।। নাদিয়া ইসলাম ।।
স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন? নাকি স্বপ্ন শুধুমাত্র একটা পোর্টাল, এক পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীতে যাওয়ার একটা দরজা মাত্র? এই যে আমি স্বপ্নে হেকেটিকে দেখলাম, তার অর্থ কী?
১
আমি একটা সবুজ পাহাড়ের মাথায় দাঁড়ায়ে আছি।
আমি অবশ্য আমি না।
আমি বলে আমি যাকে ভাবছি তার মুখভর্তি সাদা রঙের দাড়ি, মুখে সিগারেট বা সিগার জাতীয় কিছু একটা- কিন্তু তিনি সেটা টানছেন বলেও মনে হচ্ছে না। তার কপাল কুঁচকে আছে বিরক্তি বা বয়সে। ভদ্রলোকের হাড় জিরজিরা ‘কৃপা কর কমলিনী’ স্টাইলের ক্ষমাপ্রার্থনামূলক ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো পোশাক নাই, সেখানে কীসব হাবিজাবি ভাষায় কী কী সব ট্যাটু করা- আর কোমরের নীচে লাল নীল সবুজ হলুদ টাইডাই করা, সম্ভবতঃ সিল্কের অদ্ভুত একজোড়া পকেটবহুল পাজামা, একটা ফিতা দিয়ে আলগা করে বাঁধা।
কিন্তু আমি তাকে আমি বলে ভাবছি। অন্ততঃ ভাবছি বলে ভাবছি।
আমি টের পাচ্ছি আমি স্বপ্ন দেখছি। ফ্রেডরিখ ইডেনের ভাষায় যাকে বলা হয় লুসিড ড্রিমিং। আমি জোরে জোরে নিজেকে বললাম, “এটা একটা স্বপ্ন। এটা একটা স্বপ্ন। এটা একটা স্বপ্ন।”
আর তার প্রায় সাথে সাথেই আমার পিছনে দাঁড়ানো গাছদের মাঝখান থেকে কেউ বলে উঠলেন, “না, এটা স্বপ্ন না।”আমি ঘুরে পিছনে তাকালাম। দেখলাম শূন্যের মাঝখানে একটা ঘড়ি ঝুলে আছে। তাতে ১১টা বেজে ১১ মিনিট। ঘড়িটার নীচে যাদের এতক্ষণ গাছ বলে ভাবছিলাম, তারা দাঁড়ায়ে আছেন। কিন্তু তারা কেউ গাছ না। তারা সবাই মানুষ। তাদের হাঁটু থেকে পায়ের নীচের অংশ মাটিতে ঢুকে আছে, কারো কারো দুর্গার মতো দশ হাত, কারো কালীর মতো চার হাত। কারো কারো বেজোড় সংখ্যারও হাত আছে। তাদের মাথাভর্তি সবুজ রঙের পাতা। অবশ্য সবার মাথাতে পাতা নাই।
গাছদের মধ্যেও মেইল প্যাটার্ন বোল্ডনেস থাকে নিশ্চয়ই।
কথা শেষ হতেই তারা একযোগে হাত নাড়ানো শুরু করলেন। মনে হলো, সমস্ত পাহাড়ে খুব ধীরে একটা ঝড় শুরু হতে যাচ্ছে। লো-পিচের একটা গুমগুম-গুমগুম শব্দ শুরু হলো চারদিকে। অনেকটা ড্রাম বাজানোর মত। কিন্তু ঠিক ড্রামের শব্দও না। সকালবেলা দাঁত মাজার সময় ঘুমঘুম চোখে মুখের ভিতর দাঁত আর জিবের উপর টুথপেস্টওয়ালা পানি নিয়ে ঘোরালে এইরকম একটা ফাঁপা শব্দ তৈরি হয়। কিন্তু আবার ড্রামের মতো একটা ফোর-ফোর বিটও আছে তার ভিতর। ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর, ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর, ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর- অনেকটা এইরকম-
একজন বাচ্চামতন গাছ তার তিন হাত নেড়ে আবার বললেন, ‘না, এটা স্বপ্ন না।’
তিন হাতওয়ালার পাশেই আরেকজন বাচ্চামতন গাছ। তিনি উইজার্ড অভ অযের ডরোথির মতো ফ্রিল লাগানো একটা হালকা নীল রঙের ফ্রক পরে আছেন। কিন্তু তার মুখে আমাজানের তিকুনা ট্রাইবের গিয়েনিপাপো ফলের কালো রঙ আর আঠা দিয়ে ঈগলের পাখা লাগানো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। খুব পরিচিত একটা হাসি। একবার মনে হলো, না, সিগারেট বা সিগার মুখে নিয়ে দাঁড়ায়ে থাকা দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক আমি না, এই বাচ্চা গাছটাই আমি।
বাচ্চা গাছটা সম্ভবতঃ আমার মাথার ভিতরের চিন্তাটা শুনতে পারলেন। বললেন, ‘দাড়িওয়ালাও আমি, আমিও আমি। আমরা সবাইই আমি।’
আমি বললাম, ‘‘এইসব সস্তা ফিলোসফি ছাড়েন। এইগুলির যুগ শেষ হইছে একশ বছর আগে। ইবনে আরাবীই তো এইগুলি লিখছেন। ম্যাগনিফিসেন্ট ব্রেথ সম্পর্কে জানেন?’’
এইবার তিন হাতওয়ালা বলে উঠলেন, ‘‘দাম নির্ধারিত হয় জাজমেন্টের উপর। কোনটা গোলাপ আর কোনটা আগাছার ফুল, তা নির্ধারণ কর তুমি নিজে, তোমার প্রেজুডিস দিয়ে। তুমি চাইলে সবই গোলাপের মতো দামী, তুমি চাইলে সবই আগাছা।’’
আমি এইবার মাঠের উপর বসলাম। সিল্কের পাজামার পকেট থেকে ড্রাগনের ছবি আঁকা একটা সোনালী রঙের লাইটার বের করলাম, খেয়াল করলাম আমার মুখে একটা সিগারেট। সেটা অনেকক্ষণ ঠোঁটে ধরে রাখার কারণে ভিজে আছে। আমি সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম মাঠের মাঝখানে।
সেটা দূরে গিয়ে শূন্যে ভাসতে থাকলো।
পৃথিবীর সমস্ত আবর্জনাই সম্ভবতঃ এইভাবে শূন্যে ভাসতে থাকে। আমাদের তৈরি করা সমস্ত এনট্রোপি দিয়েই তো পৃথিবীর বয়স নির্ধারিত হয়, তাই না?
