।। সুমিতাভ ঘোষাল।।
মানবজমিন
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে
মানুষ বডি হয়ে গেলে
সকলেই তার জয়ধ্বনি করে
আর চেষ্টা করে দেখবার
কোথা দিয়ে প্রাণটা বেরুলো
নাক না মুখ না পায়ূ
কে যে কোনদিকে তাকায়
ঠিক বোঝা যায় না
তবে একথা ঠিক, মানুষ জন্মালে
কেউই মুখের দিকে তাকায় না
প্রথমেই তাকায় জননাঙ্গের দিকে
শিশ্ন না যোনি ?
তারপর হাত পা নাক মুখ
বাবার মত না মায়ের মতো
চার অক্ষরের কাঙাল
চার অক্ষর বললেই
রহস্য সঙ্কুল জঙ্গলের কথা ভাবো
অর্থাৎ অরণ্যানী—
অথবা ভগবানের কথা
মহাবিশ্বের কথা
চার অক্ষর বললেই
জলরাশির কথা ভাবো
নয়নিকা অথবা চয়নিকার কথা
কখনও কখনও
চালিয়াতি অথবা জালিয়াতিও ভাবো
কিন্তু তুমি
চার অক্ষর বললেই
আসলে যা ভাবো
আমি তা ভাবি না
নিশাচর ঈশ্বর
গায়ের জোরে তুমি স্বাতী নক্ষত্রকে
স্বর্ণলতা বলে চালিয়ে দিলে
শুধু খেয়াল রাখলে না
কোথায় লুকিয়ে আছে
আরও কত তারার ঝলকানি
ডাইনির ইশারা নিয়ে চোখে
পুরাণকে ইতিহাস বললে
শুধু দেখলে না
কিভাবে ঘাপটি মেরে বসে আছে
রাতজাগা নিশাচর ঈশ্বর
যার ঠোঁট থেকে ক্রমাগত
রক্ত ঝরে পড়ছে
সর্বনাশা
বৃশ্চিক লাবণ্য ছিঁড়ে
যে ছেলেটি হেঁটে আসছে
সর্বাঙ্গে নীল ক্ষত, অক্ষর মহিমা
সে দেখেছে গৃহকোণ ,গৃহস্থের হাঁড়ি কাঠ
ঘর পোড়া গরু আর
জঙ্ঘাময় নারীদের চেরা চেরা জিভ
তপ্ত লাভা হাতে নিয়ে কাটিয়েছে রঙিন গুহায়
পারদের অপমান; ফুলেদের রক্তস্রাব
ঝোলা ভরে নিয়ে আসছে
সর্বনাশা ওই ছেলে
নিজেই আগুন আর নিজেই সমিধ
সংবেদী গাছ
তবে সে কি কোনও বিবাগী পাগল
নাকি কোনও সংবেদী গাছ ?
মাথা নেই
প্রত্যঙ্গ দিয়ে বুঝে নিচ্ছে সব
বোঁটায় ধবল ফুল , তীব্র ঋতু
আমরণ আহ্নিকে ঘোরে
তুমি কোন প্রাচীন সাধক
এসেছ মনের খোঁজে?
সুফি আর গারদতন্ত্র
জানো কিছু?
অভিশপ্ত মায়াবিনী জড়িবুটির কথা
কবীরের দোঁহা আর লালনের বাণী
ধুয়ো ওঠার মত
হা হতোস্মি হা হতোস্মি
এত কিছু, এত কিছুর পরেও
শিকড় জেনেছে শুধু
চুপ করে কেন আছে হংসধ্বণিটি
মুহূর্তের জীবন
ওইসব ধাতুর মনোলগে
কোনও মেসেজ থাকে না
মিশে থাকে জল রং আলো
এই যে ইজি চেয়ারটা দুলছে
সেটা কি হাওয়ায়
নাকি তুমি এসে বসেছ
আমি দেখতে পাচ্ছি না
একটা পাখি একটানা ডাকছে
টি টি টি টি
মনে পড়ল, কে যেন বলেছিল
পাখিদের জোড় চট করে ভাঙে না
ওরা জোড়া জোড়াই থাকে
মুহূর্তের জীবন
এই কথা নাকি পাখিরাও জানে
টাইপো
অভিজ্ঞতার আঁচড় খেতে খেতে
বিস্ময় আর শোকও একদিন ভোঁতা হয়ে যায়
কিন্তু তা ভাল না খারাপ
সেটা ঠিকমতো বোঝা যায় না
গলদঘর্ম, পাগলাঝোরা – এইসব বাদ দিয়ে
কতবার যে ‘আমি’ শব্দটা লিখলাম !
অথচ সমস্ত ভালোবাসার শুরু
আক্ষরিক অর্থে স্বয়ংক্রিয় ছিল
শেষটাও কি তাই?
এত এত প্রিয়মৃত্যু পেরিয়ে এসে
আজ আর তা মনেও পড়ে না
মৃগনাভি স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে বোধহয়
অভিজ্ঞতার ঘষা খেতে খেতে
নদীটাও কেমন যেন উদাস বিমুখ
নদী? নাকি আমার ন্যাবা-হওয়া চোখ ?
প্রকোষ্ঠ খুলেই দেখি
অধরা আধফোটা আত্মারা ছটফট করছে
ওরা আলো দেখতে চায়
ওই নিষ্পাপ মুখ
ওই না-ধরা লিঙ্গ
আর ওই জরুল দেখব বলে
যতবার আমি জন্ম লিখি
টাইপোতে সেইটাই মৃত্যু হয়ে যায়
খেলা
সবটাই যেন কাটাকুটি খেলা
প্রতিটি ফাঁকা প্রকোষ্ঠেই
আগে থেকে শূন্য দেওয়া আছে
কী প্রেমে ! কী রণে !
অথচ হরিদাস জেগে আছে প্রাণপণ
যেন দৈববাণী আসবে
তালকানা হরিদাস ঠিক খুঁজে পাবে
তার কাঙ্খিত বাঁশবন
বাঁশের বাঁশির সুরে সুরে
সে ভরিয়ে তুলবে আকাশ বাতাস
কিন্তু সে জানে না
ধ্বনি মূর্চ্ছনার রতিমগ্নতা
কখনও দৈববাণীর মতো
নিস্তব্ধ নিরূপম হয় না
শূন্য থেকে ক্রমাগত
কাটাকুটি খেলা হয়ে যায়
প্রচ্ছদের ছবি: অতনু সিংহ
সুমিতাভ ঘোষাল
জন্ম ২৫সেপ্টেম্বর, ১৯৬১, মোট একক কবিতার বই আটটি । পশ্চিমবঙ্গে আটের দশকের কবি। বসবাস কলকাতায়। সম্পাদিত বই দুটি । তসলিমা নাসরিনের ওপর একটি ইংরেজি বই । ‘পদ্য গদ্য সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন । ‘বসুমতী পত্রিকা’ এবং ‘মাসিক কবিতা পত্র’র সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন । বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন ।