রাজনৈতিক রুহানিয়াত প্রসঙ্গে

।। পারভেজ আলম।।

রুহ কথাটির ব্যাখ্যা করতে নামলেও, প্রাণ কথাটির কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা হাজির করা এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। নিঃসন্দেহে প্রাণ ধারণাটি প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত বহুল আলোচিত একটি ধারণা হলেও এর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের অভাব নাই। আধুনিক যুগে মূলত জীববিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রই প্রাণের সুনির্দিষ্ট ও বাধাধরা সংজ্ঞা নিয়ে বেশি চিন্তিত। অথচ এই দুই শাস্ত্রেই প্রাণের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক আছে। ভাইরাসের মতো অপ্রাণ সত্তা জীববিজ্ঞানকে ধন্ধে ফেলে দিয়েছে খোদ প্রাণের সংজ্ঞা নিয়েই। অথবা লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম, এবরশন ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে জীব বিজ্ঞান ও আইন – উভয়কেই এই প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই – প্রাণের শুরুটা কোথায়, শেষই বা কোথায়? কিন্তু আগেই বলেছি, রুহ বা প্রাণের কোনো আধ্যাত্মিক ও অশরীরী ধারণা নিয়ে আলাপ করা এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। এই লেখার মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াতও তেমন কোনো আধ্যাত্মিক বা অশরীরী বিষয় না।

রাজনৈতিক রুহানিয়াত প্রসঙ্গে

‘রুহ’ কথাটির দুইটা অর্থ আছে। প্রথমত, এর মাধ্যমে বস্তুগত একটা কিছুকে বোঝানো হয় যা আমাদের হৃৎপিণ্ডে থাকে, এবং যা আমাদের ধমনির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং পুরো দেহকে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো স্পন্দিত রাখে। একে ডাকা হয় “প্রাণ” বলে।
আল গাজালি

গাজালি রুহ সম্বন্ধে এই আলোচনাটুকু করেছেন এহইয়াউ উলুমিদ্দীন বইটির তৃতীয় খণ্ডে (৮)। তবে রুহের এই বস্তুগত অর্থ নিয়ে তিনি আলাপ তেমন আগান নাই। কয়েক বাক্য পড়েই লিখেছেন যে “এ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু না”। বরং, তার আলাপের বিষয়বস্তু রুহের সেই অর্থ নিয়ে যা দেহস্থিত নয়, বরং অশরীরী একটা কিছুকে নির্দেশ করে। এমন দাবি করা যেতে পারে যে গাজালির লেখাতেও এই বিভাজন মূলত একটা কেজো বিভাজন, কোনো কংক্রিট বাস্তবতার বর্ণনা নয়, তবে সেই আলাপ এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমাদের এই লেখার উদ্দেশ্য গাজালির উদ্দেশ্যের বিপরীত, অর্থাৎ রুহের দেহস্থিত ও বস্তুগত অবস্থা নিয়ে তত্ত্বতালাশ করা। তাও গাজালির উক্তি দিয়ে এই লেখাটি শুরু করলাম মূলত এই কারনেই যেহেতু আমাদের সমাজে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করা আইনজ্ঞ আলেম সমাজের কাছে গাজালি এখনো একজন অথরিটি। এবং তার মতো একজন ঐতিহ্যবাহী সুন্নি পণ্ডিতও যে রুহের দেহস্থিত ও বস্তুগত রূপকে স্বীকার করতেন, তা উল্লেখ করে আমার আলোচনাটা সামনে আগানো সুবিধাজনক হবে বলে মনে করি।

গাজালির জন্যে এই ব্যাপারটা খুবি স্বাভাবিক ছিল, যেহেতু তার আবির্ভাব ঘটেছিল এমন একটা সময়ে যেই সময়টিকে দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চায় ইসলামী স্বর্ণযুগ বলে ডাকা হয়। সময়টা ছিল আল কিন্দি, ইবনে সিনা ও আল ফারাবিদের চিন্তার সর্বব্যাপী প্রভাবের একটা যুগ। ইবনে সিনা তার চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত প্রভাবশালী কিতাব “আল কানুন ফিততিব”-এ লিখেছিলেন যে আল্লাহ্‌ হৃৎপিণ্ডের বামদিকটা ফাঁপা বানিয়েছেন যেন তা রূহের ঘর ও কারখানা হতে পারে। এছাড়াও তিনি রূহকে (দম) তৈরি করেছেন নাফসের (আত্মা,প্রাণী) বৃত্তিকে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে কার্যকর করার জন্যে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রূহ হলো সম্ভাবনা থেকে বাস্তবতার বিরামহীন খোদায়ী প্রবাহের পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত একটি প্রক্রিয়া”। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে ইবনে সিনার চিন্তায় রুহ যেমন জীবদেহকে চালিত রাখার জ্বালানির ভূমিকা পালন করে, তেমনই তা সম্ভাবনা থেকে বাস্তবতার জগতে বিরামহীন একধরণের অবতরণের ঘটনাও। এছাড়াও রুহকে তিনি হায়াত এবং প্রাণশক্তি (ভাইটালিটি) হিসাবেও ব্যাখ্যা করেছেন। গাজালির তত্ত্বচর্চার অন্যতম একটা উদ্দেশ্য ছিল ধর্মতত্ত্বের কিছু তত্ত্বের উপর থেকে ইবনে সিনাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক-দার্শনিকদের প্রভাব হ্রাস করা, কিন্তু ইবনে সিনাসহ অনেক দার্শনিকের চিন্তাই তিনি অংশত গ্রহণ করেছেন, খারিজ করেন নাই।

বলে নেয়া ভাল যে, রুহ কথাটির ব্যাখ্যা করতে নামলেও, প্রাণ কথাটির কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা হাজির করা এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। নিঃসন্দেহে প্রাণ ধারণাটি প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত বহুল আলোচিত একটি ধারণা হলেও এর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের অভাব নাই। আধুনিক যুগে মূলত জীববিজ্ঞান ও আইনশাস্ত্রই প্রাণের সুনির্দিষ্ট ও বাধাধরা সংজ্ঞা নিয়ে বেশি চিন্তিত। অথচ এই দুই শাস্ত্রেই প্রাণের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক আছে। ভাইরাসের মতো অপ্রাণ সত্তা জীববিজ্ঞানকে ধন্ধে ফেলে দিয়েছে খোদ প্রাণের সংজ্ঞা নিয়েই। অথবা লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম, এবরশন ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে জীব বিজ্ঞান ও আইন – উভয়কেই এই প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই – প্রাণের শুরুটা কোথায়, শেষই বা কোথায়? কিন্তু আগেই বলেছি, রুহ বা প্রাণের কোনো আধ্যাত্মিক ও অশরীরী ধারণা নিয়ে আলাপ করা এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। এই লেখার মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত’ও তেমন কোনো আধ্যাত্মিক বা অশরীরী বিষয় না। রাজনৈতিক রুহানিয়াত কথাটি বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিক সময়ে একটা পরিভাষা হিসাবে হাজির হয়েছে মূলত ফরহাদ মজহারের লেখা ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’ বইটির কারনে, যাতে ফুকোর ব্যবহৃত ‘পলিটিকাল স্পিরিচুয়ালিটি’ ধারণাটিকে মজহার ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত’ হিসাবে অনুবাদ করেছেন। পলিটিকাল স্পিরিচুয়ালিটি ধারণাটি বিখ্যাত হয়েছে মূলত ইরানি বিপ্লব বিষয়ে মিশেল ফুকোর একটি সংবাদধর্মী প্রবন্ধ এবং এর পরবর্তিতে ধারণাটির ব্যাখ্যামূলক একটি সাক্ষাৎকার থেকে। ফুকো ইরানি বিপ্লবকে একটি স্পিরিচুয়াল আন্দোলন বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন দেখে পাশ্চাত্যের সেকুলার সমাজে বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল, এবং ফুকোও পরে তার জবাবে স্পিরিচুয়ালিটি কথাটিকে ধর্মীয় ব্যঞ্জনা থেকে যথাসম্ভব আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন এই আলোচ্য ইন্টারভিউটিতে। ফরহাদ মজহারও লিখেছেন, “রাজনৈতিক রুহানিয়াতকে আধ্যাত্মিক বা পরাবিদ্যামূলক ধারণা হিসাবে তিনি (ফুকো) হাজির করতে চান না” (২০৩)। কিন্তু ফুকো এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আসলেই সফল হয়েছেন কিনা, সেই প্রশ্নটা তোলা যেতে পারে।

 আরো বলা দরকার যে, মজহার যদিও মূলত মিশেল ফুকোর ব্যবহার করা ‘পলিটিকাল স্পিরিচুয়ালিটি’ কথাটার বাঙলা অনুবাদ হিসাবে হাজির করেছেন ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত’ ধারণাটি, কিন্তু আমি এই ধারণাটিকে বাংলা ভাষার চিন্তা জগতে সাম্প্রতিক সময়ে হাজির হওয়া একটা নিওলগিজম হিসাবেই পাঠ করতে আগ্রহী। এই নিওলগিজমের অনুপ্রেরণা হতে পারেন ফুকো, কিন্তু ফুকোর তাত্ত্বিকতার মধ্যে একে সংকুচিত করা সম্ভব না। তা করলে, ধারণাটির রাজনৈতিক সম্ভাবনা অনেকখানিই খর্ব হতে পারে। কেননা ফুকো নিজে একটা লেখা ও সাক্ষাৎকারের বাইরে পলিটিকাল স্পিরিচুয়ালিটি ধারণাটি নিয়ে তেমন কোনো আলাপও করেন নাই। অর্থাৎ ফুকোর তাত্ত্বিক জগতে ধারণাটি অবিকশিতই থেকে গেছে। আগেই বলেছি যে ফুকো আদতেই তার হাজির করা স্পিরিচুয়ালিটির ধারণাকে আধ্যাত্মিকতার ধারণা থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন কি না সেই প্রশ্নটি তোলা যায়। কেননা তার সাক্ষাৎকারে ফুকো রিলিজিওন ও স্পিরিচুয়ালিটির পার্থক্যের উপর যে জোর দিয়েছেন, তা আধ্যাত্মিকতার ধারণা বিষয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বকে একরকম স্বীকার করে নেয়। যদিও ফুকো নিজেই আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বকে আপন ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠতে সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু এইক্ষেত্রে, বিশেষ করে ফ্রেঞ্চ সেকুলার সমাজের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে তিনি স্পিরিচুয়ালিটি বিষয়ে আধুনিক ইউরোপিয় জ্ঞানতাত্ত্বিক ঐতিহের প্রতি অনুগতই থেকেছেন। অবশ্য, ফুকো এইক্ষেত্রেও তার স্বভাবসুলভ ইতিহাস সচেতনতামূলক ক্রিটিক ত্যাগ করেন নাই। তাই এমন দাবি তুলতে পেরেছেন যে রেনেসাঁ ও ধর্মীয় রিফর্মেশনের আন্দোলনের পরে ইউরোপ স্পিরিচুয়ালিটি হারিয়ে ফেলেছে (অবশ্য এই সাক্ষাতকারের পরবর্তী অংশে তিনি ইউরোপের কিছু সেকুলার বিপ্লবের মধ্যে স্পিরিচুয়ালিটি হাজির থাকার দাবি করেছেন)।

‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’ বইটির কারনে, যাতে ফুকোর ব্যবহৃত ‘পলিটিকাল স্পিরিচুয়ালিটি’ ধারণাটিকে মজহার ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত’ হিসাবে অনুবাদ করেছেন। পলিটিকাল স্পিরিচুয়ালিটি ধারণাটি বিখ্যাত হয়েছে মূলত ইরানি বিপ্লব বিষয়ে মিশেল ফুকোর একটি সংবাদধর্মী প্রবন্ধ এবং এর পরবর্তিতে ধারণাটির ব্যাখ্যামূলক একটি সাক্ষাৎকার থেকে। ফুকো ইরানি বিপ্লবকে একটি স্পিরিচুয়াল আন্দোলন বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন দেখে পাশ্চাত্যের সেকুলার সমাজে বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল, এবং ফুকোও পরে তার জবাবে স্পিরিচুয়ালিটি কথাটিকে ধর্মীয় ব্যঞ্জনা থেকে যথাসম্ভব আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন এই আলোচ্য ইন্টারভিউটিতে। ফরহাদ মজহারও লিখেছেন, “রাজনৈতিক রুহানিয়াতকে আধ্যাত্মিক বা পরাবিদ্যামূলক ধারণা হিসাবে তিনি (ফুকো) হাজির করতে চান না” (২০৩)। কিন্তু ফুকো এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আসলেই সফল হয়েছেন কিনা, সেই প্রশ্নটা তোলা যেতে পারে।

আধুনিক ইউরোপের একাডেমিক জ্ঞানতত্ত্ব যেমন রিলিজিওন ও সেকুলারের বাইনারির উপর নির্ভর করে ধর্মের ধারণা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে, তেমনি রিলিজিওন থেকে স্পিরিচুয়ালিটি, মিস্টিসিজম, ম্যাজিক ইত্যাদি ধারণাকেও আলাদা । উত্তর কাঠামোবাদ ও নয়া ইতিহাসবাদী চিন্তাচর্চার প্রভাবে সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যের রিলিজিয়াস স্টাডিজ বিভাগগুলো এই বর্গ নির্মাণের ইতিহাস সম্বন্ধে বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণার ফলে দেখা যাচ্ছে যে রিলিজিওন ও স্পিরিচুয়ালিটির এই বাইনারিটা আসলে গড়ে উঠেছিল প্রটেস্টান্ট ধর্মতত্ত্বের জগতে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মের যথাসম্ভব আক্ষরিক, শাস্ত্রীয় ও পণ্ডিতি ব্যাখ্যাকেই ‘রিলিজিওন’ হিসাবে প্রচার করা। অন্যদিকে সুস্পষ্ট আকিদা ও মজহাবের বাইরে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার এবং জনমানুষের প্রতিদিনকার জীবনের স্বতস্ফুর্ত যে স্পিরিচুয়ালিটি— তাকে বিচ্ছিন্ন করা হলো রিলিজিওনের ধারণা থেকে। মূলত এই প্রটেস্টান্ট ফ্রেমওয়ার্কের উপরেই গড়ে উঠেছিল আধুনিক পাশ্চাত্যের রিলিজিওন সংক্রান্ত ধারণা। এর ফলে আধুনিক পাশ্চাত্যে যেসব নতুন স্পিরিচুয়াল আন্দোলন হাজির হয়েছে, সেইগুলাকে আর রিলিজিওন নামক বর্গের মধ্যে ধরে রাখা যায় নাই। একদিকে শাস্ত্রীয় রিলিজিওন, আরেকদিকে সেকুলার বস্তুবাদ— এই দুই ধারার আধিপত্য ইউরোপের সমাজের বিশেষ কিছু আন্দোলন ও চিন্তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল— স্পিরিচুয়ালিটি, মিস্টিসিজম ও ম্যাজিকাল নামক বর্গের মধ্যে (হানেগ্রাফ ৫৭৬-৬০৫) । এবং এই দুই ঘরানা থেকেই স্পিরিচুয়ালিটি ও মিস্টিসিজমকে মূলত জাদুবিদ্যা, কুসংস্কার ও ভণ্ডামি-বুজরুকি বলে প্রচারণা চালানো হয়েছে। কাছাকাছি রকম ঘটনা ঘটেছে মুসলিম দুনিয়াতেও, যেখানে সালাফিবাদ এবং বস্তুবাদের আক্রমণে সুফি ও কালামি বিভিন্ন ঘরানাগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে গেছে। পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্ব এইদিক থেকে সালাফিবাদী জ্ঞানতত্ত্বের বন্ধুর ভূমিকা পালন করেছে, তবে সেই আলাপ আরেকদিন।

যা বলতে চাচ্ছি, তাহলো যে ফুকো তার সাক্ষাৎকারটিতে “রিলিজিওন ও স্পিরিচুয়ালিটির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রাখা দরকার” বলে এই আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বেরই পুনরুৎপাদন করেছেন। তবে, সেইসাথে তিনি ইউরোপিয় সভ্যতার কেন্দ্র থেকে স্পিরিচুয়ালিটিকে প্রান্তে পাঠিয়ে দেবার ইতিহাস সচেতনতাও হাজির করেছেন, যেই সচেতনতার ক্রিটিকাল মূল্য আজো টিকে আছে। আরো খেয়াল রাখা দরকার যে ফরাসি বিপ্লব এবং বলশেভিক বিপ্লবকেও তিনি স্পিরিচুয়াল বিপ্লবের উদাহরণ হিসাবে হাজির করেছেন। ফুকোর দাবি মোতাবেক বিপ্লবের মধ্যে স্পিরিচুয়ালিটি থাকাই একটা স্বাভাবিক ঘটনা, যেহেতু তার ভাষায় “স্পিরিচুয়ালিটি ছাড়া বিপ্লব ব্যতিক্রম ঘটনা” (১২৭)। সর্বপরি ফুকো ধর্মের ভেতরে ও বাইরে স্পিরিচুয়ালিটির একটি সাধারণ ধারণা হাজির করেছেন, এবং নিজের মতো খানিকটা সংজ্ঞায়িতও করেছেন। এই সংজ্ঞা নিয়ে এই লেখার শেষ দিকে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো।।

যদি ভুল না করি, তবে বাংলা ভাষায় আধ্যাত্মিকতা শব্দটির অর্থও এই আধুনিক ইতিহাসের সাপেক্ষেই বোঝা দরকার, যা অর্থের দিক থেকে আধুনিক ইউরোপিয় জ্ঞানতত্ত্বে হাজির থাকা স্পিরিচুয়ালিটি ধারণাটিরই প্রতিশব্দ। এই দিক থেকে চিন্তা করলে ফুকোর ব্যহার করা স্পিরিচুয়ালিটির বাংলা হিসাবে রুহানিয়াত শব্দটির ব্যবহার একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বটে। তবে, ফুকোর ব্যবহার করা স্পিরিচুয়ালিটি শব্দটার যেমন সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা দুইই আছে, এর প্রতিশব্দ হিসাবে রুহানিয়াত শব্দটির ব্যবহারও এমন দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে হাজির। তবে ফরহাদ মজহারই যে প্রথম স্পিরিচুয়ালিটির বাংলা রুহানিয়াত করেছেন তা না। বাংলা ভাষায় অতীতেও এর উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন, আবুল মনসুর আহমেদ তার আত্মকথায় আধ্যাত্মিকতা অর্থে রুহানিয়াত কথাটির ব্যবহার করেছেন। স্পিরিচুয়ালিটির অনুবাদ হিসাবে রুহানিয়াত শব্দটির ব্যবহারের বিস্তারিত কোনো ইতিহাস আমার জানা নাই। কিন্তু বলা দরকার যে, এই ব্যবহারের ফলে কিছু সংকটও তৈরি হয়। কেননা ইসলামী সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে, এবং ভারতীয় উপমহাদেশেও রুহানিয়াত শব্দটির একটা আলাদা জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাস আছে। বিশেষ করে, ফুকো স্পিরিচুয়ালিটি বলতে যে বৈপ্লবিক রূপান্তরের ইচ্ছা (উইল টু র‍্যাডিকাল অল্টারিটি) তত্ত্ব হাজির করেছেন, তার মধ্যে রুহানিয়াত ধারণাটি সংকুচিত হয়ে এর তাত্ত্বিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়। এই দাবি করছি না যে রুহানিয়াতের তাত্ত্বিক ঐতিহ্যের মধ্যে বৈপ্লবিক রূপান্তরের কোন তত্ত্ব নাই, অথবা ফুকোর স্পিরিচুয়ালিটি এবং ইসলামী ঐতিহ্যের রুহানিয়াতের মধ্যে সম্মিলন, সমঝোতা বা অপবর্তন সম্ভব না। বরং তা সম্ভব। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বর্তমান করার জন্যে রুহানিয়াত সংক্রান্ত তত্ত্বের ইতিহাস সামনে আনার প্রয়োজন। এবং তা আনলে দেখা যাবে যে শুধু ফুকোর তত্ত্বের সাথেই না, বরং সাম্প্রতিক পাশ্চাত্য চিন্তার আরো নতুন কিছু তত্ত্বের সাথেও রুহানিয়াত সংক্রান্ত তত্ত্বের ফলপ্রসূ আদান প্রদান সম্ভব। এবং এই সম্ভাবনার দিকগুলা তুলে ধরাই এই লেখাটির উদ্দেশ্য।

মূলত অবজেক্ট অরিয়েন্টেড অন্টোলজি এবং নিউ মেটারিয়ালিজমের মতো কিছু তাত্ত্বিক বাক সাম্প্রতিক সমাজ বিজ্ঞান ও মানবিকবিদ্যার জগতে অপ্রাণ সত্তার এজেন্সি সংক্রান্ত আলাপকে কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই তাত্ত্বিকচর্চাগুলাতে প্রায়ই দেখা যায় যে অপ্রাণ সত্তার দিকে নজর রাখতে গিয়ে তারা মানুষ সংক্রান্ত আলাপকে আড়ালে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে ইসলামি দর্শন ও তাসাউফের তাত্ত্বিক জগতে অপ্রাণ সত্তার এজেন্সি স্বীকার করে নিয়ে অস্তিত্ববান সবকিছুর (কুল্লি শাই’ইন) মধ্যে বা একটা ‘অর্ডার অফ থিং’-এর মধ্যে মানুষের অবস্থানটি তুলে ধরাই ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য। এ ধরণের তত্ত্বচর্চার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সাথে খোদ খোদা এবং মহাবিশ্বের সকল সত্তার একটা সম্পর্কসূত্র তুলে ধরা, এবং সেইসাথে বহু সত্তার এজেন্সির একটা জটিল নেটওয়ার্কের মধ্যে মানুষের এজেন্সিকে ব্যাখ্যা করা। এসব সত্তার মধ্যে যেমন মানব দেহের বাইরের বিভিন্ন সত্তা ছিল, তেমনই ছিল মানুষের বহুধাবিভক্ত মন বা আত্মার বিভিন্ন ভাগ ও স্তরও।

রুহ শব্দের আক্ষরিক অর্থ দম বা বাতাস, হিব্রু রুয়াখ শব্দের মতোই। ইংরেজি স্পিরিট শব্দের অর্থও তাই। প্রকৃতপক্ষে বাতাস, শ্বাস বা দমের রূপকে প্রাণশক্তির ধারণা তুলে ধরার ঐতিহ্য অনেক পুরাতন, এবং ইন্দো ইউরোপিয় ও সেমিটিক এই দুই ভাষা বংশের ভাষাগুলার মধ্যেই এই রূপকের ব্যবহার পাওয়া যায়। স্পিরিট শব্দটি এসেছে ল্যাটিন স্পিরিটাস থেকে, যার ধাতুগত অর্থও শ্বাস বা বাতাস। এই কারনেই ল্যাটিন বাইবেলে রুহ ধারণাটিকে স্পিরিটাস এবং তার ধারাবাহিকতাতে ইংরেজি বাইবেলে স্পিরিট শব্দে অনুবাদ করা হয়েছে। সেমিটিক ভাষাগুলোর মতো ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষাগুলোতেও আত্মা ও রুহের এই পার্থক্য পাওয়া যায়। ইংরেজি এনিমেল শব্দটির উৎস এনিমা তথা আত্মা। এনিমা এবং আত্মা, দুইটি শব্দের উৎস এক। এবং বলে রাখা ভালো যে ইংরেজি স্পিরিট এবং বাংলা শ্বাস, এই দুইটা শব্দও একই উৎস থেকে আগত, যদিও দীর্ঘ বিবর্তনের কারনে এখন আর মিলটা চোখে পড়েনা।

ইব্রাহিমি ধর্মীয় ঐতিহ্য মোতাবেক, আল্লাহ মাটির তৈরি আদমের নাকে তার রুহ বা দম ফুকে দেয়ার মাধ্যমে এই মাটির দেহে প্রাণসঞ্চার করেছেন। রুহের ধারণাটি তাই ইব্রাহিমি ঐতিহ্যে মানুষের সাথে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের তত্ত্ব নির্মানেও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ক্লাসিকাল ইসলামের যুগে রুহের ধারনাটি খোদায়ি সত্তার সাথে বিশেষ সম্পর্কের সাপেক্ষে আদর্শ মানুষের ধারণা নির্মানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। খ্রিষ্টিয় ঐতিহ্যে ঈসা ও আদমকে একই টাইপ বা ধাঁচের সত্তা হিসাবে হাজির করা হয়েছে (ইব্রানী ১,৬)। কোরানেও এক ধরণের আদম-ঈসা দৃষ্টান্ততত্ত্বের হাজিরা দেখা যায়। যেমন সূরা ইমরানে আছে: “ নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো” (৩,৫৯)। সেই সাথে কোরানে ঈসাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা রুহ ও কালেমা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে (৩.৪৫, ৪.১৭১)। অন্যদিকে সুফিতত্ত্বে, বিশেষ করে ইবনে আরাবীর তত্ত্ব চর্চায় আদম, ঈসা এবং নবী মুহাম্মদকে উল্লেখ করা হয়েছে আল ইনসান আল কামেল বা আদর্শ মানুষের আর্চটিপিকাল উদাহরণ হিসাবে। 

The Creation of Adam: Michelangelo 

 ইসলামি ঐতিহ্যে দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও তাসাউফের আলাদা আলাদা তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে একটা সাধারণ মিল ছিল আল্লাহর অস্তিত্ব থেকে অবতরণ করা প্রথম রুহকে এই আদর্শ মানুষের সাথে তুলনা করা। এই প্রথম অবতরণকে রুহ ছাড়াও, কালেমা/কালাম (লোগোস), কলম, নূর মুহাম্মদ ইত্যাদি পরিভাষার মাধ্যমেও চিহ্নিত করা হতো। রুহের এই ধারণার একটি ইসলামপূর্ব সিলসিলা রয়েছে, যেহেতু কালাম বা রুহ রূপে আদর্শ মানুষের ধারণা খ্রিষ্টিয় বিভিন্ন আকিদা ছাড়াও লেট-এন্টিক দুনিয়ার বিভিন্ন ইব্রাহিমি ঐতিহ্যের মধ্যেও পাওয়া যায়। কিন্তু রুহানিয়াত ধারণাটির বেড়ে ওঠার ইতিহাস সেই তুলনায় অনেকটাই ইসলামের ইতিহাসের অন্তর্গত ব্যাপার, যার প্রভাব পরবর্তীতে পাশ্চাত্য চিন্তায় বিশেষ করে রেনেসার মিস্টিসিজম ও মানবতাবাদের মধ্যে দেখা যায়। আর রুহানিয়াতের ধারনাটি শুরুতে যাদের হাতে গড়ে উঠেছিল, তারা ছিলেন প্রধানত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী । ধর্মতাত্ত্বিক ও সুফিরা পরবর্তিতে ধারণাটিকে নিজেদের মতো করে গড়েপিটে নিয়েছিলেন। তবে দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও সুফিদের তাত্ত্বিক ঐতিহ্যের একটা সাধারণ মিল হলো যে তারা সবাই কম বেশি রুহানিয়াতকে ব্যাখ্যা করেছেন ভাইটাল এজেন্সি তথা প্রাণশক্তি হিসাবে, এবং মানুষ ছাড়াও নক্ষত্র, জড় বস্তু, ভাষা এবং অক্ষরের মধ্যেও রুহানিয়াত বা ভাইটাল এজেন্সি হাজির থাকে বলে তারা প্রচার করতেন।

ইংরেজি এজেন্সি (agency) কথাটি বাংলাদেশের সমাজে মূলত প্রতিনিধিত্ব অর্থে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আধুনিক পাশ্চাত্যের চিন্তা ও তৎপরতার জগতে এজেন্সি কথাটির ব্যবহার করা হয় মূলত ‘স্বাধীন ইচ্ছা’র ধারণা বোঝাতে। আধুনিক পাশ্চাত্যের চিন্তা, রাজনীতি ও আইনের জগতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ধারণাটি বিশেষভাবে স্বীকৃত। মূলত স্বাধীন ইচ্ছার ধারণার উপর নির্ভরশীলতার কারনেই আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তায় মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের এজেন্সির ধারণা উত্তর-আধুনিক মুহূর্তের আগে যথেষ্ট ব্রাত্য ছিল। এবং এখনো তা একটা বিতর্কের বিষয়ই রয়ে গেছে। আর অপ্রাণ সত্তার (পাশ্চাত্যের জ্ঞানতত্ত্ব ও আইন মোতাবেক) এজেন্সি নিয়ে আলাপ আলোচনা তো একেবারেই সাম্প্রতিক ঘটনা। মূলত অবজেক্ট অরিয়েন্টেড অন্টোলজি এবং নিউ মেটারিয়ালিজমের মতো কিছু তাত্ত্বিক বাক সাম্প্রতিক সমাজ বিজ্ঞান ও মানবিকবিদ্যার জগতে অপ্রাণ সত্তার এজেন্সি সংক্রান্ত আলাপকে কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই তাত্ত্বিকচর্চাগুলাতে প্রায়ই দেখা যায় যে অপ্রাণ সত্তার দিকে নজর রাখতে গিয়ে তারা মানুষ সংক্রান্ত আলাপকে আড়ালে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে ইসলামি দর্শন ও তাসাউফের তাত্ত্বিক জগতে অপ্রাণ সত্তার এজেন্সি স্বীকার করে নিয়ে অস্তিত্ববান সবকিছুর (কুল্লি শাই’ইন) মধ্যে বা একটা ‘অর্ডার অফ থিং’-এর মধ্যে মানুষের অবস্থানটি তুলে ধরাই ছিল মূখ্য উদ্দেশ্য। এ ধরণের তত্ত্বচর্চার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সাথে খোদ খোদা এবং মহাবিশ্বের সকল সত্তার একটা সম্পর্কসূত্র তুলে ধরা, এবং সেইসাথে বহু সত্তার এজেন্সির একটা জটিল নেটওয়ার্কের মধ্যে মানুষের এজেন্সিকে ব্যাখ্যা করা। এসব সত্তার মধ্যে যেমন মানব দেহের বাইরের বিভিন্ন সত্তা ছিল, তেমনই ছিল মানুষের বহুধাবিভক্ত মন বা আত্মার বিভিন্ন ভাগ ও স্তরও।

ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও সুফিতত্ত্বের মধ্যে গ্রিক দার্শনিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাও বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। রুহানিয়াত সংক্রান্ত তত্ত্ব গড়ে ওঠার পেছনেও গ্রিক প্রাকৃতিক দর্শন বা তৎকালীন পদার্থ ও রসায়নবিদ্যার (আলকেমি) জগতে প্রভাবশালী প্যারাডাইমগুলো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে। আধুনিক পাশ্চাত্য একাডেমিয়ায় ক্লাসিকাল ইসলামী সভ্যতার বৈজ্ঞানিক চিন্তার সবচাইতে প্রভাবশালী প্যারাডাইমকে নাম দেয়া হয়েছে ‘নিও-প্লেটোনিজম’। এক কথায় বললে, নিওপ্লেটোনিজম বর্গটা দিয়ে এমন এক ধরণের সৃষ্টিতত্ত্ব/বিশ্বতত্ত্ব (কসমোলজি) ও অস্তিতত্ত্ব (অন্টলজি) চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে প্লেটোর ধারণাবাদ ও আধ্যাত্মবাদ, এরিস্টোটলের বস্তুবাদী মেটাফিজিক্স ও ইব্রাহিমি ধর্মীয় ঐতিহ্যের বিভিন্ন চিন্তার নানান রকম সম্মিলন ও সমঝোতা ঘটেছিল। নিওপ্লেটোনিক দর্শনের সবচাইতে বুনিয়াদি সূত্র ধরা হয় প্লটিনাস (তৃতীয় শতক) লিখিত ও তার ছাত্র পরফিরি সম্পাদিত এন্নিয়াড পুস্তকটিকে। এছাড়া ইসলামপূর্ব বিভিন্ন খ্রিষ্টিয় ধর্মতত্ত্বকেও নিওপ্লেটোনিক বর্গের মধ্যে ফেলা হয়। কিন্তু ইসলামপূর্ব খ্রিষ্টিয় দুনিয়ায় এই ধরণের গ্রিক ঐতিহ্য প্রভাবিত বেশিরভাগ ধর্মতাত্ত্বিক আকিদাই অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের হাতে নস্টিক ও হেরেটিক বলে চিহ্নিত হয়েছে, এবং হারিয়ে গেছে। এসব চিন্তাকে নিওপ্লেটোনিক বর্গে ফেলা যায় কিনা তা নিয়েও সাম্প্রতিক একাডেমিয়ায় নানান তর্ক আছে। দিনশেষে নিওপ্লেটোনিজম একটা কেজো ঐতিহাসিক বর্গ, যা ইউরোপের নিজের চিন্তার ইতিহাস বোঝা বা চিন্তার সচেতন সিলসিলা নির্মানের একটি ফলাফল। কিন্তু ইসলামী নিওপ্লেটোনিজম বলে পাশ্চাত্য একাডামিয়া যাকে চিহ্নিত করেছে, তা মুসলিম দুনিয়ায় কোনো প্রান্তিক বিষয় ছিলনা, বরং ইসলামি সভ্যতার মধ্যে তা একইসাথে বৈজ্ঞানিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্যারাডাইমের মর্যাদা লাভ করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে পরে ইউরোপে এই ধরণের প্যারাডাইম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যাকে পরে নিওপ্লেটোনিজম নাম দেয়া হয়েছে এবং একটা ইসলামপূর্ব ইতিহাসের সাথেও যুক্ত করা হয়েছে। 

 প্রকৃতপক্ষে মুসলিম দুনিয়ায় বেড়ে ওঠা নিওপ্লেটোনিজমকে এর নিজের ইতিহাসের সাপেক্ষেই বোঝা প্রয়োজন। আব্বাসি আমলের বায়তুল হিকমার দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয়তায় প্লেটো, এরিস্টোটল ও ইব্রাহিমি ঐতিহ্যের একটা সুসংবদ্ধ সম্মিলন ও সমঝোতা ঘটেছিল। এই তৎপরতার মধ্যে প্লটিনাসের এন্নিয়াড গ্রন্থটির কয়েক খন্ডের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল বটে, তবে বায়তুল হিকমার অনুবাদকদের কাছে প্লটিনাস কোনো পরিচিত নাম ছিলেন না। এন্নিয়াডের যেই সংস্করণটি তাদের হাতে পৌছেছিল, তা পৌছেছিল এরিস্টোটলের থিওলজি নামে। এবং তা পরিচিত ছিল ছাত্র আলেক্সান্ডারের উদ্দেশ্যে গুরু এরিস্টোটলের একটি নসিহত হিসাবে। এবং এরিস্টোটলের থিওলজি নামক যেই কিতাবটি আছে, তাকে আসলে এন্নিয়াডের বদলে তার ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ হিসাবেই পাঠ করা প্রয়োজন। খোদ গ্রন্থটির ভূমিকাতেই বলা আছে যে, “দার্শনিক এরিস্টোটলের থিওলজিয়া (উথুলুজিয়া) নামক কিতাবটির প্রথম অধ্যায়টিতে খোদায়ি সার্বভৌমত্ব নিয়ে যে বয়ান দেয়া হয়েছিল, সিরিয়ার পরফিরি তার ব্যাখ্যা লিখেছিলেন। এই ব্যাখ্যাটি এমেসার আবদুল মসিহ ইবনে নাইমা অনুবাদ করেছিলেন, এবং যা পরে আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইশহাক আল কিন্দির তত্ত্বাবধানে আহমেদ ইবনে আল মুস্তাসিম বিল্লাহ”র জন্যে সংশোধিত ও সম্পাদিত করা হয়েছে” (ডা’নকোনা ১০)। অর্থাৎ প্লটিনাসকে না চিনলেও মূল পুস্তকটাকে তারা পরফিরির লেখা একটা কাজ বলেই জানতেন। কিন্তু খেয়াল করার ব্যাপার যা তা হলো যে আলোচ্য আরবী কিতাবটি লেখা হয়েছিল একজন আব্বাসি যুবরাজের জন্যে, আল কিন্দির তত্ত্বাবধানে। আব্বাসি রাজবংশ এবং তাদের দরবারের দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীদের জন্যে গ্রিক দর্শন ও ইসলামী ধর্মতত্ত্ব এবং রুহ সংক্রান্ত ধারণার একটা সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল। এন্নিয়াড গ্রন্থটি পরোক্ষভাবে, এবং এরিস্টোটলের থিওলজি গ্রন্থটি প্রথ্যক্ষভাবে এই সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কিছু সূত্র হাজির করেছিল। প্লেটোর অলিখিত বাতেনি দর্শন নিয়ে আলাপ আছে অনেক। এই দর্শনে যে ‘এক’ নামকে একটি তৌহিদি ধারণা ছিল তা খোদ প্লেটোর ছাত্র এরিস্টোটলের লেখা থেকেই জানা যায়। তবে, সব কারনের আদি কারন এই পরম একত্বের ধারণা নিয়ে সবচাইতে বিস্তারিত আলাপ পাওয়া যায় এন্নিয়াডেই। সেইসাথে এন্নিয়াডে এই পরম একত্ব থেকে মানবাত্মার অবতরণ এবং তাতে ফিরে যাওয়ার তত্ত্বও হাজির আছে। স্বাভাবিকভাবেই ইব্রাহিমি ধর্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্য বইটির প্রতি আগ্রহী হয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া কিছু খ্রিষ্টিয় নস্টিক আকিদার মধ্যেও প্লেটোর চিন্তা ব্যবহার করে এই ধরণের ধর্মতত্ত্ব প্রচার করার ঐতিহ্য ছিল। তবে প্লটিনাস ও এই নস্টিক আকিদাগুলার মধ্যে যে মিল দেখা যায়, তা হয়তো একইধরণের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে।

গুরু এরিস্টোটল (ডানে) ও ছাত্র আলেক্সান্ডার দা গ্রেট (বামে)। জীববিদ্যা বিষয়ে এরিস্টোটল ও ওবায়দাল্লাহ বুখতিষুর লেখার সংকলন “জীবসমূহের বর্ণনা ও ব্যবহার” নামক বই থেকে নেয়া। সম্ভবত আব্বাসি আমলের শেষভাগে বাগদাদে প্রকাশিত।

নস্টিক আকিদাগুলা খ্রিষ্টিয় চিন্তা জগতে টিকে থাকতে না পারলেও, তাদের কাছাকাছি কিছু আকিদা ইসলামী সভ্যতায় বরং বেশ প্রভাবশালী ছিল। আসলে “এরিস্টোটলের থিওলজি” নামক কিতাবটির অনুবাদ ও সম্পাদনা ছিল একটা বিশেষ ধরণের তৎপরতার অংশ। ঐ সময় আলেক্সান্ডারের উদ্দেশ্যে এরিস্টোটলের নসিহত হিসাবে পরিচিত বিভিন্ন রকম টেক্সটের অনুবাদ ও সংকলন হয়েছিল আরব বুদ্ধিজীবীদের হাতে। এসবের মধ্যে অনেক টেক্সটেরই আরবীপূর্ব কোনো সংস্করণের কথা জানাও যায় না। সব মিলিয়ে এই টেক্সটগুলাকে একটা বিশেষ জনরার অন্তর্ভূক্ত হিসাবে পাঠ করাই ভাল, যেগুলোতে আব্বাসি আমলের খাস তথা এলিট সমাজের বুদ্ধিজীবী ও যুবরাজদের মধ্যকার সম্পর্কের একধরণের প্যারাডাইমও হাজির আছে। আব্বাসি যুবরাজদের মধ্যে দার্শনিক শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা লাভ করা এবং দার্শনিক রাজা হওয়ার বাসনা দেখা যায়। খোদ আল কিন্দিই আব্বাসি যুবরাজ আহমেদ ইবনে মুস্তাসিম বিল্লাহর শিক্ষক ছিলেন, এবং তার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পুস্তক ও চিঠি রচনা করেছেন। অর্থাৎ, এই পুস্তকগুলা বিশেষ এক ধরণের সাংস্কৃতিক পরিবেশেই গ্রন্থিত হয়েছিল। এই কিতাবগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষিত ও শাসকশ্রেণীর জন্যে এমন একধরণের বিশ্বতত্ত্ব ও অস্তিতত্ত্ব সরবরাহ করা যা একই সাথে বৈজ্ঞানিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক, যার মধ্য দিয়ে তারা জীবজগত ও বস্তুজগতের মধ্যে নিজেদের অবস্থান, কর্তব্য ও এজেন্সি বোঝার চেষ্টা করতেন। এবং এই ধরণের সৃষ্টিতত্ত্ব ও অস্তিতত্ত্বের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর ইচ্ছার (ডিভাইন উইল) ধারণার সাথে প্রাকৃতিক-দার্শনিক তথা বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ তত্ত্ব, এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ধারণার মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করা। যদিও শুরুতে এই ধরণের চিন্তাচর্চা সীমাবদ্ধ ছিল মুসলিম দুনিয়ার খাস সমাজে, কিন্তু পরবর্তিতে সুফিবাদের হাত ধরে দর্শন, ধর্মততত্ত্ব ও সুফিতত্ত্বের মিলঝুলে এইধরণের বিশ্বতত্ত্ব ও অস্তিত্বতত্ত্ব পরিণত হয়েছিল জনপ্রিয় জ্ঞানের বিষয়ে। আমাদের বাঙলার লোকসমাজও তার প্রভাবের বাইরে ছিলনা। এখনো নাই। তবে বলতে হয় যে বিগত দুইশ বছরে আমরা এই জ্ঞান অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি। 

আব্বাসি রাজবংশ এবং তাদের দরবারের দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীদের জন্যে গ্রিক দর্শন ও ইসলামী ধর্মতত্ত্ব এবং রুহ সংক্রান্ত ধারণার একটা সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল। এন্নিয়াড গ্রন্থটি পরোক্ষভাবে, এবং এরিস্টোটলের থিওলজি গ্রন্থটি প্রথ্যক্ষভাবে এই সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কিছু সূত্র হাজির করেছিল। প্লেটোর অলিখিত বাতেনি দর্শন নিয়ে আলাপ আছে অনেক। এই দর্শনে যে ‘এক’ নামকে একটি তৌহিদি ধারণা ছিল তা খোদ প্লেটোর ছাত্র এরিস্টোটলের লেখা থেকেই জানা যায়। তবে, সব কারনের আদি কারন এই পরম একত্বের ধারণা নিয়ে সবচাইতে বিস্তারিত আলাপ পাওয়া যায় এন্নিয়াডেই। সেইসাথে এন্নিয়াডে এই পরম একত্ব থেকে মানবাত্মার অবতরণ এবং তাতে ফিরে যাওয়ার তত্ত্বও হাজির আছে। স্বাভাবিকভাবেই ইব্রাহিমি ধর্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্য বইটির প্রতি আগ্রহী হয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া কিছু খ্রিষ্টিয় নস্টিক আকিদার মধ্যেও প্লেটোর চিন্তা ব্যবহার করে এই ধরণের ধর্মতত্ত্ব প্রচার করার ঐতিহ্য ছিল। তবে প্লটিনাস ও এই নস্টিক আকিদাগুলার মধ্যে যে মিল দেখা যায়, তা হয়তো একইধরণের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে।

তবে আল কিন্দি ও তার সহকর্মীদের রুহানিয়াত সংক্রান্ত তত্ত্ব নির্মান প্রকল্পের পেছনে অন্যতম আরেকটি কারণ ছিল জ্যোতিষ শাস্ত্র ও আলকেমির চর্চাকে কুফুরি কালামের অভিযোগ থেকে রক্ষা করা। বলে রাখা ভাল যে, যদিও জ্যোতিষ শাস্ত্র ও আলকেমির চর্চাকে আমরা আধুনিক যুগে ম্যাজিক ও অকাল্ট ধরণের বর্গের মধ্যে ভাগ করেছি, কিন্তু আগেরকালে এই দুই শাস্ত্রই বিজ্ঞান চর্চার অংশ ছিল। জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতিষশাস্ত্র যেমন একই ধরণের বৈজ্ঞানিক প্যারাডাইমের উপর নির্ভরশীল ছিল, আলকেমি ও রসায়নশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও তা বলা যায়। ইব্রাহিমি ধর্মতত্ত্বের জগতে এমন একটা অভিযোগ সবসময়ই হাজির ছিল যে জ্যোতিষবিদ্যা, আলকেমি, তাবিজ-তুমার, খাবনামা-ফালনামাসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের সাথে জ্বীন, ডিমন, প্রাকৃতিক শক্তি ও দেব দেবীর পূজা করার বা অনুগ্রহ প্রার্থনার সম্পর্ক আছে। কিন্তু আব্বাসি আমলের বিজ্ঞানীরা এইসব শাস্ত্রের চর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাদের হাতে থাকা প্রাকৃতিক-দার্শনিক তথা বৈজ্ঞানিক প্যারাডাইমের উপরে, বিশেষ করে নিউপ্লেটোনিক ও হার্মেটিক দর্শনের উপরে। এই কর্মযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল আট থেকে এগারো শতকের মধ্যে। আল কিন্দির ডে রাডিস, অকাল্ট শাস্ত্রের বিখ্যাত বই গায়াত আল হাকিম (ল্যাটিন নামঃ পিকাট্রিক্স) এবং ইখওয়ানুস সাফার রাসায়েল এই সময়ে রচিত সবচাইতে প্রভাবশালী কিছু বই, যেগুলো পরবর্তিতে ইউরোপে অনুবাদিত হয়েছিল। তবে, তেরো শতক পরবর্তিত সময়ে মুসলিম দুনিয়ায় একটা নববাকের সুচনা হয়েছিল, যারফলে গুহ্যবিদ্যা চর্চার জগতে দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক  তত্ত্বের বদলে সুফি তত্ত্বের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় (সাইফ, “ফ্রম গায়াত”)।

রুহানিয়াত সংক্রান্ত প্রাকৃতিক দর্শনের লেখালেখিগুলাতে দেখা যায় যে ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভাইটাল এজেন্সি বা প্রাণশক্তির এজেন্সির ধারণা হিসাবে। ভাইটাল এজেন্সি বা প্রাণশক্তিময় এজেন্সির ধারণার গোড়ার কথা হলো যে, তা স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা থেকে মুক্ত। এই ধরণের এজেন্সির ধারণার একটা বুনিয়াদি সূত্র হলো “আল উস্তুয়াত্তাস” নামক এরিস্টটলের নসিহত জনরার একটি কিতাব। এই কিতাবটির প্রভাব দেখা যায় প্রাকৃতিক দর্শন ও সুফিতত্ত্বের বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনায়। এরিস্টটলের নসিহত জনরার হলেও বিষয়বস্তুর দিক থেকে কিতাবটি হার্মেটিক ঘরানার অনুগামী। এই কিতাবে এজেন্সির সংজ্ঞাটিকেই দাঁড় করানো হয়েছে ইচ্ছার বদলে কর্মের উপরে। দাবি করা হয়েছে যে; “ক্রিয়াই নির্দেশ করে এজেন্টের দিকে” (“the action indicates the agent”)।[1] মানে, কোন কিছুর এজেন্সি তখনই আছে বলে আমরা ধরে নেব, যখন তার দ্বারা কোনো কর্ম বা একশন সংঘটিত হবে। ক্রিয়া বা প্রভাবন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এজেন্ট ও এজেন্সির এমন ধারণাই আমরা রুহানিয়াত তথা প্রাণশক্তি সংক্রান্ত প্রাকৃতিক দার্শনিক তত্ত্বের মধ্যে বারবার পুনরাবৃত্তি হতে দেখি। সাম্প্রতিক পাশ্চাত্য চিন্তায় এই ধরণের এজেন্সির ধারণা ফেরত এসেছে, বিশেষ করে নৃতাত্ত্বিক ব্রুনো লাতুরের “এক্টেন্ট” সংক্রান্ত তত্ত্বের মধ্যে। এক্টেন্ট হলো এমন এক কর্তাসত্তার ধারণা, যা স্বাধীন ইচ্ছার কারনে নয়, বরং কর্ম বা ক্রিয়ার কারনে কর্তা হয়ে ওঠে। যারফলে সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যের চিন্তা জগতে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন সত্তার কর্তারূপ বা এজেন্সির ধারণা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

রুহানিয়াত সংক্রান্ত প্রাকৃতিক দার্শনিক কিতাবগুলোর তত্ত্ব মোতাবেক, রূহ আল কুল্লি (সার্বজনীন রূহ) প্রবাহিত হয় নক্ষত্ররাজির মধ্যে, এবং তারপর আমাদের পৃথিবীতে। গ্রহ নক্ষত্রের দেহে রুহের এই স্থানিক-অবস্থা বা বর্তমানতাকেই বর্ণনা করা হয়েছে তাদের রুহানিয়াত তথা রুহানি এজেন্সি বা রুহানি শক্তি হিসাবে হিসাবে, যে এজেন্সির প্রভাবে গ্রহ নক্ষত্ররা আমাদের পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে (সাইফ, “ফ্রম গায়াত” ৩০৬)। সুফিরাও মূলত প্রাকৃতিক-দার্শনিকদের প্রস্তাবনার প্রভাবে রুহানিয়াতকে রুহ বা প্রাণশক্তির স্থানিক-অবস্থান হিসাবে ব্যাখ্যা করতেন, তবে মধ্যবর্তী সত্তা হিসাবে গ্রহ- নক্ষত্রের  ভূমিকা নিয়ে তাদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা যায়।    

আবু মাশার আল বালখি

এই দাবি করা বোধহয় ভুল হবে না যে, জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের একটা সমন্বয় আল কিন্দির হাতে সংঘটিত হয়েছিল। তবে, খুব সম্ভবত পৃথিবীর উপরে গ্রহ-নক্ষ্যত্রের প্রভাবকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সবচাইতে পুরাতন ও প্রভাবশালী বইটি লিখেছিলেন আল কিন্দির সহকর্মী আবু মাশার আল বালখি। আবু মাশার মনে করতেন যে, নক্ষত্রদেরও প্রাণ আছে, এবং এই প্রাণশক্তির প্রভাবে তারা পৃথিবীর বুকে হাজির থাকা সবকিছুর উৎপাদন, বৃদ্ধি ও পঁচনের পেছনে ভূমিকা রাখে। এই তত্ত্ব নির্মানের ক্ষেত্রে তিনি এরিস্টোটলের “অন জেনারেশন এন্ড করাপশন” নামক লেখাটি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা মোতাবেক ভূমণ্ডলে কোনোকিছুর আবির্ভাব এবং আবার ফেরত যাওয়াটা নক্ষত্রমন্ডলির গতিশীল চলনের সাথে সম্পর্কযুক্ত (সাইফ, “ফ্রম গায়াত” ৩০১-৩০২)। এই আবির্ভাব ও ফেরত যাওয়ার তত্ত্বটির সাথে পরবর্তি সময়ে তাসাউফে প্রচলিত ফানা ও বাকার তত্ত্বের একটা মিলঝুল গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। অবশ্য বলা দরকার যে কার্যকারণ নির্ভর প্রভাব নিয়ে আলোচনা সুফিতত্ত্বের খানিকটা কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দার্শনিক এবং সুফি এই দুই দলই মানুষের এজেন্সির ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন অনান্য সব কিছুর এজেন্সির সাথে সম্পর্কসূত্রের আলোকে।

রুহানিয়াত সংক্রান্ত প্রাকৃতিক দর্শনের লেখালেখিগুলাতে দেখা যায় যে ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভাইটাল এজেন্সি বা প্রাণশক্তির এজেন্সির ধারণা হিসাবে। ভাইটাল এজেন্সি বা প্রাণশক্তিময় এজেন্সির ধারণার গোড়ার কথা হলো যে, তা স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা থেকে মুক্ত। এই ধরণের এজেন্সির ধারণার একটা বুনিয়াদি সূত্র হলো “আল উস্তুয়াত্তাস” নামক এরিস্টটলের নসিহত জনরার একটি কিতাব। এই কিতাবটির প্রভাব দেখা যায় প্রাকৃতিক দর্শন ও সুফিতত্ত্বের বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনায়। এরিস্টটলের নসিহত জনরার হলেও বিষয়বস্তুর দিক থেকে কিতাবটি হার্মেটিক ঘরানার অনুগামী। এই কিতাবে এজেন্সির সংজ্ঞাটিকেই দাঁড় করানো হয়েছে ইচ্ছার বদলে কর্মের উপরে। দাবি করা হয়েছে যে; “ক্রিয়াই নির্দেশ করে এজেন্টের দিকে” (“the action indicates the agent”)।[1] মানে, কোন কিছুর এজেন্সি তখনই আছে বলে আমরা ধরে নেব, যখন তার দ্বারা কোনো কর্ম বা একশন সংঘটিত হবে। ক্রিয়া বা প্রভাবন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এজেন্ট ও এজেন্সির এমন ধারণাই আমরা রুহানিয়াত তথা প্রাণশক্তি সংক্রান্ত প্রাকৃতিক দার্শনিক তত্ত্বের মধ্যে বারবার পুনরাবৃত্তি হতে দেখি।

 এই দাবি করা হয়তো ভুল হবে না যে সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী চিন্তায় এই ধরণের ভাইটাল এজেন্সির ধারণা ফেরত এসেছে, বিশেষ করে নিউ-মেটারিয়ালিজমের ঘরানায়। পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞান চিন্তায় দীর্ঘদিন ধরেই একধরণের যান্ত্রিক বস্তুবাদী ধারার আধিপত্য আছে। মার্ক্সীয় ধারার ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এই ধরণের যান্ত্রিকতার বাইরে এমন এক বস্তুবাদী বয়ান হাজির করেছিল যা মানুষের রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, কিন্তু তা মানুষ ও প্রকৃতির বাইনারি সম্পর্কের আছর থেকে পুরাপুরি মুক্ত থাকতে পারে নাই। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণ ও অপ্রাণসত্তার কর্তারূপ নিয়ে আলোচনাও প্রথাগত ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ঐতিহ্যে বিরল। স্পিনোজার ঘরানার প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদ এই কারনে সাম্প্রতিক সময়ে আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যা দীর্ঘকাল পাশ্চাত্য চিন্তায় খানিকটা আড়ালে থেকে গিয়েছিল। সমাজ বিজ্ঞানের দুনিয়ায় অবজেক্ট অরিয়েন্টেড অন্টোলজির উত্থানের পাশাপাশি তাই দর্শন ও ক্রিটিকাল থিওরির জগতে প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদী বিভিন্ন তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে একটা কৌতুহলউদ্দিপক ব্যাপার হলো যে, সাম্প্রতিক সময়কার নয়া বস্তুবাদী দার্শনিক জেন বেনেট সবকিছুর মধ্যে সদা হাজির থাকা অন্তর্গত ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিছুর-ক্ষমতা বা থিং-পাওয়ার নামক যে ধারণাটি প্রস্তাব করেছেন, তার সংজ্ঞা পড়লে এই থিং-পাওয়ার জিনিসটাকে রুহানিয়াত তথা প্রাণশক্তির একটি সাম্প্রতিক সংস্করণের মতোই মনে হয়। কেননা বেনেটের প্রস্তাবিত থিং-পাওয়ার মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার মতো কোনো এজেন্সির ধারণা নয়, বরং এক ধরণের ভাইটাল এজেন্সি, বা একধরণের প্রভাবন ক্ষমতা (এফেক্টিভ পাওয়ার)। বেনেটের মতে, “অমানবিক যে কোনো কিছুর মধ্যেই যে ক্ষমতা রয়েছে, যে ক্ষমতা মানবদেহকে ধ্বংস অথবা উন্নত করে, গতি দেয় অথবা থামায়, পুষ্টি দেয় অথবা পচায়; তা-ই হলো ‘থিং পাওয়ার’ (ix)। মুসলিম দার্শনিক ও সুফিতাত্ত্বিকরা যে রুহের ধারণা গড়ে তুলেছিলেন, তাতে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণী এবং বস্তুর মধ্যেও রুহের হাজিরা থাকে বলে মনে করা হতো। বেনেট প্রস্তাবিত থিং পাওয়ার জিনিসটাও খানিকটা এমনই, যার কারনে তার মতে, থিং-পাওয়ার জিনিসটা বস্তু ও প্রাণের সরল বিভাজনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন (৮)। রুহানিয়াত ধারণাটিও আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও আইনি ডিসকোর্সে হাজির থাকা বস্তু ও প্রাণের সরল বিভাজনকে প্রশ্নের মুখের ফেলে দেয়। 

ইসলামী  ঐতিহ্যে রুহানিয়াত সংক্রান্ত তত্ত্ব চিরকালই ছিল ‘কিছু’ (শাই’ইন)-র ধারণার উপর নির্ভরশীল। এর পেছনে কোরআনে ‘কিছু’ শব্দটির অস্তিত্বতাত্ত্বিক ব্যবহার প্রভাবশালী একটা ভূমিকা রেখেছে। এই দাবি করা হয়তো ভুল হবে না যে, সত্তা (বিইং, মউজুদ) অথবা বিষয়বস্তুর (অবজেক্ট) পাশাপাশি ‘কিছু’ পরিভাষাটিও ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অস্তিত্বতাত্ত্বিক আলোচনায় প্রভাবশালী ছিল। যদিও এইসব ঘরানার তাত্ত্বিকরা অগণিত কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু সবকিছুকে (কুল্লি শাই’ইন) তারা মোটাদাগে প্রাকৃতিক (পৃথিবীর প্রকৃতিতে হাজির থাকা সবকিছু), আসমানি (ঊর্ধাকাশের নক্ষত্রমন্ডল) ও খোদায়ি- এই তিনভাগে ভাগ করতেন। তবে দার্শনিক-বিজ্ঞানীরা যতটা আগ্রহী ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে, সুফিতাত্ত্বিকরা অতটা ছিলেন না। তাই গ্রহ নক্ষত্রের রুহানিয়াতের বদলে তাদের আগ্রহ বেশি ছিল মুখের ভাষা, লেখার হরফ ও খোদ সুফি শায়েখদের মধ্যে হাজির থাকা রুহানিয়াত নিয়ে। তবে বলে নেয়া ভাল যে, খোদ আল কিন্দির লেখাতেও মানুষের ভাষার মধ্যে এমন এক ধরণের রুহানিয়াত হাজির থাকার কথা জানা যায়, যা প্রভাবন ক্ষমতা বিস্তার করতে পারে অন্যান্য জীব, উদ্ভিদ ও বস্তুর উপরে (সাইফ, এর‍্যাবিক ৩৫)। সকল সত্তাই রুহানিয়াত লাভ করে প্রথম অবতরিত সত্তা রুহ আল কুল্লির কাছ থেকে, এবং যা তাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অন্য কিছুকে প্রভাবিত করতে পারে। নক্ষত্র থেকে প্রবাহিত রুহানিয়াত প্রবেশ করে পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তুর মধ্যেও। আগেরকালে তাবিজ তৈরি করা হতো মূলত এই ধরণের রুহানিয়াত বা ভাইটাল এজেন্সির একটা আধার বা কন্টেইনার হিসাবে। যদিও বর্তমানে তাবিজের মধ্যে রুহানিয়াত ধরে রাখার এই চেষ্টাকে আমরা অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করতে পারি, কিন্তু এনলাইটেনমেন্টের আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের মধ্যেও এই ধরণের চর্চা (জ্যোতিষবিদ্যা, আলকেমি, তাবিজ-তুমার) যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। আর আল কিন্দির প্রস্তাবিত র‍্যাডিয়েশন বা বিকিরণ তত্ত্ব এই ধরণের চিন্তা জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছিল। গায়াত আল হাকিমের লেখককেও তাই তাবিজ নির্মানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন:

আসমানি দেহগুলার সাথে সংযোগ স্থাপন করা, এবং তাদের থেকে বিকিরিত রশ্মি লাভ করা, যেন আপনি তা ব্যবহার করে কোন কিছু অর্জন অথবা ধ্বংস করতে পারেন।

মনে রাখা দরকার, আল কিন্দির বিকিরণ তত্ত্ব কিন্তু অপটিকাল সায়েন্সের উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে, যাকে আধুনিক যুগে বিজ্ঞান হিসাবে মানতে কারো অসুবিধা নাই। আগের কালের বিজ্ঞানীদের কাজের মধ্যে বিজ্ঞান ও জাদুবিদ্যা এমন মিলেমিশেই থাকতো। খোদ আইজাক নিউটনের মতো বিজ্ঞানীও এর বাইরে ছিলেন না। তারা ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও জাদুবিদ্যার চর্চা করতেন কিছু সাধারণ প্যারাডাইমের উপর নির্ভর করেই।

পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞান চিন্তায় দীর্ঘদিন ধরেই একধরণের যান্ত্রিক বস্তুবাদী ধারার আধিপত্য আছে। মার্ক্সীয় ধারার ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এই ধরণের যান্ত্রিকতার বাইরে এমন এক বস্তুবাদী বয়ান হাজির করেছিল যা মানুষের রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, কিন্তু তা মানুষ ও প্রকৃতির বাইনারি সম্পর্কের আছর থেকে পুরাপুরি মুক্ত থাকতে পারে নাই। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণ ও অপ্রাণসত্তার কর্তারূপ নিয়ে আলোচনাও প্রথাগত ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ঐতিহ্যে বিরল। স্পিনোজার ঘরানার প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদ এই কারনে সাম্প্রতিক সময়ে আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যা দীর্ঘকাল পাশ্চাত্য চিন্তায় খানিকটা আড়ালে থেকে গিয়েছিল। সমাজ বিজ্ঞানের দুনিয়ায় অবজেক্ট অরিয়েন্টেড অন্টোলজির উত্থানের পাশাপাশি তাই দর্শন ও ক্রিটিকাল থিওরির জগতে প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদী বিভিন্ন তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে একটা কৌতুহলউদ্দিপক ব্যাপার হলো যে, সাম্প্রতিক সময়কার নয়া বস্তুবাদী দার্শনিক জেন বেনেট সবকিছুর মধ্যে সদা হাজির থাকা অন্তর্গত ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিছুর-ক্ষমতা বা থিং-পাওয়ার নামক যে ধারণাটি প্রস্তাব করেছেন, তার সংজ্ঞা পড়লে এই থিং-পাওয়ার জিনিসটাকে রুহানিয়াত তথা প্রাণশক্তির একটি সাম্প্রতিক সংস্করণের মতোই মনে হয়।

“তা না করে তাকে তুমি একদিকে বানালে নশ্বর
রক্তমাংসের প্রাণ, অন্যদিকে নিজের রূহের
নিশ্বাস দিয়ে তার হৃদয়ে দিয়েছ নিজ রূহ
রুহ ও নফসের দ্বন্দ্বে সে এখন কোন দিকে যাবে?”

রুহ ও নফসের দ্বন্দ্ব, ফরহাদ মজহার

সুফিতত্ত্বের রুহানিয়াত সংক্রান্ত তত্ত্ব সুফিসাধকের সাধনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, যে সাধনাকে এক ধরণের রুহানি উড্ডয়নও বলা যেতে পারে। এই রুহানি সফরের পথের ধারণা থেকে আদি সুফিতত্ত্বে তরিকা বা পথের পরিভাষাটি চালু হয়েছিল। এই রুহানি সফরে একজন সুফি পার হয়ে যান একের পর এক পর্দা, তার সামনে উন্মোচিত হয় নিত্য নতুন দিগন্ত, প্রতিটি দিগন্তের আলদা কনস্টেলেশনের চিহ্নগুলো তিনি পাঠ করেন। বড়পীর আবদুল কাদের জিলানীর অস্তিত্বতত্ত্ব মোতাবেক মানুষের বাস্তবতা চারভাগে বিভক্ত। এই ভাগগুলো হলো বস্তুজগৎ, রুহানি জগৎ (ফেরেশতা ও জীনেদের জগৎ), কালাম বা খোদায়ী ভাষার জগৎ (খোদার নাম, গুনাবলী ও লাওহে মাহফুজ তথা সংরক্ষিত ফলকের জগৎ), এবং আল্লাহর বিশুদ্ধ বা পরম অস্তিত্বের জগৎ (কোন ভাষা, নাম বা গুনাবলী দ্বারা যার বর্ণনা করা যায় না) ( সিরুল আসরার ৬৫)। এই সর্বশেষ বা সর্বোচ্চ পরম অস্তিত্বের জগতে আরোহন করাই সুফির লক্ষ্য।  

অন্যদিকে ইবনে আরাবীর মতে, পরম করুণাময় আল্লাহ হলেন একমাত্র সত্য বাস্তবতা (উজুদ), এবং পরুম করুণাময়ের দমের (নাফাস আর-রাহমান) মাধ্যমেই বাকিসব সত্তার আবির্ভাব ঘটেছে। রুহ সংক্রান্ত সুফিতত্ত্বে দম বা নিঃশ্বাসের ধারণাটি একটা কেন্দ্রীয় ধারণা, এবং রুহ শব্দটার আক্ষরিক অর্থও দম বা নিঃশ্বাস। দমের ধারণার একটা লম্বা ধর্মতাত্বিক সিলসিলা আছে। তাওরাতের পয়দায়েশ (জেনেসিস) অধ্যায় এবং ইসলামী ঐতিহ্যের বিভিন্ন হাদিস ও সিরাত গ্রন্থের বর্ণনা মোতাবেক আল্লাহ আদমের নাকে তার রুহ  তথা দম ফুকে দিয়েছিলেন। ইবনে আরাবি “পরম করুনাময়ের দম” ধারণাটির ব্যবহার করে খোদায়ি রুহের আধেয় (নাফাস যার আধার) বা ভেতরের বিষয়বস্তু এবং কর্মপ্রক্রিয়া (মোড অফ অপারেশন) এই দুইই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। বলে রাখা ভাল যে আরবি নাফস (আত্মা) এবং নাফাস শব্দ দুইটি ধাতুগতভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং একই অর্থ বহন করে। ইবনে আরাবির চিন্তায় নাফাস হলো আদি খোদায়ি দম, যার ভেতরের বিষয়বস্তু বা আধেয় হলো রুহ আর কর্মপ্রক্রিয়া হলো ফু (নাফাকা)। ইবনে আরাবির লেখায় রুহ এবং নাফাসা দুইটা শব্দই জীবন্ত বাস্তবতা এবং খোদার জীবন্ত চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে (বেজেল ১৭২)। আরাবির কাছে রহমত বা খোদায়ি করুণা সমগ্র অস্তিত্বেরই আধার, যেহেতু কোরানে আল্লাহ ঘোষনা দিয়েছেন:

আমার রহমত সকল কিছুকে ঘিরে রাখে
(চিত্তিক ৫৮)।

যা কিছু অনস্তিত্বশীল (আল-মাদুমাত) এবং যা কিছু সম্ভাব্য (আল মুমকিনাত), সবই আল্লার চিন্তার মধ্যে অস্তিত্ববান থাকে, এবং তাদের আবির্ভাব ঘটে তার রহমতময় নিঃশ্বাসের মাধ্যমে

(চিত্তিক ৫৯)।

দম ফুঁকে দেয়া ছাড়াও, আলোর বিকিরণ, শব্দ উচ্চারণ ইত্যাদি রূপকের মাধ্যমে খোদায়ি রুহের উন্মোচন ও অবতরণের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন আরাবি, যা আবার একই সাথে আল্লাহর আত্মপ্রকাশের ঘটনা (১৭২-১৭৩)। ঈসার জন্মগ্রহণের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রে রেখে খোদা ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কের যে অস্তিত্বতত্ত্ব তিনি হাজির করেন, তা যথেষ্ট জটিল, সৃষ্টিশীল ও আগ্রহউদ্দিপক। মরিয়মের প্রাকৃতিক জল আর জিবরাইলের ফুঁকে দেয়া রুহানি বিজের মাধ্যমে তার জন্ম। ইবনে আরাবির অস্তিত্বতত্ত্বে রূহ হলো পিতা ও প্রকৃতি হলো মাতা। কিন্তু আরাবির এই অস্তিত্বতত্ত্ব দ্বৈতবাদী নয়, কেননা প্রকৃতিও খোদ খোদারই আত্মপ্রকাশ। একটা খোদায়ি নিঃশ্বাসেই মহাবিশ্বের জন্ম এবং এই নিঃশ্বাস নিজেই আবার বৈশ্বিক আকারকে (কস্মিক ফর্ম) গর্ভধারণ করতে সক্ষম (ইবনে আরাবি, বেজেলস ১৮০)।

আরাবির মতে, রুহের কর্মপ্রক্রিয়া বিভিন্ন রূপে ঘটতে পারে। যদিও ঈসার জন্ম হয়েছিল সরাসরি রুহের নিষেকের মাধ্যমে, কিন্তু অন্য সকল মানুষ রুহ লাভ করে পিতা মাতার কাছ থেকে। ঈসার জন্মের বয়ান লিখতে গিয়ে আরাবি বীজ নিষেক এবং শব্দ উচ্চারণ এই দুই রুপক ব্যবহার করেছেন। সরাসরি জিবরাইলের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে রুহ লাভ করার কারনে ঈসার পক্ষে খোদায়ি আদেশ (আমর)কে এর সকল রূপেই বর্ণনা করা সম্ভব ছিল, এবং তিনি খোদায়ি রুহকে প্রকাশ করতে পারতেন শুধু এর ভাষিক রূপেই না, বরং এর প্রাণশক্তি রূপেও (আরাবি ১৭৪)। আগেই বলেছি, ঈসা যদিও আল ইনসান আল কামেলের বর্তমানতার উদাহরণ, কিন্তু সকল মানুষই সম্ভাব্য আল ইনসান আল কামেল। মানুষের রুহ সম্বন্ধে আরাবি তার এই তাত্ত্বিক অবস্থানটা এইভাবেও বর্ণনা করেছেন:, “প্রাকৃতিক আকারের মধ্যে সংরক্ষিত একটা রুহ, যা খোদায়ি প্রকৃতির মধ্যে সংরক্ষিত থাকা খোদায়ি রুহ ছাড়া অন্য কিছু নয়”। আল্লাহর সাথে মানুষের এই সম্পর্ক দ্ব্যর্থক মনে হয়, হয়তো যেহেতু তিনি একটা প্যারাডক্সিকাল তথা আপাতবিরোধী ঐক্যের তত্ত্ব বর্ণনা করতে চেয়েছেন। ঈসার সাথে আল্লার সম্পর্ক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি একটি আপাতবিরোধী সূত্র ব্যবহার করেছেন, যা হলো – “তিনি” এবং “তিনি নয়/ তার অপর” (“He” and “other than He”)। এই আপাতবিরোধী সূত্রটি মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্কেরও প্যারাডাইম। তবে, এই আপাতবিরোধিতা আসলে ভাষাগত সীমাবদ্ধতার ফলাফল, যেহেতু মানুষের ভাষায় একধরণের মেরুকরণ অন্তর্নিহিত রয়েছে (আরাবি ১৭৪)। হয়তো এই মেরুকরণই ফরহাদ মজহারের কবিতায় রুহ ও নফসের দ্বন্দ হিসাবে হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আর ‘কবিদের বেয়াদপি’ হয়ে উঠেছে ভাষার সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের উপায়।

কবি, দার্শনিক ইবনে আরাবী

এই দাবি করা যায় যে ইবনে আরাবি ও তার সমমনা সুফিরা মধ্যবর্তী বিভিন্ন বস্তুগত সত্তাকে এড়িয়ে আল্লাহ বা পরম অস্তিত্বের সাথে সরাসরি মানুষের একটা রুহানি সম্পর্কের তত্ত্ব তৈরিতে আগ্রহী ছিলেন। এই বাড়তি মানবকেন্দ্রিকতার একটি ফলাফল ছিল ভাষা (বয়ান ও লেখা) নির্ভর রুহানিয়াতের তত্ত্বের বিকাশ। সুফিদের মধ্যে কোরানের হরফ তথা অক্ষরের রুহানিয়াত নিয়ে যে আলাপ দেখা যায়, তা হুরুফি রুহানিয়াত বা অক্ষরের রুহানি শক্তির ধারণা তৈরিতে বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছে। খুব সম্ভবত বাগদাদের সুফি সাহল আল তুস্তারি ও তার স্যাঙাতরাই এই ধরণের চিন্তাকে প্রথম তাত্ত্বিক ভিত্তির উপরে দাঁড় করিয়েছিলেন। তবে হরফের রুহানিয়াত নিয়ে সবচাইতে প্রভাবশালী তাত্ত্বিক ছিলেন খুব সম্ভবত ইবনে আরাবী এবং আল বুনি। আল বুনির লেখায় রুহানিয়াত শব্দটিকে ফেরেশতার একটি পরিভাষা হিসাবেও ব্যবহার করা হয়েছে, এবং রুহানিয়াতদের বর্ণনা করা হয়েছে সহযোগী (আ’ওয়ান) এবং দাস (হুদ্দাম) হিসাবে (সাইফ, “ফ্রম গায়াত” ৩৪১)। অন্যদিকে ইবনে আরাবির রুহানিয়াত সংক্রান্ত তত্ত্ব মোতাবেক মুখের বাণী, লেখার অক্ষর, নবী-রাসুল, ফেরেশতা ইত্যাদি বিভিন্ন সত্তার মধ্যেই রুহানিয়াত তথা রুহানি শক্তি উপস্থিত থাকে, যা তারা পরম অস্তিত্ব  (উজুদ) থেকে লাভ করেন। 

আগেই বলেছি, ইবনে আরাবীসহ অন্যান্য বিভিন্ন সুফিদের মধ্যে গ্রহ-নক্ষত্রের রুহানি এজেন্সি অস্বীকার করার প্রবনতা দেখা যায়। ইবনে আরাবী ভাবতেন যে, গ্রহ নক্ষত্রকে রুহানিয়াতের মাধ্যম ভাবার প্রয়োজন নাই, যেহেতু আল্লাহ যখন ‘কুন’ বলেন, তখনই “হয়ে যায়” (সাইফ, “ফ্রম গায়াত” ৩২৩)। তবে, আরাবি যে ভূলোকের সত্তাদের উপর নভমণ্ডলের প্রভাব পুরাপুরি অস্বীকার করেছেন, তাও না। কেননা আরাবির বিশ্বতত্ত্ব মোতাবেক, নভমণ্ডল পরিচালিত হয় নবুয়তি রুহেদের শাসনে। তার কাছে নবী মুহাম্মদের রুহ (রুহ আল রাসুল)ই হলো সর্বজনীন রুহ (রুহ আল কুল্লি) ও আদি-চিন্তা (ফার্স্ট ইন্টেলেক্ট), আর নভমন্ডল পরিচালিত করে অন্য নবীদের রুহেরা (রুহানিয়াত নবি) (সাইফ, “ফ্রম গায়াত” ৩২৯) । আর তার হুরুফি তত্ত্ব মোতাবেক হরফ বা অক্ষরের মধ্যে যে শুধু রুহানিয়াত আছে তা না, বরং একধরণের ব্যক্তিসত্তাও আছে। আর প্রতিটা অক্ষরের সাথেই আছে আল্লার কোনো না কোনো নামের সম্পর্ক, যার ফলে অক্ষরগুলা দুনিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে (সাইফ, “ফ্রম গায়াত” ৩২৮)।

…আগেই বলেছি, ঈসা যদিও আল ইনসান আল কামেলের বর্তমানতার উদাহরণ, কিন্তু সকল মানুষই সম্ভাব্য আল ইনসান আল কামেল। মানুষের রুহ সম্বন্ধে আরাবি তার এই তাত্ত্বিক অবস্থানটা এইভাবেও বর্ণনা করেছেন:, “প্রাকৃতিক আকারের মধ্যে সংরক্ষিত একটা রুহ, যা খোদায়ি প্রকৃতির মধ্যে সংরক্ষিত থাকা খোদায়ি রুহ ছাড়া অন্য কিছু নয়”। আল্লাহর সাথে মানুষের এই সম্পর্ক দ্ব্যর্থক মনে হয়, হয়তো যেহেতু তিনি একটা প্যারাডক্সিকাল তথা আপাতবিরোধী ঐক্যের তত্ত্ব বর্ণনা করতে চেয়েছেন। ঈসার সাথে আল্লার সম্পর্ক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি একটি আপাতবিরোধী সূত্র ব্যবহার করেছেন, যা হলো – ‘তিনি’ এবং ‘তিনি নয়/ তার অপর’ (‘He’ and “other than He’)। এই আপাতবিরোধী সূত্রটি মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্কেরও প্যারাডাইম। তবে, এই আপাতবিরোধিতা আসলে ভাষাগত সীমাবদ্ধতার ফলাফল, যেহেতু মানুষের ভাষায় একধরণের মেরুকরণ অন্তর্ণিহিত রয়েছে (আরাবি ১৭৪)। হয়তো এই মেরুকরণই ফরহাদ মজহারের কবিতায় রুহ ও নফসের দ্বন্দ হিসাবে হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আর ‘কবিদের বেয়াদপি’ হয়ে উঠেছে ভাষার সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের উপায়।

 রুহ ও রুহানিয়াত সংক্রান্ত তত্ত্বের ধনী অর্কাইভ থেকে খুব সামান্যই এই লেখায় বর্ণনা করা সম্ভব। এতক্ষণের আলোচনায় আমি প্রাকৃতিক দর্শন ও সুফিতত্ত্বে এই ধারণাগুলার কিছু প্রভাবশালী তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি ধারণাগুলোর একটা কাজ চালানোর মতো জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্যে। এইবার আমরা মিশেল ফুকো প্রস্তাবিত স্পিরিচুয়ালিটির সংজ্ঞার সাথে এর একটি তুলনামূলক আলাপ টানতে সক্ষম হবো। রুহানিয়াতের ধারণাকে ফুকো ব্যাখ্যা করেছেন একটা চর্চা রূপে, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিসত্তা অন্য ধরণের কর্তায় রূপান্তরিত হয়। ফুকোর ভাষায়; “আমার মনে হয় এটা এমন একটা চর্চা যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি এমনভাবেই উৎপাটিত, রূপান্তরিত, ছিন্ন হয়ে যায় যে, সে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে (ইন্ডিভিজুয়ালিটি), নিজের কর্তা অবস্থানকেই (সাবজেক্ট পজিশন) খারিজ করে ফেলে। সে আর সেই কর্তাসত্তা হিসাবে থাকেনা যা হিসাবে সে এর আগে ছিল, যা হয়তো কোনো বিশেষ রাজনৈতিক ক্ষমতা, বা কোন বিশেষ জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়া, বা কোন বিশেষ অভিজ্ঞতা, বা কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতার সাপেক্ষের একটি কর্তাসত্তা ছিল (ফুকো ১২৪)।

অর্থাৎ, ফুকো এইক্ষেত্রে স্পিরিচুয়ালিটি কথাটাকে একটা চর্চা বা তৎপরতা হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যা ব্যক্তির পূর্ববর্তী কর্তাসত্তাকে ধ্বংস বা ফানা করে দিয়ে তার জায়গায় এক নতুন কর্তাসত্তার আবির্ভাবের পথ করে দেয়। সাত এটিয়েনের উক্তি ব্যবহার করে তিনি এই অবস্থাটাকে ফুটিয়ে তুলেছেন: “মানুষকে পাল্টাতে হবে, দুনিয়া পাল্টাতে হবে, ধারণাগুলা পাল্টাতে হবে, শব্দগুলো পাল্টাতে হবে, সবকিছু পাল্টাতে হবে…সবকিছু ধ্বংস করতে হবে এবং নতুন করে তৈরি করতে হবে” (১২৮)। এক কথায় বললে, ফুকো আমাদের সময়ে বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্যে কেবল রাজনৈতিক রূপান্তর বা অর্থ ব্যবস্থার রূপান্তর না, বরং কর্তাসত্তার রূপান্তরের দিকেও জোর দিয়েছেন। এবং তিনি স্পিরিচুয়ালিটি কথাটিকে সাত এটিয়েনের উক্তির প্রথম বাক্যটা, “মানুষকে পাল্টাতে হবে”র মধ্যেই ধরতে চেয়েছেন। তার নিজের ভাষায়; “সবকিছুকে পাল্টাতে হলে, সবকিছুর ঊর্ধে নিজেকে পাল্টাতে হবে, অপর হয়ে উঠতে হবে, এই অপরটা কেমন সেই ব্যাপারে কোন জ্ঞান ছাড়াই তা করতে হবে – এটা হলো নিজের সাপেক্ষে পরিবর্তিত হওয়ার বৈপ্লবিক ইচ্ছা (র‍্যাডিকাল উইল ফর অল্টারিটি)”।

মিশেল ফুকো

স্পিরিচুয়ালিটি সম্বন্ধে ফুকোর এই সংজ্ঞা বিভিন্ন কারনে কৌতুহলজাগানিয়া। ফুকোর সামগ্রিক চিন্তার সাপেক্ষে বিচার করলে স্পিরিচুয়ালিটি সংক্রান্ত তার এই তত্ত্বটিকে তার জীবনের একটি বৃহৎ দার্শনিক প্রকল্পেরই সারমর্ম বলে মনে হতে পারে ।  জুডিথ বাটলারের পর্যবেক্ষন মোতাবেক, মিশেল ফুকো তার দীর্ঘদিনের তত্ত্বচর্চার মাধ্যমে সাবজেক্ট আর দেহের মধ্যকার সম্পর্ককে দ্ব্যর্থবোধক করে তুলেছিলেন। একদিকে যেমন তিনি সাবজেক্টের ধারণাকেই বিনির্মাণ করেছিলেন, তেমনি এমন এক দেহের ধারণা নির্মাণ করেছিলেন যাকে এজেন্সির উৎস হিসেবে সাবজেক্টের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা যায় (বাটলার ১৯০)। বাটলারের এই পর্যবেক্ষণকে মাথায় রাখলে, এবং ফুকোর স্পিরিচুয়ালিটি সংক্রান্ত সংজ্ঞাটি গ্রহণ করলে – ফুকোর জীবনের তত্ত্বসাধনাকেও একধরণের স্পিরিচুয়ালিটি হিসাবে পাঠ করা যায়। ফুকো কেন এই ধরণের তত্ত্বসাধনায় নেমেছিলেন, তা বোঝার জন্যে জ্ঞান, সাবজেক্টিভিটি ও এজেন্সি সম্পর্কে ফুকোর সামগ্রিক বিচারকে মাথায় রাখা প্রয়োজন। ফুকো মনে করতেন যে মানুষের জ্ঞান তো বটেই, আত্মজ্ঞান ও কর্তাসত্তাও গঠিত হয় ক্ষমতার অধীনে বা সাপেক্ষে। আর আধুনিক পুঁজিবাদের যুগে সর্বব্যাপী ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্র নানাবিধ কলকব্জার মাধ্যমে জনগণকে তার জৈবক্ষমতা ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনস্ত রাখে। নানান শৃঙ্খলার কলাকৌশলের মধ্য দিয়ে জৈবক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে উৎপাদন করা হয় আধুনিক মানুষের কর্তাসত্তা, আর আমাদের সামাজিক সত্তা গড়ে ওঠে নিয়ন্ত্রনমূলক কলকব্জারূপী জৈবক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে। জৈবক্ষমতা আমাদের কর্তাসত্তা উৎপাদন করে, ঠিক করে দেয় বাসনা ও তৎপরতার নিয়ম ও সীমানা, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম স্বাধীন কর্তাসত্তা বলে আদৌ কিছু আছে কি না, এই প্রশ্নটিই ফুকোর বিভিন্ন লেখায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতেই ফুকো কর্তাসত্তার বৈপ্লবিক রূপান্তরের তত্ত্বসাধনা করেছেন।

ফুকোর লেখার রুহানিয়াতে পাশ্চাত্যের চিন্তাজগৎ অনেকটাই পালটে গেছে। এক হিসাবে, তার তত্ত্বসাধনার ফলে আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তা জগৎ তার আপন ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে। এর ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্য চিন্তাজগতে নানান রকম বিনির্মান সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তেমন বড় কোন বৈপ্লবিক রূপান্তর এই সময়টিতে ঘটেছে, তা বলা যাবেনা। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের জৈবক্ষমতার অধীনে মানুষের জীবন আরো বেশি করায়ত্ব হয়েছে। ফুকোর চিন্তার সাথে, বা তাত্ত্বিক জগতের রূপান্তরের সাথে বাস্তব দুনিয়ার রূপান্তরের কোন ফাঁক ফোকরগুলা এর ফলে উন্মোচিত হয়, সেই প্রশ্ন আপাতত ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখলাম। আপাতত আমাদের জন্যে যা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো যে যে ফুকো প্রস্তাবিত স্পিরিচুয়ালিটির সংজ্ঞাটি একান্তই মানবিক ইচ্ছা (উইল) বা ব্যক্তি মানুষের এজেন্সির ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি তত্ত্ব। অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছার বাইরে রুহানিয়াতের যে ধারণা থাকতে পারে, তা ফুকোর স্পিরিচুয়ালিটি তত্ত্বে অনুপস্থিত।

ফুকো মনে করতেন যে মানুষের জ্ঞান তো বটেই, আত্মজ্ঞান ও কর্তাসত্তাও গঠিত হয় ক্ষমতার অধীনে বা সাপেক্ষে। আর আধুনিক পুঁজিবাদের যুগে সর্বব্যাপী ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্র নানাবিধ কলকব্জার মাধ্যমে জনগণকে তার জৈবক্ষমতা ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনস্ত রাখে। নানান শৃঙ্খলার কলাকৌশলের মধ্য দিয়ে জৈবক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে উৎপাদন করা হয় আধুনিক মানুষের কর্তাসত্তা, আর আমাদের সামাজিক সত্তা গড়ে ওঠে নিয়ন্ত্রনমূলক কলকব্জারূপী জৈবক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে। জৈবক্ষমতা আমাদের কর্তাসত্তা উৎপাদন করে, ঠিক করে দেয় বাসনা ও তৎপরতার নিয়ম ও সীমানা, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম স্বাধীন কর্তাসত্তা বলে আদৌ কিছু আছে কি না, এই প্রশ্নটিই ফুকোর বিভিন্ন লেখায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতেই ফুকো কর্তাসত্তার বৈপ্লবিক রূপান্তরের তত্ত্বসাধনা করেছেন।

হয়তো, সুফিতত্ত্বের দিক থেকে এই দাবি তোলা যায় যে, ফুকো প্রস্তাবিত স্পিরিচুয়ালিটি ধারণাটি একজন সাধকের আপন রুহানিয়াতের সাথে প্রথম পরিচিত হয়ে ওঠারই একটি বর্ণনা। আধুনিক জৈবক্ষমতা দ্বারা উৎপাদিত কর্তাসত্তার কাছে তার যে রুহানি সত্তাটি এতোদিন অপর ছিল, তা আবার আপন হয়ে ওঠা। এই অবস্থাটাকে একটা রুহানি সফরের প্রথম স্তরে, অর্থাৎ বস্তুজগত এবং জ্ঞান-ক্ষমতা দ্বারা গঠিত একটা বাস্তবতা থেকে উড্ডয়নের প্রথম মুহূর্তটির সাথে – ডানা মেলে দেয়ার সাথে তুলনা করা যায়। হয়তো, এই ডানা মেলাটাই ফুকো কথিত বৈপ্লবিক রূপান্তরের উইল বা ইচ্ছা। হয়তো ফুকো এই ইচ্ছার ধারণাকে “স্বাধীন ইচ্ছা”র বোঝা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন অনাগত অপর কর্তাসত্তা সম্বন্ধে অজ্ঞান থাকা বা তার সম্বন্ধে না জানতে চাওয়ার মাধ্যমে। হয়তো এই কারনে, যেহেতু পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অধীনে ও যে বিশেষ জ্ঞান-ক্ষমতার সাপেক্ষে তার কর্তাসত্তা গঠিত হয়েছে, তার বাইরে আর কোন নিশ্চিত জ্ঞান তার জানা নাই। রূপান্তরিত হইতে চাওয়া ছাড়া আর কোনো স্বাধীন-ইচ্ছা তার নাই। ফুকো এই কারনেই হয়তো ভাবতেন যে, জৈবক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া কর্তাসত্তাকে আমরা সহজে জ্ঞানের বিষয় বানাতে পারি না, সে স্ট্রেঞ্জ বা গারিব হয়ে যায়।

এই দাবি করা যেতে পারে যে, ফুকো স্পিরিচুয়ালিটির যে ধারণা হাজির করেছেন, ইসলামী সভ্যতার রুহানিয়াত সংক্রান্ত ধারণার সাপেক্ষে তা একটি প্রাথমিক মোকাম বা স্তরের রুহানিয়াতের ধারণা। ফুকো পরবর্তী সময়ে অবশ্য পাশ্চাত্য চিন্তা আরো অগ্রসর হয়েছে। ফুকো ও তার সমসাময়িক উত্তর-কাঠামোবাদী লেখকরা পাশ্চাত্য চিন্তাজগৎ থেকে মানবীয় কর্তাসত্তার ধারণাটির যে কেন্দ্রচ্যুতি ঘটিয়েছেন, তার ফলশ্রুতিতে ভাষাকেন্দ্রিক অস্তিত্বতত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এবং এখন আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে অবজেক্ট অরিয়েন্টেড অন্টোলজি  এবং নয়া বস্তুবাদী ধারার চিন্তাও বিকশিত হয়েছে, যা মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণ ও অপ্রাণ সত্তার প্রাণশক্তি বা ভাইটাল এজেন্সির তত্ত্ব হাজির করেছে। তবে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, এইসবই মোটাদাগে সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যের জ্ঞানতত্ত্বের ইতিহাসের সাথে যুক্ত ঘটনা। পাশ্চাত্যের নাগরিকদের মানবিক মর্যাদা অতোটা ঝুকির মধ্যে সাধারণত পরেড়ে, যতোটা পড়ে তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের মানবিক মর্যাদা। পাশ্চাত্য চিন্তা ও আইনের জগতে মানুষের এজেন্সির ধারণা দীর্ঘকাল থেকেই এতোটা প্রভাবশালী রয়েছে যে, তাদের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে মানুষকে কেন্দ্রচ্যুত করে এজেন্সি সংক্রান্ত তত্ত্ব উদযাপন করা সম্ভব। আমাদের ঐ প্রিভিলেজটুকু অনুপস্থিত। এই কারনেই আমাদের সফরটা হয়তো অরো কঠিন। তবে একদিক থেকে তা অপেক্ষাকৃত সহজও, যেহেতু আমরা ইতিমধ্যেই বর্তমান দুনিয়ার জ্ঞান-ক্ষমতার এপারেটাস ও আইনি ব্যবস্থার সাপেক্ষে এমন এক অপর সত্তায় পরিণত হয়েছি, যারপক্ষে সহজেই অন্যান্য সত্তার সাথে সম্পর্ক আবিষ্কার করা সম্ভব। তবে, তার জন্যে সবার আগে প্রয়োজন এই অপর সত্তাকে উপলদ্ধি করতে শেখা।

এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই যে, আমাদের সময়ে রাজনৈতিক রূপান্তরের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার দিকগুলো বোঝার জন্যে ফুকোর স্পিরিচুয়ালিটি সংক্রান্ত তত্ত্বটি যথেষ্ট উপকারী । কিন্তু রাজনৈতিক রুহানিয়াতের এমন একটি ধারণায় আমাদের পৌছাতে হবে, যা ব্যক্তি মানুষের রূপান্তরের রুহানি ইচ্ছার সফর পার হয়ে বাকিসব সত্তার রিপ্রেজেন্টেশনের দায়িত্ব নিতে সক্ষম। এইদিক থেকে চিন্তা করলে ব্রুনো লাতুর প্রস্তাবিত ডিঙ্গোপলিটিকের ধারণাকেও রাজনৈতিক রুহানিয়াতের আওতাভুক্ত ভাবা যেতে পারে। লাতুর প্রস্তাবিত ডিঙ্গোপলিটিক এমন এক ধরনের গণতন্ত্রের প্রস্তাব করে যা বিষয়বস্তুর সঙ্গে কর্তার সরল বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠতে চায়। অর্থাৎ, মানুষই হলো সাবজেক্ট আর বাকি সবকিছু তার কাছে অবজেক্ট–এই পরাবিদ্যামূলক বাইনারি অতিক্রম করতে চায়, যেন গণতন্ত্রের মধ্যে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন সত্তার রিপ্রেজেন্টেশন সম্ভব হয়। লাতুরের প্রস্তাব হলো, আমাদেরকে অবজেক্ট বা বিষয়বস্তুর ধারণা অতিক্রম করে ‘থিং’ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। থিং ধারণাটি নিয়ে আধুনিক অস্তিত্বতত্ত্ব আলোচনায় অন্যতম প্রধান সূত্র হলেন হাইডেগার। হাইডেগারের মতে, আমরা যখন আর কোনো কিছুকে অবজেক্ট হিসাবে ধরতে পারিনা, তখন থিং ধারণাটার ব্যবহার করি। অক্সফোর্ড ডিকশনারি এবং হাইডেগারের বরাত দিয়ে লাতুর দেখান যে, ইংরেজি থিং শব্দটির আদি অর্থ হলো ‘সমাবেশ বা সংসদ’। হাইডেগার থিং ধারণাটিকে এমন এক সমাবেশের ধারণা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যার মধ্যে মানুষ, প্রাণী ও দেবতাদের সমাবেশ ঘটে। লাতুরও থিং ধারণাটি দিয়ে তিনি এমন এক সমাবেশের কথা বলেন যার মধ্যে শুধু মানুষই নয়; বরং নানান অমানবিক সত্তারও উপস্থিতি রয়েছে (লাতুর ২৩)।

পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে যে মহাপ্রলয়ের সম্মুখীন আমরা এখন হয়েছি, তাতে মানুষ ছাড়াও বাঙলার সকল প্রাণ ও প্রকৃতির রিপ্রেজেন্টেশন রাজনীতি গড়ে তোলার আসলে কোনো বিকল্প নাই। আমরা বাঙলার মানুষ এখন এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, যখন জাতিরাষ্ট্র এবং বিভিন্ন কর্পোরেশনের এজেন্সিই রাজনীতি ও আইনি ব্যবস্থায় মূখ্য হয়ে উঠেছে। জনগণের আইনি অধিকার ও গণতান্ত্রিক রিপ্রেজেন্টেশন যেমন সংকুচিত হয়ে গেছে, তেমনই হাজির নাই প্রাণ ও প্রকৃতির আইনি অধিকার ও রাজনৈতিক রিপ্রেজেন্টেশন । জ্বালানি কর্পোরেশনগুলোর লিগাল এজেন্সি আছে। কিন্তু সুন্দরবনের কি তা আছে? অথচ আইনের ডিসকোর্স স্বীকৃতি না থাকলেও সুন্দরবনের মানুষের কাছে বনবীবী এক জীবন্ত অস্তিত্ব। 

যে গণতন্ত্রহীনতার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে বসবাস করছে, তাতে গণতন্ত্র নিয়ে এই ধরণের তত্ত্বচর্চা হয়তো অনেকের কাছে বিলাসিতাও মনে হতে পারে। কিন্তু এই গণতন্ত্রহীনতাই হয়তো নতুন করে গণতন্ত্র নিয়ে ভাবনার, এবং খোদ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই বৈপ্লবিক রূপান্তরের সবচাইতে বৈপ্লবিক মহূর্ত। যেহেতু আমাদের পুরাতন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন সময় নতুন করে সৃষ্টি করার। তবে তারজন্যে আমাদেরকে পাশ্চাত্যের সাম্প্রতিক তত্ত্বচর্চার গন্ডি অতিক্রম করেও চিন্তা করতে পারতে হবে। সুফিতত্ত্বের রূপক ব্যবহার করলে, এই ধরণের চিন্তা হলো এমন এক রুহানি সফর, যার লক্ষ্য বস্তুজগত থেকে উড্ডয়ন করে রুহানি জগৎ (ফেরেশতি জগৎ) পার হয়ে নাম ভাষা তথা লাওহে মাহফুজের জগতের অভিজ্ঞতা লাভ করা। যে জগৎ শুদ্ধ সম্ভাবনার জগৎ। শুধুমাত্র দুইজন ফেরেশতা এই স্তরে উড্ডয়ন করতে পারেন – জিবরাইল ও ইসরাফিল। এবং আল ইনসান আল কামেল নামক মানুষ। তাই তারপক্ষে নতুন জ্ঞান অর্জন সম্ভব, এবং সম্ভব পুরাতনের ধ্বংস – ও নতুনের সৃষ্টি।

ছবি- লুবনা চর্যা

তথ্যসূত্র

[গাজালি] al-Ghazālī, Abī Ḥāmid. The Revival of Religious Learnings, Bk. III, Transleted by Fazlul Karim. Darul Ishaat, Karachi 1993
[হানেগ্রাফ] Wouter J. Hanegraaff, “Reconstructing ‘Religion’ from the Bottom Up,” Numen 63. 2016
[ডা’নকোনা] D’Ancona, Cristina. The Theology Attributed to Aristotle. Sources, Structure, Influence,” The Oxford Handbook of Islamic Philosophy, K. El-Rouayheb and S. Schmidtke (eds.), Oxford: Oxford University Press. 2007.
[আরাবি] Arabi, Ibn al. The Bezels of Wisdom. tr. R.W.J. Austin. Paulist Press, Mahwah, 1980.
[বেনেট] Bennett, Jane. Vibrant Matter: A Political Ecology of Things. Durham: Duke UP, 2010.
[চিত্তিক] Chittick, William C. “Ibn ‘Arabi and His School”. Islamic Spirituality. Manifestations. ed. Seyyed Hossein Nasr. The Crossroad Publishing Company, New York 1997, pp. 49-70.
[জিলানি] Jilani, Hadrat Ábd al-Qadir al. The Secret of Secrets, Cambridge, Islamic Texts Society, 1992.
[সাইফ, এরাবিক] Saif, Liana. The Arabic Influences on Early Modern Occult Philosophy. London, Palgrave Macmillan, 2015.
[সাইফ, ফ্রম গায়াত] Saif, Liana. “From Ġāyat al-ḥakīm to Šams al-maʿārif: Ways of Knowing and Paths of Power in Medieval Islam”. Arabica 64, 297-345, Brill, 2017.
[আল উস্তুয়াত্তাস] Pseudo-Aristotelian Hermetica: al-Ustuwaṭṭās. Paris, BnF, Arabe 2577, Translated by Liana Saif.
মজহার, ফরহাদ, মার্ক্স, ফুকো ও রুহানিয়াত, আগামী প্রকাশনী, ২০১৮
মজহার, ফরহাদ, “রুহ ও নফসের দ্বন্দ্ব”, এবাদতনামা, আগামী প্রকাশনী, ২০০৫
[ফুকো] Foucault, Michel. Political Spirituality as the Will for Alterity: An Interview with the Nouvel Observateur. Translated by Sabina Vaccarino Bremner.


[1] কিতাব আল উস্তুয়াত্তাসের কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রকাশিত সংস্করণ অনুপস্থিত। এই লেখাটির জন্যে একটি আরবি ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে লিয়ানা সাইফের করা বইটির ভূমিকা ও প্রথম অধ্যায়ের ইংরেজি অনুবাদের (অপ্রকাশিত) উপর নির্ভর করেছেন লেখক।   

পারভেজ আলম

লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী। ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টার্ডামের সংস্কৃতি বিশ্লেষণ বিভাগে গবেষণারত। প্রকাশিত বইঃ মদিনা (২০২০), মুসলিম জগতের ক্ষমতা-সম্পর্কের ইতিহাস; জিহাদ ও খেলাফতের সিলসিলা (২০১৬), ডিসেপেয়ারিং পাবলিক স্ফিয়ার্স (২০১৬), শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প (২০১৪), মুসলিম দুনিয়ার জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই (২০১১)।

Share