আমি নীল ফ্রক পরা ডরোথি বা আমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘থার্মোডায়নামিক্স পড়ছেন?’’
ডরোথির পিছনে বেশ লম্বা মতন একজন গাছ। তার হাত দুইটাই। কিন্তু এক হাতে একটা বুড়া আঙ্গুল নাই। তিনি উত্তর দিলেন, ‘‘সমস্ত জ্ঞানই সামগ্রিক। কিন্তু প্রজ্ঞাই তোমাকে আলাদা করে। থার্মোডায়নামিক্স বল আর এনার্জি ব্যালেন্স বলো, সকল জ্ঞান তোমার নিজের মধ্যেই আছে। তুমি শুধু জানো না, কিভাবে সেই জ্ঞান খুঁজে পাবে।’’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনার বুড়া আঙুলের কী হইছে? আপনি কি একলব্য? দ্রোণাচার্য আপনার আঙুল কাইটা নিছেন?’’
কেউ উত্তর দেওয়ার আগেই দেখলাম আমি আমার নতুন সিগারেটের আগুন-সহ উড়ে যাচ্ছি বেলুনের মতো। কিন্তু একই সাথে মনে হল আমার সমস্ত শরীর নিয়ে আমি মাটিতে আটকে আছি। আমার একই সাথে দশটা হাত, চারটা হাত, তিনটা হাত এবং দুইটা হাত। কোনো একটা অজ্ঞাতঃ কারণে আমার খুব কষ্ট হতে থাকলো, মনে হলো, আমি কী যেন একটা হারায়ে ফেলেছি! আমি আমার চার হাতের দিকে তাকালাম। এক হাতে লাইটারটা এখনো ধরে আছি। আরেক হাতে একটা মরোক্কান নীল সেরামিকের দলা— সেটা একটু একটু করে বড় হতে হতে বেগুনি অর্কিডের মালা পরা কালো চুলের গোবিন্দ দাসের রাধার মতো একটা অপূর্ব সুন্দর সম্পূর্ণ নগ্ন মেয়ের মূর্তিতে রূপ নিলো, আর বাকি দুই হাতে দেখলাম অনেকগুলি গ্রহ, একেকটা একেক দিকে ঘুরছে।
আমার হাতের মেয়েটা হাত থেকে দূরে সরে বাতাসে ভাসতে ভাসতে তার চার হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকলেন, ‘‘আমিই হেকেটি, আমিই হেকেটি, আমিই হেকেটি!’’
আমার পেছনে ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে কী একটা মন্ত্রপাঠের শব্দ শোনা গেল- অনেকটা ‘হ্রিম, হ্রিং, ক্লিম, চামুণ্ডা…’ এই জাতীয় অদ্ভুত কিছু শব্দ।
ডরোথি বা আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘‘তোমরা সব প্রিটেনশাস। এইসব সবকিছুই প্রিটেনশান। সবই মায়া নামের ফালতু প্রিটেনশান!’’
তারপরই দেখলাম শূন্যের মাঝখানে দাদী বসে আছেন একটা কালো কাঠের ফোর পোস্টার খাটের উপর। তাতে খুব ক্যাটক্যাটা একটা অশালীন লাল রঙের চাদর। আমি এমনকি উনার গায়ের জবাকুসুম তেলের গন্ধ পেলাম। উনি খাটের উপর বালিশে হেলান দিয়ে বললেন, ‘‘বুগলে আয় বুবু। মায়া মিছা হইবো ক্যান? এই যে আমার আপনার জন্য এত মায়া, এগুলি কি মিছা?’’
উনি জীবিত অবস্থাতেও আপনি তুই তুমি মিশায়ে কথা বলতেন।
আমি দাদীকে ধরতে গেলাম হাত বাড়ায়ে। কিন্তু তখন উনি আর খাটের উপর নাই। সেখানে এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প শুয়ে আছেন। তার সমস্ত শরীর ভর্তি রক্ত। তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘‘তোমরা ডেমোক্রাটরা আমাকে খুন করেছো। তোমরা জানো না, আমাকে খুন করে তোমরা হিরো বানিয়ে দিয়েছো। আমি অবশ্য আগেই হিরো ছিলাম। এখন এই অ্যাসাসিনেশান আমাকে আরও বড় হিরো বানাবে ইউ লুজার্স!’’
এইসব বলতে বলতেই উনি হেসে উঠলেন হাহা-হাহা করে। তারপর আমার দিকে খুব তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলে উঠলেন, ‘‘পরমারি মম, হে সারণ, প্রভু তব; তবু তাঁর দুঃখে পরম দুঃখিত আমি, কহিনু তোমারে! রাহুগ্রাসে হেরি সূর্যে কার না বিদরে হৃদয়? যে তরুরাজ জ্বলে তাঁর তেজে—’’
এবং এরপরেই আমার ঘুমটা ভেঙে গেল!
বুঝলাম না, স্বপ্নে মেঘনাদবদ কাব্য এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একসাথে দেখার রহস্য কী!
