বাসুদেব দাস বাউলের সাক্ষাৎকার: অতনু সিংহ
বাংলাদেশের মতোই পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে বাউল-ফকিরদের গুরুত্ব অপরিসীম। নদীয়া, বীরভূম, বর্ধমান, দুই ২৪ পরগনা, হুগলী, মুর্শিদাবাদ-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় রয়েছেন অসংখ্য বাউল-ফকির। নদীয়ার ফকিরদের সঙ্গে অবশ্য বীরভূম-সহ গোটা রাঢ়বঙ্গের বাউল-ফকিরদের সঙ্গে চিন্তা-চর্যায় ফারাক আছে অনেকাংশে। রাঢ় বঙ্গের তন্ত্র বা রাঢ়ি তন্ত্রের প্রভাব আছে এখানকার বাউলদের মধ্যে। এই রাঢ়বঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ জেলা বীরভূম। বীরভূম জেলায় চিশতিয়া ধারাও গুরুত্বপূর্ণ। ফলত রাঢ়বঙ্গের বীরভূম জেলা বাউল-ফকিরদের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। বীরভূমের বাউলদের মধ্যে তন্ত্র, চিশতিয়া ধারা নানা প্রভাব রেখেছে যেমন, পাশাপাশি লালন ঘরের প্রভাবও রয়েছে এখানে। এই বীরভূমেই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন আশ্রম। যেখানে প্রতিবছর পৌষমেলায় শান্তিনিকেতন ব্রাহ্ম সাংস্কৃতিক পরিসরের পরিবর্ধন করে হয়ে উঠতো বাউল-ফকিরদের দরবার। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে যখন থেকে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে তখন থেকেই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বা শান্তিনিকেতনকে দখল করতে তারা উদ্যত। আরএসএস বা সংঘ পরিবারের ক্যাডার এখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। তিনি পৌষমেলা বন্ধ করে দিয়েছেন, বিশ্বভারতী তথা শান্তিনিকেতনকে বাউল-ফকিরদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার যাবতীয় চেষ্টাতেও কসুর করছে না বিজেপি। আবার একই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী পরিসরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাউল-ফকিরদের ঢুকিয়ে ফেলে বাংলার ভাব ও ভক্তি চর্চার এবং মানুষ-প্রাণ-প্রকৃতির এবাদতের ধারাগুলোকে বিকৃত করার চেষ্টায় রত। ঠিক এ কারণেই বিজেপি চরম হিন্দু জাতিবাদী নেতা ও ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহ শান্তিনিকেতনে বাসুব দাস বাউলের বাড়িতে গিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল, জাতপাত-বর্ণগোত্র সংস্কৃতির বিপরীতে থাকা বাসুদেবকে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির অন্দরে ঢুকিয়ে ফেলা, দ্বিতীয়ত, বাসুদেব দাসেদের লোকপ্রিয়তাকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ব্যবহার করা। বাসুদেব দাস অতিথি অমিত শাহকে মানুষ জ্ঞানেই আতিথেয়তা করেছিলেন বটে কিন্তু পরে গণমাধ্যমের সাহায্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এহেন জাতিবাদী রাজনীতির সঙ্গে, ভেদাভেদের আলাপে, কর্তৃত্বের কোনো বিষয়ে তিনি নাই। বাসুদেব দাসকে আমরা সবাই চিনি। বৃহৎ বঙ্গে শুধু নয়, শুধু উপমহাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে তিনি বাউলশিল্পী হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে তাঁর। অথচ অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেন। একজন বাউলের জীবন যেমন হয় আর কী। তাঁর এক সময়ের বন্ধু পবন দাস সেই কবে বীড়ভূম থেকে প্যারিসে উড়ে গিয়ে প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর আরেক বন্ধু গৌর ক্ষ্যাপা যেভাবে সারা জীবন বীরভূমের মাটির মানুষ হয়ে থেকেছেন, মাধুকরী কাটিয়েছেন আমৃত্যু জীবন- ঠিক তেমনই বাসুদেব দাস বাউল শান্তিনিকেতনের শ্যামবাটি সুভাষপল্লি অঞ্চলে নিজের বসতভিটায় স্ত্রী তথা যুগলসঙ্গীনি ঊর্মিলা দাস বাউলের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করছেন। গত জুলাই মাসে বাসুদেব দাস ও ঊর্মিলা দাসের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিলেন ‘প্রতিপক্ষ’র নির্বাহী সম্পাদক অতনু সিংহ, সঙ্গে ছিলেন বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের গবেষক ও বোলপুর কলেজের অধ্যাপক কনকলতা সাহা। আমরা ‘প্রতিপক্ষ’র বর্ষপূর্তি সংখ্যায় এই আলাপচারিতাটি প্রকাশ করছি। অনুলিখন- নিষাদ প্রধান।
‘মনের মানুষ মনের ভেতরেই রয়েছে’
বাসুদেব দাস বাউলের সাক্ষাৎকার: অতনু সিংহ
বাসুদেব দাস: জয়গুরু।
অতনু সিংহ: জয়গুরু। বাসুদেবদা, আমাদের প্রতিপক্ষ পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন, শুভেচ্ছা।
বাসুদেব: ধন্যবাদ।
অতনু: আপনি কতদিন এই বাউল সাধনার সঙ্গে, বাউল সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন?
বাসুদেব দাস: আমার এই বাউল ভাবনা নিয়ে মোটামুটি আমার যখন নয়/দশ বছর বয়স, তখন থেকেই আমি বাউলের এবং বাউল তো বুঝি না তখন, গানের যে ভাব, গানের সুর, সে সুরে আমার মনটা পাগল করে দিয়েছিলো। ওই নয়/দশ বছর বয়েস তখন মোটামুটি আমার। এটা হলো কি করে? পুরনো বাউলরা গ্রাম দিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরতে আসতো, বীরভূম জেলার গড়গড়িয়া গ্রামে আমার জন্মস্থান, বোলপুর থেকে ঠিক আঠারো কিলোমিটার দূরে। তো সেই গ্রামে ভিক্ষা করতে আসতো বাউলেরা, তাদের পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতাম। তা এই যে বাউল গানের যে সুর, সেইগুলো আমাকে ঘরে থাকতে দিতো না, এরকম অবস্থা, গান আমাকে গাইতে হবে। সে মুখে আমার গান লেগেই থাকতো, ওই বয়স থেকেই আরকি। তারপর বিভিন্ন বাউলদের সঙ্গে সঙ্গ করতে করতে আজকে আমার গানের বয়স হচ্ছে মোটামুটি পয়তাল্লিশ বছর, কি আরেকটু বেশি হবে।
অতনু: আপনি বাউল সাধনার সঙ্গেও তো যুক্ত থেকেছেন?
বাসুদেব: আস্তে আস্তে বাউলদের সাথে বাউল সাধনা, বাউল ধ্যানধারণা, সুরের, তালের সবকিছুই গুরু কৃপায় অল্প অল্প পেয়েছি। সেই নিয়ে আরকি আছি।
অতনু: আপনার গুরু কে?
বাসুদেব: আমার গুরু ছিলো পাচ জন। প্রথম গুরু ছিলো স্বপন/সাধন চ্যাটার্জি বলে একজন, ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। তারপর আমার মায়ের কাছে শিখেছিলাম, আমার মায়ের বাউল সাধনা ছিলো। তারপরে দীননাথ দাস বলে একজন ছিলেন, বিশ্বনাথ বাউল, শম্ভুদাস বাউল, বাঁকাশ্যাম দাস বাউল। এনারা সব পুরনো বাউল ছিলেন। এসব বাউলদের কাছে আমি সঙ্গ করতাম, তাদের কৃপা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেয়েছি।
অতনু: আপনার সমসাময়িক বীরভূম বা বোলপুরের আরো দুজন আরো দু’জন এখানকারই বাউল এবং এই সহজিয়া ঘরের মানুষ তারা, গৌরক্ষ্যাপাএবং পবনদাস বাউল। তাদের সঙ্গেও তো আপনি বিভিন্নভাবে যুক্ত।
বাসুদেব: পবনদার সঙ্গে আমরা একসঙ্গে গান গাইতাম, গৌরক্ষ্যাপার সঙ্গেও গান করতাম। আমরা সবাই একসঙ্গেই করতাম আরকি। আমার সিনিয়র… পবন আমি একসঙ্গে, গৌরদা আমার সিনিয়র।
অতনু: ওদের সঙ্গে তো আপনার বোধহয় উপমহাদেশের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম করা হয়েছে?
বাসুদেব: হ্যাঁ, বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম করেছি… ইউরোপে, যেমন হল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, এইগুলো সব প্রোগ্রাম করেছি।
অতনু: আচ্ছা, এগুলো তো অনেক পরের, মানে যখন অনেক পরে আপনার খ্যাতি বা অন্যান্য জায়গায় অনুষ্ঠান করা, এগুলো তো অনেক পরে। মানে এখন তো বাউল বা বাউলফকিরি গান ইত্যাদি অনেক পপুলার হয়েছে। কিন্তু একটা সময় তো এগুলো ভদ্রলোক বা বাবুশ্রেণীর বাইরের ব্যাপার ছিলো। তো সেক্ষেত্রে তো আপনাদের একসময় একটা স্ট্রাগল ছিলো। সেইটা কেমন ছিলো?
বাসুদেব: হ্যাঁ, ঘুরে বেড়াতাম সবসময়, গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে মাধুকরী করে বেড়াতাম আমি।
অতনু: আচ্ছা, মাধুকরী করতেন?
বাসুদেব: হ্যাঁ, মাধুকরী করে বেড়াতাম। এইটাই আমার জীবন ছিলো। আজও মোটামুটি মাধুকরী জীবন রেখেছি আমি, আজও মাধুকরী করি আমি। ওটা ছাড়া যাবে না। ওটা একটা আলাদা স্বাদ, আলাদা ভাব।
অতনু: মানে মাধুকরী না করলে ফকির বা বাউল কিছু হওয়া যায় না?
বাসুদেব: মানে এটা না করলে মন ভালো থাকবে না।
অতনু: বুঝতে পেরেছি। একুশে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের আগেই দেখতে পেলাম আপনার কাছে ভারতের আজকের যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেই অমিত শাহ এলেন, এমন বহু রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি আপনাদের কাছে আসেন। কিন্তু আপনি বা আপনারা কোনোদিন,কখনো কিছু চেয়েছেন? অমিত শাহকে আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো চাওয়া-পাওয়ার কথা বলেছেন?
বাসুদেব: না, সে ইচ্ছা কখনোই ছিলো না যে, তাদের কাছে কিছু দাবী করবো, কিছু চাইবো। এটা মনের ভেতরে কখনোই ছিল না। আমরা মানুষকে ভালোবাসি এবং মানুষকে গান শোনাতে চাই, এটাই একটা বড়ো ব্যাপার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন আমার বাড়িতে, এটাও আমার একটা ভাগ্যের ব্যাপার, যে ওনার মতো একটা বড়ো মাপের মানুষ আমার বাড়িতে এসে পদধূলি দিয়েছেন। আমরা একসঙ্গে সেবা নিয়েছি, এটা আমার বড়ো পাওয়া। আমার চাওয়া-পাওয়া কিছু ছিলো না বা আগেও নেই। আমি আমার বাউলের জায়গাতে আমার মাধুকরী করে খাই এবং এই মাধুকরীতেই আমার জীবন আজও পর্যন্ত যাচ্ছে।
অতনু: আপনাকে একটা অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করি। আপনারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ এসবের উর্ধে উঠে মানুষের কথা বলেন, প্রাণ-প্রকৃতির কথা বলেন, সকলকে নিয়ে বাঁচেন এবং মানুষের মধ্যে পরম বাস করেন একথা বলেন। কিন্তু অমিত শাহদের যে বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ বা রাজনৈতিক পথ, তারা তো একটা ধরণের মানুষে মানুষে বিবাদ তৈরি করতে চায় এবং এ বড়ো, এ ছোট, অমুক ধর্ম শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি ইত্যাদি কথা বলার চেষ্টা করে এবং সেটা নিয়েই তো তাদের রাজনীতি….
বাসুদেব: বাউলদের একটাই ধর্ম। বাউলরা কোনো গ্রন্থ, কোনো মন্দির, কোনো মসজিদ ফলো করে না। বাউলদের জীব ধর্ম। তাদের একটাই লক্ষ্য, তারা সর্বজীবে প্রেম বিলাইতে চায় এবং সর্বজীবকেই ভালোবাসতে চায়, কাছাকাছি থাকতে চায়। এবং এই গান দিয়েই সর্বজীবকে বুঝাইতে চায়। মানুষের গান, দূঃখের গান, সুখের গান, প্রেমের গান এসব দিয়ে মানুষকে বুঝাইতে চায় যে তোমরা কী করবে, কী করছো, কেন করছ। এটাই বাউল গান। যেমন আমি একটা গান গেয়ে থাকি, আমাদের জীবনের একটাই কথা, কখন যেন আমাদের চলে যেতে হবে, সেটা আমরা কেউ জানি না। এই নিয়ে অনেক গান আছে, দেহতত্ত্ব নিয়ে অনেক গান আছে, মানুষতত্ত্ব নিয়ে অনেক গান আছে, মন নিয়ে অনেক গান আছে। সেইসব গান মানুষের কাছে আমরা পরিবেশন করি, যাতে মানুষ সুস্থ থাকে এবং খুশি থাকে। এইটাই হচ্ছে বাউলের কাজ। বাউলের যে টাকা ইনকাম করা বা কিছু পাবো এইসব না। যদি সত্যিকারের বাউলের মনটা তার ভেতরে থাকে তাহলে সে টাকার পেছনে যাবে না।
অতনু: তার মানে একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি এসেছিলেন, তিনি হয়তো মনে করতে পারেন, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করেন। কিন্তু আপনি সে মানুষ হিসেবে এসেছে বা তাকে সেবা দিয়েছেন। কিন্তু তার রাজনীতি সাথে কোনোভাবে….
বাসুদেব: না না, একদম। উনার রাজনীতি ওটা উনার ব্যাপার। এটা তো যুগ যুগ ধরে আসছে, এটা হবে। তা আমি মানুষ হিসাবে উনাকে গ্রহণ করেছি, যে আমার কাছে একজন মনের মানুষ এসেছে, তাকে সেবা দিতে হবে, এই আমার মনের ভাবনা ছিলো।
অতনু: বুঝতে পেরেছি। আপনি কোন কোন সাধু বা কোথায় কোথায় সাধুসঙ্গ… মানে এখন তো শুধুমাত্র বাউল বা ফকিরি গান একটা জাস্ট বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটা সময় দেখতাম যে, এটা তো একটা সাধনার অংশ গানটা, মানে আপনারা যে গানটা করেন সাধুসঙ্গের মধ্যে। এ বিষয়টা কি আপনারা কোথাও একটা অনুভব করবন যে এখন সাধনা ব্যাপারটা বা সাধুসঙ্গ ব্যাপারটা গৌণ হয়ে গেছে। মুখ্য ব্যাপারটা শুধুমাত্র আপনাদের বিনোদন হিসেবে নিতে চাইছে? কিন্তু আপনাদের যে পথ, আপনাদের যে ভাবনা ব্যাপারটা কি কোথাও একটা মনে হয় যে এটা একটা গৌণ ব্যাপার হয়ে গেছে?
বাসুদেব: এবার একটা কথা বলি। গানের মধ্য দিয়ে যে বাউল বুঝিয়ে যায় এই গানের জগটাকে, কেউ ছবি দিয়ে বোঝাচ্ছে, কেউ গান দিয়ে বোঝাচ্ছে, কেউ কবিতা দিয়ে বোঝাচ্ছে। এটা একটা জীবনযুদ্ধ, মানুষের একটা জীবনযুদ্ধ। তা কেউ নিতে পারছে, কেউ পারছে না। যে নিতে পারছে সে সব বুঝতে পারছে আর যে পারছে না সে কিছুই বুঝছে না, সে সুর শুনে ঘরে চলে যাচ্ছে, এরকম হয় অনেক সময়। কিন্তু যে নেবার সে নিচ্ছে। কিন্তু বাউল এটা ভাবে না যে তোমায় নিতেই হবে। আমার কথা আমি বলে দিয়ে যাচ্ছি, তোমার যদি ভালোলাগে তুমি নাও, ভালো না লাগলে নিও না। মানলে ভালো, না মানলে আরো ভালো, তোমার জন্য আরো ভালো।
অতনু: আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট ঘরের অনুসরণ করেন, যেমন ধরেন লালন ঘর, চিশতিয়া ঘর, অন্যান্য সুফি ঘর বা নাথ, নেড়ানেড়ি বা ক্ষ্যাপাক্ষেপি, তারপরে ধরেন সতীমার ঘর, পাঞ্জু শাহের ঘর এরকম কোনো কিছুর অনুসরণ করেন?
বাসুদেব: হ্যাঁ, এগুলো তো অনুসরণ করিই। তাদের নিয়েই চলি।
অতনু: হ্যাঁ, কোন ঘর সেটি? লালন ঘর না অন্য কোন ঘর?
বাসুদেব: আমাদের লালন ঘরই। আমাদের লালন সাঁইজীর ঘর। সাঁইজী যে ঘরে বাস করেন, আমিও সেই ঘরেই বাস করি।
বাউলদের একটাই ধর্ম। বাউলরা কোনো গ্রন্থ, কোনো মন্দির, কোনো মসজিদ ফলো করে না। বাউলদের জীব ধর্ম। তাদের একটাই লক্ষ্য, তারা সর্বজীবে প্রেম বিলাইতে চায় এবং সর্বজীবকেই ভালোবাসতে চায়, কাছাকাছি থাকতে চায়। এবং এই গান দিয়েই সর্বজীবকে বুঝাইতে চায়। মানুষের গান, দূঃখের গান, সুখের গান, প্রেমের গান এসব দিয়ে মানুষকে বুঝাইতে চায় যে তোমরা কী করবে, কী করছো, কেন করছ। এটাই বাউল গান। যেমন আমি একটা গান গেয়ে থাকি, আমাদের জীবনের একটাই কথা, কখন যেন আমাদের চলে যেতে হবে, সেটা আমরা কেউ জানি না।
অতনু: আপনার বাউল সাধনা ও বাউল গানের জীবন তাহলে মোটামুটি ক’বছর হল?
বাসুদেব: আমার পঁয়তাল্লিশ বছর।
অতনু: পঁয়তাল্লিশ বছরের বাউল জীবন থেকে আপনার এখন অনুভূতিটা কী?
বাসুদেব: এখন মানে কী বলবো, আমি পঁয়তাল্লিশ বছরেও খুজে পাচ্ছি না যে বাউল ব্যাপারটা কি। অনুভব করি তাকে, কিন্তু এখনো তার সন্ধান পাওয়া যায় নি। এখনো তাকে ভাবছি, তাকে চেনার চেষ্টা করছি, তাকে ধরবার চেষ্টা করছি, সেই সাধনায় এখনো আছি আমি।
অতনু: আপনার এই পথে সহযাত্রী হিসাবে হিসাবে একসঙ্গে পথচলায় কাদের কাদের পেয়েছেন একটু যদি বলতেন?
বাসুদেব:, বহুজনকেই পেয়েছি। বহু বাউল, বহু বাউলিনী বহুজনকে পেয়েছি। এই সাধনা, সাধনক্ষেত্রে পেয়েছি, ভাবের মানুষ পেয়েছি।
অতনু: আপনার স্ত্রীও তো….
বাসুদেব: আমার স্ত্রী তো আমার একজন জীবনসঙ্গিনী। উনিও আমার ভাব জগতে অনেক সাহায্য করেন।
অতনু: ওনার সঙ্গে কি আপনার এই সাধন পথে বা বাউল গান করতে গিয়ে পরিচয় বা আলাপ?
বাসুদেব: হ্যাঁ, করতে করতেই। আমরা ওই মালা পড়িয়ে দিয়ে, মালাচন্দন দিয়ে বিয়ে করেছি। আমাদের মন হয়ে গেল, ঠাকুরের কাছে এসে, মালাচন্দন দিয়ে, বৈষ্ণবের সামনে আমরা নিজেকে নিজে সঁপে দিয়েছি।
অতনু: ঈশ্বর বলতে আপনি মানে ঈশ্বর ব্যাপার সম্পর্কে যদি একটু বলেন, একজন বাউল হিসাবে?
বাসুদেব: মানে আমরা ঈশ্বর ঈশ্বর করি, ঈশ্বর যে কে, ঈশ্বর কাকে বলে, আমরা কেউ জানি না। ওই যে লালন যে বলে গেছেন, “ধরতে পারলে মন বেড়ি, দিতাম পাখির পায়”। এখন ঈশ্বর বললে মানা যায় যে জীবের মধ্যেই ঈশ্বর আছে, সর্বজীবের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন, যাকে আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি না। এই যে আপনার সাথে কথা বলছি, আপনিই আমার ঈশ্বর। এভাবে ঈশ্বরকে বাউলেরা দেখে, সাধারণ মানুষেরা দেখে কি না জানি না। বাউলেরা এভাবে দেখে ঈশ্বরকে যে আমরা ঈশ্বরের সাথে কথা বলছি।
অতনু: আমরা তো আপনাকে দীর্ঘদিন ধরে, আমি ছোটবেলা থেকে আপনার গান শুনেছি কিংবা আমরা সকলেই আপনাকে, আপনি পরিচিত, শুধু এখানে নয় বাংলাদেশে ও আসামেও আপনি যথেষ্ট সুপরিচিত। কিন্তু একটা বিষয় কি আপনি স্বীকার করবেন যে অনেকেই আজকাল বাউল বা ফকিরের বেশ ধরে বা দুটো গান গাইতে শিখে নিজেদের বাউল ফকির বলে ক্লেইম করছে। এ বিষয়টা কিভাবে দেখেন?
বাসুদেব: এটাও আমি দেখছি। কিন্তু আমার মনে হয় যে, কেউ হয়তো চেষ্টা করছে যে আমি এই পথে যাবো। আবার দেখছি কেউ এটাকে পাত্তা দেয় না, কেউ কেউ বসন পরে, চারটা গান শিখে, দুটো পয়সা ইনকাম করবো, ঘুরবো, দুটো খাবো, আনন্দ করবো। এই দুরকমেরই লোক পাওয়া যায়। কিন্তু যারা সত্যিকারের খুঁজছে, যারা চাইছে আমি এই করবো, তাদেরকেও বোঝা যায়।
অতনু: ‘মনের মানুষ’ বিষয়টা কী?
বাসুদেব: মনের মানুষ তো কোথাও পাওয়া যায় না, বাবা। মনের মানুষ কোথাও পাওয়া যাবে না, মনের মানুষ কেউ নয়। মনের মানুষ ওই মনের ভেতরেই রয়েছে। আমিই আমার মনের মানুষ, আমিই আমার সব।
অতনু: আচ্ছা, মনের মানুষ বাইরে কাউকে পাওয়া যাবে না?
বাসুদেব: বাইরে নেই, কেউ নেই। আমরা বলি আমার মনের মানুষ আছে, কিন্তু এটা ভুল, পুরো ভুল, মনের মানুষ আমি নিজেই।
অ: আচ্ছা, তন্ত্র থেকে বাউল সাধনার মধ্যে মানে, রাঢ় বঙ্গে বাউলদের মধ্যে তন্ত্র থেকে একটা দেহতত্ত্বের যে বিষয়, আবার দেহতত্ত্ব বলতে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত জনতা যা বোঝে, তা কি আপনাদের বাউল সাধনার অবশ্য কর্তব্য বিষয়? নাকি দেহের অন্য কোনো ধারণা আছে?
বাসুদেব: এসব করতেই হবে তার কোনো মানে নেই। গান শিখলেই যে বাউল হয় আর তন্ত্র জানলেই যে বাউল হয় এটা না, বাউল হচ্ছে নিজের মনের ব্যাপার। নিজের মনেই বাউল।
অতনু: কিন্তু এইটা একটা প্রচার করা হয়, জানেন তো আপনি নিশ্চয়, বাউল মানেই মাত্র কামসাধনা অর্থে দেহতত্ত্ব । এটা নিয়ে একটু যদি বলেন?
বাসুদের: আসল কথা যদি নিজেকে চেনা যায়, আমি কে। যদি আমি’কে চেনা যায় তাহলে সে যা বলবে তাই হবে। সে যা বলবে মন থেকে তাই হবে, সে কিছু জানে না, বলে যা তুই ঘরে গিয়ে মরে যাবি, সে ঘরে গিয়েই মরে যাবে। নিজেকে জানতে হবে। নিজেকে নিজের কাছে থাকতে হবে সবসময়। আর সর্বজীবের প্রতি বিলীন হয়ে যেতে হবে।
অতনু: আপনারা তো জীবের ইবাদত করেন, মানুষের ইবাদত করেন, তার মানে আপনাদের কাছে সেবা ব্যাপারটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাসুদেব: সেবাটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমার কাছে যে কোন জাত, চোর, ডাকাত, গুণ্ডা যেই আসে আমার কাছে, সবাই আপন। সবাইকেই সেবা দিই।
অতনু: সেখানে আপনার কোনো ভেদাভেদ নাই?
বাসুদেব: ভালোমন্দ সবরকম লোক আমার কাছে আসে। কিন্তু আমার কাছে সবাই সাধারণ মানুষ। আমি তাদেরকে প্রণাম করি, তাদেরকেও ভক্তি করি।
অতনু: বাসুদেব দা, একটা কথা জানার খুব ইচ্ছা। সেটা হচ্ছে যে, রাঢ় অঞ্চলের বাউলদের নিয়ে একটা ধারণা অনেকের মনে হয়েছে যে, বাউলরা মানেই হয়তো গাঁজা খায়, মদ খায়, তারপরে হচ্ছে যে গাঁজা ছাড়া চলে না… ফকিরদের ব্যাপারেও এইরকম অনেকে মনে করেন, মানে সাধারণ মানুষ। আপনাকে আমরা জানি যে আপনি বিড়ি-সিগারেট বাদে অন্য কোনো নেশা করেন না। চা খান এবং বিড়িসিগারেট খান। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন- এই যে গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারে, অনেকেই মনে করেন যে কুষ্টিয়ায় গেলে, ছেউড়িয়ায় গেলে গাঁজা খেতেই হবে- কী মনে করেন?
বাউল: আমি মনে করি যে, যারা শ্বাসপ্রশ্বাস এর কাজ করে (গানও তো শ্বাসপ্রশ্বাস এর কাজ) নেশা ভাং না করলেই ভালো হয়। তা হলে তার গলার তেজ আরো ভালো হবে। তার দেহের সবকিছু ভালো হবে।
অতনু: মানে সাধনার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই?
বাসুদেব: না না। এটা সঙ্গে কোনো সাধনা হতে পরে না। এটা অভ্যাস। অভ্যাস করে ফেলেছে।
অতনু: আপনি বলছিলেন যে, আপনি যদি কিছু করতেন, মানে আপনি যদি বাউল গানটাকে ব্যবসার জায়গায় নিয়ে যেতেন তাহলে আপনি হয়তো বোলপুরের মধ্যে সবথেকে বড়ো বা বীরভূমের মধ্যে সবথেকে বড়ো আর্থিক জায়গা থেকে চলে যেতেন। তো অনেকেই বাউল গান, ফকিরি গান এটাকে একটা ব্যবসার জায়গায় নিয়ে গেছেন বলে মনে করেন?
বাসুদেব: বেশিরভাগটাই ব্যবসার দিকে নিয়ে গ্যাছে। মনেপ্রাণে যে কেউ করছে, সেটা আমি দেখতে পাচ্ছি না। সবাই গাইছে, মনের আনন্দে গাইছে। কিন্তু আমি বলবো যে, আরো মন লাগাও। বাউল বা শিল্পী হতে গেলে তোমাদের কী করা দরকার তোমরা সবাই জানো। কিন্তু আমরা সবাই হচ্ছি জ্ঞানপাপী, আমরা সব জানি, জেনেও আমরা করি না।
অতনু: এবার বৌদির সঙ্গে কথা বলা যাক। ঊর্মিলা দাস বাউল। উনি চমৎকার গান করেন। এবং উনি আমাদের খুবই আপন লোক। আশ্রমটা আমি বলবো যে বাসুদেবদার চেয়েও বৌদি অনেকবেশি যত্নে আগলে রেখেছেন….
বাসুদেব: হ্যাঁ, উনি ধরে রেখেছেন। আমি তো ভবঘুরে, ঘুরে বেড়াই।
অতনু: তো বৌদি আপনার সঙ্গে বাসুদেব দার এই বাউল গানসুত্রেই আলাপ পরিচয়?
ঊর্মিলা: বাউল গান করতে করতে, ঘুরতে ঘুরতে শান্তিনিকেতনে চলে এলো। তারপরে…
বাসুদেব: আমি এখানে মাধুকরী করতে আসতাম।
ঊর্মিলা: তারপরে ওর আমাকে ভালো লেগেছে, আমার ও্কে ভালো লেগেছে। তারপর মালাচন্দন করলাম।
অতনু: তার আগে থেকেই আপনিই গান গাইতেন বা উনার সঙ্গে সঙ্গ করার পর?
ঊর্মিলা: আমি গান গাইতাম না। বিয়ে করার পর থেকে আমি ওনার কাছেই সব শিখেছি।