।। মোহাম্মদ আজম ।।
আজ ১ জানুয়ারি, ২০২১। বড় বাংলার কবি জসীমউদ্দীনের আজ জন্মদিন। এই উপলক্ষে প্রতিপক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক কুদরত-ই-হুদার গ্রন্থ ‘জসীমউদ্দীন’-এর ওপর সংক্ষিপ্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখছেন সাহিত্যতাত্ত্বিক, প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। সকলকে ঈসায়ী নববর্ষের শুভেচ্ছা।
– সম্পাদকীয় দফতর, প্রতিপক্ষ।
কুদরত-ই-হুদার ‘জসীমউদ্দীন’ প্রসঙ্গে
জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতার মতো গদ্যেও খুবই আলাদা। তাঁর আত্মচরিতমূলক বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, নিজের কাব্য-স্বাতন্ত্র্যের প্রেক্ষাপট হিসাবে নিজের জীবন-স্বাতন্ত্র্যকে তুলে ধরার একটা সচেতন প্রচেষ্টা তাতে ছিল। হুদা কবি-পরিবেশিত তথ্য-উপাত্তে ভাগ বসিয়েছেন। লিখেছেন গল্পের মতো করে, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ আর ইশারা বাদ দেননি। বিচিত্র ধরনের রচনার পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি কাব্যবৈশিষ্ট্যের কিছু দিকও তিনি ছুঁয়ে গেছেন। বলা যায়, কাব্য-বিশ্লেষণের আলো আছে তাতে, কিন্তু ভার নাই। যে বিবরণী সবার জন্য সে বিবরণীর নির্মাণকৌশল হিসাবে এটা জুতসই হয়েছে।
প্রথমা প্রকাশনী থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় কুদরত-ই-হুদার দ্বিতীয় বই ‘জসীমউদ্দীন’। প্রথমার ‘কীর্তিমান বাঙালি’ প্রকল্পের অংশ হিসাবে প্রকাশিত বইটি পুরনো জসীমউদ্দীনকে নতুন করে পড়তে এবং সহজ করে বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জসীমউদ্দীন কীর্তিমান বাঙালি তো বটেই, কিন্তু তাঁর প্রধান কীর্তি কাব্য-রচনা। ফলে এই কীর্তিমানকে কেবল তথ্য আর কৃতির সমবায়ে বুঝলে কাজটা খানিকটা অসমাপ্ত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কবি-জীবনের তথ্য আর কবিতার তথ্য-বিশ্লেষণের বাইরে কবিকে বুঝতে আরেকটা জিনিস দরকার হয়। তাঁর কবিতা বিশেষভাবে কেন এরকম হয়ে উঠল, তার একটু বেশি তত্ত্বতালাশ করতে হয়। কুদরত-ই-হুদা এই সাহিত্যিক জীবনীতে সে কাজটিই করেছেন।
জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতার মতো গদ্যেও খুবই আলাদা। তাঁর আত্মচরিতমূলক বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, নিজের কাব্য-স্বাতন্ত্র্যের প্রেক্ষাপট হিসাবে নিজের জীবন-স্বাতন্ত্র্যকে তুলে ধরার একটা সচেতন প্রচেষ্টা তাতে ছিল। হুদা কবি-পরিবেশিত তথ্য-উপাত্তে ভাগ বসিয়েছেন। লিখেছেন গল্পের মতো করে, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ আর ইশারা বাদ দেননি। বিচিত্র ধরনের রচনার পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি কাব্যবৈশিষ্ট্যের কিছু দিকও তিনি ছুঁয়ে গেছেন। বলা যায়, কাব্য-বিশ্লেষণের আলো আছে তাতে, কিন্তু ভার নাই। যে বিবরণী সবার জন্য সে বিবরণীর নির্মাণকৌশল হিসাবে এটা জুতসই হয়েছে।
কবিকে তার জীবনতথ্য দিয়ে কতটা বোঝা যাবে, সে প্রশ্ন একটা গোড়ার প্রশ্ন বটে। অন্য অনেকের মধ্যে প্রশ্নটা রবীন্দ্রনাথও তুলেছেন। তাঁর বিখ্যাত ভাষ্যটি ছিল, কবিকে তাঁর জীবনীতে বুঝতে যাওয়া নিরর্থক। দরকার তাঁর কাব্যপাঠ। এ কথা যখন তিনি লিখেছিলেন তখনো দুনিয়াজুড়ে জীবনভিত্তিক সাহিত্যপাঠের রমরমা। এরপর একটা সময় গেছে যখন জীবনী সাহিত্যপাঠের ক্ষেত্রে একেবারে বাদ পড়েছিল। আবার ফিরে এল অন্য রূপে, অন্য দরকারে। কিন্তু জসীমউদ্দীনের ক্ষেত্রে জীবনতথ্যের বোধ হয় অন্যরকম একটা গুরুত্ব আছে। সে কথাটা খুলে বলা দরকার।
