আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

লালন: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়

।। ফরহাদ মজহার।।

এক

ফকির লালন শাহ তিরোধান করেছিলেন পহেলা কার্তিকে: বাংলা বছর ১২৯৭ আর ইংরেজি ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর। তিনি ঠিক কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যে লোকপ্রিয় তথ্য প্রচারিত সেটা হোল তিনি ১১৬ বছর বেঁচেছিলেন। এ নিয়ে পণ্ডিত মহলে কোন আপত্তি চোখে পড়ে নি। ফলে তিনি ১১৬ বছর বেঁচেছিলেন এই তথ্য কমবেশি প্রতিষ্ঠিত। সেই হিশাবে বলা হয় তাঁর জন্ম সাল ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দ; বাংলা ১১৮১ সাল। 

নবদ্বীপ বা নদীয়ায় শ্রীচৈতন্য জন্মেছিলেন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৮৬ ঈসায়ী সালে। তাঁর তিরোধান ঘটেছিল ১৪ জুন ১৪৩৪ সালে। তাহলে ফকির লালন শাহের আবির্ভাব ঘটেছিল চৈতন্যের তিরোধানের প্রায় ৩৪০ বছর পর। সম্প্রতিকালে আগ্রহ বাড়লেও ইতিহাসের এই কালপর্ব নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে।

কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার বাস করতেন মতিজান এবং তাঁর স্বামী মলম শাহ। বালক বয়সী লালনকে কালিগঙ্গার নদীর তীরে কাদাজলে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মলম পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি ভোরবেলা ফজরের নামাজের জন্য অজু করতে এসে তার বাড়ির কাছে কালিগঙ্গার ঘাটে এসেছিলেন। সেখানে তিনি মুমূর্ষু কিশোর দেহ আবিষ্কার করেন। তবে বুঝতে পেরেছিলেন বালক গুটিবসন্তে আক্রান্ত। সেই সময় মৃত্যুর ভয়ে মহাসংক্রামক গুটিবসন্তে আক্রান্ত কাউকে মানুষ স্পর্শ করা দূরে থাকুক, ধারে কাছেও যেতো না। কিন্ত মলমের মনে হোল ছেলেটি মারা যায় নি। তিনি বাড়ি গিয়ে তাঁর স্ত্রী মতিজানকে ডেকে আনলেন। তাঁরা দুজনেই দেখলেন ছেলেটি জীবিত। দুজনে ধরাধরি করে গুটি বসন্তে আক্রান্ত মৃতপ্রায় লালনকে বাড়ি নিয়ে এলেন। মতিজানের শুশ্রুষায় লালন সুস্থ হয়ে উঠলেন। মতিজানকেই তিনি মা ডাকলেন। এরপর লালন আর কখনই মতিজান ও মলমের বাড়ি ছেড়ে যান নি। মতিজান ও মলমের বাড়ি তাঁর সাধনার ক্ষেত্র ও আখড়া হয়ে উঠল। একটা পর্যায়ে স্বামীস্ত্রী দুজনেই লালনকে গুরু মান্য করলেন। লালনের জীবনে ফকির মতিজান ও ফকির মলম শাহের গুরুত্ব অসামান্য।

জীবদ্দশায় লালন  তাঁর নিজের কোন পরিচয় কাউকে দেন নি। কোথায় তাঁর বাড়ি, কে তাঁর মা-বাবা , কী তাঁর বংশ পরিচয় ইত্যাদির কোন হদিসই তিনি কাউকে বলেন নি। কাউকেই না। একদমই না। ছেঁউড়িয়ায় মতিজান-মলমের গৃহস্থ বাড়িটিই তাঁর আবাস ও পরিচয়। তিরোধান অবধি এটাই ছিল তাঁর ঠিকানা এবং সাধনার ক্ষেত্র। অতএব লালনের বাড়ি, ঠিকানা, বংশপরিচয় ইত্যাদি নিয়ে যে সকল গালগল্প চালু রয়েছে তা একদমই ভূয়া। সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাঁর গুরু সিরাজ সাঁই সম্পর্কেও কোন প্রামাণ্য তথ্য নাই। তাঁর হদিসও সম্পূর্ণ অজানা। লালন নিজেও তাঁর শিষ্যদের তাঁর গুরু কে, কিম্বা কী তাঁর পরিচয় সে সম্পর্কে কিছুই বলেন নি। যদিও অনেকে অনেক কিছুই দাবি করে থাকেন, তবে সেই সকল দাবির কোন ভিত্তি নাই।

লালনের পরিচয় আজ অবধি একটাই; তিনি জল ও কাদা মাখামাখি হয়ে কালিগঙ্গা নদী থেকে উঠে এসেছেন। লালনের জন্ম এবং পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা জানতে চাইবেন, এতে কোন অন্যায় নাই। কিন্তু ভূয়া ও বানোয়াট গল্প পরিহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ছেঁউড়িয়ায় ফকির মতিজানের কবর ফকির লালনের পাশেই। লালনের সাধক জীবনের বিকাশের ক্ষেত্রে মতিজানের ভূমিকা ছিল নির্ধারক। লালনের পাশেই মতিজানের সমাধি থাকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মূলত এটি ‘মতিজান-লালন’ সমাধি কিম্বা যদি মাজারই বলতে হয় তাহলে মতিজান-লালনের মাজার। কিন্তু প্রকট পুরুষতন্ত্র মতিজানকে ইতিহাস থেকে মুছে দিয়েছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে মতিজান কিম্বা মলম শাহ সম্পর্কে তথ্য প্রায় নাই চললেই চলে।

বছরে ছেঁউড়িয়ায় দুটো অনুষ্ঠান হয়। একটি ফাল্গুনি পূর্ণিমাতে লালনের প্রবর্তিত সাধুসঙ্গ কেন্দ্র করে উৎসব। এটি নদীয়ায়  শ্রীচৈতন্যের ‘আবির্ভাব’ বা গৌরাঙ্গের জন্মের মহিমা ধারণ করবার জন্য। অপরটির সঙ্গে লালনের প্রত্যক্ষ কোন যোগ নাই; তাঁর তিরোধানের পরে তাঁর স্মৃতি হিশাবে সাধুগুরুরা পহেলা কার্তিকে আরেকটি স্মৃতিসঙ্গ প্রবর্তন করেন। তবে কার্তিকের অনুষ্ঠান ‘উৎসব’ নয়। সাধুগুরুদের কাছে সাঁইজীর মৃত্যু, বলা বাহুল্য, উৎসবের বিষয় নয়। ফাল্গুনি পূর্ণিমার উৎসব তো আছেই, কিন্তু এখন কার্তিকের অনুষ্ঠানও বাজারি, কার্নিভাল বা হ্যাংলা হৈচৈয়ের রূপ পরিগ্রহণ করেছে। ফকিররা শোক বহন করলেও লালনের তিরোধানে ছেঁউড়িয়ায় শোকের কণা মাত্র চিহ্ন আবিষ্কার করা এখন দুঃসাধ্য।

দীর্ঘদিন ধরেই ছেঁউড়িয়ায় অনুষ্ঠান হচ্ছে তার তিরোধান দিবস কিম্বা দোলে – কিন্তু এই দুটি দিনের মর্যাদা বিন্দুমাত্র রক্ষা হয় না। দেখি, কিভাবে নদীয়ার ভাবের সর্বোচ্চ প্রকাশ লালনের ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, গাঁজায়, কল্কি, সিদ্ধি এবং নানান গুহ্য সাধনার ইতিবৃত্তে। এটা করা হচ্ছে লালনকে ‘বাউল’ আখ্যা দিয়ে। ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দিয়ে লালনকে যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করা যায়। অথচ লালন কখনই ঘূণাক্ষরেও নিজেকে ‘বাউল’ বলেন নি। বাউল ভালো কি মন্দ সেটা ভিন্ন তর্ক। যাঁরা নিজেদের বাউল বলে নিগৃহীত হন তাঁদের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত কাজ। কিন্তু যিনি নিজেকে সবসময়ই ‘ফকির’ বলেছেন, তাঁকে ‘বাউল’ বানাবার রাজনীতিটুকু গভীর, বাংলার ভক্তি ধারার দার্শনিক বিচারের দিক থেকেও অগ্রহণযোগ্য। এই দিকগুলো আমাদের বোঝা দরকার। বোঝা দরকার, নদীয়ার ভাবের বিপ্লব থেকে খসিয়ে ফেললে লালনের কী দশা ঘটতে পারে! কালিগঙ্গার মতো ‘ভাবের শহর’ নদীয়াও শুকিয়ে ছ্যাবড়া হয়ে যায়।

সকলকে এই মিনতিটুকু জানাই। ছেঁউড়িয়ার পরিবেশ সাধকের উপযোগী করে তুলুন।

দুই

মলম শাহের বাড়ি বা লালনের আখড়া ছিল আম গাছ এবং নদির পাশে বাঁশ বন দিয়ে ঘেরা একটি নির্জন স্থান। আখড়ায় লালন ভক্ত, অনুরাগী, অনুসারী এবং সাধুদের আনাগোনা ছিল অবশ্যই, কিন্তু কোলাহল ছিল না। ছেঁউড়িয়ায় এখন ‘লালনের মাজার’ নামে যা পরিচিত সেটি আসলে মলম শাহের বাড়ি; এটিই এখন লালনের ‘মাজার’ নামে পরিচিত । যদিও নদীয়ার ভাবের সঙ্গে ‘মাজার’ ধারণা একদমই সঙ্গতিহীন।

লালন ভক্ত ও অনুরাগীদের কাছে ছেঁউড়িয়া ‘সাঁইজীর ধাম’। ‘মাজার’ আর ‘ধাম’ এককথা নয়। লালন সুফি কিম্বা চিশতিয়া তরিকার কেউ নন। তবে তাঁকে ‘সুফি’ দাবি করারা মধ্য দিয়ে লালনকে ‘ইসলামিকরন’ করবার একটা সক্রিয় চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এই চেষ্টার সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক কারণ হচ্ছে সাতচল্লিশের আগে লালনকে হিন্দু প্রমাণ করবার একটা সক্রিয় চেষ্টা এলাকার হিন্দু ব্যবসায়ীরা করেছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কলকাতার সাহিত্যমোদীদের একটা অংশ। তাঁরা ভিত্তিহীন দাবি করতেন লালনের জন্ম একটি কায়স্থ পরিবারে এবং তাঁর পদবী ‘কর’।

পাকিস্তান আমল থেকে এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিশাবে হিন্দু বয়ানের বিপরীতে মুসলমান বয়ান তৈরি হতে শুরু হয়। ভূয়া পুঁথি আবিষ্কার করে লালনকে মুসলমান বানাবার চেষ্টা চলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লালনের চৌচালা সাধন ক্ষেত্রকে বদলিয়ে সেখানে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার আদলে স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে লালনকে ইসলামিকরণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও লালনকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যার একটি বড় কারণ হচ্ছে লালন নিয়ে আন্তরিক চর্চা ও পর্যালোচনার মারাত্মক অভাব। লালন একান্তই নদীয়ার ভাবের মানুষ। কিন্তু ভাবের ইতিহাস বুঝতে হলে প্রথমত শ্রীচৈতন্যের জাতপাত বিরোধী লড়াই এবং ভাববিপ্লবের মর্ম বোঝা জরুরী। বলা বাহুল্য এর সঙ্গে জড়িত নদীয়ার আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাস। দরকার চৈতন্য নদীয়া ছেড়ে যাবার পর নিত্যানন্দের নেতৃত্বে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক লড়াই চলেছে সেই ইতিহাসের খোঁজ খবর নেওয়া। এ নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে। নদীয়ায় চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের ফলে যে রাজনীতি ও ভাবের আবির্ভাব ঘটেছিল ফকির লালন শাহ তার সর্বোচ্চ পরিণতি।

একদিকে লালনকে চিশতিয়া তরিকার সুফি বানানোর মধ্য দিয়ে লালনের ‘ইসলামিকরণ’ যেমন ঘটেছে, ঠিক তার বিপরীতে লালনকে হিন্দুকরণের প্রচেষ্টা থেমে থাকে নি, সেটা অব্যাহত রয়েছে ভিন্ন ভাবে। সেটা হয়েছে লালনকে ‘বাউল’ বলা, ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দেওয়া এবং নানান গুহ্যবিদ্যার শিরোমণি হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টায়। বাংলার ভাবের ইতিহাসে তন্ত্রের পর্যালোচনা হিশাবে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ঘটলেও তন্ত্র ও বৈষ্ণবীয় রসতত্ত্বের ফারাক বিচার হয় নি বললেই চলে। অথচ এই বিচার ছাড়া নদীয়ার ফকিরী ধারা বোঝা কঠিন। নদীয়ায় যে বিশাল ভাবের বিপ্লব ঘটেছিল তা নিয়ে খুব কমই ভাবাভাবি হয়েছে, লেখালিখি কিছুই প্রায় হয় নি। ফকির লালন শাহ চৈতন্যকে ‘নদীয়ার ফকির’ বলে আখ্যায়িত করলেও এর ভাবগত মর্ম এখনও অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে।

তিন

নদীয়ার ভাবচর্চায় কবর পূজা, কবরে ‘গিলাফ’ দেওয়া ইত্যাদির কোন বিধান বা সংস্কৃতি নাই। এমনকি কবরকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডও নদীয়ার ভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর কারণ নদীয়া জীবন্ত মানুষ ভজনা করে, মৃত মানুষ কিম্বা মৃতের কবর পূজা করে না। যে ‘পরম’ মানুষের শরীরে ‘বাস’ বা ‘বসত’ করেন তাঁকে কবর পূজা বা মৃত পাথর পূজা করে পাওয়া যাবে না। লালনের ভাবের দিক থেকে ‘মানুষ ভজনা’ খুবই মৌলিক। কবর ভজনা ও মানুষ ভজনার মধ্যে ফারাক আকাশ আর পাতাল। অথচ নদীয়ার ভাবের এই গোড়ার কথা এখন একদমই বিস্মৃত।

লালনের কোন ছবি নাই। ছবি রাখা তিনি সজ্ঞানে পরিহার করেছিলেন একথা ভাববার যথেষ্ট সঙ্গত কারন আছে। লালনের চর্চায় মাজার পূজা যেমন নাই, তেমনি ছবি পূজাও নাই। লালনের ছবি বা কোন প্রকার মূর্তি বানানো পরিহার করা্র অর্থ যার যার গুরুঢ় গুরুত্ব ও গৌরবকে প্রাধান্য দেওয়া। গুরু ভজনার গুরুত্বকে প্রাধান্য দেওয়া। ‘গুরু থুয়ে গৌর ভজনা’ নদীয়ায় নাই। গুরুরূপ হৃদয়ে ধারণ করাও গুরুপম্পরা রক্ষার শর্ত। লালনের গুরুবাদ এই দিক থেকে অনন্য। মৃত লালন কারো গুরু হতে পারেন না, তাঁর ছবিও উপাস্য নয়। প্রতি কালেই যে কোন ভক্তের আশপাশেই অবশ্যই এমন জীবিত মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে যিনি দেশকালপাত্র নির্বিশেষে নদীয়ার ভাব ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। মৃত কোন কিছুই  গুরু ভজনার যোগ্য নয়, একমাত্র জীবিত মানুষই গুরু ভজনার যোগ্য, কারণ বাক্যের অর্থোৎপত্তি একমাত্র  জীবিত মানুষের মধ্য দিয়েই ঘটে। এই ন্যূনতম সত্য যাঁরা মানতে রাজি নন তাঁরা এখনও অহংকার বা ‘আমি’ ভাব থেকে মুক্ত হতে পারে ন নি। তাঁরা ফণা তুলে থাকেন, জ্ঞানীর কাছে মাথা নোয়াতে জানেন না।

একসময় ঠাকুর পরিবারের জমিদারি মহিমা ও মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য একজন বুড়া বাউলকে নিজের বোটে এনে রবীন্দ্রনাথের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ  ঠাকুর একটি বালখিল্য স্কেচ আঁকেন। শিল্পকলার দিক থেকে এই তথাকথিত স্কেচ যেমন অতিশয় বাজে, তেমনি এর সঙ্গে লালনের কোন সম্পর্ক থাকা অসম্ভব। কারণ লালন জমিদারের বোটে গিয়ে স্কেচ আঁকার মডেল হবেন সেটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু ঠাকুর পরিবারের কীর্তি হবার কারণে এই বাজে স্কেচ এখনও ফলাও করে প্রচারিত হয়। স্কেচের প্রামাণ্যতা একমাত্র  জ্যোতিরিন্দ্রের স্বাক্ষর। আর কোন প্রমাণ নাই।

সম্ভবত প্রথম স্কেচের দুর্দশা দেখে শিল্পী নন্দলাল বসু একজন বাউলের স্কেচ আঁকেন। তিনি কখনই দাবি করেন নি এটি লালনের। কিন্তু তারপরও কিছুটা শিল্পীর গুণে এবং কিছুটা লালনের ছবি দেখবার জন্য লালন ভক্তদের আকুতির কারণে সেই স্কেচ জনপ্রিয় হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এটি লালনের কোন ছবি নয়, নন্দলাল বসুর আঁকা একজন কাল্পনিক বাউলের স্কেচ।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পর নন্দলাল বসুর স্কেচটি জবরদস্তি লালনের বলে প্রচার শুরু হয়। বসুর স্কেচ অনুকরণ করে একটি মুরাল বানিয়ে এখন তা লালন মেলার মাঠে চিরস্থায়ী ভাবে গেঁড়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ সরল লালন ভক্তকুল বিভ্রান্ত হয়ে এই স্কেচ লালনের ছবি ভেবে কেনে। রাজনীতি ও ব্যবসা  নন্দলাল বসুর ছবির স্কেচকে  লালনের ছবি বানিয়ে দেবার কোশেশ করছে। বলা বাহুল্য, এর জন্য শিল্পী নন্দলাল বসু দায়ী নন। তিনি শ্রদ্ধেয়।


lalonmural
এই মুরালটি উদ্বোধন করেছেন  ১৬ অক্টোবর ২০১১ সালে সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল আলম হানিফ। মুরাল গেঁড়ে রাখার বুদ্ধি বের করেছেন সেই সময়ের জেলা প্রশাসক ‘জনাব বনমালী ভৌমিক’।


লালনের ভাবের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নানান চর্চা এখন চতুর্দিকে  প্রকট। একদিকে মাজারি সংস্কৃতির আমদানি নদীয়ার বিশেষ গায়ন পদ্ধতি বা গায়কীর মধ্যে যেমন বদল ঘটিয়ে দিচ্ছে, তেমনি প্রায়ই গানের বাণীর হেরফের ঘটিয়ে অর্থবদলের প্রয়াসও জারি আছে। চৈতন্যোত্তর ভাবচর্চার ঐতিহ্যে লালনে ‘দেহ’ কথাটার মানে তান্ত্রিক দেহ নয়, বিশেষত যখন দেহকে তুরীয়ানন্দের উপায় মাত্র গণ্য করা হয়। তন্ত্রের ইতিহাসে প্রথম মৌলিক ছেদ ঘটল যখন চৈতন্য দাবি করলেন দেহ স্রেফ দেহ মাত্র নয়। কারণ, তার ‘অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ আর বহিরঙ্গে রাধা’ । গোরা সম্পূর্ণ নতুন ভাব নিয়ে নদীয়ায় হাজির হলেন। প্রাচীন তন্ত্রের দেহ আর ‘দেহ’ রইল না, কারণ ‘অন্তরের অঙ্গ’ বা ‘ভেতরের দেহ’ নামক একটা ব্যাপার আছে, তা রটে গেল। সেই দেহের ‘আস্বাদন’ই জীবের পরমার্থ এই আকাঙ্খাও নদীয়ায় প্রকট হোল। বহিরঙ্গে যে দেহকে আমরা দেখি তাকে আর আগের মতো তুরীয়ানন্দ লাভের উপায় গণ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠল। প্রশ্ন হোল, কৃষ্ণ যেখানে বাস করেন সেই অন্তরঙ্গে প্রবেশের চাবি কোথায়? বহিরঙ্গে দেহই তার একমাত্র চিহ্ন, সেই চিহ্নের ভজনার মধ্য দিয়েই ভক্ত ভগবানের মানে ধরতে পারেন।

লালন অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ বহিরঙ্গে রাধা ভাবের ভাবুক। দেহ তাঁর কাছে উপায় মাত্র না। এই উপায়বাদ দেহের অপব্যবহার করে ভয়ংকর ভাবে, বিশেষ ভাবে নারীকে। তন্ত্রের ভালমন্দ বিচার আলদা তর্ক, কিন্তু লালনকে তান্ত্রিক বলা বা বাউলবাদী গুহ্যচর্চার খোপে ঢুকিয়ে তাঁকে বোঝার চেষ্টা চরম আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। লালনের ‘দেহ’ একান্তই নদীয়ার দেহ যেখানে পরম বাস করেন। কিন্তু তাঁর দেহমূলক বাণীগুলোকে বাউলতত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যার ফলে নদীয়ার ‘ভাবের শহর’ ক্রমশ কুয়াশা ও অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।

চৈতন্যের আবির্ভাব এবং আন্দোলনকে হোসেন শাহী আমল থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা অসম্ভব। হিন্দু ঐতিহাসিকরা যা সবসময় করে থাকেন। অন্যদিকে মুসলমান ঐতিহাসিকদের কাছে চৈতন্য মন্দ, কারণ তিনি ইসলামের প্রসার ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। হিন্দুমুসলমানেরর তর্কাতর্কির গহ্বরে পড়লে লালন বোঝা মুশকিল। লালনের ভাব, চিন্তা বা দর্শনের সঙ্গে একদিকে ভক্তি আন্দোলন এবং অন্যদিকে ইসলামের সম্বন্ধ বোঝা জরুরি কাজ। কিন্তু এই কাজগুলি একদমই অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এটা নিশ্চিত এই অঞ্চলে ইসলাম এবং বাংলার স্বাধীন সুলতানদের শাসনের পরিমণ্ডল না থাকলে চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটত কিনা সন্দেহ। ভুলে যাওয়া উচিত নয় তারপরও স্মার্ত ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে চৈতন্য নদীয়া চিরতরে ছেড়েছিলেন। এই রাজনৈতিক টানাপড়েনের ইতিহাস না জানার ফলে লালন হয়ে উঠেছেন বাউলদের ডুগডুগি বাজিয়ে গান গাওয়া এবং ব্যান্ডওয়ালাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের কাঁচামাল। সাধকদের চর্চা এখন হয়ে উঠেছে ‘লালন গীতি’। আগে ছিল পল্লীগীতি। এখন এইটুকুই বদল হয়েছে। অন্যদিকে প্রান্তিক সমাজে লালন হয়ে উঠেছেন, ‘গুহ্যবিদ্যা’ চর্চার মরমি অজুহাত।

একটা সামগ্রিক অধঃপতনের চিহ্ন সর্বত্র। অধঃপতনের আরেকটি কারন আছে। সেটা রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক। সাধুগুরুদের ভাষায় ‘সাইঁজী্র ধাম’ হচ্ছে নদীয়ার ‘টাঁকশাল’। অর্থাৎ ছেঁউড়িয়া নদীয়ার ভাবচর্চার মূলকেন্দ্র, যেখান থেকে লালনের ভাবের উপলব্ধি এবং তার তাৎপর্য সাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত, প্রসারিত এবং প্রচারিত হবার কথা। কিন্তু লালনের ধাম এখন রাষ্ট্রের অধিগত, এর অধিকর্তা সাধুগুরুরা নন, সরকার; পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক, একজন আমলা। অর্থাৎ লালন ফকিরের ধাম রক্ষা বা ব্যবস্থাপনায় সাধুগুরুরা নাই, রয়েছে আধুনিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিশাবে লালনের মাজারের যাঁরা সরাসরি দায়িত্বে থাকেন তাঁরা লালনের ধারার কেউ নন। বাস্তবতা হচ্ছে লালন অনুসারী ও অনুরাগী ফকির দরবেশ আশেকান সাঁইজীর ‘মাজার’ থেকে বিতাড়িত। সরকারি কর্মকর্তা হিশাবে অনেকের ব্যক্তিগত আগ্রহ থাকতে পারে। কিন্তু লালন এবং নদীয়ার ভাব সম্পর্কে আমলারা অধিকাংশই অজ্ঞ। ফলে ছেঁউড়িয়ায় ধীরে ধীরে এমন সব লোকজনের উৎপাত বেড়েছে যাদের সঙ্গে নদীয়ার সাধনার ধারার কোন দূরবর্তী সম্পর্কও নাই। অথচ বাংলার ভাবান্দোলনের সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র কুষ্টিয়া ও তার সন্নিহিত অঞ্চল।

চার

উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালের আগে সীমান্তের দুইপাশের ভূখণ্ড‘নদীয়া’ নামে খ্যাত ছিল। ‘নদীয়ার ভাবের কথা, অধীন লালন জানে কি তা?’ – এই প্রশ্ন ও আকুতির ওপর ভাবচর্চার যে পরিবেশ এই অঞ্চলে সাধুগুরুরা সারাজীবনের ত্যাগ ও তিতীক্ষার বিনিময়ে গড়ে তুলেছিলেন তার কিছুই প্রায় আর অবশিষ্ট নাই।

‘নদীয়া’ কথাটা অবশ্য নদীয়ায় ফকিরদের মধ্যে কখনই ভৌগলিক অর্থে ব্যবহার করা হোত না। বরং একটা ঠিকানা বা ভাবচিহ্নের মতোই জারি ছিল, যার উৎপত্তি ঐতিহাসিক ভাবেই ঘটেছিল সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে। দাবি করা যেতে পারে এই উৎপত্তি ঘটা অনিবার্য ছিল। বাংলার সুলতানদের আমলে ইসলাম জাতপাত বিরোধী সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনকে শুধু অনুপ্রাণিত করে নি, প্রশ্রয়ও দিয়েছিল। উচ্চ বর্ণের জাতের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণ ও নিম্নকোটির মানুষের লড়াই সুলতানরা ক্ষমতায় না থাকলে সম্ভব হোত কিনা সন্দেহ। সুলতানি বঙ্গে ইসলামের ইতিহাসের আবহে সমাজের ক্ষমতার সম্পর্কে যে রূপান্তর ঘটছিল তার পরিণতি হিসাবে নদীয়ার তিন পাগল বা তিন ফকিরের আবির্ভাব: চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য। ‘তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে’। সেই আবির্ভাবের পুরা আখ্যান আমরা এখনও পুরাপুরি আন্দাজ করতে পারি না, কারন এই ইতিহাস পুরাপুরি জানার জন্য যে অনুসন্ধানী মন, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম দরকার আমাদের মধ্যে তার অভাব আছে। নদীয়ার বিপ্লব সুলতানি আমলেই ঘটেছিল। অতএব সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ না করে চৈতন্যের বৈপ্লবিক ভূমিকার উৎপত্তি কারণ এবং তার ভাবগত চরিত্রের বৈশিষ্ট্য কখনই বোঝা যাবে না।

আধুনিক ইতিহাস রচনা সাম্প্রতিক কালের আবিষ্কার, আমরা যখন ইতিহাস চর্চা একটু আধটু করতে শিখেছি তখন এই দেশের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠি ঔপনিবেশতার কুফলে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ফলে নদীয়ায় চৈতন্যের নেতৃত্বে যে সামাজিক ও ভাবগত বিপ্লব ঘটেছিল সেটা আজ অবধি সাম্প্রদায়িক ভাবে দুই চোখের দুই প্রকার খণ্ডিত দৃষ্টি দিয়েই দেখাই দস্তুর হয়ে উঠেছে। মুসলমান মুসলমানের চোখ দিয়ে দেখে, হিন্দু হিন্দুর। অতীতকে সাম্প্রদায়িক নজর দিয়ে দেখতে ও বিচার করতে বাংলাভাষীরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। ‘বাঙালি’ হবার কোন ঐতিহাসিক বা ভাবগত মর্ম আছে কিনা সেটা আজ অবধি হিন্দু বা মুসলমান বাঙালির আত্মজিজ্ঞাসার অন্তর্গত নয়। অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের কথা তো দূরের ব্যাপার। সে কারণে সামগ্রিক ভাবে নিজেদের ইতিহাসের যুগান্তকারী মুহূর্তগুলো বোঝা ও বিশ্লেষণ বাঙালির সাধ্যের বাইরে রয়ে গিয়েছে। তাকে সাধ্যাধীন করা রীতিমতো নতুন রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যাপার।

গুরুত্বপূর্ণ বোঝাবুঝির দিক হোল বাংলাভাষীদের মধ্যে ধর্ম বলি, ঐতিহ্য বলি কিম্বা ইতিহাস বলি নিজেদের বৈচিত্রের গৌরব উপলব্ধির শক্তি ক্রূর সাম্প্রদায়িকতার কারনে যেমন তারা হারিয়ে ফেলেছে, একই ভাবে ঐক্যের ক্ষেত্র ও ভাবচর্চার বৈপ্লবিক বাঁকগুলির ইতিহাস বোঝাও কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ এখন সেই বোঝাবুঝি সাম্প্রদায়িকতা কিম্বা ধর্মীয় জাতিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার কারণে অতীত এখন আর আর সাফ নাই, আবছা হয়ে আছে। চোখ মুছতে না শিখলে আয়নায় নিজের চেহারাও ভাল ভাবে দেখা যায় না।

সুলতানি আমল, বিশেষত আলাউদ্দিন হোসেন শাহ যদি প্রশ্রয়দাতা হয়ে থাকেন তাহলে নদীয়ার ভাবের গুরু চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য — ছেঁউড়িয়া এখনও এই সত্যই অবগাহন করে। নদীয়ার ভাবের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে লালন সহ নদীয়ার পাঁচ ঘরকে কেন্দ্র করে বাকি চার ঘর সতী মা, পাঞ্জু শাহ, চৌধুরী ও দেলবার শাহ। তবে ভাব ও প্রকাশের শক্তির দিক থেকে ফকির লালন শাহ যে পরিমান দৃশ্যমান , অন্যরা অতোটা নন।

শ্রী চৈতন্য নদীয়ায় অবতীর্ণ হয়েও নদীয়া ছেড়ে গিয়েছেন বলে নদীয়ার সাধকদের অভিমান আছে। তারপরও যাঁরা নদীয়ার ভাবের খোঁজে ভাবের মানুষগুলোকে খুঁজে বেড়ান, তাঁদের সাক্ষাৎ মিললে নদীয়ার উৎসমুখের হদিস কিছুটা হলেও তাঁরা পান। অর্থাৎ গৌরাঙ্গের প্রেরণায় হোসেন শাহীর বাংলায় যে একটা ভাবের বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল সেটা সহজেই তাঁরা বোঝেন। এটা নিশ্চিত। নিদেন পক্ষে এটা তাঁরা আন্দাজ করতে পারেন যে পুরানা তান্ত্রিক বা দেহকে উপায় মাত্র গণ্য করে নানান কিসিমের শক্তিশালী যেসকল তান্ত্রিক সাধনার ধারা চৈতন্যের আগে এই অঞ্চলে বলবৎ ছিল তার সঙ্গে নদীয়ার আসলে ছেদ ঘটে গিয়েছে অনেক আগেই। চৈতন্যের সময় থেকেই। তারপরও তার জের ‘বাউল’ নামে রয়ে গিয়েছে।

কেন এই জের থেকে গেল, ফকির লালন শাহের সাধনার ক্ষেত্রে এর সুনির্দিষ্ট ভূমিকা কি? – সেইসব আরও গবেষণা এবং বিস্তারিত আলোচনার বিষয়। আপাতত এই দিকটা বোঝা যথেষ্ট যে এর বেশ কতক সুবিধা এবং আরাম আছে। লালনকে ‘বাউল’ বা ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দিয়ে নেশা দ্রব্য গ্রহণ, নানান গুহ্য দেহবাদী চর্চার ধারা জারি রাখা এবং সেইসব ব্যাখ্যা তাঁর সাধনার ধারার ওপর আক্ষরিক অর্থে আরোপ করা, জগত-সংসার থেকে পলাতক উদাসীন জীবন যাপনের রোমান্টিকতা — লালনকে ‘বাউল’ বললে ইত্যাদি সহজেই বলবৎ রাখা যায়। অথচ লালন নিজেকে কখনই ‘বাউল’ বলেন নি। বাউলের জীবন ভাল কি মন্দ সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিতর্ক, নৈতিক বিচারের মানদণ্ড দিয়ে মানুষের বিচিত্র ও বিভিন্ন জীবনযাপনকে আমরা কোন দিনই বুঝব না। বরং নদীয়ার ভাবকে তন্ত্র থেকে আলাদা ভাবে বোঝা ভাবের ইতিহাসের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সেই ভাবের দার্শনিক তাৎপর্য ও গভীরতা বোঝাও সমান জরুরী। কিন্তু যিনি তাঁর সাধনার কোন পর্যায়েই কিম্বা তাঁর রচনার কোত্থাও নিজেকে বাউল বলেন নি, তাঁকে ‘বাউল’ বানাবার চেষ্টা ভুল।

অথচ ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন শাহের স্মৃতি উৎসব বা তিরোধান দিবসে দেখেছি , তাঁকে লালন একাডেমি ‘বাঊল সম্রাট ফকির লালন শাহ’ হিসাবেই সাধারণত উদযাপন করে থাকেন। অথচ তাঁকে ‘বাউল’ বলবার কোন ঐতিহাসিক বা ভাবগত ভিত্তি নাই। লালন নিজেকে যা বলেন নি, সেটা চাপিয়ে দেওয়া আহাম্মকি। আশা করি লালন একাডেমি এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটির প্রতি নজর দেবেন। নানান সময়ে দেখি, তারা আমন্ত্রণ পত্রে যে ছবি ছাপেন, সেটাও লালনের নয়, নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি। তাতে দোষ নাই, যদি বলে দেওয়া হোত, এটা লালনের ছবি নয়। অথচ যাঁরা জানে না তাঁরা ধরে নেবেন নন্দলালের আঁকা ছবিটিই বুঝি লালন শাহের ছবি।

সত্য হোল এই যে লালনের কোন ছবি নাই, তিনি কোন ছবি রেখে যান নি। তাছাড়া, আগেই বলেছি, লালনপন্থী সাধনায় ছবি পূজা বা মাজার পূজার কোন বিধান নাই। এই ধারা গুরু ভজনা করে, নিজ নিজ গুরুর রূপ ছাড়া তারা অন্য কোন রূপ ভজনা করে না।

ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন শাহের ভাবের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা খুবই দরকার। আশা করি সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনও এই ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top