।। জ্যোতি পোদ্দার ।।
বসন্তের চেয়ে বর্ষার বন অনন্য। ভেজা ভেজা মাটি— লাল অথবা কালচে কাঁকর মেশানো বালি মাটি জল ধরে ধরে বাঁকা রেখা বেয়ে জমানো বালির ঢিপির চারদিকে নিজেকে হারিয়ে ফেলে চিরতরে। অথবা কোনো খানাখন্দে— পথিকের পায়ের ভারে বৃত্তীয় গোড়ালির খানাখন্দে জল জমে জমে উপচে পড়ে— আর সেখানেই মস্ত আকাশ উপুড় হয়ে নিজেকে ছোট্ট করে দেখে আর বৃষ্টি ধোয়া গাছে সাদা সাদা রোদের ঝিলিক চিক চিক করে ওঠে তখন।
শ্রাবণের বর্ষায় শাল গজারি চুঁয়ে চুঁয়ে জল পড়ছে টুপটাপ। নতুন বর্ষার জলে চারদিকে সবুজ আর সবুজ আর সবুজের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে চোখ ধাঁধানো জলে ভেজা চিকচিক সবুজ— আজ সবুজের মহোৎসব। পায়ে পায়ে আঙুল সমান হলুদ রঙের ছোট্ট পাতা মেলে গজিয়ে উঠছে শালের চারা। সারা পাহাড় জুড়ে শাল চারার রাজত্ব— পায়ে পায়ে ঠেকে। পায়ের পাঞ্জার চাপে চিড়ে চেপ্টা হয়েও পরক্ষণেই বালি মেশানো ছোট্ট শরীর নিয়ে ঘাড় কাৎ করে উঠে দাঁড়ায় শাল চারা।
বৃষ্টি ভেজা সবুজ আর কচি হলুদ পাতার কোরাসে এই সময়ের রাংটিয়া সলাজ নতুন বৌয়ের কোমল মুখের মতো মেলে ধরে নিজেকে।কেমন যেন মাখনের মতো নরম নরম মোলায়েম। আলতো করে ছুঁয়ে দিলেই শিহরণ দিয়ে কেঁপে ওঠে শরীর। কোন মানবীর প্রথম স্পর্শের মতো তরঙ্গ খেলে যায় দেহে থেকে দেহে; মন থেকে মনে— আর তখনই দেহের সীমানা ভেঙে ভেঙে মিশে যায় অভেদে।
বসন্তের চেয়ে বর্ষার বন অনন্য। ভেজা ভেজা মাটি— লাল অথবা কালচে কাঁকর মেশানো বালি মাটি জল ধরে ধরে বাঁকা রেখা বেয়ে জমানো বালির ঢিপির চারদিকে নিজেকে হারিয়ে ফেলে চিরতরে। অথবা কোনো খানাখন্দে— পথিকের পায়ের ভারে বৃত্তীয় গোড়ালির খানাখন্দে জল জমে জমে উপচে পড়ে— আর সেখানেই মস্ত আকাশ উপুড় হয়ে নিজেকে ছোট্ট করে দেখে আর বৃষ্টি ধোয়া গাছে সাদা সাদা রোদের ঝিলিক চিক চিক করে ওঠে তখন।
অর্নগল কথা বলা কিশোরীর যেমন দুই ঠোঁট মেলাবার অবসর পায় না তেমন ঝির ঝিরে বাতাসের আলতো ছোঁয়ায় কুর্চি ফুল কিংবা বিস্তারক ফুলের পাতাগুলো নড়তেই থাকে নড়তেই থাকে— ছন্দে ছন্দে ধীর লয়ের মাত্রাবৃত্তে। বৃষ্টি আর রোদের হল্কায়। কী যে ভালো লেগে দেখেতে!
বসন্তে কুর্চির নৃত্য আবার গড়গড়িয়ে পড়ে— স্বরবৃত্তে; বাক্য শেষে অপূর্ণ পদ না থাকার কারণের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে পাশের ডালে। তখন স্থীর থাকবার অবসর পায় না।গতিতেই বাঁধে জীবনের সাকল্য। কালবৈশাখে ঝড়ের তাণ্ডবে সেখানে আর কোন ছন্দ থাকে না। ভেঙে খানখান কুর্চির নরম ডাল।তখন থাকে শুধু দক্ষযজ্ঞের তাণ্ডব। চারদিকে শতছিন্ন নরম নরম ডাল পাতা আর না ফোঁটা ফুলের গড়াগড়ি। আমার ভাললাগে না। বর্ষার বন অনন্য। জলসবুজহলুদের বন তখন রাসমেলা। গোপিনীরা ছলকে ছলকে ওঠে।
নন্দ ভিটার উঁচু টঙ ঘরে বসে বসে দেখছিলাম বাতাস আর বৃষ্টির ভেতর পাতাদের ক্রীড়া। প্রত্যেক ক্রিয়াই মূলত এক একটি ক্রীড়া। বহু বৃত্তীয় খেলার লীলায়ন। এই খেলাটা না থাকলেই বোঝা খুব ভারী হয়ে ওঠে। সোজা হয়ে দাঁড়াবার শিরদাঁড়া ধনুকের ছিলার মতো বেঁকে যায় দায়ের বোঝা পিঠে নিয়ে দায়িত্বের মাঝে।সেটাই বহন করতে করতে আনন্দ ক্রিয়াটির আর দেখা মেলে না। যেন এখন এবং এখানে নয়— অন্য কোথাও অন্য কারো সাথে।
টঙঘরে আমাকে ফেলেই যে দশের দলের সাথে আমি এসেছিলাম তারা আরেকটু ভেতরে গেছে ক্যামেরা নিয়ে পাখিকে স্থীর চিত্রে ধরে রাখার জন্য। প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে পাখির শরীরও ঈষৎ পাল্টে যায়। পাখির গর্ভধারনের সময়ে পাখির যে আকার আকৃতি বা রঙের যে পরিবর্তন ঘটে তার ইত্যাকার ইতিবৃত্ত ধরে রাখে এই বার্ড সোসাইটির পাখিবন্ধুরা। পাখির দিনে দিনে বেড়ে উঠার সময়টা ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা তাদের।
কী ক্লান্তিহীন ধৈর্য্য নিয়ে এই তল্লাটের পাখিন সন্ধানে নেমেছে তারা। একা একা টঙঘরে বসে বসে এই সব ভাবতে ভাবতেই ঝুমঝুমে বৃষ্টি এলো পাহাড় জুড়ে। অাকাশ ভেঙে ঝরঝরে ঠাডা পড়ে পড়ে ঝরঝরে বৃষ্টি নামল এই উন্মুক্ত চাতালে। পাহাড়ের বৃষ্টি নগরে দেখা বৃষ্টির পার্থক্য যোজন যোজন। খোলা প্রান্তরে তেচরা তেচরা হয়ে বৃষ্টি আর বৃষ্টির সাথে বৃষ্টির ভেতর সো শো সো শব্দের মাদকতা আমাকে উন্মুখ করে তুলে। শ্রাবণের জল জমি জঙ্গলের পাহাড় অন্য রকম অন্য অনুভবে।
পাহাড়ে বর্ষার আরেকটা প্রধান অনুষঙ্গ জোঁক। চীনে জোঁক। রবারের মতো সঙ্কুচিত হয়ে পলকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে শরীরে। বাহ্য পরজীবী প্রানীর বেড়ে উঠা এই শ্রাবণের বর্ষায় স্যাতসেতে পচে যাওয়া লতাগুল্ম ভেতর সদ্য বেড়ে উঠে ঘাসের পাতায় পাতায়। নতুন আর পুরাতন মজে যাওয়া পাতার মিশ্রণে যে গন্ধ ছেয়ে থাকে গাড়ো পাহাড়ের টিলায় টিলায় তার কোনো বর্ণ আমি লিখতে পারিনি। এক অনুচ্চারিত গন্ধ শুধু নাকে লেগে থাকে।
ভাদ্রের রোদ আর বাতাস এই চীন জোঁককে উন্মাদ করে তুলে।আর তখন মানুষ বা পশুর শরীরের গন্ধ পেলেই হামলে পড়ে রক্ত শুষে খায়। রক্ত খেতে খেতে যখন সে পেট মোটা গনেশ হয়ে পড়ে তখন সে শরীরের চমড়া থেকে খসে পড়ে নিজেরই শরীরের ভারে। চামড়ায় থেকে যায় লাল ক্ষতের গর্ত। আমার মতো যারা ডায়াবেটিকস শরীর নিয়ে জল জঙ্গলে চলে তাদের মস্ত অসুবিধা। ক্ষত সহজে শুকাতে চায় না। তাই একটু আষাঢ়ে-শ্রাবণ-ভাদ্রে পাহাড়ে একটা সামলে চলে হয়।
চীনে জোঁকের ভয়ে তো আর পাহাড় দর্শন মূলতবী রাখা যায় না! চীনে জোঁক শরীরে হামলে পড়লে গা ঘিনঘিন করে ওঠে। ভয়টা মাথায় ভেতর ঢুকে গেলে মুশকিল বাড়ে দ্বিগুণ। পা আর চলে না লাফানোই তখন হাঁটা। আমার হয়েছে তেমনি। লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটা। জোঁকে আমার ভয় কুট্টিকাল থেকে।ছোটবেলা কালো কালো জোঁকের শরীর মুঠোভর্তি ফ্যাকাশে খাবার লবণ ছিটিয়ে দিতে দিতে দেখতাম রবারের মতো শরীর প্রসারিত করে করে নিমিষেই কুণ্ডলি পাঁকিয়ে চিটপটাং হয়ে পড়ে আছে পুকুর পাড়ে। বাড়ির পেছন যে জলাশয় ছিল তাকে পুকুর না বরে ডোবা বলাই ভালো। কচুরিপানার ছাওনি দেয়া জল। যার যার ঘাটের কাছে তাড়ায় দিয়ে আটকে রেখেছে কচুরির ঘাট দখলের জোর চেষ্টা। সেখানেই ছিল গাদা গাদা জোঁক।
বর্ষার অল্প জলে চীনে জোঁকের বেশ বাড় বাড়ন্ত। চারা গাছ সরিয়ে সরিয়ে পথ তৈরি একটু কষ্টই বটে। হাঁটতে গেলেই জোঁক।চীনে জোঁক। শরীরে হামলে পড়ে আটকে থাকে। বুঝবার অবকাশ নেই।সন্তপর্ণে রক্ত চুষতে থাকে আর চুষতে থাকে। ছোট্ট নালার মতো যে ঢাল নিচের দিকে নেমে গেছে সোজাসোজা নাক বরাবর।সেখানেই জোঁক হামলে পড়ল হাতের কব্জিতে পায়ের গোড়ালিতে। পান্টের এখানে সেখানে। সরু ঢালু পিচ্ছিল পথ। লতা গুল্ম আর শালের চারা দাপটে প্রশস্ত পায়ে চলা পথটি সরু হয়ে গেছে। একজন একজন করে পার হতে হয়। দশের দলের মাঝখানে আমি একজনের পেছনে একজন করেই নামছিলাম ঢালু পথটি।
আর তখনই আক্রমণ। ভীতুকে আক্রমণ। ডান হাতের কব্জির নীচে,পায়ের গোড়ালিতে আর ক্যামোফ্লেজ রঙের শার্টে পিঠের দিকে শুঁড় বের করে করে কাপড় উপর খুঁজছে চরামড়া। নাজমুল মিয়া আমাদেরই চলার সঙ্গী। তার রিক্সায় আমাদের আসা যাওয়া করতে করতে সেও চিনেছে পাখ পাখালি নাম রঙ ও প্রকৃতি। সেই আমাকে বাঁচালো। তিনি হাতের দুই আঙুলে থুতু ভরিয়ে জোঁকের মুখের চোষক অংশের শুড় একেক করে ধরছেন আর ভেঙে ভেঙে ফেলে দিচ্ছেন মাটিতে।
