোটি ঘটতে পারে,তা তিনি একটিবারও মনে আনেননি। নিজের মত করে ভেবেছেন। তিনি কষ্ট করে পড়েছেন, রাজনীতি করেছেন,শেষে ‘ল’ পাস করে উকিল হয়েছেন। কিন্তু অন্য এক বংশের ছেলে তার মত হতে পারবে-এমন ভাবতে গিয়ে ভীষণ ঠকলেন। আমার তখন জ্ঞান ঐটুকু—শরৎচন্দ্র কি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস, মুসলমান মেয়েদের নিয়ে কোন বই তো পড়িনি। তবে দেখেছি.দু তিনটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শ্রদ্ধেয় মৌলভী আব্দুল গোফরান উকিল, চৌধুরী মিঞা মোক্তার এবং মৌলভী আব্দুস সোবাহান, এরা মেয়েদের জেলার বাইরে হোস্টেলে রেখে পড়িয়েছেন। তাঁরা যেভাবে স্ত্রী শিক্ষাকে সমর্থন করেছেন, বাবা সেভাবে করলেন না। হোস্টেলে না রেখে মেয়ের বিয়ের কথা ভাবলেন! স্বামীর ঘরকে হোস্টেল ভাবলেন। কী করে? এত বড় ভ্রান্ত ধারণা, সেই সময়ে তার মতো একজন প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ এবং পেশায় আইনজীবী কি করে এ কাজ করছিলেন,আমি আজও বুঝতে পারি না। অথচ আমার জন্মের পর তিনিই আযান দিচ্ছিলেন (সমাজে মেয়ে হলে আযান দেয়ার নিয়ম নেই, শুধু কানে কালেমা তৈয়বা পড়ে দেয়া হয়)। আকিকার সময় বিরাট এক নামের বহর দিয়ে আমার আপাদমস্তক মুড়ে দিয়েছিলেন।
সে কালে আরও দেখেছি,অল্প বয়সে যে সব মেয়েদের অবস্থাপন্ন বাপরা বিয়ে দিতেন, ছেলে ডাক্তারি কী ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সুযোগ পেয়েছে এমন পাত্র পেলে। কারণ এদের পড়ার খরচ চালিয়ে যেতেন। মেয়ে বাপের বাড়ি থাকে,জামাই এখানেই আসে। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। এই মেয়েরা লেখাপড়ায় মনোযোগী তেমন ছিল না (যাদের দেখেছি)। কিন্তু স্বামীর রোজগার,পদমর্যাদা পরবর্তী জীবনে তাদের সমাজে উচুস্তরে তুলে আনে। অপরপক্ষে আমি ভাল ছাত্রী হয়ে সবরকম ভোগান্তির মধ্যে নিপতিত হলাম। বিয়ের পর পড়ার সুযোগ পাওয়া আর সচ্ছলতা থেকে কতবার ধাক্কা খেলাম আবার উঠে দাঁড়ালাম, সেই খতিয়ান আর নাই-বা দিলাম। কলকাতা গিয়ে যখন সংসার পাতি,তখন আমি নামকরা উকিলের মেয়ে এবং ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করা ভাল ছাত্রী নই—ভাল করে টের পেলাম একজন আপার ডিভিশন কেরানির স্ত্রী। স্বামী রাইটার্স বিল্ডিং-এর চাকুরে, অল্প আয়ের সব খরচ ম্যানেজ করতে হবে। ‘ল’ পাস করে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করার দিকে স্বামীর চেষ্টা নেই। কিছু বলেছি তো শুনেছি,বিয়ে তো দিয়েছে কেরানির সাথে, জজ ব্যারিস্টারের সাথে দেয়নি, এত প্যানপ্যানানি। শুনতে চাই না। সংসার না করতে পার তো বাপের বাড়ি চলে যাও। আমার ইচ্ছা হয় পড়বো-নয়তো নাই… বললেই তো যাওয়া যায় না। আমার ভেতর যেমন একটি অভিমানী মন আছে, তেমন জেদী স্বভাবটাও বেশ টনটনে। বলতাম, কেন যাব! দোষ কী আমার! সংসার বড় হচ্ছে, আমরা ইচ্ছামতন চলতে পারি না। তোমাকে পড়তেই হবে এবং আমিও পড়বো— এছাড়া অন্য কথা বন্ধ।
এগুলো আমার সমূলক দুঃখ। আমাকে তাড়া করে ফিরছে, এর থেকে ছাড় পাব কী করে! কোথায় গেলে দুদণ্ড নিরিবিলি পাবো! এই করতে গিয়ে একরোখা দৃষ্টি পেয়ে যাই, আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মেয়েদের কথা কেউ ভাবতে পারে না। বাপ নিজের আদরের মেয়ের কথা ভাবতে পারে না, বিয়ের পর মেয়েটার কি দুঃখ জোটে কপালে। মহীয়সী নারীদের জীবনী, বইপত্র পড়ে আমি অতঃপর মনে বল পেতে থাকলাম। ব্রাবোর্ন কলেজে আমার সমব্যথী কেউ ছিল না। সকলেই অবস্থাপন্ন ঘরের অবিবাহিত মেয়ে। কাউকে খুঁজে নেব, সেই সময়ও আমার ছিল না। জিদের বশে কেবল কাজ করেই যেতাম। স্বামী যে বুঝতেন না, কি করে বলি। মিথ্যে হবে সেটা। কিন্তু তিনি তো এই সমাজেরই একজন পুরুষ মানুষ, তার ভাইবোন, আত্মীয়-পরিজন আছে। তাই বলবো, আমার সমূলক দুঃখ তো ছিলই এগুলো। তার সঙ্গে মাকড়শার জাল বুনতো কত অমূলক দুঃখ। তার তো সীমা নেই।
কোনো সময় আমি নিজকেই মনে করি, আমি মাকড়শা; ইংল্যান্ডের ইতিহাসে রবার্ট ব্রুসের পালিয়ে থাকা গুহার মধ্যে জাল বুনে চলেছি, যতবার জাল বুনার চেষ্টা করি, ততবার কত যে চেষ্টা আর সাধনা জুড়ে দিই শেষ নেই। তারপর জালের তন্তুগুলো জোড়া লাগলে আমি গায়ের ঘাম মুছি। মনে এক কথা, আমার পথের মধ্যখানে থেমে গেলে চলবে না, কাজগুলো শেষ করে যেতেই হবে। বেগম রোকেয়াকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখেছি। ক্লাস এইটে পড়েছিলাম সরোজিনী নাইড়র একটি কবিতা ‘দি হ্যান্ড দ্যাট ক্রাডেলস দি রক রুলস দি ওয়ার্ল্ড। তার কথা মনে গেঁথে থাকতো। আর ছিল পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, যে তার প্রিয়তম কন্যা প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরাকে লন্ডনে চিঠি লিখতেন, সেগুলোর সংগ্রহ করা বইটি পড়তে।
কিন্তু এই ছাপোষা এক স্কুল মাস্টারনী, স্বামী যার আধা বেকার, খিটখিটে আর অসুস্থ, তার এত খায়েস কেন হবে—এটি বুঝতাম, না। আমি, না বুঝতেন স্বামী। হাতে হাতে তার ফলও পেয়েছি। ঘরে তিক্ততা, বাইরে অন্যের মুখের ঝাল খাওয়া। মেয়েদের পার্সোনালিটি ঘরে-বাইরে ছেলেদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়, নারীর ভাগ্যে জোটে নিন্দা, কটুবাক্য, অপমান। আমার কপালেও ঠোক্কর আসে, প্রথমে কাঁদতাম। পরে গা সওয়া হয়ে গেল। কত আর বলে, কত আর শুনি। কিন্তু শরীর সেটা সয়ে নিল না। তার যে একটা সহ্য করার সীমা আছে, অতিরিক্ত হলে ধস নামে। আমার মাথাভর্তি ঘনকালো চুল, , পিতামাতার দান, মাথায় তার একশো ভাগের একভাগ ধরে রাখতে পারলাম না, টাক দেখিয়ে তবে ছাড়ছে। যে চোখ নাকি আমার ভীষণ জোয়ার মাখা, সে দুটো কোটরে বসেছে। সুন্দর স্বাস্থ্যের গড়াপেটা শরীর পোড়খাওয়া হলো। অনেক ঝড়-তুফান আর অত্যাচার তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। তবু আমার মন অটল রইল। মন্ত্রের সাধন নয়তো শরীর পতন। আমি নিজকে গড়েছি অনেক শ্রম দিয়ে; শিক্ষক হয়ে নিলাম মানুষ গড়ার কাজ। এভাবে এক সময় মিশে গেলাম সমাজের নানান কাজে। ভাল মানুষ তৈরি করতে হলে আমি কিভাবে কাজ করবো? একজন নিপুণ কারিগরের মত। তাই নয় কী?
সংসার বাড়ছে, আমি নিরুপায় হয়ে কোন একটা উপায় খুঁজতে থাকি। বি.টি.পড়ার পরে এম. এড পড়তে হবে আমাকে, আর কোনো উপায় নেই। আমি সুন্দর এবং সচ্ছল জীবন পেতে চাই। আমি যে কষ্ট ও সাধনা দিয়ে কাজ করতাম, আশপাশের মানুষজন হতবাক। বলতো, পড়া পড়া করে কি তুমি পাগল হয়ে গেলে! ছাড় এসব, আমাদের চোখে তোমার কষ্ট সয় না। বাচ্চাগুলোর কষ্ট হয় না? আমিও কাঁদতাম। হায় আমি পাগল হয়েছি, না হলে বাঁচবো না, আমি বাঁচতে চাই।
সত্যি অর্থে এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম, পাগলই বটে। আমাদের সমাজ মেয়েদের জন্য ভোগান্তির পথ তৈরি করে রেখেছে। চলতে গেলেই কাঁটা ফুটবে পায়ে, রক্ত ছুটবে। ব্যথায় কাতরাবো, তবে তো। শায়েস্তা হবে নারী। কিন্তু আমি তা হতে পারলাম না। দুঃখকে পায়ে মাড়িয়ে চলতে থাকি। অল্প বয়সের বিয়ে, বছর ঘুরতেই সন্তান কোলে, এ হচ্ছিল স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু আমি তাতে আগুনের মতো ফুঁসতে থাকি, কেরানি বাপের এত সন্তান কেন? খাওয়াবে কী? আর আমি তো ভাল ছাত্রী ছিলাম, কেন পড়বো না। আমার থেকে মেধায় খাটো, তারা দেখি এম. এ পাস করে কলেজে ঢুকেছে, আমি কোন্ দোষে অধঃপতন সইবো। জোর করে পড়ছিলাম। খাই না খাই একটা হবে। এর মধ্যে ঘাবড়া দিলেন স্বামী পুরুষটি। চাকরি করেন কেরানির। কিন্তু মন মেজাজে নবাব সাহেব। সংসার আর কয়েকটি পুষ্যির কথা একটুও ভাবলেন না। অফিসের বড় সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে চাকরির নিকুচি করে আসেন। বলেন ঐ মীরজাফরদের সঙ্গে কে চাকরি করে! করলেন না তো না-ই। যেন সংসারের বোঝা বইবার জন্য আমি এ দুনিয়ায় এসেছি। আল্লাহ আগ্রহ করে পাঠিয়েছেন। আমাকে এ ভার নিতেই হবে–নিলাম। স্বামীর রোজগার নেই, তাই বলে অন্যের কাছে হাত পাতবো? জীবন থাকতে নয় । মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া উচিত। বাধা কেটে গণ্ডী থেকে বেরিয়ে আসা চাই।
এ সবই আমার অমূলক দুঃখ। তাই বেশি যন্ত্রণা দিতো। মনের দুঃখে এবং ক্ষোভে পড়ালেখা করে খুব ভাল করবো– তাও করতে পারতাম না। তাই পরীক্ষার ফলগুলো পেয়ে কোনদিন খুশি হইনি। উল্টো দুঃখে মলিন হয়েছি। সবার চোখের আড়ালে কেঁদেছি। ভাগ্যের সঙ্গে আর কত লড়াই করবো! এক সময় মন শান্ত হয়, আল্লাহ যা করেছেন মঙ্গলের জন্য। এমন সংকটে না পড়লে জীবনকে অনুভব করা যায় না, সত্যের উপলব্ধি আসে না। আমি দুঃখ-কষ্টে সংসার তো টেনে নিতে পারছি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে অকূলে তো ভেসে যাইনি। জীবনে বেঁচে থাকলে আমার সব হবে, শ্রম আর সাধনা আমাকে নিরাশ করবে না। স্বামী যা করছে করুক। তবু বেঁচে থাক। ছেলেমেয়েরা সুস্থ-সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে পারবে, তেমন পরিবেশ আমি ওদের জন্য তৈরি করবো– এ ধরনের একটা উপলব্ধি আমাকে অতঃপর পেয়ে বসলো।
আমার একা রোজগার, ফিক্সড ইনকাম। সংসার চালানো দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু নিরাশ হলাম না। আমার সাধনা বার বার ভাঙ্গে, এই বলে আর চেঁচাই না। এক শান্ত নদী হয়ে যাই। উপরি আয় করার জন্য হাতের কাছে যা মিলে— তাই নিলাম। পত্রিকায় লেখালেখি, রেডিওতে গল্প-রম্য রচনা দেয়া; ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অতিরিক্ত কাজ করা, খাতা দেখা সবই করেছি। কিন্তু কখনও টিউশনি করিনি। এতে আমার সংস্কার আছে তা আগেই লিখেছি। আমার খাটুনি এবং সময় এসব কাজে বেশি ব্যয় হওয়ার কুফলও পেতাম। কোন অঘটন থেকে রক্ষা করার মত সময় দিতে পারিনি। স্বামী বিরক্ত, তাকে অবহেলা করেছি। ছোট ছেলে পড়ে হাত ভাঙলো। মেজটা পা ভেঙে কাতরায়, ওদের হাসপাতালে নিয়ে। দৌড়াদৌড়ি সেও আমি করেছি। ভাবতাম স্বামী কিভাবে নিজের বোনদের ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে। সেই মানুষ ঘরে বসে চেঁচামেচি- মা না দেখলে কি হয়, দেখ তোমরা – বলে আমাকে বকুনি কেন দেয়? মনের দুঃখ চেপে রাখতাম দুনিয়ার এই নিয়ম? ঘাড়ে বোঝা একটা নিলে আরও নিতে হয়। অন্যেরা নেয় না। ঠিক আছে তারপর স্বামীর উপর অভিমান করবো কি! তার বোঝাও আমি টানতে থাকি। কোথাও সেমিনারে অফিসার পাঠাতে হলে অফিসে আমার নাম প্রায় এক নম্বরে যেত। যাই কী উপায়ে, সামান্য দু-একদিনের জন্য দেশের ভেতরে ঢুরে যেতাম। কিন্তু ফিরে এসে মন খারাপ হয়ে যেত; আমার গলার আওয়াজ, পায়ের শব্দ তিনি শুনতে পান। অথচ আমাকে চোখে দেখছেন না, এই কষ্টে মুখে আহার তুলতে পারেন না। মনের ভয়ে ঘুম আসে না। এত নির্ভরশীল আমার উপর যে, তাকে নিয়ে আমি কী করবো! ট্যুর শেষ করে এসে প্রতিবারই এই অবস্থা দেখতাম-বিষন্ন মলিন অসহায় ! ভাবতাম এমন হয় কেন? দুঃখে বুক ধুক ধুক করতো। কী অসুখ হলো? ডাক্তার কোন রোগ খুঁজে পান না।। বলকারক খাবার খেতে দেয়ার কথা বলে। এই অবস্থা হওয়ার আগে আমার অফিসে চাকরি করা নিয়ে তিনি ঝগড়া-বিবাদ করতেন, গান গেয়ে তামাশাও করতেন। বিশেষ করে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। তিনি কটাক্ষ করবেনই; ফিল্ম স্টার? সিনেমায় এ্যাকটিং করবার যাও?
আমিও ছেড়ে দিতাম না। বলেছি, হ্যাঁ। কলকাতায় সিনেমা দেখিয়েছ, মনে রেখেছি। আগে পরতাম কড়া ইস্ত্রির দেশীয় শাড়ি। অধিকাংশ ছিল হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি। পরে এসব ছাড়তে হয়েছে, আগের মত ধোপার সুবিধা উঠে গেছে, লন্ড্রী বসেছে। নিত্য ইস্ত্রি শাড়ি পরতে গেলে খরচে কুলায় না। আবার অন্য সহজলভ্য শাড়িও হাতে পেতাম। (ছেলেমেয়েরা বাইরের থেকে রকমারি সিল্ক, জর্জেট, শিফন প্রিন্টের শাড়ি পাঠাচ্ছিল। এগুলো ইস্ত্রি লাগে না, পরেও আরাম। তার থেকে এসব ব্যঙ্গ শুনে কখনও মেজাজ চড়ে যেত; আমার পেছনে এত লেগেছ কেন? সন্দেহ করছো, তা করতে পারো। পুরুষরা এমনিতেই মেয়েদের উপর সন্দেহ করে, তার উপর আমি সাজগোজ করে অফিসে যাই। সন্দেহ করবেই। তবে ভাল করে চেয়ে দেখ, আমি পরিচ্ছন্নভাবে সাজি। অফিসে যেতে, যতটুকু দরকার। বাইরে তাকিয়ে দেখ মেয়েদের ড্রেসে কত পরিবর্তন এসেছে কারণ মেয়েরা অফিস করছে, বাসে চড়ছে, হাঁটছে। ভবিষ্যতে আরও করবে। শুধু স্কুল-কলেজে কয়জন মেয়ের চাকরি হবে? মেয়েদের সংখ্যা তো পুরুষের সমান দাঁড়িয়ে গেল। দেশের অর্ধেক নাগরিক নারী, কেবল ঘরের মধ্যে আটকে থাকছে কয়জন? ঘরের কাজ সেরে বাইরের কাজে দৌড়াচ্ছে, আমিও যাচ্ছি। তামাশা না করে বল আমাকে সুন্দর লাগছে কিনা? আমার এই আগ্রহের চাওয়া, সব সময় তার মর্জির ওপর নির্ভর করেছে। মূলকথা আমাকে অফিস যেতে দেয়া তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল। অবস্থার চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু মন থেকে কখনও সায় ছিল না। আমারও তার থেকে এই আচরণ সহ্য হতো না। এটা ছিল অমূলক দুঃখ, তাও একদিন দুজনে সয়ে গেলাম।
