আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিশেষ অতিথি

ছোটগল্প

।। হুমায়ূন শফিক ।।

ঘড়িতে প্রায় তিনের কাঁটা ছুঁই ছুঁই করছে। একটু পরেই মিলিত হবে ঘন্টার কাঁটার সাথে তিন সংখ্যাটা। তবু বিশেষ অতিথির আসার কোনো খবর নেই। রাস্তার দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো ঘুরপথে যাওয়া আসা শুরু করেছে। সেজন্য জ্যামের পরিমাণ বেড়ে গেছে। লাইনের পর লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িগুলো। কয়েক কিলোমিটার তো হবেই। 

বিশেষ অতিথি

অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি, দু’চোখ কড়া রোদে জ্বলে যাচ্ছে। হুকুমের অপেক্ষায় আছি। কখন হুকুম দিবে, কে জানে! বিরক্তির চরম সীমা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। গা থেকে ঘামের দুর্গন্ধ নাকে এসে তীব্র ধাক্কা দিচ্ছে। শরীর ঘামে জবজব করছে। নিজের কাছে মনে হচ্ছে, মাত্রই গোসল করলাম, এখনও গা মোছার সময় পাইনি। ঘাম ঝরে পড়ছে, বুক থেকে পেটে, পেট থেকে লিঙ্গের দিকে সাপের মত এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে। কেউ বাধা দেওয়ার নেই। সাপটা ঢুকছে, হয়তো এখনই লিঙ্গে গিয়ে কামড়ে দিবে। তারপর রক্তে ভিজে যাবে, নোনা রক্ত। 

‘সবাই সোজা হও।’ 
বলার সঙ্গে সঙ্গে, সবাই সোজা হয়। 

আকাশে হিংস্র সূর্য। তাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। মাথা থেকে টপ করে এক ফোঁটা ঘাম ঘাড়ে পড়ল। শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। চোখটা ডান ঘাড়ে নিয়ে দেখলাম, একটা গোল চিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। আবার সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই তিনি আসবেন কখন?’ 
‘কেমনে কই?’ বলে কষ্টের হাসি হাসলেন। ‘হেরা তো পূর্ণিমার চাঁন্দের মতন, কহন আসে, কহন যায়, কওয়া মুশকিল।’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছেন।’ বলে আমি টানটান হয়ে রইলাম। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। তবে পায়ের তালুতে এমন ব্যথা হয়, যেন কেউ কাঁটা বিঁধিয়ে দিচ্ছে। কাঁটার আঘাত সহ্য করা এত সহজ নয়। সেই প্রাচীনকালের দাসের মতই, ঠিকঠাক কাজ না করলে কঠিন শাস্তি। তবে আমরা ঠিকঠাক কাজ করেই কঠিন শাস্তি পাচ্ছি। আমাদের মতো সবাই, প্রাচীন কাল থেকেই এইরকম শাস্তি ও দাসত্ব গ্রহণ করে এসেছে। 

রাস্তাটা ফাঁকা। গাড়ি-ঘোড়ার কোনো বালাই নেই। বিশেষ অতিথিকে সম্মান জানানোর জন্য সেই সকাল ছয়টা থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর আসার কথা সকাল দশটায়। এখন দু’টো বাজে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেই ভোর ছয়টা থেকে। প্রথমে কিছুক্ষণ প্র্যাকটিস করেছি। এখন স্থির দাঁড়িয়ে। কারো মুখে কথা নেই। মুখের সব কথা শরীর চুষে নিয়েছে, এখন ঘাম হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে সেসব। 

চারপাশে গাড়ির সারি। সারিগুলো দেখে মনে হচ্ছে তারা কুচকাওয়াজ করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িগুলা’র জন্য খুবই কষ্ট হচ্ছে। জড় বস্তু বলে কি তাদের প্রাণ নাই, তাদের ব্যথা নাই! 

হঠাৎ করে দূর থেকে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। হয়তো তিনি আসছেন। আমাদের উদ্ধার করতে। মনটা খুশিতে ভরে গেল। একদিনের জন্য আমি ছুটি নিয়েছিলাম, কিন্তু হঠাৎ করেই এই কাজ। ভেবেছিলাম, ছেলেটিকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াব। ওর মাকে নিয়ে সামান্য কেনা-কাটা করে ফেলব। অনেকদিন রেস্তুরায় খাওয়া হয় না। সেখানেও যাব। কিন্তু কাজটা না করলেই নয়, কারণ আমি তাদের অধীনে। আসতেই হবে। স্বাধীন দেশে পরাধীনতা গলায় পরেছি। হয়তো, স্বাধীনতার অপর নামই পরাধীনতা। হয়ত অতি দুঃখে এইসব কথা বলছি। স্বাধীনতার সংজ্ঞাটা এখন পড়া হয়নি। তাহলে বুঝতে পারতাম হয়তো।  

কয়েকটি গাড়ি এলো সত্যি, কিন্তু তিনি এলেন না, তিনি আসবেন এই খবরটা নিয়ে এসেছে। গাড়ি থেকে একজন নেমে বলল, ‘আপনারা প্রস্তুত তো?’
সবাই বলে উঠল, ‘ইয়েস’।
‘তিনি এখনই আসবেন, রাস্তা দেখতে পাঠালেন।’ বলে লোকটি আবার গাড়িতে উঠে চলে গেল। 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচের দিকে তাকালাম। চোখ তুলে তাকাতেই দেখি রোডের ওপাশে কয়েকটা এ্যাম্বুলেন্স। তারা বের হওয়ার জন্য ভিড় ঠেলে রাস্তা থেকে গলির ভিতর ঢুকে গেল। অনেকেই বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেছে। বকবক-ফিসফাস শব্দ শুনতে পেলাম, তার মধ্যে দুই-একটার অর্থ করলে এরকম দাঁড়ায়, ‘বাল-ছাল কে না কে আসবে, আমাদের দুর্গতি।’’
আরেকজন বলেছিল,‘শালারে জ্যামের মধ্যে আটকায় রাখলে বুঝত।’
অন্যজন বলেছিল,‘খানকির ছাওয়াল…..’ সে আরো কিছু বলেছিল, কিন্তু বোঝা যায় নি। 
আর একজন বলেছিল,‘তার গুদ মারা হোক।’ এই কথাটা বলার পর মনে হয়েছে, আমাদের বিশেষ অতিথি তো পুরুষ। তার কি গুদ আছে? 

আমার মাথা আজ ভনভন করছে। মনে হচ্ছে, মাথার ভিতর কোনো পোকা ঢুকেছে। সেটা সারা মাথাময় উড়ে বেড়াচ্ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, ‘দেখ ভাই, আমি মানুষ যন্ত্র না।’ কিন্তু কাকে বলব। যন্ত্রকে বলে তো আর লাভ নাই। মানুষকে বলতে হবে, কিন্তু কই সে? 

ঘামের স্রোত আবার বইছে, বইতে থাক। মোজা ভিজে গ্যাছে, মনে হয়। সামনের লোককে বললাম, ‘ভাই, আপনার কেমন লাগছে?’ বোকার মতো প্রশ্ন, তবু কেন যেন মনে হল দেখি কি বলে?
‘অত্যন্ত বালো। আপনেরও মনে অয় বালো লাগছে।’

আমি হাসলাম। এই হাসির অর্থ সে জানে, তাই সেও হাসল। তার চোখের মণি মেঘের মতো কালো। লোকটাকে ভালই লেগে গেল। কিন্তু আলাপ করতে মন চাইছিল না, মন চাচ্ছিল, ছুটে বাসায় গিয়ে ঘুমাই। ঘুম মনে হয়, দুই একবার এসেছিল। কে জানে, এখনও ঘুমের মধ্যেই কিনা? কিন্তু না, ঘুমের মধ্যে না, সেটা আমি ভাল করেই জানি। 

ঘড়িতে প্রায় তিনের কাঁটা ছুঁই ছুঁই করছে। একটু পরেই মিলিত হবে ঘন্টার কাঁটার সাথে তিন সংখ্যাটা। তবু বিশেষ অতিথির আসার কোনো খবর নেই। রাস্তার দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো ঘুরপথে যাওয়া আসা শুরু করেছে। সেজন্য জ্যামের পরিমাণ বেড়ে গেছে। লাইনের পর লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িগুলো। কয়েক কিলোমিটার তো হবেই। 

আবার গাড়ির বহরের আওয়াজ শুনতে পেলাম। এবার ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখি দূরে একপাল গাড়ি ধীরে ধীরে চলছে। আমাদের দিকেই আসছে। যাক, তাহলে শেষ পর্যন্ত আসল। শরীরের সমস্ত শক্তি ফিরে এল যেন। একটু পরেই বাসা। দেখা যাক, কিন্তু এত ধীরে চলছে কেন, দ্রুত আসে না কেন? হয়ত আমার মতো যারা দাঁড়িয়ে আছে, সবার মনেই একই প্রশ্ন। গাড়ি এত স্লো কেন চলবে। কোনো রোগী আছে নাকি? যার জন্য গাড়ি স্লো চলছে। দ্রুত চললে হয়ত তিনি হার্টস্টোক করবেন, তাই ধীরে ধীরে চলছে। এই মুহূর্তে সময় যেন যায় না। এক মিনিট-দুই মিনিট এভাবে, বিশ মিনিট কেটে গেল, গাড়ি আগের মতই ধীরে ধীরে চলছে। এখন যেন চলছেই না, দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। 
‘ভাই, গাড়ি কি নষ্ট হয়ে গ্যাছে?’ পিছনের লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করল।
‘জানি না, ভাই, হতেও পারে।’ 
কারও সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত লাগছিল। তাই তার সঙ্গে আর কিছু বললাম না। লোকটি হয়ত বিরস মুখে আমার মাথার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যেমন তাকিয়ে আছি, আমার সামনে থাকা লোকটির মাথার দিকে। 

গাড়ির বহর এখন দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। শেষ পর্যন্ত আসছে তো, এটাই আসল কথা। একটু পরে, দেখা গেল, গাড়ির বহর আমাদের সামনে দিয়ে অতি দ্রুত চলে গেল। ঠিক বুলেটের গতিতে। আমরা যে বিশেষ অতিথিকে সম্মান জানাব, তার সুযোগ পর্যন্ত পেলাম না। সবাই আমরা ককিয়ে উঠলাম, না না শরীরের ব্যথায় নয়, মনের ব্যথায়। 

একজন এসে ঘোষণা দিয়ে গেল আমাদের কাজ শেষ। কাজটা শেষ পর্যন্ত শেষ হয়েছে ভেবে শান্তি পাচ্ছিলাম। শরীরে এখন আর ঘাম নেই। নোনা ঘাম ততক্ষণে শরীরের ভিতর ঢুকে পড়েছে, নতুন করে ঝরবে বলে।  

হুমায়ূন শফিক

জন্ম ১৯৯৪ সালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নবাবগঞ্জে। পড়ালেখা করছেন টেক্সটাইলে। গল্প, উপন্যাস লেখেন, অনুবাদ করেন।

Share

2 thoughts on “বিশেষ অতিথি”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top