এক
সম্প্রতি ‘প্রতিপক্ষ’ টাঙ্গাইলে রিদয়পুর বিদ্যাঘরে ‘রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডা’র আয়োজন করে। আড্ডাটি খুবই সাড়া ফেলে। তখনই প্রতিপক্ষের আয়োজনে একটি সাহিত্য সম্মেলন করা যায় কিনা সে কথা ওঠে। তখন রিদয়পুরে প্রতিপক্ষের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সাহিত্য আড্ডারই ধারাবাহিকতায় প্রতিপক্ষের আয়োজনে ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটা কোন জাতীয় সম্মেলন নয়। রিদয়পুর আড্ডারই ধারাবাহিকতা। যারা রিদয়পুরে যান নি বা ঢাকার বাইরে যাওয়া যাদের জন্য কঠিন, তাদের নিয়ে রিদয়পুরের মতোই আরও বড় পরিসরে একত্র হওয়া। ইতোমধ্যে আরো দুই একটি সংগঠন বা উদ্যোগ সাহিত্য সম্মেলন করেছেন বা করছেন। খুবই ভাল কাজ। তাঁদের আমরা সমর্থন করি। যে যেভাবেই করুক সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ বাড়ুক। সাহিত্যকে কেন্দ্র করে সবার সঙ্গে মেলামেশা বাড়ুক, এটাই তো চাই।
রিদয়পুরের সাহিত্য সম্মেলন অনুপ্রাণিত করে সবাইকেই। তাই পরবর্তী সম্মেলনকে একটি জাতীয় সম্মেলন হিসাবে রূপ দেবার ইচ্ছা সম্ভবত অনেকের মধ্যেই জেগেছে। এটা খুবই খুশির কথা। এ ধরণের উদ্যোগ কেউ নিলে এবং আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলে ‘প্রতিপক্ষ’ অবশ্যই তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এখন দরকার মেলামেশা, পরস্পরকে জানা এবং সাহিত্য নামক ধারণাকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন ধারা উপধারাকে শনাক্ত করা। ‘জাতীয়’ কথাটা অনেক বড়সড় ব্যাপার। তবে মেলামেশা ও পরস্পরকে জানাশোনার প্রক্রিয়া জারি রাখা গেলে বাংলাদেশের সাহিত্য আন্দোলন একটা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় রূপ আপনাতেই নেবে। তাই রিদয়পুরের পর একই ধরণের প্রক্রিয়া আমরা জারি রাখতে চেয়েছি। কারণ সাহিত্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু ধারণা নিয়েই রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডাটি হয়েছিল। সেই ধারণারই ধারাবাহিকতায় ‘ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন’-এর সিদ্ধান্ত। এরপর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, ইত্যাদি। তারপর জাতীয়…।
ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন সফল করবার প্রক্রিয়া হিসাবে আমাদের মনে হয়েছে আরো কিছু আড্ডা, আরো কিছু মানুষের সঙ্গে একত্রিত হওয়া দরকার। যেন সকলে বুঝতে পারেন আমরা আসলে কী করতে চাইছি। প্রতিপক্ষের আয়োজনে ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন করবার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা সামনে রেখে তাই দুই একটি আলোচনা বা আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে। তারই প্রথমটি “ ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ এবং নতুন সিনেমার সম্ভাবনা”। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাম্প্রতিক ছবিটিকে কেন্দ্র করে কথাবার্তা, তবে ভরকেন্দ্র হচ্ছে পরিচালকের কাছ থেকে শোনা এবং বাংলাদেশের সামনের সারির ছবি বানানেয়ালা ও ছবির সমঝদারদের সঙ্গে বাংলাদেশে নতুন সিনেমার সম্ভাবনা নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা করা।
রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডার সময় থেকেই মনে হয়েছিল অনেকেই প্রতিপক্ষ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। অনেকে (কেউ কেউ তো) একদমই না। না জানাটাই স্বাভাবিক। তাই প্রতিপক্ষকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য প্রাথমিক কিছু ধারণা দিয়ে রাখা দরকার।
