।। অর্ণব সাহা ।।
১
তোমার স্তন, তোমার নাভি, জঙ্ঘা ও যোনিদেশ
তোমার স্নায়ু, কানের লতি, কোমরের খাঁজ
ঊরুতে গভীর ট্যাটু, যৌন-চুলে ছাঁটা হার্টসাইন
এখনও শেষরাতের আচ্ছন্ন ঘুম নষ্ট করে
কাত হয়ে শুয়ে রয়েছ। তোমার বিস্ফারিত পাছা
বিস্মৃতির তলদেশ খুঁজে দেখতে বলে। আমি সেই
কুয়োর অসম্ভব নীচে জ্যান্ত শোল মাছ দেখতে পাই
ওর তলায় কাদাজল। আত্মার জীবাশ্ম লিখে-রাখা
কতো দ্রাঘিমাংশে ওই জাহাজ ডুবেছিল ?
শত ডুবুরির চিৎকারে লবণাক্ত সামুদ্রিক জল
থিতিয়ে আছে। ওইখানে, লোহালক্করের ভাঙা স্তূপে
একজন মৃত শিল্পী তোমার ন্যাংটো শরীর আজও
এঁকে যায়
২
গুহার ভিতরে এক রমণীর খোলা চুল শচীশের মুখে
পড়েছিল !
রোমশ জন্তু, যাকে অন্য কোনও ডাকনামে
সম্বোধনের কথা ভাবেওনি কেউ। তার ছায়া
হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে গ্রহণের সংকেত
দিয়ে যায়…
অলৌকিক ছোঁয়া পেয়ে পুরুষের শিশ্ন জেগে ওঠে
ওদের বাগানে পাখি গান গায়। আরও বিপন্নতা
নাবিকসমেত ওই স্টিমারের ভবিষ্যৎ কিনারগামী করে!
কালক্রম মেনে চাঁদ ডুবে যায়। চরাচরে ভরাকোটাল
হয়…
৩
এই পথ বারণাবতের। আটমাসের নির্বাসনে পাঠিয়ে আমার
সংকুচিত আত্মাকে খাঁচাবন্দী করেছে শিকারি!
বুকের মধ্যে দোল খায় একজোড়া কচি নরম হাত
যাকে সেই গতজন্মে ছেড়ে এসেছিলাম আমি…
অশ্রু এক অপার্থিব আখ্যান। সেই ভোরবেলায়
দুই বন্ধু পথের মোড়ে ধাক্কা খেয়ে ভিন্ন হয়ে গেল।
হাঁড়ি আলাদা হয় একান্নবর্তী পরিবারের
একজন সাঁতার কাটে। বাকিরা তলিয়ে যেতে শেখে।
এইভাবে কবিতা হবে না। বুনুয়েলের ‘অবস্কিওর
অবজেক্ট অফ ডিজায়ার’ ছবির মতো হাতফেরত
সারিবদ্ধ আঁতেলদের আড্ডায়, ওহে, কেউ
পিঠ চাপড়ে দিলেই ভেবো না কবিতা হচ্ছে !
কবিতা আসলে মুঘল জাফরির মতো। ভিতরে
সচ্ছন্দ আলোবাতাস খেলে…
৪
ভাবো, এক বিরতিহীন ঘুম ও স্বপ্নের তেপান্তর
মঠের জানলা দিয়ে দেখা যায় পরিব্রাজক লামা
ঝোলায় পাথেয় আর কবেকার গুপ্ত-ছিন্ন পুঁথি
ইতিহাসের পাতা থেকে ডেকে ওঠা বন্য টিট্টিভ
রক্তের উপত্যকায় হন্যে হয়ে মৃতদেহ খুঁজছে ক্লান্ত
শকুনেরা
ভাঙাচোরা পৃথিবী এক অলীক ভাগাড়
সন্ধে নামার আগে যখন স্ট্রিটল্যাম্প জ্বলে ওঠে
শান্ত প্রচ্ছায়া। আমি গতজন্ম থেকে হেঁটে এসে
রাস্তার মোড়ে দাঁড়াই। জীবনবীমার আলো
পঞ্চপ্রদীপের মতো শহরের ঢাল বেয়ে নামে !
কয়েকশ’ বামন সেই আধো-অন্ধকারে হেঁটে যায়…
৫
অন্যের প্রেমিকা। সঙ্গে ১৪ ফেব্রুয়ারির দুপুর
কাটিয়েছি। বালিহাঁস জলাশয় থেকে উড়ে গিয়ে
মেঘের শরীরে এঁকে দিয়েছে চিত্রার্পিত ডানা।
কবরখানার ভাঙা পাথরে অতর্কিত ফুল
বলেছে—“নিষ্ঠুর হও। আরও স্বৈরাচারী হতে শেখো…”
বিবিধ ভারতী শুনে ভুলে যাওয়া মেদুর রাগিনী
অযথা স্বপ্নদৃশ্য এঁকে দেয়। ভরসন্ধেবেলা
যেন কার বুনো চুল মুখের উপরে ঝরে পড়ে…
পুড়ে-যাওয়া সিগারেট। অমীমাংসিত গল্পগুলো
একজোড়া তেতো ঠোঁটে স্বাদবিভ্রমের খোঁজ দেয়।
আজ সে কোথায়? তার ভরাট দু’বুকে
নীল যন্ত্রণার তাজা চিহ্ন দেখে আলো নিভে যা!
অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদের ছবি: শোয়েতাভ সুমন (Shwetabh Suman)
অর্ণব সাহা
কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গেনব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি। পেশায় অধ্যাপক। তাঁর কয়েকটি বিশিষ্ট কবিতার বই : ধর্ম নেই কোকাকোলা নেই, ব্ল্যাকহোলের বাকি অংশ, প্যারানইয়া, ২০ জুনের ডায়েরি, নিচু গিলোটিন, নীল রঙের হাভেলি, স্বপ্নের কশেরুকা। অর্ণব বাংলাভাষার সেই বিরল কবিদের একজন যিনি মনে করেন, অক্ষরমাত্রই রাজনৈতিক।