।। হুমায়ূন শফিক ।।
।। হুমায়ূন শফিক ।।হ
“‘আপনি কি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি?’ ওপাশ থেকে গতকালকের সেই মেয়েটি বলে উঠল।
‘আসলে আপনি কে বলুন তো! বারবার বিরক্ত করছেন।’ উঁচু গলায় বললাম।
‘আরে রাগ করছেন কেন? আমি তো বলেছিই আমি বিপাশা। আমাকে পেতে চান কিনা!”
বিপাশা
সিগারেটের ধোঁয়া হয়তো শেষ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো একাই নিভে গিয়েছিল সিগারেট। তখন সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে আমার চোখ। আমেরিকার ৩৭তম প্রেসিডেন্ট কে? এই প্রশ্নটায় মাত্র চোখ গেছে, তখনই কান ফাটিয়ে সেলফোনটা চিৎকার করে উঠল। চারপাশটা ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশাচর প্রাণীর মতো আমিই বোধহয় জেগেছিলাম একা।
রিংটোনটা চেঞ্জ করতে হবে ভেবে ফোনটা রিসিভ করলাম।
ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, “আজকের রাতটা কি আরো সুন্দর করতে চান? আমাকে পেতে চান?”
“কে আপনি? এতরাতে কিসব বলছেন?” কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম। তখনও মাথায় আমেরিকার ৩৭তম প্রেসিডেন্ট কে এই প্রশ্নটা।
“আমার নাম বিপাশা। রাতে নিঃসঙ্গ মানুষদের সঙ্গী হই। আপনি চাইলে আমি আপনার সঙ্গী হবো।”
কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। এই মহিলা আমার নাম্বার কোথা থেকে পেল সেই প্রশ্নটা মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি আমাকে চিনেন? নাম্বার কই থেকে পাইলেন?”
“নাম্বার পাওয়া যায়। নিঃসঙ্গ মানুষদের নাম্বার আমার কাছে আছে। আপনি চান কিনা বলুন? যান দশ মিনিট সময় দিলাম। ভেবে কল দ্যান।”
“আপনি নিশ্চয় আমাকে চিনেন! পড়ছি, প্লিজ বিরক্ত করবেন না। যে-ই হোন তিনদিন পরে যোগাযোগ করেন।” বলেই ফোনটা কেটে দিব ভাবছিলাম।
“মজা করছি না। চলুন আজকের মতো ফোন সেক্স করি। অন্যদিন সরাসরি হবে।” একটু ভেবে আবার বলল, “আচ্ছা, আজকে আপনার জন্য ফ্রি। টাকা দিতে হবে না”।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আবার ভাবলাম নিশ্চয় কেউ প্রাঙ্ক কল করেছে। তাই পাত্তা না দিয়ে ফোনটা কেটেই দিলাম। তখন আমেরিকার ৩৭তম প্রেসিডেন্ট কে সেই প্রশ্নটার উত্তরের দিকে চোখ দিলাম।
সেদিন সারারাত পড়লাম। আযান দেওয়ার সাথে সাথে বিছানায় গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার ঘুম আমাকে চেপে ধরল।
এক ঘুমে বিকাল হয়ে গেল। উঠেই হালকা খেয়ে আবার পড়তে বসলাম। টেবিলে দেখি অসহায়ের মতো ফোন পড়ে আছে। ফোনটিকে ধরব ধরব করেও ধরলাম না। কারণ গতকালকের সেই স্মৃতিটা মনে পড়ে গেল। আর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। পড়ায় মনোযোগ দিতে পারলাম না।
রুমমেটরা এতক্ষণে আড্ডা দিতে বের হয়ে গেছে, কারণ বাসাতে আমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। পাশের রুমে দেখলাম কম্বল বিছানায় পড়ে আছে, রাকিবের অ্যাস্ট্রেতে তখনও ধোঁয়া উঠছে, অর্ধেক কাপ চা তখনও বাকি রেখে গেছে। মনে হচ্ছে জরুরি কোনো ফোন পেয়েই দৌঁড় দিয়েছে ছেলেটা।
সাদ্দামের রুমে দেখলাম বইগুলো মেঝেতে পড়ে আছে। হারুকি মুরাকামির ‘দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকেল’ বইটা খুলেই রেখে গেছে।
ভাবলাম এক কাপ চা খাবো। রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের বোয়ামটা খুজলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু নেই। কোথায় রেখে গেছে কে জানে! ওরা তো বাইরে গিয়ে প্রচণ্ড আড্ডা-ফাড্ডা মারে, কিন্তু আমার বাইরের পরিবেশ একদমই পছন্দ না। দম আটকে আসে। কিন্তু এক কাপ চা খাওয়া জরুরি।
লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরে নিলাম। ইস্ত্রিবিহীন শার্ট যেটা পরা ছিলাম সেটা পরেই বের হলাম বাসা থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমার ফোনটা আবার চিৎকার করে উঠল। দেখলাম রাকিব ফোন দিয়েছে, “শোন আমাদের রাতে ফিরতে দেরি হবে। মারুফের মা অসুস্থ। সবাই হাসপাতালে থাকবো”।
‘আচ্ছা…’ বলার আগেই ফোনটা কেটে দিল। ওরা জানে এইসব কাজে আমি যাই না। কে কোথায় মরলো নাকি বাঁচল এতে কিছু আসে যায় না আমার।
নিচে নেমে সোজা হেঁটে গেলাম মেইনরোডের দিকে। মোড়েই একটা চায়ের দোকান। সুজন ভাইয়ের চায়ের দোকান। সবাই চিনে সেখানে, সুজন ভাই দুঃখ করে বলে, “ভাই আপনি কেন আসেন না! আসবেন প্রত্যেকদিন। ভাল লাগবে”।
আমি কিছু বলি না। চা খাই-সিগারেট খাই, বাসায় চলে আসি। এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসলাম। কারণ রাতে কেউ আসবে না, সিগারেট চাইলেও পাওয়া যাবে না। আর নিচে তো নামবই না। এই কোলাহলে কে ডুবতে চায়!
বাসায় উঠে আগে খাবার টেবিলে খাবার আছে কিনা দেখে নিলাম। মুরগির মাংস, আলু ভর্তা, ডাল এবং ডিম বাজি করে রেখেছে। একেকজনের পছন্দ একেকরকম। সকালেই সব রান্নার কাজ শেষ হয়েছে, তখন তো আমি গভীর নিদ্রায় ছিলাম।
টেবিলে গিয়ে আবার সাধারণ জ্ঞানের বইটা মেলে ধরলাম। গতকাল এবং আজকে দুইদিনেই সাধারণ জ্ঞান যতদূর পারা যায় পড়ে শেষ করব। এরপর অন্যান্য বিষয়গুলো। একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছি। সময় যে কোনো গতিতে দৌড়াচ্ছে কে জানে, পেটে যখন ক্ষুধায় মোচর দিল তখনই পড়া ছেড়ে উঠলাম। ফোনে দেখলাম রাত একটা বাজে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবারও টেবিলের সামনে গিয়ে বসলাম। ফোনটা আবারও চিৎকার করে উঠল। ফোন না আসা পর্যন্ত রিংটোনটা চেঞ্জ করতে মনে থাকে না। একটা আননোন নাম্বার। রিসিভ করলাম।
“আপনি কি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি?” ওপাশ থেকে গতকালকের সেই মেয়েটি বলে উঠল।
“আসলে আপনি কে বলুন তো! বারবার বিরক্ত করছেন।” উঁচু গলায় বললাম।
“আরে রাগ করছেন কেন? আমি তো বলেছিই আমি বিপাশা। আমাকে পেতে চান কিনা!”
একবার মাথায় আসল, বলেই দেখি বাসায় আসতে। আবার ভাবলাম, ধুর হয়তো ডাকাতের দলের কেউ।
আপনি বারবার আমাকে বিরক্ত করবেন না। “প্রাঙ্ক মানুষ কতবার করে, হু..?” বলেই ফোনটা কেটে দিলাম।
কেটে দেওয়ার সাথে সাথেই আবার রিংটোন বেজে উঠল। এবার রিসিভ করলাম না। আবারও বেজে উঠল।
এবার ফোনটা ধরেই বললাম, “আপনি আসলে কি চান? ফাইজলামি করবেন না, প্লিজ। আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে”।
“আমি তো সিরিয়াস। আমার ব্যবসাই এটা। আপনিই বুঝতে পারছেন না। একবার আমার সঙ্গী হলে আপনার ভাল লাগবে। দুনিয়ার সবকিছুকে আমি ভুলিয়ে দেব। আসব?”
এবার মেয়েটার কথা কিছুটা বিশ্বাস হলো। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলি নি। চাকরিটা হয়ে গেলে মিলিকে বিয়ে করে ফেলব, এটাও সত্য। কিন্তু বিপাশা কে? জানি না। তবু কেন যেন তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি। মনে হচ্ছে দেখিই না একবার ডেকে কী হয়! বড়জোর সবকিছু চুরি করে নিয়ে যাবে! এর বেশি কিছু তো হওয়ার কথা না। কারণ তার সাথে তো আমার কোনো শত্রুতা নেই। জানে তো আর মেরে ফেলবে না।
“দেখুন, আমার পরীক্ষা আছে। আমি তিনদিন পরে আপনাকে জানাবো, আসবেন কিনা!”
“আচ্ছা। আপনাকে তিনদিনের সময় দিলাম। আর একটা কথা মনে রাখবেন। আমি কিন্তু একজন কাস্টমারকে দুইদিনের বেশি ফোন দেই না। তাই আপনাকেই আমাকে ফোন দিতে হবে। ভাল থাকুন।”
বলেই লাইনটা কেটে দিল। তখন ভাবলাম, ধুর বাল। ডাকলেই পারতাম কেউ নাই। সবার আসতে নিশ্চয় অনেক দেরি হবে। মেয়েটা কত করে বলল। ফোন দিতে চাইলাম! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাড়ির আশে-পাশের কেউ যদি জেনে যায় কোনো পতিতার সাথে আমি শুয়েছি তাহলে কি বলবে তারা! মুখ দেখাতেও পারব?
পড়ালেখার কথা ভুলেই গেলাম। বিপাশাকে ডাকব কিনা ডাকব না, এই চিন্তায় বিভোর হয়ে গেলাম। কিন্তু চাকরির কথাটা ভুলে গেলে চলবে কেন? তাই ভাবলাম সমাজ যাই বলুক, চাকরির পরীক্ষা ভাল মতো দিয়ে বিপাশাকে ডাকব। বন্ধুরাও যদি খারাপ ভাবে ভাবুক। কিন্তু ওই কণ্ঠের মুখটা আমার দেখা চাই। একবারের জন্য হলেও।
আবার নিজেকে খুব কন্ট্রোল করে বইয়ে মুখ গুঁজে দিলাম। পড়তে পড়তে আযানের ধ্বনি কানে এসে বাজল। ভাবলাম, নামাজটা পড়ি, কিন্তু তখন ঘুমে আর তাকাতে পারছিলাম না।
তিনদিন পরে পরীক্ষাটা দিলাম। পরীক্ষা বেশ ভালই হলো। হয়তো চাকরিটা হয়েই যাবে এবার। বাসায় ফিরে এসে মাজিদ মাজিদির ‘বারান’ সিনেমাটা দেখতে বসলাম। আগেও দেখেছি, কিন্তু এই সিনেমাটা এত ভাল লাগে বারবার দেখতেই মনে চায়। বিশেষ করে দৃশ্যটা। যেখানে মেয়েটি চলে যাওয়ার পরে তার পায়ের চিহ্ন কাদায় ফুটে ওঠে। আর ছেলেটি সেই দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
সিনেমাটা দেখছি আর সিগারেট টানছি। হুট করেই বিপাশার কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম আজকে ফোন দেব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ফোন যে দিব ফোনটা খুজে পাচ্ছি না।
বাসার সবাই মিলে ফোন খোঁজা আড়ম্ভ করলাম। সবকিছু তন্নতন্ন করে ফেললাম। কিন্তু ফোনটা আর পেলাম না। যতদূর মনে হয় ফোনটা আসলে পকেটমার নিয়ে গেছে বা কোথাও ভুলে ফেলে এসেছি।
বিপাশার নাম্বার তো ফোনেই সেইভ করেছিলাম। তখন কী করব বুঝতেই পারছিলাম না। পরেরদিন আরেকটা ফোন ঠিকই কিনেছি, কিন্তু সিমটা তুলতে না পেরে নতুন সিম কিনতে হয়েছে।
হুমায়ূন শফিক
জন্ম ১৯৯৪ সালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নবাবগঞ্জে। পড়ালেখা করছেন টেক্সটাইলে। গল্প, উপন্যাস লেখেন, অনুবাদ করেন।