।। জেসমিন নাহার ।।
রথীচন্দ্রপাড়া
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে সবুজ ঘন ঝোপ, কোনো বনবাসী মেয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে গিয়েছে মনে হয়। বড় বড় ঘাস, অসংখ্য বুনোফুল। কোনো একটা নির্দিষ্ট গাছের বন নয়। ছোট, মাঝারি আর বড় নানান জাতের গাছে সমৃদ্ধ এই স্বচ্ছন্দ প্রকৃতির লীলাভূমি। জায়গায় জায়গায় বন বেশ ঘন। গায়ে গায়ে ডালপালা এসে ঠেকে। ঘন হলেও এই ঘন বন ভেদ করে সূর্যের আলো মাটিতে এসে পড়েছে। আলো ছায়ার খেলা বনের সর্বত্র।
রাস্তা ইঁটের বটে তবে পিচ ঢালা নয়। জঙ্গলের বুক চিরে যে রাস্তা তা কোনো এক সময় মাটির ছিলো । পাহাড়ি বনের রাস্তা, পাড়ি দেওয়া যতই দূর্গম হোক সেখানে ইঁট বড়ই বেমানান। তাই বৃষ্টি তার বর্ষণের শক্তি দিয়ে পাহাড়ি রাস্তার ইঁট সরিয়ে মাটি বের করে দিয়েছে। এ অঞ্চলে যানবাহন বলতে পর্যটকদের জন্য বাইক, স্থানীয়দের জন্য পা এবং লেগুনা। বিশেষ কাজে সময় বাঁচাতে তারা লেগুনা ব্যবহার করে। অন্য সময়ে পায়ে হেঁটেই দূর দূরান্তে চলে যাতায়াত । যে পথ সমতলের মানুষ পাহাড়ে গিয়ে আড়াইঘন্টায় পাড়ি দেয় সেই একই পথ পাহাড়ি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী আধাঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পাড়ি দেয়। বনের পথ সন্ধ্যায় নিরাপদ নয়। যদিও বাঘ, ভাল্লুক, নীলগাই বা অন্য কোনো হিংস্র পশুর নিশানা চারিদিকে নাই। এখন এই সকল বনের প্রাণী ও জীবকূল গল্প আর জনশ্রুতি হয়ে গিয়েছে। তারা এক সময় ছিল । এখন আর তারা চোখে দেখা যায় না। মানে নাই। বানরের দেখাও মেলে না সচরাচর। তবুও স্থানীয় অধিবাসীরা সাবধানে চলাফেরা করে। শহর বা অন্য কোনো জায়গায় গেলে সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরে। ভয় পায় ওরা। তবে কোনো পশুর নয়, মানুষের।
বেলা বারোটা। ঠিক দুপুর। ইঁট হড়কে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তায় আমার মতো সমতলের মেয়ের অভিযান দুঃসাধ্য বটে। মাথার উপরে কখনো সূর্যের প্রখর রোদ, তো কখনো ছায়া। পথ চলবার কষ্ট আছে। কিন্তু কানে প্রবাহিত হচ্ছে পাহাড়ি ঝর্ণার ঝির ঝির করে বয়ে যাবার শব্দ। স্থানীয়রা প্রবাহের নাম দিয়েছে ‘ছড়া’। উঁচু টিলার উপরে তাদের বসবাস। টিউবওয়েল নাই। এই ছড়া থেকেই তারা পানি সংগ্রহ করে পান করে। শব্দ খুব নিকটে মনে হলেও আসলে বহুদূরে। রথীচন্দ্রপাড়া গ্রাম থেকে ছড়ায় যেতে লাগে আধাঘন্টা, আর আশেপাশের স্থান থেকে লাগে দু তিন ঘন্টা। কিন্তু শব্দ শোনা যায় দূর থেকেই।
হঠাৎ রাস্তা দিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ে পালালো কালো রঙের কাঠবিড়ালি। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই হরেন বিকাশ আর সোনিয়া ত্রিপুরা বললো, এখানে প্রায় চার প্রকারের কাঠবিড়ালি দেখতে পাওয়া যায়। ধূসর, সাদা, কালো আর ধূসরের উপরে বাদামি কালো ছোপ। বললাম, শেষেরটা আমার গ্রামে পাওয়া যায়। হঠাৎ উড়ন্ত কাঠবিড়ালির কথা মনে পড়লো। বইয়ে পড়েছি, কিন্তু দেখিনি। পাখি ওড়ে, কিন্তু জীব কি ওড়ে? আমি যখন জানলাম কাঠবিড়ালিও ওড়ে এবং বাংলাদেশে ‘উড়ন্ত কাঠবিড়ালি’ আছে! কাঠবিড়ালি প্রজাতিটি বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের রক্ষিত বন্যপ্রাণীর তালিকার তফসিল-১ অনুযায়ী সংরক্ষিত – তখন ভেবে রেখেছি একবার উড়ুক্কু কাঠবিড়ালির সঙ্গে মোলাকাত দরকার। হয়তো এই বনেই তারা আছে। কিন্তু এদের যে রক্ষা করতে হবে সেটা আমরা কয়জনই বা জানি। বাংলাদেশের একই পরিবারের কতো রকম ‘জাত’ আছে তা নিয়েও আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা নাই। আমার সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করবার ইচ্ছা হলো একবার, কিন্তু একটা অপরাধবোধ আমাকে চুপ করিয়ে দিল। কারন বন তো আমরাই, মানে শহরের মানুষেরাই ।ধ্বংস করেছি! কী করে এখন জিজ্ঞাসা করি, এখানে এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে যাওয়া কালচে বাদামি কাঠ বিড়ালি কি দেখতে পাওয়া যায়? পারলাম না। আমরা কাঠবিড়ালির মতো নিঃশব্দে অনেকটা পথ পার হয়ে এলাম।
বনের মাঝে থেকে থেকে টুং টাং ঘন্টা বাজছে। ত্রিপুরী নারীরা তাদের গরুর গলায় ঘন্টা বেঁধে বনে ছেড়ে দিয়েছে। ঘন্টার শব্দ তাদের গরু খুঁজে পাবার নিশানা। প্রায় দুই কিলোমিটার পথের ধারের রাস্তায় কোনো বাড়ি নেই। মাঝে মাঝে হুঁকো হাতে এক দু’জন লোককে পথে বসে গল্প করতে দেখা যায়। তাদের পাশে ধারালো দা। ভেবেছিলাম দা দিয়ে বুঝি তারা গাছ কাটবে! কিন্তু হরেন বিকাশ সংশোধ করে করে দিলো। জানালো যে তারা তাদের জুমের ফসল কাটতে এসে জিরিয়ে নিচ্ছে। বনের ধার থেকে হঠাৎ শূকরের ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজ আসছে। সাথে দুপুরের খাঁখাঁ রোদের তাপে বের হওয়া ঘন বিন্যস্ত ঝোপের মাঝ থেকে নাকে এসে লাগছে বুনো ফুলের গন্ধ।
জঙ্গলের শেষ নাই। হেঁটেই যাচ্ছি কিন্তু আসলে পাহাড়ে উঠছি। পাহাড় তবে পাথর নয়। ভেজা বা শুকনা চিকচিকে বালিও নয়। মাটির পাহাড়। যে মাটির বুক ভেদ করে পৃথিবীর প্রথম পদক্ষেপ ফেলা বৃক্ষ সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেদিকেই চোখ যায় পাহাড়ের বুকে সবুজ। বহুদূরে চোখ মেলে তাকালে দূরের সবুজে ঘেরা বনকে কালো পাহাড় বলে ভ্রম হয়। রাস্তা আর কতটুকুই বা শুধু মনে হয় পৌঁছে গেলাম রথীচন্দ্রপাড়া।
– এই দূর্গম পাহাড়ি রাস্তা তুমরা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পাড়ি দাও!
– হ্যাঁ দি। তুই আছিস বলে আমারও দেরি হচ্ছে।
সোনিয়া বললো। রথীচন্দ্রপাড়া গ্রামের মেয়ে সোনিয়া। হরেন বিকাশের গ্রাম চারমাইল। সোনিয়ার গ্রাম পাহাড়ের টিলায়। ওকে দেখছিলাম আর চর্যাপদের পদ গুন গুন করে গাইছিলাম।
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসি
হাড়িত ভাত নাই নিতি আবেসি।।
প্রখর সূর্যতাপ আমাকে মলিন করে তুললেও এই প্রসারিত বন আর ওদেরকে এই আলো যেন সতেজ করে তুলেছে। সূর্যের আলো আর বাতাসে ওরা হেলেদুলে চলছে। আর সবুজ বনও হেলেদুলে খেলছে, কিম্বা পাশে হাঁটছে। ওরা দুজনেই ত্রিপুরী। যাবার পথে সোনিয়া থাকলেও আসবার পথে শুধু হরেন বিকাশ সাথে থাকবে। এক চাকমা বান্ধবী আমাকে বলেছিল, “পাহাড়ে গিয়ে কখনো বাঙালিদের সাথে ঘুরবি না তাহলে ঘুরার সমস্ত আনন্দ মাটি হবে। হয় যেখানে যাবি সরাসরি সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গী বানাবি, নয় তো গাইড হিশেবে চাকমা মারমা ত্রিপুরীদের নিবি।” আমি তাই মেনেই পাহাড়ে ঘুরি। ওরা বলে চলেছে, চাঁদনি রাতে বন বেশি সুন্দর হয়। মাঝে মাঝেই হরেন বিকাশ আমাকে জিরিয়ে নিতে বলছে। বলে, “তুই ছমতলের মেয়ে একটানা হাঁটিছ নে। ফেরার পথে কস্ট হবে।” ওদের আধো বাংলা বোল… তারপরে নিজেই বলছে, “তাড়াতাড়ি চল দি, ফেরার পথে তোর সন্ধ্যা হবে। ওদের সহজ তুই সম্বোধন যেন আমাকে ওদের আপন দিদি বানিয়ে দিলো। ওদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দিগন্তবিস্তৃত নয়নাভিরাম সবুজ দেখছি। বনের মাঝে ঘরের চাল উঠে গেছে। তারও মহৎ সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছে। পাহড়ের গা ঘেঁসে কলার বাগান। তিলের সারি সারি গাছ। সমতলে আখের যেমন ঝোড় বাঁধে তেমনি তিলের ঝোড় বেঁধে রেখেছে ওরা, বাতাসের দোল লেগে যেন পড়ে না যায়। হরেন বিকাশ বললো, “ওটা দীঘিনালা দি। দীঘিনালায়ও তুই আমার ছাতে যাইছ।” ওরা আমাকে আপন করে নিয়েছে। অথচ আসার সময় বহু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। ভেবেছিলাম অনেকক্ষণ। কী করব? যাব নাকি অচেনা যুবকের সাথে অজানা স্থানে! কে জানে কোন অনিশ্চিত বিপদে পড়বো কি না! আমার ভীতির কারণ ওরা বুঝেছিলো। তাই আমার নারী সঙ্গী হিশেবে ওরা সোনিয়াকে দিয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা উঁচু পাহাড় পড়লো সামনে। হরেন বিকাশ বললো, “দি আগে এখানে আর্মি ক্যাম্প ছিলো।” ক্যাম্প এখন নাই কেন প্রশ্নের জবাবে জানালো, শান্তিবাহিনী অস্ত্র জমা দিয়ে দেবার পরে আর ওদের থাকবার প্রয়োজন পড়েনি। এখন বনের মানুষের ন্যায় অন্যায়ের বিচার করে বনের মানুষেরাই। হরেন আর সোনিয়া পাহাড়ি মানুষ। হরেন কাজ করে, রোদ্র তাপে পুড়ে তার সাদা বর্ণ তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। সোনিয়ার সাদা ধবধবে শরীর। রোদ তার গায়ের শোভা মলিন করবে কী বরং বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আমার এই প্রথম পাহাড় ভ্রমণ নয়। এ আমার দ্বিতীয়বার পাহাড় ভ্রমণ। ওইবারও আমি শহর গ্রাম দুটোতেই ঘুরেছিলাম। এইবারও তাই। পাহাড়ের রাতের রাস্তা মায়াবী। চারপাশ থেকে আসা পাকা আনারসের ঘ্রাণ নাকে ধাক্কা খায়। সাথে যদি থাকে পাহাড়ি মেয়ে তবে তা হয়ে ওঠে আরো উপভোগ্য। প্রথমবার মহালছড়িতে দেবতার পুকুর দেখতে যাবার পথে পুজারি চাকমা ছিলো সাথে। সংকীর্ণ রাস্তার দুধারে লজ্জাবতীর বন। কানে ঝর্ণার পানি প্রবাহের ঝিরি ঝিরি শব্দ। আর কিছুক্ষণ পরে পরে পূজার হারিয়ে যাওয়া। হঠাৎ আবার উদয় হওয়া। এবং হাতে ধরা তাড়ি তাড়ি ঢেঁকি শাক। মাথায় ব্যাগটাকে পাহাড়ি কন্যার ঝুলানো। সে অপূর্ব দৃশ্য। লজ্জাবতীকে ছুঁয়ে দিচ্ছিলাম আমি। আর তার মানুষের স্পর্শে লজ্জায় ভেঙে পড়ে যাওয়া, যেন কুমারীর প্রথম পুরুষ স্পর্শ! যাইহোক, আড়াইঘন্টা পেরিয়ে আমরা পৌছে গেলাম রথীচন্দ্রপাড়া গ্রামে।
আমি আজ এই গ্রামে আসবো আমি জানতাম না। আমি খাগড়াছড়ি শহরের কাঁচাবাজারে ঘুরছিলাম। পাহাড়ি নরনারী নানান শাক সবজির পসরা সাজিয়ে বিক্রি করছে তাদের পাশে পাশে ঘুরে ঘুরে গল্প করছিলাম। বাঙালিদের আর পাহাড়িদের বাজার পার্থক্য করা যায় সহজেই। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক ব্যক্তি আমার নিকটে এসে বললেন, “দিদি আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন? আপনি কি সাংবাদিক?” বললাম, আমি ঢাকা থেকেই এসেছি দাদা। কিন্তু সাংবাদিক না। মনের আনন্দে ঘুরছি। জুমে চাষকৃত ধান, চিকুরফল, মরিচ, বেগুন, পাহাড়ি আমলকির চারা পাবো কোথায় তা জানবার এবং আপনাদের সাথে মিশে যাবার চেষ্টা করছি। বললেন, “দিদি আমাদের গ্রামে চলেন। আমাদের গ্রামের নাম রথীচন্দ্রপাড়া। আমাদের ত্রিপুরী গ্রাম। কোনো চাকমা মারমা বা অন্য কোন উপজাতি নেই। আমাদের গ্রাম বড়ো না, ছোট একখানা ছড়া ( ঝর্ণা) আছে দিদি। ও দিদি আমার বাড়ি পুড়ে গেছে দিদি। আমার বাড়িটা নিয়ে একটু সরকারের কাছে লেখেন দিদি…” এই ব্যক্তির নাম যুক্তিরঞ্জন। সে দেখা দেবার পূর্বেই আমার অন্য এক চাকমা নারীর সাথে কথা হয়েছে যে আমি তার গ্রামে যাব। ওই সময়ই তিনি পাশে এসে বললেন, “যা, তুই যুক্তিদের গ্রামে যা।” তোর ভালো লাগবে। অনেকদূর পাহাড়ে। আমি একবার গিয়েছিলাম। এই যুক্তিরঞ্জনই আমাকে তাদের গ্রামে পাঠায়েছে। বাজারে তার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে রথীচন্দ্রপাড়া গ্রামের অন্যান্য আর সকলে হরেন বিকাশের সাথে পাঠায়েছে। একা একটা অচেনা ছেলের সাথে কিভাবে যাব তাই সাথে সোনিয়াকে দিয়েছে। ফিরতে হবে যদিও হরেন বিকাশ ত্রিপুরীর সাথেই।
রথীচন্দ্রপাড়া গ্রামে প্রবেশ করবার মুখে দ্বিতীয় বাড়িটা যুক্তিরঞ্জনের। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে, গায়ে ডালপালার আঁচড় খেয়ে তার বাড়িতে গিয়ে দেখি যুক্তিরঞ্জনের মা দা দিয়ে পাতা সাইজ করে কাটছে। বাড়িতে সদস্য তারা তিনজন। যুক্তিরঞ্জন, তার ছেলে এবং তার মা। স্ত্রী মারা গেছে। পরিস্কার করে ঝাড় দেয়া উঠোনবাড়ি। বিভিন্ন স্থানে পুড়ে যাওয়া জিনিসের স্তুপ। পোড়া টিন এক স্থানে গাদা করে রাখা। ওই পোড়া টিনেই একটা ছোট চালা বাঁধা। কালীপূজার রাতে হঠাৎ তাদের ঘরে আগুন লেগেছে। বাড়ির সর্বত্র পোড়া চিহ্ন। যুক্তিরঞ্জনের মাও অনুরোধ করলেন ঢাকায় ফিরে সরকারকে বিষয়টা জানাতে। আমি রীতিমতো বিব্রতবোধ করলাম। ওদের আমি কিভাবে বুঝাই যে যিনি যুক্তিরঞ্জন তিনিই জেসমিন। সরকারের কাছে আমাদের কোনো প্রভেদ নাই। তবুও বলে দিলাম, আচ্ছা মাসি বলবো। যুক্তিরঞ্জনের সত্যিই দূর্দশার অন্ত নাই। তার বাড়ি থেকে বের হয়ে পৌছালাম প্রথম বাড়িতে। দেখি একটা চেয়ারে একজন বসে হুঁকো টানছে। তার পাশে তিলের গাছ শুকাতে দেয়া, শুকালে মাড়াই চলবে। তার স্ত্রী শূকরকে খেতে দিচ্ছে। আমরা যেমন বাড়িতে ছাগল বেঁধে রাখি ওরা তেমন শূকর বেঁধে রাখে। একটি শূকর বাঁধা। তার পেটে বাচ্চা। তাই তাকে বাড়িতে বেঁধে বিশেষ যত্ন নেওয়া হচ্ছে। অন্যগুলো পাশেই চরে বেড়াচ্ছে আর ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ করছে। মনে হচ্ছে একে অপরের সাথে ঝগড়া করছে। শূকরকে খাদ্য দেওয়া শেষ হলে তাদের ঘরে আমাকে বসতে দেওয়া হলো।
আমি না বসে ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বেড়ালাম। বনের মাঝে পাহাড়ের টিলায় ওদের জীবনযাপন। ঘর মাটির। কিন্তু তৈরি স্টাইল শহরের। একটা ঘরের তিনটা রুম। তার মাঝেই রান্নাঘর এবং বাইরে দুটি বারান্দা। এ বাড়ির কর্তা বৃদ্ধ কিন্তু কর্ত্রী যুবতী। তাদের ছেলেমেয়ে শহরে গেছে। আজ সোমবার, খাগড়াছড়ি শহরের বাজার।তাদের কাপড়গুলো বাঁশে ঝুলানো। বাড়ির মধ্যে পেয়ারা কুল তেতুল কাঁঠাল নারিকেল আর লেবুগাছ। ঘরে শিদলের উগ্র গন্ধ। তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে তিলের বীজ দেওয়া যাবে? যুবতী উত্তর দিলো, “দিদি একমাস পরে এলে নিশ্চই দেওয়া যাবে।”
বনের মধ্যে দিয়ে মানুষের যাবার রাস্তা। রোদের তীব্রতা কমবে কী বরং বাড়ছে। জুমে চাষ করা নানান ফসল দেখতে দেখতে পুড়তে পুড়তে পাহাড় থেকে আবার রাস্তায় নামলাম। এতক্ষণে আমার তৃষ্ণা পেয়েছে। সোনিয়াকে বললাম তাদের বাড়ি গিয়ে পানি খাবো। রাস্তায় হাঁটছি আমরা কিন্তু আসলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠছি। উঠতে উঠতে দেখি একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। পুরাতন নয়, নতুন। তিনটা রুমে বারোটা বেঞ্চ। রথীচন্দ্রপাড়া গ্রামে শিক্ষার হার নগন্য। স্কুলে যাবার তাড়া নাই তাদের। কেউ এখনো তারা এস এস সি পাশ করেনি। আবার তারা বর্বর অসভ্যও নয় (আমরা যা সাধারণত মনে করি)। চারটা ডিগ্রী অর্জন আমার। ওদের দেখে বৃথা মনে