আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

অমল সে দুঃখরাতে তুমি

কবিতাগুচ্ছ

গৌতম বসু (১৯৫৫-২০২১)

এমন সুখের অনুভব এমন যে ব্যথা
এমন অশ্রুর বনে নেমে-আসা দৈব আলো
অমল সে দুঃখরাতে তুমি আত্মহারা মেঘ
এমন যে মরণকালের তরণী, রসুল।

হাসপাতাল


একজন ছুঁয়ে থাকে তার জরা, চশমার খাপ
দেখতে দেখতে বস্ত্রে বাক্স ভরে ওঠে; যাকে
ভিন্ন দেশে যেতে হবে তার চিরুনী,
সংবাদপত্রে মোড়া গেলাসে অন্য পথে যায়
ফিরিয়ে আনে ঘাতক মেষপাল ।

এই রোদ, লক্ষ্য করো, শ্বেতাঙ্গিনীর শব্দে
চোখ মেলছে, দৃষ্টি আমার দিকে নয়
দেয়ালের দিকে নয়, আলো স্যালাইনের
বোতলে প্রবেশ করে ক্ষীপ্র গতি লাভ করছে
এইভাবে রশ্মি ও জলের ফাঁসি সংগঠিত হয় ।


বিশ্রামতলা

তার কাছে বৃষ্টির মতো ফিরে আসি
আমার দুইকূল তার চোখের কালি, জলভারে
বেঁকে নীল হয়, জ্যোৎস্নায় আবার স্ফীত, উতলা হয়ে ওঠে;
নক্ষত্রের নশ্বর দৃষ্টিপাত, নশ্বর আমার পদধূলি,
চন্দ্রকিরণতলে যেদিকে চাই, দেখি,
আলোর কলস চূর্ণ, শঙ্খধ্বনির ভিতর
এই পথ, মাঠ, কৃষ্ণকায় বৃক্ষগুলি জেগে আছে।
সে কোথায়, কোথায় তার সুরমাখা কঙ্কণ, শূন্যতা ছুঁয়ে আছি
এ-শূন্যতায় বুকের আলো বুকে নিভে যায়।


অনিঃশেষ

পৃথিবীর বুক থেকে এই হাওয়ার রাত যদি-বা মুছে যায়, ক্ষয় নেই জাগরণের। হৃদয়ের, সুবৃহৎ অন্ধকারের সমাপ্তিরেখা নেই, কভু শেষ হবে না মধ্যরাত। জেগে আছ তারাদলপতি গভীরতম নীলে, বলো, আমি কিভাবে বাড়ি ফিরে যাই? পায়ের তল থেকে কারা যেন পথ সরিয়ে নিয়ে গেছে, যেদিকেই ঘুরে দাঁড়াই, ক্ষমাহীন, ক্ষমাহীন দামোদর নদ। আকাশ নেমে এসে ছিঁড়ে ফেলেছে আমার জীবন, হাড়ের সংসার, তবু ক্ষতচিহ্ন নেই, তবু ক্লান্তি জানে না বৃষ্টিপাত। গাও বৈষ্ণবী গাও, মনের কোণে এসে দাঁড়াও, মোবিলের টিন হাতে বিষণ্ণ, তোমার কন্যাসন্তানটিরে দেখি।


বিসমিল্লা

এমন সুখের অনুভব এমন যে ব্যথা
এমন অশ্রুর বনে নেমে-আসা দৈব আলো
অমল সে দুঃখরাতে তুমি আত্মহারা মেঘ
এমন যে মরণকালের তরণী, রসুল।


শ্রীরাধারক্রমবিকাশ’

জননীজঠরে শয়নের মতো পুরনো কথায় ফিরে আসি
একদা আমি ভেবে বসেছিলাম প্রেমার্তি ও প্রদীপশিখায়
সম্পর্ক নেই কোনও, ভুলের ভীষণ রক্তে ভেসে-ভেসে এসেছি,
এইখানে এসে দেখি শ্রীরাধিকা পতঙ্গের রূপ ধরেছেন।
অন্ধকার, আপনি কি সম্মুখে এসে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত?
আপনার আচরণে কোপিত আমি, হতে পারি সামান্য জীব
হাড় আর পাঁজরা বের-করা আলোর প্রদেশের অধিবাসী,
তবু জানাই, আমি শ্রীরাধার নুন খাই, আর ঘুরে বেড়াই
রোদে-পোড়া, পক্ষীবিষ্ঠা ছড়ানো সন্ধ্যাকালের ঠাকুরদালানে,
এভাবেই, ভিক্ষাগ্রহণ, ইহজন্ম দু’পাশ দিয়ে বয়ে যায়।
সুমধুর বাতাস বইছে এখন, স্পষ্ট অনুভব করছি
ক্রোধানল স্তিমিত, চন্দ্রালোকের কথা ভাবতে ভালো লাগছে,
ইচ্ছে করছে, এই কল্পলোকে, কলঙ্কভোগের বিছানা পেতে
শিয়রের কাছে এক ঘটি শীতল জল রেখে, ঘুমিয়ে পড়ি।

গল্প

অসুরদের উপদ্রবে স্বর্গলোক যখন বিপন্ন, সেই সুদূর অতীতকালে দেবতারা অনেকেই পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। স্বর্গের রাত্রি কেমন আমরা জানি না, কল্পনা করি, অন্ধকারই হবে। কোনও এক ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রাতে, অতিসাধারণ বেশে দেবী নৌকায় উঠে বসলেন সবার অগোচরে, সঙ্গে দু’তিনজন বিশ্বস্ত ভৃত্য। সাতরাত সাতদিন অবিরাম নৌকাচালনার পর মাঝিরা নির্বল, এক সাঁঝের বেলায় নৌকার গলুই এসে ঠেকল এই পোড়া বাংলাদেশের শীর্ণ এক নদীর পাড়ে।
রাজরাজেশ্বরী রয়ে গেলেন এই গ্রামে। পৃথিবীর শাড়ি, পৃথিবীর গয়নায় নতুন ক’রে সাজানো হলো তাঁকে, মন্দির স্থাপিত হলো। গ্রীষ্মের দুপুরে সেই মন্দিরের ঠাকুরদালানে ব’সে কেউ-কেউ ইষ্টনাম জপতেন, মাথায় হাত রেখে শীতল মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়তেন কেউ-কেউ, দু’একটা কুকুর মন্দিরপ্রাঙ্গণে নিঃশব্দে ঘোরাফেরা করত। দেবী কথা বলতেন না, তাই স্বর্গে তাঁর ঐশ্বর্যের কথা গ্রামবাসীগণ জানতে পারেন নি, তবু তাঁরা সাধ্যমতো রাজরাজেশ্বরীর সেবা করতেন। যে-বছর ফসল ভালো হতো, সেই বছরে নতুন গয়না গড়িয়ে দিতেন কোনও সম্পন্ন গৃহস্থ, দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে দিয়ে দেবী একবার পেয়ে গেলেন শিকল পরানো, ধাতুর পাতে মোড়া, লাল অক্ষরে ভক্তের নাম লেখা, প্রণামীর নতুন বাক্স। খুব জাঁকজমকের সঙ্গে সন্ধ্যারতি সারা হতো, ধূপধুনো চামরের পিছনে দেবীর নিশ্চল, প্রসন্ন মূর্তির দিকে চেয়ে-চেয়ে ঘোর লেগে যেত, মনে হতো সত্যই স্বর্গীয় ভাবের অধিকারিণী দেবী রাজরাজেশ্বরী। কখনও কি স্বর্গে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা জাগত তাঁর? দেবী কথা বলতেন না।
কালের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে ভাগ্যও রূপান্তরিত হয়; নদীর কোল ঘেঁষা অভাবদীর্ণ, নিস্তরঙ্গ সেই গ্রাম্যজীবনে এক দুঃসময় অতর্কিতে এসে আছড়ে পড়ল। অকারণে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো ঘরদুয়ার, কাছারি ও ধানের গোলা; বহুপূর্বে দেবী যেমন স্বর্গরাজ্য পিছনে ফেলে এসেছিলেন, প্রায় তেমনভাবেই রাতের অন্ধকারে, নৌকায়, গরুর গাড়িতে, ছেলে কাঁধে ও ঘটিবাটি মাথায় নিয়ে, পায়ে হেঁটে, মানুষ পালাতে লাগল।
রাজরাজেশ্বরী ত্যাগ করতে পারলেন না সেই পুড়ে-যাওয়া গ্রাম, প্রবাসের বিষণ্ন মৃত্তিকা।

আখতারী বাঈ

শেষ বাক্যে পৌঁছবার আগেই আপনি কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিলেন,
আপনি জানেন, পশ্চাতে কেউ আছেন রুদ্ধ সুর কুড়িয়ে নেবার;
আর তখন, সুন্দর, ত্রিভুবনে অতুল হাহারব ছড়িয়ে পড়ে।
যা-কিছু বলতে পারি নি, তা যেন কত শত রূপে ব’লে রাখলাম
যা-কিছু ব’লে রেখেছি, আশা জাগে, রাতের প্যাঁচারা দ্রুত নেমে এসে
সেইসব অতিতুচ্ছ তপ্তদেহ উদ্ধার ক’রে নিয়ে যাবে পবনে।
যা-কিছু হারালো সমাপ্তির আগেই, তা যেন জন্মায়, মরে, জন্মায়
যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি।

শ্রাবণ

অন্ধকার কেঁপে-কেঁপে উঠছে বিদ্যুতের প্রহারে, নিমেষের জন্য তাঁর নতমুখের এক পাশ প্রকাশিত হয়, আবার ঘন তমসা। এক ভীষণ বিস্ফোরণের অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্ত বয়ে যায়। মেঘের পাতায়-পাতায় বৃষ্টি অস্থির, পায়ের নিচে গড়িয়ে চলে আকাশের জল; আমরা পারব কি নির্বিঘ্নে আরও একটি বজ্রপাত পেরিয়ে যেতে? ক্ষয়ে-আসা, ভেঙে-পড়া আয়ুর প্রান্তে তপ্ত পাথরফলকের মতো এই দাঁড়িয়ে-থাকা, অদৃশ্য নতমুখ তাঁর, ধুয়ে যায়। ধুয়ে যায় আমাদের কথার ফাঁকে-ফাঁকে এতদিন পড়ে-থাকা দীর্ঘ বিরতিগুলি, নক্ষত্রগণনার কাজ। অকস্মাৎ, আরও একবার আলোর পর্বত মাথার উপর ভেঙে পড়ে; দৃষ্টিশক্তি লুপ্ত হবার পর তিনি স্পর্শ করেন আমায়, দেখি, নিচে, বহু নিচে, ওই রসাতল। সুয্যি দত্ত লেনের দাবার রোয়াক থেকে আমি ডেকে উঠছি, ‘বিভুতিদা, বৃষ্টিআসছে!’ আঁচলের খুঁটে মাথা ঢেকে টুকুমাসি ছুটে-ছুটে ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলছে, রাজেনদের পায়রার ঝাঁক এক সাথে তীরবেগে নেমে যাচ্ছে অজানা পৃথিবীর দিকে।

গঙ্গানারায়ণপুর

অবশেষে, কোনও এক মধ্যাহ্নে
বাঁশবনের ধারে, যদি কেউ ললাট স্পর্শ করে
ধীরে, অতিধীরে, তাকে দিও, আমার বিরহ।

পাটনা-র মতিচন্দ্

নরকদর্শনপর্ব চলছে, আমার চটির একটা ফিতে ছিঁড়ে গেল,
খালি পায়ে হাঁটবার কোনওরকম অসুবিধা হবার কথা নয়, তবু
প্যাড-পরা বল্লেবাজের মতো হাঁটু মুড়ে ব’সে পড়লাম, বিরতি চাই।
বিরতি চাই, বিরতি চাই, আমার দু’চোখের অনড় দাবী যমদূত
লক্ষ করলেন, ভ্রূযুগল কুঞ্চিত ক’রে জানালেন মেয়াদ বৃদ্ধি হবে,
আমি কি প্রস্তুত? এইভাবে মূক আবেদন, মূক অনুমোদনের ফাঁকে
বিরতির পুষ্প ফুটে উঠল, মধুক্ষরা বাতাস বইছে, আমরা শান্ত।
আকাশপাতাল ভাবলাম, আকাশের কথা কম, পাতালের কথা বেশি,
যমদূত গান ধরলেন মৃদু সুরে, আঈলন হো রামজী অয়োধ্যা মেঁ
পাটনা-র মোতিচন্দের জন্য প্রাণখানা একেবারে হু হু ক’রে উঠল,
মাটি থরথর কেঁপে উঠছে, দৈত্যের মুণ্ডুর আকারের পাথর সব
ধুপধাপ শব্দে পুনরায় পড়তে শুরু করল চারদিকে, রক্ষা নেই
বুঝলাম, আর রক্ষা নেই আগুনের হল্কা থেকে। গান গাও যমদূত,
অসংখ্য হাত, দেহ, সরীসৃপের মতো পায়ের কাছে কিলবিল করছে,
দু’টো হাত এগিয়ে এসে আমার দু’পা মুছিয়ে দিয়ে চটি পরিয়ে দিল।
এতক্ষণে বোধোদয় হলো, উচ্চস্বরে গান গাইবার সময় এসেছে
গানের কলির পানে তাকালাম, যেভাবে সর্বপ্রথম নরকের সঙ্গে
দেখা হয়েছিল কুয়োতলায়, ফিরে এসেছে হাড় হিম-করা প্রতিধ্বনি,
উঠুন, উঠুন তবে ক্লান্ত দেবদূত, আঈলন হো রামজী অয়োধ্যা মেঁ।

ঝরাপাতা

পথ থেকে একটি হলুদ পাতা কুড়িয়ে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এটি কি জীবনের প্রতীক, না মৃত্যুর?’
‘জ্ঞানের, পরাজয়ের’।
আত্মমগ্ন পথের বাতাস বয়ে চলে। জগতে, এই অখণ্ড নীরবতায় হাওয়া বয়; বৃক্ষশাখার ভিতর দিয়ে, জনপদ ও মানুষের ভাষার উপর দিয়ে, কখনও উদাসীন ও অবসন্ন, উন্মত্ত কখনও-কখনও, এই পর্যন্ত। মাঝে-মাঝে হাওয়া যখন থেমে আসে, মনে হয়, অজানা কোনও এক গভীর শ্বাস গোপনে অঙ্কুরিত হয়ে, ক্রমে সঞ্চারিত হচ্ছে পাতায়-পাতায়, বনপথে, অন্তরীক্ষে।
সবুজ, উচ্ছল, মুখর পাতাগুলি হলুদ হয়ে, রক্তবর্ণ হয়ে নেমে আসে মাটিতে, যেভাবে শান্তি নামে, শতকোটি বছরের স্মৃতির আকাশভাঙা রূপ যেভাবে অন্ধকারে সহসা কেঁদে ওঠে, মানুষ নতমস্তকে পরাজয় স্বীকার করে যেভাবে।

বস্ত্র

একটি সুতো আলোর, অন্যটি ছায়ার
একটি সুতো শরীর ছিঁড়ে টেনে আনা,
অন্য সুতো ধুলোর গরবে গরবিনী।
আমি বলি নি কিছু,বলছেন কবীর
যে-সুতোটি চিতার চেয়েও কালো,
তাকে সাজাও, সাজো চিরফাগুনের আভায়।

গৌতম বসু

১৩ মে, ১৯৫৫- ১৮ জুন, ২০২১

প্রকাশিত বই :
১. অন্নপূর্ণা ও শুভকাল [১৩৮৮/১৯৮১, লেখক কর্তৃক প্রকাশিত]
২. অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে [১৩৯৮/১৯৯১, মহঃ রফিক, ‘বাক্‌চর্চা’, বর্ধমান]
৩. রসাতল [১৪০৮/২০০১, ইন্দ্রাণী অনির্বাণ, ‘অনুবর্তন’, কলকাতা]
৪. নয়নপথগামী [১৪১৪/২০০৭, গৌতম মণ্ডল, ‘আদম’, কৃষ্ণনগর, নদীয়া]
৫. কবিতা সমগ্র [১৪১৪/২০০৮, সুবীর মণ্ডল, ‘কবীর’, কলকাতা]
৬. স্বর্ণগরুড়চূড়া [১৪২০/২০১৩, স্বাতী রায়চৌধুরী, ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’, কলকাতা]
৭. কবিতাসংগ্রহ [১৪২১/২০১৫, গৌতম মণ্ডল, ‘আদম’, কৃষ্ণনগর, নদীয়া]

গ্রন্থ-সম্পাদনা :
১. শ্রেষ্ঠ কবিতা দেবদাস আচার্য [২০০৮, গৌতম মণ্ডল, ‘আদম’, কৃষ্ণনগর, নদীয়া]
২. সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা (যৌথ সম্পাদনা, ভূমেন্দ্র গুহ-এর সঙ্গে) [২০১৩, অণিমা বিশ্বাস,‘গাঙচিল’, কলকাতা]

পুরস্কার (কবির অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ তথ্য সন্নিবেশিত হলো) :
১. বীরেন্দ্র পুরস্কার ২০০৩—’রসাতল’-এর জন্য (এটি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত একটি বার্ষিক পুরস্কার)
২. রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ২০১৫—’স্বর্ণগরুড়চূড়া’-এর জন্য (পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বার্ষিক পুরস্কার)

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top