ফরহাদ মজহার
আফিরিদা তানজিম মাহির মৃত্যু আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছিল, ঠিক যেমন এর আগে কবি মাহমুদ হাছানের মৃত্যু। একই ভাবে আমি ভয়ংকর ভাবে পীড়িত বোধ করেছি মাহীর পরে ২০১৯-এর এপ্রিলে হিমালয় হিমুর (নওশাদ হাসান হিমু) চলে যাওয়া। একজন শিল্পী, একজন কবি এবং আরেকজন রাজনৈতিক ও সমাজ কর্মী। আরও রয়েছে, যারা আমাদের নজরে নাই। এই সময়ে প্রতিভাবান এবং বিপুল সম্ভাবনাময় তরুণরা কেন আত্মহননের পথ বেছে নিল সেটা বর্তমান সময় সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই ভাবতে বাধ্য করে। শিল্প-সাহিত্য এবং বিপ্লবী রাজনৈতিক আকাংখার গোড়ায় রয়েছে বর্তমানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ব্যক্তির নিজের অর্থ তালাশ। তালাশের দরজা কেন হঠাৎ আমরা বন্ধ করে লড়াইয়ে ইস্তফা দেই, তা নিয়ে বহু কিছু ভাবার আছে। সেই সূত্রে এই লেখা। প্রতিভাবান মানুষ খুব কমই রয়েছে যারা জীবনের কোন না কোন কঠিন সময়ে আত্মহননের কথা ভাবেন নি। আমি সবসময় ভাবি, এই ক্ষেত্রে শিল্প-সাহিত্য আদৌ কোন আশ্রয় হতে পারে কিনা। কিম্বা ধরা যাক ঢাকা শহরের বেওয়ারিশ কুকুর, হিমু যাদের আশ্রয় করে হয়তো কঠিন সময়ে প্রাণপণ বাঁচতে চেয়েছিল, কিম্বা হয়তো হিমুই ছিল বেওয়ারিশ কুকুরদের একমাত্র আশ্রয়। বেওয়ারিশ কুকুরদের ইতিহাস আমাদের কোন কাজে আসে কি? ভাবা উচিত।
ভাবি হিমালয় হিমু নাই, হয়তো তাই সম্প্রতি ঢাকার মেয়র শহরের সমস্ত বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন। তাই কি? কে জানে?
কিন্তু এই যে লড়াই ছেড়ে হঠাৎ সব কিছুতে ইস্তফা দেওয়া, মায় জীবন ধারনও, এইসব নিয়ে অনেক কিছুই ভাববার আর বলার আছে। এটি তারই একটি কিস্তি- ফ.ম।
‘ব্রাদার অন ল্যাপটপ’। কিম্বা ‘গাছের তলে ল্যাপটপ নিয়ে আমার ভাই’।
যিনি দুই হাজার ষোল সালের ছয় তারিখে ছবিটি এঁকেছিলেন সেইদিন তিনি বয়েসে বিশ ছুঁয়েছেন কিনা জানি না। গত কয়েকদিন ধরে এই ছবিটি বার বার দেখেছি। একটি হাজারবর্ষী গাছ, শুকিয়ে গিয়েছে। তার শুকনা দুটো ডাল ত্রিকোনমিতির বিজ্ঞান, দুই ডাল মিলে যেখানে ত্রিভূজ সেখানে ডানা ভাঁজ করে রাখা একটি ত্রিকালদর্শী প্রাণী বসা। এটা লক্ষ্মী পেঁচা কি? নাকি হুতুম? গ্রামে এখনও রাতে হুতোম ডাকলে লোকে অকল্যাণ মনে করে।
শুকনা গাছের কাণ্ড জড়িয়ে আছে একটি সাপ। নীচে ভূমিতে সাপ পেঁচিয়ে ধরেছে আধুনিক ভাইয়ের বসার আসন। সেই আসনের চারটি পায়া পাখির পায়ের মতো। পাখিদের নখ আর শীর্ণ ঠ্যাং বোঝা যায়। ভাই পা রেখেছে মাটির ভেতর থেকে উঠে আসা মানুষের হাতের ওপর। নাকি ভিন দেশের কোন জীব! পায়ের দুই পাতা মানুষ কিম্বা এলিয়েনদের হাতের ওপর স্থাপন করা। একটি মা পাখি তার ছানা পাখিকে আধার দিচ্ছে।
ছবিতে কোথাও একট জিরাফ আছে, কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় না। কিম্বা আঁকবার পদ্ধতি বা ড্রয়িং করবার কারিগরিটা গুপ্ত এবং রহস্যময়। এমনই যে টেকনিকটা প্রবল জিরাফের ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু কোথায় সে বাস করে — বাংলাদেশে না আফ্রিকায় — বলে না।
আঁকাআঁকির মধ্যে জিরাফ আছেন, তিনি তাহলে ছবর মধ্যে লুকালেন কি করে?
পাখির পায়ের ওপর পাতা আসনের আয়তক্ষেত্র, তার ওপর আধুনিক ভাই উস্কুখুস্কু চুলে ল্যাপটপে নিষ্ঠ। কোন দিকে তার খেয়াল নাই। পাতাঝরা শূন্য প্রকৃতির মধ্যে এখনও যে সকল প্রাণিকুল বেঁচে আছে, তারা ভাইয়ের নজরের অন্তর্গত নয়। হয়তো তারা বাঁচার আশায় ভাইকে জড়িয়ে ধরছে, ভাইয়ের সেইদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। এমনকি বামন হয়ে যাওয়া হাতিটিও। ভাই তাকিয়ে আছে এলসিডি স্ক্রিনে, আর সকল ভাইদের মতোই। ভাইদের জগত এলসিডি স্ক্রিনে, ইলেক্ট্রনিক পর্দার মধ্যে। তার বাইরে ভাইদের আর কোন জগত নাই। নিজের জগতের বাইরে ব্রাদারদের আর কোন জগত কস্মিন কালে ছিল কি? নাই। বাস্তবের দুনিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বিরান প্রকৃতিতে রূপান্তরিত, কিন্তু ভাইদের সেই দিকে নজর নাই।
ভেবেছি, এর মধ্য দিয়ে কে নিজেকে জানান দিচ্ছে? কী জানাতে চায় এই ছবি? গত ১২ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ব্যাপী আফরিদা তানজিম মাহির ছবি প্রদর্শনী । মিক্সড মিডিয়া এগজিবিশন। ওর মধ্যে হয়তো এই ছবিটিও আছে। কিন্তু তার আগেই এই দুর্দান্ত অতি তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী নিজেকে জগত থেকে সরিয়ে নিলেন। পনেরো তারিখের পর থেকে আর্টিস্ট নিজেই আর নাই। জেনেছি, কয়দিন পরই বৃত্তি নিয়ে মাহীর বিদেশ যাবার কথা।
আফরিদা তানজিম মাহি পরিণত জীবনে কী হতে পারতেন সেই সম্ভাবনা নিয়ে এখন বিস্তর কল্পনা করা যায়। নির্মম সত্য হচ্ছে এখন তিনি শোক কাটিয়ে ওঠার চর্চায় পর্যবসিত। সেটা সম্ভবত মাহীর মা কবি রহিমা আফরোজা মুন্নী ছাড়া আর কেউ বুঝবেন কিনা জানি না। মাহীর বাবা ও পরিবারের অন্যদের কথা আমি ভুলছি না। যে মা বাচ্চাকে পেটে ধরেন, তাঁর কষ্টকে আমরা সাধারণত মনের কষ্ট হিসাবে দেখি না, মায়ের নাড়ি ছেঁড়ার কষ্ট হিসাবেই দেখি। ভবিষ্যৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে গিয়ে মাহি মায়ের নাড়ি আরেক বার ছিঁড়ে দিয়ে গিয়েছেন।
মাহির শিল্পকর্ম দেখে কি আমরা বাংলাদেশের সংবেদনশীল শিল্পবোধ সম্পন্ন তরুণদের সম্পর্কে কোন আন্দাজ করতে পারি? হয়তো পারি। তাতে মনস্তত্ত্বের বা সমাজতত্ত্বের লাভ হতে পারে, কিন্তু বাড়তি কোন ফায়দা আছে কি? আশ্চর্য যে কবি মাহমুদ হাছান (১৫ অগাস্ট ১৯৮৭ – ১৪ জানুয়ারি ২০১৩) আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন জানুয়ারি মাসেই। একই মাসে এক দিনের ব্যবধান। হাছান সম্পর্কে লিখেছিলাম:
“মৃত্যুকে এতো অবলীলায় মেনে নেবার পেছনে জীবনের ওপর নিজের কর্তাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রমান করা হাছানের বিবেচনায় ছিল কিনা জানি না, কিন্তু জীবনের পরমার্থের প্রতি তার তীব্র তাগিদ সবসময় আমাকে মুগ্ধ করতো। হয়তো স্থির বা নিশ্চয় কোন মুল্যমানের প্রতি সে নিষ্ঠ থাকতে পারে নি। ইতিহাসে মনুষ্য জীবনের কিম্বা ব্যক্তি মানুষের কানাকড়ি কোন মূল্য আছে কিনা সে বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল কি? অর্থাৎ সেই অর্থহীনতা পাশ্চাত্য যাকে নীৎশের বরাতে ‘নিহিলিজম’ নামে আখ্যায়িত করে রেখেছে। নীৎশের সঙ্গে মাহমুদ হাছানের তুলনার কোন মানে হয় না, কিন্তু একথা না বলে পারছি না যে নীৎশে আত্মহত্যা করেন নি, শেষ বয়সে পাগল হয়ে মরেছিলেন। এই তথ্য হাছানেরও জানা ছিল”।
হয়তো আফরিদা তানজিম মাহি সম্পর্কে একই কথা বলা যায়। জীবনের ওপর নিজের কর্তাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রমান করা। কিন্তু আত্মহনন সেই সত্য প্রমাণের খুবই শর্টকাট পথ!
আমি ভাবছি মাহির মায়ের কথা। রহিমা আফরোজ মুন্নী এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবি। অনেকেরই বন্ধু তিনি। কবি বলে তাঁকে বুঝি আমি। পড়ি। ভাবছি, তিনি কিভাবে এই শোক সামলিয়ে উঠছেন!
তবে সত্য বলতে কি, কবি রহিমা আফরোজ মুন্নীর দৃঢ়তা আমাকে অভিভূত করেছে। তিনি তাঁর সন্তানের সঙ্গে তাঁর নিজের সম্পর্ক অটুট রাখবার পথ হিসাবে লেখালিখিকে বেছে নিয়েছেন। আমাদের কালে কিম্বা আমাদের কোন লেখকের মধ্যে লেখাকে এভাবে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের কোন নজির আছে বলে আমার জানা নাই। মুন্নী লিখছেন:
“কজ এ্যাণ্ড এফেক্ট। হ্যাঁ, এই সূত্রের সত্যতা প্রমান করতেই চলে গেল আমার বাচ্চাটা। নিয়ম মেনে সুত্রের সুতা ধরায় আমার এই হাত দুইটাও শামিল ছিল। তাতে অবশ্য অপরাধী হাতগুলার লজ্জা হত না। সাবানে আর লোশানে ভালই প্রলেপ পড়ে গেছিল। তবে আজকে বাচ্চাটার গলা থেকে শাল দিয়ে বানানো ফাঁস খুলতে গিয়ে প্রলেপ সামান্য মুছে গেছে। বাকিটা মুছে ফেলবার সাহস হলে হয়তো ওর সাহসের দিকে চোখ তুলে তাকানোর যোগ্য হতাম। বাচ্চাটাকে শিখিয়েছি একরকম, মানতে বলেছি আরেকরকম। বলেছি সত্যি স্বীকার করলে ছাড় দেব, কিন্তু ছাড় দেবো কি করে, সেই ক্ষমতা অন্য কোন হাতের সুতায় ধরা, তাই বাচ্চাটার সত্যি স্বীকার আমার কানের ফুটাতে ঢুকতেই অস্বীকার করত।
তাছাড়া এইরকম ভুলভাল শিখতে শিখতে বড় যখন আমিও হয়েছি হক নেব সেরের উপরে সোয়াসের। আমার অবদমনের শোধ নেবার সাধ জাগা অন্যায় তো না। কিন্তু মস্তানি আমার উপর যা হয়েছিল মেয়ের উপর বোধহয় তার চেয়ে বেশি হয়েছিল। আমি একফোঁটা স্বাধীনতা পাইনি বলে স্বাদও জানতাম না, কিন্তু মেয়েকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েও স্বাদ নেবার বেলায় চামচের মাপ করে দিয়েছি নির্দিষ্ট। তো মেয়ের পরস্পর বিরোধী সত্তা আমার ছায়াতেই বেড়ে উঠেছিল। দায় এড়াব না রে মা। কিন্তু চলে গেলি যে এখন শাস্তি দেবে কে? মাফই বা চাইব কার কাছে?”
মা আমাদের বোঝাচ্ছেন, তাঁর সন্তানের আত্মহনন পরাজিতের আত্মহত্যা নয়। মা দাঁড়িয়েছেন তাঁর সন্তানকে মানুষের ভুল মূল্যায়নের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য। আমি কবিকে চিনতাম, এখন জননীকে চিনতে পারছি। রহিমা আফরোজ মুন্নীর সঙ্গে আমি একমত:
“আমার ছোট্ট বাচ্চাটার হিম্মতের দাম দেই আমি; দুর্গন্ধময় এই দুনিয়াদারিতে অনেকেরই দম আটকায়, কিন্তু মৃত্যু কামনা করা এবং সেইমতো রাস্তা ধরে আগানো কত সাহসের আমি জানি। আত্মহত্যার জয়গান গাইছি না। জন্মের মতো মৃত্যুও স্বাভাবিক এমনকি তা নিজহাত দিয়ে হলেও, এইটুকু বলতে চাই। আত্মহনন পরাজিতের লক্ষণ না, বরং অনেকেই আপোষ করতে পারে না বলেই চলে যেতে চায়। আমি যখন বাচ্চাটাকে শিখাতে চাইতাম কম্প্রোমাইজ করা, ডিপ্লোম্যাসি করা, ওর ভাল লাগত না। আবার স্বভাবগতই মানুষের চরিত্র যেমন থাকে ভালোমন্দয় মিলানো, তারও ছিল, কিন্তু নিজের সেসব কন্ট্রাডিকশন সে হজম করতে পারত না। প্যারাডক্স স্বাভাবিক, জানে তার মাথা, কিন্তু মন মানতে দেয় না সেটা। আমি তাকে অনেকটাই বুঝতাম বলে নিশ্চিত বলতে পারি তার আত্মহত্যা পরাজিতের আত্মহত্যা না, আপোষহীন মানুষের ক্ষোভ আর অভিমান মিলে সিস্টেমের কাছে সারেণ্ডার”।
“শুধুমাত্র আমি নাই, আমি থাকব না এইটুকু ভাবনাতেই ভরে যায় বালতি চোখের পানিতে, আমার নিজেরই এমন হয়েছে কিন্তু সাহসের দৌড় অতটুকুই ছিল। কখনও-বা সস্তার ব্ল্যাকমেইল হিসাবেও আত্মহত্যাকে ভাঙিয়ে খেয়েছি। কিন্তু সত্যিই এখনই মরব তা মানব কিনা ভাবতে হবে। বেঁচে থাকার মতো এমন লোভনীয় লাভ আর কিছুতে নাই। সেই লোভ জয় করা কজনের পক্ষে সম্ভব কেউ ভেবেছে সেই দিকটা একবারও? যেনতেনভাবে হোক বেঁচে থাকাটা খুব মহিমান্বিত সকলের কাছে, এর গলা কেটে হোক আর ওর গাল চিরে হোক, বেঁচে থাকার কত আরাধনা আবার সেটা স্বাভাবিকও। সারভাইব ফর ফিটেস্টের সূত্রানুযায়ী তো শেষ মানুষটাকে মেরে হলেও নিজের বাচা নিশ্চিত করা জায়েজ করেছে এই দুনিয়া। বাঁচো তবে মেরেকেটে হলেও। কিন্তু কেউ কেউ সত্যিই নিতে পারে না দুইপা’অলা জীবের জঘন্যতা। দুনিয়াবি কায়েমে সবকিছুর হালাল সার্টিফিকেট দেয়া। আমার বাচ্চাটা তেমনই ছিল, আর এখনও সে আছে আমার অন্তরে”।
‘আত্মহত্যা পরাজিতের লক্ষণ না’। ঠিক। কিন্তু ধর্ম তাকে গুনাহ এবং আইন তাকে অপরাধ গণ্য করে। কেন? কারণ জীবন মানুষ সৃষ্টি করে না, জীবন আমরা দান হিসাবে পাই; সেই দেনা শোধ করার দায় যেমন আছে, তেমনি যিনি সৃষ্টি করেছেন তার ওপর খোদকারি ধর্ম বরদাশত করে না। ধর্ম — আমরা মানি বা না মানি, যে জীবন মানুষের নিজের তৈরি নয়, তাকে নিজে হরণ করবার অধিকার দেয় না। অপরদিকে আইনের চোখে অপরকে হত্যা আর নিজেকে হত্যা সমান অপরাধ। কিন্তু ধর্ম বা রাষ্ট্র যখন নিজ নিজ সত্যের দাবি দিয়ে শত্রুমিত্র ভেদ করে তখন অপরের প্রাণ হরণ করতে দ্বিধা করে না। উভয়েই দাবি করে আমরাই সত্য এবং মিথ্যা সবসময়ই অপর পক্ষে।
কিন্তু দর্শন ধর্ম নয়, এবং মানুষের তৈরি আইনও নয়। অতএব ধর্ম ও রাষ্ট্রের সঙ্গে দর্শন তর্ক করবেই। দর্শন রহিমা আফরোজ মুন্নীর সঙ্গেই শর্ত সাপেক্ষে সায় দেবে। আত্মহত্যা পরাজিতের সাহস না, এই সাহস তারই থাকে যিনি সত্যিকার অর্থে স্বাধীন। সকর্মক কর্তা হিসাবে তিনি স্বাধীন না হলে নিজের জীবন তিনি হরণ করতে পারেন কিভাবে? আত্মহননের মধ্য দিয়ে জীব জীবনের উর্ধে সেই কর্তা নিজেকে স্বয়ম্ভূ শক্তি হিসাবে প্রমাণ করেন। কেন, কখন এবং কিভাবে আমরা শরীরকে বলি, তুমি সত্য না, সত্য আমি, কারণ আমি চাইলে তোমার অস্তিত্ব নিমেষে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারি — মীমাংসার অতীত এই জিজ্ঞাসা নিয়ে দর্শন বিব্রত বোধ করে। যে কর্তা নিজের জীবন নিজে নিতে পারে সেই কর্তা তার স্বাধীনতাকে চূড়ান্ত ভাবে প্রমান করে। হেগেল এই কথাই বলবেন। এই ক্ষেত্রে আরও অনেকেই সাক্ষী হবেন।
তবে হেগেল নিশ্চয়ই যুক্ত করবেন, ব্যক্তির স্বাধীন ও স্বয়ম্ভূ হবার এটা খুবই শর্টকাট পথ। কারণ মানুষ সমাজের মধ্যে থেকে আর দশজনকে নিয়েই ‘স্বাধীন’ বা ‘মুক্ত’ হয়। নইলে স্বাধীনতা, মুক্তি ইত্যাদির কোন অর্থ নাই। সমাজে বেঁচে থেকে সমাজের মধ্যে স্বাধীন হবার পথই সত্যিকারের মুক্তির পথ। সমাজের বাইরে ‘ব্যক্তি’ কথাটারও কোন মানে হয় না। ব্যক্তির মুক্তি সমাজে। এমনকি মৃত্যুও যদি ব্যক্তির কাম্য হয় তবে সেই মৃত্যু তখনই মুক্তির নিশানা হয়ে ওঠে যখন সমাজ বা সমষ্টির জন্য ব্যক্তি নিজেকে বিসর্জন দেয়। যে কারণে সমষ্টির জন্য নিজেকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া, কিম্বা মৃত্যু বরণ করা ধর্ম এবং রাজনীতি উভয়ই স্বাধীন মানুষের চূড়ান্ত অর্জন বলে গণ্য করে। কারণ ধর্ম এবং আধুনিক রাষ্ট্র উভয়েরই দাবি করে তারা সমষ্টিরই অভিব্যক্তি। ধর্মের চোখে যিনি ‘শহিদ’, সমাজ রূপান্তরের রাজনীতির চোখে তিনিই ‘বিপ্লবী’। বিপ্লবী নিজের জীবনকে সমষ্টির জন্য আত্মত্যাগ করে।
ব্যক্তিবোধ বা ব্যক্তিতন্ত্র অতিক্রম করে যাওয়া মানবেতিহাসের যারপরনাই কঠিন একটি পর্ব। মানুষ আত্মহত্যা করবার শর্টকাট পথ নিয়ে ব্যক্তিকে দেহের চেয়ে অধিক কর্তৃত্বপরায়ন প্রমাণ করতে পারে, কিন্তু শেষাবধি সেটা ব্যাক্তিতান্ত্রিকতারই জয়। প্রকট ব্যক্তিতন্ত্রের যুগেও ‘ব্যক্তি’ হিসাবে স্বাধীন হবার চেষ্টা — সেটা ব্যক্তিতন্ত্র হোক, কিম্বা আত্মহনন — ব্যক্তির চূড়ান্ত ব্যঞ্জনা প্রকাশ করে না। ব্যক্তিতন্ত্র — অর্থাৎ পরিবার, সমাজ ও সমষ্টিকে বাদ দিয়ে শুধু ‘আমি’, ‘আমি’ করা বা ‘আমিবাদ’ একান্তই আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের চিন্তা। ‘আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না’ এই কাঁদুনিও ব্যক্তিতন্ত্রের নাকে সর্দি লাগা আহ্লাদি প্রকাশ।
ব্যক্তির নিজেকে স্বাধীন ও স্বয়ম্ভূ সত্তা হিসাবে আস্বাদনের চেষ্টার পালটা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ব্যক্তিকে দমন, নীতিনৈতিকতার বেড়া দিয়ে ব্যক্তিকে বাঁধবার বিবিধ সেকুলার বা ধর্মীয় নীতিবাদী চেষ্টা, নীতিনৈতিকতার শাসন। আসলেই, ব্যক্তি সাংঘাতিক বিপজ্জনক। কারণ সে সততই প্রেমের জন্য ‘খোলা হাওয়ায় ডুবতে রাজি’, আদর্শের জন্য মরতে প্রস্তুত; কিম্বা মানুষ স্বাধীন, সে কারো তোয়াক্কা করে না — স্রেফ এই কঠিন সত্য প্রমাণ করবার জন্য ব্যক্তি যে শরীরে বাস করে তাকেই ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ে। আত্মহত্যা করে। ধর্ষণের পর যে মেয়ে আত্মহত্যা করে সে তার শরীর ধর্ষিত হয়েছে বলে করে না। সে উপলব্ধি করে তার আরও অনেক বড় কিছু ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। সে ক্ষতি তার ব্যক্তিসত্তার ক্ষতি। এই অপমান — ব্যক্তির অমর্যাদা — মানুষ সহ্য করতে পারে না।
ঐ করবে না, ওটা ঠিক না, এভাবে চলো, ওভাবে চলবে না, ইত্যাদি শাসন ধর্ম ও নীতি-নৈতিকতার। কিন্তু একালে দমন নিপীড়নের ভয়ংকর রূপ ধর্ম কিম্বা নীতিনৈতিকতার শাসন নয়। বরং শাসন ও শৃংখলার রাজনৈতিক রূপ: আধুনিক রাষ্ট্র। ধর্ম বা নীতিশিক্ষা ‘মনের পুলিশ’ দিয়ে ব্যক্তিকে শাসনে রাখতে চায়, কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র হচ্ছে সেই পুলিশটাকেই বাইরে নিয়ে আসে যার থাকার কথা ছিল মনে, বিবেকে কিম্বা নীতি-নৈতিকতার বোধে।
আধুনিক রাষ্ট্রে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সর্বত্র পুলিশ, সর্বত্র নজরদারি। বায়োমেট্রিক, মোবাইল ট্রাকিং, কম্পিউটারে পোকা (bug) বসিয়ে দেওয়া তো চলছেই। ব্যক্তি আধুনিক রাষ্ট্রে পিঁপড়া হয়ে যায়। ধূলাবালিতে পরিণত হয়।
অতএব ধর্মের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে আধুনিক সেকুলার রাষ্ট্র; কারন পুলিশ এখন আর মনের পুলিশ না, বরং বাইরের শাসনকর্তা, হর্তাকর্তাবিধাতা। আইন, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ, সেনাবাহিনীর চোটে ব্যক্তি খড়কূটায় পরিণত হয়। আধুনিক নানান কিসিমের গণতন্ত্র/সমাজতন্ত্র ইত্যাদি নামে নানান টোটলিটারিয়ান রাষ্ট্র ব্যক্তিকে টুঁটি টিপে মারে। এমন সব প্রতিষ্ঠান আশপাশে গড়ে ওঠে যাদের প্রধান কাজ পদে পদে ব্যক্তিকে পিষে মারা। ব্যক্তির মুক্তি চাই, সন্দেহ নাই। কিন্তু ব্যক্তি আত্মহননের মধ্য দিয়ে, কিম্বা আধুনিক রাষ্ট্র গঠন করে মুক্তি পায় না। তার কাজ বাকি থেকে যায়। তার মুক্তির প্রতিশ্রুতি ফাঁপা আওয়াজ হয়ে বাতাসে ভাসতে থাকে। ইমাম মেহদির জন্য মানুষ অপেক্ষা করে। ‘আমি’কে যারপরনাই নিন্দা করে তাকে দমন নিপীড়নের পথ শেষাবধি অকার্যকর।
অতএব দর্শনের যুগও বারবার ফিরে আসে। ফুরায় না।
অন্যদিকে বুর্জোয়া সমাজের মধ্যে কিম্বা বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্যাক্তির স্বেচ্ছাচারিতাকেই পরমার্থিক গণ্য করা, আরেক প্রকার আপদ ও প্রতিক্রিয়া। ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজ অতিক্রম করে সমাজের মধ্যে ব্যক্তি কিম্বা ব্যক্তির মধ্যে সমাজকে আস্বাদনের প্রশান্তি অর্জন স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে অর্জন সম্ভব নয়। অতএব একালের জিজ্ঞাসা: ব্যক্তিকে ধারণ করে সমষ্টি হবো কিভাবে? কিভাবে বিশ্বসমাজ তৈরি করব? কিভাবে ‘উম্মাহ’ গড়ে উঠবে? ব্যক্তিকে ধারণ করে ব্যক্তিতান্ত্রিক যুগ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা অতিক্রম করে যাবার ছহি পথ ও চর্চা কি হবে? সেই পথ আত্মহনন কিম্বা আধুনিক রাষ্ট্রের গোলাম হওয়া হতে পারে না। ব্যক্তিতন্ত্র ব্যক্তিকে অতিক্রম করে যাবার সাধনা নয়, হতে পারে না।
অপরদিকে আধুনিকতার নিগড়ে পিঁপড়ার জীবন বেছে নেওয়া মানুষের লক্ষ্য নয়। ‘মানুষের মুক্তি’ আজও নিছকই প্রতিশ্রুতি কেবল। সাড়ে ষোল আনা ধর্মতাত্ত্বিক। সেকুলাররা যতোই চেঁচাক, তাদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি ধর্মের প্রতিশ্রুতির অধিক কিছু নয়। মানুষের মুক্তি এখনও অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছে। সেই পথ এখনও কুয়াশাচ্ছন্ন।
ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বাধীনতাবোধ আত্মহননের সাধ হয়ে ব্যক্তির কাছে আবেদন সৃষ্টি করে।
কিন্তু যে সন্তান অভিমানে চলে যায়, তাকে আমরা যেন সমাজের ভুল মূল্যায়নের হাত থেকে রক্ষা করি। যে ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজ ও মূল্যবোধের আমরা পূজা করি এটা বরং তারই প্রতিশোধ। আমাদেরই কর্মফল। ব্যক্তিতন্ত্র এবং ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবে দাঁড়ানো জরুরী, দাঁড়ানো উচিত নিপীড়ন-সর্বস্ব আধুনিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও। কারন জীবিত সন্তানদের রক্ষার দায় আছে আমাদের। দোষ তাই ব্যক্তিকে নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও বহন করতে হবে।
সন্তানের লাশ বুকে নিয়ে তাই আমাদের বলতে হয়, ‘এটা ঠিক পথ নয়, এটা মুক্তির পথ নয়, তুমি এতো স্বার্থপর হলে কিভাবে? আমাদের ছেড়ে, এই সমাজ ছেড়ে এই পৃথিবী ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে? কোথায় গেলে? কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের বলা উচিত এই সমাজই আমার সন্তানের হত্যাকারী, একে বদলাতে হবে। বলা উচিত, ধর্ম আমার সন্তানকে শুধু নিন্দা করেছে, বোঝার চেষ্টা করে নি; শাসন করেছে, ভালবাসেনি। এই রাষ্ট্র আমার সন্তানকে মুক্ত মানুষ হিসাবে বিকাশের সুযোগ দেয় না। পিঁপড়ার জীবনে পর্যবসিত করে। এই রাষ্ট্র আমরা চাই না।
সিদ্ধান্ত নেবার ও সংকল্প নির্ণয়ের অমীমাংসিত ক্ষেত্রগুলো আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। এই তর্ক চলুক। তবে এটা নিশ্চিত আমি কিছুদিন পরপরই মাহমুদ হাছানের কবিতা পড়ব আর আফরিদা তানজিম মাহীর ছবিগুলো দেখব।
বুঝতে চাই, কার ডাক তাঁরা শুনেছিলেন, আমরা যা শুনি না, কিম্বা শুনতে অক্ষম! আমাদের আর কোন সন্তান এই ডাক শুনুক আমরা তা চাই না।
আমার পথহারা সন্তানেরা, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। থাকব।
ভালবাসা নেবেন দাদা