হলো। মনে হলো পঁচিশটা বছর শুধু পরীক্ষা দিয়ে কাটায়েছি। কে প্রথম আর কে দ্বিতীয় হবে তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি। আমার বান্ধবী রুমি একবার মানত করেছিলো সে যদি পরীক্ষায় আমাকে টপকে এক পায় তাহলে এক খতম কোরান পড়ে দেবে আল্লাহর নামে। ভাবলাম, ভাবটা এমন যেন আল্লাহ দারুণ ঘুষখোর! সেভেন থেকে এইটে উঠবার সময় আমার দুই রোল হয়েছিল আর রুমির এক। জানিনা খতম দিয়েছিল কিনা। শুধু জানি আমার আগে যেতে পেরেছিল, আমি অঙ্কে পেয়েছিলাম মাত্র তেত্রিশ। যা ওকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। শুধু অঙ্ক করবো না দেখে আমি চাকরির জন্যও পড়িনি। আমি ক্লাসে কখনো কাউকে আগে যেতে দিইনি। কিন্তু বোর্ড পরীক্ষায় কখনো মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। ক্লাসেই যা অর্জন করতাম সেগুলোই হতো আমার পরীক্ষার খাতার সম্বল। সে যাক, পরীক্ষা পাশের ওই যে হুড়োহুড়ি আর ডিগ্রী অর্জন মাত্র নিরর্থক মনে হলো আমার। যে মেয়েটা সারাপথ দি দি বলে পাশাপাশি হাঁটলো সে কখনো স্কুলে যায়নি। কিন্তু আধো বোলে বাংলা বলে। চাঁদনি রাতের সৌন্দর্য বেশি তা জানে, দেশ সরকার কন্ট্রোল করে তা জানে, সন্ধ্যায় বনের রাস্তা আমার জন্য বিপদসংকুল তা জানে। সে দূর ঝর্না থেকে প্রতিদিন পানি আনে। ওরা যা শিখেছে, সবটাই এই প্রকৃতি থেকে। ওদের কাছে আমার ডিগ্রী বৃথাই পড়ে রইলো। যাকে আমরা বলি শিক্ষা, তার সংবাদ ও নমুনা ওদের গ্রামে পৌছেছে মাত্র কয়েকবছর হলো। হ্যাঁ, এটা ভারতের কোনো প্রদেশ নয়, আমাদেরই তিন পার্বত্য এলাকার এক এলাকা খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম রথীচন্দ্রপাড়া।
স্কুল ছাড়িয়েই আধাকিলোমিটার পরেই মূল গ্রাম। একেকটি বাড়ি আরেকটি থেকে একটু উপরে। গিয়ে দেখি তিন ত্রিপুরী বৃদ্ধা পাশাপাশি বসে ধান শুকাচ্ছে। মাটি দিয়ে গুল্টির গুলি তৈরি করে শুকাতে দিয়েছে শিশুরা। হরেন বিকাশ বললো তিন বৃদ্ধাই বাংলা বলতে জানে না। কিন্তু বোঝে। গলায় পাঁচ সাতটা করে পুঁতির মালা জড়ানো। কান বিশেষ ভাবে ফুটানো। কানের দুলও বেশ মোটা। শিশু কিশোর এবং যুবক পাশের এক বাঁশের চালিতে বসে আছে। একজন আমাদের দেখে হুঁকোতে টান লাগালো। উঠানে বড়ো তেঁতুল গাছ। যার গুঁড়িতে শিশুরা বসে খেলছে। কাঁচা তেঁতুল ছেয়ে আছে গাছে। গাছের নীচেই খাদ। উপর থেকে নীচে তাকালে ভয় লাগে। সেই নীচ থেকে বাঁশগাছ উঠে গেছে উপরে। কো্নো বাড়িতে বড়ো কাঁঠাল গাছ। মুরগি আর শূকর চরে বেড়াচ্ছে পাশাপাশি। গেরস্থ বাড়িতে যা প্রয়োজন তা সব ওদের আছে। শুধু ঘরে ওদের আসবাব নেই। যেন তার প্রয়োজনও নেই। ওরা যেন শহরবাসীর জন্য এক বড়ো ধিক্কার! দ্যাখ তোরা সোনার পালঙ্কে শুয়েও মানুষ আর আমরা মাটির ঘরে শুয়েও মানুষ। পুরো গ্রামে একটা দোকান। দোকানে দ্রব্যও সামান্য। ডিম, শিশুদের নানান খাদ্যদ্রব্য যেমন