দুই
‘প্রতিপক্ষ’ প্রথাগত অর্থেই সাহিত্যের পত্রিকা হিসাবে গত শতকে ৮৯/৯০ সালে বেরুতো। বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্যিক, আব্বাস উদ্দীন, ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সেই সময়ে বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো সংখ্যা প্রতিপক্ষ বের করেছিল। পত্রিকা সব সময়ই নতুন চিন্তার মঞ্চের মতো। প্রকাশ পত্রিকার বাইরের দিক। যথারীতি, প্রতিপক্ষের প্রাণের দিকটা ছিল আড্ডায়। প্রতিপক্ষ নামে প্রতি বৃহস্পতিবার যে আড্ডা হোত সেটাই ছিল সাহিত্যের দিক থেকে এক নম্বরের কাজের জায়গা। এক নম্বর কাজ তো অবশ্যই: নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা; তারপর, সাহিত্য নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তাভাবনা করা। ইত্যাদি।
প্রতিপক্ষের বিখ্যাত উর্দু সাহিত্য সংখ্যা। বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্যিকদের নিয়ে লেখা যখন কঠিন ছিল, প্রতিপক্ষ তখন এই সংখ্যাটি বের করে। বাংলাদেশেও উর্দু ভাষায় লেখালিখি করছেন অনেকে, এবং তাঁরা স্বনামধন্য সাহিত্যিক — এই ধারনাও তখন কারো ছিল না। জাতীয়তাবাদী উগ্রতা এমন পর্যায়ে ছিল যে যে একজন উর্দুভাষী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে পারেন এবং বাংলাদেশিকে নিজের দেশ মন করতে পারেন — এই ধারণা করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আজও পরিস্থিতির খুব বদল হয়েছে বলা যাবে না।
নতুন ভাবে যখন আমরা ‘প্রতিপক্ষ’-কে ওয়েব পাতা হিসাবে বের করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তখন একদিকে এই পুরানা ইতিহাস ও তার গৌরব, আর অন্যদিকে সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের কিছু নতুন ধারণা মাথায় নিয়েই আমরা শুরু করি। যারা সাহিত্য ধারণা নিয়ে দেশেবিদেশের তর্ক কমবেশী অনুসরণ করেছেন, তাঁরা জানেন ‘লিটারেচার’ কথাটা আমরা ব্যবহার করি বটে, কিন্তু তার কোন সারবত্তা নাই। কেন নাই? কারণ লিটারেচার কি তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাবার কোন যুৎসই মানদণ্ড নাই। কি মিল আছে কবিতার সঙ্গে গদ্যের? কিম্বা রম্য রচনার সঙ্গে উপন্যাসের; তারা ছাপাখানায় ছাপা হয় এটা একটা মিল বটে। লিটারেচার কথাটার অসারত্ব নতুন কিছু না। যারা টেরি ইগলটন (Terry Eagleton) বা স্টেনলি ফিশের (Stanely Fish) মতো লেখকদের পড়েছেন তারা এ ব্যাপারের অবহিত আছেন বলেই আমার বিশ্বাস। ইগলটন লিটারেচারের সার্বজনীন সারবত্তা (essence) অস্বীকার করলেও ক্যাটাগরিটির ব্যবহারকে অন্যায্য বলেন নি। কিন্তু তাদের তর্ক ছাপাখানায় ছাপা লেখালিখির মধ্যে। আমরা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি তার সঙ্গে কিছুটা প্রাসঙ্গিক, কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের নতুন চিন্তাভাবনার জন্য কেন্দ্রীয় বিষয় না। তবে লিটারেচার নিয়ে নতুন ভাবে ভাবনাচিন্তা করা যে ন্যায্য এটা তাঁদের লেখালিখি থেকে অনেক আগেই টের পাওয়া গিয়েছিল।
রিদয়পুরের সাহিত্য আড্ডার আয়োজনের আগে থেকেই প্রতিপক্ষ ‘সাহিত্য’ ধারণাটিকে বিচারের অধীন আনবার জন্য কিছু কথা পেশ করেই শুরু করেছিল। প্রতিপক্ষের ওয়েবপাতাটি যেদিন প্রকাশিত হয়েছে সেদিন থেকেই আমরা নতুন কথাই বলেছি। তবে বলেছিলাম অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে। নিজেদের ‘প্রাচীন’ বলে মেনে নিয়ে। যেমন,
“সাহিত্য কথাটা প্রাচীন অর্থেই আমরা আপাতত ধরে নিচ্ছি। সহিত থেকে সাহিত্য, সবার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ও বিরাজ করবার বাসনা। এই বাসনা আছে বলেই মানুষ নাকি কথা বলে। ওর মধ্য দিয়ে সমাজ নামক যে-পদার্থটা দানা বাঁধে তা একই সঙ্গে এক ও অনেক। চিহ্ন বা আরও সুনির্দিষ্ট অর্থে অক্ষর নিয়ে কায়কারবারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই উৎপাদন হয় বলে প্রচার আছে”।
দাবিটা ছিল এই যে সাহিত্য যদি ‘সবার সঙ্গে যুক্ত হবার ও বিরাজ করবার বাসনা’ হয় আর বাসনা কোন না কোন চিহ্নব্যাবস্থা বা মাধ্যমের মধ্য দিয়ে ‘যুগপৎ ব্যাক্তি ও সমাজ হয়ে ওঠে”। তাহলে প্রাচীন অর্থের দিক থেকে দেখলে সাহিত্য ব্যাপারটা শুধু লিখিত ভাষার ব্যাপার না। সেটা আরও বড় জিনিস। সাহিত্য চর্চা শুধু গুটেনবার্গের টেকনলজি দিয়ে হতে হবে তারও কোন কথা নাই – যে কোন মাধ্যম বা টেকনলজির মধ্য দিয়ে সাহিত্য চর্চা সম্ভব। অর্থাৎ মুদ্রিত অক্ষরের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও চিরায়ত – এই ধারণার অবসান চাইছিলাম আমরা। যাতে মুদ্রিত অক্ষরের বাইরেও আরও অনেক কিছুর সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক আছে সেই দিকে আমাদের নজর নিক্ষিপ্ত হতে পারে। যেন সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অন্যান্য মাধ্যমের ভুমিকা সহজে দৃষ্টিগোচর হয়।
জোহান্স গুটেনবার্গ (Johannes Gensfleisch zur Laden zum Gutenberg) ছিলেন পেশায় কামার ও স্বর্ণকার। এই মানুষটি ছাপাখানা আবিষ্কার করেন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা যায় এই ধরণের আলাদা আলদা সিসার অক্ষর দিয়ে চালানো ছাপাখানা দিয়ে তিনি ইউরোপে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলন। বলা হয়, গুটেনবার্গের ছাপাখনা ইউরোপে রেঁনেসা ও এনলাইটমেন্টের কারন। বিজ্ঞানের আবির্ভাব ও বিকাশের সঙ্গে ছাপাখানার সম্পর্ক আছে, এটাও বেশ বদ্ধমূল দাবি। গুটেনবার্গকে বাদ দিয়ে ইউরোপের ইতিহাস চিন্তা করা কঠিন। আর, সেটা ছিল কৃৎকৌশলের বিপ্লব।
কেন এখন এই ডিজিটাল যুগে সাহিত্যের এই ‘প্রাচীন’ অর্থটা ধরে রাখতে চাইছি সেটা আমরা আরও লেখালিখি ও কাজের মধ্যে ব্যাখ্যা করব বলে পণ করেছিলাম। রিদয়পুরে যাবার আগে ‘সাহিত্য’ কথাটাকে তার মাধ্যম বা বিশেষ টেকনলজির প্রতি একনিষ্ঠ থাকার দায়বদদ্ধতা থেকেই যে আসলে আমরা মুক্তি দিতে চাইছি, সেটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট করতে পেরেছিলাম। মুদ্রিত অক্ষরের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক আছে, সেটা থাকুক, সেটা তো থাকবেই। কিন্তু অন্যান্য মাধ্যমের সঙ্গেও সাহিত্যের সম্পর্ক নিবিড়। লেখালিখি কিছু হয়েছে, তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেককেই ব্যাখ্যা করে বলেছি: আমরা সাহিত্য বলতে শুধু বইপত্র বুঝি না, বইপত্র যে অর্থে সাহিত্য নিয়ে কারবার করে, সিনেমাও সেটা করতে পারে। তেমনি টেলিভিশানও। কিম্বা সঙ্গীত বা ছবি আঁকা। সাহিত্যচর্চা শুধু ছাপাখানার ব্যাপার নয়। টের পাই এই দেশে সাহিত্য বা শিল্পের বিচার কেন রসতত্ত্ব নিয়ে উৎসাহী ছিল। কিভাবে বা কোন্ মাধ্যম দিয়ে রসের উৎপাদন ঘটল সেটা ছিল শিল্প বিচারের অবিচ্ছেদ্য, কিন্তু গৌণ দিক।
“যুক্ত হওয়া বা বিরাজ করবার বাসনা” কথাটা নিয়ে আরও অনেক কিছু ভাববার আছে। সাহিত্যিকদের নিয়ে কারবার করছি বলে ব্যাক্তির দিক থেকে কথাটা বলা। কিন্তু মাধ্যম বা চিহ্নব্যবস্থা নিজেও কিভাবে ব্যাক্তিকে তৈয়ার করে, সে দিকেও মনোযোগ থাকা দরকার। তাছাড়া কমিউনিকেশন – কিম্বা আগাম তৈয়ারি কোন তথ্য বা বার্তা কাউকে পৌঁছানোর কাজ ঠিক সাহিত্যের কিনা তাকেও সন্দেহের অধীন রাখা দরকার। যাতে সংবাদ ও সাহিত্যের পার্থক্য আমরা করতে পারি। সাহিত্যের মধ্যে কমিউনিকেশন আছে, তবে কমিউনিকেশন হলেই সাহিত্য হলো না। এটা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু এভাবে কেন বুঝি তার ব্যখ্যা দাবি করে সাহিত্য। ‘যুক্ত হওয়া বা বিরাজ করবার বাসনা’কে আমরা সাহিত্য নিয়ে চিন্তাভাবনার অভিমুখ বদলাবার পতাকা হিসাবে তুললাম মাত্র। আরো কথা হবে নিশ্চয়ই। বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত ভাবে লিখবার সুযোগ পাই নি। তবে রিদয়পুরে যাবার আগে এটা অধিকাংশই কবুল করেছিলেন: সাহিত্যের আড্ডা মানে প্রথাগত অর্থে পত্রপত্রিকায় মুদ্রাক্ষর যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যারা সাহিত্য করেন, তাদের নিয়ে আড্ডা না। কারণ তারাই শুধু ‘সাহিত্যিক’ না। সবার সঙ্গে যুক্ত হবার আর সবার মধ্যে বিরাজ করবার বাসনা শুধু অক্ষর-অলা সাহিত্যিকদের আছে এটা একটা মিথ। এই মিথ আমরা ভাঙতে চেয়েছি। এটা ভাঙা দরকার।
সাহিত্যকে তাহলে নানান দিক থেকে দেখা ও বিচার করা জরুরী। টেকনোলজির দিক থেকে যেমন, তেমনি যিনি একটি মাধ্যম ব্যবহার করছেন তার বাসনার দিক থেকেও। তার বাসনাকে টেকনলজি কিভাবে রূপ দেয় সেই দিকটাও। গুটেনবার্গ টেকনোলজি যেমন মুদ্রিত অক্ষর দিয়ে সাহিত্য করার ধরন, সিনেমার অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমও তেমনি সাহিত্য চর্চারই আরেকটি ধরণ। মুদ্রণ যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত সাহিত্যকে আমরা সাহিত্য হিসেবে খারিজ করছি না। শুধু বলতে চাচ্ছি, এই টেকনোলজির বাইরেও অন্য টেকনলজি আছে, অতএব অন্য সাহিত্যও আছে, সাহিত্য হচ্ছে। তাই সিনেমাকেও আমরা বলছি সাহিত্য।
মুখের ভাষা বা মুদ্রিত অক্ষরই একমাত্র চিহ্নব্যবস্থা নয়। সিনেমারও একটা ভাষা আছে। যেমন আছে ফটোগ্রাফি বা স্থির চিত্রের, রঙের ও তুলির, স্পেইস বা জায়গা ব্যবহারেরও ভাষা আছে, যাকে আমরা স্থাপত্য বলি; ভাষা আছে নাচের মুদ্রা আর জীবন্ত শরীরের বিশেষ স্থাপত্য নির্মাণে, সঙ্গীতের পর্দা ও তাদের আন্তঃসম্পর্কের ভাষাও ভাষা– এমনকি ভাষা আছে পোশাক আশাক, ফ্যাশান, কিম্বা ঘর সাজানোর মধ্যেও। নাটক, যাত্রা, পালা – নানান ভাষা আর নানা ভাবে মানুষের সাহিত্য চর্চার ধরণ। প্রাচীন ‘সাহিত্য’ কথাটির পরিব্যাপ্তি এতো তুমুল ও গভীর সেটা আমরা টের পেয়ে আমোদিত অনেক দিন থেকেই।
“সাহিত্যের প্রাচীন ধারণা নিয়ে আমরা শুরু করেছি। বুৎপত্তিগত অর্থের ওপর জোর দেওয়ার অর্থ এটাই সাহিত্যের এক্মাত্র ব্যাখ্যা তা না। প্রাচীনকালে সাহিত্যের ভিন্ন ধারণা জারি ছিল সেই দিকে নজর ফেরানো। এ নিয়ে আরও গবেষনা হতে পারে। সবার সঙ্গে যুক্ত ও বিরাজ করবার বাসনার চর্চা যে কোন চিহ্নব্যবস্থা, মাধ্যম, উপায় বা টেকনলজির মধ্য দিয়ে যে কেউই চর্চা করতে পারেন। করেনও বটে। আমরা তাই সকলের, সকল মাধ্যমের ‘সহিত’ সাহিত্য করতে চাই।
আমরা কৃতজ্ঞ সিনেমার ভাষাও সাহিত্য চর্চার একটা ধরণ, এটা রিদয়পুরে যাবার আগে নূরুল আলম আতিককে বোঝাতে আমাদের একদমই বেগ পেতে হয় নি। রিদয়পুরে কেউই প্রশ্ন তোলে নি, সাহিত্যের আড্ডায় আবার সিনেমার লোক কেন? তাঁদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু সিনেমার নিজের একটা ভাষা আছে, সেটা মুদ্রণ যন্ত্রের ভাষা কিম্বা গুটেন বার্গ টেকনলজি নয়। পার্থক্য এখান থেকে শুরু হয়। কিভাবে সে ভাষা নিয়ে আমরা কথা বলব বা আলোচনা করব সেই দিক তাহলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নূরুল আলম আতিক তাই রিদয়পুরে সিনেমার ভাষা নিয়ে কথা বলেছেন। ‘সাহিত্য’ কথাটাকে একটি বিশেষ ভাষা, মাধ্যম বা প্রযুক্তি থেকে বিযুক্ত করে বিভিন্ন মাধ্যমে যাঁরা কাজ করছেন সকলকে নিয়েই সাহিত্যচর্চা কেন জরুরী তার একটা ছোটখাট রিহার্সাল হয়ে গিয়েছিল রিদয়পুরে। সাহিত্যের ধারণাটিকে পরিচ্ছন্ন করা ছাড়াও আরও নানান দিক থেকে বাড়তি লাভ তো ছিলই।
এটা পরিষ্কার যে সাহিত্য বলতে সকলে যা বোঝে সেই গড়পড়তা গড়ে হরিবোল জায়গা থেকে আমরা সাহিত্য বুঝতে চাইনি । এটা না বোঝার কিছু নগদ লাভ আছে। অন্যান্য ভাষা, চিহ্নব্যবস্থা বা মাধ্যমে যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈয়ারির তীব্র আকুতি জন্মেছে আমাদের মধ্যে। আমাদের অনুমান এই সম্পর্ক বাড়াতে পারলে সব মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার প্রণোদনা বাড়বে, নতুন কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করা যাবে, নানান মাধ্যমে নতুন কিছু তৈরি হবে। এটা হবে কিনা হলফ করে বলবার কোন উপায় নাই। কিন্তু কাজটা আমাদের জরুরী মনে হয়েছে। এই আকুতি থেকেই আমরা নতুন সিনেমার সম্ভাবনার কথাও ভাবতে পারছি। এটা শুধু সিনেমার আকুতি নয়, সাহিত্যের আকুতি।
তখন এটাও মনে হয়েছে প্রতিপক্ষ যে ধারণা নিয়ে সাহিত্য সম্মেলন করতে চায় সেটা সকলকে বোঝানো দরকার। সেটা এক লাফে হবে না। এ একটা কাজ বটে। আমরা অক্ষর বা মুদ্রণ যন্ত্রের মধ্যে তৈয়ার হওয়া সাহিত্যকে সাহিত্য মানি, কিন্তু সেটাই শুধু সাহিত্য নয়, রিদয়পুরের সাহিত্য আড্ডায় সেটাই আমরা বোঝাতে চেয়েছি। ফলে সেখানে বাখতিনের উপন্যাস তত্ত্বের পাশাপাশি সিনেমার ভাষা নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কে অন্যদের প্রথাগত ধারণা ও মতকে উপেক্ষা করাও আমরা ঠিক মনে করি নি। কারণ আমরা যা ভাবছি সেটা তো সবাইকে যথেষ্ট বলি নি। বলবার সুযোগ ও সময় দুটোই দরকার। কোন বড় বা জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন করবার আগে সাহিত্যের ধারণা নিয়ে যথেষ্ট লেখালিখি, কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা জরুরী মনে করেছি
তিন
আশির শেষ ও নব্বইয়ের শুরুতে প্রতিপক্ষ যখন বেরুচ্ছিল, এবং আমরা বৃহস্পতিবারের আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছিলাম ‘সহিত থেকে সাহিত্য’ কথাটা তখনও বলতাম, কিন্তু তাকে প্রাচীন ধারণা গণ্য করেই কথা হোত, সে অনুমানে সংশয় ও সন্দেহ ছিল না, তা নয়; কিন্তু তাকে বিচারের অধীনে আনা হয় নি। ‘সাহিত্য’ কথাটা লিটারেচার-এর চেয়ে ভালো লাগত। বাংলা বলে নয়, টের পেতাম এর কিছু তাৎপর্য আছে যাকে লিটারেচারের অনুবাদ হিসাবে গ্রহণ করলে হারিয়ে যায়। হারানোর হাহাকার তখন অতো তীব্র বোধ করতাম না, কারণ তাকে বোঝার জন্য যথেষ্ট ভাবাভাবি করতে পারিনি আমরা। এটাও তখন বুঝিনি যে এই ধারণা টেকনলজি বা কৃৎকৌশলের ধারণার সঙ্গে যুক্ত, যাকে সাধারণত আমরা বাংলায় ‘মাধ্যম’ বলে থাকি। ‘প্রতিপক্ষ’ নিজেকে লিটারারি ম্যাগাজিন বা পত্রিকা হিসাবে হাজির করেছিল ফলে ‘সাহিত্য’ কথাটার দ্যোতনা বা তাৎপর্য বিচার তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হয় নি। ‘সহিত থেকে সাহিত্য’ কথাটা প্রাচীন ধারণা হিসাবে বহাল থেকে গিয়েছিল। লিটারেচার কথাটারই অনুবাদ হিসাবে এর আধিপত্য রয়ে গেল। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ যখন নিজেকে কেবলই মুদ্রিত অক্ষরের পত্রিকা ভাবত তখন সাহিত্য বলতে আমরা লিটারেচারই বুঝেছি। ইংরেজির অনুবাদে।
লিটারেচারের ধারণা দানা বেঁধেছে আধুনিকতার মধ্যে। কিন্তু যে আধুনিকতা আমরা কলোনির দুর্দশা ভোগ করা দেশে চর্চা করি সেটা পাশ্চাত্য এনলাইটমেন্ট নয়, বরং ঔপনিবেশিক সম্পর্কের অধীনতা মেনে ‘আধুনিকতা’ নামক একটা ফিনিশড প্রডাক্ট কনজিউওমার হিসাবে ভোগ। আমরা কোকাকোলা খাই, কিন্তু কোকাকোলা কোথায়, কিভাবে কেমন করে উৎপাদন করা হয় সে সম্পর্কে আমাদের কোন হুঁশজ্ঞান নাই। আমরা শুধু খাই বা পান করি। আর পাশ্চাত্য তা বেচাবিক্রি করে। সংক্ষপে কোকাকোলার উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চাইছি। ঠিক তেমনি পাশ্চাত্য লিটারেচার করে আমরা তাকে অনুবাদ করে সাহিত্য করি। কিন্তু আমাদের ভাষায়, উপলব্ধিতে কিম্বা সাহিত্যের ইতিহাসে ধারণাটির যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য আছে আমরা তা খোঁজ করে দেখি নি। তাকে পরখ বা পর্যালোচনা করা তো দূরের কথা। সেটা খোঁজ অরে দেখাও তাহলে কর্তব্য হয়ে উঠেছে। লিটারেচারের ধারণাকে নির্বিচারে গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেটারই অনুবাদ হিসেবে সাহিত্য কথাটা আমরা চালিয়ে দিয়েছি। সহিত থেকে সাহিত্য কথাটার মর্ম বোঝার চেষ্টা করি নি। লিটারেচার অর্থেই আমরা সাহিত্য কথাটা এখনও ব্যবহার করি। প্রতিপক্ষ যখন শুধুই সাহিত্য ম্যাগাজিন ছিল তখনও ইংরেজি লিটারেচার কথাটার অনুবাদ আমরা ‘সাহিত্য’ করব কিনা তর্ক উঠেছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষের বৃহস্পতিবারের আড্ডা বন্ধ হয়ে যাবার ফলে তর্কটা আগায় নি; পত্রিকাটিও নানা কারণে বের করতে পারি নি।
লিটারেচার একটি আধুনিক ধারণা, ফলে এর বিচারও অনেকাংশে আধুনিকতা-বিচারের অন্তর্গত। কিন্তু সেই দিকে এখন এখানে যাচ্ছি না। এটা তো বোঝাই যায় ‘লিটারেচার’ কোন হাওয়াই ধারণা না। তার দেশকালপাত্র আছে। আধু্নিকতার মধ্যেই তার আবির্ভাব ও বিকাশ। আধুনিকতার একটা ভাবগত দিক আছে, কিন্তু সেই ব্যাখ্যা নিয়ে এখানে কালক্ষেপ করবো না, বরং জোর দেব টেকনলজি বা কৃৎকৌশলের ওপর। যাকে আমরা সাধারণত ‘মাধ্যম’ বলে এড়িয়ে যাই, কিম্বা অপরিচ্ছন্ন করে ফেলি। যেমন, শিল্পমাধ্যম। অনুমান হচ্ছে মাধ্যম একান্তই একটি উপায় – শিল্পের চর্চা, মর্ম নির্ণয়ে বা অর্থোৎপাদনে এর কোন ভূমিকা নাই। মার্শাল মাকলুহানের “দ্য মিডিয়াম ইজ দ্য মাসাজ” – বা মাধ্যমই মর্ম নির্ণয় করে, কথাটা বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে শোনা গিয়েছিল, কিন্তু এর প্রতি খুব একটা মনোযোগ কারো দেখি নি। কিন্তু মাকলুহানও এখন আমার আলোচনার বিষয় নয়।
বলা হয় ট্রাজেডি ও মহাকাব্যের যুগ লিটারেচা্রের যুগ নয় – বিশেষত উপন্যাসের যুগ তো নয়ই। উপন্যাস তখনই সম্ভব যখন ভাষা বলতে আমরা যেভাবে মুখের ভাষা বুঝি সেভাবে আর স্মৃতি, শ্রুতি ও কন্ঠের আদানপ্রদান ও এই তিনের সীমার মধ্যে আবদ্ধ নাই। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, উপন্যাস মানুষ শোনে না, পড়ে। আর পড়া মানে কান বা কণ্ঠ না, চোখের ভূমিকা প্রধান হয়ে ওঠা। যদি এতোটুকু বুঝতে পারি তাহলে কৃৎকৌশল কিভাবে সাহিত্য চর্চার মধ্যেও বিপ্লব ঘটিয়েছে ( নাকি অন্য কিছু) তার খানিক হদিস আমরা করতে পারব। যদি তাই হয় তাহলে সাহিত্যের বিচার সাহিত্যের নিজের ক্ষেত্র ছাড়া একই সঙ্গে কৃৎকৌশল ও নৃতাত্ত্বিক বিচারেরও অন্তর্গত।
বিস্তৃত অর্থে লিটারেচার হচ্ছে যে কোন লিখিত কাজ। যদি ব্যুৎপত্তি বিচার করি ,তাহলে সেটা এসেছে ল্যাটিন থেকে (literature/litteratura – ইত্যাদি)। এর অর্থ যাকে অক্ষর দিয়ে তৈয়ার করা হয়। গীত বা মৌখিক সাহিত্যকে মাঝে মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, কিন্তু সেটাও তার মুদ্রিত রূপকে। তার মৌখিক রূপ সাহিত্য বিচারের বাইরে রয়ে গিয়েছে।
লিটারারি ব্যাপার বা বিষয় বলতে কী বুঝব তা নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে; যেমন, কোন একটি মুদ্রিত লেখার সাহিত্যিক মূল্য কি? লিটারেচারের যেটা লিটারারি ব্যাপার বা তার ‘সাহিত্য মূল্য’ সেই মূল্যের বিচার করার সময় ধরা পড়ে লিটারেচার একান্তই মুদ্রণ যন্ত্র ও মুদ্রিত অক্ষরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ লিটারেচার নিয়ে কোন কিছু বিচারের আগেই মুখস্থ সাহিত্য, বা মুখে তৈয়ারি সাহিত্য আগেভাগেই বাদ দিয়ে রাখা হয়। যেমন কবিতার আলোচনায় আমরা লালন, জালাল উদ্দীন খাঁ, কুবীর গোঁসাইদের নিয়ে আলোচনা করি কি? করি না। তাদের আমরা পছন্দ করলেও সাহিত্যের প্রচলিত সংজ্ঞায় তাঁরা পড়ে না। কারণ তাঁরা তাদের কাজ মুদ্রিত অক্ষরে প্রকাশ করেন নি। গলা দিয়ে গেয়েছিলেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের মনে হয়েছে নতুন ভাবে যখন প্রতিপক্ষ আবার নিজেকে জাহির করতে চাইছে, তখন আমরা যেন ‘সাহিত্য’ কথাটিকে তার প্রাচীন অর্থেই বুঝি। লিটারেচার অর্থে না। এর প্রথম সুবিধা হচ্ছে পাশ্চাত্যের ইতিহাস , বিশেষত টেকনলজির ইতিহাসের সঙ্গে লিটারেচারের যে ধারণা গড়ে উঠেছে সেই ধারণা থেকে নিজেদের বিযুক্ত করা। লিটারেচার যদি শুধু মুদ্রিত অক্ষরের কায়কারবার হয় তবে তাকে অনুবাদ হিসাবে ‘সাহিত্য’ কথাটা আমরা পরিত্যাগ করছি। এটা প্রথমেই সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। এরপর প্রশ্ন আসে, তো সাহিত্য মানে কি? সেই কারনেই আমরা বলেছি, ‘আপাতত’ আমরা সহিত থেকে সাহিত্য – এই প্রাচীন ধারণাটি মাথায় রেখেই শুরু করি। শুরু করবার জন্য এই অনুমানটুকুই যথেষ্ট। সাহিত্যের মানে খুঁজতে খোঁজা মানে নতুন অর্থোৎপাদনের অন্বেষণ। সেটা না হয় অন্বেষণ হয়েই থাকুক। এখন এটাই আমরা মানি যে লেখালিখি, সিনেমা, যাত্রা, নাটক, ছবি আঁকা, ফটো তোলা সবই সাহিত্য চর্চার প্রকার ভেদ, কিন্তু তাদের ভেদবিচার তাদের মাধ্যম বা তাদের নিজ নিজ ভাষার বিচার ছাড়া সম্ভব না। সাহিত্য যদি কোন বিশেষ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত না থাকে তাহলে সবই তাদের নিজ নিজ মাধ্যমের জায়গা থেকে সবার সঙ্গে যুক্ত হবার বা বিরাজ করবার বাসনা চর্চা করে। এই বাসনা আছে বলেই মানুষ কথা বলে, গান গায়, ছবি আঁকে, ছবি তোলে, নাটক করে, ইত্যাদি। ওর মধ্য দিয়ে সমাজ নামক যে-পদার্থটা দানা বাঁধে তা একই সঙ্গে এক ও অনেক। এই এক ও অনেককে বিমূর্ত ভাবে ভাবলে চলছে না। তাকে সুনির্দিষ্ট মাধ্যম বা ভাষার মধ্য দিয়ে বোঝা দরকার।
টেকনলজির প্রশ্ন যখন শ্রুতি সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভাবি তখন আমরা বুঝতে পারি যাকে ইচ্ছা বা বাসনা বলছি তাকে চরিতার্থ করবার উপায় বা হাতিয়ার হিসাবে শরীরকেও আমরা ভাবছি বা ভাবতে পারি। সেই অর্থে কন্ঠ কথা বলবার আর শ্রুতি শব্দ শুনবার হাতিয়ার। সম্ভবত জাঁ জাক রুশোই বোধহয় প্রথম বলেছিলেন কণ্ঠ দিয়ে মানুষ কথা বলবে সেটা তো সৃষ্টির আদি বাসনা ছিল না। সবার সঙ্গে বিরাজ করবার বাসনার দরকারে শরীরের যা করার কথা নয়, সেই কাজে তাকে খাটানো। তখন কথাবলার কর্তা আর যে হাতিয়ার দিয়ে কথা বলা হয় – কন্ঠ বা শরীর – এক নয়। সাহিত্য তাহলে আমাদের শরীরের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নতুন করে বিচার করবার দিকেও ইঙ্গিত করে। হাতিয়ারের বদল শরীরেরও। তাহলে সকলের সঙ্গে বিরাজ করবার বাসনার কথা যখন বলি তখন কোন না কোন উপায়, হাতিয়ার বা টেকনলজির কথা ভাবতে আমরা বাধ্য। শরীরও তার ব্যাতিক্রন নয়। গান যেমন, তেমনি নৃত্যের ক্ষেত্রেও।
সাহিত্যের অনুশীলন বলাবাহুল্য লিটারেচার চর্চা না। সাহিত্যের চর্চা। সকলের সঙ্গে‘সহিত’ হবার, সম্পর্কিত থাকবার বাসনা বা ইচ্ছা ব্যাপারটা বিভিন্ন মাধ্যম তার নিজ নিজ ভাষায় চর্চা করে। আমাদের খুবই সরল ও সিধা দাবি হচ্ছে, সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়েই ‘ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই উৎপাদন হয় বলে প্রচার আছে’। যদি তাই হয় তাহলে বিভিন্ন মাধ্যমের সাহিত্য চর্চা কী ধরনের ব্যাক্তি ও সমাজ উৎপাদন করছে সেই মোক্ষম বিষয়ের দিকে আমরা কার্যকর ভাবে মুখ ফেরাতে পারি।
অনেকে বলতে পারেন, সাহিত্য সবসময় নিজ নিজ ভাষার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ উৎপাদন করে; ঠিক, কিন্তু কী ধরণের ব্যক্তি বা সমাজ তৈয়ার করে তার বিচার তো দরকার। এমন সমাজ সাহিত্য তৈয়ার করতে পারে যা নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য না। ঠিক। সবই হতে পারে। কিন্তু নীতি, আদর্শ, কে কী ধরণের ব্যাক্তিত্ব চাই বা কি ধরণের সমাজকে আদর্শ মনে করি সেটা ভিন্ন তর্ক। এই ক্ষেত্রে বইপুস্তকের তৈয়ারি নিয়ে যে বিচার, সিনেমা-টেলিভিশানের বিচারও আলাদা কিছু না। কিম্বা চিত্রকলা বা যাত্রার। আমরা আপাতত শুধু এতোটুকুই চাইছি যে বইপুস্তকের সাহিত্যই সাহিত্য – আর সিনেমা বানানো ভিন্ন একটা ব্যাপার — এই অনুমানের অবসান ঘটুক। সাহিত্যের আলোচনাকে বিশেষ একটি মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত করে বিচারের অভ্যাস যতো তাড়াতাড়ি আমরা ত্যাগ করব, গুটেনবার্গের টেকনলজির বাইরে অন্যান্য মাধ্যমের শক্তি ও সীমা সম্পর্কে আমাদের ধারণাও আরও পরিচ্ছন্ন হবে। সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে টেকনলজির প্রশ্ন মুখ্য করে আনার মধ্য দিয়ে স্মৃতি, শ্রুতি ও কন্ঠের মধ্যে রচিত সাহিত্যের মর্যাদাকেও আমরা নতুন করে বিচার করতে শিখব।
শেষে একটি সতর্ক বাণী। বিশেষ একটি মাধ্যমের সঙ্গে সাহিত্যের বিযুক্তি চাওয়ার অর্থ মোটেও সাহিত্যের সঙ্গে তার ভাষার বিযুক্তি দাবি করা নয়। সাহিত্য মাত্রই তার ভাষার, মাধ্যম বা চিহ্ন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। সাহিত্যকে বিশেষ মাধ্যম – বিশেষত মুদ্রণ যন্ত্র থেকে বিযুক্ত করলে আমরা সাহিত্য নিয়ে আরও দরকারী বিচারে প্রবেশ করতে পারব।
যেমন, বিভিন্ন মাধ্যমের নিজ নিজ ভাষার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক। যেমন, রিদয়পুরে সিনেমার ভাষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সিনেমার ভাষা কি? সিনেমার ভাষা বোঝার জন্য আমাদের আগ্রহ আছে কি? আমরা সিনেমা দেখতে গিয়ে কি সিনেমা দেখি? নাকি গল্প খুঁজি। সিনেমাতে গিয়ে আমরা গল্প দেখি, বা উপন্যাস পাঠ করি। কাহিনী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু সিনেমা দেখি না। দেখি কি?
এই ধরণের প্রশ্ন তোলার দিকেই আমাদের বিশেষ আগ্রহ। এটা সাহিত্যিক আগ্রহ। নিছক সিনেমা প্রীতি নয়। তাই সিনেমা যারা বানাচ্ছেন তাদের কাছে আমরা যাচ্ছি। ক্রমে ক্রমে অন্যদের কাছেও যেতে হবে। সাহিত্যের দরকারেই সিনেমার ভাষা নিয়ে আমাদের অনেক অনেক ভাবা দরকার।