।। ফাতেমা রিয়া ।।
ভাতঘুম দিলেন বিষণ্ণ মনেই। মেয়ে পাশের রুমে। স্বপ্নে দেখলেন, এক বিশাল অজগর সাপ তাদের তিনজনকে তাড়া করছে। স্বামী এবং মেয়েকে নিয়ে সাবিহা বেগম দৌড়াচ্ছেন। মেয়ে দৌড়াতে পারছে না, বারবার পড়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে দেখলেন তিনি একা দৌড়াচ্ছেন, সাপটাও আর পিছনে নেই, মেয়ে আর স্বামীও নেই। আশেপাশে যেন গড়ের মাঠ। সাবিহা একা দাঁড়িয়ে আছেন।
তিনি ডাকলেন, ‘‘ও মিশু, মিশু।’’
পাশের বিল্ডিং এর কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে ডেকেই চলেছে। এই সাত সকালে এই কুকুরটার কী হলো কে জানে! সাবিহা বেগমের মাথা ধরে যায়। রাতে ঘুম হয়নি ভাল। আজেবাজে স্বপ্ন দেখলেন। অবশ্য প্রতিদিনই দেখেনঁ। গলায় একটু জোর এনে ডাকলেন, ‘‘ওরে সুমাইয়া, সুমাইয়া’’।
সুমাইয়া তার কাজের মেয়ে, খাটের পাশে মেঝেতে সে ফ্লোরিং করে ঘুমায়। মরার মতো ঘুম দিয়েছে, সুমাইয়ার মধ্যে নড়াচড়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সাবিহা বেগম হতাশ হলেন, নিজের তরুণী জীবনের কথাও মনে আসলো। তারও অনেক ঘুমের অভ্যাস ছিল। মা সকালে এসে চেঁচামেচি করতেন, ‘‘ওরে নবাবের বেটি, শ্বশুড়বাড়ি গেলে বুঝবি!’’ সাবিহা বেগমের বাবা অবশ্য আদুরে ছিলেন, উনি বলতেন, ‘‘আহা ঘুমাইতে দাও তো। যতদিন বাপের বাড়ি আছে, ততদিন ই শান্তি।’’
মা গজগজ করতেন, তার ধারণা এই খাসলত রয়ে যাবে। পরে বেয়াই-বেয়ানদের কাছে কথা শুনতে হবে, মা কিছু শিখায়নি।
মায়ের আশঙ্কা অবশ্য আর বাস্তবে রূপ নিল না, বাথরুমে গোসলের সময় স্ট্রোক করে সাবিহা বেগমের বিয়ের আগেই তিনি মারা গেলেন।
মরার আগে সাবিহা ডাক শুনতে পেলেন, ‘‘ও সাবিহা, সাবিহা…’’
এইটুকুই শেষ কথা। হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার বলে দিলেন, ‘‘সরি! উনি আর নেই!’’
সাবিহা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সুমাইয়া নড়াচড়া করছে, তিনি আবার ডাকলেন, ‘‘নবাবের বেটি উঠ রে এবার।’’
সুমাইয়া চোখ খুললো মনে হয়, চোখ মুখ হাত দিয়ে ডলছে।
সাবিহা বেগম বললেন, ‘‘গরম পানি কর। গোসল দিবো।’’
সুমাইয়ার ঘুম যায় নাই, ক্লান্তিও না। তারে দেখে মনে হয়, সম্ভবত নিজের জীবনের ওপর বিরক্ত! ফ্লোরিং করা বিছানা না তুলেই সে ঘুম ঘুম শরীর নিয়ে টলতে টলতে রান্নাঘরের দিকে গেল মনে হয়।
সাবিহা বেগমের শরীর জ্বলতে থাকে, এর মধ্যে গরম পানি দিয়ে গোসল করা কি ঠিক হবে?
যা হয় হউক। তিনি করবেন। বিছানার সামনের দেয়ালে টানানো মেয়েটার ছবির দিকে চোখ যায়। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। এই ছবিটা কবে তোলা? বয়স মনে হয় তখন ১২-১৩ হবে।
শরীর বাড়ন্ত ছিল। মনে হত ১৫-১৬ বছরের মেয়ে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবার নজরেই পড়লো মেয়েটার এমন হুট করে বড় হয়ে যাওয়া। ওড়না সামলে রাখতে পারত না। সাবিহা বেগম মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় নামলে মেয়ের দিকে তাকাতেন সর্বদা।
‘‘ওই গলা ঢাক, বকের মত গলা আবার দেখানোর কী!’’
‘‘ওড়না সরলো কেন ছেনাল? ঠিকমত দে।’’
‘‘চুলটা ভাল করে বাধতে পারলি না, এত ফ্যাশনের কী দরকার?’’
ছোট মেয়েকে বোরকা চাপিয়ে দেবার ইচ্ছা হয়নি, জানেন তার মেয়েটার গরম বেশি লাগে তার মতো। ভেবেছিলেন কয়েক বছর পর দেবেন।
সাবিহার বুকের মধ্যেটা হুহু করে।
সুমাইয়া এসে বললো, ‘‘পানি দিছি বাথরুমে।’’
সাবিহা বেগমের ঘোর ভাঙলো। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, ‘‘বিছানা তুল। আর ঘর গোছাইয়া রাখ। আমি গোসলে যাই।’’
আলমারি থেকে ম্যাক্সি বের করে নিয়ে বাথরুমে গেলেন। ইদানিং ম্যাক্সি ছাড়া কিছু পড়তে ইচ্ছা হয় না। নিচে সায়াও পড়েন না, গায়ে ওড়নাও থাকে না।
ঘরে সে আর সুমাইয়া। পুরুষ মানুষ আসে না বললেই চলে।
এই নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ও যে এত ভারী কে জানে!
পানি অতিরিক্ত গরম, আগুন জ্বাল দিয়ে এনে রেখেছে যেন। উনি বাথরুমে বসেই চেঁচালেন, ‘‘বেয়াক্কেল বেটি আমারে মারার লাইগা পানি আইনা রাখছস?’’
সুমাইয়া বাইরে থেকে কী যেন বললো, উনি শুনলেন না। ঠান্ডা পানির সাথে গরম পানি মেশালেন। বাথরুমের কলটা ঠিকঠাক কাজ করছে না, ঠিক করতে হবে।
গায়ে কুসুম গরম জল ঢাললেন। শরীরের জ্বলুনি শান্ত হলো বলে তার মনে হয়।
গরম পানি তার মেয়ে একদম সহ্য করতে পারত না। শীতের দিনে গোসল করতে চাইত না, উনি বলতেন, গরম পানি করে দেই। মেয়ে তাতেও রাজি না।
রাগ করে সাবিহা বেগম বলতেন, ‘‘তুই ত ছাগল। ছাগলে যেমন পানির নিচে যাইতে চায় না, তুইও চাস না।শীত লাগে, কইলাম গরম পানি কইরা দেই, তাও চাস না!’’
মেয়ে কী বলতো এখন আর মনে পড়ছে না, তবে মনে হয় কিছু বলতো। হয়তো অভিযোগের সুরে, হয়ত দুঃখ অথবা অভিমান, না হয় নেহাতই রাগ। অথবা কিছুই না, মায়ের বকুনি মেয়েদের গায়ে খুব লাগে না। সাবিহা বেগম নিশ্চিন্ত হলেন মনে হয়। আবার জল ঢাললেন শরীরে।
গায়ে সাবান দিতে হবে, ছাতা পড়েছে। সোপকেসে সাবান খুঁজলেন, নেই। নিশ্চিত সুমাইয়ার কাজ, তিনি আবার চেঁচালেন, ‘‘ওই সাবান কই?’’
– কাউয়ায় লইয়া গেছে। সুমাইয়া নিশ্চিন্ত ভাবে জবাব দিলো।
– কাউয়ায় নিলো কেম্নে?
– পরশু বারিন্দা থেইক্যা লইয়া গেছে।
সাবিহা বেগমের মনে পড়লো পরশু বারান্দায় বসে সাবান দিয়ে পা ডলছিলেন তিনি। রোদে বসে শরীরের যত্ন করতে ভাল লাগে।
বারান্দার কার্নিশে রেখেছিলেন, কাক সেখান থেকেই নিয়ে গেল। সাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিছু মনে থাকে না আজকাল। সুমাইয়াও জানে তা। সেও সব প্রশ্নের উত্তর অক্লান্ত ভাবে দেয়!
মেয়েটার প্রতি একটু মায়া ও অনুভব করলেন সাবিহা! সারাদিন খাটে। ভালো দেখে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যুবতী মেয়ে একা রাখা ঠিক না।
সাবিহা গোসল শেষ করলেন। ম্যাক্সি পরে বারান্দার রোদে গিয়ে দাঁড়ালেন। আজ সূর্যটা বেশি তাপ দিচ্ছে মনে হয়। সুমাইয়াকে বললেন মোড়া আনতে। সে রান্না বসিয়েছে।
সাবিহা বসলেন, শরীরের জ্বলুনিটা আর নেই, ভালোই লাগছে, পাশের বাসার কুকুরটাও শান্ত হয়েছে। মায়ের কথা মনে পড়লো। মা দেখতে সুন্দরী ছিলেন। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রঙ। লোকমুখে শুনেছেন বাবা নাকি তুলে এনেছিলেন মাকে! অবশ্য মাকে কখনো সেসব বলতে শোনা যায়নি।
মায়ের চোখ পটলচেরা ছিল, কোমর পর্যন্ত চুল ছিল। দেবী প্রতিমার মতো চেহারা, ছোটখাটো শরীর আর অনেক তেজ।
সাবিহা বেগম অবশ্য মায়ের সেই রূপ পান নাই। তিনি শীর্ণকায়, কালো। আত্মীয় স্বজন এসে বলতো, কী মায়ের কী মেয়ে। পাড়া প্রতিবেশীরাও ছাড়ন দিতো না।
সাবিহা মৃদু হাসেন। তার মেয়েটা হয়েছিল নানীর মতো। যেমন গায়ের রঙ, তেমন চুল। কোঁকড়া আর ঘনকালো, লম্বা। রোদে বসে তেল দিতে দিতে সাবিহা হয়রান হয়ে যাইতেন। বিরক্ত স্বরে বলতেন, ‘‘এইগুলা কেটে ফেল। এত বড় হইছোস অথচ নিজের চুল নিজে যত্ন নিতে পারবি না, আমার করা লাগে সব!’’
মেয়ে হাসতো। সাবিহা চুলের মুঠি ধরে মৃদু টান দিতেন। মেয়ে বলতো, ‘‘উফ! ব্যথা লাগে!’’
তার মা কৌতুকের স্বরে বলতেন, ‘‘ শাশুড়ি চুলের এমন অবস্থা দেখলে কাইটা দিবো। সব জায়গায় মা পাইবি না।’’
মেয়ের মধ্যে অবশ্য শাশুড়ি নিয়ে তেমন চিন্তা দেখা যেত না। তরুণ বয়সে সেই চিন্তা সাবিহারও ছিল না অবশ্য ।
‘‘খালা, চা নেন।’’ ‘
সুমাইয়ার কথায় বাস্তবে ফিরে এলেন সাবিহা। চা নিলেন।
– আজকে কী রানবি?
– মুরগীর সালুন আর ভেন্ডি।
– ভেন্ডিতে মেথি দিস।
– মেথি নাই।
– তাইলে একটু পোড়া পোড়া করিস। মুরগীর সালুনেও ঝোল রাখিস না। আর ডাইল রান।
– আইচ্ছা।
সুমাইয়া চলে গেল। প্রথম রান্না করার সময়টা মনে পড়লো সাবিহার। তখন তার ১৩-১৪ বছর বয়স হবে মনে হয়। মা অসুস্থ, বাতের ব্যথা উঠেছে, বুক ধড়ফড় করছে।
তাকে বললেন, ‘‘রানতে পারবি? আমি চুলার ধারে যাইতারমু না। যা ভাত চড়াইয়া দে। চাইর পট পানি দিবি দুই পট চাউলে। জ্বাল কম রাখবি’’।
তখন লাকড়ির চুলা ছিল। পাকঘর ছিল বাসার পিছনে। সাবিহা লাকড়ির স্তূপ থেকে লাকড়ি নিতে গেলেন। একটা কালো সাপ হিস হিস করে ফনা তুললো। সাবিহা ছিটকে পড়লেন ভয়ে। চিৎকার দিলেন। সাপটা দ্রুত বাইরে চলে গেল। মা শোবার ঘর থেকে বললেন, ‘‘ কী হইছে?’’ সাবিহা কোনমতে বললেন, ‘সাপ!’
মায়ের অসুস্থতা পালিয়ে গেল যেন, তড়িঘড়ি করে পাকঘরে আসলেন।
‘‘কই সাপ কই!’’ তিনি উদ্ভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকালেন।
সাপটাকে আর কখনো দেখা যায়নি। সাবিহার এখনো মনে সন্দেহ জাগে আসলেই ওখানে কোনো সাপ ছিল?
স্বপ্নে তিনি মাঝে মাঝেই সাপ দেখেন। এক শুক্রবারে দুপুরে ঘুমালেন। তখন মেয়েটার বাবা বেঁচে আছেন। জুমা থেকে তিনি তখনও ফেরেননি। সাবিহা অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে মেয়েকে নিয়ে খেয়ে নিলেন। মোবাইলে ফোন দিলেন, মেয়ের বাপ ধরলেন না ফোনটা! সাবিহা ভাতঘুম দিলেন বিষণ্ণ মনেই। মেয়ে পাশের রুমে। স্বপ্নে দেখলেন, এক বিশাল অজগর সাপ তাদের তিনজনকে তাড়া করছে। স্বামী এবং মেয়েকে নিয়ে সাবিহা বেগম দৌড়াচ্ছেন। মেয়ে দৌড়াতে পারছে না, বারবার পড়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে দেখলেন তিনি একা দৌড়াচ্ছেন, সাপটাও আর পিছনে নেই, মেয়ে আর স্বামীও নেই। আশেপাশে যেন গড়ের মাঠ। সাবিহা একা দাঁড়িয়ে আছেন।
তিনি ডাকলেন, ”ও মিশু, মিশু।”
মিশু তার মেয়ের নাম। স্বামীর কথা তার মনে আসলো না ঘুমের মধ্যে। তিনি শুধু ডাকেন, ”মিশু, ও মিশু।”
ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখেন, মিশু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘‘মা তুমি ঘুমের মধ্যে কানতেছিলা কেন?’’
সাবিহা বেগম উদ্ভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন। যেন তিনি মিশুকে চিনতে পারছেন না। তারপর স্বাভাবিক স্বরে বললেন, ‘‘তোর বাপ আইছে?’’
মিশু বললো, ‘না।’
মিশু চলে গেল। তার প্রাইভেট টিউশনি ছিল বেলা ৫ টায়। এলাকার মধ্যেই পড়তে যায়। যাবার সময় মেয়েকে বললেন, ‘‘মাথায় কাপড় দিয়া যা। এত বড় মাইয়ার লাজ শরম যদি থাকে!’’
মেয়ে বিরক্ত হয়ে মাথায় কাপড় দিল। তারপর দ্রুতই চলে গেল। তিনি বুঝতে পারেন মেয়ের মন উত্থাল পাথাল হয়েছে। কতই-বা বয়স, ১৪ তে পড়লো মনে হয়! এই বয়সে মনে রঙ লাগে, ব্যাটাছেলেদের দেখতেও ভালো লাগে।
মেয়েটার ওপরেও অনেকের নজর পড়েছে। পাশের বাসার গুণ্ডা ছেলেটাকে প্রায়ই দেখেন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতেছে। সাবিহার ভয় লাগে। মেয়েকে তো পড়াশোনা ও করাতে হবে, বাইরে একা পাঠানো ঠিক না, এত সুন্দরী মেয়ে, কখন কী হয়ে যায়! ভেবে রাখলেন মেয়ের সাথে যাওয়া শুরু করবেন কিছুদিন পর। এখন বাসায় ব্যস্ততা আছে কিছু।
যেতে হলো না, তার আগেই একদিন অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো। তখন সাবিহা পেঁয়াজ কাটছেন রান্নাঘরে বসে। চোখ থেকে পানি ঝরছে, অনেক ঝাঁঝ। মাছে হলুদ মাখিয়ে রেখেছেন, একটু পর চুলায় দেবেন। ভাত উথলিয়ে পড়ছে। সেদিন বুয়া আসেনি, অনেক ব্যস্ততা।
তার মধ্যে ফোন টা বেজেই যাচ্ছিল। কোন মতে হাত ধুয়ে গিয়ে বেডরুমে রাখা ফোনটা ধরলেন
‘‘চাচী আপনার মেয়ে হাসপাতালে।’’
সাবিহার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল, হাসপাতালে থাকবে কেন? সকালেই না স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন, এখন তো আসার সময়। তার এটাও মনে হলো, মিশু সকালে না খেয়েই গেছে, সে আসতে আসতে রান্না শেষ করবেন! সে হাসপাতালে কি করে? সাবিহা বুঝতে পারলেন না, আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কী বললেন?’’
‘‘মিশু হাসপাতালে। এই যে মডেল ক্লিনিকে, আপনি আসেন।’’
‘‘কী হইছে? কী হইছে?’’
ফোন কেটে গেল। সাবিহার চুলায় রাখা ভাতের কথা আর মনে রইলো না, আধাকাটা পেঁয়াজরাও পড়ে রইলো অবহেলায়। মাছ অমনই রইলো।
সাবিহা ছুটলেন হাসপাতালে।
এরপর আর কিছু উনি মনে করতে পারেন না। রাতের বেলা ডাক্তারকে বলতে শুনলেন, ‘‘আপনার মেয়ে মারা গেছে!’’
ডাক্তার নির্বিকার মুখে এই সংবাদ দিয়ে অন্য রোগী দেখতে ছুটলেন। নার্সরা তড়িঘড়ি করে স্ট্রেচার নিয়ে এলেন মেয়েকে মর্গে পাঠানোর জন্য।
সাবিহা তখন পাগলের মতো চিৎকার করছেন-
‘‘ওরে কই নিয়া যান?’’
বিরক্ত মুখে নার্সের জবাব, ‘‘পোস্ট মর্টেম করা লাগবে। কাল লাশ পাবেন।’’
‘‘কেন আমি কেন নিয়া যাইতে পারব না?’’
মিশুর বাবা পাশেই ছিলেন, উনি নীরব হয়ে দেখছিলেন সব।
সাবিহা বেগম তার দিকে ফিরে বললেন, ‘‘কই নিয়া যায়? তুমি আটকাও না কেন?’’ বুড়া মতো একজন নার্স বললেন, ‘‘পুলিশ কেস হইছে, পুলিশ অনুমতি না দিলে লাশ নিতে পারবেন না, ঝামেলা কইরেন না, আরো কাজ আছে। আপনার স্ত্রীকে এখান থেকে নিয়া যান।’’
মিশুর বাবা সাবিহা বেগমকে জোর করে বাইরে নিয়া আসলেন, সাবিহা বেগম তখন শুধু চিৎকার করছেন। আকাশ বাতাস ফাটানো চিৎকার। মিশুর কয়েকটা বান্ধবী দূরে দাঁড়িয়ে কাদছিল। মিশুর মামাকে দেখলেন হাসপাতালের মধ্যে…
অবশ্য হাসপাতালের মানুষজনের কাছে এগুলো নিত্তনৈমিত্তিক দৃশ্য, আশেপাশের মানুষজন তার দিকে বিরক্তিভরা চোখে তাকিয়ে রইলো, কারো চোখে হয়ত করুণাও ছিল!
সাবিহা বেগমের বুক ব্যথা করতে শুরু করে। তিনি মৃদু স্বরে ডাকেন, ‘‘মিশু, ও মিশু…’’
মনে হয় তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন, সূর্যের তাপ আরো বেশি মনে হয়।
কেউ এসে তাকে ধরে, তখন বিলাপ-প্রলাপের মধ্যে থেকে বের হয়ে আসে অসহয়ায় জিজ্ঞাসা একখান, ‘‘কে এটা? মিশু না?’
দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। স্বাভাবিক হতে সাবিহা বেগম দেখেন সুমাইয়া দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে লেবুর শরবত। সুমাইয়া মৃদু স্বরে বলে, ‘‘খালাম্মা আপনি বারান্দায় পড়ে গেছিলেন।’’ সাবিহা বেগম কিছু বলেন না। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন সুমাইয়ার দিকে। সুমাইয়া শরবতটা পাশের টি টেবিলে রেখে চলে যায়।
মিশু সেদিন স্কুলে যেতে পারেনি। যাওয়ার পথেই তাকে ধরে নিয়ে যায় কিছু মানুষ। শোনা যায় মাইক্রোতে করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই খবর দুপুর পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। আচ্ছা মেয়েটা তখন কেমন করছিল?
গুণ্ডাগুলো আদালতে বলেছে মেয়েটা বেশি ঘাউড়ামি করছিল তাই অনেক মেরেছে! পরে আধমরা দেখে ভয় পেয়ে মিশুকে ফেলে দিয়ে গেছে নদীর পাড়ে! এই শহরের পাশের নদী। মিশু ওই নদীর পাড়ে খুব খেলতে যেত ছোটবেলায়। বড় হয়ে আর যেতে দেন নাই তার মা। মাস্তানের ভয়েই।
কী লাভ হলো? স্মৃতির বিলাপের ভিতর সাবিহা বেগম হাসেন!
যতদিন বেঁচেছিল মেয়েটার কোনো সাধ পূরণ হলো না। জামদানি শাড়ি চেয়েছিল একটা, বান্ধবীর জন্মদিনে যেতে চেয়েছিল রাতের বেলা, সবাই মিলে রাতে থাকবে, মজা করবে। অনুমতি দেওয়া হয় নাই!
মেয়েটার বড় পছন্দ ছিল সরিষা ইলিশ। সাবিহারও পছন্দ। এখন তিনি সরিষা ইলিশ খান না, দেখলেও তার অসুস্থ লাগা শুরু হয়।
দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে আবার তাকান সাবিহা বেগম।
মিশু হাসছে। সে হাসি অমলিন…
অলঙ্করণ: বৈশালী ও মিশুক শান্তনু
প্রচ্ছদের ছবি: মিশুক শান্তনু
লেখক পরিচিতি:
ফাতেমা রিয়া
তরুণ গল্পকার, উপন্যাসও লিখেছেন। জন্ম ১৯৯৫ সালে। দেশের বাড়ি বরিশাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়েছেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন ও রাজনীতে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।