চকলেট, চুইংগাম, পেপসি, চিপস এবং নানা জাতের শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, পেপসোডেন্ট এবং মেরিল সাবান। রথীচন্দ্রপাড়ায় প্রযুক্তির ছোঁয়া ক্রমেই পৌছানো শুরু হয়েছে। বাড়ির পুরুষরা সব বাড়িতেই আছে। যুবতী মহিলারা শাক সবজি তেতুল থোড় প্রভৃতি শহরে নিয়ে গিয়েছে বেঁচতে। পুরুষরা হুঁকো হাতে গল্প করছে। কোনো কোনো বৃদ্ধা ঘরের দরজায় বসে হুঁকো টানছে।
সব শেষে গেলাম সোনিয়াদের ঘরে। ওদের ঘরটা অন্যদের তুলনায় ছোট। সিদলের উৎকট গন্ধ। সোনিয়া আমাকে পানি খেতে দিলো। টিলার উপরে টিউবওয়েল বিহীন বাড়ি। ঝর্নার জল দিলো খেতে। ওরা ঝর্ণার পানিতেই গোসল করে। সোনিয়াদের ঘরের মধ্যে দুটো কক্ষ, ওর ঘরের একপাশে চালের বস্তা গাদা করে রাখা, আরেকপাশে ওর পাটি পাড়া। পাটির উপরে ওর বালিশ কাঁথা রাখা। পাশের ঘরে ওর দাদাবৌদি থাকেন। মাঝের ড্রয়িং মতোটাতে ওর বাবা-মা থাকেন। আর একটা ছোট রান্নাঘর। ওরা সকলেই মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমায় এখনো।
তারপর কিছুক্ষণ বনে বনে ঘুরলাম। ছোট বড়ো গাছ দেখতে দেখতে ভাবলাম, এই বন হয়তো ভবিষ্যতে আরো গভীর হবে নয়তো উজাড় হয়ে যাবে। যদিও এই সহজ মানুষগুলোর মধ্যে টাকার লোভ এখনো পেয়ে বসেনি। তাদের নিজস্ব সম্পত্তি তারা আগলে রেখেছে। কবে না জানি কুঠার আঘাত নিশ্চিহ্ন করে ফেলে অরণ্যের এই অপ্রতিহত সাম্রাজ্য।
ফিরবার সময় হয়ে গেল। আমি সোনিয়াকে এবং তার গ্রামের সকলকে বিদায় জানিয়ে হরেন বিকাশের সাথে শহরের দিকে পা বাড়ালাম। সকলে তখন শহর থেকে ফিরছে খাগড়াছড়ি থেকে বেচাবিক্রি শেষে। মাথায় ঝুড়ির বাট লাগানো। সকলে আমাকে বললো, কী ভয় কমলো? আমি হাসলাম। কোলাকুলি করে তাদের বিদায় জানালাম। আমি রাতের বন দেখিনি, বন-জ্যোৎস্নাও দেখিনি। কিন্তু ওদের দেখেছি। ওদের বন বনের সূর্যের পড়া প্রথম আলোর মতই আলোকিত। নাতিশীতোষ্ণ। বনের মতোই সবুজ প্রাণবন্ত নির্মল বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। ভালো করে চোখ রাখলে দেখা যায়, ওদের আর আমাদের কোনো প্রভেদ নেই। সকলে সমান। ফেরার পথে সেই রাস্তা আর বন। গাঢ় সবুজ বনকে বিদায় দিতে দিতে ফিরলাম আর শুনছিলাম সোনিয়ার কথা, “দি তুমি যদি আমার ঘরে থাকতে আরো তবে আজ রাতে থাকো।” কথা দিয়ে এসেছি কোন একদিন নিশ্চয় গিয়ে থাকব। সারারাত জ্যোস্নালোকিত রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শুনে জেগে থাকব। আবার কখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রিও যাপন করব।
ছবি:লেখক
জেসমিন নাহার
ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। বাড়ি যশোহর জেলার শার্শায়। গোড়পাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম। চিশিতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। মা রওশানারা বেগম। গল্প লেখক। উপন্যাসও লিখছেন