।। রওশন সালেহা।।
রওশন সালেহার ‘আমার এক নদীর জীবন’ বাংলা আত্মজৈবনিক সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অধীন অবিভক্ত বাংলা এবং পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাংলার নানা খণ্ডচিত্র উঠে এসেছিল এই গদ্য সাহিত্যে। বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় নোয়াখালী, ঢাকা ও কলকাতার সমাজ জীবন, রাজনীতি, শিক্ষাপ্রসার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ, ইতিহাসের নানা বাঁক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি মুসলিম পরিবারের ভিতর থেকে আত্মজৈবনিক কথনের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছিলেন রওশন সালেহা। এই রচনার দ্বারা বাংলা সাহিত্যে রওশন সালেহা শক্ত স্থান দখল করে নেন। এছাড়াও ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত। আমরা ‘আমার এক নদীর জীবন’ নামক আত্মজৈবনিক এই গদ্য সাহিত্যকে কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রতিপক্ষ’-এ পুণরায় প্রকাশ করছি।
আমার এক নদীর জীবন (তৃতীয় পর্ব)
কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা
দেশ স্বাধীন হয়েছে,নিজের অঞ্চলে ফিরে আসার মধ্যে দারুণ উত্তেজনা ছিল। গ্রামে নোয়াপুর বাড়িতে কয়েকদিন আনন্দে কেটে গেল। উত্তেজনা কর্পুরের মতো উবে গেল,যখন টের পেলাম আমি এক অতি সাধারণ মেয়ে হয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক নেতাদের উপর ক্ষোভ এসে গেল। জিন্নাহ সাহেবের মাথায় কে এমন কুবুদ্ধি দিয়েছিল, কলকাতায় ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে’ নামক হিন্দু-মুসলমান মারামারি লাগিয়ে দেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তো এরকম চাননি শুনেছি। একটি বছর কলকাতায় থাকতে পারলে আমি লেখাপড়ার একটা বড় অংশ শেষ করতে পারতাম! এখন কী হবে! কী আমার ভবিষ্যত! কলকাতা থেকে বুকিং দেয়া মালপত্র এদিকে ফেনীতে এসে পৌছে গেল,অথচ স্বামী সেই যে ঢাকায় গেলেন, আর কোনো চিঠি নেই,সংবাদ নেই। দুশ্চিন্তায় কিছুই ভাল লাগছিল না। শরীর যে ইতিমধ্যে আরেকটি সন্তান ধরে আছে তা টের পেয়ে আরও মুষড়ে পড়ি। খাই-ঘুমাই,গল্প করি, বাড়িতে সকলে সমাদর করে। শাশুড়িকে মা ডাকি। উনি তো চোখের মনি করে রেখেছেন। তথাপি গায়ে গায়ে জ্বর,কাশি থাকে,মন খারাপ হয়ে যায়। আমার বড় জা সকলের থেকে বকুনি শোনেন; শহরের মেয়েটিকে আরও.আদর-যত্ন করেন,ওর যা চেহারা হচ্ছে,শেষে আমরা বদনামের ভাগী হব ইত্যাদি। আসলে যত্নের কোনো ত্রুটি ছিল না। ছেলেমেয়েসহ আমরা খাঁটি সরষের তেল মেখে গরম পানিতে গোসল দিতাম। মন ভাল না থাকলে শরীরের ওপর তার চাপ তো থাকবেই। এটা দূর করার কোনো উপায় দেখতাম না।
একদিন তিনি চিঠি দিলেন, সাত-আট পাতা ভর্তি বহু কথা। বর্তমানে কোনো ঠিকানা নেই। হঠাৎ একটা দাবি জানাতে গিয়ে সাসপেন্ড হয়েছেন। উনি সেটিই অন্যায় আচরণ বলে কোর্টে কেইস দিয়েছেন।
এখন বাড়ি আসা সম্ভব নয়। ঘটনা ছিল এই, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একাউন্টেন্ট জেনারেল (মিঃ সাঈদ আহমদ) অফিস দেখতে এলে তারা সুবিধা অসুবিধা জানানোর সময় দাবি তুলছিল,বাঁশ তক্তা দিয়ে হলেও পলাশীতে ব্যারাক তুলে দিতে। পরিবার নিয়ে থাকার মতো ঢাকায়। বাসা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সেই উর্দুওয়ালা তাদের কথা বুঝতেই চায়নি, উল্টা ‘কুইসলিং মুসলমান’ বলে গালি-গালাজ করেছিলেন। বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঙালিদের গালি দেয়, এত সাহস, এর! প্রতিবিধান চাই। এ. জি. সাহেব ভয় পেয়ে ব্যাকডোর দিয়ে সোজা এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে লাহোরে। পত্র পাঠান এই মর্মে, ‘চাকরি জীবনে কেউ এমন উদ্ধত হবো না। ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এ রকম অঙ্গীকারনামা দিতে হবে। নতুবা ডিসিপ্লিনারি এ্যাকশন নেবে। ক্ষমা কেন চাইব? অন্যায় দাবি তো করিনি। শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে হবে আমাকে।
চিঠিখানি কয়েকবার পড়ে নিলাম,আমাদের কথা কিছুই লিখেননি কেন? মন খারাপ হয়ে গেল। আমরা কি ভেসে যেতে তাঁর সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছি। যা হোক গর্ব একটু হয়েছিল,অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি-ভাল করেছেন। কিন্তু তার আদর্শের জের আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিল। ঢাকা যাওয়ার কোনো আশা করতে পারছিলাম না। এদিকে চিঠির কথা অন্যদের বলতেও চাই না। আমার ভাগ্যের পরিহাস শুনাতে আমি পারবো না। নোয়াখালী যাওয়ার জন্য মন ছটফট করলেও সে তো ভাল কাজ হবে না,মা বাবা দুঃখ পাবেন। গ্রামে বসে কী করতে পারি, ভাবতে ছিলাম। চোখের সামনে ভাসুর ঝি কিরণ স্কুলে যায় না। সারাক্ষণ আমার কাছে ঘোরাঘুরি। ওকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারি, স্কুল হয় না, পড়াবে কে? স্যার নেই। আমি চট করে ঠিক করলাম; এই তত আমি কাজ খুঁজে পেলাম। কিন্তু কাকে বলি? কে আমাকে উৎসাহ দেবে-ভাল কাজ,তুমি করতে চাও-কর! শাশুড়িকে বললে ফল হবে উল্টো। বাড়ির সকলে জেনে হুলস্থুল বাঁধিয়ে দেবে। পড়ার সময়ে যে সকল ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম,সে রকম কিছু করা বোকামি মনে করি এবং অবশেষে ঠিক করি বাড়ির কর্তা মেজদেবরকে বলা যায়। সে দুদিন পর ফেনী থেকে বাড়ি আসে। খাওয়ার পর আমার খোঁজ নিতে আসলে আমি হাসি মুখে চেয়ার এগিয়ে দিই। বলি, প্রেসিডেন্ট সাহেব শুধু হাঁকডাকেই,কাজ কিছু করেন নাকি? বাড়ির কাছেই প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা হয় না মশাই। ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যায় না। আপনার গদি উল্টে যাবে। আমাকে ওখানে যদি মাস্টারি করতে না দেন। কাল থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করবো… কী বলেন!
শেখ নুরউল্যা চৌধুরী সুন্দর হাসি দিয়ে আমার কথা লুফে নিলেন, ‘ভাবী সাব আপনে স্কুলে পড়াবেন,সেটা তো আগে বলবেন। আপনার স্কুলে যাওন লাগবে না। স্কুল আপনার কাছে এসে যাবে।’ বুঝলাম সে রাজি নয়। এর দুদিন পর আমি আরও অসহায় বোধ করলাম। ফেনী থেকে সে অনেক রকম সদাই কেবল আমার জন্যই পাঠিয়েছে তার লোক মারফত। তাতে ছিল বিলাতের তৈরি সাবান, পাউডার, স্নো,ভারতের জবাকুসুম তেল, বাচ্চাদের জন্য হরলিকস,বিস্কিট। প্যাকেটের জিনিসপত্রগুলো দেখি আর সে সাথে অনুভব করলাম,সে সুচতুর কৌশলে আমাকে বলে দিয়েছেন,যেমনি আছি,তেমনি থাকি। বাড়ির মধ্যে ঝামেলা কী জন্যে। ভাল ভাল জিনিসের জন্য অভাববোধ আমার ছিল না। মনে করলাম‘ঘুষ’। পরিবারের খাতিরে তাই মেনেও নিলাম। তবুও মনের দাপট,অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারি না। ছোট দেবর ব্যবসা নিয়ে ফেনী আসা-যাওয়া করছে। ওকে বললাম, ভাই আমাকে কাগজ খাতা পেন্সিল কলম বেশি করে এনে দিতে পারবেন। গল্প লিখবো। এবার আমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসপত্র পেয়ে কাজেও লেগে গেলাম। প্রায় প্রত্যেকদিনই গ্রামের মেয়েরা দু-একজন নতুন বৌ (স্বামী অন্যত্র ছিল) আমাকে দেখতে ও গল্প করতে আসতো। ওদেরকে নিয়ে আমার ঘরেই স্কুল স্কুল খেলা শুরু করে দিলাম। যে যতক্ষণ থাকে,পড়া কাগজে লিখে দিতাম,পেন্সিলও দিতাম, কেউ কেউ নিজের বই খাতাও আনতো। কয়েকদিন বাড়ির অন্য দুই বৌ (ডলির মা এবং হুমায়ুনের মা নিজ নিজ ঘরে ছোট বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। আমার কাছে তেমন আসতো না। কেবল খাওয়ার সময় আমরা তিনবেলা একত্র হতাম। তখন যত সব অকথা আর কুকথা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করেন বড়-জা কিরণের মা। সারাবাড়ির রান্না-খাওয়ার চোট তার উপর, কিন্তু কী সুন্দর হালকা মনে তাকে চলতে দেখেছি। সকালে চা-নাস্তা খেতে বসতাম বৌয়েরা, তার চুটকি কথা দিয়ে তিনি যেমন হাসাতেন,লজ্জাও সামলাতেন আমাদের। কাউকে যদি আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকাঢকি করতে দেখতেন, অমনি জিভ কেটে কথা, আহা! কে এমন করে দিলো বিবি! আয়তো, এদিকে,কাঁচা হলুদ বেটে রেখেছি। তোর শরমিন্দা গালটায় লাগিয়ে দেই। কাউকে বলবেন, একি ভিজে চুল! খুলে দে,জ্বর হলে বাপু সেবা-যত্ন করার সময় পাব না। তাকে পাকড়াও করলাম একদিন,এত ভাল মানুষ আপনি,কেবল আগুনের দুয়ারে সময় নষ্ট করেন কেন;রাঁধুনি ঝিতো রয়েছেই। দেবরদের এত আদর করতে দেব না,পড়ালেখা যা করেছেন,সব তত ভুলে গেছেন। আমি আবার ধরিয়ে দিই। এনিয়ে তাকে উৎসাহিত করতে পারিনি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। স্বামী তো বিদেশ যায়নি, গেছে পরকালে। চিঠি লিখবো কোথায়! ঐ যে জানু (একটি নতুন বৌ,পাশের বাড়ির) স্বামীকে পত্র লিখলো, পতি পরম গুরু,আপনার চরণে হাজার সেলাম। আর যায় কোথায়-বড় বিবি (আমি) আপনার ছাত্রীর স্বামী এমন অবাক হয় যে,পত্র পাওয়া মাত্র ছুটে আসে… জানু আজ দু’দিন পড়তে আসে না… কেন, শুনবেন? আমার ঐ বিদ্যায় কাজ কি! চুলায় লাকড়ি ঠ্যাংয়ালে বরং দেবরদের মুখে হাসি দেখতে পাই। আর কিছু চাই না বোন।
হাসির আড়ালে তার নিঃসঙ্গ জীবনের দুঃখ নিয়ে সুখী সুখী কথা এরকম বলতেন। আমাদের দুপুরের আর রাতের খাওয়া একঘন্টা-দেড় ঘন্টায়ও শেষ হতো না। ওদিকে ‘মা’ চায়ের জন্য হাঁক ছাড়ছেন, কেউ তাঁকে দেখছে না। বাড়িতে এত লোক, তার চা দেয়ার লোক কই! তড়িঘড়ি আমরা কেউ একজন এককাপ চা হাতে তার সামনে গেলেই তিনি শান্ত, একদিন আমি চা নিয়ে গেলাম। কিছু বলার জন্য কাছে বসতে ইঙ্গিত করলেন। আধ শোয়া, পিঠের নিচে বালিশ । একটু মাথা তুলে তসতরিতে চা ঢেলে সবটুকু শেষ করলেন। বললেন, তুমি গ্রামের বাড়িতে আছো; একটা কাজ করবে আমার জন্যে বৌমা! আমার এই এতিম বাচ্চাগুলোকে যা হোক কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দেবে? আমার শরীর তো দেখলে ! দু’চোখ বুঝলে ওদের আর কেউ দেখবে না।
তিনি মেদ-মাংসহীন মুখের উপর ভাসাভাসা দুটো নয়ন মেলে আমার উত্তরের অপেক্ষায়; কথা বলতে না পেরে আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম। আমি কেঁদেও দিলাম,মা মরে যাবেন কেন! এতদিন সাতটি সন্তানের শোক, স্বামীর শোক বুকে ধরে তো বেঁচে রয়েছেন,এই এতিমদের নিয়ে তবে বেঁচে থাকবেন না কেন! তার অংকুরী, সকিনী,সুফিনী,কালনী,মোকসুদ্দী,পঁচনী তাকে কি মরতে দেবে! সর্বক্ষণ তাঁকে সেবা করছে, বুকে গরম সরষের তেল,হাত-পা মালিশ কত কী। চুলে বিলি কাটা,গরম পানিতে গোসল দেয়া-এতসব সেবা মিথ্যা হবে! ভাবতেই বুকের পাঁজর চিপে যন্ত্রণা বোধ হয়,চোখে পানি এসে গেল। কান্না দেখাতে নেই চিররুগ্ন স্নেহময়ী মানুষের সামনে। আমি চলে এলাম তখন।
আমার মধ্যে তখন মাস্টারির নেশা, মা তাতেই ডাক দিলেন। অল্প কয়েকদিন পর শ্লেট,চক,খড়ি,বর্ণমালা নিয়ে তাঁর আলমারিতে সাজিয়ে রাখলাম। তাঁর বইও ছিল সেখানে। নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ প্রায় পংক্তি তার মুখস্ত। রামায়ণ,বিষাদসিন্ধুও দেখলাম। একদিন দুপুরে খাওয়ার পর আমরা সকলে নতুন পাঠশালা খুলে বসেছি। উনি শুয়েছিলেন,উঠে বসলেন। জিলাপি আনিয়ে রেখেছিলেন। আমাদের অবাক করে হুকুম দিলেন, কালনী, জিলাপি বার কর, চা বানা। বৌরা আজ আমার মেহমান। হাতেখড়ি অনুষ্ঠান বেশিক্ষণ চালানো সম্ভব হয়নি। মায়ের বেদম কাশি উঠলো,গলা চিরে রক্তও বের হলো। ঐ পোষ্যদেরও লেখাপড়া কিছুই হয়নি। হবে কখন? মা তো ঘুমাতে পারেন না, একটু ঘুম আসলো,কাশিতে জেগে চায়ের জন্য চিৎকার। ওদের ছুটি নেই, সর্বক্ষণ একাজ-ওকাজ। ওঁকে নিয়েই ওরা আছে। আমি পড়াতে গিয়ে দুঃখে কাতর হয়ে যাই;যাদের পড়ানোর কথা তিনি আমাকে বলেছেন, সেটি যে শুধু তারই অন্তর-বেদনা, যা শেখার উনি নিজেই তো ওদের শিখিয়েছেন। রোগীর ঘর ঝাড়মোছ করা, কোনো গন্ধ নেই। তাঁর সেবা ওরা মন থেকেও করে যাচ্ছে, কেউ তো বলে দেয় না। পথ থেকে কুড়িয় এনে আপন ঘরে ঠাঁই দিয়ে তিনি নিজেই ওদের মানুষ করেছেন। ওরা নিজ জীবনে টিকে থাকবে, উনি দেখে যেতে পারবেন না। দুঃখ আমার এখানেই।
আমাকে কাজ দিলেন মেজ দেবর। সেলাই শেখাতে হবে বাড়ির মেয়েদের। এক থান ‘আদ্দি’ কাপড় নিজ হাতে বয়ে এনে বললেন, আমাকে একটা পাঞ্জাবি আগে সেলাই করে দিন। বাকি সব আপনাদের ব্লাউজ, ডলির-শেলীর জন্য ফ্রক, পারবেন তো? বাড়ির বৌগুলো খেয়ে মুটকি হচ্ছে ওদের কাজে লাগান। আমি বললাম, তা ঢাল তলোয়ার দেবেন না? সেলাই –এর মেশিন…কাঁচি… সুঁই-সুতা… এইসব কোথায়? পলিটিশিয়ান মানুষ, সব কি আর একসঙ্গে দেবে? আজ একটা, কাল একটা করে অবশ্য পেয়েছিলাম এবং বাড়িতে সকলেই সেলাই শিখতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। বুঝেছিল যে ব্লাউজ, পেটিকোট, সেলাই করতে পারলে দর্জির কাছে যেতে হয় না। পর্দা রক্ষা হয়। দু’চারটা বেশিও পরা যায়। এরা এত বুদ্ধিমতি, আমি একটু দেখিয়ে দিলেই শিখে যায়, নিজেদের মন থেকেও পারে। এসব মেয়েরা গাছের ফল, এমন কি কিছু না পেলে লেবুও নিয়ে আসতু আমার জন্য। নিষেধ করলে রাগ করতো। বলতো, আপনি এমন করেন কেন? আমাদের ভালবাসেন না? এ সকল কথায় কি আছে! ওদের মধ্যে আমি নিজেকে পেয়েছিলাম বলেতো উল্টো আমিই ওদের ভালবেসেছি।
একদির জানালা দিয়ে উঠানে চোখ রেখে বসে আছি এমনি। দেখলাম আমার সেলাই করা পাঞ্জাবিটা পরে প্রেসিডেন্ট সাহেব লম্বা পা ফেলে ঘরের দিকে আসছেন। খুশি যেমন লাগলো, লজ্জাও হলো। ভাল সেলাই হয়নি। ওনার পাঞ্জাবির উপর কাপড় ফেলে কাপড় কাটলে কি আর ভাল হবে! আমি এর আগে পাঞ্জাবি সেলাই করিনি। খারাপ বলার আগে লুকাতে যাব, কিন্তু ভাবীসাব বলে ডাকছেন। দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালাম। বললেন, গ্রামে আর কতদিন পড়ে থাকবেন; নোয়াখালী চলে যান, বেড়িয়ে আসেন। কাল সকালে ছোটমিঞা নিয়ে যাবে। তৈরি হয়ে থাকেন। কথাগুলো আদেশী, মুখে তেমন হাসিও নেই। এমন করে কথা বলতে তাকে আগে দেখিনি। তাই আমিও জোর দিয়ে বললাম, সেলাই-এর ক্লাস ফেলে আমি যাব না। আপনার পাঞ্জাবি খারাপ হয়েছে বলে রাগ করছেন?
না, মাওই আম্মার অসুখ। দেখে আবার আসবেন। আমিই নিয়ে আসব। মায়ের কথা যে প্রায় ভুলই গিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে সোজা এদিকে এসেছি। তিনিতো অভিমান করে একটা চিঠিও দিলেন নাখুবই চিন্তাই কাটলো সারারাত। ভোরে রওয়ানা দিয়ে দুপুরে পৌঁছালাম। মাকে সুস্থ দেখে অবাক। আমাকে এভাবে শহরে তুলে আনার মতলবটা কি? মাও জানেন না কিছু। পুরুষ মানুষরা কি মতলবে কখন কি করে ঘরের স্ত্রী পর্যন্ত জানে না। আশ্চর্য। কয়েকদিন পরেই জানা গেল ঘটনা সুদূর প্রসারিত। আমার বাবা ছিলেন জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি, দেবর ছিলেন মহকুমা মুসলিম লীগের। তারা দুজনে পরামর্শ করে আমাকে গ্রাম থেকে বের করে এনেছেন। আমার মা নাতি-নাতনি পেয়ে অন্য সকল বিষয় ভুলে গেলেন। তাঁর পছন্দ করা জামাই মিঞা যে রেগে যাবেন, তার সঙ্গে কোন যোগ-জিজ্ঞাসা নেই। আমি নুয়াখালী চলে এলাম এবং একটা স্কুলের দায়-দায়িত্ব ঘাড়ে নেব। তিনি কিছুই জানবেন না?
একদিন বিকেলে আমাদের বাসায় বাবার সঙ্গে শহরের প্রখ্যাত নেতা, রাজনীতিবিদ, সমাজ সেবক কয়েকজন এসেছেন। তাদেঁর মধ্যে ছিলেন রেজাকুল হায়দার চৌধুরী, মুজিবর রহমান মোক্তার, ফজলুর রহমান উকিল, সৈয়দ আব্দুল মজিদ। সকলের মধ্যে আমি বসে আছি।তাদেঁ মুখে এক কথা, মা, তোমার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম। শহরের একটি মাত্র সরকারী এম.ই.স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনই হতভাগ্য যে, এ দেশের মেয়েদের জন্যে প্রাইমারী শিক্ষাটুকুও দিতে পারবো না। কোথায় ওদের পাঠাবো? আমরা জানি তোমার লেখাপড়া শেষ হয়নি। বি.এ পরীক্ষা তুমি দিতে চাইবে। কিন্তু শত শত মেয়ের প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া যে এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন এ মুহূর্তে। দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে, মেয়েদের শিক্ষা না হলে কি নিয়ে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াব। তুমি অমত করবে না মা।আগের দিদিমনি গ্র্যাজুয়েটতো ছিলেনই, আরও কত ডিগ্রি ছিল। আমাকে আগে বি.এ. পাস করতে দিন। আপনারা বাবার বন্ধু। দেশের বরেণ্য মানুষ। আমাকে চাকুরির মোহে জড়িয়ে দেবেন না। আমার কান্না পেয়েছিল। আমি পড়তে চাই।
মুজিবর রহমান সাহেবকে আমি খালু ডাকতাম। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি আমার মনের অবস্থা টের পেলেন। তক্ষুনি বললেন, তোমার পড়ার সুযোগ আমরা করে দেব। সে বিষয়ে আমরা দায়িত্ব নিচ্ছি। তুমি আমাদের বাচ্চাগুলোর ভার নাও মা গো। কাল সকালে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব স্কুলে আসবেন। আমরা তোমাকে সেখানে উপস্থিত পাবতো, কী বলো?
একদিকে নিজের উচ্চশিক্ষা লাভের আকাঙ্খা, অন্যদিকে দেশের মেয়েদর প্রাথমিক শিক্ষার রুদ্ধ দুয়ার, আমি মহাসংকটে ভারাক্রান্ত। শেষে গুরুজনদের আগ্রহ এবং আদেশও বটে, মাথায় তুলে নিলাম। আমার যা হয়েছে, অন্য মেয়েদের ততটুকু এগিয়ে যাওয়ার পথতো একবার খুলে দিই। ষোলই অক্টোবর, উনিশ’শ সাতচল্লিশ সাল। স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার রুমে বিকেল চারটায় ম্যানেজিং কমিটির মিটিং বসলো। সভাপতি ডি.এম. আহসান-উল-হক (কিংবা উদ্দিন হবে) আই.সি.এস। শুকনো মুখে হাজির হলাম। সেখানে সিদ্ধান্তে লেখা হলো, আমাকে হেড মিস্ট্রেস-ইন-চার্জ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য ডি.পি.আইকে অনুরোধ এবং সে সাথে অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকার অনতিবিলম্বে নিয়োগ প্রদান। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মৃদু আপত্তি করলাম। ওখান থেকে কোনো শিক্ষিকা আসবে না। আসেও যদি মেইল টিচার আসবে। এতে স্কুলের লাভ হবে না। আমরা পর্দানশীল। ছাত্রী আসবে না স্কুলে। সভাপতি আমাকে আক্রমণ করলেন, তাহলে আপনি একা চালাবেন? নোয়াখালীতে শিক্ষিত মহিলা পাবেন কোথায়?
কেন? আমাকে এঁরা খুঁজে বের করেননি? আমার মতো দেশের বাইরে যারা ছিলেন, অনেকেই ফিরে এসেছেন হয়তোব।। আমার এডুকেশন কমপ্লিট হয়নি। কিন্তু আরও শিক্ষিত মেয়ে পেতেও পারেন। আমাকে সপ্তাহখানেক সময় দিন, আর যদি আপনার জিপটা দিতে পারেন, দূেও চলে যাব, এখানে চমৎকার একটা হোস্টেল আছে, দেখেননি? ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট বয়স্ক এবং মেজাজী শুনেছিলাম। কিন্তু উনি একটুও রাগলেন না। হাসিমুখে কথা বললেন, Then alright,you willget my Jeep. But mind it,you have challanged me.
এক সপ্তাহ পর মিটিংয়ের তারিখ দিয়ে তিনি গটগট করে বেরিয়েগেলেন। ঘরে ফিরে আসতেই আমার ছেলেকে দেখলাম। নানী আর তার রাঙখালার সঙ্গে বলে যাচ্ছে—‘তুমি ম-ল (ময়লা) হাত ধোও, জামা খোলো… বাইরের থেকে এলে কাপড় ছাড়তে হয়।’ ওর কচি কন্ঠের কথায় হাসির ঢেউ উঠলো ঘরে। আমার মা আর বোন বেশ তৈরি করেছে তো।
স্কুলের কার্যভার নেয়ার বৈতরণী
নিজের এলাকা নিয়ে সকলের একটা গর্ব থাকে, আমার আছে। তবে এরকম সাহস ও দৃঢ়তার সাথে বলা, তাও আবার একজন ঘাগু আই.সি.এস. ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে! অবিমৃশ্যকারিতা করলাম কি? সন্ধ্যা থেকেই ভাবনায় কাতর। আমার অভিজ্ঞতা কতটুকু? ঐ তো কলকাতা-নোয়াখালী আর ফেনী দৌড়াদৌড়ির মধ্যেই আটক। আত্মীয়-কুটুম্বদের শোনা কথা সম্বল করে এতটা বড়াইয়ে নামতে কেন যে গেলাম! জিহ্বায় লোনা স্বাদ লাগতেই বুঝলাম, অলক্ষ্যে দাঁতে ঠোঁট কেটেছি এবং বেশ খানিকটা রক্ত ঝরিয়েছি। ভালমতোন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি তো! দেশ বিভক্ত হওয়ার সময় কলকাতায় দেশের সঠিক খবর পেতাম না। অতঃপর ফিরলাম, নোয়াখালী শহরে নয়, সোজা ফেনীর শেষ প্রান্তের গ্রামে। এদিককার কোন খবর জানি না। অথচ কয়েক জন দেশ নেতা এবং অভিজ্ঞ প্রশাসকের মুখের ওপর কত বাহাদুরি করে এসেছি। সারারাত জেগে কাটিয়ে কোন সুরাহা করতে পারলাম না, কিভাবে আমি উৎরিয়ে উঠবো।
ভোরে দেখলাম এক চমৎকার দৃশ্য। চোখ জুড়িয়ে গেল। নামাজের চৌকিতে আমার দুই সন্তান নানার দু পাশে বসে তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে দরূদ পাঠ করছে। মা নাস্তা সাজিয়ে ডাকছেন, আজ কি কাছারি নেই? পেটে ভুখও নেই। সাহেব-বিবি দুজনে সব হাতিয়ে নিয়েছে? অন্য সময় হলে এ আনন্দে আমিও যোগ দিতাম। কিন্তু তখন আমার ‘শিরে সংক্রান্তি। অভিমানী হয়ে বললাম, আমি বুঝি তোমাদের কেউ নই? ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কি সব গোলমেলে কথা বলে এলাম, কেউ আমাকে থামিয়ে দিল না। এখন আমি কি করবো, কোথায় পাব স্কুলের জন্য মেয়ে টিচার। খুবতো বড় গলায় বলে এলাম।
আমার কথায় মা আশ্চর্য হন। বলেন, কেন সোবহান সাহেবের মেয়ের কথা ভুলে গেলি। রাজিয়া তোর খোঁজে একদিন এসেছিল। জিপ গাড়িতে। আরও কয়েকজন অফিসারের বিবি ছিল ওর সাথে । বলে গেল ও এখন এখানে আছে।
মায়ের কথা কয়টিতে আমার খুশি টগবগ করে ওঠে; হুট করে সালাম করে নিয়েই গপাগপ পিঠা (খোলাজাঁই) আর মুরগির গোস্তের সুরুয়ায় ডুবিয়ে খেতে লাগলাম। মা ধমকে উঠলেন, “কিরে হাত ধুলি না? পা ধুয়েছিস?’ আমি কথা বলারও সময় দিলাম না, আমার এখন অনেক কাজ। তৈরি হব, কখন আবার ঐ বাঘা ম্যাজিস্ট্রেট জিপ পাঠিয়ে দেয়।
সকাল দশটার পর জিপ এলো। আমি সোনাপুর ডিস্ট্রিক্টবোর্ডের চেয়ারম্যান অফিস ছাড়িয়ে কিছুদূর এগিয়ে রাজিয়া আপাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হই। আমাকে দেখে রাজিয়া মতিন চৌধুরী খোঁটা মারলেন। বিয়ে বুঝি আর কোন মেয়ের হয়নি। তাদের স্বামী, শ্বশুর বাড়ি নেই, তাই ভেবেছিস? লেডি ব্রাবোর্নের ছাত্রী-গ্রামে ভেরেণ্ডা ভাজতে গেছিস তুই। আয়, বস। আমি, তোর খোঁজে গিয়ে পাইনি। আমি হেসে বলি, আমি আপনার কাছে ছুটে এলাম, আর আপনি আমার পেছনে লাগলেন। কত খুশি হয়েছি আপনি নোয়াখালীতে আছেন। সারারাত এক ফোঁটাও ঘুমাইনি।
অতঃপর আমার না ঘুমানোর হেতুটি ব্যক্ত করতেই রাজিয়া আপা প্রাণস্পর্শী সাড়া দিলেন। বললেন, সময়টা কিভাবে কাটবে ভেবে ঠিক করতে পারছিলাম না। তোর দুলাভাই আমেরিকায় ডক্টরেট করতে গেলেন, কত দিন লাগবে, বলেছেন তো দুই-আড়াই বছরে কমপ্লিট করে চলে আসবেন। আমাদের ছেড়ে বেশি দিন থাকতে পারবেন না। তারপর তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইলেন। আমি ভাবলাম বুঝি স্বামীর বিরহের নমুনা কিছু আমাকে দেখাচ্ছেন। তিনি তো জানেন না, আমি কি অবস্থায় আছি। কলকাতার সুখের সংসার নেই। ঢাকায় নতুন করে সংসার পাতার স্বপ্নও বুঝি নেই। স্বামী চাকরি ছেড়েছেন। ঠিকানা করতে পারছেন না। ভবঘুরে হয়ে এ বাড়ি ও বাড়িতে পড়ে রয়েছেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস আমারই ফেলার কথা।
