ভাবান্দোলন চর্চার অভিমুখ কোনদিকে ফেরালে ও নির্দিষ্ট করলে ফকির লালন শাহ ও নদিয়ার ভাবচর্চাকে বর্তমান করা যায় সেই বিষয়ে দুই একটি প্রস্তাব দেবার জন্যই এই লেখা। এই লেখাটি দুটো কিস্তিতে এখানে পেশ করা হচ্ছে। এই অংশটি পড়বার আগে আগের কিস্তিটি পড়ে আসলে ভাল হয়।
আমরা তিনটি বিষয়ের দিকে নজর ফেরাবার চেষ্টা করব।
এক. মানুষের মধ্যে যে কথা বলে অথচ দেখা দেয় না তাকে বিচার করবার ভাবগত প্রশ্ন;
দুই, নদিয়ার জাতপাত, শ্রেণি ও নারীপুরুষ বেদ বিরোধী আন্দোলন এবং
তিন. পাশ্চাত্য চিন্তার প্রভাবে এবং পাশ্চাত্য চিন্তার পরিমণ্ডলে থেকে আমরা যেভাবে এতোকাল সমাজ পরিবর্তন, ব্যাক্তিগত সম্পত্তি, উৎপাদন সম্পর্ক ইত্যাদি বুঝেছি তাকে পর্যালোচনার কোন নতুন দিক নির্দেশনা নদিয়া দিতে পারে কিনা সেই প্রসঙ্গ
এক: কে কথা কয়রে দেখা দেয় না…
প্রথমেই যে দিকটা স্পষ্ট করা দরকার সেটা হোল আমাদের কিছু অভ্যাস বদলানো জরুরী। ফকির লালন শাহকে মরমি বা আধ্যাত্মিক পুরুষ হিশাবে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত; এই অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। আমরা জগতকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করতে অভ্যস্ত। এই সকল অভ্যাসের জায়গা বিশাল সমস্যা। এই অভ্যাসের অধীন থেকে লালনকে বোঝা কঠিন।
লালন মানুষের ভজনা করেছেন। যে মানুষ দেহসম্পন্ন ও বর্তমান। সেখানে দেহ ও আত্মার বিভাজন নাই, ইহলোক/পরলোক ভেদ নাই। আমরা যেহেতু আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করে ভাবতে অভ্যস্ত, ফলে দেহসাধনার কথা শুনলে আমরা তাকে দৈহিকতা ছাড়া আর কিছু বুঝি না। এই দৈহিকতার মানেও আমাদের কাছে হয়ে ওঠে স্রেফ যৌনতা, গুহ্য ও রহস্যময় যৌনতার চর্চা। এর ফলে বাস্তবে বর্তমান দেহের বাইরে যে আসলে ‘মানুষ’ নামক বিমূর্ত কিছু নাই, এই অতি প্রাথমিক ‘বস্তুবাদী’ শিক্ষা আমাদের নজরের আড়ালে চলে যায়। তখন লালনকে বুঝতে গিয়ে আমরা নানান গুহ্য সাধন প্রণালী, চারিচন্দ্র ভেদ ও নানান আচার-অনুষ্ঠানকে মুখ্য জ্ঞান করা শুরু করি। যেহেতু গোপন ও রহস্যময় জগতের দিকে মানুষের একটা স্বাভাবিক কৌতুহল থাকে, তখন গোপন যৌনচর্চার আলোকে লালনকে এক রহস্যময় পুরুষ হিশাবে গড়ে তোলা হয়। এর পরিণতি কি হতে পারে সেটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস ও সেই উপন্যাস নিয়ে গৌতম ঘোষের বানানো ছবির উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে ‘লালন চন্দ্র কর’ নামে এক চরিত্র বানানো হয়েছে যে রীতিমত রতিগ্রস্ত। তার গুরু তাকে মেয়ে সাপ্লাই দেয়। যৌনতার চর্চা ছাড়া তার অন্য কোন সাধনা নাই। নারী যার কাছে নিছকই সাধনার উপায় বা তথাকথিত ‘সাধনসঙ্গিনী’। সেখানে লালন এমনই এক ব্যক্তি যে কোন চিন্তা করতে জানে না; গান বা বাক্য তার মধ্যে আপনা আপনি আসে, আপনা আপনি পয়দা হয়। এইসব আজগবি বিতিকিচ্ছি কাহিনী। ইত্যাদি।
ওপরে লালনের ‘বস্তুবাদী’ শিক্ষার কথা বলতে ‘বস্তুবাদী’ কথাটা উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছি এ কারণে যে বস্তু ও ভাবের বিভাজন মেনে ‘বস্তুবাদ” ও ‘ভাববাদ’ হিশাবে যেভাবে আমরা চিন্তাকে পরস্পর বিরোধী স্রোতে বিভক্ত করি, লালনকে বুঝতে হলে এই বিভাজনের ফাঁদে পা দিলে চলে না। ‘বস্’ ধাতু থেকে ‘বস্তু’ – যে ধাতু থেকে ‘বসত, বসা ইত্যাদি শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করা যায়। পরম যেখানে বসত করে সেই অর্থে বস্তু। নদিয়ার ভাবচর্চায় ‘বস্তু’ কথাটার অর্থ আমরা যেভাবে বস্তু বুঝি সে রকম নয়।
বস্তু/ভাব, দেহ/আত্মা, ইহকাল/পরকাল এই প্রকার দুইয়ে দুইয়ে জগতকে বিভক্ত করে ভাববার অভ্যাস ত্যাগ করার দিক থেকে আমরা লালনকে ‘বর্তমান’ করে তোলার অভিমুখ নির্দিষ্ট করবার প্রথম সূত্রটা পেতে পারি। লালনের ‘দেহ’ প্রচলিত অর্থে তান্ত্রিক বা যোগাচারী দেহবাদ নয়। দেহের অতিরিক্ত বা দেহের বাইরে কোন এক মিস্টেরিয়াস পরম বা পুরুষের সন্ধানী নন লালন। দেহ তাঁর কাছে সে কারণে মিস্টেরিয়াস অতিরিক্তকে পাবার কোন উপায় বা হাতিয়ার নয়। অন্যদিকে নদিয়ার ভাবুক হিসাবে তাঁর কাছে দেহের প্রশ্ন তান্ত্রিক পরিমণ্ডলের প্রশ্ন নয়। যেমন, কিভাবে দেহকে ব্যবহার করে কুল্কুণ্ডলিনী শক্তির বিকাশ ঘটানো যায়, কিম্বা কিভাবে দেহকে উপায় হিসাবে চর্চা করে তুরীয়ানন্দ ভোগ করা যায়, ইত্যাদি। তাঁর প্রশ্ন হচ্ছে: দেহ হয়েই যিনি ‘বর্তমান’ রয়েছেন, তাঁকে আমি বুদ্ধি দিয়ে, ভাষা দিয়ে পাচ্ছি না কেন? তার সঙ্গে তো আমি একসঙ্গেই আছি, দুয়ে ‘এক’ হয়ে আমরা বর্তমান, কিন্তু দুয়ের মাঝখানে এই লক্ষ যোজন ফাঁক থেকে যাচ্ছে কেন? দেহের সঙ্গে এই ভাষাসম্পন্ন ‘আমি’র কি সম্পর্ক? – যে ‘আমি’ কথা বলি এবং কথা বা বাক্যের মধ্য দিয়ে অপরদের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা করি সে কে?
কে কথা কয়রে দেখা দেয় না
নড়ে চড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম ভর মেলে না।।
এই ভাষাসম্পন্ন ‘আমি’র সঙ্গে অন্যান্য শরীরের বা অন্যান্য ভাষাসম্পন্ন মানুষের সম্পর্ক কি? কিভাবে সে সম্পর্কের বিচার সম্ভব? নদিয়ার ভাবচর্চার এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই কথাসম্পন্ন আমি সম্পর্ক রচনা করে দেহের সঙ্গে দেহের – সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি গড়ে ওঠে কথার মধ্য দিয়ে। কথার মধ্য দিয়ে আমরা দ্বন্দ্ব, হিংসা, হানাহানি বন্ধ করেতে পারি। আবার দ্বন্দে ও হানাহানিতেও জড়িয়েও পড়তে পারি। অন্যদিকে কথা মানুষের জীবন বদলে দেয়। মানুষের মধ্যে ‘গোষ্ঠভাব’ জাগিয়ে তুলতে পারে। কিভাবে আমরা সেই রসিক পূর্ণচন্দ্র সচ্চিদানন্দ পুরুষ হবো যিনি শক্তির সৃজন ঘটান গোষ্ঠভাব বিকাশের মধ্য দিয়ে। গোষ্ঠভাবের দ্বারা তিনি সকলের চিত্তকে আকর্ষণ করেন। গোষ্ঠেভাবই নতুন সামাজিক শক্তির সম্ভাবনা তৈরি করে; আর যিনি সেই ভাব সৃষ্টি করে আমাদের চিত্ত আকর্ষণ করেন তাঁকেই এতোকাল আমরা ‘বিষ্ণু’ নামে জেনেছি। অর্থাৎ যিনি জীবের পালন করেন। গোষ্ঠভাব হচ্ছে সমাজকে এক ও সমগ্র সত্তায় উপলব্ধি করা যাতে প্রতিটি জীবের প্রতিপালন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
লালন অনাদির আদি নদিয়ার যে ‘কৃষ্ণ’কে ডেকেছেন তিনি পুরানের কৃষ্ণ নন, কারণ এই কৃষ্ণের কোন জন্মমৃত্যু নাই। তার কোন পিতা নাই, ইনি নন্দের পুত্র কৃষ্ণ নন। নদিয়ার কৃষ্ণকে নদিয়ার ভাবের জায়গা থেকেই বুঝতে হবে। আমাদের চলতি ধারণা দিয়ে বুঝলে চলবে না।
সত্যাসত্য সকল বেদ-আগমে কয়
সচ্চিদানন্দ রূপে পূর্ণব্রহ্ম হয়
জন্মমৃত্যু যার নাই ভবের পর
সেতো নয় স্বয়ং কভু নন্দ লালা।।
বিভিন্ন শাস্ত্র আর দর্শন সত্য আর অসত্যের তর্ক করেই ব্যস্ত। এক পক্ষ দাবি করে সত্য আমার কাছে, আরেকপক্ষের দাবি সত্য আমার। অথচ মানুষের কর্তব্য হচ্ছে মিজেকে সচ্চিদানন্দ করে তোলা যেন সাধক সৎ বা পরিচ্ছন্ন, চিত্তসম্পন্ন এবং সততই আনন্দময় হয়ে উঠতে পারেন যিনি পূর্ণচন্দ কৃষ্ণের মতো রসিক হয়ে উঠতে পারেন। লালনের সাধনা অন্ধকারে পূর্ণ চাঁদ হয়ে ওঠা। এই সেই কৃষ্ণ যার জন্মমৃত্যু নাই, তিনিই নদিয়ায় গৌর হয়ে মানুষের রূপ পরিগ্রহণ করেছিলেন। বারবারই তিনি মানুষের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করবেন। এই যে কৃষ্ণ যার কোন জন্মৃত্যু নাই তিনি কিভাবে নন্দের পুত্র কৃষ্ণ হতে পারেন? যাঁর জন্মমৃত্যু নাই, বাবা মা নাই তাঁকেই আমরা বিষ্ণু বলি – তিনিই পালন কর্তা। আবার তিনিই গোষ্ঠভাবে আমাদের চিত্ত আকর্ষণ করেন
পূর্ণচন্দ্রকৃষ্ণ রসিক সেজন
‘শক্তিতে উদয় শক্তিতে সৃজন
গোষ্ঠভাবে সব চিত্ত আকর্ষণ
বৃহদাগমে তারে বিষ্ণু বলা’
তাহলে দেখা যাচ্ছে কথা সম্পন্ন ‘আমি’র সঙ্গে দেহের সম্পর্ক বিচার নদিয়ার ভাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এখানে কোন মিস্টিসিজম নাই। বরং সকল রহস্যকে ইহ্লৌকিক বাস্তবতার মধ্যে অনুবাদ করে বোঝার চেশটা আছে। ভাবকে ‘বর্তমান’ করে তোলার সাধনা রয়েছে। আবার আমার এই দেহ শুধু আমার নিজের দেহ মাত্র নয়। এই দেহ সারা ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত, ব্রহ্মাণ্ডেরই অংশমাত্র। সারা ব্রহ্মাণ্ড এই দেহেরই পরিবর্ধিত রূপ; ব্রহ্মাণ্ড বলি, বিশ্ব বলি, জগত বলি বা প্রকৃতি বলি – সবই তো আসলে দেহেরই সম্প্রসারণ। আমরা মনুষ্যকুল জগত থেকে আলাদা কোন সত্তা না, জগতেরই অংশ। তাহলে এই ‘এক’ই তো জগতব্যাপী বা ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী ‘বর্তমান’।
লালন প্রশ্ন করছেন, কিন্তু যে নিজেই এক ও অদ্বিতীয় – যে নিজেই সমগ্র তার আবার নিজেকে নিজে নাম দিয়ে নিজেকেই আবার ডাকার সাধ কেন? কে কাকে ‘আল্লাহ ডাকে? এ কেমন লীলা তার? প্রশ্ন করছেন, ‘আল্লাহ, কে বোঝে তোমার অপার লীলে? তুমি আপনি আল্লাহ, ডাকো আল্লাহ বলে?’।
লালন বর্তমানবাদী। তিনি নদিয়ার মানুষ। নদিয়ার ভাবে ভাবুক। তন্ত্র ও শাক্ত ধারার বিপরীতে শ্রীচৈতন্যের জাতপাত বিরোধী সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি যে ভাবান্দোলনের উৎপত্তি লালনের বিকাশও ওর মধ্যেই। কিন্তু বৃন্দাবনের গোস্বামীরা শ্রীচৈতন্যের আন্দোলন ও শিক্ষার যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন, লালন সেই পথে যান নি। তিনি বর্তমানের ভজনা করেছেন, অনুমান নয়। আধুনিক দর্শনের ভাষায় তাঁর জীবনচর্চায় কোন প্রকার পরাবিদ্যার (metaphysics) স্থান নাই। কারন নদিয়া ‘অনুমান’-এ নয়, ‘বর্তমান’-এ বিশ্বাসী। বর্তমান কথাটার সহজ মানে হচ্ছে যা আমরা সাক্ষাৎ দেখি, আমাদের সকল বৃত্তির সমগ্রতা দিয়ে উপলব্ধি করি, আস্বাদন করি তাই বর্তমান। যা আস্বাদন করলাম তার বাইরে অতিরিক্ত কিছু নাই। যা আছে তার বাইরে বর্তমানতার অতিরিক্ত কোন অর্থ বা সত্তা নাই।
বোঝা যাচ্ছে দার্শনিক ভাবে ‘অনুমান’, ‘বর্তমান’ ইত্যাদি পরিভাষার বিস্তারিত ব্যাখ্যার দরকার। আমরা এখানে সেই ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তাটুকু ধরিয়ে দিতে চাইছি যাতে অভিমুখ নির্ণয় কথাটা কর্তব্য হিসাবে বুঝি। এই ক্ষেত্রে অভিমুখ হচ্ছে নদিয়ার ভাবচর্চার বিভিন্ন শব্দ ও পরিভাষাগুলো নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা। লালনকে বর্তমান করে তোলার এটাই হচ্ছে প্রথম করণীয় কাজ। সেখানে ভুল হবে, ভিন্ন মত হবে, তর্ক হবে, কিন্তু কোন অসুবিধা নাই। এই চর্চাই বাংলা ভাষায় শক্তিশালী ভাবচর্চার ধারা তৈরি করবে।
দুই. সকলি এক জলে সূচি…
দ্বিতীয়ত বাংলার ভাবান্দোলনের জাতপাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদ বিরোধী যে রাজনৈতিক ধারা সুলতানী আমলে ইসলামের প্রভাবের কারনে শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ফকির লালন শাহের আবির্ভাব ও বিকাশ নদিয়ার সেই ভাবের মধ্যেই। এই রাজনীতিই লালনের আবির্ভাবকে সম্ভব করে তুলেছে। জাতপাতবিরোধী নদিয়ার এই ভাবের বিকাশের ক্ষেত্রে ফকির লালন শাহের গুরুত্ব অপরিসীম। এর রাজনৈতিক দিকটা বোঝার জন্য শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসটা আমাদের জানা দরকার এবং সেই প্রয়োজনে সুলতানি আমল ও ইসলামের ভূমিকা বোঝা জরুরী। এই ক্ষেত্রে কাজ হয়েছে খুবই কম, যদিও সম্প্রতি কিছু কিছু অগ্রগতি হয়েছে।
যে ভাবগত জায়গায় দাঁড়িয়ে ফকির লালন শাহ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও ভেদবুদ্ধির রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন তাকে বিশেষ ভাবে বোঝা দরকার। সেই ক্ষেত্রে তাঁর ভাবুকতা ও রাজনীতিকে আমরা আলাদা করতে পারি না। মানুষের ভজনা করেছেন তিনি, কিন্তু মানুষে মানুষে সমান এই বুর্জোয়া সাম্যবাদ ফকির লালন শাহ প্রচার করেন নি। তার মধ্যে এই ধরণের কোন ‘মানবতাবাদ’ নাই। কিম্বা তিনি কোন ‘মানবধর্ম’ প্রচার করেন নি। এইসব একালের বুর্জোয়া কিম্বা সেকুলারবাদীদের মনগড়া আবিষ্কার।
তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিরোধিতার যুক্তিটা তিনি কিভাবে খাড়া করেছেন? তাঁর যুক্তি হচ্ছে, “ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার, মুচি সকলেই এক জলে সূচি”। সকলেরই সূচনা “একই জল”। রজোবীজের প্রাকৃতিকতায় সকল মানুষের সূচনা ঘটেছে “একই জলে”। মানুষের মধ্য দিয়েই মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতি, প্রক্রিয়া বা প্রাকৃতিকতার দিক থেকে অভেদ প্রতিষ্ঠার এই বিশিষ্টতার দিকে নজর রাখা দরকার। ‘দেহ’ কেন বাংলার ভাবান্দোলনের কেন্দ্রীয় বিষয় সেটা আমরা এই ক্ষেত্রেও দেখছি। তাহলে এটা নিছকই মানবধর্ম, কিম্বা মানবতাবাদ বা সাম্যবাদের বয়ান নয়। এখানে দেহের বাইরে ‘মানব’ নামক অনুমান নাই। রক্তমাংসের মানুষের কথা আছে। এটা একই সঙ্গে প্রকৃতির প্রাকৃতিকতার স্বীকৃতি। যে প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে মানুষের সূচনা ঘটেছে সেটা ‘বর্তমান’ – সেটা আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি এবং কে, কেন এই প্রক্রিয়া জারি রেখেছে, কেন সেই মহাজন রজোবীজের মধ্য দিয়ে দণ্ডেকে উদয় হয় ফকির লালনশাহ তা জানতে এবং সেই বাস্তব প্রক্রিয়াকে ভাবগত ভাবে বুঝতে তুমুল আগ্রহী ছিলেন।
অমাবস্যার পূর্ণিমা হয়
মহাজন সেই দিনে উদয়
লালন বলে তাহার সময়
দণ্ডেক রয় না।।
রজোবীজের মধ্য দিয়ে মানুষের রূপ নিয়ে যে ‘মহাজন’ বারবার ‘বর্তমান’ হতে চাইছেন, তাঁকে তিনি এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই উপলব্ধি করতে চেয়েছেন, বুঝতে চেয়েছেন। কোন অনুমান দিয়ে নয়। লালনের সাধনায় এই ‘মহাজন’ বা সহজ মানুষের প্রাকৃতিক বা প্রক্রিয়াগত আবির্ভাব বিচার নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তিনি তন্ত্র থেকে একদমই আলাদা। দেহ নিয়ে ভাবনাকে আমরা এখনও গড়ে হরিবোলে ‘তন্ত্র’ বা তন্ত্র চর্চা ভাবি। ফলে লালনের সাধনায় ‘দেহ’ কেন্দ্রীয় বিষয় হলেও তিনি কিভাবে তার বিচার করেছেন সেই বিষয়ে গবেষণা হয় নি বললেই চলে। অভিমুখ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নদিয়া জাতপাত মানে না। নারীপুরুষের প্রাকৃতিক ভিন্নতা অস্বীকার করে না, কিন্তু নারী পুরুষের কোন প্রকার সামাজিক ভেদ তো মানেই না, বরং মনে করে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতি রাধিকার দাসত্ব করতে গিয়েই জ্ঞানী হয়েছেন, গৌরাঙ্গ হয়ে আবার মানুষ রূপে নদিয়ায় লীলা করে গিয়েছেন, ফলে প্রকৃতির দাসত্ব ছাড়া মুক্তি নাই। একে পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র্যের রক্ষার কর্তব্য হিসাবেও আমরা একালে সহজে বুঝতে পারি। পুরুষতন্ত্রের উচ্ছেদ তো অবশ্যই। নদিয়া ধনি গরিব ভেদ মানে না – ইত্যাদি তুলনামূলক ভাবে সহজ বিষয়। এই অভিমুখ সম্পর্কে আমরা কমবেশী স্পষ্ট। তবে এই ক্ষেত্রেও আরো বিস্তারিত কাজ করবার প্রয়োজন রয়েছে।
তিন. ব্যাক্তি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ‘জ্যান্তেমরা’
তৃতীয় দিকটা হচ্ছে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’-র প্রশ্ন। যে-জীবন সাধকরা চর্চা করেছেন সেখানে ত্যাগের ভূমিকা প্রধান, এটা সহজেই বোঝা যায়। সম্পত্তি বা বিষয়আশয় ত্যাগের দিকটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিষয়-আশয় ত্যাগ করতে গিয়ে ফকির লালন শাহ ‘বর্তমান’-কে ত্যাগ করেন নি। বাস্তব জগতকে ত্যাগ করবার কথা বলেন নি। এখানে শিক্ষনীয় দিকটা হচ্ছে বিপ্লব বা আইন করে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি উৎখাত করলে সেটা উৎখাত হয়ে যায় না। সেটা ফিরে আসে। কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে ‘আমি’ বা ‘আমিত্ব’ জড়িত। ‘আমি’-র বিলোপ না ঘটানো গেলে জগতকে ব্যাক্তিগত ভাবে ভোগদখলের বাসনা থেকে যায়। বাইরের জগত, বস্তু বা বিষয়কে আমিত্বের অধীনস্থ রাখবার তাগিদ জারি থাকে, অর্থাৎ ব্যাক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব থাকবার শর্ত রয়ে যায়। ‘আমি’ থেকে যায় বলে আবার নিজেকে সম্পত্তির দখলদার বা মালিক হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করবার ফাঁক যে কোন সময়ই পেয়ে যায়। আইন করে বা ডিক্রি জারি করে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ঘোষণা করলে তাহলে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বাসনা উবে যায় না। আবার প্রবল বেগে প্রত্যাবর্তন করে। তাহলে জগতের সঙ্গে আমাদের বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রশ্ন স্রেফ আইনী সম্পর্ক রূপান্তরের প্রশ্ন মাত্র নয়, একই সঙ্গে এই ‘আমি’-র সঙ্গে মোকাবিলার প্রশ্ন। পাশ্চাত্যে যে বিপ্লবী রাজনীতির ধারা আধুনিক কালে মার্কসের নামে গড়ে উঠেছিল সেখানে আইনী মালিকানা এবং উৎপাদন সম্পর্কের রূপান্তরের প্রশ্নই ছিল মুখ্য। ‘আমি’ কিম্বা কর্তাসত্তার রূপান্তরের প্রশ্ন বিস্ময়কর ভাবে গরহাজির ছিল। এখনও তাই রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিন প্রভৃতি দেশে বিপ্লবী রাজনীতির সফলতা বিফলতা বিচার করতে গেলে এই দিকটি আমাদের মনে রাখতে হবে।
এই দিকটি বুঝতে পারলে নদিয়ার ভাবচর্চায় ‘আমি’, বা আত্মাকে জানার রাজনৈতিক তাৎপর্য আমরা সহজে বুঝতে পারব। নদিয়ার রাজনীতির গোড়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে যে ‘আমি’ বা যে কর্তা বিশ্বজগতের সঙ্গে বুদ্ধির, ভাবের, প্রজ্ঞার, ভক্তির কিম্বা ভোগের আর উৎপাদনের বৈষয়িক সম্পর্ক পাতায় তাকে চেনা, তাকে জানা। নদিয়ার ঘোষণা হচ্ছে:
আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে
দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে
কুবৃক্ষে সুফল ফলেছে
কীর্তিকর্মার কি কারখানা!
এই আত্মতত্ত্ব মোটেও মরমি কোন ব্যাপার নয়, কোন রহস্যময় আত্মার অনুসন্ধানও নয়। মানুষ ও প্রকৃতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার যে মুহূর্তটি বিশেষ ভাবে মানুষের মাধ্যমে মানুষের মধ্য দিয়ে ঘটছে তাকে প্রত্যক্ষ করবার ও উপলব্ধি করবার বাসনা থেকেই এই ঘোষণা দেওয়া একে ‘সহজ মানুষ’ও বলা হয়েছে। কারণ যে মহাজন এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদিত হন তাঁর উৎপত্তি প্রাকৃতিকতার মধ্য দিয়ে – একসঙ্গে। ‘সহ’ বা প্রকৃতির সঙ্গেই একই সঙ্গে তার আবির্ভাব ঘটে। সহজ বা যা একই সঙ্গে উৎপন্ন এই অর্থে।
এই ঘোষণার মধ্যে বৈপ্লবিক রূপান্তরের রাজনীতিও নিহিত রয়েছে যাকে পাশ্চাত্য চিন্তার কাঠামো দিয়ে ধরা বা বোঝা যাবে না। নদিয়ায় বস্তু ও ভাবের কোন বিচ্ছেদ আগাম অনুমান করা হয় না। যা ভাণ্ড তাই ব্রহ্মাণ্ড – অতএব আমি বা মানুষের শরীরের অন্তর্গত অবিচ্ছিন্ন কর্তার রূপান্তর একই সঙ্গে জগতেরও রূপান্তর। অন্যদিকে জগতের রূপান্তরও কর্তাসত্তার মধ্যে রূপান্তর ঘটায়। যে মানুষ নিজেকে ‘আমি’ বলতে পারে, এবং চাইলেই জগতের সঙ্গে সম্পর্ক বদলাবার কর্তা হতে পারে তাকে জানা , আত্মতত্ত্ব লাভ করা নদিয়ার ভাবের গোড়ার কথা। কিন্তু সেটা স্রেফ ভাব্বাদী ব্যাপার নয়, সে কি করে রজোবীজে বর্তমান হোল সেটাও একই ভাবে জানা। অর্থাৎ তার বস্তুগত সত্তা থেকে তার ভাবের সত্তা আলাদা কিছু না। যে নিজেকে এই উদয় মুহূর্ত থেকে জানে এই ‘মহাজন’ বা কর্তার সীমা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত সেই দিব্যজ্ঞানী। এই কর্তা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন মিস্টেরিয়াস পদার্থ নয়, রক্তমাংসের মানুষের শরীর হয়েই সে ‘বর্তমান’, সে কারণে তার ভজনা একই সঙ্গে শরীরসম্পন্ন মানুষেরই ভজনা। তাই
ভবে মানুষগুরু নিষ্ঠা যার
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার
কর্তাগুণ সম্পন্ন মানুষের ভজনার কথা নদিয়া বলে। এই কর্তাই বিদ্যমান জাগতিক সম্পর্ক রূপান্তর ঘটাতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তরের রাজনীতির মধ্যে ব্যক্তির রূপান্তর প্রধান বিষয় হিশাবে গণ্য করবার শিক্ষাও আমরা ফকির লালন শাহের কাছ থেকে পেতে পারি।
লালনকে সহজে বিপ্লবী রাজনৈতিক চর্চার দিক থেকে বোঝার জন্য ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’-র দিক থেকে ওপরে কথা পেড়েছি। আসলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রশ্ন মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্ন। একই সঙ্গে নিজের সঙ্গে নিজের এবং অপরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্নও বটে। এই সম্পর্ক নির্ণয়ের পদ্ধতি কি হবে? এই দিক থেকে যদি ভাবি তাহলে দেখি লালন যখন ‘জ্যান্তেমরা”-র কথা বলেন তখন তার একটা গভীর রাজনৈতিক মানে দাঁড়ায়। লালন সাধকদের জ্যান্তে মরবার বা মৃত্যুর আগেই মরে যাবার চর্চা করতে বলেন। এর নগদ লাভ হচ্ছে মানুষের আর মরণের ভয় থাকবে না। মরণের ভয় আছে বলেই মানুষের পরকালের ভয় আছে। পরকালের ভয় থাকার অর্থ হচ্ছে ধর্মতত্ত্ববিদ বা মোল্লাপুরোহিতের বিধান ও হুকুম মেনে নেওয়া। জ্যান্তেমরার অর্থের সন্ধানে আমরা চাইলে আরও গভীরে যেতে পারি।
ঠিক যে জ্যান্তেমরার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে জীবিত থেকেও মৃত হবার সাধনা করা। কিন্তু জীবিত থেকেও মরে যাওয়া আবার কিভাবে সম্ভব? সহজ কথায় এর অর্থ হচ্ছে জীবের যে জীবমূলক বাসনা তাকে দমন করা। এতে মনে হতে পারে লালন জীবের জীবনকে অস্বীকার করছেন। আসলে তা নয়। আগেই বলেছি লালন ‘বর্তমান’ চর্চা করেন। অতএব জীবের জীবন ছাড়া মানুষের যে কোন জীবন হতে পারে না এই কাণ্ডজ্ঞান তো তাঁর অবশ্যই ছিল। শুধু তাই নয়। জীবের জীবনই সাধনার ক্ষেত্র এটাই তার মৌলিক প্রস্তাব। কারণ যাকে ‘পরম’ বা পরমার্থিক সত্য’ বলি তার আস্বাদন একমাত্র জীবের জীবনেই সম্ভব। তাহলে ‘জ্যান্তেমরা’ কথাটা জীবের জীবনকে অস্বীকার করা নয়, বরং জীবজীবনের সত্যকে নিঃশর্তে মেনে নেওয়া। জীবের জীবনে পরমের আস্বাদনের জন্যই – পরমকে ‘বর্তমান’ করে তোলার জন্যই জ্যান্তে মরবার চর্চা করতে হবে।
কিন্তু জীবকে তাহলে মরবার সাধনা করতে হবে কেন? অর্থাৎ জীবমূলক কামনাবাসনা ত্যাগ চর্চার কি দরকার? দরকার কারণ মানুষ ‘জীব’ একথা সত্য, কিন্তু মানুষ শুধু জীব নয়। এ এমন এক জীব যার মধ্যে পরমার্থিক সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। মানুষ মাত্রেই পরম হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির। সেই সম্ভাবনাকে বর্তমান করে তোলা সম্ভব যদি জীবমূলক কামনাবাসনার জায়গায় মানুষ পরমের আকাঙ্ক্ষা — পরমার্থিক বাসনার চর্চা করতে শেখে। বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তর কামনা করা বাংলার ভাবুকতার দিক থেকে পরমার্থিক বাসনা।
অন্যদিক থেকে জীবের বাসনা মূলত ভোগের বাসনা। তাহলে জ্যান্তে মরার অর্থ মানুষের জীবনকে ভোগীর জীবনে পর্যবসিত হতে না দেওয়া। ভোগের জীবন ত্যাগ করার অর্থ হচ্ছে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককেও নতুন ভাবে বিন্যস্ত করা। জগত শুধু ভোগের বিষয় নয় এই শিক্ষা দেওয়া। জগত মানুষের কাছ থেকে আলাদা থেকে মানুষের বাইরে মানুষের ভোগের জন্য হাজির এ ভাবনা পূঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গোড়ায় যেমন সক্রিয়, তেমনি পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণও বটে; পরিবেশ, প্রাণ, প্রাণের বৈচিত্র বিনাশের কারনও জীবমূলক ভোগী বাসনার মধ্যে নিহিত। যদি এতটুকু আমরা বুঝি তাহলে জ্যান্তেমরা হবার জন্য খিলকা নিয়ে ফকিরিবেশ ধারণকে আমরা শুধু লালনপন্থীদের একটা আচার আকারে নয়, মানুষের পরমার্থিক সত্যকে বর্তমান করে তোলার আবশ্যিক চর্চা হিশাবে বুঝতে শিখব। ফকিরি রহস্যও আমাদের কাছে গুহ্য কোন ব্যাপার হয়ে থাকবে না। মানুষের সঙ্গে জগতের বা প্রকৃতির সম্পর্ক কোন ভাবেই ভোগীর সম্পর্ক হতে পারে না, এই শিক্ষা লালনে ও নদিয়ার ভাবে প্রবল।
আরও অনেক দিক নিয়ে আলোচনা দরকার আছে, সন্দেহ নাই। ওপরে যে তিনটি দিক নিয়ে কথা বলেছি সেই দিকে আমাদের নজর ফেরাতে পারলে কম অর্জন হবে না। লালন শাহকে নিয়ে অনেকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। ভবিষ্যতে আরো অনেকেই আগ্রহী হবেন। তাঁর সাধক জীবনের চর্চা ও অনুশীলন তিনি যেভাবে করেছেন তাকে যথাসম্ভব জানা দরকার। তাঁর সাধনার আচার, অনুশীলন বিধিবিধান কেমন ছিল? তিনি সাধুসঙ্গ করতেন কিভাবে? তাঁর ‘কালাম’ বা গানের যথাসম্ভব সঠিক পাঠ নির্ণয়ের উপায় কি? ইত্যাদি দিকগুলো জানা, বোঝা ও আলোচনার দরকার আছে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই কাজগুলো তখনই এই কালে প্রাসঙ্গিক হবে যখন আমরা বাংলার ভাবান্দোলনের ঐতিহাসিক অভিমুখ ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট করে তুলতে পারব। লালনের রাজনৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য যতো বেশী নিজেদের কাছে আমরা পরিষ্কার করে তুলব ততোই ফকির লালন শাহ আমাদের জন্য ‘বর্তমান’ হয়ে উঠবেন; একালের লড়াই সংগ্রামের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন।
[লেখাটি ২০১১ সালে ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস সামনে রেখে লেখা হয়েছিল। কিছুটা পরিমার্জনা করেছি ও কিছু নতুন কথা যোগ করেছি]
২৫ আশ্বিন, ১৪১৮/ ১০ অক্টোবর, ২০১১। শ্যামলী, ঢাকা