।। অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।
চিত্রাঙ্কন: শুভাশীষ ঘোষ
পৌঁছে মনে হয়েছিলো জীবনে কত মেলা খেলায় ঘুরলাম এও এক অমৃত কুম্ভের সন্ধান। সোনাঝুড়ির হাট দেখে ‘দেখি মিলন মহান’ টাইপ ধরো ধরো মরি মরি অবস্থা আমার নয়। অর্ধ-পূর্ণ মিলিয়ে কুম্ভই গোটা চার, শোনপুর থেকে পাথরচাপুরি- মেলায় মোচ্ছবে আমি থাকি। অন্ধ্রে মাওবাদীরা যখন সরকারের সাথে আলোচনায় এলো ওয়ারেঙল-এ মেলা বসেছিলো প্রকাশ্য সমাবেশে,পৌঁছে গেছিলাম। কিন্তু সিঙ্ঘুতে বত্রিশ সংগঠনের জোটের আন্দোলনের মূলমঞ্চ থেকে আওয়াজ উঠছে তেগ বাহাদুরের নামে, দু হাত তুলে ধ্বনি দিচ্ছেন যে অমৃতধারী দস্তার কৃপাল, তাদের বুকে ঝুলছে ভগৎ সিংহের ছবি। ”বিবিধের মাঝে” এমন ছবি সত্যি দেখিনি।
‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’ সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষ-সহাবস্থান বিষয়ে গবেষণার কাজে দিল্লির সিঙ্ঘু সীমান্তে চলমান কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিতাভ সেনগুপ্ত। সেখানে রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে কৃষকদের বলতে শুনলেন, ‘হয় কৃষি আইন বাতিল করো, নয়তো সেনা নামিয়ে আমাদের উঠিয়ে যাও’! দিল্লি থেকে ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকায় লিখে ফেললেন নিজের অভিজ্ঞতা। অমিতাভের এই লেখার সঙ্গে যুক্ত হলো পশ্চিমবঙ্গের তরুণ চিত্রকর শুভাশীষ ঘোষের আঁকা দুইটি ছবি। ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে যে কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ক্রমে তা জমি অধিগ্রহণ বিরোধী ও এসইজড বিরোধী আন্দোলন হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে নন্দীগ্রাম, লালগড়-সহ নানাপ্রান্তে। সিঙ্গুরের কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ছবি এঁকেছিলেন শুভাশীষ। সেই ছবি আজ ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে দিল্লির সিঙ্ঘু সীমান্তের কৃষক আন্দোলনে। বাংলার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম মিশে গেছে দিল্লির সিঙ্ঘুর সীমান্তে।
‘হয় কৃষি আইন বাতিল করো,
নয়তো সেনা নামিয়ে আমাদের উঠিয়ে যাও’
শুনে এলাম সিঙ্ঘু সীমান্ত থেকে
আজ ৪৪ দিনে পা দিয়েছে কৃষক আন্দোলন।এত দিনে সবাই জানে ২০২০র ১৪ই সেপ্টেম্বর ৩টে কৃষি বিল আনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন সরকার। তারপর কোনও সংসদীয় পদ্ধতি ফেডারেল নীতির তোয়াক্কা না করে বিল পাসও করায়।ঐ বিলে যা বলছে, এতদিন দিয়েছে কিন্তু,ফসলের উপর নূন্যতম আর চাষিদের দেবেনা সরকার। ফসলকে অত্যাবশ্যক পণ্যের আওতা থেকে সরানো হয়েছে। কৃষি বাণিজ্যে বেসরকারী অংশীদারিত্ব বাড়ানোয় জোর দিয়ে কৃষক ‘মাণ্ডি’গুলোকে নিষ্ক্রিয় করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। মজুতদারী নিয়ন্ত্রণ থেকে ভবিষ্যতে হাত ঝেড়ে ফেলার কথাই নতুন কৃষি আইন বলছে, অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা। তাই বিলের বিরুদ্ধে দিল্লী সীমান্ত অবরোধ করেছেন কৃষকরা। দিল্লীতে পা দিয়ে দেখেছিলাম এবিভিপি ক্যাম্প করে পথ চলতি মানুষকে শেখাচ্ছে নমো অ্যাপে কিভাবে ভলান্টিয়ার মডিউল এ গিয়ে কৃষি বিলের উপকারিতা জানবেন। পঞ্জাবের বিজেপি নেতারা অভিযোগ তুলছিলেন পাঞ্জাব পুলিশ সরকারের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের কর্মীরা লঙ্গর-এ বসে আন্দোলনকারী সঙ্গে খাওয়া বসা করছেন। ট্যুইটারে আন্দোলনকারী কৃষকদের সম্পর্কে কঙ্গনা রানাওয়াত এর কটূক্তির জবাব দিচ্ছিলেন পাঞ্জাবি ফিল্মের জনপ্রিয় নায়ক দিলজিত দোসানু।
‘ওয়াহে গুরুজী কা খালসা ওয়াহে ফতেহ।’ ৪৭ আমাদের অর্ধেক খেয়ে নিয়েছে ৮৪ সালে আরও অর্ধেক ‘। এটা মাচিস ছবির ডায়লগ ওমপুরী-র মুখে, শুনিয়ে দিলেন অটোয় বসে পাশের মানুষটি।
নয়া দিল্লী স্টেশন থেকে ইয়োলো লাইন মেট্রো ধরে সময়পুর বদলী নেমে অটো ধরেছিলাম।নেমে একটা অটোয় সিঁঘু বর্ডার। অটোয় সহযাত্রীরাও চলেছেন কলকাতা থেকে এসেছি জেনে খানিকটা ওরিয়েন্টেশন দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পৌঁছে মনে হয়েছিলো জীবনে কত মেলা খেলায় ঘুরলাম এও এক অমৃত কুম্ভের সন্ধান। সোনাঝুড়ির হাট দেখে ‘দেখি মিলন মহান’ টাইপ ধরো ধরো মরি মরি অবস্থা আমার নয়। অর্ধ-পূর্ণ মিলিয়ে কুম্ভই গোটা চার, শোনপুর থেকে পাথরচাপুরি- মেলায় মোচ্ছবে আমি থাকি। অন্ধ্রে মাওবাদীরা যখন সরকারের সাথে আলোচনায় এলো ওয়ারেঙল-এ মেলা বসেছিলো প্রকাশ্য সমাবেশে,পৌঁছে গেছিলাম। কিন্তু সিঙ্ঘু-তে বত্রিশ সংগঠনের জোটের আন্দোলনের মূলমঞ্চ থেকে আওয়াজ উঠছে তেগ বাহাদুরের নামে, দু’হাত তুলে ধ্বনি দিচ্ছেন যে অমৃতধারী দস্তার কৃপাল, তাঁদের বুকে ঝুলছে ভগৎ সিংহের ছবি, ‘বিবিধের মাঝে’ এমন ছবি সত্যি দেখিনি। মেজর কবাডি লীগ আর শিখ রিলিফের চালানো লঙ্গরের পংক্তিতে দাঁড়িয়ে প্রসাদ নিচ্ছিলাম পালক সবজি আর পরোটা। পাশে দাঁড়িয়ে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ফেডারেশন-এর জেনারেল সেক্রেটারী ভিকি মহেশ বললেন, ‘সন্ধ্যেবেলা আছো? আদানি আম্বানি মোদীর কুশ পুতুল পোড়াবে গোটা পাঞ্জাব-হরিয়ানা।’
মাইল মাইল হেঁটে আসা বয়স্কদের ক্লান্ত পা মালিশ করে দিচ্ছে যুবকেরা। ভোর ভোর উঠে সবার স্নানের জল গরম করে দিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষ। মূর্ত হছে কৃষির মানসিকতা, কৃষি সংস্কৃতি। বাজার সংস্কৃতি যাকে ‘প্রাক আধুনিক পশ্চাদপদ’ বলে চেনাতে চায়। মূল মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে সিপিআই -এর রাজ্যসভা এমপি বিনয় ভিস্বাম বললেন, ‘পার্টির লোক হিসেবে নয় আমি এখানে কৃষক মঞ্চের লোক।পার্টির লোককে ওরা মঞ্চে উঠতে দিচ্ছে না।’ ধর্মীয় ব্যানারের এনজিও খালসাএইড, অমরপ্রীত সিং এশিয়ান চ্যাপ্টারের দ্বায়িত্বে,ভুল শুধরে দিলেন, ‘আমরা কৃষক সংগঠন নই। কিন্তু সিঙ্ঘুতে দেড়লাখ কৃষকদের জন্য ২৮শে নভেম্বর, প্রথম দিন থেকে পড়ে আছে আমাদের ভলান্টিয়াররা। টুথপেস্ট থেকে মাস্ক যুগিয়ে চলেছি।’ ওদেরই ব্যবস্থায় সারি দিয়ে পাতা তাঁবুতে রাত কাটালাম। অন্তর্বাস থেকে কম্বল- সবই পৌঁছে দিচ্ছেন কেউনা কেউ। অভিযোগ শুনলাম বিদেশ থেকে খালসা এইড-এর ফান্ড আসা আটকাতে চাইছে এবার সরকার। ‘লোক ইনসাফ ভালাই পার্টি’র শীর্ষ নেতা বলদেব সিংহ সিরশা সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন আন্দোলনের প্রাঙ্গনে বা মেলার মাঠে। অনেক রাতে। বললেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকরা রাত পাহারা দিচ্ছে। তোমাদের চেনেনা তাই অসুবিধায় পড়বে। আমি সঙ্গে যাবো তোমাদের। রোজ পয়সা দিয়ে কিছু লুম্পেন ঢোকাচ্ছে সরকার। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ আর ‘টুকরা টুকরা’ স্লোগান দিতে। আমরা সতর্ক আছি। অমিত শাহের এই খেলাটা আমরা চিনি। পঞ্জাবে ‘রেল রোখ’ দিয়ে শুরু করেছিলাম আমরা। সি এম আমরিন্দার বললো আলোচনায় বসবে, আমরা সদর্থক মানসিকতা নিয়ে তুলে নিলাম রেল রোখ। তারপর ছ’দফা আলোচনা হলো, স্রেফ আন্দোলন ভাঙতে সময় চুরি করে চলেছে।’ কিষান সভার অফিসে দেখা করলাম হান্নান মোল্লার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমি এতো সুশৃঙ্খল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দেখিনি। জলকামান ছুঁড়েছে, লাঠি চালিয়েছে, ভুয়ো মামলায় গ্রেফতার করছে তাও কৃষকরা পাল্টা হিংসার পথ নিচ্ছে না। সরকার আলোচনায় ডাকছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে, এবং মিটিংয়ে কোনও পূর্বঘোষিত এজেন্ডা নেই, এটাকি ইয়ার্কি হচ্ছে? ‘অল ইন্ডিয়া কিষান কোঅর্ডিনেশন কমিটি (AIKCC)-র ভি এম সিং অভিযোগ করলেন , ‘আলোচনার নামে ‘তারিখ পে তারিখ তারিখ পে তারিখ’-এর খেলা শুরু করেছে সরকার, বাজিয়ে দেখতে চাইছে কিষানের দম।’
তেভাগা নকশালবাড়ি দেখেছে বাংলা, লিগ্যাসি নিয়ে প্রচ্ছন্ন বুক ফুলে থাকা আমাদের থাকেই, আর থাকে বাম রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে অন্যকে বাঁকা চোখে দেখা! যা চলছে তার রাজনৈতিক দিশা কী? মাণ্ডি মালিক আর মধ্যস্বত্বভোগীদের আন্দোলনে প্রান্তিক চাষীর জায়গা কোথায়? এমন নানা প্রশ্ন মনে, ঠেঠ পাঞ্জাবী কানে নিয়ে কথা এগোতে পারছি না। বাংলা থেকে এসেছি শুনে গুরদাসপুরের প্রান্তিক চাষী মেলার মাঠে চওড়া থাবায় আমার কাঁধ জড়িয়ে সেলফি তুললেন আর বললেন ‘হ্যাঁ আদানি আম্বানির বিরুদ্ধে আমাদের চালিয়ে যাওয়ার টাকাও আছে, লোকবলও আছে। বাংলায় গিয়ে বলো এশুধু আড়তিয়া ফড়েদের আন্দোলন হলে আমরা এসে রাজপথে বসে থাকতামনা একমাস। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান তেলেঙ্গানার চাষীরা রোজ এসে জুড়ছে, বাংলাকেও বুঝতে হবে।’
চাষির হকের লড়াই পাঞ্জাবি অস্মিতাকেও জড়িয়ে নিয়েছে। কীসের এমেন্ডমেন্ট নরেন্দ্র সিং তোমর? মোদী সরকারকে বাতিল করতে হবে কৃষি আইন, হয় ‘হ্যাঁ’ নয় ‘না’-বলো? এতেই দাঁড়িয়ে এখনো সিঁঘু-গাজীপুর-টিকরি-শাহজানপুর। ফিরে আসার সময় দেখলাম দাবাং ছবির ভিলেন চরিত্রাভিনেতা সোনু সুদ কম্বল আর উলের মোজা ভর্তিকয়েকটা ট্রাক্টর নিয়ে হেটেঁ আসছিলেন সিঁঘু বর্ডারে। দিল্লি ছেড়ে আসার সময় শুনলাম হরিয়ানার পুরভোটগুলোতে ব্যাপকভাবে হারতে শুরু করেছে বিজেপি। দিল্লী হরিয়ানাতে জিও টাওয়ার উপড়ে ফেলে দিচ্ছেন কৃষকরা। অন্ততঃ ৫০ জন কৃষক প্রবল শীতে বা অন্যান্য অসুখে প্রাণ হারিয়েছেন দিল্লীর বিভিন্ন সীমান্তে অবস্থানরত অবস্থায়। শিয়ালদহ এসি স্পেশাল-এ অনেক কষ্টে ফেরার তৎকাল টিকিট জোগাড় করে শুনলাম এক বন্ধু হাঁটতে শুরু করেছে দিল্লীর দিকে। ‘বিপ্লব হলো জনতার মহোৎসব’ টহোৎসব আমি অবশ্যই লিখে ফেলেছি নিজের ওয়ালে কিন্তু জিও সিম ছেড়ে ফেঁড়ে দেওয়া বা ফরচুনের তেল হেঁসেলে ঢুকতে দোবো না জাতীয় ইনফ্যান্টাইল খিল্যতা করে ফেলছিনা নিশ্চয়ই, বরং তলিয়ে ভাবছি, আমি-আমরা আবার খুব ভাবা প্র্যাক্টিস করে এগোই কিনা, সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ-এ কৃষক বিদ্রোহের প্রশ্নে রণজিত গুহর সাথে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ডিবেটটা, ওটা ভাবছি এখন।
…চাষীরাতো বছর বললেনই এক বছরের রসদ নিয়ে এসে বসেছেন। আমার পলিটিক্যালি কারেক্ট অবস্থান নিতে পারার জন্য ওরা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবেন!!!
ফটোগ্রাফি: অমিতাভ সেনগুপ্ত
অনবদ্য লেখা। অনবদ্য।