২
স্বপ্ন বিষয়টা অদ্ভুত, এই জিনিস সম্ভবতঃ ‘অজ্ঞান বিহঙ্গকে ধাড়ীবেলায় পোষ মানানো যায় না’ বাক্যের পরেই সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। স্বপ্ন, ব্রেইন, সাবকনশাস, নিউরোএ্যানাটমি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এইসমস্তই আমার খুব আগ্রহের বিষয়। আমি অনেক বছর স্বপ্ন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই স্বপ্ন কী, ক্যানো আমরা স্বপ্ন দেখি, যা দেখি বলে ভাবি, যা ভাবি বলে ভাবি- তা কেন দেখি, কেন ভাবি— তার কোনো সদুত্তর পাই নাই। অবশ্য আমি তো আমি, স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানী বা গবেষকরা আজকের দিন পর্যন্ত দিমিত্রি মেন্ডেলিভ ক্যানো পিরিয়ডিক টেবিলের মতো একটা জিনিস স্বপ্নে দেখলেন, বা আলবার্ট আইনস্টাইন বা রামানুজান কীভাবে স্বপ্ন থেকে পদার্থবিজ্ঞান বা অংকের সূত্র খুঁজে পেলেন, কীভাবে নাইন/এলেভেনের ঘটনা অনেকেই আগে স্বপ্নে দেখেছিলেন, কীভাবে আব্রাহাম লিংকন তার খুনের তিন দিন আগেই নিজেকে খুন হতে দেখেছিলেন, কীভাবে স্যামুয়েল কোলরিজ স্বপ্ন দেখে একটা আস্ত কবিতা লিখে ফেললেন, কীভাবে স্বপ্নে বেনজিন বা ডাবল হিলিক্স ডি-এন-এ স্ট্রাকচারের খোঁজ পাওয়া গেল— এই সব একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেন নাই।
তবে হ্যাঁ, স্বপ্ন কীভাবে দেখা হয়, বা স্বপ্নের মেকানিজম কী— তার অনেকটাই আমরা এখন জানি। অন্ততঃ জানি বলে ভাবি।
আমাদের ব্রেইনের হিপোক্যাম্পাল এলাকায় আমাদের এপিসোডিক মেমরি জমা হয়। আমরা যখন ঘুমাই বা র্যাপিড আই মুভমেন্টের ভিতর থাকি, তখন আমাদের হিপোক্যাম্পাস এবং ডরসোল্যাটেরাল প্রিফ্রন্টাল করটেক্স কাজ করা বন্ধ করে রাখে। কিন্তু তখন আমাদের অবচেতন মন কাজ করা শুরু করে। এমনকি জেগে থাকতে আমাদের ব্রেইন যতদূর কাজ করে, ঘুমিয়ে থাকাকালীন আমাদের ব্রেইন তার চাইতে বেশি এবং দ্রুত কাজ করে। আমাদের অবচেতন মন আমাদের সচেতন মনের চাইতে কয়েকশ গুণ বেশি শক্তিশালী। আমরা প্রতিদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে যা যা দেখি, যত মানুষের দিকে তাকাই, যত বিলবোর্ডে যত বাক্য যত ব্যাঙ্গচিত্র যত হলিউডের অভিনেতাদের পূর্বপুরুষের ইওরোপের ভূতাত্ত্বিকের প্রভাবে ভাঙা চোয়াল আর সবুজ চোখের ভিতর দিয়ে ক্যারিবিয়ানের স্ট্রাইপড ছাতাওয়ালা হলিডের টাকার অংকে বিজ্ঞাপন দেখি, তার সবই আমাদের অবচেতন মন ব্রেইনে জমা করে রাখে। কিন্তু আমাদের সচেতন মন এক সেকেন্ডে সাতটার বেশি তথ্য প্রসেস করতে পারে না বলে অপ্রয়োজনীয় সকল তথ্য আমরা ভুলে যাই। উল্টাদিকে আমাদের অবচেতন মন এক মিলি-সেকেন্ডে প্রায় তিরিশ হাজার বিটসের তথ্য প্রসেস করতে সক্ষম। তাই আমরা যা ভুলে যাই বলে ভাবি, তা আমরা আসলে ভুলি না। আমরা হয়তো সচেতন ভাবে তা ভুলে গেছি বলে ভাবি, কিন্তু আমাদের অবচেতন তার সবই ব্রেইনে তুলে রাখে। আর সচেতনভাবে এইসব ভুলে যাওয়া তথ্যের সমষ্টি দিয়েই আমরা স্বপ্ন দেখি।
মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় দিয়েই এইসব তথ্য সংগ্রহ করি না। আমাদের কালেক্টিভ আনকনশাস মাইন্ড আমাদের জিনেটিক মেমরিতে আমাদের পূর্বপুরুষের সমস্ত তথ্য বহন করে। এই জিনিসের সবচাইতে মজার উদাহরণ হচ্ছেন শিশুরা। যারা দুই তিন বছরের শিশুদের কাছ থেকে দেখেছেন, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, শিশুদের টেলিভিশনের রিমোট কনট্রোল বা জুতা বা মাটি বা খেলনা বা চশমা সহ পৃথিবীর খাদ্য-অযোগ্য কোনোকিছু খেতেই আপত্তি না থাকলেও তারা কোনোভাবেই সবুজ শাক-সবজি খেতে চান না। এই ধনুকের মত বাঁকা হয়ে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল বিদীর্ন করা অহৃদয়বিদারি কান্নাকাটি ‘নাটকের’ অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে শিশুদের জিনেটিক মেমরি। আমাদের হান্টার-গ্যাদারার পূর্বপুরুষরা
যখন তাদের শিশুদের গুহায় রেখে খাদ্য সংগ্রহে বের হতেন, তখন তারা তাদেরকে গুহার আশেপাশের কোনোপ্রকার লতা পাতা না খেতে নিষেধ করে যেতেন। কারণ তারা তখনও সম্পূর্ণভাবে জানতেন না, কোন্ পাতা বিষাক্ত আর কোন্ পাতা খাদ্যযোগ্য। যে কারণে আজকের দিন পর্যন্ত শিশুরা বাবা মা বা বিশ্বস্ত মানুষদের মাধ্যমে সবুজ শাক সবজি নিয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তা মুখে তুলতে নারাজ থাকেন। একইভাবে সাপ বা আরশোলা সহ পোকামাকড় ভয় পাওয়ার কারণও আমাদের জিনেটিক মেমরিতে বহন করা আদিম ভয়।
আমাদের সারভাইভাল ইনস্টিংক্ট।