আমরা কাব্যপাঠ করি সাধারণত কবিতার ইতিহাসের মধ্যে। জাতীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাসের মধ্যেও কবিতা পাঠ করা যায়। কিন্তু ‘আধুনিক’ বাংলা কাব্যপাঠের ক্ষেত্রে এ নজির খুবই বিরল। প্রশ্ন হল, বাংলা কাব্যপাঠের ইতিহাসের মধ্যে বা বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত বয়ানের ভিত্তিতে জসীমউদ্দীনের কবিতা পাঠ করা যায় কি? এ প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হতে বাধ্য। কলকাতার কাব্য-ইতিহাস বা রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের সাথে জসীমউদ্দীনের কবিতার আংশিক বা দূরতম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করাও বেশ কঠিন। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই যে, যাঁরা তাঁর কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বা পূর্ণাঙ্গ বিবরণী দাখিল করেছেন, তাঁদের একজনও সে চেষ্টা করেননি। পরোক্ষ প্রমাণ অবশ্য আরো জোরালো। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের ‘মূলধারা’য় উৎপন্ন বর্গের ভিত্তিতে যাঁরা ওই কাব্য পড়তে চেয়েছেন, যেমন, এ কাব্য ‘আধুনিক’ কিনা, এ কাব্যের সাথে নগর বা গ্রামের সম্পর্ক কেমন ইত্যাদি, তাঁরাও খুব সুবিধা করতে পারেননি। একটি উদাহরণ দিলে কথাটা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে। কাজী নজরুল ইসলামও কবি হিসাবে কলকাতার মূলধারার কাব্যপ্রবাহ থেকে যথেষ্ট দূরবর্তী। কিন্তু যদি ‘জাতীয়তাবাদী’ ইতিহাসের নিরিখে পড়া যায়, যদি ‘অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলনে’র সাথে মিলিয়ে দেখা হয়, যদি কলকাতার সাম্প্রদায়িক সমস্যার নিরিখে পাঠ করা হয়, তাহলে নজরুলের কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ তার সাথে ভালোভাবেই খাপ খেয়ে যাবে। জসীমউদ্দীনের ক্ষেত্রে এরকমটা হওয়ার জো নাই। তাই তাঁর কাব্যপাঠের তরিকা হিসাবে কবির জীবনেতিহাস আর যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার মধ্যে সে জীবন রচিত হয়েছিল, তার পাঠ ছাড়া বিশেষ উপায় থাকে না।
কুদরত-ই-হুদা ‘জসীমউদ্দীন‘ নামের নতুন বইটিতে এ কাজই করেছেন। তিনি আনুষ্ঠানিক জীবনীর উপাদানগুলোকে আলগোছে ছুঁয়ে গেছেন বটে, বিস্তারে যাননি। গুরুত্ব দিয়েছেন সেসব উপাদানকে যেগুলোর সাথে তাঁর কাব্যের বিশিষ্টতার যোগ। কথা বলেছেন গল্পের ভঙ্গিতে, জমিয়ে আসর বসানোর আমেজে। তথ্যগুলো তিনি নিয়েছেন প্রধানত কবির নিজের লেখালেখি থেকে। পরিকল্পনাটা ভালো হয়েছে। জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতার মতো গদ্যেও খুবই আলাদা। তাঁর আত্মচরিতমূলক বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, নিজের কাব্য-স্বাতন্ত্র্যের প্রেক্ষাপট হিসাবে নিজের জীবন-স্বাতন্ত্র্যকে তুলে ধরার একটা সচেতন প্রচেষ্টা তাতে ছিল। হুদা কবি-পরিবেশিত তথ্য-উপাত্তে ভাগ বসিয়েছেন। লিখেছেন গল্পের মতো করে, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ আর ইশারা বাদ দেননি। বিচিত্র ধরনের রচনার পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি কাব্যবৈশিষ্ট্যের কিছু দিকও তিনি ছুঁয়ে গেছেন। বলা যায়, কাব্য-বিশ্লেষণের আলো আছে তাতে, কিন্তু ভার নাই। যে বিবরণী সবার জন্য সে বিবরণীর নির্মাণকৌশল হিসাবে এটা জুতসই হয়েছে।
জসীমউদ্দীন ফরিদপুরের মানুষ। লেখক জানাচ্ছেন, গ্রামে গেলে তিনি আশপাশের কবি ও কবিয়ালদের নিয়ে আসর জমাতে পছন্দ করতেন। এ আসরে অনেকের মধ্যে কবিরত্ন এম এ হকও থাকতেন। এই কবিরত্ন, যদ্দুর জেনেছি, বর্তমান গ্রন্থকারের বাবা। তথ্যটার গুরুত্ব এই যে, জসীমউদ্দীন যে পরিবেশ-প্রতিবেশে কবি হয়ে উঠেছিলেন, তার সাথে কুদরত-ই-হুদার অন্তরঙ্গ পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছে। এ বইয়ের অনায়াস সহজতা দেখে মনে হয়, সুযোগটা লেখক কাজে খাটিয়েছেন।
মোহাম্মদ আজম
জন্ম ২৩ আগস্ট ১৯৭৫, হাতিয়া, নোয়াখালী। এম এ বাংলা, ঢাবি, পিএইচ ডি, ঢাবি। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাবি। প্রকাশিত বই : প্রবন্ধ ও গবেষণা— বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ [আদর্শ, ২০১৪, ২০১৯] বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার [প্রথমা, ২০১৯, ২০১৯] কবি ও কবিতার সন্ধানে [কবিতাভবন, বাতিঘর, ২০২০] হুমায়ূন আহমেদ : পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য [প্রথমা, ২০২০] সম্পাদনা— নির্বাচিত কবিতা, সৈয়দ আলী আহসান [বাংলা একাডেমি, ২০১৬] ই-মেইল : mazambangla1975@gmail.com