স্কুলে চাকরি করছিলাম, তখন আমার সন্তানেরাও স্কুল-কলেজে যাচ্ছিল। ওদের জন্য আমি খুব কম সময় দিতে পেরেছি। আমার কাজের ফাঁকে তারাও ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু সার্বক্ষণিক তদারকির বোধ করি একটা খারাপ দিক আছে, ছেলেমেয়েরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহার করার সুযোগ পায় না। আত্মনির্ভরশীল হতে বাধা পায়। সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা ব্যাহত হয়। ঘরে অনেক সময় থাকতাম না। ওরা ভাইবোন যে ঘরে থাকতো, ঘরের কাজকর্ম সারা করে রেখেছে। কোনটি ছেলের কাজ, কি মেয়ের। কাজ তা নিয়ে ভাগাভাগি করতো না। ডিম ভাজা, চা তৈরি, কাপড় কাঁচা আমার ছেলেরা অক্লেশে করেছে। এদিক থেকে বলা যায়, ভবিষ্যত জীবনের ট্রেনিং তাদের হয়ে গেছে। ঝগড়া ও গালমন্দ করার মধ্যে ওদের কম দেখেছি, মায়ের অনুপস্থিতিতে ওদের মাখামাখি ভাব বেশি গড়ে ওঠে – আমার মনে হয়। তবুও লেখাপড়ায় খারাপ ফল করলে অথবা বাইরে মারামারি করে ঘরে এলে আমার সুপারভিশন নিয়ে স্বামী কটাক্ষ করেছেন, মা এত বাইরে থাকলে ওদের কি দোষ! কিন্তু সন্তানদেরকে আমি যে চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল করিনি, তা তো ঠিক। আমার শাসনের নীতি ছিল এমন, আমরা মতিঝিলের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকায় থাকি, একথা কেউ বিশ্বাস করে না। ভাবে র্যাংকিং স্ট্রিট কিংবা ধানমণ্ডিতে আছি। কারণ আমি তোমাদের সেভাবে তৈরি করছি, এরপরেও আমি তোমাদের থেকে চাই, তোমরা বাপের চরিত্রের সৎ গুণগুলো নিজেরা আয়ত্তে আনতে চেষ্টা করবে, কিন্তু তার মেজাজকে অনুকরণ করবে না । আমরা শিক্ষক, ছেলেমেয়ে পড়াই, তোমরাও মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া কর, এই হবে তোমাদের জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাদের রক্তে অন্য কিছু নেই। শিক্ষিত লোকের জীবনে কষ্ট আসলে সে অবিচল এবং একনিষ্ঠ থাকতে পারে, অন্যেরা পারে না।’
উনিশ’শ আশি সালের কথা। স্বামীর শরীর খারাপের দিকে যাচ্ছিল। বিশেষ করে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি বুঝি নিজের দিন গোণা শুরু করলেন। আমি কোথাও গেলে, দেরি করলে ভীষণ ক্ষুব্ধ। আমার হাতে খাবে না। আমি মরে গেলেই তোমরা বাঁচো—এসব উক্তি করতেন। আমি তাকে উৎসাহ এবং পরিতোষ দেয়ার জন্য তক্ষণি বলতাম, এতদিনেও আমাকে চিনলে না, উল্টোই ভেবে গেলে! এদিকে সাতজন সন্তানের মধ্যে নিজের ভাল মানুষী গুণগুলো দিয়ে গেলে, চেনা-জানা মহল আমাকে প্রশংসা করে বলে রত্নগর্ভা। আমি তো কেবল পরিবেশ দিয়েছি, স্বর্ণের আধার তো হলে তুমি। সোনার ছেলেদের ফেলে যাবে কোথায়? ওরা কত যত্ন করে তোমার! ওদের দোয়া করো– সেটা দরকার। (সাংবাদিক কামাল লোহানী আমাকে দেখলেই রত্নগর্ভা বলে সম্বোধন করেন। কাছে থেকে দেখেছেন তো,তার মনের মধ্যে সুন্দর একটা মন্তব্য উঠে এসেছে)। কিন্তু আমার গর্ব করার বিষয় অন্য, ওরা আমার মুখ রেখেছে। শিক্ষিত ও চরিত্রবান পিতার এবং শিক্ষয়িত্রী মায়ের সন্তানেরা যে যেখানে আছে রত্নবিশেষ মর্যাদা পায়-একথা শুনলে বুক ভরে যায়।
নিজ পরিবারের মধ্যে কতক্ষণ বা থাকতে পেরেছি, বিরাট একটা স্কুল সামলেছি। সকাল সাতটায় বসতো একটি, বারোটায় বসতো অন্যটি। কত ছাত্রী লোকজন তাদের সকলকে একটা নিয়ম শৃঙ্খলায় রাখার জন্য আপ্রাণ সাধনা করতাম। আমার এক সহকর্মী সুলতানা প্রায়ই আমাকে টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিত, এত পরিশ্রম করছেন, শরীরের কি হাল! আপনি তো হেডমিস্ট্রেস। আমাদের হুকুম করেন কী করতে হবে। অন্যরাও বলতেন। কিন্তু আমার যে ভাল লাগে ছাত্রীদের নিয়ে নানান বিষয়ে ওদের উৎসাহ দিয়ে কাজ করাই, অন্যরা কি জানি কতখানি করবে। ছাত্রীদের বলেছি তোমাদের কত ভাগ্য, স্কুলে পড়তে পার, চারদিকে চেয়ে দেখ, মেয়েরা ছেলেরা স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ওদের প্রতি তোমাদের কিছু করার নেই? আছে, তোমাদের বাড়িতে দু একটা কাজের ছেলে থাকে। আশপাশেও থাকে। ওদের নিয়ে পড়াবে। ওরা আমার কথা অনেকেই পালন করেছিল, স্কুলে এনে দেখাত ওরা কি করেছিল। অবশ্য বড়দের মত মাস্টারি করা ওদেরও বোধকরি শখের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। না হলে এত সুন্দর করে লেখাপড়া শেখাতে চাইতো না। আজও ঐ সব দায়িত্বশীল মেয়েদের দেখা পেলে জানতে পারি, সমাজের দায়িত্বশীল কাজেই ওরা নিযুক্ত হয়েছে। কোথায়ও দেখতে পেলে গর্ব ও আনন্দের সাথে সালাম জানাতে ছুটে আসে। তাইতো প্রায়শ শুনি, মাস্টারি করলেই দেখি লাভ, অনেকের সালাম পাওয়া যায়। আমিও খুশি মনে শুনিয়ে দিই; শিক্ষকতার এ হচ্ছে নগদ পাওনা। বাকিতো শূন্য। সেজন্য সাধ করে কেউ আজকাল এ লাইনে আসে না।
উনিশ’শ বিরাশি সনে দিল্লিতে শিক্ষার উপর একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম, বিষয়টি ছিল ‘লঙ টার্ম এডুকেশন প্লানিং ইন বাংলাদেশ’ ইউনেস্কোর আয়োজিত। ডাইরেক্টর ছিলেন দিল্লি ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর মুনিশ রাজা। লম্বা বাবরি চুলের মাথা নেড়ে গল্প করছিলেন। বললেন, তুমি তাহলে আগে টিচার ছিলে? তোমাকে একটা স্কুলে নিয়ে যাব। আজ সন্ধ্যায় যাবে? আমি রাজি জানাতেই তিনি কোথায়ও একটা ফোন করলেন হ্যালো মিস… (নাম মনে নেই) আপনাকে সারপ্রাইজ দেব… কয়েকজন গেস্ট, ইন্টারন্যাশনাল ব্যক্তিত্ব নিয়ে আসবো। তার মধ্যে স্পেশাল হলেন সালেহাজী ফ্রম বাংলাদেশ। আহা! গিয়ে যা দেখলাম অবিস্মরণীয়। স্যার বল্লভ ভাই প্যাটেল স্কুলে সেদিন ছিল আবেগ আর উদ্দীপনাপূর্ণ এক সমাবেশ। সন্ধ্যা বেলাতে আলো ঝলমল মেলা। যার নাম প্যারেন্ট-স্টুডেন্ট টিচার সম্মেলন। দিল্লির (লাড্ডু নয়) ইদলি, আলুচাট, ফুসকা, হালুয়া লাবড়ি কত যে মেয়েদের মায়েরা তৈরি করে এনেছিল, ছাত্রও ছিল। কো-এডুকেশন সেখানে।
স্কুলটি দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। সে দিনটি ছিল ক্লাস সিক্স ও সেভেনের জন্য। বসার ব্যবস্থা তেমন নেই, শুধু মাঝে মাঝে কয়েকটি চেয়ার রাখা, কেউ অবশ্য বসেনি। কেবল ঘুরে ফিরে আলাপ-আলোচনা এবং খাওয়া। ছাত্রছাত্রীরা দারুণ স্মার্ট। মেহমানদের নিয়ে টানাটানি, আমার পেরেন্টস এসেছে, ওদের সঙ্গে কথা বলবেন না? ঐ তোদাঁড়িয়ে। আমি এমন আহবান ঠেলি কোন মুখে! শেষে কী হলো? আমি দলছাড়া। হারিয়ে গেলাম। শেষে মাইকে শুনতে পেলাম ঘোষণা, ডক্টর রাজা ডাকছেন মিস বাংলাদেশ। একজন ভলান্টিয়ার মেয়েকে বললাম, আমাকে গাইড করে নিয়ে যাও ঘোষণা কেন্দ্রে। সেখানে দেখতে পেলাম, অনেক বাঙালি ছাত্রছাত্রী ও তাদের বাবা। আসলে এই ছিল বুড়ো প্রফেসারের মনে? আমার দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া।কেউ সরকারী চাকুরে,কেউ স্থায়ী বাসিন্দা ব্যবসা করছেন। সংখ্যায় পাঁচ-সাতজন হবেন।