আমরা যা স্বপ্ন দেখি তার অধিকাংশই বিবর্তনবাদের সাথে যুক্ত। স্বপ্ন আমাদের সতর্ক থাকতে সাহায্য করে। আমরা যদি সতর্ক না থাকি, ভয় না পাই, আমরা যদি উদ্বিগ্ন না থাকি, তাহলে মানুষ হিসাবে আমরা এই এত মিলিয়ন বছর টিকে থাকতে পারতাম না। ঘুমের ভিতর যদি ওলট পালটভাবে শোওয়ার জন্য কোনোভাবে আমাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে থাকে বা ঘুমের আগে গুরুপাক কিছু খাওয়ার জন্য বদহজম হয়, তাহলে দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে ঘুম ভাঙিয়ে অবচেতন মন বা বিশেষতঃ ব্রেইনের অ্যামিগডালা নামের একটা অংশ আমাদের রক্ষা করে। যে কারণে আমরা আমাদের জীবদ্দশায় যা স্বপ্ন দেখি, তার অর্ধেকই দুঃস্বপ্ন। আমি অবশ্য এই বিষয়ে কোনো রিসার্চ পেপার এখন পর্যন্ত খুঁজে পাই নাই, তবে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, পৃথিবী যত ‘আধুনিক’ হচ্ছে, বা বলা ভালো, পৃথিবী যত আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে সাপের ভয়, বাঘের ভয়, চোর ডাকাত ধর্ষকের ভয় কমিয়ে দিচ্ছে, আমাদের দুঃস্বপ্ন দেখার হার ততই বাড়ছে। আমরা দেখি, আমরা অনেক উঁচু বিল্ডিং থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছি, রাস্তার মাঝখান দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি এবং অসংখ্য মানুষ অস্ত্র হাতে আমাদের তাড়া করে আসছেন, আমরা দেখি আমাদের প্রিয়জনরা মারা গেছেন, আমরা নিজেদের নৃশংসভাবে খুন হতে দেখি। (অবশ্য খুন হওয়ার অনৃশংস কোনো পদ্ধতি আছে বলে আমার জানা নাই।) এবং আমি বিশ্বাস করি, আমাদের পূর্বপুরুষ যাদের জীবনের অধিকাংশ সময় অনিশ্চিয়তাতে কাটতো, তারা খুব কমই দুঃস্বপ্ন দেখতেন।
স্বপ্ন দেখার অবশ্য আরও বেশ কিছু কারণ আছে বলে গবেষকরা দাবী করেন। ‘মেমরি কনসোলিডেশান থিওরি’ অনুযায়ী আমরা প্রতিদিন যা শিখি, তা মনে রাখতেই স্বপ্ন দেখি। এছাড়াও স্বপ্ন আমাদের বাস্তব জীবনে পাওয়া মানসিক আঘাত বা লজ্জা বা অপমান থেকে রক্ষা করে। যে সহমর্মিতা আমরা বাস্তবে পাই না, স্বপ্ন দ্বিতীয় বাস্তবতা তৈরির মাধ্যমে আমাদের সাময়িক উপশম দেয়। আমাদের বাস্তবের না পাওয়া, অবদমিত যৌনতা, অবদমিত চিন্তাও স্বপ্ন নির্ধারণ করে।
কিন্তু এর বাইরে, অর্থাৎ স্বপ্নে দেখা ঘটনা বাস্তবে ঘটা বা স্বপ্নের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বা স্বপ্নের সাথে সৃষ্টিশীলতার কী যোগ- তা আমরা এখনও জানি না। আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি যতবার স্বপ্নে নিজেকে খুন হতে দেখেছি, তার দুই থেকে তিন দিন পরে আমার কাছের কেউ মারা গেছেন। আমি এটাকে কাকতালীয় বলে উড়ায়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারি নাই।
৩
লুসিড ড্রিমিং-এর বাংলা আমার জানা নাই। তবে বিষয়টা অনেকটা এইরকম। যখন আপনি একই সাথে ঘুমিয়ে আছেন এবং আপনার শরীরের কিছু অংশ এখনও ‘জেগে’ আছে, তখন রেম স্লিপে যা স্বপ্ন দেখবেন, তাই লুসিড ড্রিমিং। লুসিড শব্দের আভিধানিক বাংলা অর্থ স্বচ্ছ। যদিও এখানে স্বপ্নের সাথে স্বচ্ছতার কোনো সম্পর্ক নাই। লুসিড ড্রিমিং এর সময় আপনি টের পাবেন আপনি স্বপ্ন দেখছেন কিন্তু একই সাথে সেই স্বপ্নকে বাস্তবের মত বলে মনে হবে।
ছোটবেলায় ই বি হোয়াইটের লেখা আর গার্থ উইলিয়ামসের ইলাস্ট্রেশান করা ‘স্টুয়ার্ট লিটিল’ এবং পরে লুইস ক্যারলের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ পড়ে আমার লুসিড ড্রিমিং নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। পরে আমি রবার্ট মসের ‘কনশাস ড্রিমিং- আ স্পিরিচুয়াল পাথ ফর এভরিডে লাইফ’ পড়ি। এই বইয়ে লুসিড ড্রিমিং এর মাধ্যমে স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করার ৯টা ধাপ দেখানো হয়। আমরা রেম স্লিপ এবং নন-রেপ স্লিপে যা স্বপ্ন দেখি, তার ৯০ শতাংশই ভুলে যাই। এই বইয়ে স্বপ্ন কিভাবে মনে রাখা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত বলা আছে। তবে আরও পরে আমি লুসিড ড্রিমিং এর স্বপ্ন মনে রাখার আরও সহজ একটা পদ্ধতির খোঁজ পাই। ঠিক কোথায়, তা অবশ্য মনে নাই। পদ্ধতিটা এইরকম— আপনি যখন টের পাচ্ছেন আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই, তখন আপনার ডমিন্যান্ট হাতের প্রথম দুই আঙ্গুল বিছানার উপর এমনভাবে নাড়াবেন যেভাবে হারমোনিয়াম বাজানো হয়। তবে এই নাড়ানোটা খুব দ্রুত হবে না, আবার খুব আস্তেও না। একটা আঙুল থামলে দ্বিতীয় আঙুল নড়বে। এবং এই আঙুল নাড়ানোর দিকে মনোযোগও দেয়া যাবে না। আঙুল নড়তে থাকবে এবং একই সাথে আপনি ঘুমিয়েও পড়বেন।
তাতে যেই ঘটনা ঘটবে, তা হচ্ছে, একই সাথে আপনার অবচেতন এবং সচেতন মন সক্রিয় থাকবে। এবং আপনি লুসিড ড্রিমিং এর ভিতর ঢুকবেন।
এবং অতি অবশ্যই, পৃথিবীর আর সবকিছুর মতোই এই জিনিস আয়ত্ত্বে আনতে আপনার নিয়মিত প্রাকটিস লাগবে।
৪
ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত আমি আমার ডায়েরিতে প্রতিরাতের স্বপ্ন লিখে রাখি। এই স্বপ্নগুলিকে আমি অনেকভাবে ব্যখ্যার চেষ্টা করেছি, স্বপ্ন নিয়ে কাজ করা সিগমুন্ড ফ্রয়েড আগাপাশতলা পড়েছি, কিন্তু কোনো কিছু দিয়েই কোনো কংক্রিট সমাধানে আসতে সফল হই নাই। এইক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের বেশিরভাগ কথাবার্তাই আমার সহ্য হয় না। এবং অতি আবশ্যিকভাবে উনার ‘আমাদের অবদমিত কামনা’ থেকে স্বপ্নের উৎপত্তি হওয়ার থিওরি আমি ডাউনরাইট নাকচ করে দেই। এই যে আমি স্বপ্নে হেকেটি নামের কালীর মতো চার হাত ওয়ালা এক অপূর্ব সুন্দর মেয়ে বা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে স্বপ্ন দেখলাম, তার সাথে আমার অবদমিত কামনার সম্পর্ক কী?