আমার চুপ থাকা দেখে রাজিয়া আপা আমার একখানা হাত টেনে বুকে। ধরলেন, জানিস, আমার ছেলেটা মারা গেল! কচি শিশু কেন এমন চলে গেল! লাকির পর ছেলেটা হয়, ওর বাপ দেখতেও পেল না। কথার সঙ্গে চোখের কোণে পানি চিক চিক করছিল। আমি মুছিয়ে দিলাম আঁচল দিয়ে। বললাম, স্কুলে কাজ নিলে হোস্টেলে থাকবেন, মন শান্ত থাকবে। আপনার নাম, শিক্ষাগত যোগ্যতা জাতীয় মামুলি কথাগুলো যদি আমাকে এখন দিতেন, উপকার হতো। চটপট লিখে দিলেন। রাজিয়া আপা। হাতের লেখাও স্বচ্ছ ও সুন্দর। তদুপরি তার থেকে পেলাম মিসেস ফাতেমা খাতুনের ঠিকানা, ঢাকা ইডেন হোস্টেলে থেকে আই. এ. পড়েছেন। ঐ কাগজে নামটা লিখেও দিলেন আপা। অতঃপর গেলাম সুফিয়া খাতুনের বাসায়। আমার স্কুল মেট, একসাথে। ম্যাট্রিক পাস করি। ওর তখন বিয়ে হয়েছে, স্বামী নোয়াখালী জেলা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। ওরাও সানন্দে রাজি। এমনকি ওর স্বামী ওকে হোস্টেলে থাকতে দিতেও সম্মত। একদিনের অনুসন্ধানে চারজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষিকা পেয়ে আমার গর্ব ধরে রাখতে পারছিলাম না। দেরি না করে এদের নিয়ে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত সকলকে ঐ দিনই জানিয়ে দিলাম। আমার সেই এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে আরও দুজন শিক্ষিকার নাম পেলাম— একজন রেণুবালা, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আই. এ. পড়তো। বাবার সাথের একজন উকিলের মেয়ে। অন্যজন ঢাকার মুন্সিগঞ্জ থেকে ভার্নাকুলার ট্রেনিং প্রাপ্ত জহুরুন নেসা। দুই ছেলে রেখে স্বামী হঠাৎ মারা যান। চাকরি পেলে হোস্টেলে চলে আসবেন জহুরুননেসা। বাসন্তী চক্রবর্তী বলে অন্য এক মেয়ে স্কুলে কাজ করতে চায়, ওর বাবাও জজ কোর্টের উকিল। কলকাতা যাবে না। গান ও শরীর চর্চার জন্য একে উপযুক্ত মনে হল। দেখা গেল আমি এক সপ্তাহের মধ্যে সাতজন শিক্ষিত মেয়ে, যারা চাকরির জন্যে নয়, স্কুলটা বাঁচাতে এগিয়ে এলো এবং আমিও আই.সি.এস. ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাসিমুখে উপস্থিত হয়েছি। বিনয়ের সাথে বলেছি, আগের দিদিমনিদের বিদ্যা ও যোগ্যতার সমকক্ষ আমরা না হলেও আমরা তাদের ছাত্রী। কিছুটা হলেও তাদের গুণ আমাদের মধ্যে তারা রেখে গিয়েছেন। স্কুলটা চালু করার অনুমতি দিন। উনি গুরুগম্ভীর মানুষটি সহাস্য হয়ে উঠলেন। ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্তগুলো নিজেই লিখলেন। সই করে ফাইলটি চাপরাশিকে দিলেন। ঢাকায় ডি. পি. আইতে তিনিই পাঠাবেন। উঠে যাওয়ার সময় মুখে চমৎকার এক টুকরো হাসি। বললেন, নোয়াখালীকে সারা ভারতবর্ষ কেন চিনে আমি আজ দেখলাম, কেন মহাত্মা গান্ধী লাঠিভর দিয়ে নোয়াখালীতে চলে এসেছিলেন। উইস ইউ গুড লাক।
সেই তো যাত্রা শুরু। সবাই চলে গেলেন আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে স্মৃতিচারণ করেছি। এই স্কুলের এই চেয়ারে শিশিরদি বসেছিলেন, আমি ক্লাস সিক্সে বৃত্তি পেয়ে নমস্কার করে বেরিয়ে গিয়েছি। উনি মাথায় হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন বুঝি এই! তার মনের টানেই কি আমি তার কক্ষে এসে সেই দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছি! কোথায় আমার ঢাকা যাওয়া, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, সব জলাঞ্জলি! চোখ। কড়কড় করে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। চেয়ারে বসতে পারলাম না। মাথা ঠেকিয়ে রাখলাম সুন্দর ফুল লতা কাটা সেগুন কাঠের চেয়ারটির মাথায়! আশীর্বাদ পাওয়ার আকাংক্ষা রয়েছে অন্তরে। নিরাশ করেনি আমার স্মৃতি। স্পষ্ট তার গলা, বলছেন, এই টাওয়েলটা ফেলে দিলাম তোর সামনে; উথলে পড়া দুধ তাড়াতাড়ি মুছে নে, সুরমাদি দেখবার আগে মুছে নে। মার্ক কেটে দেবে। তোর উপর আমার অনেক আশা। বৃত্তি পরীক্ষায় পায়েস রান্নার সময় দুধ উথলে পড়লে তিনি জানালা দিয়ে টাওয়েল নামিয়ে দিয়েছিলেন। এমন সতর্ক দৃষ্টি ছিল তার। মনে করলাম আজও তেমনি সতর্ক করে দিচ্ছেন। জীবনে এমনি ঘটনা এসে পড়লে সেটি সামলাতে হয়, মন খারাপ করে হাল ছেড়ে দিতে হয় না।
বাড়ি ফিরে আসার পর শরীর খুব দুর্বল লাগছিল। শুয়ে পড়ি। মা জানালেন, ‘সাকীর রানের উপর লালচে হয়ে একটা ফোড়ার মত দেখা যাচ্ছে। গায়ে জ্বর। কেবল আব্বা আব্বা করছে। জামাই আসেও না, চিঠিও নেই। তোদের এসব আমার ভাল লাগে না।আমি চুপ, বলার কিছু নেই। মাও মেয়েকে কাছে রেখে চলে যান। বুঝলাম তার কষ্ট কম নয়। স্নেহের অভাব কি দিয়ে পূরণ করবেন তিনি। ঐ ফেঁড়াটা কাটার সময়ও সাকী বাপকে ডেকে ডেকে কেঁদেছিল।
সে সময় আমার বোন নুরজাহান ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করেছে। ওকে বিয়ে দেয়া ও নিজেই গলাবাজি করে ঠেকিয়ে রেখেছিল, ‘আপাকে বিয়ে দিয়ে তোমাদের শিক্ষা হয়নি? না হোক, আমি আপার মত তোমাদের লক্ষ্মী মেয়ে নই। ম্যাট্রিক পাসের আগে বিয়ে দিতে চাইলে গোলমাল বাঁধিয়ে দেব।’ পরীক্ষা শেষ হলে পর ওর কাজ শুরু হল ঘরদোর সাজানো, ক্রশের সূক্ষ্ম লেইস বুনে যেত, টেবিল ক্লথ দু দিনে বুনে ফেলতো। আর ঘর-লাইব্রেরিতো ছিলই। শৃঙ্খলামত ঐসব বই নাম্বারিং করে সাজাতো। তার সাথী ছিল বোনের ছেলে বাহাদুর। দুজনে হাসি খুশিতে জমে থেকে কাজ করতো।আমি ব্যস্ত স্কুল নিয়ে। মুশকিল দেখলাম, যাদের পড়াবার আগ্রহ নিয়ে স্কুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছি তারা অনুপস্থিত। মুসলমান মেয়ে হাতে গোনা। ভাবলাম দেশ ভাগ করা সাপোর্ট করেছি। অবহেলিত, শিক্ষা বিমুখ মুসলমান জাতির জন্য সুযোগ-সুবিধা এবং পরিবেশ দরকার। এখন পরিস্থিতি এমন কেন। আমরা যে আগের মত সেই তিমিরে রয়েছি। ঘা দিতে হবে, কিন্তু কিভাবে কুসংস্কারে মজে থাকা মানুষগুলোকে জাগিয়ে তুলবো! প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নিজেরা বোরখা পরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। পাকিস্তান হয়ে যাওয়ায় ভারতের বিভিন্ন এলাকার মুসলমান পরিবার নোয়াখালীতে চাকরি এবং ব্যবসা উপলক্ষে আসেন। তাতে বোরখা ও সালওয়ার-কামিজ পরার নিয়ম দেখে তারই আশ্রয় নিলাম। আমরা ইসলামী কায়দায় চললে মুসলমান পরিবার স্কুলে মেয়ে পাঠাবে, ধরে নিলাম। কাজ হয়েছিল, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। ছাত্রী পেলাম, কিন্তু অধিকাংশই মায়ের শাড়ি পরে স্কুলে আসে। এ ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই সালওয়ার কামিজ প্রথমবারের মত স্কুলে সেলাই করে দিয়ে ওদের পরিয়েছি। রঙিন থান কাপড়ের গজতো ছিল মাত্র চার আনা। এ পয়সা নিজেরাই খরচ করতে পেরেছি। ফাতেমা খাতুন নিজের ব্যাগে চিরুনি ক্লিপ রাখতেন। নোংরা চুলছাড়া মেয়েদের ধরে চুল আঁচড়িয়ে দিয়ে ক্লিপ এঁটে দিতেন। দাঁত, নখ পরিষ্কার করার কাজও আমরা করে দিতাম।বাড়ি থেকে এসব শিক্ষা খুব কম মেয়ের ছিল দেখতাম।হেঁটে হেঁটে লোকজনের বাড়ি কি করে যেতাম,আপনার মেয়েকে স্কুলে পাঠান, দেশ স্বাধীন,মেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে হবে ইত্যাদি কথা যে বলেছি… কেউ শুনেছে,কেউ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে … তবু হতাশ হইনি। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।
নোয়াখালীর লোকদের ধর্মপরায়ণতার দিক সকলে স্বীকার করবেন।এতে আমাদের কাজের একটা সুবিধার দিকও ছিল।ঘরের শিক্ষার অভাবে স্বভাবত অনেক মেয়ে অবাধ্য হতো।পড়া তৈরি করতো না।শাস্তিস্বরূপ খাতায় রুলটানা স্কেল দিয়ে হাতে পিটুনি দিতে হয়েছে।এতে অভিভাবকদের রাগ হতো না।উল্টো বলতে শুনতাম,- ওস্তাদ যেখানে মারেন,দেহের সে অংশ পবিত্র, বেহেস্ত পায়। শাসন ও অন্যান্য নিয়ম-কানুন ফিরিয়ে আনতে সময় লেগেছিল।তবে শেষ পর্যন্ত স্কুলটি সুন্দরভাবে দাঁড়িয়ে গেল। নিয়ম-শৃংখলা ফিরে আসার পর, শিক্ষিকাদের মনে বাৎসরিক পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা-ভাবনা আসে। তারা নতুন প্রেরণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ধৈর্য এবং সহনশীলতা মস্ত বড় গুণ।এ দিয়ে তখন আমরা সংকট কাটিয়ে উঠেছিলাম।
অমানুষিক পরিশ্রম যাচ্ছে আমার। নিজের শরীর ভারি হতে চলেছে।তা ও বুঝি মনে আসতো না। নোয়াখালী শহর মেঘনার ভাঙনের কূলে। রাস্তা বড় হলেও দু পাশে খাল,কাঠের পুল,বাঁশের সেতু দিয়ে।মানুষের বাসাবাড়িতে যাওয়া। গরমে বোরখা পরে, রাতের বেলায় কী করে যে গিয়েছিলাম, জানি না। মা আমার সাথে পেরে উঠতেন না। রাতে বাবাকে পেয়ে বকছিলেন একদিন।মেয়েটাকে মরণের রাস্তায় নামিয়ে দিলেন? ওর জামাই পড়ে আছে ঢাকায়, নতুন জায়গায়। তার চাকরি নিয়ে বিপদে। আপনের কিছু করার নেই? বাবাকে বলতে শুনলাম, না। ঐ চাকরির দরকার নেই, আমাদের বলেছিল ‘ল’ পড়ছে।তার সেই পড়া শেষ করতে বলেন, এবার সরকার এক সাথে দু’পার্ট পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দিয়েছে। এ সুযোগে পরীক্ষা দিতে পারে সে। ঢাকাতেই তো আছে।
বাবার মনোক্ষুন্ন হওয়ার কথাগুলো আমাকেও ব্যথিত করে। ঘরের মাঝের বেড়াটি পাকা দেয়ালের ছিল না। নিজ বিছানায় শুয়ে শুনতে পেলাম। স্কুল নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত থেকে নিজের আপন লোকের কথাই ভুলে রইলাম! মা-বাবা ঠিকই ভাবছেন। ভীষণ স্বার্থপর আর অকৃতজ্ঞ মনে হতে লাগলো নিজেকে। আমাদের সুখের জন্য কলকাতায় সে কত কি না করেছে, মান-সম্মান গায়ে না মেখে বাড়ির ভেতর কামরাগুলো ভাড়া খাটিয়েছে পর্যন্ত। মা-বোনদের সাথে আমার পড়া নিয়ে মতবিরোধ করে আলাদা হল শেষে। তারই বিরহে আমি কাতর হলাম না-এই আমি? কান্না দিয়ে বালিশ ভিজিয়ে শান্ত হই। পরে দেখলাম এ কান্নায় মুক্তা ঝরেছে, দুদিন পর উনি এসেছেন। জানেন না আমরা কোথায়, ফেনী পর্যন্ত গিয়ে শুনলো আমার কীর্তি… পাঠশালা খুলেছি, বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়ে যোগাড় করি … অতঃপর নোয়াখালীতে না এসে পারেন!