আজও ভুলতে পারি না সেই প্রাণচঞ্চল আর উদীপ্ত প্যারেন্ট টিচার সমিতির সমাবেশটি। এ তো শুধু জনসংযোগ নয়,এক মহতী যোগাযোগ।এখানে জোর করে কিছু উপর থেকে চাপিয়ে দেয়নি,স্বতঃস্ফুর্ত মেলামেশা। শাসন ছাড়া ছেলেমেয়েরা ঘরের পরিবেশে যেমন স্নেহ-মমতা পায়, তেমনটি স্কুলের নিয়মের মধ্যে শিখে নেয়। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনসংযোগ বিষয়টি এমনভাবে দেখি যেন বাধ্যতামূলক কিছু ফরমালিটির অনুষ্ঠান। এতে নিয়ম আছে— হয়তো নিষ্ঠাও আছে-কিন্তু আবেগও দীপ্তির বড় অভাব। ফলে পুরো আয়োজন যা চায় তা পেতে পারে না।দিল্লি থেকে দেশে ফিরে আসার বেশ কিছুদিন পর একখানা চিঠি পেলাম। বল্লভ ভাই প্যাটেল স্কুলের প্রিন্সিপাল লিখেছেন তার স্কুলের অনুষ্ঠান কেমন লেগেছিল জানতে চেয়ে।(পরে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল যা নাচে,গানে,ছন্দে,কাব্যে বুঝি গোটা ভারতবর্ষ দেখছিলাম)। আমি এখনও জ্বলজ্বলা মনে রেখেছি সেই অনুষ্ঠানটিকে,তাঁকেও (সুস্মিতা নাম হবে ঠিক মনে পড়ছে না,চিঠিটাও খুঁজে পেলাম না)। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে এই সত্য কথাটি জানিয়ে দিয়েছিলাম। আমি আমেরিকা ও লন্ডনের কয়েকটা স্কুলে গিয়েছিলাম। প্যারেন্ট হিসেবেও স্কুলে গিয়েছি।কিন্তু সেখানকার ব্যবস্থা অন্য। আমার মন ভরেনি,তোমার স্কুলে যা দেখেছি,আর কোথাও তা দেখিনি,আমি সার্থক হয়েছি। প্রাণে জাগরণ তুলতে না পারলে-ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের সম্পূর্ণ বিকশিত করতে পারে না।তুমি একজন সফল শিক্ষয়িত্রী। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই জাগরণ সঞ্চার করেছ।
আমার এই স্মৃতি থেকে শিক্ষা যা পাই,তাকে কাজে লাগাতে অদ্যাবধি চেষ্টায় আছি। বিবিধ আচার-অনুষ্ঠানে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখা পেলেই এ গল্প করতে থাকি,আপনারা ওরকম করতে পারেন না? ও পারবো না কেন? কেবল একটা অসুবিধা,আমাদের স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রী অনেক বেশি।এত স্টুডেন্ট নিয়ে ভাল কিছু করা যায় না।কেউ কেউ এও বলেন, যা মা-বাপ আমাদের,অবুঝ একেবারে,নিজের বাচ্চা ভাল,এরা কখনও খারাপ হতে পারে না। যত খারাপ অন্যরা।
এরপর আমি তবুও বলি– চেষ্টা করেই দেখুন না ।
নিবেদন
উনিশ’শ আশিতে দেশ হৈ চৈ-তে ভরা। খালকাটা কর্মসূচি নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। তিনি স্বয়ং হাতে কোদাল ধরেছেন। টি.ভি খুললেই এই দৃশ্য। ইদানিং আমার স্বামী নাতনিদের হাত ধরে বসেন, টিভি দেখেন। একদিন খুব উত্তেজিত, আমাকে কাছে পেয়ে বেশ জোর গলায় বললেন। আমি এ রকম গ্রাম উন্নয়ন করতাম, তোমাদের পছন্দ হলো না। গ্রামের লোকও চাইল না। সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে আমাকে, তুমি কি ভুলে গিয়েছ? দেশের ভাল চাইতে নাই, চাইলে মরণ। এই ভালো লোকটিও মরবে।
দূর! এসব বলবে না। উনি মরবেন কেন! মরে আমাদের মতো লোক। আমার কথা কেড়ে নিলেন। আমি তোমাকে বলছি উনি মরবেন এবং সেই সাথে আমিও মরবো। কী বলিষ্ঠ কথা! আমি শিউরে উঠি, পাগল হয়ে গেল হঠাৎ? হাত ধরে মিনতি করি এরকম মরার কথা বলবে না, ভয় করছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এমন উদ্যোগী মানুষ মরবেন কেন! আর ওঁর সাথে তোমার কোনো মিল নেই। তোমার চিন্তা কেবল মরা নিয়ে, আমার খারাপ লাগে শুনতে। অফিসের এত খাটাখাটুনি করে কোথায় দু দণ্ড দুটো ভাল কথা শুনতে পাব—তা নয়—কেবল। অলক্ষুণে কথা। তুমি আবার আল্লাওয়ালা, আল্লাহর কানে না পৌছে যায়। দোহাই আর এরকম বলবে না।
আমি কাঁদো কাঁদো করে ওর দিকে তাকাই। শুকনো শরীর, কিন্তু মাথাভর্তি বাবরি চুল, তীক্ষ্ণ নাক, বড় বড় দুটো চোখ, মুখের গড়ন লম্বাটে, তাতে সামনের দাঁত দুটো ঝকমক করছে (জীবনে পান সিগারেট কিছুই খাননি)। সুন্দর করে হাসেন। একটু থু থু বেরিয়ে আসতেই হাতের রুমাল দিয়ে মুছে ফের আমাকে দেখলেন। বললেন– এর নাম সবুজ বিপ্লব। ছাত্র অবস্থায় আমরা কচুরিপানা তুলবার কাজ করেছিলাম গ্রামে, বাংলাদেশে গ্রাম হলো আসল স্থান। গ্রামে কত গিয়েছি, এখন শরীরের জন্য পারি না।
এর মধ্যে আমার বড় মেয়ে সাকী নিউইয়র্কের আবাস তুলে বাংলাদেশে ফিরে আসে। ওরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই গণস্বাস্থ্যে ডক্টর জাফরুল্লাহর সাথে কাজ করে। সাভারে থাকে। সিজান-সন্তলি দু’নাতি আমার কাছে। কোথাও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। ওরা নানার সাথে বেশি জমিয়ে নিল। সাকী তার পিতার শরীরের অবস্থা দেখে খুবই মন খারাপ করে। জামাতা ফরহাদও। তখন জার্মান থেকে এক অভিজ্ঞ ডাক্তার গণস্বাস্থ্য ভিজিট করতে আসেন, ফরহাদ তাকে নিয়ে আসে। সাথে আরও বাঙালি ডাক্তার। তারা রোগী দেখে বুঝতে পারছিল না, কি অসুখে রোগী এমন হলেন! হার্ট ভাল, ব্লড ঠিক আছে। শুধু হজমের গোলমালের জন্য এমন হয় না। আবার মানসিক রোগীও মনে হয় না। সব কথার ঠিক উত্তর দিয়ে গেলেন। ওরা তাকে খুব চিয়ার করে গেলেন, ইউ আর পারফেক্টলি অলরাইট, নো ট্রাবল, বি চিয়ার আপ। আপনার কোনো অসুখ নেই। অতঃপর আমাকে ডেকে বললেন, আপনি খুব ঘাবড়ে গেছেন, উনি এমন হলেন কবে থেকে? এসব রোগীর কিছু ঠিক নেই; অনেক দিন বাঁচেন, আবার কখন কি হয়! অসুখ হলে ভয় থাকে। আচ্ছা উনি কি খুব রাগী ছিলেন?কী চাকরি করতেন?কবে থেকে চাকরি নেই? নিজেকে Establish করতে পারেননি? এমন Withdrawn হয়ে গেলেন। কেন?
বিদেশী ডাক্তার। তাকে আমি আর কত বলবো! এদিকে ভয়ও আমার বেড়ে গেল। ভয়ার্ত গলায় বলেছি,উনি অত্যন্ত সাদাসিদা প্রকৃতির লোক,ন্যায় আর অন্যায় বলতে যা বোঝায়,তাই মেনে চলেন। অন্যদের মধ্যে অন্যায় দেখলে সহ্য করেন না। সারাজীবন ধরে এমন করে শেষে নিজকে গুটিয়ে নিলেন! আমি সংসার নিয়ে যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত এসেছি। আর পারি না!
আমি কান্না রাখতে পারলাম না। কেঁদেই বললাম,আমাকে কি করতে হবে? চেষ্টা-যত্ন কোনটার ত্রুটি করেছি? ভরা সংসারের প্রত্যেকে তাকে দেখে,সেবা করে। বিছানা নোংরা করলে ছেলেই পরিষ্কার করে,ঝি-চাকর দিয়ে করায় না। তবুও কেন এমন কষ্ট পাচ্ছেন উনি! ওকে কেউ তো অযত্ন করেনি। আমরা ওকে ভালবাসি।
আমার প্রশ্নের কে জবাব দেবে? চাকুরে মহিলা, তাকে ছেড়ে কাজে যেতে হয়, উৎকণ্ঠা নিয়ে সারাক্ষণ থাকি, আল্লাহকে ডাকতে থাকি, ওকে ভাল রাখো, সুস্থ রাখো। আর যদি কোনো কারণে অসুখে পড়ে, আমায় দূরে রেখো না আল্লাহ, ওর শয্যাপাশে রাখবে।
তখন স্বামীর শরীর ভালই। স্বভাবে একটা নির্ভরশীল ভাব। নিজের থেকে কিছু করবে না। আর আমার গায়ের শাল সবসময় নিজের গায়ে জড়িয়ে থাকতে দেখছি। খুলে তারটা পরাতে চাইলে দেয় না। আমি হাসি ‘এটা লাল, সবুজ আর শাদা ফুল তোলা মেয়েদের চাদর। তোমায় পরা দেখলে লোকে হাসবে। কোন ফল হল না। শেষে আর কি করবো। মেনে নিলাম আমি। যে মানুষটি সারাজীবন পৌরুষ দেখিয়ে এসেছে, তার বুঝি তাতেই এখন বিতৃষ্ণা!ভাল। জীবনের ঘটনা দ্রুত এগিয়ে চলছিল বুঝি, তা না হলে হঠাৎ করে এমন কড়া জ্বরে তিনি পড়লেন কেন? ডাক্তার রফিক তো ছিলেনই, তার সঙ্গে অন্য একজন স্পেশালিস্ট চিকিৎসা করলেন। তাদের আপ্রাণ চেষ্টায় দশ দিনের মাথায় জ্বর ছেড়ে গেল। কিন্তু শরীর শেষ। পিঠে আর কোমরের নিচে ‘বেডসোর’ লেগে গেল। সে ঘা সহজে শুকাচ্ছে না। ডাক্তার বলেন, ওপাশ করে শুতে আর হাঁটাহাঁটি করাতে। ভাত পথ্য দিলাম। জাউভাত, মাগুর মাছ আর আনাজ কলার ঝোল মেখে খাইয়ে দিই, বেশ পেট ভরে খেয়ে ঘুমান, নামাজ পড়েন শুয়ে শুয়ে মসজিদের ইমাম ওকে প্রায় দেখতে আসেন। সেদিন সুস্থ দেখে মসজিদে শোকরানা নামাজ ও মিলাদ পড়াতে বলে গেলেন। শুক্রবার ছিল। আমরা খুশিমনে তা পালন করি।
এদিকে তার একটি কথা যে আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছিল, সে তো সবার অজানা। দুদিন পর হঠাৎ জ্বর ফিরে এল। তখন আমি ভয় পাই। ভীষণ ভয়। রোগীর কথা না শুনে ডক্টর নূর ইসলামের চেম্বারে নেওয়ার ব্যবস্থা করে রাখি, পরের দিন বিকাল চারটায় অ্যাপোয়েনমেন্ট। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না। সেজন্য তারও ইচ্ছা ছিল না। আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল না। সে এক অলৌকিক ঘটনা। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে একসাথে মরণের কথা যে বলেছিলেন, আমরা গুরুত্ব দিইনি। তা অলক্ষ্যে সমাধান কেউ যেন আকস্মিক হস্তক্ষেপ করে এনে দিয়েছে ঘটনা এই, সকালে অফিসে গিয়ে শুনলাম চাটগা সার্কিট হাউজে প্রেসিডেন্ট নিহত, তাকে ঘাতকরা কোথায় যেন কবর দিয়েছে। জেনারেল মঞ্জুর ক্ষমতা নিতে গিয়ে নিজেও নিহত। জেনারেল এরশাদ প্রেসিডেন্টের মরদেহ ঢাকা এনেছেন। জনসাধারণকে দেখানোর জন্য টিভিতেও শোকযাত্রার অনুষ্ঠান চলছে।
আমার বুক থরথর বেগে কাঁপছে, ছেড়ে যাওয়া জ্বর ফিরে আসার কি কারণ তবে এই? এর মরণও কি আমাকে দেখতে হবে? ডাক্তারকে ফোন করি—রোগীর আবার জ্বর এল কেন? দেখে যান, ওষুধ কি দেবেন? ডাক্তার রফিক এলেন (উনি বাসার কাছে থাকেন)। নতুন একটা ওষুধ দিলেন, বললেন, দুর্বল শরীর। ঘাবড়াবেন না। বিকেল চারটায় আমি আসবো। ডক্টর ইসলামের কাছে তো অ্যাপোয়েনমেন্ট আছে। গায়ে জ্বর ছিল ৯৮.৬ । স্যুপ দিলাম, বড় কাপ। খেয়ে বেশ ভারি গলায় ডাকছেন, শায়ের তুই ঐখানে কেন, আয় আমার কাছে। আমি মাথায় হাত রাখি, তিনি প্রলাপ তো বকছেন না? জ্বর বাড়েনি। ইতিমধ্যে গা মুছে পরিষ্কার শার্ট, লুঙ্গি পরিয়েছে দুই ছেলে; বড় আর মেজ। শায়ের দেশে নেই। তাই আমি জিজ্ঞেস করি, ওর কথা কি খুব মনে পড়ছে? ওকে আসতে বলবো? আমার কথায় স্পষ্ট করে বলেন, আমি ভাবছিলাম; ও বুঝি বারান্দায় কথা বলছে। ওখানে তো শামীম বসা।
আমি বলি, ওদের দুজনের কণ্ঠস্বর এক। তবুও আমি শায়েরকে আসতে লিখে দেব। পরীক্ষা থাকলেও তোমার ছেলে, আমি জানি ছুটে চলে আসবে। ২রা জুন, সময় বুঝি নির্দিষ্ট করা থাকে; মানুষ তা দেখে না, বুঝতে পারে না। তা নাহলে আমি কেন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অতঃপর তিনি যে অন্তিম কথা বলতে শুরু করেন; আমার বুকে অনেক কষ্ট, সহ্য করতে পারছি না।
হাত বুলিয়ে দিই? কোথায় কষ্ট? আমার হাতখানা নিজেই টেনে নিয়ে বলেন,তোমাকে আমি সারাজীবন কষ্ট দিয়েছি, কেন দিলাম,এই কষ্ট ঠেলে উঠে আসছে; তুমি আমায় মাফ করে দাও। আমার চোখ ভিজে এলো, কেমন করে ভুলে বসেছিলাম এত এত দিন,আমার হাত তার অতি আদরের। তিনি তো এই কষ্টের মধ্যে ভোলেননি। কেঁদে বলেছি-আমি সাধারণ ঘরণী বৌ হয়ে থাকলেই ভাল ছিল।তোমার এমন কষ্ট হত না।আমাকে তুমি মাফ করে দাও। অতঃপর বলেন, আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলো ‘মাফ করে দিলাম। আমি তাই করলাম। তিনি শান্ত মনে চোখ বুজলেন।
আমি পাশের খাটের উপর বসে তাকিয়ে আছি। সেই চাদরখানা গায়ে, সোজা শুয়ে আছেন। মন মানলো না। উঠে এসে জিজ্ঞেস করি, একটু হরলিকস দেব? মাথা নেড়ে সায় দেয়ায় আমি চামচ কেটে মুখে দিলাম। বেশ খানিকটা খেলেন। ওষুধ খাওয়াতে এসেছে মেজ বৌ। সময় ধরে সে ওষুধ খাওয়ায়। ওষুধ খেয়ে চুপচাপ। ভাবলাম স্যুপ খাইয়ে দিলে ঘুমাবে। একটু অপেক্ষা করি, সবে তো খেয়েছে। হাতে কী একটা পত্রিকা নাড়ছি। হঠাৎ শান্ত মানুষটির দিকে চোখ পড়ে। তার বুক উঠানামা করছে কেন? কাছে আসতেই শুনি কলেমা পড়ছেন, মুখ জড়িয়ে আসছে, চিৎকার দিয়ে কাঁদি, ওরে তোরা এদিকে আয় আর জিয়ার লাশ দেখতে হবে না। আমাদের জন্য আল্লাহ কী রেখেছেন কপালে! আল্লাহ রহম কর! বাঁচিয়ে দাও এ যাত্রা… যাত্রা ছিল তাঁর শেষ কষ্ট। বড় ছেলের হাতে শেষ পানিটুকু খেয়ে চোখ বুঝলেন, তখন বিকেল পাঁচটা। তার ভাইঝি ডাক্তার কোহিনুর, বললো, ভাইজান সরে আসে। জেঠুর শরীর ঢেকে দিল সে। ডাক্তার রফিক চোখ মুছে বললেন, আলহাজ্ব শেখ সলিমউল্লাহ সাহেব বেহেস্তী মানুষ। আপনাদের কাউকে কষ্ট দিলেন না। ঈমানে আহসানে চলে গেলেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
রাত নয়টায় সেগুন কাঠের কফিনে শুইয়ে গাড়ি শোভাযাত্রাসহ তার। আরাধ্য নোয়াপুর পারিবারিক কবরস্থানের উদ্দেশ্যে আমরা রওয়ানা দিই। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। তবুও বৃষ্টিতে পড়লাম না। মনে হচ্ছিল, কেউ বুঝি মেঘ আগলে রেখেছে, বৃষ্টি ঝরাতে দেবে না। বিদ্যুৎ চমকিয়ে পথ দেখাচ্ছে। সুদীর্ঘ পথের এক অন্তিম যাত্রী তার প্রিয় গায়ের বাড়িতে পৌছুক তো আগে! নতুন মুন্সির হাট পর্যন্ত সেই বিখ্যাত গ্রান্ড ট্রাংক রোড (বর্তমানে পীচ ঢালা পাকা) তারপর কাঁচা রাস্তা। সামান্য বৃষ্টি তো মৃত্যুর ফাঁদ। লাশবাহী ট্রাক আনা যেত না। সকলের মুখে এক কথা, যদি বৃষ্টি হতো এরকম, নতুন মুন্সীর হাটে পড়ে। থাকতে হতো। আল্লাহর রহমত! লাশ তো বাড়ি আনা হল, দাফন করা যে বিপদ আনবে। এত বৃষ্টি কবর খোড়াই যাবে না। জানাজায়। লোকজনও আসবে না। খবর কে দেবে। উঠানে হাঁটু অবধি পানি। জমে রয়েছে। আরও বৃষ্টি বাড়লে ঘরে পর্যন্ত পানি উঠে যাবে। বড়ভাই-এর লাশ সামনে নিয়ে ছোট ভাই বকু মিঞা কোরান তেলাওয়াৎ করছিল! বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। আমাদের চোখেও তেমনি অফুরান পানি। হায় আল্লাহ-এখন কি করবো, বৃষ্টি থামিয়ে দাও।
সেই বৃষ্টি থামলো সকাল দশটায় এবং প্রখর রৌদ্র উঠে আধ ঘন্টার মধ্যে সব পানি শুকিয়ে নিলো। লোকজনে ভরে গেল উঠান। ‘বড় মিঞা নেই’—ভোর রাতে আযানের পূর্বে দীঘির কোণা থেকে কেউ যেন চিৎকার দিয়ে খবরটা জানিয়ে দিয়েছে। কে দিল? ঐ বৃষ্টির শব্দের মধ্যে কার আওয়াজে এত জোর ছিল? কেউ বলতে পারলো না। শেষে গ্রামবাসীর আর বুঝতে দেরি হয় না, এ কার আওয়াজ। আল্লাহ বড় মিঞাকে বড় ভালবাসেন। ফেরেস্তা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমিও খুঁজতে থাকি ঐ ছেলেটি কোথায়? ফেনী থেকে আমার পাশে বসে কেবল কলেমা শাহাদাৎ পড়ে যাচ্ছিল এবং সামনের লাশবাহী ট্রাক একটু জোরে চালালেই ড্রাইভারকে আস্তে চালাতে বলতো চিৎকার করে। লাশ ব্যথা পাবে ভাই, আস্তে চালান। ছেলেটাকে আপন আত্মীয় মনে করেছিলাম। কিন্তু তাকে কেউ চিনলো না। আমাদের কেউ নয় সে— পরে খোজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এখনও ঘটনাটি মনে হলে একটা বিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠে; ফেরেস্তা মানুষের রূপ ধরে আমাদের বিপদের ঐ পথটি পার করে দিয়েছে। মৃত্যুর পরও তিনি আমাদেরকে কষ্ট দিলেন না, এমনি ভালবাসতেন আমাদের! আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য ফেরেস্তা চেয়েছিলেন? কী জানি!