সেই রাতে ঐ স্বপ্নটা দেখার পর আমি অনেক ঘাঁটাঘাটি করে বের করি, আমি যেই শব্দগুলি শুনেছিলাম, তা আসলে বৈদিকীকরণ করা একটা কালীমন্ত্র।
মন্ত্রটা কিছুটা এইরকম- ‘ওঁ, হ্রিম, হ্রিং, ক্লিম, চামুন্ডায়ে… নমঃ’। বলে রাখা ভালো, এই মন্ত্রটির শব্দগুলির ক্ষেত্রে ‘ওঁ’ এবং ‘নমঃ’ জাতীয় শব্দগুলি সংস্কৃত হলেও বেশিরভাগ শব্দই অসংস্কৃত। মন্ত্রটি তন্ত্রের। আমরা জানি যে আদি যে তন্ত্র তা সম্পূর্ণরূপেই অবৈদিক। কিন্তু একটা সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ বা আর্যীয় অনুপ্রবেশ তন্ত্রের বৈদিকীকরণের চেষ্টা চালায়। যার ফলে তন্ত্রের অনেক মন্ত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পূর্ণরূপেই অসংস্কৃত বাক্যের মধ্যে কয়েকটি সংস্কৃত শব্দ সংযুক্ত করে এবং সংস্কৃত ভাষার বিভক্তি, প্রত্যয় ইত্যাদির সংযোজনে অবৈদিক মন্ত্রের বৈদিক রূপান্তরের চেষ্টা স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান। এই মন্ত্রেও এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে।
সে যাই হোক, যা বলছিলাম, আমি দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এই মন্ত্র আমি সচেতন বা অবচেতনভাবে জীবনে কোনোদিন শুনি নাই। অবশ্য জীবন বলতে যদি আমি এই একটা জীবনের কথা ভাবি, তাহলে অতি অবশ্যই আমি কখনো ‘এই’ জীবনে এই জিনিস শুনি নাই। তবে অন্য কোনো জীবনে এই জিনিস শুনেছি কিনা তা নিয়ে আমি নিশ্চিত না। সময়কে যদি শুধুমাত্রই অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে যাওয়া দুই ঘটনার একমুখী ব্যবধান বলে আমরা না দেখি, বরং তাকে বৃত্তাকার একটা স্থান বলে ভাবি, তাহলে হয়তো একই সাথে অনেকগুলি জীবনের অস্তিত্ব থাকাটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। আইনস্টাইনের স্পেইস টাইম কার্ভকে যদি বাস্তবিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়, তাহলে হয়তো সিউডো সায়েন্স বলে বিজ্ঞান আর এইসব ফেনোমেনাকে বাতিল করে দিতে পারবে না।
আমি জানি আমার কথা শোনার সাথে সাথে নাস্তিক এবং ধার্মিকরা একই সাথে উদ্বাহু মণিপুরি কুঁচিপুরি নাচতে নাচতে হায়হায় মাতম করে আমাকে জ্যান্ত পুড়ায়ে মেরে আমার ছাই বুড়িগঙ্গায় ভাসায়ে দিয়ে বুড়িগঙ্গার সমস্ত পানি রকেটে করে চাঁদে পাঠায়ে বোমা মেরে চাঁদ উড়ায়ে দিতে চাইবেন, কিন্তু তারপরেও আমি বিশ্বাস করি, স্বপ্ন কী বা কেন দেখি- তার উত্তর পেতে হলে বিজ্ঞান এবং ধর্মকে একই জায়গায় আসতে হবে। আমি অতি অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে ‘আমি কে’ জাতীয় প্রাইমারি ও বেসিক প্রশ্নে আমি ধর্মকে উড়ায়েও দেই না।
খেয়াল করলে দেখবেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অবজার্ভার থিওরির সাথে সুফিবাদের অসম্ভব মিল আছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে, আপনার আশেপাশের পৃথিবী আপনার তৈরি করা পৃথিবী। আপনি দেখছেন বলেই আপনার পৃথিবীর অস্তিত্ব আছে। একই কথা গৌতম বুদ্ধও বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘জীবন মাত্রই মায়া।’’, তবে বৈদিক ‘মায়া’ আর গৌতম বুদ্ধের ‘মায়া’ একই জিনিস না। উপনিষদের মায়ার অর্থ ঈশ্বরের শক্তি। অপরদিকে বুদ্ধের কথা অনুযায়ী, পৃথিবীতে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নাই, এবং মায়া শুধুমাত্রই ‘ভান’ যা আমাদের অস্তিত্বর একটা বিভ্রম তৈরি করে। সুফি কবি রুমি লিখেছিলেন, ‘‘এই পৃথিবীটা হল একটা স্বপ্ন, শুধু একজন ঘুমন্ত ব্যক্তিই একে বাস্তব মনে করে। এরপর ভোরের মত করে মৃত্যু আসে, আর যা কিছুকে দুঃখ বা কষ্ট বলে ভাবতে- তা নিয়ে হাসতে হাসতে তুমি জেগে ওঠো’’।
তাহলে স্বপ্ন আসলে কী? খুব ক্লিশে শোনালেও এবং ক্লিশে কথাবার্তা আমি একদমই বলতে না চাইলেও এই প্রশ্নটা করতেই হয়, আমাদের পুরা জীবনটাই কি তাহলে একটা স্বপ্ন? আর তাই যদি হয়, তাহলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমরা যা দেখি, তা কী? স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন? নাকি স্বপ্ন শুধুমাত্র একটা পোর্টাল, এক পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীতে যাওয়ার একটা দরজা মাত্র? এই যে আমি স্বপ্নে হেকেটিকে দেখলাম, তার অর্থ কী?
