।। নাদিয়া ইসলাম ।।
রেহানা এই সিস্টেমের একটা অংশ মাত্র। রেহানার মাধ্যমেই স্পষ্ট যে এই সিস্টেমে থেকে একজন স্বতন্ত্র মানুষের পক্ষে সামাজিকভাবে নৈতিক হওয়া সম্ভব হয় না। পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এই সিস্টেমকে পোর্ট্রে করেছেন অর্থোক্রোমাটিক ফিল্ম স্টকে- নীল রঙে। পুরো ফিল্মটাই মূলত লো স্যাচুরেশান, লো ভ্যালুড নীল রঙে টিন্টেড। এবং শুধু তাই না, ফিল্মের প্রতিটা চরিত্রও আগাগোড়া নীল সাদা কালো মনোক্রমের বিভিন্ন শেইডের পোশাক পরেছেন, একমাত্র ব্যতিক্রম এ্যানি ছাড়া। একমাত্র এ্যানিকে দুইটা ভিন্ন দৃশ্যে হলুদ রঙের ফতুয়া পরতে দেখা যায়, এছাড়া বাদবাকি সবকিছুই নীল। পৃথিবীর বেশিরভাগ সংস্কৃতিতে নীল বিষাদ এবং একাকীত্বের রঙ এবং নীল প্রাইমোডিয়াল পর্নোগ্রাফিরও রঙ। অপরদিকে হলুদকে বেশিরভাগ অর্থে শিশুসুলভ আনন্দের জায়গা থেকে দেখা হলেও অনেকক্ষেত্রেই এই রঙ কাপুরুষতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা, লোভ, প্রতারণা, সতর্কতা এবং ভয় বোঝাতে ব্যবহার হয়।
১৯ নভেম্বর ২০২১
‘রেহানা মরিয়ম নূর’ দেখলাম গতকাল। এবং দেখার পর থেকেই মাতালের মতো খানিক আচ্ছন্ন অবস্থায় এ্যাঁকাব্যাঁকা ঘুরছি আমি। প্রায় অনেকদিন, বা বলা ভালো, প্রায় অনেকবছর পর এতো অদ্ভুত একটা ফিল্ম দেখা হলো আমার। এ্যাওয়ার্ড পাওয়া সো-কল্ড আর্ট হাউজিয় ফিল্ম নিয়ে নাক সিঁটকানোর অভ্যাস আমার পুরানো। রেহানা মরিয়ম নূর দেখার আগেও আমি বরাবরের মতো নাক সিঁটকাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম, প্রথমত ফিল্ম নামের ক্লিশে সংলাপবহুল তিন ঘণ্টার ততোধিক ক্লিশে অভিনয়ের বাংলাদেশী নাটক দেখে সময় নষ্ট করার সময় আমার নাই, দ্বিতীয়ত অরন্ধতী রায় সূত্রে পশ্চিমা বাজারে ট্রেন্ডি হওয়া সমকামী, হিজড়া, নাকে সর্দি গড়ানো আফ্রিকান কালো চামড়া অপুষ্ট শিশু এবং ‘দুর্বল’ নারীদের ‘সবল’ হওয়ার গল্প নিয়ে বানানো এ্যাওয়ার্ড পাওয়া ফিল্মের ‘নারী রক্ষা প্রকল্প’ মার্কা আলগা নারীবাদী এ্যাকটিভিজম নামক পিঁউপিঁউ কান্নাকাটি দেখে মেজাজ খারাপ করার বাসনাও আমি জ্ঞানত লালন করি না। সুতরাং এ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, ভেরি গুড- মেনি কংগ্রাচুলেশানস, কিন্তু আমি উহা নঃ দেখিবো।
তবে আমার বন্ধু কামরুল হাসান জোরাজুরি করতে থাকলেন, ‘দ্যাখো দ্যাখো’ বলে।
তাই অগত্যা অনুরোধে জাহাজ গেলা স্টাইলে বাধ্য হয়েই ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ দেখা হলো।
অবশ্য জাহাজ সাপ্লায়ের জন্য কামরুলকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ দিতে হবে।
আগেই বলেছি, বেশ অনেক বছর এতো অদ্ভুত ফিল্ম আমি দেখি নাই। অদ্ভুত, গুগোল ট্রান্সলেটিয় ঋণাত্মক (নেতিবাচক) অর্থে না। অদ্ভুত, ইতিবাচক কিংকর্তব্যবিমূঢ়িয় অর্থে অদ্ভুত।
লেখা শুরুর আগেই বলে নিচ্ছি, এই লেখায় স্পয়লার থাকবে। সুতরাং স্পয়লার সংক্রান্ত ফিল্মের শাড়ি খোলা সতীত্ব বিষয়ে কারুর মাথাব্যথা থাকলে নিজ দায়িত্বে এই লেখা এড়িয়ে যাবেন। আগে থেকে আপনাকে সাবধান করা হয় নাই বলে পরে আমাকে দোষ দিবেন না।
গল্প হিসাবে রেহানা মরিয়ম নূর খুব সাধারণ।
গল্পটা এরকম- রেহানা একজন এমবিবিএস ডাক্তার, যিনি আপাততঃ একটা আবাসিক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন। ফিল্মের শুরু পরীক্ষার হলে এক ছাত্রীর নকল ধরার ঘটনা থেকে। ঐ ছাত্রীর পায়ের কাছে পড়ে থাকা রুলারে রেহানা নকল দেখতে পেয়ে তাকে হল থেকে বের করে দেন। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি তার সহকর্মী আরেফিনের অফিস থেকে এ্যানি নামের আরেক ছাত্রীকে কাঁদতে কাঁদতে অসংলগ্ন অবস্থায় বের হয়ে আসতে দেখেন। তিনি ধারণা করেন এটা যৌন নির্যাতনের ঘটনা। কিন্তু এ্যানি এই ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করতে নারাজ, তিনি বলেন এটা জানাজানি হলে তিনি কলেজের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন। রেহানা সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজেকে ভিকটিম সাজিয়ে কলেজে এই নিয়ে অভিযোগ করবেন। এবং তিনি সেটা করেনও। কলেজের প্রিন্সিপাল একজন মধ্যবয়সী নারী। তিনি রেহানাকে ‘এসব করে কোনো লাভ হয় না’ যুক্তিতে এই অভিযোগ তুলে নিতে অনুরোধ জানান। এদিকে নকল করে হল থেকে বহিস্কার হওয়া ছাত্রী রেহানার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কলেজে তদন্ত কমিটি তৈরি হয়। সেই কমিটির সামনে ঐ ক্লাসের প্রতিটা ছাত্র ছাত্রী রেহানার বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষী দেন। রেহানা প্রচণ্ড রাগে ঐ ছাত্রীকে চড় মারেন। এবং তার ফলশ্রুতিতে কলেজের সকল ‘বন্ধুর অপমান মানে আমার অপমান’ স্লোগানে বিশ্বাসী আত্মমর্যাদায় বলীয়ান বিপ্লবী ছাত্রছাত্রী কলেজের কোলাপসিবোল গেইট আটকে ফেলেন, এবং রেহানা পদত্যাগ না করলে তারা গেইট খুলবেন না এবং কাউকেই কলেজ থেকে বের হতে দিবেন না- এই মর্মে বিশাল চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেন। প্রিন্সিপাল ভদ্রমহিলা রেহানাকে বলেন, আরেফিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিলে রেহানাকে পদত্যাগ করতে হবে না। তারা কোনো না কোনোভাবে ছাত্র ছাত্রীদের বুঝিয়েসুজিয়ে শান্ত করে ফেলবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। রেহানা বাধ্য হয়ে অভিযোগ তুলে নেন। এই ঘটনার সমান্তরালে রেহানার ছয় বছর বয়সী কন্যা ইমুকে দেখানো হয়। রেহানা ডিভোর্সড এবং সিংগেল মাদার। ইমুকে দেখাশোনা করেন রেহানার বাবা মা এবং ভাই রনি। ইমুর স্কুল থেকে রেহানার কাছে অভিযোগ আসে ইমু তার কোনো এক সহপাঠীর হাতে কামড় দিয়েছেন। রেহানা ইমুর কাছে জানতে পারেন, ঐ সহপাঠী (লিঙ্গসূত্রে যিনি পুরুষ) তাকে ক্লাসে বিভিন্ন সময় বিরক্ত করেন, তাকে চিমটি দেন ইত্যাদি। স্কুল থেকে জানানো হয়, ইমু ঐ সহপাঠীর কাছে ক্ষমা না চাইলে তাকে স্কুলের ফাংশানে পারফর্ম করতে দেওয়া হবে না। রেহানা ইমুকে সেই ফাংশানে যেতে দেন না।
তো এই হচ্ছে স্টোরি লাইন।
কিন্তু রেহানা মরিয়ম নূরকে এই অতি সাধারণ স্টোরি লাইন দিয়ে বিচার করা যাবে না। যদি শুধুমাত্র চরিত্র হিসাবে রেহানাকে ব্যবচ্ছেদ করা হয়, তাহলে আপনি ফিল্ম দেখে আমার মতো তাজ্জব হয়ে লাট্টুর মতো দুইদিন ঘুরতে থাকবেন সন্দেহ নাই। একটু বেশি তাজ্জব হলে তিনদিন।
আমার আগে যারা নারীবাদের ধারকবাহক কর্ণধাররা এই ফিল্ম দেখেছেন এবং সেই মর্মে রিভিউ লিখেছেন, তাদের অনেককেই দেখলাম, রেহানাকে নারীবাদী-প্রতিবাদী জেদি ঘাড়ত্যাড়া অনমনীয় শক্ত মেরুদণ্ডওয়ালা চরিত্র হিসাবে ব্যখ্যা করতে। আবার উল্টাভাবে ফিল্ম বিষয়ে অনেক অকালকুষ্মাণ্ড বিশুদ্ধতাবাদীরা রেহানাকে সোজাসাপ্টা বিষাক্ত চরিত্র শিশু নির্যাতক চরিত্র হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
কিন্তু রেহানা কি শুধুমাত্রই একজন নারীবাদী চরিত্র? মোটেই তিনি তা নন। নারীবাদ কি শুধুমাত্র যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার, বা শুধুমাত্র প্রতিবাদ ফর দা সেইক অভ ইটের ঘাড়ত্যাড়ামি নাকি? রেহানার মধ্যে বরং নারীবাদী চরিত্রের চাইতেও পুরুষতান্ত্রিকতা প্রবল। আবার রেহানা কি শুধুমাত্রই একজন কান্টিয়ান ধার্মিক নৈতিক চরিত্র? মোটেই তিনি তা নন। বরং তিনি কিছুক্ষেত্রে নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদে আক্রান্ত, কিছুক্ষেত্রে অনৈতিকও। তিনি কি শুধুই জেদি, শুধুই প্রতিবাদী চরিত্র? এমনকি তিনি তাও নন। তিনি একই সাথে অতি মানবিক, ইন্ট্রোভার্টেড রোমান্টিক একজন মানুষ। তিনি কি একজন ভালো মা? তিনি কি একজন আদর্শ শিক্ষক? তিনি কি একজন খিটখিটে মেজাজের বিষাক্ত চরিত্র? এই একটা প্রশ্নের উত্তরও আপনি হ্যাঁ বা না বাচক এক শব্দে দিতে পারবেন না। বরং খেয়াল করলে দেখবেন, রেহানা একজন সাধারণ নারী (বা বলা ভালো সাধারণ মানুষ) চরিত্র, যার প্রতিটা বৈশিষ্ট্য, যার প্রতিটা অন্তর্দ্বন্দ্ব, যার প্রতিটা দ্বিধা, প্রতিটা বিভ্রান্তি আপনার আমার সবার মধ্যে একই সাথে স্ববিরোধীভাবে অবস্থান করে। এই স্ববিরোধিতা খুব ইউনিক মঙ্গলগ্রহিয় কোনো বিষয় না, এবং এই নৈতিকতা আর অনৈতিকতার পাশাপাশি অবস্থান দেখতে আমাদের সুদূর চীনদেশে যেতে হয় না। আমরা জুম্মার নামাজ পড়ে ঘুষ দাবী করা মানুষদের, রাস্তায় মানবাধিকার নিয়ে বিপ্লব করে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে বাসায় ফেরত আসার পথে রিক্সাওয়ালাকে দুই টাকা বেশি ভাড়ার জন্য থাপ্পড় মারা মানুষদের, নারীবাদ নিয়ে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল বিদীর্ণ করে বড়ো বড়ো ডায়লগ দিয়ে বাসায় বউ পেটানো মানুষদের নিয়মিত আমাদের আশেপাশেই দেখি। কিন্তু রেহানা কি হিপোক্রিট? না, সেটা তিনি অতি অবশ্যই না। তিনি হিরোও না, ভিলেনও না। তিনি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করা একজন অতি সাধারণ নারী চরিত্র, যিনি অনেক কিছু হতে চান, কিন্তু দিনশেষে তেমন কিছুই হতে পারেন না। এই চরিত্রকে আপনি বাংলা (এবং এমনকি বলিউড ও হলিউড) ফিল্মের ভিলেন মিশা সওদাগর এবং বিছানায় ইয়া আলী স্টাইলে ঝাঁপ দিয়ে সদা ক্রন্দনরত শাবানা বা এমনকি সারাদিন বনেবাদারে নাচ গান করে ক্লাসে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া নায়ক মান্নার হিরোইজম দিয়ে বিচার করতে পারবেন না। এই চরিত্র সমাজের চাপে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হতে হতে ঐ সমাজই হয়ে যাওয়া, পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেই পুরুষতান্ত্রিক হয়ে যাওয়া অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগা, অপরাধবোধে ভোগা একজন সাধারণ বাঙালী নারী চরিত্র মাত্র। এই চরিত্র এ্যানির বিরুদ্ধে হওয়া যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন, একই সাথে এ্যানিকে তার কড়া পারমিউম পরে মানুষ (পড়ুন- পুরুষকে) আকৃষ্ট করার জন্য ভিকটিম ব্লেইমিং করেন। এই চরিত্র পরীক্ষায় নকলের জন্য ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দেন, একই সাথে নিজে মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে আরেফিনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ণের অভিযোগ করেন। এই চরিত্র নিজ কন্যাকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে চান, একইসাথে তার উপর মানসিক (এবং শারীরিক) নির্যাতনও চালান।
সিমোন দা বিভোঁওয়া বলেছিলেন, নারী শুধু লিঙ্গসূত্রে নারী নন, তাকে ‘নারী’ হয়ে উঠতে হয়। আমি সিমোনের সেই বক্তব্যকে মোটাদাগে খারিজ করে দেই। আমি বরং দেখি, আমাদের আশেপাশের বেশিরভাগ নারীই দিনশেষে নারী হতে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক পুরুষে রূপান্তরিত হন। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ নারীই আদতে লিঙ্গসূত্রে নারী হয়েও মননে এবং চেতনায় পুরুষ হিসাবে বাস করেন। এই পুরুষ, ব্যক্তি পুরুষ না। এই পুরুষ হচ্ছে কেন্দ্রীয় পুরুষ মস্তিষ্কের পুরুষ। সমাজের পুরুষ। উদ্বৃত্ত সম্পদ নির্ভর অর্থনীতির পুরুষ, পুঁজিবাদের পুরুষ।
ফিল্মের শেষ দৃশ্যগুলিতে দেখা যায়, স্কুলের ফাংশানে যেতে দেওয়া হবে না বলে ইমু পাগলের মতো রেহানাকে খামচাচ্ছেন, আঁচড়াচ্ছেন, কামড়াচ্ছেন, আর রেহানা ইমুকে গায়ের জোরে টেনে হিঁচড়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের অফিসে। তার মুখ পাথরের মতো শক্ত। না, ইমু এখানে আর শিশু না, বরং ইমু প্রতিনিধিত্ব করছেন সমাজের নির্যাতিতদের, প্রলেতারিয়াতদের মধ্যে প্রলেতারিয়াতদের; আর রেহানাও এখানে শুধুমাত্র একজন মা নন, নারী নন, বরং এই দৃশ্যে তিনি সেই কেন্দ্রীয় পুরুষ মস্তিষ্কের পুরুষ, যিনি তার এথিকাল ইগোইজমের মাধ্যমে নির্ধারণ করেন তার ‘সমাজে’ কোন্ আচরণ বৈধ, কোন্টা অবৈধ, যিনি সমাজের বিবেক, যিনি সিদ্ধান্ত নেন, কোন্ মেয়ে কতদূর পোশাক পরবেন, কতদূর খুলবেন, কাকে বিয়ে করবেন, কখন বিয়ে করবেন, কোথায় পড়ালেখা করবেন, কিভাবে রিক্সায় বসবেন, কিভাবে নতমুখে কতখানি ভাত খাবেন। সেই ভাত খেতে গিয়ে কতখানি দাঁত নাড়াবেন।
হ্যাঁ, রেহানা চরিত্র আপনাকে কনফিউজড করে দেবে বলাই বাহুল্য। এই চরিত্রকে আপনি ভালোবাসতে পারবেন না, ঘৃণাও করতে পারবেন না। রেহানার অহংকার, তার জেদ, তার দ্বৈততা, তার সংশয়ের পাশাপাশি, তার বাথরুমে বসে চিৎকার করে কান্না, তার নিজের শরীর থেকে সব গ্লানি মুছে ফেলার চেষ্টায় একের পর একের পর একের পর একের পর একের পর এক পানির ঝাঁপটা দেওয়া, তার হতাশা, তার অসহায়ত্ব, তার ক্ষোভের সাথে আপনি একবার নিজেকে আইডেন্টিফাই করবেন, পরমূহুর্তেই ভাববেন, না, আমি এটা কিছুতেই না। সক্রেটিস জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমাদের কিভাবে বাঁচা উচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে রেহানাকে আমরা আবশ্যিক অহংবাদের চর্চা করতে দেখি, তিনি ভাবছেন, তিনি যা ভাবছেন, তাই সঠিক। ইংরেজিতে মোরাল এবং এথিকাল, দুইটা ভিন্ন শব্দ। বাংলায় যদিও এই দুইয়ের শব্দার্থই নৈতিকতা। কিন্তু মোরালিটি এবং এথিকস, দুইটা ভিন্ন বিষয়। এথিকস- ব্যক্তিগত, কিন্তু মোরালিটি সামগ্রিক। অর্থাৎ মোরালিটি হচ্ছে সমাজের তৈরি করা নৈতিকতা, আর এথিকস হচ্ছে ব্যক্তির তৈরি করা নৈতিকতা। রেহানার চরিত্রে এই ব্যক্তিগত নৈতিকতার যে সংজ্ঞা দেখা যায়, তা সমাজের সৃষ্ট নৈতিকতার অনুজ্ঞাসূচক নৈতিকতার জগাখিচুড়ি নিজস্ব রূপ।
এই যে ভুল এবং সঠিকের নিজস্ব সংজ্ঞা, এই ব্যক্তিগত নৈতিকতার ধারণা, এই অফিসে ঘুষ খেয়ে বাসায় এসে কাজের লোককে একটা সাবান চুরির জন্য পেটানো- এটা আমাদের সমাজের তৈরি করে দেওয়া প্রপঞ্চ। আমাদের আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষ তাই সামাজিকভাবে নৈতিক নন, বরং তারা ব্যক্তিগতভাবে নৈতিক। রেহানা এই সিস্টেমের একটা অংশ মাত্র। রেহানার মাধ্যমেই স্পষ্ট যে এই সিস্টেমে থেকে একজন স্বতন্ত্র মানুষের পক্ষে সামাজিকভাবে নৈতিক হওয়া সম্ভব হয় না। পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এই সিস্টেমকে পোর্ট্রে করেছেন অর্থোক্রোমাটিক ফিল্ম স্টকে- নীল রঙে। পুরো ফিল্মটাই মূলত লো স্যাচুরেশান, লো ভ্যালুড নীল রঙে টিন্টেড। এবং শুধু তাই না, ফিল্মের প্রতিটা চরিত্রও আগাগোড়া নীল সাদা কালো মনোক্রমের বিভিন্ন শেইডের পোশাক পরেছেন, একমাত্র ব্যতিক্রম এ্যানি ছাড়া। একমাত্র এ্যানিকে দুইটা ভিন্ন দৃশ্যে হলুদ রঙের ফতুয়া পরতে দেখা যায়, এছাড়া বাদবাকি সবকিছুই নীল। পৃথিবীর বেশিরভাগ সংস্কৃতিতে নীল বিষাদ এবং একাকীত্বের রঙ এবং নীল প্রাইমোডিয়াল পর্নোগ্রাফিরও রঙ। অপরদিকে হলুদকে বেশিরভাগ অর্থে শিশুসুলভ আনন্দের জায়গা থেকে দেখা হলেও অনেকক্ষেত্রেই এই রঙ কাপুরুষতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা, লোভ, প্রতারণা, সতর্কতা এবং ভয় বোঝাতে ব্যবহার হয়। রেহানা মরিয়ম নূরের এই রঙ সিলেকশানকে আমি অনিচ্ছাকৃত বা কাকতালীয় বলে মনে করি না। একটা পচাগলাকুৎসিত পর্নোগ্রাফিক সিস্টেমকে, সেই সিস্টেমে বাস করা প্রতিটা চরিত্রের অসহায়ত্বকে, একটা সামগ্রিক বিষাদগ্রস্থতাকে, একটা চিরকালীন ‘রাত্রি’কে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নীলের চাইতে উপযুক্ত রঙ আর হতে পারে না। এই ধরণের নীল রঙ, মুড লাইটিং বা রঙের তাপমাত্রা কমানো দৃশ্য সায়েন্স ফিকশন জনরাতে খুব কমন বিষয়, ভিজুয়াল এবং মেটাফোরিক স্টোরি টেলিং এর মাধ্যমে আমাদের দৃশ্যজগতের বাস্তবতাকে ঘোল খাওয়ানোর জন্য রঙের ফিলোসফি ব্যবহারও ফিল্মের জগতে পুরানো বিষয়। বেঞ্জামিন ক্রিসচিয়ানসন দেখিয়েছিলেন, রঙ কীভাবে আমাদের সামগ্রিক মনস্তত্বতে প্রভাব ফেলে। ‘কিল বিল’ ফিল্মের উমা থারমানের অতি উজ্জ্বল হলুদ জাম্পসুট বা ‘উইজার্ড অভ অয’ এর সাদা-কালো দৃশ্য থেকে ডরোথির টেকনিকালারে প্রবেশ বা ‘মেট্রিক্স’ এর গাঢ় সবুজ টিন্ট যদি হলুদ, রঙিন বা সবুজ না হয়ে খয়েরি, বেগুনি বা গোলাপি হতো, তাহলে কি কিল বিল বা উইজার্ড অভ অয বা মেট্রিক্স দেখে আমাদের একই অনুভূতি হতো? আর রঙ পরিবর্তনের সাথে সাথে যদি আমাদের অনুভূতি পাল্টায়, তাহলে মেট্রিক্স তো আর মেট্রিক্স থাকে না, তখন মেট্রিক্স হয়ে যায় সম্পূর্ণ অন্য একটা ফিল্ম। আমার অতি প্রিয় ফিল্ম ‘এমিলি’তে কমপ্লিমেন্টারি লাল-সবুজ কালার স্কিম ব্যবহার হয়েছিলো। এই লাল-সবুজের ব্যালেন্স এবং ডিসকর্ডের যে হারমোনি, সেটা পালটে ফেলে তাকে সাদা-কালো বানালেও এমিলি আর এমিলি থাকে না, এমিলি হয়ে যায় অন্য কোনো বস্তু। আবার ‘ব্লু ইয দা ওয়ার্মেস্ট কালার’ এ নীল রঙের ব্যবহার বিষাদ অর্থে ব্যবহার হয়নি, বরং নীল সেখানে সম্পর্ক বা প্রেম অর্থে ব্যবহার হয়েছে। এইক্ষেত্রে নীলের জায়গায় লাল রঙ ব্যবহার করা হলে এই ফিল্মের সম্পূর্ণ এ্যাটমোস্ফেরিক আন্ডারকারেন্ট পাল্টে যায়।
তবে শুধু রঙের মাধ্যমে এ্যাটমোস্ফিয়ারের আন্ডারকারেন্ট তৈরি করা না, হ্যান্ড-হেল্ড ক্যামেরায় জার্ক করা ক্লোজ আপ শট, তার সিনেম্যাটোগ্রাফি, সাউন্ড মন্তাজের কাজও রেহানা মরিয়ম নূরকে রেহানা মরিয়ম নূর বানিয়েছে। ক্লোজ আপ শটের অতি ব্যবহার অনেকক্ষেত্রেই বিরক্তিকরভাবে খুব ক্লিশে সন্দেহ নাই, কিন্তু এইক্ষেত্রে ক্লোজ আপের ব্যবহার আবশ্যিক ছিলো। ক্লোজ আপ শট যেকোনো দৃশ্যে ইমোশান এ্যাড করে। ক্লোজ আপ শটে আমরা রেহানার মুখ, মুখের অভিব্যক্তি, তার কান্না, তার রাগ, তার ক্রোধ ছাড়া আর কিছুই দেখি না। এবং তা দেখার আমাদের প্রয়োজনও নাই। আমাদের জানা জরুরী না এখন রাত নাকি দিন। আমাদের জানা জরুরী না রেহানার আশেপাশে কী হচ্ছে। আমাদের দেখা জরুরী না ইমুর স্কুলের সহপাঠীর বাবা মা কেমন দেখতে। আমাদের দেখার একমাত্র বিষয় রেহানা। এবং তার মাথার ভেতরের একটানা স্ট্রাগল। এই ফিল্মের আমার সবচাইতে প্রিয় ক্লোজ আপ শট হচ্ছে, রেহানা বাথরুমে ঢুকে মুখে পানি দিচ্ছেন। আমি যখন ভাবছি, এখন হয়তো পানি দেওয়া থামবে, তখনও উনি একের পর একের পর একের পর একের পর একের পর একের পর এক পানির ঝাঁপটা দিয়ে যাচ্ছেন মুখে। এবং তারপরেও সেই পানি দেওয়া থামছে না। একইসাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে ট্রেনের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিন্তু মেডিকেল কলেজের মাঝখানে কোথা থেকে ট্রেইন আসলো, এই প্রশ্ন করার উপায় নাই আপনার।
ওয়াল্টার মুর্চ বলেছিলেন, দৃশ্যের চাইতেও শব্দ গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেছিলেন, “আমরা জন্মের আগেই শুনতে শুরু করি, গর্ভধারণের সাড়ে চার মাস পরেই। সেখান থেকে আমাদের অবিচ্ছিন্ন ঐশ্বর্য্যময় শব্দস্নান শুরু হয়- আমাদের মায়ের গলার স্বর, তার নিঃশ্বাসের ধাক্কা, তার অন্ত্রের বাজনা, তার হৃদপিণ্ডের দ্রিমদ্রিম শব্দের ভেতরে। জরায়ুর অন্ধকারের বদ্ধ জলাশয়ে যেখানে দৃশ্য এবং ঘ্রাণ অসম্ভব, যেখানে স্বাদ একরঙা এবং স্পর্শ শুধুমাত্রই যা আসছে তার ভোঁতা ও সরলীকৃত অপেক্ষা, সেখানে দ্বিতীয় সাড়ে চার মাস থেকে শব্দ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে একক সম্রাজ্ঞীর মতো” (মুর্চ, ১৯৯৪)
আমি নিজে যদিও এই নিয়ে কনফিউজড। শব্দ দিয়ে আমরা চিন্তা করি সত্য, কিন্তু সেইক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, তাহলে যেই মানুষ কানে শুনতে পান না, তিনি কি চিন্তা করেন না? আবার এটাও ভাবি, চিন্তা যদি শব্দের আগে তৈরি হয়, তাহলে সেই চিন্তাকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব কিভাবে? আর যেই মানুষ দেখতে পান না এবং শুনতেও পান না, তিনি কি চিন্তা করতে পারেন না? আমরা কি দেখার আগে শুনি, না শোনার আগে দেখি? পৃথিবীতে ঈশ্বর যখন বলেছিলেন, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ তখন কি তার কথা আগে শোনা গিয়েছিলো নাকি আলো আগে দেখা গিয়েছিলো, ‘কুন’ শব্দ আগে উচ্চারিত হয়েছিলো নাকি কেন্দ্রীভূত কসমসের সিঙ্গুলারিটির সূত্রে বিগ ব্যাং এ বিচ্ছুরিত আলো প্রথম দেখা গিয়েছিলো? আচ্ছা, ডিগ্রেস নাহয় আপাতত নাই করলাম। তাই মুর্চের শব্দ বনাম দৃশ্য যুদ্ধে আপাতত গেলাম না। এবং সেখানে না গিয়েও আমি বলতে পারি, শব্দ গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো দৃশ্যের সমান, এবং হয়তো কিছুক্ষেত্রে দৃশ্যের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্রেঁসোর ফিল্মে যেভাবে আমরা শব্দ দিয়ে ফিল্ম দেখি। একটা ফিল্ম সিনেম্যাটিক হোরাইজনের ক্ষেত্রে তার Mise en Scène কে অতিক্রম করে গেলে শব্দ ছাড়া দুই দৃশ্যের ফাঁককে অতিক্রম করার আর কোন্ বিষয় থাকতে পারে? ‘আ ম্যান এসকেইপ’ এ জার্মান অফিসার যখন ফন্তানের মাথায় পিস্তল দিয়ে বাড়ি দিচ্ছেন, তখন আমরা দৃশ্যে ফন্তানের মাথা বা পিস্তলের কিছুই দেখি না, বরং শুনতে পাই মাথার খুলির সাথে ধাতব কিছু বাড়ি খাওয়ার কর্কশ কুৎসিত শব্দ। এটাই একমাত্র ‘দৃশ্য’ না; ফন্তানের নিঃসঙ্গ কারাবাসের প্রায় পুরো ছবিই ব্রেঁসো শব্দ দিয়ে এঁকেছেন- দরজার ওপাশে কারারক্ষীদের পায়চারির প্রতিধ্বনি, পাথরের দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়া শিষের সুর, তালায় চাবি ঘোরানোর ক্যাঁচক্যাঁচ, মেশিন গানের গুলিতে বন্দীদের মৃত্যু- এর কোনোটাতেই ভিজুয়ালি আমরা কারারক্ষী বা বন্দীদের বা তাদের গুলি খেয়ে মরার দৃশ্য দেখিনি, বরং মেটালিঙ্গুয়িস্টিক্যালি আমরা সেই দৃশ্য ‘অনুভব’ করেছি। রেহানার ইন্টারনাল মনোলগও আমরা মেটালিঙ্গুয়িস্টিক্যালি শুনেছি ট্রেইনের তীব্র ঝমঝম শব্দে, তার মাথার ভেতরের বাজারের হট্টগোলে, যেন আমরা তার নিউরোলজিকাল ভাইব্রেশান দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।
এই ফিল্মে কথা, অর্থাৎ সংলাপ সামান্যই। যে ক’টা সংলাপ আছে, তার প্রতিটাই ফিল্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আরেফিন যখন রেহানাকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি দেন, তখন রেহানা তাকে জিজ্ঞেস করেন, অভিযোগ তুলে না নিলে কী হবে? তাকে রেইপ করা হবে? তখন আরেফিন উত্তর দেন, “সব মেয়েরা রেইপড হয় না। শুধু তোমার মতো মেয়েরাই রেইপড হয়।”
এই ‘তোমার মতো মেয়েরাই রেইপড বা ধর্ষিত হয়’ ডায়লগ ধর্ষণ যে শুধুমাত্র একটা যৌন নির্যাতন না, তা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়। ধর্ষণে যৌন অবদমনের চাইতেও পাওয়ার পলিটিক্স গুরুত্বপূর্ণ। এত (সুন্দরী) মেয়ে থাকতে অমুকে কেন ধর্ষিত হলেন, এটা বাংলাদেশের মতো ধর্ষণ-ফ্রেন্ডলি রাষ্ট্রে খুব পরিচিত ডায়লগ। নিশ্চয়ই ধর্ষিতর চরিত্রে সমস্যা আছে, নিশ্চয়ই তার পোশাক ঠিক নাই, নিশ্চয়ই তিনি ঐ ধর্ষককে নিজের আচরণে কাছে ডেকে এনেছেন, নিশ্চয়ই ধর্ষণের দায় ধর্ষিতর নিজের- এই ধরণের চিন্তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরুর চিন্তা। এবং সেই ধর্ষিত যদি রেহানার মতো জেদী দুর্বিনীত ঘাড়ত্যাড়া চরিত্র হন, তাহলে ধর্ষণ ঠেকানো যে রেহানার চোদ্দগুষ্টির সাধ্য না- তা বলার মাধ্যমে নারী বনাম পুরুষের ক্ষমতার লড়াইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে ঐ দৃশ্যে। অর্থাৎ ধর্ষিত না হতে চাইলে নারীকে চুপ থাকতে হবে, ধর্ষিত না হতে চাইলে নারীর গলার স্বর নিচু থাকতে হবে, ধর্ষিত না হতে চাইলে নারীর জেদ থাকা চলবে না- আরেফিনের ঐ বক্তব্য মূলতঃ পৃথিবীর তাবত পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের বক্তব্য। আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ ছিলো (ছিলো মানে এখনও আছে সম্ভবতঃ)- ‘পুরুষের রাগে হয় বাদশা, নারীর রাগে হয় বেশ্যা’। আমি ধারণা করি, বাংলাদেশের নিরানব্বই দশমিক নয়নয়নয়নয় শতাংশ মানুষ এই প্রবাদ বিশ্বাস করেন। আর বেশ্যাবাড়িতে যিনি যান, তার কোনো দোষ না থাকলেও বেশ্যা হওয়া যেহেতু ‘দোষের’- তাই সকল নারী জ্ঞানতঃ বেশ্যা না হওয়ার সামাজিক প্রক্রিয়ায় রেহানার মতো নিজেদের রাগ প্রকাশ না করে তা গিলে খেয়ে হজম করে ফেলতে অভ্যাস করে ফেলেন ছোটোবেলায় ইমুর বয়সেই।
রাগের মতো সাধারণ মানবিক অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ একজন নারীর জন্য যে সমাজে নাই, সেই সমাজে পেটের ভিতর তীব্র ক্ষোভের, তীব্র কষ্টের, তীব্র অভিমানের বারুদের বস্তা গর্ভে ধারণ করা রেহানার মতো একেকজন নারী কিভাবে অতি বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক পুরুষে পরিণত হন, তা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। নারীর উপর এই সামাজিক মানসিক অত্যাচারের ম্যাগনিচিউড কতখানি ভয়ংকর, তা রেহানার চোখেমুখে দেখা যায়। রাগ প্রকাশের অক্ষমতা থেকে তৈরি হওয়া অক্সিমোরোনিক ধ্বংসাত্মক রাগ তার প্রতি কথায় ফুটে ওঠে। তিনি টের পান, তিনি লুপহোলে আটকা পড়েছেন, তিনি একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তিনি জানছেন, এর থেকে বের হওয়ার পথ তার জানা নাই, তার পরেও তিনি যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, নিজের ভুলের খেসারত তার কাছের মানুষদের দিতে বাধ্য করছেন।
তার কাছের মানুষরা তাকে কতদূর বোঝেন, তা এখানে স্পষ্ট না। তার ভাই রনির সাথে তার সম্পর্ক টাকা আদানপ্রদানে সীমাবদ্ধ। কন্যা ইমুর সাথে তার অনেকখানিই লাভ-হেইটের সম্পর্ক। ইমু তাকে বিশ্বাস করেন, ভালোবাসেন, তার উপর নির্ভর করেন বোঝা যায়, আবার একইসাথে তিনি মা’কে ভয় পান, কিছুক্ষেত্রে হয়তো ঘৃণাও করেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি আমাকে এখন শাস্তি দেবে, মা?”
রেহানা মরিয়ম নূরের প্রতিটা ক্যারেক্টারের ক্যারেক্টার আর্কে এই বৈপরীত্য খুব সহজভাবে ধরে ফেলা যায়। আরেফিনের সাথে এ্যানির সমাজের বিচারে অনৈতিক সম্পর্ক আছে, হয়তো তিনি এ্যানিকে যৌন নিপীড়ণও করেছেন, কিন্তু আরেফিনকেও এ্যান্টাগোনিস্টের জায়গা থেকে সম্পূর্ণ ঘৃণা করা সম্ভব হয় না। কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের মাধ্যমে রেহানা যখন চূড়ান্ত অপমানিত হন, তাকে বাধ্য করা হয় অভিযোগ তুলে নিতে, তখন আরেফিন এসে রেহানার কাছে ক্ষমা চান। ঐ অভিযোগের জন্য না, বরং ছাত্র ছাত্রীদের রেহানার বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া যে তার আইডিয়া ছিলো, তা স্বীকার করে তিনি ক্ষমা চান।
একই বিষয় কলেজের প্রিন্সিপাল ভদ্রমহিলার ক্ষেত্রেও। তিনিও আপাদমস্ত টেক্সট বুক ভিলেন বা আপাদমস্তক টেক্সট বুক হিরো না। তিনি সমাজের একজন সাধারণ চরিত্র, এইক্ষেত্রে একজন হিন্দু নারী চরিত্র, যিনি মাথায় এক বিপুল পরিমাণ ডুয়ালিটি নিয়ে বাস করেন।
এই ডুয়ালিটি, ইনার-আউটারের ডাইকোটমি এই ফিল্মের অন্যতম প্রধান ন্যারেটিভ। এবং শুধুমাত্র দৃশ্য বা সংলাপ দিয়ে এই ন্যারেটিভ তৈরি হয় নি। বরং শব্দ এবং নৈঃশব্দের ব্যালান্সে আমাদের দেখার জগত বনাম শোনার আর অনুভবের জগতের মধ্যকার মিথ্যাচার এই ফিল্মে নাই হয়ে আসে। রডিন বলেছিলেন, “ছবি মাত্রই মিথ্যা” আর সে কারণেই সম্ভবতঃ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদকে ছবির চাইতেও শব্দকে এই ফিল্মে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করতে দেখা- আই মিন- শোনা গেছে। শব্দদৃশ্যের মন্তাজে আমি রেহানার মেকিং এ আলেহান্দ্রো গোনজালেৎস ইনারিতুর ‘রেভানেন্ট’ এর প্রত্যক্ষ ছাপ দেখি। রেভানেন্টের আমার খুব প্রিয় একটা ক্লোজ আপ দৃশ্য এমন- তীব্র ঠাণ্ডায় প্রায় নীল হয়ে যাওয়া একটা ভাঙাচোড়া অতি রূক্ষ চেহারায় দাঁড়িগোঁফভুরু নাক থেকে বের হওয়া পানি সবই জমে বরফ হয়ে যাওয়া হিউ গ্লাস চরিত্রে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ফিটসজেরাল্ডের দিকে। ফিটসজেরাল্ডতার সন্তানের খুনি। আর কিছুক্ষণ পরেই ফিটসজেরাল্ডকে তিনি খুন করবেন। কিন্তু গ্লাসের চোখের দৃষ্টিতে সন্তানের খুনির প্রতি ঘৃণার অস্তিত্ব ছিলো না, তার চোখে, এবং চোখের ভেতর দিয়ে তার মনের নিরাসক্ততা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। যেন এই যে, এতো এতো এতো লম্বা একটা যাত্রা, যার সূত্রপাত ভয়ংকর প্রতিহিংসায়, সেই যাত্রা নিয়ে গ্লাস প্রশ্ন করছেন, যেন নিজেকেই তিনি প্রশ্ন করছেন, যেন তিনি ভাবছেন, এর পরে কী? ডি ক্যাপ্রিও আমার পছন্দের অভিনয়শিল্পী ছিলেন না, কিন্তু গ্লাস চরিত্রে অভিনয়ের পর তাকে আমি আমার প্রিয় শিল্পীদের ‘অলমোস্ট’ পারমানেন্ট তালিকায় যুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
না, রেহানা চরিত্রে আজমেরি হক বাঁধনের অভিনয়কে আমি ডি ক্যাপ্রিওর সাথে তুলনা করবো না। বাঁধনের অভিনয় নিয়ে আমি খুঁত ধরবো না, কিন্তু তারপরেও বলবো, বিরক্তি বা রাগ প্রকাশ নিরাসক্ততা প্রকাশের চাইতে সহজ কাজ। না, ডি ক্যাপ্রিওর স্ট্যান্ডার্ডেও আমি বাঁধনকে বিচার করতে বসি নাই, কার কাজ কত কঠিন এবং সেই কঠিনতা বিচারের মাপকাঠি দিয়ে আমি শিল্পীর মান নির্ধারণ করছি না। শুধু বলছি, ডি ক্যাপ্রিওর ক্ষেত্রে কিছু না বলে অনেক কিছু বলে ফেলার যে মুন্সিয়ানা, তা বাঁধনের ছিলো না। এবং হয়তো সেটা পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী সম্ভবও না।
অভিনয়, এই ফিল্মের দুর্বলতম অংশ। আর সেটা বলতে হচ্ছে শুধুমাত্র অন্যান্য সবগুলি ক্ষেত্রে রেহানা মরিয়ম নূর এতো বেশি উচ্চতায় উঠেছে, এতো বেশি মেটাফোরিকাল সাটেলটি তৈরি করেছে, এতো বেশি ডেপথে যেতে পেরেছে যে অন্যক্ষেত্রে যেখানে আমি এই অভিনয়ের জন্য দশে সাড়ে আট রেটিং দিতাম, সেখানে আমি অভিনয়কে আন্ডার মাইক্রোস্কোপে নিয়ে এসে দশে সোয়া পাঁচ দিচ্ছি।
গতকাল রাতে গায়ত্রী বলছিলেন, এই ফিল্মকে ফিল্ম স্কুলের পাঠ্য করা উচিত। আমি সেই বক্তব্যের সাথে কতদূর একমত সেটা নিয়ে নিশ্চিত না, তবে আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এই ফিল্ম বাংলাদেশের ফিল্ম মেইকিং এ মাইল-ফলক হয়ে থাকবে। একজন ব্যক্তি পুরুষ হিসাবে একজন নারীর অন্তর্দ্বন্দ্ব এইভাবে সম্ভবত বাংলা ফিল্মের ইতিহাসে সাদের আগে আর কেউ তুলে আনতে সমর্থ হননি। ঋতুপর্ণ ঘোষ চরিত্রের মনস্তাত্বিক ন্যারেটিভে ‘বস’ ফিল্মমেকার ছিলেন, কিন্তু এমনকি তার কোনো চরিত্রকেও এতো কমপ্লেক্সিটির ভিতর দিয়ে যেতে দেখা যায় নি। ‘অন্তরমহল’ এর রক্ত-পানিতে একাকার হওয়া মহামায়া চরিত্র বা ‘চিত্রাঙ্গদা’তে মণীপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার পুরুষের বেশে নারী চরিত্রের দ্বৈততা রেহানার কমপ্লেক্সিটির কাছে এসে মার খেয়ে যায়। সম্ভবতঃ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর উপর এই নিরন্তর নিঃশব্দ জুলুমকে রক্তে অনুভব না করলে, সামাজিক ভারবাহী গাধা চরিত্রে নারীর রাগে রূপান্তরিত হওয়া তীব্র অভিমানকে শরীর দিয়ে স্পর্শ না করলে এমন ফিল্ম বানানো সম্ভব হয় না।
এই ফিল্মের জন্য আমি রাইটার-ডিরেক্টার আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, সিনেম্যাটোগ্রাফার তুহিন তমিজুল, সাউন্ড এনজিনিয়ার সায়বা, কালারিস্ট চিন্ময়কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিবো। রেহানা চরিত্রে বাঁধন এবং ইমু চরিত্রে আফিয়া জাহিন জাইমা সুন্দর অভিনয় করেছেন সত্য, কিন্তু রাইটার ডিরেক্টার সিনেম্যাটোগ্রাফার সাউন্ড এনজিনিয়ার কালারিস্টের মুন্সিয়ানার কাছে, শব্দ দৃশ্য রঙ গল্প বলার ঢঙের সাটেলটির কাছে সেই অভিনয় তেমন কিছু বড়ো কাজ হয় নি, অন্ততঃ আমার বিবেচনায়।
আমি দর্শকদের হলে গিয়ে রেহানা মরিয়ম নূর দেখতে অনুরোধ করবো। কোনো প্রিকনসেপশান, প্রেজুডিস না রেখে, ভালো খারাপের সরলীকৃত বাইনারিতে মানুষকে বিচার করার নির্বুদ্ধিতায় না গিয়ে ফিল্ম ফর ফিল্ম সেইকে এই ‘ফিল্ম’ বুঝতে মানুষকে অনুরোধ করবো। শেষ অনুরোধ করবো, এই ফিল্ম দেখে ‘আমরা ইহা হইতে কী শিখিবো’ জাতীয় নির্বোধ প্রশ্ন না করতে। কারণ সেই প্রশ্ন শোনার সাথে সাথে আমার কচুগাছের সাথে গলায় দড়ি দিয়ে সেই দড়িতে আগুন ধরিয়ে বুড়িগঙ্গার কালো পানিতে ডুবে মরে মঙ্গল গ্রহে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হবে। ফিল্ম তো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না, ফিল্মের দায় নাই মানুষকে শুদ্ধ বানানোর, ফিল্ম এমনকি কোনো ‘এখানে শুরু হয়ে এখানে শেষ হবে’তে আটকানো কোনো গল্প বলার সারওয়ার ফারুকিয় নাটক না, ফিল্ম শুধুমাত্রই ভিজুয়াল আর্টের সর্বোচ্চ অবস্থানে বসে থাকা একটা শিল্প মাত্র। আর সেই শিল্প কী বস্তু, উহা খায় না মাথায় দেয়, তা রেহানা মরিয়ম নূরের আগে বাংলাদেশের ফিল্মের ইতিহাসে খুব খুব খুব কম ফিল্মমেকার দেখাতে পেরেছেন।
রেহানা মরিয়ম নূরকে অভিনন্দন।
নাদিয়া ইসলাম
লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।
এযাবৎ পড়া সবচেয়ে ভালো রিভিউ, রেহানা মরিয়ম নূর এর।
thanks for TAKING medicine for allergy OF HIJAB BEFORE WRITING THIS review.some ultra progressives
THINK RMN IS NOT worth OF review BECAUSE REHANA wears hijab.these KOLKATA ( INDIA) facing COMMUNITY
in BANGLADESH ARE VERY sad “WHY
AND HOW A HIJABI Bangladeshi movie WENT TO cannes AND acclaimed BY connoisseurs!! it IS STILL A pain in THEIR arse
সাউন্ড ডিজাইনার এর নাম শৈব তালুকদার। সংশোধন করবেন প্লিস।