জানাজায় নেয়ার জন্য লাশ বাইরের দিকে নিয়ে যাওয়ার আগে বাড়ির মেয়েদের কাফনের বাঁধন খুলে একবার দেখিয়ে নিচ্ছিল,তাই আমাকে ধরে এনে সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেই আমার কান্না থমকে গেল; আমার দিকে এমন করে চেয়ে আছেন কেন? চোখ দুটো যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সেই গতকাল বিকেলে। বুক দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে উঠলো। অবিকল এ রকম করে জানালার শিক ধরে বাইরে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতেন, কখন আমি অফিস থেকে ঘরে ফিরবো। ভাবতে গেলাম, অনন্তকাল ধরে এ রকম চেয়ে থাকবেন। উঁহ! আমি এর প্রতিদানে কী করবো! কিন্তু মাথাটা ঘুরে উঠে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম,বড় জা টেনে নিয়ে আসেন। আসো বোন,তোমাকেও গোসল দেব।সোনা-রূপার পানিতে কলসি ভরে রেখেছি, একবার বিয়ের সাজন করেছিলে এভাবে। এখন তার উল্টো। গায়ের সব গহনা খুলে নিতে হয়, শাদা থান পরবে। কান্না থামাও। মুখে এই তিতা করলাটি চিবিয়ে নাও। তিতা খেলে শোক সইতে পারবে।
গ্রামের নিয়মে তৈরি হয়ে তসবি হাতে এসে বসলাম ঘরে, যেখানটায় লাশ রাখা ছিল। ঐ দিন সন্ধ্যায় চলে আসতে মন কেমন করছিল, মনে পড়ছিল তারুণ্যের এক স্মৃতি। দেশ বিভাগের পর কলকাতা ছেড়ে, ঢাকার চাকরি ছেড়ে তিনি গ্রামে থাকতে শুরু করেন, গ্রামের উন্নতি করবেন। আমি তার স্বপ্নে একমত ছিলাম না। লেখাপড়া করার জন্য মিথ্যা অজুহাত, মায়ের অসুখ দেখতে যাচ্ছি বলে তাকে ছেড়ে পালিয়ে এলাম। আজ তো পালিয়ে যেতে চাই না। সে নিজেই পালিয়ে গেল। আমাদের আর কষ্ট দিতে চায়নি। নতুন মাটি দেওয়া কবরটি যতদূর থেকে দেখা যায়—ঐ বড় রাস্তায় উঠা পর্যন্ত। আমাদের সেই দেখার শেষ ছিল না।
ঢাকায় ফিরে এসে আবার কান্নার রোল, বড় ফাঁকা করে দিয়ে গেছেন, এ ঘর ছেড়ে বহুদিন তিনি বাইরে যাননি। কোন বাড়ি থেকে রাতের খাবার পাঠিয়েছে, সব পড়ে রইল, কারও মুখে অন্ন ওঠেনি। ক্লান্ত অবসন্ন যে যার হালে। আমার ভীষণ জ্বালা। বুকের ভেতর পুড়ে যাচ্ছে। কেবল বরফের পানি গিলছি। তবুও জ্বালা শীতল হয় না। বেশি কাঁদতে পারিনি তাই বুঝি ! একটা কথা বার বার মনে হচ্ছিল, আমার বডিগার্ড চলে গেল! কতভাবে আমাকে রক্ষা করেছেন। এখন কী হবে?
তখনও বুঝিনি কেন আমার এত জ্বালাপোড়া! মধ্যের ঘরে খালি। মেঝেতে কেবল গড়াগড়ি খাচ্ছি; চোখ বন্ধ করলে স্মৃতি এসে ভিড় করে। তাই ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ টেলিফোন ঝনঝনিয়ে উঠল, মধ্যরাত শেষ। এও কী সম্ভব? পরপার থেকে ফোন করছেন?পড়িমরি করে ফোন ধরেছি, তো শুনলাম ছোটছেলের গলা। মা আমাকে তোমরা জানালে না কেন? খবর দিলে না কেন? কান্নায় আর কথা বলতে পারে না শায়ের। আমিও সমানে কাঁদছি, ‘তুই খবর পেলি কী করে? তোকে তো উনি সকাল বেলায় কাছে ডাকলেন, কথা বলতে চেয়েছিলেন। এভাবে তোর জানা হয়ে গেল? অপরাধ নিস না বাপ, ভেবেছি একা এ শোক সইতে পারবি না। বিদেশে তোকে কে দেখতো, সান্ত্বনা দিত? ধীরে সুস্থে আমি চিঠিতে সবিস্তারে তোকে জানাতাম। অপরপ্রান্ত থেকে ছেলের হু হু কান্না! বললাম, এ জন্যই বলতে চাইনি।উনি হঠাৎ করে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বেশি খারাপ অবস্থা দেখলে অবশ্যই তোকে ফোন করতাম। শেষে ছেলের কান্নাভেজা কথা জানালে ভাল করতে মা। অন্যের মুখ থেকে শুনলাম। নাজমা আপাকে কোহিনুর আপা একটু আগে খবর দিয়েছেন। উনি আমাকে ফোনে জানিয়েছেন। ফোনে কথা বলার সময় আমি এক দৃশ্য দেখিনি, কিন্তু সাকী দেখেছিল, একটা বড় আকারের প্রজাপতি আমার ঘরের দেয়ালে বার বার এসে বসেছিল। সাত সমুদ্রের পানি ঢেলেও আমি গায়ের জ্বালা-পোড়া নেভাতে পারলাম না। দুটি আত্মা (বাপ ও ছেলে) গভীর তৃষ্ণা নিয়ে ছটফট করেছিল, আমি ভুল করেছি, শায়েরকে খবর দিইনি। সেই জ্বালা আমাকে পোড়াচ্ছে। শোক যত কঠিন হোক,আঘাত যত তীব্র হোক, প্রিয়জনদের সে খবর দিতে হয়। মৃত্যু তো অনিশ্চিত,কখন এসে শিয়রে দাঁড়ায় কেউ তা বলতে পারে না।সেই দুর্লঙ্ঘ নিয়মকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। তার উপর অন্য কোনো কথা হয় না। আমার সেই ভুল আমাকে আজীবন সেই দিনের কষ্টের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মেজ মেয়ে রাখীকেও খবর দিইনি। সেই একই চিন্তা ছিল। ভুল চিন্তা।ও বেচারীকে কেউ জানায়নি। পরে শায়েরের ফোন পেয়ে শিক্ষা পেলাম। ওকে ফোন করে দিলাম। ওর হাত থেকে ফোন পড়ে যায়, ওর স্বামী পাশে ছিল বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল।
জীবন তো থেমে নেই
আমাকে ঘিরে বিরাট সংসার। আগেও ছিল। এখন তফাৎ হল ঘরের। মানুষটি যিনি সর্বক্ষণ ঘরে থাকতেন, শুয়ে-বসে-হেঁটে চলতেন, তিনি নেই। শূন্য-ফাঁকা সে অংশ। বেডরুম বদলিয়ে নিলাম। না হলে পাগল পাগল লাগতো আমার, এই বুঝি ডাকছে, চেয়ে আছে আমার দিকে। আমার দিকে ছেলেমেয়েরাও তাকাতে পারতো না। চোখের পানি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিত। শাদা থান পরে কেন মা! চোখে সয়না একটু। আমিও চাকুরে। চল্লিশ দিন এভাবে চলার পর মন শক্ত করি। বাহ্যিক শো করার মধ্যে আমি আর থাকি কেন! অন্তরের জিনিস কেউ তো কেড়ে নেয়নি! ভরাঘর, নাতিপুতি, চল্লিশ বছরের সংসার আমার সবই তো রেখে গিয়েছেন। অপরদিকে কর্মস্থল। সেখানে আমি ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো এবং ঝোলের লাউ, অম্বলের কদু। যত বিদঘুটে এবং আজেবাজে কাজ স্তুপ হয়ে আছে; সব ক্লিয়ার করতে হবে এই আমাকেই। এর মধ্যে আরেক ঝুট ঝামেলায় পড়ি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে বদলি হয়ে আসতে হয়। আগের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাহেব ছাড়ছেন না। শিক্ষাসচিব আমায় তলব করেন। আচ্ছা, আপনি প্রাইমারির এত কী জানেন যে আপনি না এলে এটা চলবে না? বুঝতে অসুবিধা হল না, এ আমার বিরুদ্ধে সাংঘাতিক অভিযোগের কারণ। প্রাইমারির ডিজি ডক্টর হাফেজ আমাকে আনছেন কেন তার উত্তর চান তিনি। আমি সাতঘাটের পোড়-খাওয়া মেয়ে, প্রতি পদে শুনতে পেতাম, পোড়ে নারী! ওড়ে ছাই, তবে নারীর বিশ্বাস পাই। পঞ্চাশ পেরিয়ে এসেছি তো হয়েছে কী! মরে গেলে এসব চুকেবুকে যেত। চরিত্র নেই বলে উড়োচিঠি পড়তো না। যা হোক মুখে হাসি অক্ষুন্ন রেখে কাজি জালালকে বললাম, প্রাইমারি শিক্ষার ক্ষেত্রে আমার যা আছে বহু বিদ্বান ব্যক্তিত্বের তা নেই, তার প্রমাণ আমি নিজে। উনিশ’শ আটচল্লিশ সালে আমি ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স পর্যন্ত একটি মিডল ইংলিশ স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হই। ছাত্রী নেই,শিক্ষক নেই।একহাতে ঐ। স্কুলকে দাঁড় করিয়ে এসেছি। অভিজ্ঞতার দাম দেবেন তো! বাঙালি জাতির উড়োচিঠি লেখার হাত আজকের নয়, চিরকালের। শরৎ বাবুর উপন্যাস পড়লে বুঝতেন।
এক বিপদ বুঝি আরেক বিপদ ডেকে আনে। একটা কাটিয়ে উঠছি তো, একশ বিশটা বেসরকারী প্রাইমারি স্কুল সরকারী করার কাজটি ঘাড়ে পড়লো। প্রতি ইউনিয়নে একটা দিতে হবে কিনা জানতে চাওয়া বড় অন্যায়!সে আপনি জানেন। কিন্তু কার জন্য কয়টা দেব-সে রকম লিস্টও হাতে ধরিয়ে দিলেন উপরের কর্তাব্যক্তি। উনি কি ইচ্ছা করে আমাকে আগুনে ফেলে দিলেন? বাঁচবো কী উপায়ে? সেবারেও লোভ আর লালসার মধ্যে এমন ঠেলে ফেলে দিলেও আমি কিন্তু অক্ষত বেরিয়ে আসতে পারি।আমাকে যে ঐ খোলা দুটো চোখ ভালবাসায় মাখিয়ে দিয়েছে। সেই আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। কী কী । প্রলোভন শুনতাম ? এইগুলো- “ম্যাডাম আপনি তো এখনও বাড়ি করতে পারলেন না, চাকরি তো শেষ। ঠিকানা একটা থাকা তো চাই। এখনই সময়,আপনি টের পেলেন না। যা করার ওদিক দিয়ে হয়ে যাবে।কেবল আমার কাজটি আপনি একটু দেখবেন”। আমি অবশ্যই দেখবো। আমার কাজই এই। কিন্তু আমার সম্পর্কে আপনারা তো জানেন না; আমার সাত সাতটা বাড়ি আছে, দেশেও আছে। বিদেশে তো আছেই। একা মানুষের আর কত চাই? রিটায়ার করে চিরস্থায়ী ঠিকানা কোথায় সে আমার ভবিতব্য।
হেঁ হেঁ করতে করতে ঐ স্বার্থান্বেষী মহল অন্য পথ ধরে,কুচক্রের দুষ্টবুদ্ধি থামে না। একদিন রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হচ্ছি, বড় সাহেব ডাকছেন। আরে পায়ে ঠেকলো কী? পেট মোটা এক মানিব্যাগ। ওরা ভেবেছিল আমি জানি না। প্রশাসনিক অফিসারকে ডেকে বলে দিলাম ব্যবস্থা নিতে। রমনা থানায় পুলিশ অফিসারকে অবশেষে কেস করার জন্য দিতে হলো, নাম ঠিকানা তো ভেতরে ছিলই। একজন রসিক ব্যক্তি আমাকে শুনিয়ে রবি ঠাকুরের ‘গুপ্তধন’ থেকে কোটেশন আবৃত্তি করলেন; “পায়ে ধরে সাধা, রা নাহি দেয় রাধা’। অতঃপর ওদের থেকে ধাতানি শুনি—শিক্ষা দেওন দরকার। বদলি কইরা দিলে তয় বুঝবো মেয়েছেইলা।
আমি যে এদিকে ‘হু কেয়ার্স’ গোছের অফিসার। কোমর বেঁধে বস্তাবন্দি ইন্সপেকশন রিপোর্টগুলো ঘাঁটতে লেগে যাই, কোন্ ইউনিয়নে স্কুল নেই খুঁজে বের করি, ঘরে ফিরতে দেরি হয়, হোক। একজন মানুষ যে থাকতো জানালার শিক ধরে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, সে এখনও দেখছে আমি ন্যায়ের জন্য খেটে যাচ্ছি। একশ বিশটা স্কুলের জন্য আমি যদি এলাকা খুঁজে পাই, যেখানে শিশুরা কাছাকাছি স্কুল পাবে, কষ্ট করে অনেক দূর হেঁটে যেতে হবে না; তার চেয়ে ভাল কাজ আমার জীবনে আর কী হতে পারে? আমি পেরেছিলাম সেই কাজটি সুন্দর এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে।কেউ ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। সেই উনিশ’শ বিরাশি সালের কথা। প্রতি বছর স্কুল দশ-পাঁচটা সরকারী হয়েছে,কিন্তু সেগুলো প্লানিং থেকে হয়েছে।আমার প্রশাসনে ছিল না।সেগুলো নিয়ে টানা-হাচড়া হতে শুনতাম, সুনামও ছিল না। কলেজের অধ্যাপনা থেকে সোজা এসব কাজে আসার অভিজ্ঞতা না থাকলে যা হয়। আমার তো ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা,তার সাথে রয়েছে নিজের হাতে করা এবং অমানুষিক পরিশ্রমে গড়া সক্ষমতা।
কাজের লোকদের মূল্য দেওয়ার স্বভাব যদিও বাঙালিদের থেকে ক্রমে ক্রমে উবে যাচ্ছে, একথা আমার ক্ষেত্রে একটু যেন অন্যরকম ঘটে গেল। অবসর নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, বাধ সাধলেন অনেকেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কী সুন্দর এক সার সংক্ষেপ যাচ্ছে প্রেসিডেন্টের কাছে, আরও দুবছর যেন আমাকে চাকরিতে রাখা হয়। আজীবন শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবী, অক্লান্ত সংগ্রামী চেতনার… এসব প্রশংসা লেখা সার সংক্ষেপটি আমাকে দেখালেন ডেপুটি সেক্রেটারি আহমদ হোসেন। কান্না এসে গেল। চোখ মুছে নিয়ে বললাম, আপনারা আমাকে এত মূল্য এত পাওয়া দেবেন,জীবনে! কী বলে ধন্যবাদ দেব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কথা হলো; আমাকে তো প্রশংসা করেছেন, তার মধ্যে গভীর বেদনা লুকিয়ে রয়েছে, আমার জীবন আর চাকরি ভিন্ন করে আমি কোনোদিন দেখিনি। এদিকে আমার স্বামী আমাকে অফিসে চাকরি করতে দিতে চাইতেন না। প্রায় প্রত্যহ ঝগড়া করে ঘর থেকে বের হতাম। অতঃপর অভিমান করে তিনি আমাদের ছেড়ে আগে চলে গেলেন। এবার তার ছেলেমেয়েদের দাবি, আমি নিরুপায়। রেহাই চাই।
ঘটা করে ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান হলো আমার। শাড়ি, গহনা, জায়নামাজ, তসবি হাত পেতে নিলাম। গলায় গোলাপের মালা, এমন শ্রদ্ধা আর ভালবাসা! অশ্রু ভিজিয়ে নিয়েছি। কেউ একজন প্রশ্ন করেন, আপা সারাজীবন তো চাকরি করলেন, বসে থাকতে কি পারবেন? কী করবেন? জায়নামাজ দেখিয়ে বললাম, এক জীবন শেষ করেছি, এখন অন্যজীবনের জন্য কাজ করবো। ফাঁকে ফাঁকে আপনাদের হাসিকান্না, দুঃখ-সুখের কথা লিখে বই প্রকাশ করবো। ঐ বই পড়ে ভাববেন ওর মধ্যে আপনিও একজন। (অযুত পাঠশালা লিখেছি) খুশি? আমার আজও ভাল লাগে শিক্ষাভবনের সামনে দাঁড়াতে। মুখ চিনি, নাম ভুলে গিয়েছি এমন কত লোকজন ছুটে আসে, সালাম করে। আমায় চিনতে পারেন– জিজ্ঞেস করেন। আপনি আমার জন্য … আমি ওদের কৃতাঞ্জলি গ্রহণ করি।
সেবার অবসর নিয়ে আমেরিকায় যদিও ছুটে গেলাম, থাকলাম মাত্র ছয়মাস। চলে আসলাম ঢাকা ইউনেস্কো থেকে আমাকে কনসালটেন্ট করে চিঠি দিয়েছে, ডেভেলপমেন্ট নিয়ে গবেষণামূলক কাজ। এসবই আমার পছন্দের, কাজ করলাম গ্রামে-গঞ্জের স্কুলে গিয়ে, মিশলাম টিচারদের সঙ্গে অতি অন্তরঙ্গ হয়ে; প্রশাসনের মেয়েরা ছুটে আসতো আমায় দেখলে; আপা আপনারা ইন্সপেকশনে আসেন না কেন? আমাদের সব কথা তো পুরুষদের বলতে পারি না। জানেন আপা, ছেলেরা সাইকেল পায়, আমাদের কোনো সাইকেল দেয় না। ভ্রমণ ভাতাও তুলতে পারি না। আমি হেসে বলি, পৃথিবীর তাবত ছেলেরা সাইকেল চড়া যেদিন ছেড়ে দেবে, সেদিন তোমরা পাবে। ওরা থামে, না, বলে, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মেয়েরা সাইকেল চড়ে, যত মানা শিক্ষার বেলায়; এখানকার শিক্ষার ভাল কেউ চায় না। যাতায়াতের কষ্টে আমরা অনেক সময় সুপারভিশনে যেতে পারি না। এটা কার ক্ষতি? মেয়েরা আরও বলেছিল এক লজ্জার কথা। পুরুষরা বাইরে প্রস্রাব করতে বসে যায়। আমরা যাই কোথায়? আশেপাশে কার বাড়ি আছে খুঁজি। দালান ওঠে স্কুলে, এই সাধারণ কথাটা কেউ ভাবে না কেন?
ক্লাসরুমে কারও হাতে দেখেছি বেত, কারও মুখে মমতা মাখা মৃদু হাসি। স্নেহ ঢেলে যত্ন নিয়ে পড়াচ্ছেন যিনি, সেখানে ছাত্রছাত্রীরাও প্রাণচঞ্চল, কী যে ভাল লেগেছিল, নিজের স্কুলের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে সে মুহূর্তে। আমার কাজ ছিল সুপারিশমালা তৈরি। এসব কাজ স্বচ্ছ ও নিখুঁত হওয়া চাই। করেছি। তারপর জানি না, আমার অরণ্যে রোদন। তবে যা শুনি, বেশ তোড়জোড় করে শিক্ষক ও পরিদর্শক ট্রেনিং চালু হয়েছে।
এসব মামুলি কথা রেখে কাজ করতে গিয়ে প্রাইমারির উঠানে আমি যে সোনার হরিণ দেখেছি—তার খবর একটু তুলে ধরবো। এই পাকা দালানগুলো ধানক্ষেত আর কুঁড়ে ঘরগুলোর মধ্যে বড় খটখটা লাগে চোখে। ছেলেমেয়েদেরও লাগে— তা না হলে ওরা নিশ্চয়ই স্কুলের মাঠে নিজেদের ভাঙ্গা ঘরগুলো থেকে উড়ে এসে জুড়ে দাঁড়াতো। আমরা ওদের বিলাসী করে তুলতে চাই। ওরা পেছনে তাকায়, দেখে। জীর্ণ-শীর্ণ সেখানটায়। কোনটা ওদের স্থান? বুঝতে পারে না। গ্রামের সমাজ এবং অর্থনৈতিক অবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমরা বিত্তবানদের অনুকরণ করি। কিন্তু তাদের দেশের মত মাস্টার্স ও পি.এইচ.ডি শিক্ষক দেই না। তেমন বেতন দিই না। আই. এ পাস শিক্ষক আর নিম্নমান সহকারীর বেতন, আবার পিয়ন- চাপরাশির গ্রেডের বেতনও দিই। শিক্ষার হার বাড়বে এবং শিক্ষার মান বাড়বে—এমনই দুর্লভ কত প্রত্যাশা করে বিদেশী ঋণ নেই। দালান ঘর বানাই, প্রতিবার মেরামত করি …।
ঝড় তুফানের দেশ … সব দিক তো দেখতে হবে। কিন্তু ঝড় তুফান হয় যে সব জায়গায় সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান আমি পেয়েছি। গরিবরা দালান তো নয়, এমন কি রিলিফের টিনও চায় না। ওদের মতে খড়ের মজবুত ছাউনি ঘর ভাল, ঝড়ে উড়িয়ে নেয় না। ফুটোফাটা দালানের মত ধসে পড়ে না। জোর করে টিন দিলে তারা জোতদারের কাছে নামমাত্র মূল্যে বেচে দেয়। শ্রেণীবিভাগ ধনী-দরিদ্র তবে কি আমরা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছি না?
স্কুল বাড়ি তো এই, এবার ইংরেজি শেখানোর ধুম! বিদেশ যাবে সন্তানেরা। হায় বাঙালি! নিজের ভাষায় উচ্চারণ আর বানান শিখতে বাছার কয়েক গ্যালন থু বেরোয় তাকে আমরা ইংরেজি শেখাই। ক্লাস ফাইভের ঝরে যাওয়া সংখ্যা নিয়ে কী উপায়! যে বয়সের ছেলেরা ফাইভে পড়বে ওদের পড়ার আগ্রহ যে থাকে না। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যোগ্যতা একটি বড় ফ্যাক্টর। ওদের বয়সে এমন আত্মসম্মান থাকে বেশ টনটনে। এই ক্লাসটি হাইস্কুলের শুরুতে ঢুকিয়ে দিলে লোকশানটা কোথায়, এই পড়ুয়ারা মনের আনন্দে হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী হবে। বি.এ. বি.এড টিচারদের কাছ থেকে পড়ার সুযোগ পাবে।
হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী হওয়ার আশায় ক্লাস ফোর থেকে ওদের মধ্যে পড়ায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা আপনা থেকেই এসে যাবে। ‘Three R’ শেখার জন্য ক্লাস ফোর পর্যন্ত একটা স্টেপ যদি স্থির করি, দু ধরনের লাভ পাওয়া যাবে। ক্লাস ফাইভের ড্রপ আউট ঝামেলা নিয়ে এক দিকে মাথা ঘামানো বাদ। অপরদিকে ভাল করে লেখন, পড়ন, শিক্ষা ও হিসেব শেখার দিকে বেশি মন লাগানো হবে। শিক্ষক সমস্যা একটি বড় সমস্যা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি স্কুলে শিক্ষক থাকেন প্রয়োজনের অনুপাতে কম। তা অবশ্যই শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। শিশুরা যা চায়, আপনাতেই তা ফুটে ওঠে না, তাকে ফুটিয়ে তুলতে হয়, বিকশিত করে তুলতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক থাকা এত দরকার। গ্রামের আর্থসামাজিক চিত্র পর্যালোচনা যদি করি— দেখবো ক্লাস ফোর, এই চতুর্থ শ্রেণীর বেশি প্রয়োজন থাকে না।
এ আমার নিজস্ব ভাবনা চিন্তা। প্রাইমারি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিস্তারিত কাজ করতে পেরেছি। কিছু বাস্তব চিন্তা তো আসবেই। মনে হয়েছে, বিদেশের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল থেকে আমরা পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছি। কঠিন শ্রম দিলে, ধৈর্যশীল হতে পারলে আমরা নিজেরা দেশকে আত্মনির্ভরশীল করতে পারি। একটা বাস্তব কর্মসূচী তো হাতে থাকা চাই।
ধনী দেশগুলোতেও এতখানি দেখা যায় না। আমরা করছি কী,‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতাং পিবেৎ’। ঋণ করে পাকা দালানকোঠা তুলছি স্কুলের জন্যে। গরিব মা-বাবার সন্তানরা স্কুলঘরকে নিজের ভাবতে পারে না। মনে করে বড়লোকদের জায়গায় বুঝি পড়তে এল। পড়ালেখা পোশাকী হয়ে যায়, বাড়তি ঝামেলা ভেবে একদিন ঝেড়ে ফেলতেও দেরি করে না। অনাবশ্যক চাকচিক্য এনে শিক্ষা বিস্তারের মূল উদ্দেশ্যকে এভাবে গৌন করার প্রতিবাদ আমি একটি ইউনেস্কো প্রতিবেদনে লিখেছিলাম। কিন্তু সেটা পরে বাদ দিয়ে অন্যভাবে লিখতে হয়েছিল। আমি জীবনে ঋণ করে ঘি খাইনি কোনদিন, অপচয় যাতে না হয় সেদিকে সতর্ক থেকেছি। সেই দৃষ্টিতে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে দেখতে চেয়েছি। ভেবেছি প্রতিষ্ঠান থেকে মানুষ বড়। এই মানুষকে অবশ্যই শিক্ষিত করা প্রয়োজন। কবে আমাদের দরিদ্র জনগণ নিখরচায় ছেলেমেয়ের প্রত্যেককে ন্যূনতম শিক্ষা-হাইস্কুল পর্যন্ত পড়াবার সুযোগ পাবে? দেশের সার্বিক উন্নতির জন্যে এর কোনো বিকল্প নেই।
পরিশিষ্ট
জীবনের অসমান এবং খাড়া উৎরাই পার হওয়ার সময় আমার হাতে, কোলে, পিঠে ছিল সন্তানেরা। ওদের কোমল শরীরে, নরম মনে দুঃখ-কষ্টের আঁচড় তো হরহামেশাই লেগেছিল। ফলে তাদেরকেও ছোটবয়স থেকেই লড়াই করতে হয়েছে। মায়ের যত্ন, আদর দেবার সময় কম। তো ভাইবোনেরা পরস্পর সে ঘাটতি ভরিয়ে নিয়েছে, অভাব-অনটনকে গায়ে মাখেনি। হাসি গানে মুখর রয়েছে। লেখাপড়ার বেলাতেও সেই সমান সহযোগী ছিল তারা। ভাইবোন একজন ভাল হয়ে অনুজদের সেই পথে চলতে দেখিয়েছে। বাপকে খুশি রাখার জন্য সব সময় তার মন যুগিয়ে চলতে চেষ্টা করেছে। তিনি উগ্র মেজাজ করলে স্পোর্টসম্যানলি নিয়েছে। এতে আমার লাভ, ওরা আমাকে শান্তি দিয়েছে।
জন্মেই আমি কেঁদেছিলাম। সুকান্ত বলেছেন, পৃথিবীতে শিশুর এ কান্না তার অধিকার ঘোষণা। আমার জন্য এ নিদারুণ সত্য। নদী যেমন পাথর কেটে, মাটি ভেঙ্গে, একে বেঁকে নিজের কঠিন চলাকে সুজলা করে, আমিও যে তেমন। এক পা এগিয়েছি, ঐ গতিতে বাধা, নিষেধ এলো। ঝড়ো সাহসে ভর করে, দুটো পা বাড়িয়ে দিয়েছি। নিজের সাধ-আহ্লাদ পূরণের জন্য নয় সেটি।
স্বামীর সেই আক্ষেপ, “আমাকে আল্লাহ মেয়ে, তোমাকে ছেলে করে পাঠালেই পারতেন’’- আসলে তার অধিকার আমি হরণ করেছি সেটা ভেবেই কষ্ট পেতেন তিনি। কিন্তু আমি উপার্জনশীল হয়েছি। নারী হয়ে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার কেড়ে নিইনি। সমান অবস্থা নিয়েছি। এই ছিল সংগ্রাম।
স্বামীদের আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার ভরণ-পোষণের জন্যে। বেশি বাড়াবাড়ি করবে না, আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। এ ধরনের উক্তি তো ছিলই। তবে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত আমি করি, মূর্খতা, দারিদ্র, এগুলোর সঙ্গে লড়াই করার কথাকে সেখানে জিহাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একজন বিশ্বাসী এবং ভাল মুসলমান যা করে, আমিও তা করেছি। আমার বিশ্বাসের এই চাবিকাঠি শক্ত হাতে ধরা ছিল।
তো জীবন মানুষের একটাই। এক বস্ত্রে, ছা-পোষা মেয়ে লোকটা মোটে তো ম্যাট্রিক পাস। এত তড়পায় কেন? এক সময় যারা এসব বলে আমায় নাক উঁচিয়েছিলেন, তাদের কেউ এখন দেখলে চোখ বড় করে বলেন, কে, সালেহা! বেশ ভালোই তো আছ। মানুষের সব দিন সমান যায় না। একরাশ পুষ্পের হাসি ওদের জন্য; শত্রুতায় তারা এতটুকুও ব্যর্থ হননি।
জীবনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে স্বরূপে দেখি— একটা নদী, তার নাম মেঘনা। তিরিশ দশকের হয়ে যাই আমি। সূর্য ওঠা ভোরে কুলভাঙ্গা চরের বালুতে কুড়িয়ে যাচ্ছি কড়ি আর চুড়ি ভাঙ্গা। ফ্রকে তুলে রাখছি। এক সময় ঢেউয়ের মধ্যে ছুঁড়ে দেখতে থাকি—কতদূর গেল। অমাবস্যা আর পূর্ণিমার ঢেউ মেঘনাকে দুর্দান্ত করে—আমি অস্থির হই।
মানুষ শেষ জীবনে পুরোনো জায়গায় ফিরে যেতে চায়। বড় অবাক লাগে! সেই মেঘনার ভাঙ্গন আর বিশাল বালুচরের গড়ন আমায় এক নদীর জীবন দিয়ে গেল।
শেষ।
আমার এক নদীর জীবন (সপ্তম পর্ব)
আমার এক নদীর জীবন (পঞ্চম পর্ব)
আমার এক নদীর জীবন (চতুর্থ পর্ব)
আমার এক নদীর জীবন (তৃতীয় পর্ব)
আমার এক নদীর জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)
আমার এক নদীর জীবন (প্রথম পর্ব)
রওশন সালেহা
রওশন সালেহার জন্ম নোয়াখালী, ১৯২৯ সালী ১ জুলাই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় ম্যাট্রিক ও আইএ পড়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিএ পড়বার সময় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৈরুতে আমেরিকান ইউনির্ভাসিটি থেকে শিক্ষা প্রশাসন (UNESCO), দিল্লী এবং ব্যাংকক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে ডিডিপিআই পদমর্যাদায় অবসর নেন। তাঁর প্রবল সাহিত্য অনুরাগের জন্য তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘আমার এক নদীর জীবন’ প্রকাশিত হবার পর আত্মজৈবনিক সাহিত্য তিনি শক্ত স্থান দখল করে নেন। ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত।