আজ বৃহস্পতিবার, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ছোটমানুষের গপ্পো

গদ্য সাহিত্য

।। অরূপশঙ্কর মৈত্র।।

“বাংলায় দুই পৃথিবীর যে দূরত্ব তা সারা বিশ্বে আর কোথাও নেই। বাংলা এই ব্যাপারে ইউনিক। ডাইকোটমি, ডায়ালেকটিক্স, যাই বলি, আসল কথা ডাই, মানে বাইনারি। গরিব বড়লোক, এলিট সাব অল্টার্ন, সাদা কালো, শিক্ষিত অশিক্ষিত, শোষক শোষিত, এসব সারা পৃথিবী জুড়েই আছে। সাদা কালো ছাড়া বাকিগুলোর মধ্যে কিন্তু মোবিলিটি আছে। বাংলায় নেই। তাই এখানকার দুই পরস্পর অপরিচিত পৃথিবীকে বলা যাক, ভদ্রলোক ছোটলোক পৃথিবী। বাইনারির এই নামকরণ ভদ্রলোকদের করা। ছোটলোক শব্দে কারও খারাপ লাগতে পারে। ‘আমরা-ওরা’ও চলতে পারে।”

ছোটমানুষের গপ্পো

দুই পৃথিবী। একে অপরকে চেনে কিন্তু কেউ কাউকে জানে না। চেনা আর জানা এক নয়। পাশের বাড়ির লোকটাকে চিনি। দেখা হলে কথা হয়। কিন্তু জানি কি? যদি ভৌগলিকভাবে এই দুই পৃথিবী আলাদা হয়, তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে। এই যেমন কলকাতার ট্যুরিস্টরা আন্দামানে গেলে একবার জারোয়া কিম্বা ওঙ্গিদের এলাকায় যায়। জারোয়া পৃথিবীর আদিম উপজাতি। এই আদিম আর উপ বিশেষণ অবশ্য আমাদের দেওয়া। আমরা বলতে ‘আমরা’। ‘ওরা’ নয়। ওরা আদিম। আদিম তো সেই অর্থে আমরা সবাই। এখন যদি ধরা যাক এমন হয়, দুই ভিন্ন পৃথিবী ভৌগলিকভাবে একই মাটিতে ফিজিক্যালি মিলেমিশে আছে, অথচ কেউ কাউকে জানে না! চেনে কিন্তু জানে না! আপাতভাবে মনে হয় এ অসম্ভব। না, সম্ভব। ঠিক এই অদ্ভুত ঘটনাই সম্ভব হয়েছে আমাদের বাংলায়। বাংলা বলতে আমি সমগ্র বাংলা বলছি। যেখানে বাঙালির বসবাস। অবশ্যই ঐতিহাসিক পরম্পরায়। ধরুন কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে গেলাম। সেখানে একদল আদিবাসিদের দেখলাম, তাদের আমরা চিনি, কিন্তু জানি না। তাদের নৃত্যগীত আমরা মোবাইলে ভিডিও করতে পারি, সেটা কিন্তু তাদের জানা হলো না। সুন্দরবনের গভীরে গেলাম। একটা গ্রাম। সেখানে গাজী কিম্বা ফকিরি শুনলাম, বনবিবির গান শুনলাম, মোবাইলে রেকর্ডও করলাম। গাজী, ফকির, বনবিবি, সবাইকে ‘আমরা’ চিনি, কিন্তু জানিনা। তবু এগুলোতে একটা ভৌগলিক দূরত্ব আছে। কিন্তু খোদ কলকাতাতেই? হ্যাঁ, খোদ কলকাতাতেই মিলেমিশে আছে দুই ভিন্ন পৃথিবী। একে অপরকে চিনি কিন্তু জানি না। আমি জানি আমি এই কথাগুলো বলছি এই দুই পৃথিবীর একদিকের বাসিন্দাদের সঙ্গে। তাই, ধরুন, একদিন আপনি, আপনাকে আমি চিনি, জানিও, আপনি সোদপুরে আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতায় নন্দনে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একটি বিলিতি সিনেমা দেখতে এলেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অটো ধরে স্টেশন। দমদমে নেমে মেট্রো ধরে নামলেন রবীন্দ্রসদনে। তারপর হেঁটে নন্দন। এই জার্নিতে আপনার নজরে অনেক মানুষ পরবে। সবাইকে কি নজরে পরবে? বোধহয় না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নি সবাইকে নজরে এল, দেখবেন যাদের আপনি জানেন না তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অসংখ্য অটোওয়ালা, দোকানদার, স্টেশনে ঢোকার মুখে তরিতরকারির ডালা নিয়ে বসে থাকা বৌগুলো, ভিখারি, হকার। স্টেশনে হস্তরেখাবিদের আসন। তার সামনে হাটুর ওপর কাপড় তুলে মাথায় ঘোমটা দেওয়া একটা গেঁয়ো বৌ হাত দেখাচ্ছে। নন্দনের গেটের মুখে একটা মাঝবয়সসী লোক একগুচ্ছ বাঁশি নিয়ে আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে, এদের সবাইকে আপনি চেনেন, কিন্তু জানেন না। বাড়ি থেকে বেরোনর পর, রাস্তায় অনেক বেড়াল, কুকুর, ছাগল অথবা গাছের ডালে পাখিও ছিল, নজরে পরে না। কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পাশে পাশে যে বিশাল গাছগুলো চোখে পরে, অনেক গাছের নিচে পাথরে সিঁদুর লেপা কিম্বা একটা ছোট্ট মূর্তি। গাছগুলো কি আমরা চিনি? ওর মধ্যে আছে সুন্দরী, গেওয়া, গড়ান, বাইন, হেঁতাল, কেওড়া, ধুন্দুল, ওড়া, কাঁকরা আরও অনেক প্রজাতি। কেননা কলকাতা ছিল সুন্দরবনের অংশ। ওই গাছগুলো কবিতা লেখার জন্য, বাংলা অ্যাকাডেমিতে কবিতা পাঠের আসরে বলার জন্য আমরা বানিয়ে বলি। কিন্তু ট্রেনে মোটামুটি অনেক মধ্যবিত্ত, মেট্রোয় বহু ভদ্রলোক, নন্দনে অনেক বুদ্ধিজীবীদের ঠিক আমাদের নজরে পরে। এরা কিন্তু সংখ্যালঘু।

এই যে আমরা যাদের দেখতে পাই, যারা আমাদের কাছে ভিজিবল, আমরা ভেবে নেই পৃথিবীতে এরাই আছে। রাস্তায় শনিমন্দির হিন্দু ভদ্রলোকদের নজরে পরে, কিন্তু মাজার পরে না। কলকাতার বড় রাস্তার পাশে ইয়াব্বড় গাছের গুঁড়িতে কয়েকটা ফুল আর চন্দনের চর্চা কি মুসলমান আশরাফিদের নজরে পরে? তবে বড় মসজিদ বা মন্দির অবশ্যই নজরে পরে। আজান কিম্বা ঢং ঢং ঢং ঘন্টা আর আরতির শব্দও কানে আসে। ইনভিজিবল, নৈঃশব্দদের আমরা চিনিনা। আকাশে তাকিয়ে থাকলে আপনার কি মনে হয় পাখির সংখ্যা মানুষের থেকে বেশি? পৃথিবীতে প্রায় আটশ কোটি মানুষ। আর পাখির সংখ্যা পাঁচ হাজার থেকে তেতাল্লিশ হাজার। গড় ধরলেও ২৫গুণ। ওরা আমাদের কাছে ইনভিজিবল থেকে যায়। ঠিক তেমনই আমাদের চোখে ওই ছোটমানুষেরা ইনিভিজিবল। একটা ঘটনা বলি। উনিশ শতকের কেষ্টবিষ্টুদের ধারণা ছিল, বাংলায় কিছু মুসলমান, ডোম, চাঁড়াল, কেওট, বাগদি, শূদ্দুর আছে ঠিকই কিন্তু আসলে বেশিরভাগ বাঙালিই বামুন কায়েত আর বদ্যি। যদিও সেন আমলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা অনেক গবেষণা করে আবিষ্কার করেছিল যে বাংলায় চতুর্বর্ণ নেই, আছে শুধু ব্রাহ্মণ আর শূদ্র। তবু, ‘আমরা’ কায়েত বদ্যিদেরও সামাজিক কাঠামোয় ওপরের দিকেই জায়গা দিয়েছি। বিদ্যাসাগর মশাই সংস্কৃত কলেজে কায়েতদের জায়গা দিয়ে বৈদ্যদেরও জায়গা দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৮৮১’র আদমশুমারির পর আচমকা একটা ধাক্কা এল বাঙালি বাবুদের মনে। অর্ধেক বাঙালি নাকি মুসলমান! বাকি চল্লিশ শতাংশ শূদ্র! সেকি! বামুন কায়েদ বদ্যি’র সংখ্যা দশভাগের একভাগও না? স্তম্ভিত বঙ্কিম এই নিয়ে বঙ্গদর্শনে লেখালেখি শুরু করে দিলেন। দুই পৃথিবী। আপনার মনে হতে পারে এতো সারা পৃথিবীর ইতিহাস। সব জায়গায় একই চেহারা। না। বাংলায় দুই পৃথিবীর যে দূরত্ব তা সারা বিশ্বে আর কোথাও নেই।

ঔপনিবেশিক কলিকাতায় ভদ্রলোক বাবু বাঙ্গালির দুর্গাপূজা ও ব্রিটিশদের তোষামদের তৈলচিত্র

বাংলা এই ব্যাপারে ইউনিক। ডাইকোটমি, ডায়ালেকটিক্স, যাই বলি, আসল কথা ডাই, মানে বাইনারি। গরিব বড়লোক, এলিট সাব অল্টার্ন, সাদা কালো, শিক্ষিত অশিক্ষিত, শোষক শোষিত, এসব সারা পৃথিবী জুড়েই আছে। সাদা কালো ছাড়া বাকিগুলোর মধ্যে কিন্তু মোবিলিটি আছে। বাংলায় নেই। তাই এখানকার দুই পরস্পর অপরিচিত পৃথিবীকে বলা যাক, ভদ্রলোক ছোটলোক পৃথিবী। বাইনারির এই নামকরণ ভদ্রলোকদের করা। ছোটলোক শব্দে কারও খারাপ লাগতে পারে। ‘আমরা-ওরা’ও চলতে পারে। প্যানডেমিকের সময় আমার বন্ধুর কাছে ভদ্রলোক ছোটলোকের একটা ভিন্ন বাইনারি শুনেছিলাম। তখন লোকাল ট্রেন শুধু রেলকর্মীদের জন্য চালু। ছোট গাড়ি যা ছোট হাতি নামে পরিচিত সেই গাড়িতে গাদাগাদি করে সোনারপুর বারুইপুরের শহর কেন্দ্রিক শ্রমজীবীরা অনেক টাকা ভাড়া দিয়ে যাদবপুর টালিগঞ্জে কাজ করতে আসত। পেটের টান। যে রকম গাদাগাদি করে আসত, ছাগল কিম্বা ভেড়াও ওভাবে যাতায়াত করতে রাজি হতো না। যে লোকটা গাড়ি চালায়, যার গাড়ি, তারাও একই দলে। ছোটলোক। একটি ছোট্ট ছেলে হাতে একগুচ্ছ ডাব নিয়ে বিক্রি করতে আসত। তার মা লোকের বাড়ি কাজ করে। সে ডাব বেচে। তারপর দুজনে একসঙ্গে ছোটহাতিতে বাড়ি ফেরে। আমার বন্ধু ওই ছেলেটির কাছে নিয়মিত ডাব কেনে। একদিন ডাব কিনে আমার বন্ধু একটা একশ টাকার নোট দিয়েছে। ছেলেটি বললো, খুচরো নেই। কাল এসে ফেরত দেব? আচ্ছা, দিস। তারপর প্রায় ১৫ দিন আর ছেলেটার দেখা নেই। ছোটলোকের ছেলে। টাকাটা বোধহয় মেরেই দিল। এই আমাদের ভদ্রলোকদের মানবিকতার সুযোগ নেয় ছোটলোকগুলো। ইতিমধ্যে লোকাল ট্রেনগুলোয় পাবলিকও উঠতে শুরু করেছে, যদিও সরকারিভাবে লোকাল ট্রেন তখনও ছাড়পত্র পায়নি। ১৫ দিন পরে ছেলেটি আবার ডাব নিয়ে এসে হাজির। টাকার পরিবর্তে ডাব দিয়ে শোধ করতে চায়। অ্যাদ্দিন আসিস নি কেন? টাকা ছিলনা, তাই ছোট হাতিতে (ছোট লড়ি বা ম্যাটাডোর টাইপ গাড়ি) আসতে পারছিল না। কেন? এখনতো লোকাল চালু হয়ে গেছে। ট্রেনে বড়মানুষদের উঠতে দেয়, আমাদের দেয়না। মানে? তুই বাচ্চা বলে? না। বাচ্চা বলে না,। ওরা বড়মানুষ। ওরা শুধু বড়মানুষদের উঠতে দেয়।

আসলে ওর ভাষায় ও বলতে চাইছে বড়মানুষ আর ছোটমানুষ। বড়’র জায়গায় ভদ্র বসিয়ে নিন আর মানুষের জায়গায় লোক। আমাদের মনের সমস্ত গোপন কথাই শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। ওর কাছে ভদ্র বলে কিছু নেই, আছে বড়। কারা? যারা রাষ্ট্র স্বীকৃত। সে কেরানি হোক কিম্বা ডাক্তার। হাতুড়ি, হালবলদের কারবারি না হলেই হল। পায়ে কাদা না লাগলেই সে বড়। আর বাড়ির কাজের লোক, হকার, ঠেলাওয়ালা, ছোটহাতির ড্রাইভার সব শ্রমজীবীরাই ছোট। আমরা ওদের লোক বলছি, ওরা বলছে মানুষ। লোক আর মানুষ কিন্তু একই অর্থ বহন করে না। লোক মেটান্যারেটিভ। ভ্যুলোক, দ্যুলোক, গোলক। অন্য পৃথিবী। তাই লোকশিল্প, লোকগান, লোকাচার। ‘আমরা’ কিন্তু ওই পৃথিবীর বাসিন্দা নই। আকাদেমিতে যে নাটক হয়, সেটা লোকনাট্য নয়। লোকনাট্য হল ওই হেতালগঞ্জের যাত্রাপালার আসর কিম্বা গাজন, গম্ভীরা। ওরা কিন্তু আমাদের প্লাস ওদের নিজেদেরও ‘মানুষ’ ভাবে। মানুষ শব্দের তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। এই বাচ্চাটা যে ভাষাটা বলল, বড়মানুষ, এটা আমাদের ভাষা নয়। ওদের এমন অজস্র শব্দ আছে যা আমরা যে মানে জানি, ওদের কাছে তার অর্থ আলাদা। আমাদের অর্থ ওরা জানে, ওদের অর্থ আমরা জানিনা। ওই বাচ্চাটাই বড় হয়ে গেলে আমাদের সঙ্গে আমাদের ভাষায় কথা বলবে, ওদের ভাষায় নয়। যে লোকটার মাতৃভাষা ভোজপুরি, এখানে বাংলায় কাজ করে, কাজের তাগিদে এখানে সে বাংলায় কথা বলে। নিজের ঘরের লোকের সঙ্গে কিন্তু ভোজপুরি। ঠিক তেমনই, ‘ওরা’ ‘আমাদের’ সঙ্গে ‘আমাদের’ ভাষায় কথা বলে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায়। ওরা নিজভূমে পরবাসী। হ্যাঁ, নিজভূমে পরবাসী। আপনি ভাবছেন, হেঁয়ালি। দুজনেই তো বাংলায় কথা বলছে! না। একজন বড়মানুষদের বাংলা বলছে, আর একজন ছোটমানুষদের বাংলা।

এই দুই পৃথিবীর ভাষা এবং কালচারও সম্পূর্ণ পৃথক। হ্যাঁ, ঠিকই, ব্যকরণগতভাবে দুটোই বাংলা। কিন্তু অর্থ বদলে বদলে যায়। শুধু এলাকায় এলাকায় নয়, জাতপাতেও। আমরা ওদের কালচার চিনি, কিন্তু জানি না। কালচার বা কৃষ্টি। সংস্কৃতি বলব না। সংস্কার বা সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার এই ছোটমানুষদের কালচারের কোনো সম্পর্ক নেই। আছে কাল্টিভেশন বা কৃষির সঙ্গে। তাই কৃষ্টি। বাঙালি বড়মানুষদের কালচারের পরম ব্রহ্ম রবীন্দ্রনাথ এই কৃষ্টি শব্দটা শুনলেই ক্ষেপে যেতেন। সুনীতিবাবু সংস্কৃতি শব্দটা চালু করে ‘আমাদের’ বাঁচালেন। আমরা হয় কালচার বলব অথবা কৃষ্টি। বড়মানুষদের সংস্কৃতি, ছোটমানুষদের কালচার। হোক না ইংরেজি শব্দ।

বাড়ির কাজের লোক, হকার, ঠেলাওয়ালা, ছোটহাতির ড্রাইভার সব শ্রমজীবীরাই ছোট। আমরা ওদের লোক বলছি, ওরা বলছে মানুষ। লোক আর মানুষ কিন্তু একই অর্থ বহন করে না। লোক মেটান্যারেটিভ। ভ্যুলোক, দ্যুলোক, গোলক। অন্য পৃথিবী। তাই লোকশিল্প, লোকগান, লোকাচার। ‘আমরা’ কিন্তু ওই পৃথিবীর বাসিন্দা নই। আকাদেমিতে যে নাটক হয়, সেটা লোকনাট্য নয়। লোকনাট্য হল ওই হেতালগঞ্জের যাত্রাপালার আসর কিম্বা গাজন, গম্ভীরা। ওরা কিন্তু আমাদের প্লাস ওদের নিজেদেরও ‘মানুষ’ ভাবে। মানুষ শব্দের তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। এই বাচ্চাটা যে ভাষাটা বলল, বড়মানুষ, এটা আমাদের ভাষা নয়। ওদের এমন অজস্র শব্দ আছে যা আমরা যে মানে জানি, ওদের কাছে তার অর্থ আলাদা। আমাদের অর্থ ওরা জানে, ওদের অর্থ আমরা জানিনা। ওই বাচ্চাটাই বড় হয়ে গেলে আমাদের সঙ্গে আমাদের ভাষায় কথা বলবে, ওদের ভাষায় নয়।

বাংলায় ছোটমানুষদের কালচার একটা বিশাল গভীর সমুদ্র। যতদূর বিশ্বাসযোগ্য অতীত জানা যাচ্ছে, তাতে বুঝতে পারছি প্রায় আড়াই তিন হাজার বছর আগে, এই বাংলা ভৌগলিক দিক থেকে ছিল অত্যন্ত দুর্গম। পৌঁছনই অসম্ভব ছিল প্রায়। সামুদ্রিক চেহারার অজস্র নদী, দিঘি, দহ, বাদা, ভেড়ি, বাঁওর, সোঁতা খাঁড়ি, সাগর। এখানে একদল সরু সরু কালো ঠ্যাঙওয়ালা মানুষের মত জীব দেখা যেত, যারা নাকি পক্ষীর ভাষায় কথা বলত। আড়াই তিন হাজার বছর আগের বৈদিক অসভ্যতা’র রেকর্ড থেকে এই তথ্য জানা যাচ্ছে। অসভ্যতা বললাম কেননা, সভ্যতার জন্ম তো চাষবাস থেকে। বৈদিকেরা পশুপালক ছিল। ওরা চাষবাস ঘৃণা করত। তো সে যতই কাব্য টাব্য রচনা করুক, আসলে অর্থনীতির প্রশ্নে অসভ্যতা ছাড়া তো আর কিছু বলা যাচ্ছে না। স্থানীয় আদিবাসিদের শ্রম চুরি করে তারা তাদের সমাজ গড়ে তুলছিল। মুখে মুখে অনেক গপ্পো, দার্শনিক ভাটও রচনা করেছিল, শ্রুতি হয়ে পরবর্তিকালে যখন তাদেরই রাজত্ব তৈরি হল, তখন সেগুলো লিখিত রুপ পেল। অথচ এখানকার পক্ষীকুলের অনেক কাব্য সাহিত্য মুখে মুখেই থেকে গেছে। আজও তার সিকিভাগও লেখ্য রুপ পায়নি। এই বর্ণনা থেকে একটা জিনিস পরিস্কার, মানো ইয়া না মানো, এই বাংলায় একদল মানুষ থাকত। তাদের গায়ের রঙ কালো ছিল। তারা দুর্গম এলাকায় থাকত। অর্থাৎ দুর্গম এলাকায় তারা তাদের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল। দুর্গম এলাকাকে তারা তাদের পায়ের নিচের আপন মাটি করে নিতে পেরেছিল। যা আজও বড়মানুষেরা পারেনি। তারা আজও বাংলায় ট্যুরিস্ট। আরও বোঝা গেল ‘ওদের’ একটা ভাষা ছিল। সাগরের বুকে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাই হাইপিচ লেভেলে তারা কথা বলত। পাখি যেমন হাই পিচে ডাকে। পক্ষীর ভাষা। আমরা যেমন পাখির কলকাকলি বুঝতে পারি না। এই দুর্গম এলাকা যেমন বাংলাকে দীর্ঘদিন বিদেশিদের হাত থেকে রক্ষা করেছে, তেমনি, এই এলাকার বাঙালি, যাদের এখন ছোটমানুষ বলছি তাদের সমাজ কালচারে একটা ইউনিক বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। পক্ষীর কালচার। পাখিকে একজায়গা থেকে আর এক জায়গায় উড়ে যেতে হয়। দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে। একই তরুশাখা পরে ছিল বাসা (বাসা, বাড়ি নয়), ছিলা ঘরে, অজানার কোন ঝড়ে ভেঙ্গে দিল বাসাটিরে।

আজও সেই পক্ষীর কালচারই বাঙালির কালচার। ছোটমানুষদের কালচার। সেই কালচারে প্রবেশ করার সাধ্য ‘আমাদের’ বড়মানুষদের ছিল না, আজও নেই। কাজটা ওই ছোটোমানুষদেরই করতে হবে। আমরা কায়দা করে রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিশাল উঁচু মঞ্চ তৈরি করে ওদের সামনে মাঠে মাটির ওপর বসিয়ে জ্ঞান দিচ্ছি। ওদেরই কথা বলে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি। আমাদের নিচে নেমে যেতে হবে। ওদের মঞ্চ ওদের ছেড়ে দিতে হবে।

ছোটলোকি কালচার

আমরা যারা বড়মানুষ, আমরা ওই ছোটমানুষদের কালচারের একটা মোটামুটি ছবি আমাদের মত করে আমরা বানিয়ে নিয়েছি। লিখেছি। সমস্যা হচ্ছে, ওই ছোটমানুষেরা যতক্ষন না সেটাকে অ্যাপ্রুভ্যাল দিচ্ছে ততক্ষন সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। আগন্তুকে মমতাশঙ্কর গিয়ে সাঁওতালদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচলেই তো দুই কালচারের বন্ধুত্ব হয় না।

আমার মোটা মাথায় ছোটমানুষদের কালচারের কিছু বৈশিষ্ট নজরে এসেছে। সাবজেক্ট টু অ্যাপ্রুভ্যাল বাই ছোটমানুষ মোড়লস।

প্রথমতঃ এই বাংলার ছোটমানুষদেরই আমি বাঙালি বলব। বাঙালি ছাড়া আর তাদের অন্য কোনও পরিচয় নেই। একশ বছর আগে, একটা ছোট্ট খেটো কাপড় কোমরে টাইট করে বেঁধে খালি গায়ে, খালি পায়ে গফুর মিয়াঁ কিম্বা পরাণ মণ্ডল মাঠে হাল দিত। তার বৌ লক্ষী বা মীনাবিবি একটা ছ’হাতি কাপড় গায়ে জড়িয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিত। উর্ধাঙ্গ প্রায় অনাবৃত থাকত। আজ, পরাণ মণ্ডল গফুর মিয়াঁরা প্যান্ট পরে হাল ধরে। লক্ষী মীনারা সালোয়ার কামিজ পরে ধান মাড়ায়। পঞ্চাশ বছর পরে পরাণ গফুররা হয়ত আরও আধুনিক জামাপ্যাণ্ট পরে ছোট ট্রাক্টর চালাবে। মেশিনে ধান মাড়াই করবে লক্ষি অথবা মীনা, সর্টস পরে। পোশাক বদলে যাবে, কিন্তু পরাণ মণ্ডল গফুর মিয়ারা কিছুতেই দেবব্রত ভট্টাচার্য কিম্বা সৈয়দ আখতারুজ্জামান হবে না। তাদের গলায় স্টেথো কিম্বা হাতে ল্যাপটপ আসবে না। তারা মাঠেই থাকবে। এইটে গুরুত্বপূর্ণ।

পক্ষীর কালচারই বাঙালির কালচার। ছোটমানুষদের কালচার। সেই কালচারে প্রবেশ করার সাধ্য ‘আমাদের’ বড়মানুষদের ছিল না, আজও নেই। কাজটা ওই ছোটোমানুষদেরই করতে হবে। আমরা কায়দা করে রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিশাল উঁচু মঞ্চ তৈরি করে ওদের সামনে মাঠে মাটির ওপর বসিয়ে জ্ঞান দিচ্ছি। ওদেরই কথা বলে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি। আমাদের নিচে নেমে যেতে হবে। ওদের মঞ্চ ওদের ছেড়ে দিতে হবে।

অনেকে বলে বাংলা একসময় বৌদ্ধ ছিল। পরে ইসলাম আর হিন্দু। এর থেকে বড় ধাপ্পা আর হয় না। বাংলায় যে কালচার ছিল, সেটা একেবারের লৌকিক বা মানবিক। সেই কালচারের বৈশিষ্ট হল নৈরাজ্য। নৈরাজ্য শব্দটা অনেকে মন্দ অর্থে ব্যবহার করে। আমি কিন্তু এটা পজিটিভ অর্থে ব্যবহার করছি। বাঙালির কালচারের মুখ্য চরিত্রই হল নৈরাজ্য। কেন? সেই নিয়ে কথা বলা যাক।

বাংলায় ছোটমানুষদের কালচারের প্রধান বৈশিষ্ট হলো নৈরাজ্যবাদ। আর ঠিক তার বিপরীতে বড়মানুষদের রাজ্যবাদ বা রাষ্ট্রবাদ। ইংরেজিতে বলি অ্যানার্কি আর স্টেটিজম। ছোটমানুষদের কালচার টুকরো টুকরো, ভিন্ন ভিন্ন। বড়মানুষদের কালচার মেটা। বড়মানুষদের আড্ডায় তাই দিনরাত আলোচনার বিষয় হয় ছোটমানুষদের নৈরাজ্য। একটা ডাইকটমি, ডায়ালেকটিকস বা বাইনারি। ইউনিটি অফ অপোজিটস। এখানকার মূলনিবাসী মানুষেরা শ্রমজীবী। ঠিক কত হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষরা এখানে এসে ওই ভাঙ্গাগড়া চরগুলোয় বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছিল তা বলা মুশকিল। শুধু এইটুকু জানি এই বাংলার ভাটি এলাকায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগেরও বসতি পাওয়া গেছে, যেখানে এমনকি বাণিজ্যও হতো। ভূপ্রকৃতিই বাঙালিকে ক্ষ্যাপা বাউন্ডুলে করে ছেড়েছে। যারা পরে বাইরে থেকে এসেছে, বৈদিক অসভ্যরা, কিম্বা পাঠান মোগলরা, তারা ছিল স্টেটিস্ট বা রাজ্যবাদী। তারা পরশ্রমজীবি! শুধু পরশ্রমজীবী নয়। তারা শ্রমকে ঘৃণা করত। মনে হতে পারে এই শ্রমজীবী পরশ্রমজীবী বিভাজন তো সারা পৃথিবী জুড়েই আছে। একদল মানুষ শ্রম করে না, অপরের শ্রম চুরি করে বাঁচে। ঠিকই কিন্তু সেটা বংশপরম্পরায় চলেনা। এখানে যারা পরশ্রমজীবী তারা বংশপরম্পরায় পরশ্রমজীবী। শুধু পরশ্রমজীবী নয়। তারা শ্রমকে ঘৃণা করে। অত্যন্ত দরিদ্র ব্রাহ্মণ, খেতে পাচ্ছে না, তবু মেথরের কাজ, হালবলদের কাজ করবে না। যজমানি করে পেট চালাবে। একটা মজার কার্টুন মনে পড়ছে। বিশাল এক কোম্পানি মালিক প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলায় কিছুক্ষণের জন্য রাস্তায় হকারি করে। একদিন একজন জিজ্ঞেস করল, একি স্যার? আপনি হকারি করছেন? অভ্যাসটা রাখছি, যদি আবার কোনোদিন পুরনো পেশায় ফিরে যেতে হয়। এই মবিলিটি এদেশে হয়না কাস্টিজমের দৌলতে। চোদ্দপুরুষ ধরে পরশ্রমজীবী। চোদ্দপুরুষ কথাটা এই জন্য আমাদের সোসাইটিতে এত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যবাদীদের আমার তাই বাঙালি বলতে একটু অস্বস্তি হয়। তারা বহিরাগত। বলা যায় বাঙালি পরিচয়টা এরা চুরি করেছে। আমার হিসেবে এখানে স্টেটিস্টরা ম্যাক্সিমাম দেড় থেকে দু’হাজার বছর আগে এসে পৌঁছে ছিল। হঠাৎ কেন স্টেটিস্টদের আসা শুরু হলো? খবর পৌছে গেছিল এই বাংলা সাংঘাতিক উর্বরা আর প্রচুর সম্পদ। সোনার বাংলা। তাই প্রথমেই বণিকদের নজরে পড়লো। বৈশ্যদের। তারা ছুটে এলো। কিন্তু দূর্গম প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে, ভিতরে প্রবেশ করি সে সাধ্য ছিলনা একেবারে। তাই প্রান্তে প্রান্তে বাণিজ্য নগরী। তারপরে বণিকদের বাণিজ্য করার প্রয়োজনেই ক্রমশ এখানে শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন হল। বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে পোহালো শর্বরী। যেই রাজতন্ত্রের প্রশ্ন এলো সঙ্গে সঙ্গে রাজত্ব চালানোর জন্য দরকার হয়ে পড়ল প্রশাসকের দল। আইসিএস, বিসিএস ডব্লিউবিসিএস আইপিএস অফিসার। এবং ব্রাহ্মণদের ওই উত্তর থেকে নিয়ে আসতে হলো নানা উপঢৌকন দিয়ে। তারা এখানে রাজ্য বা স্টেটহুড প্রতিষ্ঠা করল। এখানেই যারা আদি বাসিন্দা ছিল, তাদের থেকেই কেন এই প্রশাসকদের পাওয়া গেল না? অশিক্ষিত বলে? লেখাপড়া জানে না বলে? লিখতে না পারা আর পড়তে না পারাই কি কারণ? না। প্রথমত এখানে যারা ছিল, তারা লিখতে পড়তে জানত না এটা ভেবে নেবার মত যথেষ্ট তথ্য নেই। লেখা পড়া না জানলে তিনহাজার বছর আগে দক্ষিণ বঙ্গে বাণিজ্যে শুরু হতে পারত না। চীনা কড়িও পাওয়া গেছে। আসলে এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, বা স্টেটিজিমের লেজিটিমেসির জন্য দরকার হয় একটা দর্শন। সেটাকে অবশ্যই হতে হয় মেটা ন্যারেটিভ। বাংলায় নৈরাজ্যবাদ কোনো মেটা ন্যারেটিভের জন্ম দিতে পারে নি। এখানকার চিন্তন জগত ছিল প্রাকৃতিক, ন্যারেটিব মাইক্রো, ন্যানো। এই আমগাছ, তো পাশেই তেঁতুল। ঠিক মাছখানে বাবলা কাঁটার ঝোপ। লইটা, তোপসে, বেলে, বোয়াল, রুই কাতলা একসঙ্গে প্রাকৃতিক বৈচিত্র নিয়ে যেমন থাকে। পুকুরে কৈ মাছের চাষ নয়। প্রেমের গপ্পোরই হাজারটা ভ্যারাইটি। সে প্রেম রাধা কেষ্ট’র হোক কিম্বা শিব পার্বতীর। এই গপ্পোগুলোর মধ্যেও অ্যানার্কি। কিন্তু মেটান্যারেটিভ জন্ম দেয় একটা সামগ্রিকতার। যাকে বলা যায় বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। আসলে ঐক্যটাই মুখ্য, বৈচিত্র গৌণ। শেষকালে ঐক্যটাই হয়ে যায় একমেবাদ্বিতীয়ম। হবার কথা ছিল উলটো। বাগানে অনেক রকম ফুল ফলের গাছ গড়া যায়। তার বৈচিত্রও থাকে। আকারে প্রকারে। কিন্তু এটা যে প্রাকৃতিক নয়, মানব সৃজিত বাগান বোঝা যায়। সাজানো বাগানে কোথাও একজন অথরের স্পর্শ থাকে। তাই অদৃশ্য অথারিটেরিয়ানিজম দেখা যায়। জঙ্গলে সে নিয়ম নেই। প্রথম মেটা ন্যারেটিভ এল বৌদ্ধধর্ম হয়ে। এই ধর্মের ইতিহাস আর বণিকের বাণিজ্যের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গি। বাংলায় নাকি বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক চাষ হয়েছিল। এবং ‘আমরা’ বলছি, সেই বৌদ্ধধর্ম আসলে ছিল হীনযান। ‘হীন’ শব্দটা লক্ষ্য করার মতো। পরে অ্যাকাডেমিকসরা থেরবাদ বা থেরাবাদ বলে ম্যানেজ দিয়েছে। আসলেতো বলতে চাইছি হীন। এই হীনমন্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক মানসিকতা গঠনে এই হীনমন্যতা খুব কাজে লাগে। আহা, এরা সহজিয়া। আহা, এরা সহজ সরল মানুষ। এই হীনমন্যতা আজও ‘আমাদের’ ডিভিডেন্ড দিচ্ছে। বৌদ্ধ ধর্মের পরে এলো ইসলাম। মনে করা হয়, আরবের বণিকেরাই ছিল ইসলামের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু সেখানেও পীর ফকির দরবেশের দল এসে আসলে বাঙালিয়ানায় কিছু নতুন রঙ চাপালো। সব শেষে খৃষ্টান। সেতো বণিকের মানদণ্ড হাতে নিয়েই এসেছিল।

কিন্তু বাংলার আদি নৈরাজ্যে এরা কেউই দাঁত ফোটাতে পারেনি। সমাজ সমুদ্রের গভীরে আজও নৈরাজ্যবাদের টানা চোরাস্রোত। ওখানে হেঁদু মোছলমান শব্দের তাৎপর্য অন্যরকম। আসলে ধর্ম রিলিজিয়ন অর্থে কোনওদিনই বাংলায় দাঁত ফোটাতে পারেনি। কামড় দিয়েছে। কামড়ের দাগও থেকে গেছে। কিন্তু বাঙালিকে ব্রাহ্মণ্যবাদি, ইস্লামিস্ট, ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট এমনকি কম্যুনিস্টও করে তুলতে পারেনি। নৈরাজ্যবাদ বাঙালিকে আজও স্বতন্ত্র করে রেখেছে। সেই স্বাতন্ত্র্য আমরা বুঝে উঠতে ব্যর্থ। তাই নৈরাজ্যবাদ রাজ্যবাদিদের চক্ষুশূল। তারা এটাকে নিন্দার্থে ব্যবহার করে। ভূপ্রকৃতির নৈরাজ্য আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আজও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে। আমরা জানি আমাদের জীবনের নিশ্চিন্ত স্থায়ি ঠিকানা সম্ভব নয়। আর স্থায়িত্ব না থাকলে রাজ্য হয়না। বাংলা ভাটির দেশ। নৌকা, মাঝি, হাল, পালের দেশ। ছোটমানুষদের তাই জাতীয় সঙ্গীত-

মাঝি বাইয়া যাও রে।
অকুল দরিয়ার মাঝে
আমার ভাঙা নাও রে।।

ভেন্না কাষ্ঠের নৌকা খানি।
মাঝখানে তার বুরা

(নৌকার) আগার থাইকা পাছায় গেলে।
গলুই যাবে খইয়া রে।।

গ্রাফিক্স- সাইদ উজ্জ্বল

অরূপশঙ্কর মৈত্র

নাট্যকার, নাট্য পরিচালক ও লেখক। নিবাস: দক্ষিণ কলকাতা।

Share

2 thoughts on “ছোটমানুষের গপ্পো”

  1. দেবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    আপনার বাঙালি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আমার অনেক কৌতূহল ছিল। আজ কিছু নিরসন হল। বাঙালির সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তারপর কি কি হল, কিভাবে হল সেটা আরেকটু জানতে পারলে ভাল হত। একজায়গায় লিখেছেন বর্ণনা অনুযায়ী পাওয়া
    যাচ্ছে— ইত্যাদি। কোন বর্ণনা অনুযায়ী?

    ছোটমানুষের মোড়লদের কাছ থেকে অনুমোদন চেয়েছেন। তাঁদের কাছে লেখাটা যাচ্ছে কি? যদি প্রতিপক্ষ থেকে না যায় তাহলে কিভাবে পাঠানো যায়?

    যে সব ইংরেজি শব্দ আপনি ব্যবহার করেছেন তার বেশিরভাগ সম্পর্কেই আমার ধারণা নেই। আমরা কি আপনার লেখা পড়ব না? ভাল লেখা পড়তে হলে কষ্ট করতে হবে তা মানি। নেটে মানে দেখি কিন্তু পিছনের দর্শন বুঝতে পারি না। বাংলা শব্দে কি লেখা যায় না? আপনি যদি বলেন এই শব্দগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে পারবেন না তাহলে মানব না। বাংলায় লিখে বন্ধনীতে ইংরেজিটা দেওয়া যেতে পারে। আমার মত গোদা পাঠকের তাহলে বুঝতে সুবিধা হয়।

    নৈরাজ্য কি এখনো আছে বাঙালির চিন্তায়? এখন তো স্থায়ী বাসস্থান অনেকেরই হয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে এলেও বারবার ফিরে যায়। ওই গ্রামের বাড়িকেই তো বাসস্থান মনে করে, বাসা নয়। এর ওপর সরকারি প্রচেষ্টায় যা কিনা রাজ্যবাদী স্থায়ী বাসস্থান দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। নৈরাজ্য হটাবার এও এক অস্ত্র।
    এখন নৈরাজ্যের লক্ষ্মণ কোথায় কোথায় আছে সেটস একটু আলোচনা করলে ভাল হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top