তবু মন থেকে পড়ছে না। বারবার ঘুরে ফিরে দেখছি আর লাফিয়ে লাফিয়ে চলছি। সুজয় শহীদ টিটু দেবু ‘ দারা নির্বিকার। চলছে ফিরছে। এই স্যাতসেতে ভেজা মাটিতে নিশ্চন্তে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করে আছে গাছের মগলালে। পাতার আড়াল কী যেন একটা পাখির লেজ নড়ছে। তার স্থীরচিত্র ধরে রাখার জন্য তারা ক্যামারা যার যার পজিশনে রণাঙ্গনে প্রস্তুত।তাদের কোন জোঁকের ভয় নেই? এক চক্ষু মুদে ক্যামেরায় রেখে দিয়েছে আরেক চোখ। আমি কিছুটা দূরে। টিলার মতো স্তপে দাঁড়িয়ে বারবার লাফিয়ে ঝেড়ে ফেলবার চেষরটা করে যাচ্ছে। যেন এখন কোথায় জোঁক বসে আছে।
অথচ ওদের কোনো, ভয় নেই। জোঁকের ডিব্বায় দাঁড়িয়ে থেকে ক্যামেরা তাক করে আছে। মনে ভাবলাম ওদের কোনো জোঁকের ভয় নেই?বন বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে ওরা কী মন্ত্রতন্ত্র দিয়ে রবারের মতো চীনে জোঁকের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে? যে কিনা মানুষের শরীরের গন্ধ পেলেই রবারের মতো সঙ্কুচিত হয়ে লাফিয়ে পড়ে শরীরে? কী জানি কি তার রহস্য? তাদের কাউকেই জোঁক ধরল না? তবে গোপন আর থাকলো। সঙ্গ দোষে ঘুরতে ঘুরতে জানা গেলো কী তার রহস্য।
রহস্য আর কিছুই না। সারা শরীরে গুলের পাউডার মেখে নিয়েছে বলে নিশ্চিন্তে ক্যামেরা তাক করে ক্লিক দেবার জন্যই তাড়া। যে তামাক পাতা চূর্ণ করে গুল তৈরি করা হয় দাঁত মাজনের জন্য। এক সময় গ্রাম বাঙালায় গুলের প্রচলন ছিল ব্যাপক। এখনো সে চল ওঠে যায়নি। সেই গুলো পাওডার মেখে নিলে চীনা জোঁক আর আক্রমণ করার ফুসরত পায় না। শরীরে হামলে পড়রেও তামাকের উৎকট গন্ধে নিজেই শরীর থেকে আছড়ে পড়ে মাটিতে।
সুজয়েরা বন বাদাড়ের নিত্য অধিবাসী। ওরা বনবাসীর মতো পাহাড়ের বীজগনিত পাটিগণিত বুঝে গেছে। কোন সিজনে নিজেকে বনের সাথে কিভাবে অভিযোজিত হতে হবে তার সূত্র তাদের করায়াত্ত। পাখি হোক বা হোক চীনা জোঁকের মতো প্রাণী প্রত্যেকের স্থানিকতাকে নিশ্চিত করার তৎপরতা নিয়েই সুজয়দের কনজারভেশন সোসাইটি।
জ্যোতি পোদ্দার
জন্ম ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নয়ের দশকের কবি। বাসস্থান বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতা বাড়ি। পেশা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। প্রকাশিতকাব্যগ্রন্থ: ‘(a+b)2 উঠোনে মৃত প্রদীপ’ (১৯৯৭), ‘সীতা সংহিতা’ (১৯৯৯),
‘রিমিক্স মৌয়ালের শব্দঠোঁট’ (২০০২), ‘ইচ্ছে ডানার গেরুয়া বসন’ (২০১১), ‘করাতি আমাকে খুঁজছে’ (২০১৭) এবং ‘দুই পৃথিবীর গ্যালারি’ (২০১৯)।
ShareShare
খুব আনন্দ নিয়ে পড়লাম লেখাটা। কোন কোন সময় মনে হচ্ছিল, লেখকের চোখ-মন-শরীর যেন আমার হয়ে গেছে। প্রতিটি শব্দ, লাইন, বর্ণনার ভঙ্গি অদ্ভুত হৃদয়ছোঁয়া।