প্রাচীন গ্রিক ধর্ম এবং মিথোলজি অনুযায়ী হেকেটিকে বলা হয় সমস্ত জ্ঞানের দরজার দ্বাররক্ষক দেবী। তন্ত্রসাধক এবং ডাকিনিরা হেকেটিকে পুজা করেন। তন্ত্রসাধনা বা ডাকিনিবিদ্যা সম্পর্কে আমার কোনোপ্রকার জ্ঞান নাই। তবে ঐ স্বপ্ন দেখার পরে ডাকিনিবিদ্যা নিয়ে আমি যতদূর পড়ালেখা করলাম, তাতে বুঝলাম, ডাকিনিরা স্বপ্নকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। তারা বলেন, স্বপ্নের মাধ্যমেই আমাদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। অ্যাস্ট্রোলজারদের মতো তারাও বিশ্বাস করেন, আমরা সবাই কালের উর্দ্ধে এক জায়গা এক জ্ঞান থেকে তৈরি হয়েছি। আমাদের শরীর শুধুমাত্র আমাদের একটা একজিস্টেনশিয়াল ক্যারিয়ার মাত্র, কিন্তু আমাদের সকলের আত্মা সামগ্রিকভাবে একটা সর্বজনীন জ্ঞান। বা ঈশ্বর। অর্থাৎ আমাদের খণ্ডিত জ্ঞান সেই ঈশ্বরের অংশ। তাই ঈশ্বরকে পেতে হলে আমাদের সকল খণ্ডিত আধ্যাত্মিক শক্তিকে এক জায়গায় হতে হবে। এবং সম্ভবতঃ এই কারণেই প্রায় সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে সমবেতভাবে ধ্যান করার নিয়ম আছে। যেকোনো প্রার্থনাই এক ধরণের ধ্যান, যার মাধ্যমে আমরা ‘উচ্চতর’ পরমে পৌছাই।
এনিওয়ে। ফ্রয়েডে কিছু না পেয়ে আমি উনার ছাত্র কার্ল ইউং পড়লাম কিছুদিন। ইউং এর কাজ ফ্রয়েডের চাইতে অনেক গুণে ইন্টারেস্টিং। এবং তিনিই সেই আমলে একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি ‘অবৈজ্ঞানিক’ ভাবে চিন্তার সাহস দেখিয়েছিলেন। তার ‘এয়ন- রিসার্চেস ইনটু ফেনোমেনোলজি অফ দ্যা সেলফ’ বইয়ে যীশুর আর্কিটাইপের সাথে মধ্যযুগীয় রসায়ন শাস্ত্র এবং মানুষের মন ও কালেকটিভ আনকনশাস নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়। ইউং যেই পদ্ধতিতে স্বপ্নকে দেখেছেন, তাকে এ্যানালিটিকাল সাইকোলজি বলা হয়। তিনি স্বপ্নকে সচেতন এবং অবচেতন মনের মধ্যকার ব্রিজের সাথে তুলনা দিয়েছেন। ইউং এর পাশাপাশি জোসেফ ক্যাম্পবেল-সহ বিংশ শতকের আরও অনেক দার্শনিকই আমাদের চিন্তাপদ্ধতি, বিশেষতঃ আমাদের কালেক্টিভ আনকনশাসনেসে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন ধর্ম এবং পুরাণের বিভিন্ন রূপকের ব্যবহার নিয়ে কাজ করেছেন। ইয়ুং-এর ম্তো ক্যাম্পবেলও বিশ্বাস করতেন, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম এবং পুরাণের অদ্ভুত সামঞ্জস্যর রহস্য আমাদের কালেক্টিভ আনকনশাসনেসের সঙ্গে যুক্ত। তারা দুইজনই বিশ্বাস করতেন, আমাদের ব্যক্তিগত অচেতন মনের পাশাপাশি সামগ্রিক অচেতন মনেরও অস্তিত্ব আছে। এই সামগ্রিক অচেতন মন মানবসভ্যতার ইতিহাসের বিভিন্ন এলেমেন্ট এবং কগনিটিভ স্ট্রাকচার ধারণ করে, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি শিশুদের ঘাস লতা পাতা খাওয়া প্রসঙ্গে। ইউং এইসব কগনিটিভ স্ট্রাকচারকে উল্লেখ করেছিলেন ‘আর্কিটাইপ’ বা আদিরূপ হিসাবে। ক্যাম্পবেল দেখিয়েছিলেন, ইউং এর উল্লেখ করা এইসব আর্কিটাইপ আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি দেখি না। বরং তা পুরাণের বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে আমাদের সামনে ধরা দেয়। উনি বলেছিলেন, “পুরাণের রূপকরা তৈরি করা না; তাদের আদেশ দেয়া যায় না, আবিষ্কার করা যায় না, বা পুরাপুরি দমনও করা যায় না। তারা আমাদের মনের সতস্ফূর্ত উৎপাদন।” (দ্যা হিরো উইদ আ থাউসান্ড ফেইসেস) ইউং নিজেও তা বিশ্বাস করতেন। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের সার্বভৌম সাইকির প্রথম এবং অন্যতম প্রধান প্রপঞ্চ হচ্ছে এইসব পৌরাণিক গল্পরা। এই গল্পগুলি আমাদের আত্মার চরিত্র উন্মোচন করে।” (কালেক্টেড ওয়ার্ক্স অভ সি জি ইউং, ভলিউম ৯, পার্ট ১)
ইউং তার স্বপ্নের ব্যখ্যায় গ্রিক, মেসোপটেমিয়ান এবং ব্যবিলনিয়ান রূপকের ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন সময়। এবং তিনি বিশ্বাস করতেন আমাদের কালেক্টিভ আনকনশাসনেস টেলেওলজিকাল সাইকো-স্পিরিচুয়াল পদ্ধতিতে আমাদের জীবনে সেই রূপকগুলিকে ধরে রাখে। তিনি এই পদ্ধতির নাম দিয়েছিলেন, ‘দ্যা প্রসেস অভ সৌল মেকিং’।
মেসোপটেমিয়ান এবং ব্যবিলনিয়ানরা বিশ্বাস করতেন, ঘুমের সময় আমাদের খণ্ডিত আত্মা শরীর থেকে বের হয়ে এসে আমাদের সামগ্রিক আত্মার সাথে যুক্ত হয়; এবং স্বপ্নই আমাদের ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হবার রাস্তা দেখায়। গ্রিকরা বিশ্বাস করতেন, ঘুমের সময় শরীর থেকে আত্মা বের হয়ে যায় এবং স্বপ্নের মাধ্যমে দেবতা বা দানবরা আমাদের কাছে তাদের বার্তা পাঠান। গ্রিক পুরাণের স্বপ্নের দূত মরফিয়াসের ভাই ফোরবিটোর ছিলেন দুঃস্বপ্নের বাহক। প্রতি রাতে তিনি বিশাল দুই পাখা নিয়ে পাতালের অনন্ত অন্ধকার থেকে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসতেন; এবং কালো কাক, নেকড়ে বা সাপের রূপ ধরে মানুষের দুঃস্বপ্নে হাজির হতেন। তিনি ছিলেন অন্ধকারের পুত্র। একেশ্বরবাদী আব্রাহামিক ধর্মগুলিও স্বপ্নের ব্যাপারে গ্রিক বিশ্বাসের কাছাকাছি। আব্রাহামিক ধর্মগুলি পুরাণ নির্ভর না হলেও গ্রিকদের ব্যবহার করা সমস্ত রূপক তাদের বিশ্বাসের সাথে যুক্ত ছিল। প্রাথমিক সময়ের ইহুদী এবং খ্রিশ্চানরা বিশ্বাস করতেন স্বপ্ন ঈশ্বরের পাঠানো কোনো বার্তা। ওল্ড টেস্টামেন্টে দেখা যায়, সলোমনের স্বপ্নে ঈশ্বর এসেছেন। তিনি সলোমনকে জিজ্ঞেস করছেন, সলোমন তার কাছে কী চান। সলোমন উত্তর দেন, তিনি এমন একটা হৃদয় চান, যা দিয়ে ঈশ্বরকে অনুভব করা যায়। (প্যাসেজ ১- কিংস ৩) পরবর্তীতে ইসলামেও তার কনটিনিউয়েশান দেখা যায়।
ইসলাম স্বপ্নকে নবুয়্যতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এছাড়াও নবী মুহম্মদ স্বপ্নের মাধ্যমেই আল্লাহর কাছ থেকে বার্তা পেয়েছিলেন বলে মুসলিমরা বিশ্বাস করেন।
এখন আমার স্বপ্নে কালী বা হেকেটির উপস্থিতির কারণ খুঁজতে ইউং এর পদ্ধতি অবলম্বন করে আব্রাহামিয়ান পেট্রিয়ার্কাল এথিকাল মনোথেইজমের ক্ষমতাচর্চার বাইরে বের হয়ে যদি ঈশ্বর অর্থাৎ জ্ঞানকে চিন্তা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে আমরা ঈশ্বরকে যেই রূপে কখনোই চিন্তা করি না, তাই কালীমূর্তি। প্রথমতঃ এই কালী লিঙ্গসূত্রে একজন নারী, তার গায়ের রঙ কালো এবং তিনি লজ্জাহীনভাবে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়ে আছেন। ঋণাত্মক অর্থে যা যা আমরা ভাবি বা ভাবি বলে ভাবি, তার সমস্তই কালী চিত্রিত করেন। অথচ, ভালো-খারাপের বাইনারী ব্যখ্যার বাইরে যদি দেখা সম্ভব হয়, তাহলে দেখা যাবে, কালো না থাকলে সাদার অস্তিত্ব থাকে না। ঋণাত্মক না থাকলে ধনাত্মকেরও অস্তিত্ব থাকে না। শূন্যতা না থাকলে পূর্ণতার অস্তিত্ব থাকে না। তাই পৃথিবী বা আমাদের অস্তিত্ব বা সামগ্রিক জ্ঞান কোনোকিছুই কালীর শূন্যতাকে অগ্রাহ্য করে সম্ভব হয় না। কেননা কালী হচ্ছেন কালের আদি। তিনি অসীম, তাঁর কোনো আকার নাই। সময় ও ব্রহ্মাণ্ড জাত বা সৃষ্ট হচ্ছে তাঁর থেকেই।
অর্থাৎ শূন্যতাই পরিপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করে। এবং জ্ঞানহীনতাই জ্ঞানপ্রাপ্তিকে জ্ঞানলব্ধ করে।
এবং এখানেই আমাদের সমস্ত ধর্মের সমস্ত পুরাণের সমস্ত স্বপ্নের আর্কিটাইপরা এক জায়গায় এসে একটামাত্র কালেক্টিভ আনকনশাসনেস হয়ে যায়।
কালী বা হেকেটি বা এমনকি নবীকন্যা ফাতেমা দশমহাবিদ্যার একটামাত্র আদিরূপ হিসাবে ধরা দেয়।
৫
আমার দাদীর কাছে একটা খোয়াবনামা ছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা না, স্বপ্নের ব্যখ্যার খোয়াবনামা। সেইখানে দুনিয়ার আজব আজব সব স্বপ্নের ততোধিক আজব আজব সব ব্যখ্যা ছিল। যেমন স্বপ্নে এলোমেলো চুলের নারীকে দেখার অর্থ কী। স্বপ্নে মা’কে খেজুর খেতে দেখার অর্থ কী। স্বপ্নে নিজের বিয়ে হতে দেখার অর্থ কী। এইসব।
ছোটবেলায় আমি এইগুলিকে কুসংস্কার বলে এক কথায় উড়ায়ে দিতাম। এখন দেই না। এখন মনে হয়, পৃথিবী এত বেশি রহস্যময় এবং আমরা এত কম জানি যে শুধুমাত্র একটা পরিপ্রেক্ষিতে একটা জিনিসকে এক পাক্ষিকভাবে দেখে কোনোভাবেই তার সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান পাওয়া সম্ভব না। দশমহাবিদ্যা বা সাতাশমহাবিদ্যা যাই হোক, আমাদের খণ্ডিত বিদ্যা দিয়ে সামগ্রিক জ্ঞান অর্জন অতি অবশ্যই অসম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আমরা যেভাবে ইস্কুলে পলাশির যুদ্ধের সময়কাল আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ আর মশার জীবনচক্র জাতীয় একগাদা হাবিজাবি জিনিস শিখে দিনশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রি অর্জন করে একটা চাকরি একটা বিয়ে করে গোটা দুই সন্তান উৎপাদন করে সিস্টেমের শ্রমিক হিসাবে কাজ করে টরে মরে যাই, তাতে আমাদের খণ্ডিত জ্ঞান একটা জীবন শেষ করে আরেক জীবনে- তার পরের জীবনে- তারও পরের জীবনে খণ্ডিতই থেকে যায়।
আমি মাঝেমধ্যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির কাজ দেখি আর ভাবি, একজন মানুষ একই সাথে এতকিছু কিভাবে করতে পারতেন? তিনি কি জিনিয়াস হিসাবে জন্ম নিয়েছিলেন নাকি জিনিয়াস হিসাবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন? কোনো একটা জায়গায় পড়েছিলাম, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। ভিঞ্চি কি স্বপ্নে নিজেকে উত্তরণ করেছিলেন? আমরা কি চাইলেই ভিঞ্চির মতই স্বপ্নে নিজেদের উত্তরণ করতে পারি? আমরা কি চাইলেই সামগ্রিক জ্ঞানের লাইব্রেরিতে ঢুকতে পারি? বাস্তবতা যদি আমারই তৈরি করা স্বপ্ন হয়, আর স্বপ্ন যদি সামগ্রিক জ্ঞান খুঁজে পাওয়ার একটা পোর্টাল হয়, তাহলে কি আমি স্বপ্নের মাধ্যমে ঈশ্বরে রূপান্তরিত হই? নাকি আমরা আগে থেকেই ঈশ্বর ছিলাম, শুধুমাত্র স্বপ্নে আমরা আমাদের হারানো অংশগুলি খুঁজি? এই কারণেই কি আমরা ছবি আঁকি, গান গাই, কবিতা লিখি? মানুষের জীবনে শিল্পের প্রয়োজন কি শুধু এ্যাসথেটিক্সের জায়গা থেকে তৈরি হয়? নাকি এইসব নিরর্থক শিল্পের উদ্দেশ্যও শেষ পর্যন্ত নিজের বাকি অংশগুলিকে খুঁজে পাওয়া? বিগ ব্যাং এ আমাদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন অংশগুলি কি আমাদের কালেক্টিভ আনকনশাসনেসের কালো বেড়াল আর সাদা পাখা ওয়ালা ফেরেশতা জিব্রাইল আর বানরের চেহারার সিংহের শরীরের সাপের লেজের জাপানিজ পৌরাণিক দানব নু আর দশ মাথাওয়ালা রাবণ আর সমুদ্রের পাশে বসে করুণ সুরে গান গাওয়া সাইরেনের দল আর হেইডির অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া ডিমিটারকন্যা পারসিফোনির সমস্ত আর্কিটাইপের প্রতিফলিত রূপ ধরে আমাদেরকে স্বপ্নের আনএক্সপ্লেইনেবল জগতে নিয়ে গিয়ে জ্যাকসন পলোকের মাথা খারাপ রঙের ভিতর দিয়ে, গিরিজা দেবীর খনখনা গলার গানের ভিতর দিয়ে, শেলির উইচ অভ এ্যাটলাসের আজগুবি কবিতার ভিতর দিয়ে, স্বপ্নে মেঘনাদবদকাব্য আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভিতর দিয়ে এক জ্ঞান এক ঈশ্বর হওয়ার চেষ্টা করে?
জ্ঞানের দ্বাররক্ষক হেকেটি কি তাই চাবি নিয়ে আমাকে ডাকেন? আমাদের সবাইকেই কি তিনি ডাকেন?
ছবি: ইন্টারনেট ও গ্রাফিক্স
লেখক পরিচিতি:
নাদিয়া ইসলাম
লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে। প্রকাশিতব্য উপন্যাস ‘রকি রোড সানডে’। ফেসবুকে একইসঙ্গে প্রবল জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত নারীবাদী মুখ।
ভালো লেখা
nice write up
সুখপাঠ্য। ধন্যবাদ প্রিয় নাদিয়া।
নাদিয়া’র লেখা পড়া সবসময় আনন্দের। কারনটা হচ্ছে তাঁর কোন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার সক্ষমতা। এই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি যেভাবে ইস্ট কিংবা ওয়েস্টের দর্শনকে রেফারেন্স হিসেবে টানেন, তা ব্যাক্তিগত ভাবে আমাকে প্রলুব্ধ করে সেই দর্শনগুলা পড়ার কিংবা পুনরায় পড়ার।
ভালো থাকুন থাকুন নাদিয়া।