।। হাসান রোবায়েত ।।
মুসলমানের ছেলে
১
কাউকে বোলো না তুমি আমাদেরও কথা হয়েছিল
হয়েছিল দেখা যেন, সান্দ্র সে দূরের কোথাও
গ্রিলের জানালা ধরে দুপুরের আলো, রূপছায়া
সমস্ত খাঁখাঁ নিয়ে জলে ছায়া ফেলে চলে যাও—
তোমার হদিস যেন পাতার পেছনে সেই হাওয়া
সমুদ্রের দূর থেকে যে আসে গানের মতো করে
সুর ভুলে যায় যারা তাদের কি দোষ দিই বলো
বাগান কি জানে তার ফুলগুলো কেন ধু ধু ঝরে—!
ফারসি ভাষার মতো তোমার দু চোখে কী যে মায়া—!
হিন্দুর মেয়ে তুমি, আমারও ধর্মে ছিল ভয়
আমার আঙিনা ফাঁকা থেকে গেল চিরকাল—দূরে
পা টিপে চলার মতো বৃষ্টি পড়ছে মনে হয়—
মানুষ যে কাকে চায়, কাকে করে বুকের মানিক
কার জন্যে ডুবে মরে, আজীবন কাকে দেয় ধিক—
২
বলো নি কাউকে কিছু লুকিয়ে কেঁদেছ ঘরে একা
প্রতিবেশীদের থেকে আড়ালে থেকেছ বহুদিন
যেন তারা বুঝে নেবে তোমার বুকের কালো তিলে
রয়েছে যে দাগ আজো যেন এক সোনালি হরিণ
বনের সারাটা পথ ঘুরে ঘুরে তোমার কাছেই
চেয়েছে পানির দিশা—জেনেছি সমুদ্র শুধু নুন
আমার পানীয়ে ছিল তার চেয়ে বিষের নিদান
হিন্দুর মেয়ে তুমি আর আমি বাঙালি তরুণ—
আমার ভাষায় ছিল পুরানা গাঙের হাঁটু পানি
লোকালয় ঘুরে ঘুরে জোগাড় করেছি মিঠা স্বর
হাওড়ে ধানের মতো দুলে ওঠে চোখের বাতাস
এখানে আজান শুনে নাও ছাড়ে চাঁদসদাগর—
মাটির দরদ তুমি, নামাজের রেওয়াজ-রসম—
তোমাকে বিরহ করি চোখ ছুঁয়ে, খোদার কসম—
৩
তাদের বাড়ির পাশে যে জাম গাছটা হাওয়া দেয়
আমি তার থেকে দূরে থাকতে পারি না বেশিদিন
যার গাছটার হাওয়া এতটা মধুর লাগে তার
না জানি চোখের ভাষা কী যে স্বাদ, কতটা শিরিন!
সে-ও কি পাতার মতো খালি ঝরে উথাল-পাথাল
মাদরাসা পার হয়ে একা যায় হেঁটে হেঁটে দূরে
সুবহান আল্লা বলে তাকে দেখি, ফিরে বহুবার
যেভাবে দেখত রাই দিনরাত বুকের কানুরে—
আমি কি শুধুই ভাবি দাঁত দিয়ে নখ কাটা তার
উর্দু শেরের মতো দুটা ঠোঁট আফরিঁ আফরিঁ
দুপুরে নিরলে হাঁটে তুলাবীজ যেন উড়ে যায়
পায়ের প্রতিটা দাগ ফুল তোলা সলমা ও জরি—
মানুষ যাকেই চায় ভুল করে চায় জেনে শুনে
নিজেকে পোড়াতে চেয়ে হাত রাখে গভীর উনুনে—
৪
তোমার সঙ্গে দেখা কতদিন হয় নি আমার
সেই যে রিক্সায় কথা—তারপর, অনেক বছর!
তখন দুপুর ছিল জোহরের আজানের নিচে
জ্বালে জ্বালে ধোঁয়া ওঠা দুধের মতন শাদা সর—
তোমার মুখের মায়া ছোট ছোট সুরার মতন
কারিরা যেমন করে টান দেয় দীর্ঘ আয়াত
সেইভাবে দূর থেকে আমাকেও ডেকেছিলে তুমি,
নিয়েছিলে খুব কাছে, ইশারায় কেঁপেছে দু হাত—
এখানে ছড়িয়ে আছে ঝরে যাওয়া হাওয়ার পালক
আমাকেও বোলো সব সংসার বয়সী হলেই
কী হবে সেলাই কওে কবেকার দেয়া সেই জামা
সুঁই-সুতা সবই আছে আগেকার প্রেম খালি নেই
মানুষ কোথায় যাবে দাঁড়াবে কোথায় বলো আর
যদি না ঘরের মাঝে থাকে ঘর, প্রেম, সংসার—!
৫
তোমাকে লেখার কথা ইদানীং ভাবি না তো আর
এখন দুপুর এসে থমকে আছে আতার বাগানে
কী যে মায়া হয় আজো! বুকের ভেতরে ধরফর
করে ওঠে! তবু দিন চলে যায় কোথায়? কে জানে!
এখনো তোমার কথা মনে পড়ে সময় সময়
যখন দুপুর আসে পাটকিলে পাখির ডানায়
আমাকে দরদ করে ডেকেছিলে ‘ধূসর প্রেমিক’
যেভাবে নতুন বউ ভালোবাসা শরমে জানায়—
পুড়েছে হাতের তালু ভাগ্যও পুড়ে গেছে সাথে
বিটপী ফলের মতো তোমাকেও হয়েছিল ছোঁয়া
একদিন ভুল করে ছুঁয়েছিলে আমার আঙুল
রুকুতে যেভাবে কেউ ভুলে পড়ে সেজদার দোয়া
যাদের পা নাই, শোনো, তাদেরও গন্তব্যে যেতে হয়
যে ফেরার ফিরে আসে বেশি দিন নেয় না সময়—
৬
তোমাকে পড়েছে মনে আজ এই কী নিধুয়া রাতে
যখন গজল বাজে গোলাম আলীর গাওয়া সুরে
বোলো না কিছুই আর নিজেকে বা বন্ধুর কাছে
বন কি কখনো চায় দাবানলে সব যাক পুড়ে—?
নামাজ শিক্ষায় পড়া তুমি যেন রুকুর নিয়ম
ছোট ছোট বাচ্চাদের মসজিদে মিঠা চিৎকার
স্বামীর ফেরার পথে চেয়ে থাকা বউয়ের নিকট
তুমি যেন মাস শেষে কী আকুল বৃহস্পতিবার—!
কখনো ভুলি না সুরা ফাতেহার প্রতিটা আয়াত
সেইমতো ভুলি নাই তোমার কথাও কোনোদিন
স্বজনের জন্য যদি দোয়া করে ইমাম সাহেব
তোমার মুখটা ভেবে আমি বলি ‘ছুম্মা আমিন—
তোমাকে ভুলি নি মেয়ে, তুমি যেন টেক্কার তাস,
যেমন ভোলে না কেউ কখনোই সুরা ইখলাস—
৭
তোমাকে ভোলার পর মনে পড়ে নামাজের কথা
কত না সময় আমি আলস্যেই করে দিই পার
কখনও সবুর করি ভুলে গিয়ে ওয়াক্ত নামাজ
তারপর চেয়ে থাকি কোনদিন আসে শুক্রবার—
তুমি কি রুকুর মতো অথবা কি সেজদার দোয়া
বহুদিন পরে পড়া নামাজেও মনে পড়ে ঠিকই
পুরানা ড্রয়ারে থাকা তুমি যেন মুদ্রা ভীনদেশী
হঠাৎ কৈশোরে কেউ দিয়েছিল যে আধুলি, সিকি—
একদা তোমাকে দেখা হতো কোনো রিক্সায় ভুলে
যেন বা বিরল পাখি অরণ্যের নাই যে কোথাও
আমাকে খুনের পরে চলে গেছ মাড়িয়ে শরীর
ছুরিকে ছুরিই ডাকি চিরদিন, হোক না ভোঁতাও—!
এখানে হাওয়ারা বয় যেন উর্দু শেরের কালাম
তুমি তো নামাজ শেষে ডানে বাঁয়ে ফেরানো সালাম—
৮
যদি ভুলে যাই, যেন ফিরে আসি তোমার হাতের
চাল ধোয়া পানি হয়ে—সুরা কাওসার যেইভাবে
বারবার ফিরে আসে মুসল্লির ওয়াক্ত নামাজে
আমি যেন ফিরে আসি চাল শেষে ভাতের অভাবে—
তোমাকে হঠাৎ যেন দেখতে পাই আজারে-বাজারে
কখনো স্বামীর পাশে হাত ধরে থাকা রিক্সায়
তোমার শাঁখার গায়ে আমি যেন ছোট ছোট ধুলা
প্রেম তো এমন ক্ষত ওষুধে যা আরো বেড়ে যায়—
এহরাম বাঁধা তুমি হাজিদের সফেদ কাপড়
সুরা আর রাহমানে কারিদের কণ্ঠে বেহুশ
নগরীর পথে পথে আমের ফুলের মতো তুমি
আমার নবীর প্রেমে দরদের জশনে জুলুস—
তুমি কি এমন রোগ পথ্য যার নাই কোনো দিনই—!
মানুষ প্রেমের কাছে আজীবন থেকে যাবে ঋণী
৯
তোমার যাওয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকি খালি
ছুরির নিচেই শোওয়া আমি যেন সুঠাম মহিষ
আমাকেও ধরে আছে পা চিপে মানুষ কয়জন
বড় বড় চোখ করে খুঁজে ফিরি তোমার হদিস—
যেখানে নাব্যতা নাই আমি সেই নদীর মতন
পাড়ে তুমি বসিয়েছ কী গভীর বালুর ড্রেজার
মেশিনে কেটেছে মাটি পাথরের ছায়া, উপছায়া
তাও তুমি খুশি নও অহেতুক দারুণ বেজার—
তোমার ফেরার দিকে চেয়ে থাকি, যেন আমি কোনো
রাস্তায় জবাই করা পশুদের ধুধু খোলা চোখ
আবার ফিরবে তুমি একদিন ঠিকই এই পথে
সেই জন্য চেয়ে থাকি, মরা চোখে ফেলি নি পলক—
তোমার ছুরির নিচে আমার তো পশুর দশাই
দু চোখে সুরমা দেওয়া তুমি যেন তরুণ কশাই—
১০
যদি ফিরে এসে দেখো কবর খুঁড়ছে লোকজন
মসজিদে মসজিদে ঘোষণা হয়েছে মউতের
হয়তো তোমাকে দেখে বলে যাবে আমার স্বজন
এসেছে আবার ফিরে ‘হৃদয়ের জালিম কাফের’—
খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে আমিও কি তাকাবো আবার
তোমার দু চোখ যেন ফেটে আছে আনারের দানা
তুমুল ভ্রুকুটি হেনে বুঝে নেবে কাফনের দাম
গুনে নেবে লাভটুকু পাইপাই করে ষোলোআনা—
তুমি ছিলে কাফনের পুরানা চতুর ব্যবসায়ী
আমার ছিল না কোনো ইয়ার-দোস্ত সদাগর
খাঁখাঁ চোখে চেয়ে থাকি আমি সেই আড়তের মাছ
লোকে খালি টিপে দেখে, আমাকে কেনে না তারপর—
আমি তো ভীষণ লাশ ভুলে গেছি জীবনের কেতা
এটাই বরং ভালো তুমি হও কাফন বিক্রেতা—
হাসান রোবায়রেত
জন্ম ১৯ আগস্ট, ১৯৮৯; বগুড়া। শিক্ষা : পুলিশ লাইন্স হাইস্কুল, বগুড়া। সরকারী আজিজুল হক কলেজ; বগুড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত বই — ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৬] ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে [ভারতীয় সংস্করণ, বৈভাষিক, ২০১৮] মীনগন্ধের তারা [কবিতা; জেব্রাক্রসিং, ২০১৮] আনোখা নদী [কবিতা; তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৮] এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে [কবিতা; ঢাকাপ্রকাশ, ২০১৮] মাধুডাঙাতীরে [কবিতা; ঐতিহ্য, ২০২০] ই-মেইল : hrobayet2676@gmail.com