শ্বশুর বাড়িতে জামাই আসলে তার আলাদা সমাদর। আমার মা আর একটু বেশি করেন। জামাইও শাশুড়ি মা পান খান, তার জন্য সুগন্ধী জর্দা এনেছেন। আমিও বাদ নই, ঢাকার শাড়ি, ব্লাউজ (রঙ মেলানো), স্যান্ডেল, বাচ্চারা পেল কমলার ঝুড়ি, আপেল আর বেদানা-আনার, বিস্কুট এসব। কিন্তু ওকে দেখে চেনাই যাচ্ছিল না, মাথার চুল প্রায় সবই পেকে ধবধব করছে। সুন্দর গায়ের রঙ পোড়া তামাটে। শুকিয়ে অর্ধেক। তিনি আমাদের বিমূঢ় দৃষ্টির জবাব দিলেন, ঝামেলা যাচ্ছে। আর যা-তা রান্না খেয়ে আমাশা হয়ে গেল! অতঃপর আমাকে বলেন, তুমিও শুকিয়ে গেছ, আমারও চাকরি নেই, ঘর নেই…. তুমিও বিপদে আছ দেখছি। সকলে বলছে-সরকারী কেইসে কেবল তারিখ পড়ে, বাদি কোনদিন জেতে না। আমি এসব বুঝি। কিন্তু ছাড়বো না। • শেষ দেখে নেব। কিন্তু ঐ চৌধুরীর ব্যাটা হামিদুল হক তা হতে দিচ্ছে না। আমাকে তার অর্থ মন্ত্রণালয়ে সেকশন অফিসারের লোভ দেখায়। আমি ওসব লোভে পড়ার মানুষ নাকি! বল দেখি! ‘ল’ পরীক্ষা দেয়ার ফিস জমা দিয়ে এলাম। স্বাধীন কাজই করে খাবো।এমন খুশি হলাম যে, পট করে জিজ্ঞেস করি ….খুব ভাল। দুটো পার্ট দিচ্ছতো? এবার নাকি গ্রেট চান্স দিয়েছে সরকার। আমার কথায় তাকে রাগ হতে দেখি; আমার থাকা-খাওয়ার জায়গা নেই, কোনমতে ইকবাল হলে একজনের সাথে শেয়ার করে থাকি। তোমাদের সন্তুষ্টি নেই তাও … দুটো পরীক্ষা দেয়ার শরীর আছে আমার যে দেব!
এ কথার উত্তর দেয়ার এবং উত্তর জানার সময় এবং অভিজ্ঞতা আমারও কম। বিশ বছর বয়সে আমার শরীরের উপর দিয়ে কি কম যাচ্ছে? অল্প বয়সের মধ্যে তিনটি অপগণ্ড শিশুর মা হতে যাচ্ছি। আয়ের কোন সংস্থান নেই। পিত্রালয় থেকে সমাজ আর সংসার নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। অভিমানে গলা ধরে গিয়েছিল। বলেছিলাম, শরীর কি আমার ভাল? কিন্তু যা ভাল, যা অত্যাবশ্যক তা তো করতে হয়। আমার কথাগুলো তার কাছে আরও খারাপ লাগলো! এবং দুদিন থেকে আবার চলে যান। আমি কান্নাকাটি দিয়ে পথ রোধ করতে ব্যর্থ হই। ভীষণ দুঃখ পেলাম। যার জন্য এত ভাবি, সে বোঝে উল্টো। ছেলেরা কি মেয়েদের মনের মূল্য দিতে চায় না? শিখেছে কেবল তেজ দেখাতে? পুরুষরা এ রকম করতে পারে কি করে! সমাজে তাদেরকে এই বলে উৎসাহ দেয়া হয়—পুরুষ রাগ করে চললে হয় বাদশা, আর মেয়েরা হয় বেশ্যা! ছিঃ মেয়েদের পতিতা হতে হয়। হতেই হবে। লেখাপড়া না শিখলে, মুখ বুঝে নির্যাতন সয়ে গেলে উপায় কি আর আছে একজন নারীর ভাগ্যে! নিজেকে অতঃপর দুঃখিত না ভেবে ভাগ্যবতী দেখতে থাকি। আমায় একটি স্কুল চালাতে হয়, কত মেয়ে আমার কথা শুনছে। ওদেরকে নিজের মূল্য বুঝতে দিতে হবে। রাগ মানুষ মাত্রেরই হতে পারে। ছেলেমেয়ে বলে তফাৎ কেন হবে। স্কুলে আপাদের নিয়ে এ ধরনের আলোচনায় বসতাম আমি। ওরা ভাবতেন, স্বামীর ওপর রাগ করে আমি আলাদা হয়ে আছি এবং সমর্থন চাচ্ছি। কিন্তু আলোচনার সুফল অতি সত্বর পেতে লাগলাম। আমাকেই যদি ভুল বুঝবে অন্যরা, তাহলে স্কুল চালাই কি করে। আল্লাহ আমাকে এভাবে বদনাম থেকে মুক্ত করেছেন।
সময়পূর্তির এক মাস আগে কায়ক্লেশে একটি ছেলের জন্ম দিলাম। স্কুল থেকে ছুটি নিলাম না, আবার দশদিন গেল মাত্র স্কুলে হাজির হলাম। নিজকে পার্ল বার্কের গুড আর্থের নায়িকা বানিয়ে ছেড়েছি। শস্যের ক্ষেতে ফসল তুলতে এলে মাঠে নায়িকার প্রসব বেদনা উঠে; অন্য এক বর্ষিয়সী, শাশুড়ি হবেন, তাকে ঘরে নিয়ে আসেন, সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। তারপর কয়েকদিনের মধ্যে প্রসূতি স্বাভাবিক জীবনে নেমে আসে। আমার মা আমাকে বললেন কৃষাণ-মজদুর পরিবারের মেয়ে হয়েছি আমি। তারা বাচ্চা পেট থেকে নামিয়ে আবার কাজে লেগে পড়ে; কাঁখে কলসি তোলে, চেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল খুঁটে বের করে, এমনি সব। আমি খুশি মনে মায়ের বকুনি হজম করি, বলি তোমার মেয়ে এখন কাজ করে খায়। কর্মী মেয়ে। শরীরে যা সওয়ার সইবে। স্কুলে একদিন তোমায় নিয়ে যাব। দেখে মন আনন্দে মেতে উঠবে। সালওয়ার-কামিজ পরা বড় বড় মেয়েরা কি সুন্দর স্কুলে আসছে, লেখাপড়া করছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শিখছে। আমার ছোটফুফু, যে ঠোঁট কাটা আগেও লিখেছি, তিনি আমার কাজকর্ম দেখে নাম দিলেন। ইউরোপের মর্দা মেয়ে।
স্কুলের হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। কচি কচি শিশু পালতে সুবিধা পাব তাই। বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা এবং ঘর থেকে ছুটাছুটি করে না। এলে শরীর কিছুটা বিশ্রাম পাবে, এ দুটো বিষয় চিন্তা করলাম। একজন আয়াও পেয়ে গেলাম। স্কুলের পিছনের দিকে সামান্য দূরে সরকারী হাসপাতাল ছিল। তখন সমস্যা দেখা দিল, অর্থের যোগাড় ছিল না। খাওয়া সম্পূর্ণ মা পাঠাতেন। কিন্তু অন্য খরচ? আমার হাতে যা টাকা ছিল, সবই শেষ অনেক আগেই। ছয়মাস গত হয়ে গেল চাকরি করছি, বেতন পাই না। কারণ ডি.পি. আই আমাদের নিয়োগ দিল না। বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়মমাফিক নিয়োগ হয়নি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুপারিশ করেছেন। ভাল কথা। এডভারটাইজ করা হলে আমাদের দরখাস্ত করতে বলা হল। আমরা খুবই মুষড়ে পড়ি। স্কুলকে উঠে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেরা ধুঁকে ধুঁকে মরবোনাকি? তবে স্বাধীন দেশ হওয়ার দরকার কি ছিল। ব্রিটিশরাই ভাল ছিল। সবাই ক্ষেদোক্তি করেও সান্ত্বনা পেলাম না। আরও অপেক্ষা করতে থাকি। শিগগিরই বিজ্ঞাপন চোখ পড়তে পারে। মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কোন সুরাহা না পেয়ে মনস্থির করলাম, ঢাকায় ডি. পি. আই অফিসে যেতেই হবে।
ভাঙাগড়ার কবলে
‘লঙ লীভ দি কিঙ’ শব্দে লিখিত একটা গান। শৈশবে আমরা সুর মিলিয়ে গলা ছেড়ে সারা স্কুলের মেয়েরা কয়েকবার গেয়েছিলাম। সমুদ্র পেরিয়ে ব্রিটিশ দ্বীপের রাজা দীর্ঘায়ু হবেন, এ যে সাম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষণ, তা হোক। আমরা লেখাপড়া শেখার জন্য সুন্দর স্কুল পেয়েছি, পরিবেশ পেয়েছি। কলকাতার দিদিমনিরা এই সুবিধা পেয়েই তো এসেছিলেন, এখন সব আমাদের। এই বোর্ডিং হাউজ, বেশ বড়, দোতালা একটি বাড়ি, উপর তলায় আগের মত আমরা থাকছি, নিচে লাইব্রেরি, টিচার্স কমন রুম নিয়ে বড়দির ঘর এবং অফিস। আগে পিছে চওড়া বারান্দা-লাগোয়া ফুলের বাগান। প্রশস্ত খেলার মাঠ ও বাংলো ডিজাইনের বড় বড় রুম নিয়ে মস্তবড় স্কুলঘর। সাজানো-গোছানো, কোমো কিছুরই অভাব নেই। আমরা এসে আগের ট্র্যাডিশন চালিয়ে যাওয়ার পথে নেমেছি। এর মধ্যে সংকট দেখতে পেয়ে আমি বুঝতে পারি না কী করবো! আমাদের নিয়োগ এ যাবত নিয়মমাফিক করা হলো না। ব্রিটিশরা গান গাইয়ে তাও অনেক দিয়েছে। নিজের স্বাধীন দেশের লোকরা মুখে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপনের বুলি তুলে কচকচি শোনায়। দেশের মেয়েরা লেখাপড়া না শিখুক, তাতে কার কী আসে যায়? সন্ধ্যাবেলায় খোলা ছাদে উঠলে মন আরও খারাপ হয়ে যেত। এই নদীভাঙা শহরে মানুষ কত কষ্টেই না চলে। মেয়েদের লেখাপড়ার কথা ভাববার সময় পায় না। সরকারও ভাবে না। আমি কেন নিজের কথা বাদ দিয়ে এনিয়ে ছটফট করছি?
স্কুলে কাজের সময়, সব ছেড়ে দিয়ে যেন মনে হতো এক কর্মশালায়,কাজে পরিব্যাপ্ত রয়েছি, আমার ছুটি নেই। বেতন না থাক কাজ করে যাব।কিন্তু নিস্তার নেই। আমার কাজের দাবি থাকবে তো ঐ নিয়োগপত্রে। স্বামীর কাছে চিঠি দিলাম, খোঁজ নিয়ে আমাদের চাকরির বিজ্ঞাপনের কপি পাঠাও। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এখনও কিছু হয়নি, অফিসে কাজের লোকের অভাব। কলকাতার সেই ছোট্ট মোহামেডিয়ান এডুকেশন সেকশন ঢাকায়। বদিয়ার রহমান সাহেবের সাথে কথা বলে লাভ হলো না। তারা বিজ্ঞাপন দেবে না। কোনো বুড়ো মাস্টার পেলে তোমাদের ছাড়িয়ে দেবে। চিঠিটা কোন কাজের কথা বয়ে আনেনি। আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। দেশপ্রেমিক নেতাদের ডাকে আমি পথে নেমেছি, দৃঢ়তার সঙ্গে আই. সি.এস ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়েছি। আমি বিশ্বাস করি এই পথই আমকে সাফল্যের পথেটেনে নেবে। ডি.পি. আইতে যাওয়ার জন্য ঢাকার ট্রেনে উঠি অতঃপর। একাকি চলেছি, সম্বল আমার মনের বল। ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে সোজা কমিশনার্স বিল্ডিং হাতে ইন্সপেকট্রেস অব স্কুলস-এর চিঠি। তিনি মিসেস ম্যাকোনাল।
সাক্ষাৎকারের সময় এগারটা। তিনঘন্টা ঠাঁয় বসে থাকি খুঁটি গেড়ে। সময় হলে পর, ভিতরে এসে হতভম্ব। এযে আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব, লেডী ব্রাবোর্ন কলেজের ভূগোলের অধ্যাপিকা মিস বেকার! তাহলে বিয়ে করে ম্যাকোনাল হলেন! তিনিও আমাকে একজন ভাল ছাত্রী হিসেবে চিনেন, জানেন। আমার সমস্যার কথা শুনে কি ভেবে তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। একটা কাগজ বের করে বললেন, * আই হেভ রিসিভড এ গুড রিপোর্ট এবাউট ইউর স্কুল, দিস উইল ডু? আমার জন্য অর্ডারলিকে চায়ের কথা বলে ছোটখাট স্কার্ট পরা মেমসাব নিজেই কাজে লেগে গেলেন। এদিকে ব্রিটিশ কায়দায় টি পট ইত্যাদির শোভায় ট্রে সাজিয়ে রাখে অর্ডারলি। মেমসাবও এককাপ নিলেন, আঙ্গুলে সিগারেট। পি. একে ডিক্টেশন না দিয়ে নিজেই টাইপ মেসিনে বসে গেলেন। আমার কাছে ভোজবাজির মত পুরো ব্যাপার। তাহলে আমি আজই নিয়োগপত্র পেয়ে যাচ্ছি? হাতে যখন পেলাম কতবার যে থ্যাংক ইউ বলেছি, জানি না। উনি কাঁধে হাত দিয়ে থামালেন। হাসলেন।
বের হয়ে আসতে পূর্বদিকের সিঁড়ির নিচে একটু ঘেরা জায়গা, নেইম। প্লেট দেখি, মিসেস আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, স্পেশালিস্ট, ফিমেল এডুকেশন। আরে একে তো চিনি!খোদেজা আপার ম্যাটার্নিটি ভেকেন্সিতে কলেজে আমাদের বাংলা পড়িয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবীব উল্যা বাহার চৌধুরীর স্ত্রী। আমাদের জেলার বৌ। ঢুকেই সেলাম করি। তিনিও খুশি হলেন। আসার কারণ বলতেই কিন্তু হাসিমুখ কঠোর করলেন। ঐ মেমসাব তোমার কাজ কেন,ও সবার কাজই করবে। করবার জন্যতো এদেশে রয়েছে।ব্রিটিশ রাজত্ব গেলেও শোষণ যায়নি; বুঝলে? দেখে যাও আমি সিড়ির গোড়ায় কোন মতে বসেছি; আমার কোনো কাজ নেই।
অন্যের খেদ বুঝতে গেলে কিছু আপ্তবাক্য বলতে হয়। কিন্তু কিছু মুখে আসেনি। মেম সাহেবের মধ্যে একটা বড় মাপের দিল আছে,সেটা আমার কাছে সে সময় আবিষ্কৃত। গুরুজনকে পুনরায় সালাম জানিয়ে সোজা রেল স্টেশনে। খুশির খবর যত তাড়াতাড়ি বয়ে নিয়ে যেতে পারি,তর সইছিল না। উৎখাত হলাম না। আমরা প্রত্যেকেই বহাল হলাম,গিয়েই ছাদে বসে গা জুড়াব। মেঘনা নদীর টালমাটাল ঢেউ এর শব্দ শুনব;ঝাউ আর পবন গাছের ঝিরঝিরে মিষ্টি বাতাস আর সেই সাথে রাস্তার ওপার থেকে রওশন বাণী টকিজ’ থেকে উর্দু, হিন্দি, বাংলা যে গান বাজবে … উপভোগ করবো আমরা সবাই।
ট্রেনে বসে আমার মনে পড়লো,সিলেবাস,বুক লিস্ট এসব নিয়ে তো আনোয়ারা আপার সঙ্গে আলাপ করতে পারতাম। মাঝে মাঝে আমি খুশিতে বোকা হয়ে যাই। আমার স্বামী বেচারার ইকবাল হল খুঁজে দেখা করা উচিত ছিল।এ জীবন কেবল ভুলে ভরা। ও শুনলে কী জবাব দেব তাকে? বলব আমি না জানিয়ে ঢাকা এসেছি,এ খবর লুকাতে চেয়েছি।আনন্দের ঘোরে সব উলট পালট করে ফেলেছি। একথা তাকে বোঝাতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে অতঃপর।
স্কুল সুন্দর চলছিল। ছাত্রীরা স্কুলে আসার জন্য পাগল। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন থাকলো না। আমরা নদী ভাঙ্গা শহরের মানুষ। বারবার ভিটেমাটি ছাড়া হই। মেঘনা কখন যে ক্ষ্যাপা হয়, যতখানি ভাঙ্গার শক্তি ধরে, ইচ্ছে মতন তা বিলীন করে শান্ত হয়। এই নিয়ে মানুষ আছে, হাসে গায়, জীবনের স্বাদ নেয়। সেই তো দেখলাম পনের বছর আগে। এই শহরটি ভাঙতে গিয়ে নদী থেমে গিয়েছিল। নতুন শহরের পত্তন পর্যন্ত হয়ে গেল মাইজদিতে। জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, হাসপাতাল, জেলখানার ইমারত তৈরি করা হলো। সে সময় এই স্কুলটা করার কথাটি কেউ বলেনি কেন! নতুন নদী ভাঙার কবলে পড়ে এর অবস্থাটা কি হবে! চারদিকে তাকিয়ে আমার এতদিনের শ্রম সাধনার মৃত্যু দেখছিলাম। এবারে নদীটা বেশি রকম তান্ডবলীলা ঘটিয়ে যাচ্ছে। আজ একটা বিরাট ফাটল মাটির বুকে দেখা দিল; কালই সম্পূর্ণ অংশ নদীতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, মানুষ সরে যাওয়ার সময়ও পাচ্ছে না, জীবন হাতে নিয়ে দিশেহারার মত ছুটছে।
স্কুলের সম্পদ সরিয়ে নিতে কালেক্টরেটের নাজির সাহেব এসেছেন। স্কুলের দারোয়ান দুজনসহ আমি বসে আছি। বললাম, এবার আমাদের সবই গেল। স্কুলটার জন্য কোথায় বাড়ি ঘর পেয়েছেন, নতুন শহরে কোথায় বসবে স্কুল? বৃদ্ধ নাজির সাহেব আমার কথায় বেশ অসন্তুষ্ট। বললেন, শীতকালে নদী কোন সময় ভাঙে? এত আক্রোশ তাকে কে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা। মুসলমান মেয়েরা হিন্দুর মতো চললে আল্লাহর গজব পড়বেই। বাচ্চা মেয়েগুলো পর্যন্ত স্কুলে আসার জন্য পাগল হয়, মা বাপের হুকুম মানে না। হিন্দু মেয়েদের মতন চলে। এত পুরানো মসজিদ, কোনবার নদী ভাঙতে পারল না, এবার নিল। আমাদের মেয়েরা পর্দা-পুশিদায় থাকলে নদী ফিরে যাইতোই।
কথাগুলো আমার কানে আগেও এসেছিল। ঝি, আয়া, দারোয়ান বা লোকমুখে শুনেছি কিন্তু একজন নাজির সাহেবের মুখে কেন এভাবে শুনছি? সব পাপের ভাগ আমাকেই দিলেন তিনি। কিন্তু আত্মসংবরণ করে নিয়ে বললাম, মাফ করবেন। একটা কথা আপনাকে বলি, মসজিদ গেছে, নতুন শহরে আবার জাঁকজমকে মসজিদ উঠে যাবে। দশ বিশজন মুসলমান একত্র হলেই মসজিদ তোলেন। স্কুল গড়ার কথা কেউ ভাবেন না। আজ আপনার কথায় স্পষ্ট বুঝে নিলাম। দোয়া করেন আমাকে, নতুন জায়গায় আবার মেয়ে জড়ো করবার জন্য আমিও আছি। কোন লোক আমাকে একটা স্কুল ঘর বানিয়ে দেবে না। না দেয়, আমাদের একটা আলাদা ঘর আছে। সেখানে চালু করে দিয়ে আন্দোলনে নামবো, সরকার স্কুল বানিয়ে দেবে। মেয়েদের লেখাপড়া ধর্মে মানা নেই। চাবির গুচ্ছ নাজির সাহেবকে দিয়ে উপর তলায় চলে এলাম।
নিজের মালপত্র গোছগাছ করছিলাম আর ভাবছিলাম, অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে আমাকে। মেয়েরা কি উৎসাহ আর কলরব করে স্কুলে আসত, এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করতে গিয়েই তা বন্ধ ঘোষণা! তাহতে দেব কেন? উমা গার্লস স্কুলের তখন স্থানান্তর হতে বেশ দেরি, নদী সবে তো অফিসপাড়া, মসজিদ আর বড় বড় বাণিজ্যিক এলাকাকে গ্রাস করেছে। শহরের পশ্চিম দিকের মধ্যবিত্ত এলাকায় নদী পৌছতে ঢের দেরি হবে। বেশির ভাগ ছাত্রী ওদিক থেকেই আসে, এসব কথা মনে হতেই সাহসী হয়ে যাই। স্কুলের আপাদের থেকে জানতে চাই, উমা স্কুলে সকাল বেলায় মর্নিং শিফট করতে রাজি আছেন কিনা। তাদের উৎসাহ দেখে আমি আর দেরি না করে উমা স্কুলের তখনকার হেডমিস্ট্রেস প্রীতিদিকে (তিনি আমার শিক্ষক, স্কুলের ভিতরে বাস করতেন) আমার বক্তব্য জানাই। তিনি সহৃদয় হাসি দিয়ে বললেন, তোমার স্কুল বন্ধ হলে আমারও বন্ধ হতে বাধ্য। তোমার থেকে সিক্স পাস করে মেয়েরা এখানে পড়তে আসে। কিন্তু চেয়ারম্যান রয়েছেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন, তাদের অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করতে পারি না। বুঝতে অসুবিধা হল না। তিনি সুচতুর কৌশলে আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। বোরখা পরিহিতা আমি, শীতেও কাপছিলাম, অতখানি পথ হেঁটে আসা এবং ব্যর্থ হয়ে আবার ফিরে যাওয়া, তার সামনে প্রায় ভেঙ্গেই পড়ছিলাম কান্নায় আর না পাবার ব্যাথায়। কিন্তু মন বলে উঠে, অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে, যেতে হয় যাব সবার কাছে কিন্তু স্কুল বন্ধ করতে দেব না।
স্কুলের দুই কর্তা ব্যক্তির একই কথা। আমি অনর্থক ঝামেলা করছি। স্কুল নদীতে ভেঙ্গে যাচ্ছে। নতুন শহরে লোকজনের বসত ঠিক হলে তখন চালু হবে আবার। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আশ্বাস দিলেন। শিপ্টের জন্য খরচ লাগবে আপনাদের, ছয় মাসের বেতন এডভান্স করিয়ে দেব, ভাববেন না। আমি তখন মরিয়া, উল্টো প্রশ্ন করলাম। অনুমতি দিতে কি আপনার কোন অসুবিধা আছে? ডিস্ট্রিক বোর্ডের চেয়ারম্যান কি আপনার কথা শুনবেন না?আপনার দায়িত্ব স্কুল শিপ্ট করা, সেটি হয়ে যাচ্ছে, স্কুলের ছাত্রীদের এবং আমাদের শিপ্ট করার দায়িত্ব কি আমরা আপনাকে দিয়েছি? দিলে কি আপনি নেবেন?
দেখলাম আমার ইচ্ছাশক্তি তার মন জয় করছে। তিনি লিখে দিলেন অর্ডার। কাজ হয়ে গেল। সবাই তখন ও দিকটায় বাসা খুঁজতে তৎপর হলাম। এই বোর্ডিং হাউজ দু একদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ঐ ঘন বসতিতে সুন্দর করে তৈরি দুটো বাড়ি কাঠের মেঝে রেলিং দেয়া ভিতরে টিউবওয়েল খুঁজে পাই। ভাড়া নামমাত্র। আমরা সরে এলাম। এবারে আমার তিন সন্তানকে কাছে আনলাম। কারণ মায়েদের তখন বাড়িঘর শিপ্ট চলছিল। নতুন ভাড়াটে বাড়িতে নিজের সাফল্যের খবর। উচ্ছাস ভরে ঢাকায় ওকে জানিয়ে দিলাম। প্রশংসা পাব এমনটি আশা ছিল। কিন্তু পেলাম তিরস্কার। তিনি কঠোর ভাষায় লিখলেন, স্ত্রীলোক স্বাধীনতা পেলে তার সদ্ব্যবহার করে না। আমার উচিত ছিল নিয়মমাফিক ডি, এম, সাহেবের প্রস্তাব মেনে নেয়া, ছয়মাসের অগ্রিম বেতনসহ পুত্রকন্যাদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে আসা। তাহলে তার পক্ষেও সুবিধা ছিল। বাড়িতে থাকতে পারতেন। ঢাকায় কেইসের তারিখ আর উকিলের কাজ ছাড়া তার অন্য কোন কাজ নেই। তার থেকে এসব কথা শুনতে পেলাম অকারণ। না জানালে ভাল হতো। কিন্তু একটা ভাল কাজ করতে পেরেছি। সেই সৎসাহস তিনি কেন বুঝলেন না। আমাকে কষ্ট দিলেন, আমি সে কথাই ভাবছিলাম। তার মধ্যে একটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগে গেছে! অবাক হতে হয়। মনে সান্ত্বনা পেতে চাই এই ভেবে, নানান অসুবিধায় পড়ে এবং আমাদের থেকে আলাদা থাকায় মন মেজাজ ঠিক ছিল না। হয়তো। আমাদের দেখতে এসেও যেতে পারে। কিন্তু ঐ ছয়মাস তার জন্য অপেক্ষা করা বৃথা হয়েছিল।
ভাদ্রমাসে মেঘনা আবার প্রলয়ঙ্কর ভাঙ্গন লাগিয়ে দিয়েছে। এবার আমাদের স্থানান্তরের জন্য নিজেরা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। উমা স্কুলকে মাইজদিতে আনার ব্যবস্থা দেখছিলাম, মানুষ মাথায় করে কয়েকজন মিলে বড় বড় টিনের চাল, দরজা জানালা পায়ে হেঁটে মাইলকে মাইল পার করে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্মৃতির অকুতস্থানগুলোকে। তবুও চোখের সামনে তখনকার নতুন অভিজ্ঞতা বড় পবিত্র ছিল। ভোরের শীতল স্পর্শে ছাত্রীদের একেকজনকে তাজা। ফুল মনে করতাম, ওরা আমাদের জন্য ফুল নিয়েও আসতো, গাঁদা, গোলাপ, বেলী, গন্ধহীন কাঠগোলাপ। পুরনো এলাকায় প্রায় বাড়িতে বাগান ছিল। সকাল বেলা বেশির ভাগ সময় মেয়ে স্কুলে না খেয়ে আসতো, সেজন্য উমা স্কুলের টিফিনের মত মুড়ি, চিড়া, গুড় এগুলো মেয়েদের খেতে দিয়েছি। ঐ খাওয়া কিন্তু আমাদের সামনে ওরা খেত না।আড়ালে নিয়ে খেত। লাজুক মেয়েদের এটাতো স্বভাব।
আমার সংসারও মন্দ চলছিল না। আগে মা খাবার পাঠাতেন, এখন নিজের আয়ে চলা। বেতন মাত্র একানব্বই টাকা। ব্রিটিশ আমলের বেতন স্কেল ৫৫-২-৭৫. আমার বায়ান্ন টাকার সাথে মহার্ঘ ভাতা, যুদ্ধের পরবর্তী ভাতা এসব যোগ করে একানব্বই হয়েছিল। তাছাড়া রিলিফ অফিস থেকে ধানের কি গমের পারমিটও নিতাম। ধান কুটে চাল করার কাজ দারোয়ান করে দিত। চিনি এবং গুঁড়ো দুধ তখন বাইরের দেশ থেকে রিলিফ হয়ে আসতো। অনেকে এগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করত। ফলে সস্তায় পেতাম। ঐ গোছান ঘর করা ছেড়ে সামান্য মালপত্র নিয়ে মাইজদি বাবার বাসায় পুনরায় এসে পড়ি। সারারাত বুকের ভিতর কিছু শব্দ টনটন করছিল; একটা ঠাঁই তো আমি পেলাম, বাকিরা? ঐ কচি কচি মুখগুলো! আহা, ওরা বেঁচে যাক।
দুঃখের দহনে করুণ রোদনে
নিজের চোখে দেখেছিলাম শান্ত নদী হঠাৎ অশান্ত উত্তাল হয়ে আমার আবাল্য বিচরণ ভূমি গ্রাস করে নিতে। বেদনার ভারে বুকে নিঃশ্বাস চেপে আসছে, বিদায় নেয়ার সময়টুকুও এবারে নেই। সামান্য মালপত্র নিয়ে তিন শিশু সন্তানসহ জিপে রওয়ানা দিলাম। পিছনে নদীর আর্তনাদ, সামনে নতুন শহরের কাল পীচঢালা রাজপথ। মনের অশান্ত চিন্তায় দেহ অবসন্ন লাগছিল, চোখ বন্ধ করে অনেকটা পথ ছেড়ে এলাম। এবারে নতুন শহর দেখছি। রাস্তার বাম পাশে বাড়িঘর, দোকানপাট বসেছে। কিন্তু ডাইনে কেবল পানি আর পানি। ভাদ্র মাসের বৃষ্টি খাল-বিল আর ধানের ক্ষেত ডুবিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল, ঐ পানির মধ্যে বন্দি মানুষ এসে ঘর তুলেছে। ছাড়া ছাড়া টিনের ঘর, রোদ পড়ে ঝিলিক দিচ্ছিল। মোড় নিয়ে অতঃপর কোর্ট এলাকা পার হয়ে জিপ আরও একটা বাঁক নিয়ে ল-ইয়ার্স কলোনি এবং বায়ে মাইজদি কোর্ট, রেল স্টেশন রেখে আমাদের নিয়ে এল অন্য এক আবাসিক এলাকায়। এই সময়ের মধ্যে বাবা পুরনো শহরের ঘরগুলো বসিয়ে নিয়েছেন। অনেকখানি জায়গা ঘিরে পুকুর এবং নানান ফলের গাছ দেখতে পাচ্ছিলাম। বৈঠকখানার সামনের রাস্তাটি বড় রাস্তার সাথে মিশেছে। রাস্তার দু পাশের একদিকে পোলাও এর ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছিল। বাতাসে সবুজ ধানের ক্ষেত নেচে চলেছে ঢেউয়ের তালে তালে। কালিজীরা ধানের ক্ষেত! মনে আনন্দ ধরিয়ে দিল সহসা। বাচ্চাগুলো ঝুপঝাপ নেমে ছুট লাগাল, নানা-নানীকে তারা অনেকদিন দেখেনি।
পুকুর পাড় আজই ঘেরাও করে দেয়ার তাগিদ এল মায়ের থেকে। একজন মিন্তি অবিরাম এটা ওটা করেই যাচ্ছিল। বাঁশ চিরে ফালি ফালি করে বেড়া বানাতে বসে গেল। সবই নতুন, সবই ভাল। ছিন্নমূল মানুষেরা আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বাবার বৈঠকখানা গমগম, গাঁয়ের মানুষ জমির মামলা-মোকাদ্দমা করে যাচ্ছে আগের মতো। আমার মনে ব্যথা টন টন করে। সব হল কিন্তু আমাদের স্কুল? কোথায় পড়তে আসবে ছাত্রীরা? কাউকে স্কুল নিয়ে বলতে গেলে তারা বিরক্ত, বলে স্কুল করার ভূত কাঁধ থেকে নামাও এখন। পানি কমুক। শীত মৌসুম আসুক। চুপ করে থাকা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। মনে করলাম এই ফাঁকে গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে কিছুদিন থেকে আসব। ওরা খুশি হবে, সেই যে মায়ের অসুখের সংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছিলাম, আর তো যাওয়া হয়নি। স্টেশন লিভ করার জন্য একখানা দরখাস্ত নিয়ে ডি. এম. সাহেবের কোর্টে হাজির হলাম। আমাকে দেখে মুখের ভাব গম্ভীর করলেন। অসময়ে বিরক্ত করতে আসা কেন! স্কুলের কোনো প্রস্তাব নিয়েই এলাম মনে করে নিজের থেকেই বললেন, বসুন। চা খান। আমি বললাম, আমি চা খাই না, অভ্যাস করিনি।
আমার দিকে ভ্রু তুলে হাসিমুখে তাকালেন। বললেন, আপনার অভ্যাস না থাকলে জোর করবো না। তবে আমি খাব। ঐ চায়ের উপর টিকে আছি। না হলে পানির বাতাস খেয়ে মরে যেতাম। তারপর একটু থেমে পুনরায় বলেন, কেন এলেন বললেন না তো?
স্টেশন লিভ করতে চাই। স্কুল তো আপনারা কোথাও খুলবেন না। কী করবো?
কেন এই পানি আর বাতাস, ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে কবিতা লিখুন।
ও আমি কষ্ট করে কবি হতে চাই না। আমার দরখাস্তে একটু লিখে দিন স্টেশন লিভের পারমিশন।
ও কোথায় যাবেন? ঠিকানা লিখেছেন?
ও আছে, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এই ফাঁকে তাদের মন যুগিয়ে আসি। মেয়েদের এই তো কাজ।
ও! আপনি ম্যারেড!
ও এ প্রশ্ন কেন স্যার?
ও এই প্রথম জানলাম। সে জন্যে অবাক হচ্ছি! এই নিন, যতদিন খুশি থেকে আসুন।
কাগজটি হাতে নিয়ে প্রৌঢ় লোকটিকে দেখলাম। সালাম না দিয়েই চলে আসি। আমার মনে হাজার প্রশ্ন তুলে দিলেন ভদ্রলোক। ম্যারেড মেয়েরা আমার মত বাইরে এত ছুটাছুটি করে না। স্বামীর সেবাতেই দিন গুজরান করে। তার মতে আমি অনূঢ়া, তাই কেবল স্কুল নিয়ে পড়ে আছি। বেশ মজার তো! নতুন তথ্য পেলাম।
বাসায় ফিরে এ কথা বলার মানুষ খুঁজলাম, স্বামী ভদ্রলোক বাইরে। তাকে পেলাম না। তার লেখা চিঠি পেলাম দুদিন পর। তিনি ফেনীতে, আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে যেন উপস্থিত হই। একা চলাফেরার সাহস দেখিয়েছি। ঢাকাতে গিয়েছি একা। চিঠিতে বেশ উল্টো গুঁতো দিলেন যা হোক। বাড়ির কাছেই রেল স্টেশন। টিকিট করে সটান উঠে গেলাম। লাকসামে ট্রেন বদলিয়ে চিটাগাং মেইল ধরে ফেনী স্টেশন। কুলিটা খুব ভাল, তাড়াতাড়ি নামিয়ে প্লাটফরমে নিয়ে এলো।
ফেনী স্টেশনে তাকে পেলাম। আহা! কি সুন্দর ফুলবাবুটির ছন্নছাড়া চেহারা! আমাকে কষ্ট দিয়ে নিজের উপর বেশি উসুল করে নিয়েছেন। বললেন, গত দুদিন চিটাগাং মেইল এটেন্ড করে যাচ্ছেন। স্টেশনেই আস্তানা গেড়ে পড়ে থাকলেন। আমাদের না নিয়ে ঘরে যাবেন না। এমন পাগলা চেহারা দেখে আমি দুঃখ পেলাম। তুমি মানুষটা যেমন, তার উল্টা চলতে যাও কেন? অসুখ হলে দেখবে কে শুনি? তোমাকে দেখবো, না এই তোমার বাচ্চাদের! তারপর বললাম, আর কখনও এরকম করবে না।
বাড়িতে দিনগুলো আনন্দে কাটছিল প্রথম দিকে। ছেলেমেয়ে দুটোর হাত ধরে গ্রামের পরিচিত বাড়িগুলোতে বেড়ানো, নতুন হাটে নিয়ে গিয়ে ওদের এটাসেটা কিনে দেয়া করে জীবনের শখ মেটাচ্ছেন। কিন্তু সময়টা যে আশ্বিন-কার্তিক মাস। গ্রামে অসুখ-বিসুখ হওয়ার সময়। দুধ পাওয়া যাচ্ছিল না। কৃষকের ঘরে চাল থাকে না। ওরা ছড়া বানিয়েছে এই অভাব সহ্য করার সান্ত্বনা স্বরূপ। ছড়াটি হল এই, ‘শামুকে থাকে না রস, বেতাগে থাকে না কষ।’ সময়টা বুকের রক্ত শুষে নেয়। আমরাও দেখলাম, একটু রোদ উঠলেই ঝাঁ ঝাঁ করে, জ্বরে পড়লো মেয়েটা, এ জ্বর ছাড়েও না, মুখে কিছু দেয় না। কোলের ছেলেটি যখন পেটের আমাশয় কাবু হতে লাগলো, আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আর তো থাকা ঠিক হবে না, শেষে কোন বিপদ গুণতে হবে। কিন্তু ওদের বাবাকে বুঝাতে পারছি না। তার কেবল এক কথা, ফেনী থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে আসবো, নয়তো ফেনীতে মেজবুবুর বাসায় কয়েকদিন থেকে চিকিৎসা করাবো। ওরা ভাল হয়ে যাবে। উনি দালান বাড়ি করলেন, বড় দীঘি কাটিয়েছেন। আমরা এখনও বেড়াতে গেলাম না। উনি রাগ করেছেন।
এতসবের জবাব কি আর দেয়া যায়! ফেনীতে গেলাম। ডাক্তার দেখানো, ওষুধপথ্য করালাম বাচ্চাদের। কিন্তু ক্রনিক হয়ে যাচ্ছে, সাকীর তো টাইফয়েড। তখন অত্যাগী জ্বর বলতো। এদিকে ফেনীতে সেজ দেবর শেখ ওয়াহিদ উল্যাহ চৌধুরী সাহেব ফেনী বার-এ জয়েন করেছেন। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ফেনীর বাসায় থাকেন। স্বামীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালাম। তোমার মেরিট তার চেয়ে কম ছিল? সে কিভাবে একবারে দুটো পার্ট পাস করে উকিল হয়েছে? তোমার আসলে পড়ালেখা করার মন আর নেই। আমাদের দিকে চেয়েও তোমাকে একটা কিছু করতে হয়। কেন, এমন উদ্দেশ্য ছাড়া দিন কাটিয়ে দিচ্ছ! ‘Time and tide wait for none.’ সময়তো চলেই যাচ্ছে। শেষে তোমার কিছু করা হবে না। ‘ল’ পরীক্ষার জন্য ফিস জমা দিয়ে কেন পরীক্ষা দিলে না! তোমার ভবিষ্যত কি?
স্ত্রীর থেকে উপদেশ নেবার মানুষ আর কেউ থাকতে পারে, কিন্তু ইনি নন। আমাকে সব সময় ছোট মনে করে এখন এমন, আর পরিণত ভাবতে পারে না। চট করে রেগে গেল এবং আমাদের নোয়াখালী নিয়ে এসে রেখে ঢাকা চলে গেল। যাওয়ার আগে অসংলগ্ন বকুনিও দিয়েছে। তার দুঃখ বুঝলাম না। সে কত কষ্টে দিন কাটাচ্ছে, কথায়। বলে স্ত্রীর ভাগ্যে স্বামীর ধন-দৌলত। আমি সেটা নিজে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। আমি তার জন্য শনি।
মনের মধ্যে এসব কথা চেপে রাখলাম, কাকে কথা শোনাব? মানুষটা আগের ভদ্রলোকটি নেই, গোল্লায় যাচ্ছে। আমাকে গাল দিল কী করে! এই রাগ বুকে পুষে রাখার ফল এক সময় অসহ্য লাগছিল। মা ও বাবা দুজনকে এক সাথে পেয়ে আক্রমণ করলাম; আচ্ছা আম্মা, একজন গরিব নিরন্ন মানুষও মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে ভাবে, যার হাতে মেয়ে তুলে দিচ্ছি, দু বেলা দু মুঠো খেতে দিতে পারবে কিনা! বছরের জন্য দু খানা বস্ত্র যোগাড় করতে পারবে কিনা! ছেলেটা কি চাকরি করে! তোমরা কি করলে, ভবিষ্যতে কি একটা পাস দিয়ে মুঠোভর্তি রোজগার করবে এই? তোমাদের আশা পূরণ হলো?
বাবা চুপ, মায়ের হাত থেকে পান নিয়ে মুখে দিলেন। মা কটকট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, তোর ছেলেমেয়েরা কি উপোষ আছে? না তাদের জামা-জুতোর অভাব? আল্লাহ তালা সৎচরিত্র এবং পরহেজগার লোকদের বিপদে রেখে তার ঈমানের পরীক্ষা নেন। জামাই-এর এখন খারাপ সময়, আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চাও মা, গলা নরম করে মা কথা শেষ করলেন। এঁদের কাছেও আমি তার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। তাহলে যাব কোথায়?
বড় ঘরের বারান্দা থেকে সোজা বড় উঠানটি পেরিয়ে নিজের ঘরে উঠলাম। শুয়ে আছি। আমার রুমটির সামনে অন্য কামরা, ওখানে টেবিল পেতে স্কুলের অফিস করেছি, ঐদিকে দরজাও আছে। একটা জানালা ঠিক ভেতর বাড়িতে ঢোকার রাস্তায়। বাবা বৈঠকখানা থেকে ফেরার পথে খুব আদুরে গলায় ডাকছেন আমাকে। উত্তর দিলাম না, আমার কেউ নেই। কেউ আমার জন্য ভাবে না। বাবা ডাকছেন বারবার, শেষে ঘরে আসেন। আমাকে কাঁদতে দেখে শোয়া থেকে টেনে তুলে বসান। মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দেন। স্কুলটা স্টার্ট করে দিতে পারলে তোর জন্যে ভাল হতো। মন খারাপ করছে মা? এ কয়দিন বইখাতা নিয়ে বসলে পারতি, শরীরটা ঠিক থাকলে হয়। বাবাকে এত কাছে পেয়ে দুঃখ ভুলে গেলাম। না, আবা, শরীর ভাল। স্কুলের জন্য ভাড়া নিতে পারি এ রকম ঘরবাড়ি খোঁজা লাগিয়ে দেব। কি বলেন! পানি শুকাচ্ছে, অক্টোবর মাস।
কত রহস্য আছে, আর তাই নিয়ে কত মানুষ গল্প করতেও উৎসাহী। আমার অতসবে একটুও মাতামাতি নেই। কিন্তু নিজের মনেই একদিন ডাক দিল এমন করে, সেটা আজও রহস্য মনে হয়। ফজরের নামাজ পড়ে সেদিন মনে করলাম, রাস্তা এ সময় নিরিবিলি, হেঁটে আসি। বের হয়ে বেশি দূর যেতে হল না, ব্যারাক প্যাটার্নের একটি বাড়ি, কারা যেন থাকেও। বারান্দায় শার্ট, প্যান্ট ঝুলানো। তা হোক, কাছেই একটা বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে গেলাম। আশ্চর্য কাণ্ড, ঘরের গৃহিণীকে পরিচিত লাগছে। সুন্দরী ভারিক্কি মহিলা, আমরা একসাথে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলাম। আমার বিষয়টি বলতেই স্বামীকে হাজির করে বলে, নদীতে স্কুল ভেঙে নেয়ার পর কাউকে দেখিনি স্কুল দাড় করার জন্য এমন করে ছুটাছুটি করতে। তা যদি করতেন আগের দিদিমনিরা, আমার পড়া বন্ধ হতো না। দুঃখ আমি মুর্খ মেয়েলোক রয়ে গেলাম। ভাড়াটেদের তুলে দেব। আর যা লাগে। আমি আছি, তুমি স্কুল কর এখানে। স্বামী ভদ্রলোক কোন কথা বলার সুযোগটি পেল না। স্ত্রীর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়েই রইলেন। এদিকে কৃতজ্ঞতায় আমি প্রায় কেঁদেই ফেলি; এই কাজি আনোয়ারা শৈশবের বান্ধবী; সমুদ্রের বেলাভূমি থেকে কড়ি কুড়িয়ে এনে চার কড়ি খেলেছি এক সাথে। তারপর দেখা সাক্ষাত নেই এতকাল। আবেগে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বলতে চাইলাম, তোকে না পেলে কি যে হতো। কিন্তু আমার অশ্রুই সব কথা বলে গেল। দু মাসের মাথায় স্কুল ঘর তৈরি পেয়েছিলাম। জায়গা বেশি করার জন্য ওরা নিজ ঘরের সামনের দুটো রুম ছেড়েও দিয়েছিল। উঠান ইত্যাদি ঘিরে মুলি বাঁশের বেড়া দিয়েছিল। একটি টিউবওয়েল বসিয়ে পানির ব্যবস্থা করে দিল। নূরুল হুদা সাহেব প্রথম শ্রেণীর কন্ট্রাকটর, শিক্ষিত লোক। দিল দরাজ ব্যক্তিত্ব, স্ত্রীর এক কথায় স্কুলের জন্য বিনা স্বার্থে ঘরবাড়ি ছেড়ে দিলেন।
কাজ করতে নামলে বুঝা যায়, আরম্ভ করা বড় কঠিন। কিন্তু একবার শুভ সূচনা হলে তার গতি রোধ করাও যায় না। জানুয়ারি মাসে স্কুল ছাত্রী সমাগমে ভরে গেল। মেয়েদের মা-বাবাদের সহায়তায় অন্যান্য কাজও করতে পেরেছিলাম। তাদের অনুরোধে এই প্রথম স্কুলে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করি। স্কুলে তখন মহব্বতপুর থেকে মরিয়ম-উন-নেসা আপা যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে ছাত্রীরা মিলাদ-হামদ-নাত পড়েছিল। তারপর অনুরোধ পেলাম কালচারাল ফাংশন করার। এভাবে আমারও মনে আশার সঞ্চার হচ্ছিল। মেয়েদেরকে নিয়ে একটা সমিতি গঠন করবো। স্কুলে কতক্ষণ আর থাকে ছাত্রীরা! মায়েদেরকেও সচেতন করতে হবে। তাদের মেয়েরা অন্যান্য জেলার কিংবা দেশের মেয়েদের থেকে অযোগ্য নয়, কিন্তু পিছিয়ে আছে। স্কুলের পরিবেশ ভারি চমৎকার লাগছিল। বাগানের মালি ইতিমধ্যে একখানা গেইট দাড় করিয়ে তাতে মাধবীলতা তুলে দিয়েছে। ছুটি হওয়ার পর আমার রুমে বসেছিলাম। তখন ডিএম সাহেবের ড্রাইভার একখানা চিঠি পাঠালেন। সারবস্তু, ‘অল পাকিস্তান উইমেনস এসোসিয়েশন খোলার জন্য করাচি থেকে প্রাইম মিনিস্টারের স্ত্রী বেগম রানা লিয়াকত আলী চিঠি দিয়েছেন। ডিএম-এর স্ত্রী থাকবেন এক্স অফিসিও প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারিকে নির্বাচিত প্রতিনিধি হতে হচ্ছে। তিনি আমাকে এ পদের জন্য প্রার্থী হতে লিখেছেন এবং সেই সন্ধ্যায় তার গাড়িতেই আমি যেন সোনাপুর তার বাংলোতে উপস্থিত হই। বেগম রানা দু মাসের পর একটা ট্যুর প্রোগ্রাম নিচ্ছেন। সমিতির। কাজকর্ম দেখবেন।
সারাদিন স্কুল। দশটা-পাচটা হলেও আমাকে বাড়তি কয়েক ঘন্টা কাজ করতে হতো। অফিসের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য কোন কেরানি ছিল না। নিজেই করতাম। ডিএম সাহেবের চিঠি পেয়ে বাসায় ফিরে আসি। ছোট ছেলেটার অসুখ ভাল হয়েছে, কিন্তু সারাদিনের পর মাকে না দেখলে তাকে শান্ত রাখতে পারে না কেউ। শামীম আমার এত ন্যাওটা হল কেন কে জানে। ওর জন্যই ঘরে আসা। সেই সঙ্গে একটু পরিপাটি হয়ে নিলামও।
ডিএম তখন মিঃ শামসুদ্দিন আহমদ। বাংলোয় গিয়ে দেখি মহিলাদের নিয়ে তার স্ত্রী বেশ খোশগল্পে মেতে আছেন। আমি সেলাম দিয়ে কাছে দাঁড়িয়েছি, খোশ দিলে ঘোষণা দিলেন, আমার সেক্রেটারি হবেন ইনি, খুব কাজের লোক। কিন্তু একজন বিশেষ সুসজ্জিতা মহিলা বেশ রাগত স্বরে বলে দিলেন, শুনেছি সেক্রেটারির পোস্ট ভোটাভুটিতে হবে। কখন ভোট হল!
আমি এরকম সোজাসুজি আক্রমণের মধ্যে পড়বো, বুঝিনি। মিসেস ডিএমও বুঝতে পারেননি। সহজ-সরল মহিলা। ভেবেছিলেন নোয়াখালী জেলায় কে আর ডিএম সাহেবের কথার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করবে। তবুও তাকে কিন্তু গম্ভীর হতে দেখলাম না। হাসিমুখেই বললেন, কাগজপত্রের দরকার কি, হাত তুলে ভোট করে ফেলি। আমি প্রার্থীর নাম বলবো, যারা সপক্ষে থাকবেন হাত তুলবেন।এভাবে ভোট হল,আমার পক্ষে বেশি হাত তোলা দেখে তিনি বেশ কৌতক করলেন। একজনে দু হাত তোলেননি তো? দেখি দেখি আবার হাত তোলেন আপনারা। হাসির মধ্যে করতালি শুনতে সেদিন ভালই লেগেছিল।সভানেত্রী আমাকে বোঝালেন,শত্রু থাকা ভাল।নিজের ওজন পাওয়া যায়।মূল্য বুঝলেন তো ভাই নিজের!ভোটে জিতে সেক্রেটারি হলেন।কেউ বলতে পারবে না ডিএম-এর খাতিরের লোক।
ঐ সভাতেই কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য বেছে নেয়া হয়।এসপির স্ত্রী খোরশেদা হক হলেন ট্রেজারার। সিভিল সার্জনের স্ত্রী বেগম নুরজাহান খান হলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।স্কুলের আপাদের থেকে ফাতেমা খাতুন,রাজিয়া আপা (স্বল্পকালীন),মরিয়ম উন নেসা… সদস্য হলেন।আমরা ঐদিন থেকে কিভাবে কাজ করবো চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাই।বেগম রানা লিয়াকত আলীকে কিভাবে সংবর্ধনা দেব। নোয়াখালীর কোন উপহার দেয়া যায় কিনা তাও ঠিক করলাম।পাটের পাতায় তৈরি পাখা,আসন, চটের উপর উলের কাজ করা স্কুল ব্যাগ,আসন এ কয়টি জিনিস শেখাতে লেগেও গেলাম।পরে শুনলাম বেগম রানা নোয়াখালী পর্যন্ত আসবেন না।লিয়াকত আলী সাহেব চাটগা মিটিং করবেন।উনি সে সময় ফেনীতে আসতে পারেন।ফেনী সরলা গার্লস স্কুলে আমরা নির্দিষ্ট দিনে গিয়েছিলাম।অপ্সরীর মত দেখতে,বিদেশিনীর মত ইংরেজি বলতে দেখলাম তাকে।আমাদের।উপহারগুলো তার খুবই পছন্দ হয়েছিল।আমাদের কাজের প্রশংসা তিনি করাচি থেকে চিঠিতেও জানিয়ে দিলেন।
আঘাতের পর আঘাতে পাথরও ক্ষয়ে যায়
মহিলা সমিতি (আপওয়া বলা হতো, ALL PAKISTAN WOMEN’S ASS) নিয়ে মেতে থাকব এমন সময় আমার নেই। কিন্তু ট্রেজারার মিসেস খোরশেদা হক (ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছোট বৌন) একেবারেই নাছোড়বান্দা। এম. ই স্কুল হোক, তাতে লেখাপড়া এবং রীতিনীতি তৈরি নিয়ে আমরা যেভাবে সেটি গড়ে তুলতে লেগে আছি, সেই খাটুনি কোন হাইস্কুলের থেকে কম ছিল না। স্কুলের ছাত্রী বেড়ে চলেছে, শহরের শূন্য এলাকায় রাতে দিনে ঘরবাড়ি উঠে ভরপুর। খোরশেদা জিপ নিয়ে এসে বসে থাকবে, খোটা দিয়ে আমাকে বলবে, বছরে কুল্লে তিন টাকা চাঁদা, তা দেয় না কেন তোর দেশের মহিলারা! শরম দিবি, পান-দোক্তা খেয়ে দাঁত কালা করা বাদ দিয়ে চাঁদা জমাইতে কইবি। ফান্ড রেইজ করা দরকার। একটু সময় কর লক্ষ্মীবোন।
আমরা প্রায় একসাথে বের হতাম। চাঁদা তোলার জন্য গেলে নানান মন্তব্য শুনতে হতো। তার অধিকাংশ মেয়েদের স্বামীভীতি। আমাকে এমনও শুনতে হয়েছে, আমার তো সুন্দর একটা সুখের সংসার ছিল, কলকাতার কো্নো বড় লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। আমার এই বেলিল্লাহ কাজ দেখে স্বামী ছেড়ে দিয়েছে। তাদের সংসার ভাঙতে কেন আমি এসেছি! স্বামীরা নাকি বলে, আমরা ওদের সুখের ঘরে আগুন দিতে আসি। নিজের ঘর ভাঙা, অন্যের সুখ দেখতে পারি না। এসব আক্রমণাত্মক কথার উত্তর খোরশেদা চমৎকার রসিয়ে বলে দিত, ঠোঁট উল্টিয়ে অবজ্ঞা করে চোখ ট্যারা মেরে আমাকেই জিজ্ঞেস করেছে, এই এসব কি শুনি? বছরে একটা করে বাচ্চা পয়দা করছিস, তোর সোয়ামী কাছ ছাড়া থেকেই এত, কাছে থাকলে তুই তো আল্লাহর আলামত দেখাবি; ছয় মাসে একটা করে সন্তান! ওরে আল্লাহ, আপনারা মাফ করেন বোন আমাকে, ওর সোয়ামী দূরে থাকন বালা। হাসি-তামাশা করে হলেও খোরশেদা টাকা উসুল করতে পারতো । আমরা কাজের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তুলি।
প্রশাসনিক রদবদল হল তখন। ডিএম শামসুদ্দিন বদলি হন এবং পানাউল্লা সাহেব আসেন। তাঁর স্ত্রী সংস্কৃতিসেবী। স্কুলের মেয়েদের নিজের উদ্যোগে তৈরি করিয়ে নিলেন। একটা ফাংশন করবেন টাউন হলে। চ্যারিটি শো-ফান্ড তুলবেন মহিলা সমিতির উন্নয়ন কাজের জন্যে। একবার লক্ষ্মীপুর বন্যায় ডুবে যাচ্ছে শুনে তিনি আমাদের রিলিফের কাজের জন্য নিয়ে যান। চাল, পুরনো কাপড়, মোমবাতি, কুপি, তেল ঘরে ঘরে দিয়ে আসতাম। মেয়েরা পর্দার জন্য ঘর থেকে বের হতো না, না খেয়ে তারা অসুখে মরে যাবে, তবুও ভাঙবে না। আমাদের সামনেও আসে না। কি মুশকিল, পুরুষদের মত কাজ করে আমরা পুরুষ হয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমি এবং অন্যরা হাল ছাড়িনি। ওদের সাহায্য করে এসেছিলাম। আমরা আর একটা কাজ করেছিলাম, যা আজও আমাকে আনন্দ দেয়। সোনাপুর দীঘির পাড় পেরিয়ে বেশ ভেতরে গেলে নদীভাঙ্গা ছিন্নমূল অসহায় গরিব ছেলেমেয়ে, বৌ দেখতে পেতাম। চাল-ডাল খয়রাতি দিলেও হাঁস-মুরগি কিনে দিতাম, ডিম বিক্রি করে সামান্য আয় যাতে করতে পারে। শাক-সবজির বাগান করার জন্যও বীজ কিনে দিয়ে আসতাম। ছোট ঘরের ক্ষুদ্র উঠানেই কিছু করুক। মিসেস পানাউল্লা নিজের হাতে এসব করতেন। আমাকে শিখিয়েছেন। মেয়েদের স্বাস্থ্য গঠন বিষয়েও তার সময়ে আমরা বিশদ প্রোগাম নিয়েছিলাম। বিশেষ করে স্কুলের মেয়েদের। জন্যে ডকুমেন্টারি ছবি যোগাড় করে দেখান, মেয়েদের যত্ন, সপ্তাহে একদিন গুঁড়ো দুধ বানিয়ে তাতে ওভালটিন মিশিয়ে খাওয়ান আমরা আনন্দ নিয়ে করেছি। একদিন বিদেশী টিম এল। তারা বিসিজি টিকা দেবে, এতে একটা সমস্যার সৃষ্টি হলো। মেয়েরা ভয়ে স্কুল থেকে পালাতে চায় এবং ভীষণ কান্নাকাটি। অনেক বাবাও ছুটে এলেন। তাদের মেয়েদের খ্রিস্টানরা বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বলছে, মুসলমান আর খ্রিস্টানরা চিরকালের শত্রু। সবেমাত্র পাকিস্তানের বয়স পাঁচ। এমন কুসংস্কারের সম্মুখীন তো হবো, জানা কথা। আমরা জোর করিনি, যারা ইচ্ছা করে দিয়েছে, তাদের আমরা একটা করে চকোলেট দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে ভুল বুঝতে পারি। ছোট মেয়েরা এর জন্য দায়ী নয়, তাদের কেন শাস্তি দিলাম! পরে সকলকেই চকলেট দিলাম কিন্তু বুঝিয়ে বললাম, বিসিজি টিকা নিলে, তোমার শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু ঢুকলেও তা মরে যাবে। তোমার যক্ষ্মা রোগ হবে না। যক্ষ্মা অর্থ ক্ষয় রোগ। “যার হয় যক্ষ্মা, তার নেই রক্ষা”- একটা ছড়া আছে-বাড়িতে বলবে। মেয়েরা কতটুকু বলতে পেরেছিল, সেটা বুঝেছিলাম অবশ্য পরে। বিসিজি দেয়ার মোবাইল পার্টির সাথে তখন আর যোগাযোগ করতে পারিনি। বাবা-মায়ের অজ্ঞতার জন্য অনেক মেয়েই সেবার বাদ পড়েছিল।
তখন আমরা এত কাজ করতে পেরেছিলাম তার কারণ ছিল; বোরখা পরে হলেও আমরা দিনে রাস্তায় একাও চলাফেরা করতে পেরেছিলাম। দেশ ভাগ হওয়ার আগে মুসলমান মেয়েরা নোয়াখালীতে বলা যেতে পারে অসূর্যস্পর্শা ছিল।
একদিন মায়ের বকুনি খেয়ে হুঁশ হল, তাইতো, কথা তিনি একটুও বাড়িয়ে বলছেন না। স্কুল হয়ে গেল আমার ঘরবাড়ি এবং বাইরের ছেলেমেয়ে হয়ে গেল আপন। নিজের ছেলে যে নোয়াখালী জেলা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে তার চাঁদ মামার সঙ্গে, সেখানে দিব্বি সে ভাল ছাত্র এবং আবৃত্তি, গান, কেরাত এসবে পুরস্কার ঘরে নিয়ে এসেছে। ক্লাস থ্রি কি ফোরে ফার্স্ট হয়েও উঠেছে। মায়ের কাছে থেকে তার এত কৃতিত্ব। সে কথা তিনি প্রকারান্তরে নিজের আনন্দ প্রকাশ করেন এভাবে। মেয়েটি আমার স্কুলে অন্যান্য ছাত্রীর সঙ্গে খেলে, পড়ে, নাচে, গায়। শিক্ষিকাদের মুখে ওর প্রশংসা শুনে লজ্জা পেতাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম, আমি ওদের দিকে নজর দিলে আরও ভাল হবে। এবার থেকে দেব। মায়ের সংসারে আছি বলে তাকে এত জালাতন করছি, আমার কাজ তিনি কতটা করবেন, একটা সীমাতো আছেই।
আসলে আমি ভুল বুঝেছিলাম, মা যে আমারই মা, তার কর্তব্য কাজে ত্রুটি করেন না তিনি। আমাকে বকতেন, মনের আড়ালে গোপন ব্যথা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। সেটা আর কিছু নয়, তার জামাতাকে ঘিরেও তিনি সম্মানজনক কিছু একটা আশা করেছিলেন। সেখানে আশানুরূপ সাফল্য দেখছিলেন না। বছর কয়েক গড়িয়ে গেল, আমার আর একটি মেয়ে হয়েছে। সংসারে মানুষ আসলে ব্যয়ভার, দায়িত্বভার বেড়ে আসে। অথচ জামাই কিনা এসবের জন্য চিন্তা করে না। সরকারের বিরুদ্ধে কেইস করে মানুষ হেরে যায়, সে কিনা জিতে গেল। তার এই লড়াই করার কি কোন অর্থ হয়! জিতে যাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিল? গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কি করে আল্লাহ মালুম। মা সোজাসুজি এসব কথা বলেন না; আমার মনে কষ্ট লাগবে। তবুও বুঝতে আমি পারি এবং পারি বলে মন ঠিক থাকে না। অস্থির হয়ে যাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারার সংকল্প দুর্বল হয়ে যায়। অভিমানে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি। কেইসে জয়লাভ করার পর দি পাকিস্তান অবজার্ভার, আজাদ, ইত্তেফাক পত্রিকায় সেই বিজয় ফলাও করে ছাপা হওয়ার কাটিং আমাদের জন্য তিনি সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন। অথচ চাকরিতে ইস্তফা দেয়ার কথা একবারও আমাদের জানানো প্রয়োজনবোধ করলেন না। আমরা তার শত্রু? তার মহৎ সংকল্প, চাকরি ছেড়ে গ্রামের উন্নয়ন। আমরা তাতে বাধা সৃষ্টি করবো। আমি তার এ হেন আচরণে ভীষণ কষ্ট পাই, আপনার ভবিষ্যত জীবন অন্ধকার দেখি। কোথায় আমার স্বপ্ন! ওর চাকরিটা ঠিক হলে ঢাকায় একটা বাসা করা যাবে, মামলায় জিতলে খরচ ফেরত পাওয়া যায়, তদুপরি বেতনের টাকাও গত দু বছরের বাকিটা পাওয়া যাবে। ঢাকায় বাড়ি ভাড়া নেব। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব, মাস্টার ডিগ্রি করতে পারলে আমার স্বপ্ন বাস্তবে এসে দাঁড়াবে। ব্রাবোর্ন কলেজে বেগম শামছুন্নাহার মাহমুদ, খোদেজা খাতুন এঁদের মত অধ্যাপনা করতে পারবো। স্বপ্ন কেবল নিদ্রার কোলে, তার জাগ্রতরূপ আমার থেকে দূরে সরে গেল। এ নিয়ে স্বপ্ন দেখা সমূলে উৎখাত করতে আমি রীতিমত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম। সেজন্যে সংগঠনমূলক কাজ নিয়ে বেশি ঝুঁকে পড়েছিলাম। আনন্দ পেতামও। তাই আমি যে কেবল আই এ পাস, ক্লাস সিক্স বাদ করলে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এতসব বিষয় ভেবে দুঃখী হইনি, হতাশায় ভেঙেও পড়িনি। মা কিন্তু বাস্তব দৃষ্টিতে উপলব্ধি করতেন, বলতেন, সংসারের নিয়ম স্বামী ভাল রোজগার করবে। স্ত্রীর রোজগার একটা মামুলি, তা যদি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, সেটা সমাজে দৃষ্টিকটু, মুখরোচক, আলোচনার বিষয় হয়। জামাইকে এসব কথা বুঝিয়ে বলবি।
ঘরের পাশে পুকুরঘাটে কিছুক্ষণ বসার অভ্যাস করেছি, সামনের পুকুরটাকে নিস্তরঙ্গ হ্রদ ভাবতে থাকি। মনের কত শত ইচ্ছা তাতে ভাসে, ডুবে, দেখতে থাকি। একদিন অনুভব করলাম, আর সয় না। এই বয়স আমার, পঁচিশও হয়নি। এত যন্ত্রণা, এত ঝামেলা সইবো কেন। সামনেই তো পানি ভর্তি পুকুর রয়েছে। ডুবে হতভাগ্য জীবনটা শেষ করে দিচ্ছি না কেন? ঘাটে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে বসলাম। কারা আমার পা জড়িয়ে ধরলো! এরা কেন আমায় আটকায়! আমার বুকে কার ‘ধুকধুকানি’। এই কি সেই ব্যক্তি, যিনি ছোট মেয়ের বালিকা অন্তরকে কামের পীড়নে ক্ষত করতে উদ্যত হননি? অপেক্ষা করেছিলেন কত কত দিন! আমাকে ছাড়া যার জীবনে আর কেউ নেই! খেয়ালের লাগামছাড়া মানুষটা নিজের জন্য যদি একবার ভাবতো! হায় খোদা! আমি এখন কি করি! বুকের স্পন্দন আরও দ্রুত হয়। কেউ কি আমার হাত ধরেছে? বলছে গ্রামের স্কুলটা দাঁড়িয়ে গেল। মিসেস ম্যাকনেল তোমার প্রিয় শিক্ষক, তাকে বলে এটার রেকগনিশন এনে দাও। মাদ্রাসার জন্য ভাবি না, গ্রামের লোকেরা চাইতে হয় না, খুশি মনে চাঁদা এনে দিচ্ছে। আর একবছর গ্রামে থাকবো …আমি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াই। কার ঘ্রাণ আমার নাকে লাগছে? না! কেউ কোথায়ও নেই। আমি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে স্কুলের চালা দেখতে পাই। লক্ষ্মীপুর, রামগঞ্জ, চৌমুহনী, হাতিয়া থেকে কত মেয়ে পড়তে চায় বলে তাদের বাবারা আমায় হোস্টেল খোলার পরামর্শ দেন। ফেনীতেও কোন স্কুল নেই। অবাক হওয়ার কথা।
কোন সমস্যা হয়েছে আম্মা?এখানে কেন একলা দাঁড়িয়ে? দেখলাম বাবা এশার নামাজ শেষে অন্দর মহলে ফিরছিলেন। চটপট বলে দিলাম, না আবা। মাথা ধরেছিল, সেজন্য ঠাণ্ডায় পুকুর পাড়ে এসেছি। ঘরে ফিরে এলাম। হ্যারিকেনে নিভু নিভু আলো, ছোট্ট কাজের ছেলেটি আজ কোরোসিন ভরেনি। আমার থাকার ঘরে কেউ নেই। ছেলেমেয়েরা বড় ঘরে নানা-নানুর সঙ্গে হয়তো রূপকথার গল্পে মেতে আছে। ওদের না ডেকে নিজেই হ্যারিকেনে তেল দিলাম। একটা বই হাতে নিয়ে সবে টেবিলে বসেছি। পূর্বের দরজাটি খোলা। সরাসরি স্বামী ঢুকে পড়লেন।
ও ‘ফেনী-মাইজদি বাস চলছে, চলে এলাম। এত রাতে দরজা খোলা কেন?বলতে বলতে কয়েকটি বোস্কা নামিয়ে রাখতে বলে কুলিকে; তাতে মিষ্টি আলু, চিনে বাদাম আর নাড়ু।
ও তোমরা ভাল আছ? বেশি দিন থাকতে পারবো না। বাচ্চারা কই?শক্ত হয়ে আছ কেন?কাছে আস।
এই হলেন তিনি। তার এই আসা-যাওয়া নিয়ে আমার বান্ধবী খোরশেদা খুনসুঁটি করতো; গাল টেনে টিপ্পনি-কিরে, গাভীন হওয়ার জন্য ডাক পেড়েছিলি? ঐতোর সাহেব আসলো কেন? এবার যদি বাচ্চা হয় তোকে ধরে পেটাব। আমি সত্য কথা বলতে চেয়েছিলাম, এই জ্বালায় পুকুরে ডুবতে চেয়েছিলাম। তোরা কেউ আমার দুঃখ বুঝবি না। যা চাই না, তা আমার কপালে জোটে। খোরশেদার স্বামী এসপি আব্দুল হক। মাইজদি থেকে ঢাকায় বদলি হওয়ায় ওরা চলে আসে। আমার একজন সহযোগী বন্ধু ছিল ও। ও চলে আসায় ‘আপওয়ার’ কাজে আমি ভীষণ অসুবিধায় পড়েছিলাম। ঢাকায় আসলে রাজারবাগ পুলিশ কোয়ার্টারে ওর বাসায় একবার উঠলাম। কিন্তু আগের ভাব আর টেনে আনা গেল না। নোয়াখালীতে বাইরের লোক গেলে আমাদের খুঁজে বের করে, ঢাকায় এর প্রয়োজন হয় না। ওদের পার্টি দেয়া আর বান্ধবী পাওয়া সহজ ব্যাপার।
এ সময় আমার বোন নুরজাহান মাইজদিতে ছয় মাস থাকার জন্য এসেছিল। ওর স্বামী এম.এইচ. খান লয়ালপুর ট্রেনিং-এ গিয়েছে। ওকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিলাম, বসে থাকবি না। স্কুলে মেয়েদের পড়া, তুই ভাল ছাত্রী-মেয়েরা তোর থেকে ভাল জিনিস শিখবে। ও রাজি হয়ে যায়, সময় কাটানোর জন্য এমন ভাল ব্যবস্থা আর নেই। তখন আমরা দু বোন বেশ মেলামেশা করতাম মিসেস খানের সঙ্গে। সিভিল সার্জনের স্ত্রী, আপওয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট, আমাদের বয়সী এবং সমমনা। তার শখ ছিল সিনেমা দেখার। এদিকে বিপদ মা সিনেমা দেখাকে গুনাহর কাজ বলে জানেন। দেশের কাজ কর ভাল কথা, বেতার জন্য যতখানি বাইরে যাওয়া এবং বেপর্দা হওয়ার প্রয়োজন, সেটি। তিনি মাফ করে দিতেন। সিনেমা দেখতে যেতাম লুকিয়ে, তাও ধরে ফেলতেন এবং আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। তারপর শুনতাম। মা উপোষ দিয়েছেন, অর্থাৎ তার মেয়ে গুনাহর কাজ করছি। এ তারই পাপ। তিনি রোজা রাখছেন, আল্লাহর কাছে মাফ চাইছেন। এদিকে আমাদেরও একটা আনন্দের সন্ধান পাওয়া এতদিন পর-তা ছেড়ে দিতে কষ্ট হচ্ছিল। গম্ভীর মুখে মা একদিন আমাকে ঘোষণা দিলেন, আমার জন্যই নুরজাহান খারাপ হচ্ছে। তার স্বামী ওকে মায়ের হেফাজতে রেখে গিয়েছে। আমি সে কথা যেন মনে রাখি। এদিকে মায়ের অবুঝপনা আমরা মেনে নিতে পারছি না। তাকে কিছু বলতে গেলাম তো রাগে ফেটে পড়লেন। আমাকে হুকুম দিলেন, স্বামী ছাড়া মেয়েদের এভাবে চলাফেরা শরিয়ত বিরুদ্ধ। রওশন, তুমি নোয়াপুর ..চলে যাও।
আমার স্কুল?উঠে যাবে? এ তোমার স্কুল মা। এ যাবত অনেক রকমে আমাকে সাহায্য-সহায়তা করেছ বলে স্কুল নামকরা হয়েছে। আমাদের বাসায় থেকে মাহিনুর পড়ে। লুফুল উকিলের বাসায় ফেনী থেকে এসেছে শরীফা, হালিমা এসেছে লক্ষ্মীপুর থেকে … এরা একদিন নামকরা হবে মেয়েরা সমাজের কড়া নজরের মধ্যেও আমার কাছে পড়তে এসেছে-আমাকে অভিসম্পাত দিও না মা। আমরা আর সিনেমা হলে যাব না।
নোয়াখালীর কিছু প্রভাবশালী লোকজনও যে আমাকে উচ্ছেদ করার পথে নেমেছে! আন্ডার গ্রাজুয়েট একজন মহিলা নিজের সংসার ছেড়ে স্কুলের মেয়েদের ভুল বলে বেড়াচ্ছে; স্কুলের নামে সরকারের কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছে, সিক্স পাস করলে তারপর কোথায় পড়বে? উমা গার্লস স্কুল অর্থের অভাবে উঠে যাচ্ছে। এই গ্রুপ বিরাট এক আবেদন নিয়ে সরকারকে বাধ্য করাবে উঠে যাক এ স্কুল। সেই টাকায় উমা স্কুল চালানো হবে। এদের মধ্যে কয়েকজন আরও বিদ্বেষ দেখালেন। মহিলা সমিতির টাকায় স্কুল করি। গরিব, ছোট ঘরের মেয়েদের স্কুলে পড়াই, ওদের জামা-কাপড় কিনে দিই। বই-খাতা, কলম, খাবার দিই . . . এই গরিবদের সাথে পড়ে তাদের মেয়েদের চরিত্র নষ্ট হবে।
কিন্তু আমি দেখেছি এই গরিব পরিবারগুলো অতি ভদ্র পরিবার, নদী ভাঙায় দুর্দশায় পড়েছে, সরকারের ছোট পোস্টের কেরানি, দফতরি। দশবার জন ছেলেমেয়ে তাদের, ছেলেরা স্কুলে যায়। মেয়েদের মেধা ভাল। মহিলা সমিতির একটা প্রজেক্ট হিসেবে এদের আমরা স্কুলে। পড়াচ্ছিলাম।
ডি এম পানাউল্লা সাহেব প্রভাবশালী উকিল,মোক্তার ও রাজনীতিবিদদের অনুরোধে টাউন হলে একটা মিটিং ডাকলেন। আমাকে এসব ব্যক্তির সম্মুখীন হয়ে বক্তব্য পেশ করার পর তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন। কালোবোরখা গায়ে, মার্চ মাস,গরমে ঘামে ভিজে জ্ঞান যে হারাইনি,সেটাই রক্ষা।তেজের সঙ্গে দাড়িয়ে কি বলেছিলাম হুবহু মনে নেই, তবে সারকথা এমন ছিল,ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক রাজনীতিতে অভ্যস্থ মানসিকতা দেশের জন্য ক্ষতিকারক। আমি অনুরোধ করবো ধ্বংসের প্রস্তাব আমরা যেন প্রত্যাহার করে নেই।উনিশ শ বিশ সালের একটা স্কুল,ভ্রাম্যমাণ শিক্ষিকা দিয়ে জন্মলাভ করেছিল,তাকে হাই স্কুলে উন্নীত করার দাবি।ওঠার কথা আজ। তা না করে তুলে দেয়ার কথা দেশবাসীর জন্য লজ্জা।একটি জেলা সদরে সরকারি বালিকা বিদ্যালয় পাওয়ার দাবি।ন্যায্য,সরকার অবশ্যই মানবে।আজ সম্মিলিতভাবে সেই দাবি। উথাপন করুন,আমার দীর্ঘদিনের তপস্যা তবে সার্থক রূপ নেবে।আমি নোয়াখালী জেলার আপওয়ার সেক্রেটারি,পদাধিকার বলে আন্দোলন চালিয়ে যাব। এখানে ছেলেদের জন্য হাই স্কুল আছে সরকারের, মেয়েদের জন্য চাই।
নিরব সভাকক্ষে করতালিতে আমি বিস্মিত, আমাকে তাহলে সকলে সাপোর্ট করছে? সভাপতি ডিএম পানাউল্লা সাহেব কনগ্রাসুলেট করলেন আমাকে, উঠে দাড়িয়ে কাছে এসে,‘আমরা তোমার কাছে হেরে গেলাম মা।কিন্তু মায়ের কাছে সন্তানরা হারলে লজ্জা নেই,বরং গর্ববোধ করে। কিছু মনে কর না মা, এরা তোমাকে চিনতে পারেনি। কষ্ট দিয়েছে,সবার হয়ে মাফ চাইছি।’এসব’শোনার পর আমি আনন্দে কথা বলতে পারলাম না।মনে তখনও ভয়;যে সকল ব্যক্তি এখন করতালি দিচ্ছে,এদের কতটুকু বিশ্বাস করা যায়।
আমার এক নদীর জীবন (তৃতীয় পর্ব)
আমার এক নদীর জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)
আমার এক নদীর জীবন (প্রথম পর্ব)
রওশন সালেহা
রওশন সালেহার জন্ম নোয়াখালী, ১৯২৯ সালী ১ জুলাই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় ম্যাট্রিক ও আইএ পড়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিএ পড়বার সময় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৈরুতে আমেরিকান ইউনির্ভাসিটি থেকে শিক্ষা প্রশাসন (UNESCO), দিল্লী এবং ব্যাংকক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে ডিডিপিআই পদমর্যাদায় অবসর নেন। তাঁর প্রবল সাহিত্য অনুরাগের জন্য তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘আমার এক নদীর জীবন’ প্রকাশিত হবার পর আত্মজৈবনিক সাহিত্য তিনি শক্ত স্থান দখল করে নেন। ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত।