‘বর্ষবরণ এবং ছায়ানট এখন সমার্থক’!!!
দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় জনপ্রিয় কথাকার হুমায়ূন আহমেদের একটি লেখার প্রথম লাইন (দেখুন ‘সমকাল’ ৬ এপ্রিল ২০১১)। একই লেখা আরো কয়েকটি পত্রিকায় একই তারিখে ছাপা হয়েছে। পড়ে থতমত হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। লেখাটির শিরোনাম, ‘অদৃশ্য মানুষের বর্ষবরণ’। দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় ‘খবর’ ছাপবার কথা। কিন্তু বর্ষবরণ নিয়ে হুমায়ূনের লেখা, সেটা ‘খবর’ তো বটেই। নাকি বর্ষবরণ এবং ছায়ানট যে এখন সমার্থক সেটাই খবর!
লেখাটি পড়ব কি পড়ব না দোনামনার মধ্যে পড়লাম। প্রথম বাক্যে থমকে গেলেও বেশ কয়েকটি পত্রিকায় লেখাটি ছাপা হয়েছে দেখে ভাবলাম পড়ে রাখা দরকার। জনপ্রিয় লেখক বলে যারা হুমায়ূনকে নানাভাবে ম্লান করে দেবার চেষ্টা করে, আমি তাদের দলের কেউ নই। আমি হুমায়ূন আহমেদকে পছন্দ করি। হুমায়ূন যেমন ঠিক তেমনি তাকে পছন্দ করি। তাকে পড়বার সময় মাথার খুলির মধ্যে বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, কমল মজুমদার বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ডেকে এনে বসিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করি না। হুমায়ুনকে যেভাবে পড়া দরকার সেভাবেই পড়ি। ওর জনপ্রিয়তা ওকে পড়বার পক্ষে বাড়তি যুক্তি জোগায়। জনপ্রিয় লেখক হতে পারাকে আমি ছোটখাট গুণ বলে মনে করি না। জনপ্রিয়তার একটা সমাজতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক মানে আছে। এই তাৎপর্য সাহিত্য বিচারের খুঁটিনাটি থেকে আলাদা। নন্দনতাত্ত্বিক মানদণ্ড দিয়ে এর তাৎপর্য বোঝা যাবে না।
আশির শুরু থেকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশের মধ্যে নতুন একটা জগৎ তৈরী হয়েছে। টের পাই। ঢাকা শহরে ও ঢাকার বাইরের গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন মফস্বলের তরুনদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এই জগৎ। এই অংশটিকে সমাজতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক ভাবে চেনার দরকার আছে। তারা কী কল্পনা করে, কিভাবে চিন্তা করে, কিভাবে সিদ্ধান্ত টানে, ইত্যাদি জানা দরকার। ধর্ম, পুরান, গল্প, ইতিহাস, বয়ান ইত্যাদির সঙ্গে তাদের যোগ কতোটুকু ইত্যাদি বোঝার দরকার আছে। জনপ্রিয় লেখকদের লেখা ও তার জনপ্রিয় হবার কারন নিয়ে ভাবলে এই জগতটিকে বোঝার সূত্র অনেক সময় পাওয়া যায়। বাঙালি সংস্কৃতি বলে যে ধারাটিকে আমরা চিনি বলে জানি সেখানে গত কয়েক দশকে যে রূপান্তর ঘটেছে বা ঘটছে সেটা বোঝার জন্য হুমায়ূন আহমেদ খুবই কাজে আসে। যেমন, হুমায়ূন কতো স্বচ্ছন্দে বললেন যে বর্ষবরণ ও ছায়ানট সমার্থক – কার আছে এতো স্পষ্ট ভাষায় এই কথাটা বলার সততা ও সাহস। ছায়ানট ও বর্ষবরণ দুটোরই অর্থ এক। যাকে আমরা ছায়ানট বলি, সেটাই বর্ষবরণ। আর যাকে আমরা বর্ষবরণ বলি সেটাই ছায়ানট। এতো সংক্ষেপে ও সরল ভাবে বাংলা সংস্কৃতির অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ উৎসবকে ঢাকা শহরের সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হয়ে বলবার ক্ষমতা একমাত্র হুমায়ূন আহমেদেরই আছে। পুরা চৈত্র মাস, চৈত্র সংক্রান্তির দিন এবং পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে বিচিত্র সব অনুষ্ঠান, উদযাপন, ব্রত বা মানত পালন, খাদ্য ব্যবস্থার সংস্কৃতি ও নানাবিধ উৎসব রয়েছে – এবং এই সকল উৎসবের উৎপত্তি ও বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে — তাকে এক বাক্যে গায়েব করে দিলেন হুমায়ূন আহমেদ। যাহা ছায়ানট তাহাই বাঙালির বর্ষবরণ।
যাহা নববর্ষ তাহাই ছায়ানট। আলবৎ। আমি হুমায়ূনের সঙ্গে একমত। শুধু আমাকে কান পেতে শোনার শিক্ষাটা নিতে হয়েছে যে হুমায়ূনের হয়ে কথাটা কাদের। আমি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যে কারণে একমত সেটা হোল এটা অনৈতিহাসিক অর্থাৎ ঐতিহাসিক পরিবর্তন সম্পর্কে অচেতন থেকে করা মন্তব্য কিন্তু নয়। খেয়াল করতে হবে, বলা হয়েছে যে এটা আগে ছিল না। ‘এখন’ হয়েছে। ‘এখন’ কথাটা ছোট ও সংক্ষিপ্ত, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হুমায়ূ্ন অসাধারণ স্মার্ট। ছোট্ট ‘এখন’ যুক্ত করে ঢাকার শেকড়হীন ইতিহাস অজ্ঞদের মধুর ভাবে খিস্তি করে গেল। বলল, তোরা ‘বর্ষবরণ’ নামে যা করছিস সেটা ছায়ানটের বানানো, তাদের প্রচলন। বাঙালি সংস্কৃতির এটাই এখন হূমায়ুনের ভাষায় মূলস্রোত।
কিন্তু ছায়ানট তো রমনার বটমূলে ষাট দশক থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে বর্ষবরণ করে আসছে। বাঙালী জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেবার ক্ষেত্রে ছায়ানটের অবদান অস্বীকার করার উপায় নাই। সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ছায়ানটের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের গঠন ও উত্থানের সময় ছায়ানটের ভূমিকা নিছকই সাংস্কৃতিক বা নববর্ষ বরণের একটি অনুষ্ঠান মাত্র ছিল না। এমনকি নববর্ষ উদযাপনও ছিল রাজনৈতিক তাৎপর্যে সমৃদ্ধ। কিন্তু এখন সেই মহিমা নাই। জাতীয় মুক্তির লড়াই রূপ নিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণীর পরস্পরের মধ্যে লড়াইয়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি বিশেষ অংশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ধারা হয়ে হাজির রয়েছে ছায়ানট। বাংলাই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাংস্কৃতিক পাহারাদার হয়ে। এখনকার ছায়ানট আর ষাট ও সত্তর দশকের ছায়ানটের তাৎপর্য ভিন্ন। এখন ছায়ানটের বিপরীতে হাজির রয়েছে শুধু গ্রামীণ আর খেটে খাওয়া মানুষসকলের সংস্কৃতি শুধু নয়, এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্য অংশগুলোর সাংস্কৃতিক তৎপরতা। রয়েছে শক্তিশালী কর্পোরেট সংস্কৃতির দাপট। বর্ষবরণে ব্যান্ড সঙ্গীতের শক্তিশালী উপস্থিতি কিম্বা বাউল সঙ্গীতের প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আদিখ্যেতাও দেখার মত হয়ে ওঠে বর্ষবরণে। ছায়ানটের ভূমিকাকে গৌণ করবার জন্য কথাগুলো বলছি না। শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি এখন রাজনৈতিক লড়াইয়ের চরিত্র ভিন্ন। হুমায়ূন যে অর্থে ‘এখন’ কথাটি বললেন তাকে ভাল ভাবে বোঝার জন্য প্রসঙ্গটি তুলেছি কেবল। এখন ছায়ানট মানে হচ্ছে বর্ষবরণ করবার একটা অনুষ্ঠান। ছায়ানট ও বর্ষবরণকে সমার্থক ঘোষণা দিয়ে হুমায়ূন ছায়ানটকে বড় করলেন নাকি নীচে নামিয়ে আনলেন এটা তিনি নিজেই বিবেচনা করে দেখতে পারেন। কিন্তু হুমায়ূনের এই অক্ষয় বাক্য থেকে থেকে যেটা বুঝে নেবার সেটা বুঝে নিতে পারছি। এখানেই লেখক হিশাবে হুমায়ূনের কৃতিত্ব।
এবার আসি লেখার শিরোনামে: ‘অদৃশ্য মানুষের বর্ষবরণ’। ‘অদৃশ্য মানুষ’ কেন? কারণ হুমায়ূন আহমেদ সরাসরি নয় বরং টেলিভিশনের পর্দায় ‘কিছু কিছু’ অনুষ্ঠান দেখতে ভালবাসেন। এটা হুমায়ূনের কাছে ‘অদৃশ্য’ হয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা। যেমন ক্রিকেট খেলা। বেশ। কিন্তু ক্রিকেটের সমান মর্যাদায় সমান্তরালে আছে বর্ষবরণ এবং একুশের মধ্যরাতে শহিদ মিনারে পুষ্পদান। বর্ষবরণ কিম্বা একুশের মধ্যরাতে শহিদ মিনারে পুষ্পদান ক্রিকেট খেলার মতোই সমান আনন্দদায়ক ঘটনা। তাই কি? সবই কি তাহলে খেলা? কেবলই উপভোগের জন্য? কোন অনুষ্ঠানে সশরীরে না থেকে টেলিভিশনে সেই অনুষ্ঠান দেখার মানে হচ্ছে ‘অদৃশ্য মানুষ’ হয়ে ‘অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা’। অদৃশ্য মানুষ হয়ে যাওয়া। সেখানেই হচ্ছে ‘আসল মজা’। হুমায়ূনের এই রকম ‘অদৃশ্য মানুষ’ হয়ে যেতে ভাল লাগে। মজা লাগে। টেলিভিশনে কিছু দেখা আর যা দেখানো হচ্ছে সেখানে ‘উপস্থিত থাকা’-র মধ্যে ফারাক করছেন না হুমায়ূন।
হুমায়ূনের কাছ থেকে শিখলাম বাস্তবে হাজির না থেকে, উপস্থিত না হয়েও আমরা ‘হাজির’ থাকতে পারি। সেটা পারি টেলিভিশনের মাধ্যমে। এই বাক্সটির সামনে বসে থাকলেই আমাদের বাস্তবে উপস্থিত থাকা হয়ে যায়। মূলঘটনা বা অনুষ্ঠানে আমরা নাই, অদৃশ্য, কিন্তু অদৃশ্য থেকেও আমরা হাজির থাকতে পারি। অদৃশ্য থেকে অনুষ্ঠানে হাজির থাকা, সেখানেই ‘আসল মজা’। ঘটনা যেখানে ঘটে, বাস্তব যেখানে বাস্তবিক হয়ে ওঠে, যেখানে মূল অনুষ্ঠান ইতিহাস হয়ে ওঠে সেখানে সরাসরি প্রত্যক্ষ ভাবে থাকার মধ্যে মজা নাই। ‘আসল মজা’ হচ্ছে ঘরে বসে টেলিভিশানে সেটা দেখা এবং উপভোগ করা। একাত্তরে আমাদের ‘মজা’ ছিল বাস্তবে পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা, মুক্তিযুদ্ধে যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। ইতিহাসের মূল অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। যুক্ত হওয়া। এখন ইতিহাস তৈরীর মধ্যে মজা নাই। যুক্ত হওয়া নয়, এখন মজা হচ্ছে বিযুক্ত হয়ে থাকার মধ্যে। এখন ‘অদৃশ্য মানব’ হয়ে থাকার মধ্যেই আনন্দ। আমি হুমায়ূন আহমেদের লেখার মধ্য দিয়ে জীবন ও জগত সম্পর্কে আমাদের সম্পর্কের ধরণে যে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে তার প্রমাণ পেয়ে যাচ্ছি। ধন্যবাদ হুমায়ূন আহমেদ।
আরেকটি খবর দিলেন হুমায়ূন আহমেদ। দুর্দান্ত খবর। তাঁর দীর্ঘ জীবনে তিনি কখনও রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে যান নি। মধ্যরাতে শহিদ মিনারে কোনদিন হুমায়ূন ফুল দিতে গিয়েছে্ন কিনা সে সম্পর্কে কোন খবর আমাদের জানানো হয় নি। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে না যেতে পারার বিস্তর কারন থাকতে পারে। সেইসব দিক থাক। হুমায়ূ্ন আহমেদ কেন এই লেখাটি লিখেছেন সেই প্রসঙ্গে বরং যাওয়া যাক।
একবার বাংলাদেশের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের সময় হুমায়ূন সুইডেনে ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল সুইডেনে বসে বাংলাদেশের কোন টিভি চ্যানেল দেখা যাবে না। হুমায়ূন আহমদের মনে হোল ‘আচমকা বাঙালির মূল স্রোতের বাইরে চলে গেছি’। তাঁর লেখা পড়ে মনে হোল বর্ষবরণে ছায়ানটের অনুষ্ঠানই ‘বাঙালির মূল স্রোত’। তবে তিনি আবিষ্কার করলেন সুইডেন থেকে চ্যানেল আই দেখা যায়। চ্যানেল আই বটমূলের অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচার করে। কিন্তু শোকের খবর হোল, এই বছর চ্যানেল আইকে বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয় নি। এই অনুষ্ঠান প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন। যেহেতু চ্যানেল আই অনুষ্ঠানটি প্রচার করতে পারবে না অতএব বিদেশের বাঙালিরা এই অনুষ্ঠানটি দেখতে পারবে না। কারন বিদেশে বিটিভি নাই। তাহলে কি করতে হবে? হুমায়ূন আহমদের যুক্তি মানলে বটমূলের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান প্রচারের অধিকার বা দায়িত্ব তাহলে চ্যানেল আইকেই দিতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের পুরা লেখাটাই চ্যানেল আইয়ের জন্য ওকালতির অধিক ছিল কি? তাহলে ওপরে এতো কীসের ব্যাখ্যা করছি আমরা? হুমায়ূন আহমদের এই ‘অদৃশ্য মানব’ হয়ে থাকার অর্থ তো আসলে এখানেই নিহিত। ছায়ানট আর বর্ষবরণ সমার্থক এই সিদ্ধান্ত হুমায়ূন আহমদকে টানতে হয়েছে চ্যানেল আই যেন বাঙালির এই মূল স্রোত প্রচারের অনুমতি পায় শুধু তার জন্য। কিন্তু এই কর্ম করতে গিয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ যে সাহসী(?) সিদ্ধান্ত ও তার পক্ষে বয়ান দিলেন সেটা আমাদের নগদ লাভ। হুমায়ূন খুব হিসাবী ছিলেন। খারাপ কী!
এই আলোকে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের ব্যাখাও দিয়েছেন হুমায়ূন। দারুন লেগেছে আমার। গানের কয়েকটি কথা হোল, “তোমার আমার মিলন হলে সকলই যায় খুলে / বিশ্বসাগর ঢেউ খেলিয়ে উঠে তখন দুলে”। এই গানে ‘বিশ্বসাগর’ কথাটির মানে কি? এর মানে হচ্ছে যারা বিদেশে বসে চ্যানেল আই-এ ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দেখে তারা। তারা তো এই বছর অনুষ্ঠান দেখতে পারবেন না। হুমায়ূন প্রশ্ন তুলেছেন এই না দেখার বেদনার যে ‘দুঃখবোধ’ ছায়ানটের কর্মকর্তাদের কি তা স্পর্শ করবে? ঠিকই তো। তাই না?
কী বুঝলাম আমরা? ছায়ানট এবং বর্ষবরণ বা ‘বাঙালির মূল স্রোত’ যে সমার্থক শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্বসাগর’ আর বিদেশে বসে চ্যানেল আইয়ে যারা বাঙালির এই মূল স্রোতের অনুষ্ঠান দেখে থাকেন – অর্থাৎ প্রবাসী বাঙালিরাও সমার্থক।
সাবাশ হুমায়ূ্ন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের লেখা পছন্দ না করার কী আর কারন থাকতে পারে? হুমায়ূন আহমেদের এই ছোট্ট লেখাটি পড়ে আমি কত সহজে ধরতে পারছি কিভাবে ছায়ানটের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বদলে যাচ্ছে বা গিয়েছে, কিভাবে বদলে যাচ্ছে বর্ষবরণ বা বাঙালির মূল স্রোত সংক্রান্ত বয়ান। বুঝে নিচ্ছি ‘অদৃশ্য মানুষ’ হয়ে বাস্তবে না থেকেও টেলিভিশানের গুণে বাস্তবে ‘উপস্থিত’ থাকার মজা। ইত্যাদি। বুঝতে পারছি একটি জেনারেশান বাংলাদেশ পেয়েছে যারা ইতিহাস যেখানে বাস্তবে তৈরি হয় সেখানে নয় তারা চ্যানেল আইয়ের সামনে বসে ইতিহাসের বাইরে থেকে ইতিহাস অবজার্ভ করতে চায়। কিভাবে আমি এখন বলতে পারব না, কিন্তু অনেক চড়া দামে এর মুল্য দিতে হবে বাংলাদেশকে।
হুমায়ূন আহমদের এই লেখার গুরুত্ব আমি একা বুঝতে পেরেছি দাবি করার প্রশ্নই আসে না। বেশ কয়েকটি পত্রিকা একই লেখা গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলা নতুন বছরে আমরা ‘এখন’ ঠিক কোথায় আছি তার একটা হদিস পাওয়া যাচ্ছে। তাই না?
২৭ চৈত্র ১৪১৭।১০ এপ্রিল ২০১১। শ্যামলী।
… … …
হুমায়ূনের লেখাটি সংগ্রহ করা কঠিন হতে পারে ভেবে এখানে জুড়ে দিচ্ছি।
অদৃশ্য মানবের বর্ষবরণ
হুমায়ূন আহমেদ
বর্ষবরণ এবং ছায়ানট এখন সমার্থক। দিনের শুরু ছায়ানটের গান দিয়ে। সূর্য ওঠার আগে রমনা বটমূল লোকারণ্য। ছোট বাচ্চাদের কেউ মায়ের হাত ধরে এসেছে, কেউ এসেছে বাবার ঘাড়ে চেপে। বটগাছের পাখিরা কিচিরমিচির করে অস্থির। প্রতিবছর এই দিনে কিছু একটা হয়, এটা এখন পাখিরাও জানে। তারা অপেক্ষা করে কখন গাওয়া হবে-
‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে।’
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে যাইনি। কিছু কিছু অনুষ্ঠান আমার টিভির পর্দায় দেখতে ভালো লাগে। যেমন_ক্রিকেট খেলা, বর্ষবরণ উৎসব, একুশের মধ্যরাতে শহীদ মিনারে পুষ্পদান। নিজে উপস্থিত না হয়ে টিভিপর্দায় অনুষ্ঠান দেখার আসল মজা অদৃশ্য হয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা। আমার অদৃশ্য মানব হতে ভালো লাগে।
দুই বছর আগে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, পহেলা বৈশাখে অদৃশ্য মানব হওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমি তখন সুইডেনে। সুইডেনের কোনো টিভি চ্যানেল নিশ্চয়ই রমনা বটমূলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দেখাবে না। মনটা খুবই খারাপ হলো, মনে হলো আচমকা বাঙালির মূল স্রোতের বাইরে চলে গেছি। তখন খবর পেলাম সুইডেনে ‘চ্যানেল আই’ দেখা যায়। রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান তারা সব সময় প্রচার করে। মূল স্রোতে ভেসে থাকা এখন সম্ভব। সেদিনের অনুষ্ঠান দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমি চ্যানেল আইকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।
এ বছর কী হলো বুঝতে পারছি না। চ্যানেল আই স্ক্রলে দেখাচ্ছে, তাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে তারা বর্ষবরণ উৎসব দেখাতে পারছে না। চ্যানেল আইকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এ অনুষ্ঠান শুধু বিটিভি প্রচার করতে পারবে। আর কেউ নয়।
ঘটনাটা কী? রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান এখন সর্বজনীন অনুষ্ঠান। কারও ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান না। শুধু সরকারি টিভি বিটিভি এ অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারবে, আর কেউ পারবে না_কারণটা কী? ইউরোপে যেসব বাঙালি থাকেন, তাঁরা এবার কিছু দেখবেন না? বিটিভি ওই সব দেশে নেই।
ছায়ানট ভবন নামের বিশাল ভবনটি কিন্তু জনগণের টাকায় বানানো। ছায়ানটের কর্মকর্তাদের টাকায় নয়। জনগণের একটি বড় অংশ প্রবাসী বাঙালি। আজ তাঁদের কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে?
যাঁরা বিদেশে থাকেন, তাঁদের প্রকৃতি চিলের মতো। চিল আকাশে ওড়ে, তার দৃষ্টি থাকে মাটিতে। প্রবাসীরা বিদেশে বাস করেন, তাঁদের মন পড়ে থাকে দেশে। দেশে কী হচ্ছে, তা নিয়ে তাঁদের সীমাহীন আকুলতা।
রমনা বটমূলের চমৎকার অনুষ্ঠানটি তাঁদের অনেকেই দেখতে পারবেন না। তাঁদের দুঃখবোধ কি ছায়ানটের কর্মকর্তাদের স্পর্শ করবে? তাঁরা গভীর আবেগে গাইবেন_
‘তোমায় আমায় মিলন হলে সকলই যায় খুলে
বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে উঠে তখন দুলে।’
গানের বাণী তাঁরা বিশ্বাস করেন কি? তাঁদের চেতনায় কি ‘বিশ্বসাগর’ আছে? (ইংরেজিতে বলি, ‘I doubt that.’)
৬ এপ্রিল ২০১১