।। বৈঠকি ।।
ফকির সাদেক আলি। চিশতিয়া ঘরের ফকির। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার আরামবাগে। এক সময় রাজ্য সরকারের কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু ফকিরি পথের সন্ধান পেয়ে ফকিরির টানে স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়েন। মুরিদ হন চিশতিয়া ধারার।
পরমহংস ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্মস্থান কামারপুকুরের অদূরে আনুড় গ্রামে গাছগাছালি আর ফুল-ফলে সমৃদ্ধ নিজের হাতে তৈরি করা ‘গুরুছায়া’ আশ্রমে ফকিরি সাধনায় দিনগুজরান করেন ফকির সাদেক আলি। সেখানেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে ভক্ত-সহ সাধারণ মানুষ নানা সময় তাঁর দরবারে হাজির হন। এক গুরুবারে (বৃহস্পতিবার) তাঁর দরবারে একত্রিত হয়েছিলেন তাঁরই মুরিদ রূপসা ও আলমগীর হোসেন এবং লালন অনুরাগী অতনু সিংহ। তাঁরা ভক্তিধারার নানা বিষয়ে আলাপ করলেন ফকির সাদেক আলির সঙ্গে।
বৃহৎ নদীয়ার ফকির লালন সাঁইজীর ১৩০তম তিরোধান দিবস ছিল গত ১লা কার্ত্তিক। সেই উপলক্ষ্যেই বাংলা তথা উপমহাদেশের আরেকটি ভাবঘর চিশতিয়া ধারা, সেই ধারার সাধু পশ্চিমবঙ্গের কামারপুকুরের শ্রদ্ধেয় এই ফকিরের সঙ্গে বৈঠকি আলাপ প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিপক্ষে।
ফকির সাদেক আলি বললেন, ‘‘বুঝতে না পারার জন্য এত পথ হয়েছে, বুঝতে পারলে হতো না। প্রত্যেকের জন্ম একই প্রক্রিয়ায়। পৃথিবী এক দেশ। মানব এক জাতি। মনুষ্যত্ব ধর্ম।
প্রেম এবাদত, প্রেম কুদরত / ধর্ম প্রেমের মাঝখানে/ আল্লাহ জানে দেহের মানে / পাপ কিসের কারণে !”
সেদিন ছিল প্রবরণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধধর্মের লোকাচারে এই পূর্ণিমা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবছর বৃহস্পতিবার ছিল এই পূর্ণিমাক্ষণ। প্রতি বৃহস্পতিবারেই ফকির সাদেক আলির ‘গুরুছায়া’ আশ্রমে সাধুগুরু, ভক্ত-মুরিদ-সহ সাধারণ মানুষের সমাগম হয়। ফকিরি গান ও কাওয়ালী গাওয়া হয়, ধর্মকথা আলোচনা হয় আর অন্নসেবা দেওয়া হয় সমবেত মানুষকে। করোনাকালে এসব স্বাভাবিক সময়ের মতো নয় ঠিকই, কিন্তু সীমিত সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে নিরাপদ দূরত্ববিধি মেনে প্রতি গুরুবার ফকির দরবারে মানুষের মজলিশ জারি রয়েছে। প্রবরণা পূর্ণিমার দিন যেহেতু ছিল বৃহস্পতিবার, ওইদিন এই আলাপের তিন প্রশ্নকর্ত্তা হাজির হয়েছিলেন ‘গুরুছায়া’য়। দুপুরে অন্নসেবা ও বিশ্রামের পর বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বৈঠকি আলাপ চললো ফকিরের সঙ্গে।
আলাপের শুরুতে ছিল অতনুর প্রশ্ন। তিনি জানতে চাইলেন—
“এখন চারপাশে ধর্মীয় পরিচয়বাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। ধর্মের নাম করে হানাহানি হচ্ছে। ধর্ম কি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, না কি একত্রিত করে?”
এই প্রশ্নের উত্তরে ফকির সাদেক আলি বললেন—
“ধর্ম হল জোড়ার পদ্ধতি। মানুষের সঙ্গে মানুষকে জোড়ার জন্য। আজ যদি মানুষ ধর্মচ্যুত হয়, তা হলে রাষ্ট্রের কত পুলিশ, কত আদালত, জেলখানা আছে যে সবাইকে পুরবে? ধর্মভীতি, আল্লাহ-ভীতি থেকে আজও মানুষকে অনেক মারামারি হানাহানি, জেল-আদালত থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। বহু মানুষ আল্লাহর বিচারের উপর নিজেকে ও অন্যকে ছেড়ে দেয়। এই ভাবেই জুড়ে জুড়ে থাকে”।
এবার অতনু পালটা প্রশ্ন তুললেন—
“ধর্মকে ঘিরে পরিচয়বাদ তৈরি হয়েছে। সাধুগুরুরা বলেন, ধর্ম কোনও হোর্ডিং নয়। অথচ উপমহাদেশে ধর্মকে কেন্দ্র করেই দেশভাগ হয়েছে…”
ফকির সাদেক আলির উত্তর—
“ধর্ম কোনো বিভেদ মানে না। এই বিভেদনীতি কায়েম করা হয়েছে, ফল হলো দেশভাগ। এই বিভেদনীতি মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে। পরবর্তী প্রজন্ম এর ফল ভোগ করবে বলেই আশঙ্কা”।
আগের প্রশ্নের রেশ ধরেই অতনু বললেন,
“অথচ এই পরিচয়বাদের সঙ্গে সঙ্গেই তো সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়েছে। মানে, আমি হিন্দু, তেমন ভাবে সকলকেই তাই হতে হবে, যেটা আমরা ভারতে দেখতে পাচ্ছি”।
ফকির বাবাজীর বক্তব্য—
“ধর্ম প্রেম, সম্প্রচার যন্ত্র নয়। যে মানে, সে প্রচার করে না। যে প্রচার করে সে মানে না। পরিচয়বাদের কথা উঠলে বলতে হয়, পরিচয়-পরিচিতের সত্তা। সেটা একমাত্র আত্মপরিচয়ে ঘটে থাকে। যাঁদের আত্মপরিচয় ঘটে, তারা কোনো দিনও মৌলবাদী নয়”।
এবার এই আলাপের মাঝে জানতে চাইলেন রূপসা। তাঁর প্রশ্ন—
“যিনি বিশ্বাসী, তার কাছে ধর্ম এক রকম ভাবে মুক্তি বা শান্তির জায়গা। কিন্তু অবিশ্বাসীরা তো তাঁদের মতো করে থাকেন। তাঁদের শান্তির জায়গাটা কী?”
ফকির সাদেক আলির উত্তর—
“ধর্ম মানে শান্তি, স্বস্তি, অশান্তি কিছু নয়। ধর্ম জীবনপদ্ধতি। জীবনবাদ। ধর্ম মোটেই ব্যবসা নয়। ধর্ম তো প্রেম। তাই প্রেম যেখানে ধর্ম, সেখানে আবার এ সব ক্লাসিফিকেশন কী করে আসে? অবিশ্বাসী বিশ্বাসীর কথা হলো, সকলে কখনও একরকম হতে পারে না। ধরো তুমি একটা স্কুলে পড়ো। সবাই যদি মাস্টার হবে, পড়বে কে? সেখানে দারোয়ানের চাকরিটাই বা করবে কে? ইস্কুল কমিটিটা কে চালাবে? এগুলো ব্যাঙ্কের ডিপোজিটের মতো। যারা ত্যাগী মানুষ, আধ্যাত্মিক পথে চলে গেছে, তারা ওই অবিশ্বাসীদেরও টানতে পারে, তাদের পাপ নিয়ে, নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী। পাপ-পুণ্যের বিচার আছে। অবিশ্বাসী মানে যে, সে শান্তি পাবে না, ভালো থাকবে না- এমন কোনও কথা নেই। বিশ্বাসী মানুষও যে ‘মুক্তি’ পাবে, এমন কিছু না। ধর্ম মানে তো একটা সন্তোষের জায়গা। আত্মোপলব্ধির জায়গা। প্রথমে আত্মসমর্পণ, তারপর আত্মোপলব্ধি, তারপর আত্মদর্শন। ধর্ম মানে তোমরা অন্যরকম করে ফেলেছ— ওখানে গেলে নাকি শান্তি পাওয়া যায়, মুক্তি পাওয়া যায়, মোক্ষ পাওয়া যায়, এ সব একেবারে বাজে কথা। কোথায় মুক্তি, কোথায় মোক্ষ?”
মোক্ষম প্রশ্ন তুললেন সাধু।
এই আলাপের মধ্যে এবার শামিল হলেন মুর্শিদাবাদের যুবক ও সুফিভক্ত আলমগীর হোসেন। তিনি জানতে চাইলেন—
“এই ধর্মের হানাহানিতে কি সুফিবাদ বড় প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে?”
চিশতিয়া ঘরের সাধু সাদেক আলি বললেন—
“অবশ্যই। ইসলামের সুফিবাদে হিন্দু-মুসলমান নেই। কারণ সবটাই এক। মুসলিম কালচারে প্রথমেই ‘ঈমানে মুফাসসের’ বলে একটা কলমা পড়তে হয়,। সেটা কী? সেটা হলো আমি ঈমান আনলাম সমস্ত কেতাবের উপরে, সমস্ত রাসূলের উপরে, সমস্ত ফেরেশতার উপরে। ফলে কাউকে ইনকার করার কিছু নেই। এটা প্রেমের ধর্ম। এটা আশেক-মাশুকের ব্যাপার। প্রেম আর প্রেমিকার মাঝখানে প্রেমাস্পদের সন্ধান তারা পেয়েছে। প্রতিটি ধর্মই হলো মানুষপন্থী”।
আলমগীরের পরবর্তী প্রশ্ন—
“উপনিষদে আমরা দেখছি, বসুধৈব কুটুম্বকম। কোরআন বলছে্ন, একজন মানুষকে হত্যা করা হলে, সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করা হলো। বৌদ্ধ ধর্মতেও তাই দেখছি। তাদহলে বর্তমান পৃথিবীতে যে ধর্ম নিয়ে সংকট তৈরি করা হচ্ছে, সেটা কি পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের রূপগুলিকে ঢেকে রাখার জন্য?”
সাধুর উত্তর—
“একশো বার। পুঁজির শাসন আর সাম্প্রদায়িকতা একসঙ্গে চলছে। অস্ত্র ব্যবসার কথা তাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে। তার জন্য যা যা করার দরকার, তাই তারা করছে। ধর্মে কিন্তু কোনো ব্যবসা-রাজনীতি থাকতে পারে না। বুঝতে না পারার জন্য যত দ্বন্দ্ব। ধর্ম বুঝলে প্রত্যেকের ধর্মের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কোনো কথাই উঠতো না”।
সাধুর উত্তর শেষ হতেই রূপসা বললেন—
“অনেকেই বলেন, মানুষের মধ্যে ঈশ্বর আছেন। আমরা খুব কথার কথা হিসেবে বিষয়টাকে ধরি। অনেকে বলেন শিবজ্ঞানে জীবসেবার কথা। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর, এই ভাবনাটাকে যদি ব্যাখ্যা করেন।“
রূপসার কথার জবাবে ককির বললেন—
“সব থেকে বড় সেবক হলো গাছ। সে অক্সিজেন দিচ্ছে, ফুলফল দিচ্ছে, জ্বালানি দিচ্ছে। সে কিছু বলছে? বলছে না তো! আল্লাহর নবী বলেছেন, ডান হাত দিয়ে দান করো, কিন্তু বাঁ হাত যেন জানতে না পারে। এটা কেমন করে সম্ভব? সেবা করার থেকে পুজো করা ভালো। কারণ সেবার মধ্যে এক ধরনের অহংকার আসলেও আসতে পারে, কিন্তু পুজোর মধ্যে শুধুই সমর্পণ আর নিবেদন। — ‘মায়া-মোহর আঁধারে ডুবে দেখে অন্ধকার, সামনে ঘোরাফেরা করে তবু খোঁজে বারবার”।
আমরা জানি, ফকিরিতে নানা ধারা আছে। নানা ভাবনা আছে। নানা পথ আছে। সব পথই প্রেমের পথ। যদিও বিচারপদ্ধতিতে ফারাক ভক্তিবাদের বিরাট চালচিত্রে বৈচিত্র্য হাজির করে। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ফকিরি ধারায় যেমন শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দ-অদ্বৈতাচার্য হয়ে ক্রমে লালন-সহ দুই বাংলার বৃহৎ নদীয়ার ভাবঘরগুলি হাজির, তেমনই খাজা মঈন-উদ্দিন-চিশতি আর নিজাম-উদ্দিন-আউলিয়ার সুফি ধারাও বাংলায় মিশেছে অবাধে। সেই চিশতিয়া ধারার আবার অনেক রূপবৈচিত্র্য বৃহৎবঙ্গে। আবার বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জের ফকিরি ধারা আরেকরকম।
যাইহোক, বৈচিত্র্যের এই জায়গা থেকেই অতনু জানতে চাইলেন—
“অনেকে বলেন, তিনি আছেন ভিতরে। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি আছেন তাঁর জায়গায়, আমাকে তাঁর সঙ্গে ফানাফিল্লাহ হতে হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কি আমি এবং তিনি, কোনোভাবে দ্বিত্বের বিষয়টা হাজির হয়ে যাচ্ছে না?”
সাধুর জবাব—
“যেখানে আমি-তুমি নাই, সেখানেই তাঁর দেখা পাওয়া যায়। দেহের মধ্যে এমন এক জায়গা আছে, অক্ষর বা শব্দ নাই, অথচ বাক্য মুহূর্তে মুহূর্তে তৈরি হয়। সেইখানে নজর করলেই পাওয়া যায়।“
অতনুর পালটা প্রশ্ন—
“তার মানে আপনি দ্বিত্বের জায়গা থেকে ফানাফিল্লাহতে বিশ্বাস করেন না?”
সাধুর জবাব—
“বিলীন ব্যাপারটা অন্য রকম। মোহনায় গেলে বুঝতে পারবে। নদী যখন সমুদ্রে মিশতে যায়, অনেক কিলোমিটার এগোনোর পরে তাকে জোয়ার থামিয়ে দেয়, তারপর ভাঁটাতে আস্তে আস্তে টানে। অর্থাৎ তাঁর দয়াতেই সে আমাকে বিলীন করে। আমার কোনো ক্ষমতা নাই যে আমি বিলীন হবো…”
ফের ফকিরি ঘরগুলির বৈচিত্র্য ও ঐক্যের বিষয়টিতে ফোকাস করে অতনুর প্রশ্ন—
“ফকিরি ধারাতে অনেক ঘর, অনেক সিলসিলা। এদের মধ্যে মিল-অমিলের বিষয়টা কী?”
একটু মুচকি হেসে ফকির বাবাজী উত্তর দিলেন—
“দেখো, যত মত তত পথ- কথাটা ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলে গেছেন। আমার মনে হয়, একটাই পথ একটাই মত। এক থেকে নয় পর্যন্ত সমস্ত সংখ্যার আকৃতি আলাদা। কিন্তু শূ্ন্যের আকৃতি এক। যাদের হৃদয় শূন্যে পূর্ণ হয়েছে, তাদের কাছে অমিল কথাটাই অবাস্তব।”
অতনু: সেটা কী?
সাধু: একটাই মত একটাই পথ। প্রেম। বুঝতে না পারার জন্য এত পথ হয়েছে। রুচিবোধ আলাদা হতে পারে, কিন্তু প্রেমের পথ একটাই। প্রাণ খুলে মেলামেশা। এই যে এত জাতি-ধর্ম পরিচিতির কথা বলা হয়, হিন্দু, মুসলমান, জৈন, শিখ আরও নানা—জন্ম তো সবার একই প্রক্রিয়ায়। তবে? তা হলে প্রক্রিয়া যখন এক, তখন আবার এত মত-পথ আসছে কোত্থেকে? পৃথিবী এক দেশ। মানব এক জাতি। মনুষ্যত্ব ধর্ম। এর মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, শেখ, সৈয়দ, পাঠান… এইসব ভাগাভাগির ফসল।
এরপর অতনু বলতে যাচ্ছিলেন,
‘আপনি চিশতিয়া ঘরানার সাধক…’
কথা থামিয়ে কিছুটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে সাধুর পালটা প্রশ্ন—
“তোমার কাছে রেজিস্টার খাতা আছে নাকি, যে সাধক বলে দিচ্ছ? আমি চিশতিয়া ঘরানার মুরিদ। শেষ আছে নাকি এর, যে সাধক বলা যাবে, বলা যাবে ‘আমি সাধক’? ফুলস্টপ থাকলে তবে তো বলা যেত।“
অতনু স্মিত হেসে জিজ্ঞাসা করলেন—
“আচ্ছা, তাই ধরলাম। তা হলে আলাদা আলাদা ঘরের আলাদা আলাদা আচার কেন?
ফকিরের জবাব এলো। তিনি বললেন—
“এগুলো রুচিবোধ। কেউ তেতো খেতে ভালোবাসে, কেউ মিঠে খেতে ভালোবাসে। এগুলো রুচিবোধে তৈরি হয়েছে। আর বিভিন্ন মনীষী যা করেছেন, তাঁরা মানুষকে বাদ দিয়ে কিছু করেননি। সুতরাং মনুষ্যত্ব যাতে রক্ষা হয়েছে, তাতে আর আপত্তির কী আছে!”
এরপর উঠলো সহজ মানব-সমাজ ও সহজ-মানুষের প্রসঙ্গ। অতনু জানতে চাইলেন–
“বিশ্ব উম্মাহ নিয়ে আপনার মত কী?”
পরিভাষা ব্যবহারে সাধুদের অনীহা থাকে। কারণ, তাঁরা সহজ কথা সহজভাবে বলতে চান। তাই সাধুর জবাব এলো—
“আমরা তো আসলে ভালো ভালো কথা বলতে শিখে গেছি। সমস্যা হলো, আমরা এ সব বলার সময়ে নিজেকে বাদ রেখে দিই। গোনায় ভুল হয় বলে মুশকিল হয়। সে বিশ্ব উম্মাহ-ই বলো, সৌভ্রাতৃত্ব বলো— নিজেকে ঠিক করো, সব ভালো হয়ে যাবে। আপ ভালো তো জগৎ আলো। মুসলমানরা নিজেই বিশ্ব উম্মাহ বা সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলে। কিন্তু নিজের ভাইয়ের সঙ্গেই তাদের মিল নাই, বড় পাঁচিল তৈরি হয়ে গেছে, ঘরের ভিতরে। অপরের দোষ ধরে কখনও হবে না। বিপ্লব কীসে আসে? দল গঠন করে হয় না। একটা চরিত্র গঠন করতে হবে। যেমন নবীজী, যেমন রামকৃষ্ণদেব। ব্যক্তিত্বটা আগে তৈরি হয়েছে, তারপরে বিপ্লব এসেছে।”
আলাপ শেষ হলো রূপসার প্রশ্ন ও তার জবাবে সাধুর বয়ান দিয়ে।
রূপসা জানতে চাইলেন—
“সুফিবাদ কি এখানে কোনও অবদান রাখতে পারে?”
সাধুর জবাব, “সুফিবাদ বিপ্লব আনার জন্য নয়, নিজেকে চেনার জন্য। নিজেকে চিনলে সে নিজেকে নিয়েই নিজে বিভোর থাকবে। আলো দেবার জন্য প্রচুর আলোর দরকার নেই, একটা সূর্য আর একটা চাঁদই আকাশে যথেষ্ট। প্রেমিক হতে গেলে, প্রেমের ভাজনের সংখ্যা কমবে”।
কথা প্রসঙ্গে আলাদা করে সুফিবাদ এলো বটে, কিন্তু বৈঠকি জুড়ে সকল ভক্তিবাদী ধারা, মানুষ ভজনা, ইনসানিয়াত তথা ধর্ম ও তার প্রেম-সম্বন্ধের ভাবটাই স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
বৈঠকির শেষে গান হলো সন্ধ্যায়। আল্লা, আদম, রাসূল আর মানুষের গান। প্রেমে প্রেমে মানুষ ভজনার। তারপর ভক্ত, সাধুগুরু, মেহমান সবাই একত্রে বসে সেবা নেওয়া হলো। অন্নের, শস্যের।
মনে পড়লো লালন সাঁইয়ের কথা-
”মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”
রাত ঘন হলো যত চাঁদের আকার বাড়তে লাগল আশ্রমের আকাশ জুড়ে। প্রবরণা পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের সুরতে প্রেম এলো মনে মনে।
সাধুগুরুদের জয় হোক।
জয়গুরু