রোম শহর যেমন একদিনে গড়ে ওঠেনি, ঠিক তেমনি ঢাকা শহরও একদিনে গড়ে ওঠেনি। পৃথিবীর কোনো শহরই একদিনে গড়ে ওঠেনা।একটা শহর মানে, শুধুই একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড না সেখানে থাকে মানুষ, আর মানুষের সঙ্গে মিশে থাকে তাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সংঘাত, বিচ্ছেদ, মিলন আর জীবন সংগ্রামের এক অনন্ত জীবন প্রবাহ । একটা শহর মানে অনেক ধরণের স্থাপনা, রাস্ত-ঘাট, দালান-কোঠার স্মৃতি, তার গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠার স্মৃতি। একটা শহর মানে গোটা এক জনপদের ইতিহাস। সেসব ইতিহাস সাধারণত লিখিত আকারে থাকে। ইতিহাস থেকে জানতে পারি সেই শহরের রাস্তঘাট, দালান-কোঠা, যানবাহন, মানুষজনের পোষাক-পরিচ্ছদ, তাদের আচার-ব্যবহার, ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি। লিখিত আকারের এই জানা অনেকটাই কল্পনার চোখ দিয়ে আমাদের দেখে নিতে হয়। কারণ ইতিহাস মানেই অতীত দিনের স্মৃতি। কিন্তু এই একই ইতিহাস যখন চিত্রকর্ম, ফটোগ্রাফি বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পাই, তখন আর লেখা থেকে ছবি কল্পনা করতে হয় না, ছবকেই মনে হয় যেন বাস্তব দেখছি। সরাসরি সেই শহরকে দেখতে, বুঝতে এবং জানতে পারার একটা সুবিধা ঘটে।
শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় চলচ্চিত্র এই ক্ষেত্রে একটি বিশাল ভূমিকা রাখে। কেননা, চলচ্চিত্রে শুধু যে শহরের বাইরের রূপটাই ধরা পড়ে তা নয়, তার ভেতরের রূপ অর্থাৎ একটা বিশেষ সময়ে সেই শহরের জীবন সংগ্রাম, মানবিক মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা সহ জীবনের নানা দিক কাহিনীর মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়।
আমাদের চলচ্চিত্রে আমরা যদি পুরনো ঢাকা শহরকে দেখতে চাই, তাহলে আমাদের ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু করতে হবে। কেননা, ১৯৫৬ সালেই এখানে নির্মিত হয় প্রথম চলচ্চিত্র “ মুখ ও মুখোশ”। যদিও মুখ ও মুখোশ ছবিটি গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত, কিন্তু শুটিং পর্বটি হয়েছে এই ঢাকা শহরেই। খন্দকার মাহমুদুল হাসান তার ‘সেকালের ঢাকা শহর’ ( প্রকাশকাল ২০১২) বইটিতে জানান, ছবির শুটিং হয়েছিলো ঢাকার মায়াকানন, শান্তিনগর এলাকায়। ছবির অন্যতম অভিনেতা মো. সাইফুদ্দিনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, সেই সময় শান্তিনগর এলাকা ছিলো একেবারেই গ্রাম, মূল শহর ছিলো এখন আমরা যাকে পুরনো ঢাকা বলি সেই পুরনো ঢাকার বাহাদু্র শাহ পার্ক, নবাবপুর এলাকা। কাজেই ছবিতে গ্রামের যে দৃশ্যগুলো দেখা যায় তার সবটাই সেই সময়ের ঢাকা শহর ধরে নিতে পারি। অর্থাৎ আমাদের আদি ঢাকা শহরের অর্ধেকেরও অধিক অংশ জুড়ে ছিলো গ্রাম।
এখন দেখা যাক, মুখ ও মুখোশের পরে ষাটের দশকে কি ধরণের ছবি নির্মিত হতো। সেই সময়ে এখানে যেসব ছবি নির্মিত হতো, সেগুলি ছিলো মূলত সামাজিক এবং পারিবারিক কাহিনী ভিত্তিক ছবি। পৌরাণিক এবং রূপকথা ভিত্তিক ছবিও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সামাজিক এবং পারিবারিক ছবিগুলিতেই আমরা আমাদের ঢাকাকে বড় বেশি আপন করে পাই। আশির দশকের পর থেকে, আমাদের ছবিগুলি যখন ধীরে ধীরে নায়ক-নায়িকা নির্ভর ছবি হতে শুরু করে ঢাকা শহরও একই সঙ্গে একেবারে বিলুপ্ত না হলেও সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। আউডডোর নির্ভর পরবর্তী সময়ের এসব ছবি ঢাকা শহরের চাইতে প্রধানত প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং অন্য দেশের আউটডোরের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে। ফলে রঙিন চলচ্চিত্রের চাইতে সাদা-কালো ছবিতেই ঢাকা শহরকে আমরা বেশি করে পাই। সাদা-কালো যুগের ছবিগুলি নায়ক-নায়িকা প্রধানের চাইতে চরিত্রাভিনেতা-অভিনেত্রী প্রধান ছিলো। আর তাই আমরা ফাতেলোহানী, নারায়ন চক্রবর্তী, কাজি খালেক, খান আতাউর রহমান, সিরাজুল ইসলাম ,এনাম আহমেদ, সুভাষ দত্ত, বেবী জামান, আনোয়ার হোসেন,রানু, খান জয়নুল, আলতাফ, হাসমত, মো.সাইফুদ্দিন, ফরিদ আলী, আশিষ কুমার লোহ, আমজাদ হোসেন, খলিলুর রহমান খলিল, রানী সরকার, রোজি, রহিমা খালা, মিরানা জামান, সুমিতা দেবী, আনোয়ারা, নাসিমা খান সহ আরো অনেক শক্তিশালী অভিনয় শিল্পী ও চিত্র নির্মাতাদের দেখা পাই। আমাদের বক্তব্য পেশ করার আগে, তাই এসব শিল্পী, নির্মাতা ও সংশ্লিষ্ট অন্যন্য কলাকুশলীদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধাঞ্জলি। বাংলাদেশের সিনেমায় তাদের অবদানের জন্য। তাদের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এসব ছবি নির্মিত হয়েছে। আমাদের পুরনো ঢাকার স্মৃতি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আজ আমরা কিছুটা তাদের মাধ্যমেই পাচ্ছি।
[অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে ছব করতে হয়েছে যারা গোড়ার দিকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন করেন। কিছু ছবি এখনও উল্লেখযোগ্য কাহিনী, অভিনয় ও ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য। অনেকে সিনেমা জগতে নতুন এসেই তাঁদের অভিনয়ের গুনে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। ‘সুতরাং’ তেমনি একটি ছবি। নিজের ছবি সম্পর্কে সুভাষ দত্ত জানান: “”চিত্রালীর এসএম পারভেজ সাহেব আমাকে একদিন ডাকলেন। তিনি বললেন, আমি ‘মাটির পাহাড়’ নামে একটি ছবি করছি। এর টাইটেল এবং পোস্টারের কাজ আপনি করে দেবেন। পারভেজ সাহেবের সঙ্গে চিত্রালী পত্রিকার লোগোর কাজ করতে গিয়ে আমার আগেই পরিচয় ছিল। তিনি আমাকে তার ছবির চিত্রায়নে থাকারও অনুমতি দিলেন। সময়টা ১৯৫৭ সাল। এর দুই বছর আগে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায়। সে বছর ‘পথের পাঁচালী’ দেখলাম এবং যথারীতি আমার মাথা ঘুরে গেল। মাথায় তখন ছবি নির্মাণের পোকা ঘুরছে। এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতে প্রথম কমেডিয়ান হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ পাই। এভাবে ১৯৬০, ‘৬১ ও ‘৬২ প্রায় শেষ। তখন হঠাৎ মনে হলো, আমি তো অভিনয় করতে আসিনি! শচীন ভৌমিকের একটি গল্পের চিত্রনাট্য সৈয়দ শামসুল হককে দেখালাম। তিনি বললেন, সব ঠিক আছে। সত্য সাহার সঙ্গে কথা হলো। তিনিই চট্টগ্রামের কিশোরী মিনা পাল অর্থাৎ কবরীর কথা বললেন। কিউ এম জামানের চিত্রগ্রহণে ছবিও শেষ। ‘সুতরাং’ মুক্তি পেল ১৯৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল। ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে চারটি প্রিন্ট দিলাম। ছবি সুপারহিট। ‘সুতরাং’ দেখে সে সময় সত্যজিৎ রায় আমাকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। ফ্রাংকফুর্ট এশীয় চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিল এটি।” (দেখুন, সমকাল, ২৮ এপ্রিল ২০১২)
বাংলা সিনেমা গান ছাড়া কেউ ভাবতেই পারেনা। ভারত এবং পাকিস্তান ছাড়া শুধুমাত্র গানের কারণে বাংলা সিনেমা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সিনেমা থেকে আলাদা একটা বৈশিষ্ট্যের দাবী রাখে। এই গান নায়ক বা নায়িকা বা চরিত্রাভিনেতা যাকে দিয়েই গাওয়ানো হোক না কেনো, অনেক গান আছে যেখানে আমরা পুরনো ঢাকা এবং সেই সময়ের জীবনযাত্রার আঁচ পাই। যেমন, “ দুই দিগন্ত” ছবিতে বেকার আনোয়ার হোসেনে্র লিপ্সিং-এ আমরা দেখি রমনা পার্কে একটা গান গাইতে — “ চলো রিকশা চালাই, ভুলে বিদ্যার বালাই”। গানটি শুধু সেদিনের নির্জন রমনা পার্কই আমাদের দেখায় না, আমরা বুঝতে পারি সেদিন আনোয়ার হোসেনের মতো শত শত বেকার যুবকদের জন্যে রমনা পার্ক তাদের হতাশ জীবনের ক্ষণিকের আশ্রয়স্থল ছিলো। শান্তি না পেলেও স্বস্তি ছিলো। ছিনতাই এর মতো কোনো ঘটনা ঘটতো না সেদিনের পুরনো ঢাকায়। পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত “ এতটুকু আশা” ছবির গান “ তুমি কি দেখেছো কভু, জীবনের পরাজয় ” আমাদের সিনেমার গানের ইতিহাসে একটা মাস্টারপিস হয়ে আছে। অভিনেতা আলতাফের অভিব্যক্তিতে তা যেন আরো করুণ হয়ে ফুটে ওঠে। পুরনো ঢাকার সেই সময়ে জীবন-সংগ্রামের যুদ্ধে পরাজিত মানুষদের কাহিনী যেন মাত্র একটা গানের মধ্যে পেয়ে যাই। ১৯৭০ সালে নির্মিত, পরিচালক এহতেশাম পরিচালিত “ পীচ ঢালা পথ ” ছবির, “ পীচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি, তার সাথে এই মনটারে বেঁধে নিয়েছি” বাংলা সিনেমা জগতে এই একটা মাত্র গান যেন পুরনো ঢাকার এক সামগ্রিক চিত্র।
গানের চরিত্র জালিল একজন পকেটমারের ভূমিকায় থাকেন। সারা ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে সে পকেট মারে। গানের মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের সারা ঢাকা শহরকে আমরা দেখতে পাই। একসময়ের বহুল প্রচলিত শব্দ “রিকশার শহর” ঢাকাকে আক্ষরিক অর্থেই আমরা এখানে পেয়ে যাই। সদ্য নির্মিত কিছু উঁচুতলা ভবন, ফুটপাতের ছিন্নমূল মানুষ, রেসকোর্সের ময়দান, কমলাপুর স্টেশন, হাইকোর্ট, পীচ ঢালা মসৃণ ফাঁকা এবং আবর্জনাহীন রাজপথ, সুসজ্জিত দোকানপাট এক অপূর্ব চিত্রায়নের মধ্যে দিয়ে বিনি সূতার মালার মতো গেঁথে দেয়া হয়েছে। সেই সময়ে সিনেমার সংলাপের মতো গানের শব্দ অর্থাৎ আবহসঙ্গীতের চাইতে গানের সুর আর কথার ওপর জোর দেয়া হতো বেশি। ষাটের দশকে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সারা বিশ্বের মতো এখানেও ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিলো। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যেসব বিচ্ছিন্নতাবোধ, অর্থনৈতিক শোষণ ইত্যাদি গড়ে উঠতে দেখা যায়, গানের দুটো কলিতে অসাধারণ ভাবে উঠে আসে, যেমন, “ সারি সারি জনতার এই যে ভিড়ে, কেউ তো কারো পানে চায়না ফিরে অথবা “ ছোট ছোট মানুষের অন্ন কেড়ে, বড় বড় বাড়িগুলো উঠছে বেড়ে”। জহির রায়হানের “ জীবন থেকে নেয়া ” ছবির গানে ঢাকা শহরকে পাওয়া যায়। এভাবে সেদিনের আরো অনেক সিনেমার গানের মাঝে এভাবেই পুরনো ঢাকাকে ফুটে উঠতে দেখা যায়।
গল্প শোনা এবং বলা মানুষের সব থেকে আদিম সাহিত্য চর্চা। আর আমাদের দেশে গল্প ছাড়া কোনো সিনেমার কথা কেউ ভাবতে পারেনা। এই গল্প চিত্রভাষার মধ্য দিয়ে সেদিনের সিনেমাগুলো পুরনো ঢাকার জীবনযাপন, মূল্যবোধ, সমাজব্যবস্থাসহ জীবনের নানা দিক তুলে এনেছিলো। ১৯৬৩ সালে, পরিচালক সালাউদ্দিন নির্মিত “ ধারাপাত ” ছবিতে এক অদৃশ্য, কাল্পনিক এবং স্বপ্নময় ঢাকাকে পাই। ছবির কোথাও ঢাকা শহরকে দেখা যায়না। কিন্তু ছবির চরিত্রদের মধ্যে ঘিরে থাকে ঢাকা শহর। প্রথম দৃশ্যেই আমরা দেখি গ্রামের একটা বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন চলে যায়। একজন মা দাঁড়িয়ে থাকে সেই বাড়ির দরজায়। একটু পরে তার মেয়ে (নাসিমা খান ) কাছে আসলে, মা বলে ওঠেন, তার খোকা সেই যে ঢাকা শহরে গেছে আজও বাড়ি ফিরে এলোনা। ছবির গল্প যত এগিয়ে যায়, আমরা দেখি, ঢাকায় কাজের খোঁজে চলে যাওয়া সেই খোকা যেন ঢাকার প্রতীক হয়ে পরিবারের সবার মধ্যে বিরচরণ করে। ঢাকা মানেই টাকা, ঢাকা মানে দুরাশার আশা, ঢাকা মানে গরীব স্কুল মাস্টার বৃদ্ধ বাবার অবলম্বন, ঢাকা মানে বকেয়া বাড়িভাড়ার পরিশোধ, ঢাকা মানে বিবাহযোগ্যা বোনের বিয়ে হওয়া ইত্যাদি। সারা ছবিতে আমরা ঢাকার এই স্বপ্ন বা স্বপ্নাতীত স্বপ্ন বুনে যেতে দেখি।
ঢাকার আরেক চরিত্র আমরা পাই, ১৯৬৪ সালে ওবায়েদ উল হক পরিচালিত “ দুই দিগন্ত” ছবিতে। এই ঢাকা কোনো স্বপ্নময় ঢাকা না। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সমাজের ঢাকা। কঠিন, কংক্রিট পাথরে গড়া এবং দুটো শ্রেণী বা সমাজের প্রান্তে অবস্থানরত মানুষের ঢাকা শহর। যেখানে এক প্রান্তে থাকে প্রাকৃতিক মানুষ, বিশেষ করে গ্রাম থেকে উঠে আসা — যারা জীবনে প্রতিষ্ঠা অর্জন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জীবিকার তাগিদে ঢাকা শহরে আসেন এবং কঠিন জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত হন। অন্য প্রান্তে থাকে ভোগ-বিলাসে পূর্ণ ধনিক শ্রেণী, সৎ মানুষের চাইতে যারা বংশ-মর্যাদা দিয়ে মানুষকে সভ্য-অসভ্য ভাগে ভাগ করেন। ছবির নায়িকা তামান্নার ( সুমিতা দেবী ) বাবাকে তাই বলতে শোনা যায়, খানদানের পরিচয়ই ব্যক্তির পরিচয়। খানদানের ফিল্টারে রক্ত পরিশোধিত হয়। অন্যদিকে সমাজের আরেক প্রান্তের মানুষ, ছবির নায়ক — গ্রাম থেকে উঠে এলেও, বংশমর্যাদা নয়, সততা আর কাজের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তাই ফুটপাতে রাত কাটিয়েও তিনি হাসতে জানেন। এই রাত কাটানোকে জীবনের অভিজ্ঞতা বলে সম্মান বোধ করেন। ছবির শেষে অবশ্য সততারই জয় হয়। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত “ সুতরাং ” ছবিতে দুই দিগন্তের মতোই সংগ্রামী এক ঢাকা শহরকে পাই, তবে ভিন্ন এক প্রেখ্যাপটে। ছবির নায়ক খান ( সুভাষ দত্ত ) তার প্রেমিকাকে (কবরী ) বিয়ে করার জন্যে, টাকা উপার্জনের আশায় গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে আসে। সকাল থেকে পত্রিকার হকারের কাজ থেকে শুরু করে, শিশুদের স্কুলে আনা-নেয়া এবং রাতে নাইট গার্ডের কাজ সহ তিনটা কাজে নিয়োজিত থেকে সে অর্থ উপার্জন ও সঞ্চয়ের কঠিন সংগ্রাম চালায়। জীবন কঠিন হলেও, সহজ-সরল এক ঢাকা শহরকে পাই। যেখানে ছবির নায়ক তিনবেলা পরিশ্রম করেও হাসতে জানে, শহরের ডাক্তার ( সিরাজুল ইসলাম) গভীর রাতে রোগীর বাড়িতে ছুটে যান, লেখক শওকত আকবর নায়কের জীবন কাহিনী ভালোবাসা আর ধৈর্য নিয়ে শোনেন, নায়কের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চান ইত্যাদি। এক কথায় সেদিনের ঢাকা শহর কঠিন বা¯তবের মাঝে এক মানবিক ঢাকা।
পুরনো ঢাকার সব থেকে ব্যতিক্রমি এবং আদি রূপ ফুটে উঠে ১৯৬৬ সালে নির্মিত অভিনেতা খান জয়নুলের কাহিনী ও সংলাপ এবং পরিচালক বশীর হোসেনের সম্পাদনা ও পরিচালিত ছবি “ ১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন ”। ছবির শিরোনামটাই যদি শুধু আমরা লক্ষ্য করি, দুটো শব্দ বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে — ১. ওস্তাগার এবং ২. লেন। একটা শহর শুধু নিছকই শহর হয়ে থাকেনা, সেখানে চলে ভাষা, শব্দ ইত্যাদি প্রয়োগের পরিবর্তন, পরিবর্ধন আর বিবর্তন। ওস্তাগার শব্দটি এখন আমরা আর ব্যবহার করিনা, পবিবর্তে কারিগর বা মিস্ত্রি প্রয়োগ করি। লেন শব্দটি, বর্তমান পুরনো ঢাকার কোনো কোনো এলাকায় থেকে গেলেও, বর্ধিত বা নতুন ঢাকায় তা একেবারেই নেই। ভাষার প্রসঙ্গ যখন এলো তখন আমরা আরেকটা ছবির কথা উল্লেখ করতে পারি। অভিনেতা আশিষ কুমার লোহ পরিচালিত “ স্বরলিপি ” ছবি। এই ছবিতে আমরা একদিকে যেমন, বাংলা, উর্দু, বাংলা উচ্চারণে উর্দু অথবা উর্দু উচ্চারণে বাংলা সংলাপ পাই তেমনি পাই খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষা। এই ঢাকা শহর যেন উর্দু এবং বাংলা মিশেলের এক ঢাকা, যা বাংলা সিনেমার খুব বিরল।
১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগর লেনে আদি ঢাকা শহর অর্থাৎ এখন আমরা যাকে ‘পুরনো ঢাকা’ বলি শুধু তারই প্রতিরূপ পাই না, একই সঙ্গে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো পুরনো ঢাকাকে কেন্দ্র করে একমাত্র ছবি হিসেবেও সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাছাড়া ছবিটি এই দেশের একমাত্র কমেডি ছবি। যার আগে এবং পরে আর কোনো কমেডি ছবি নির্মিত হয়নি। ছবির বিশ্লেষণে যাবার আগে এর আঙ্গিক এবং চিত্রনাট্য ও সংলাপ নিয়ে একটু কথা বলা যেতে পারে। ছবির পুরো শুটিং ইনডোর ভিত্তিতে নির্মিত হলেও, ইনডোরের কারণে সেদিনের পুরনো ঢাকার মধ্যবিত্তদের বাড়ির অবয়ব পাওয়া যায়। একতলা বাড়ি, বাড়ির সামনে ছোট খোলা পরিসর, লম্বা শিকের জানালা, দালানের মাঝে মোটা খাম, খোলা ছাদ ইত্যাদি সেদিনের চিরপরিচিত গতানুগতিক বাড়ি। চিত্রনাট্য এবং সংলাপ এতো যত্নের সঙ্গে লেখা হয়েছে, আজও দর্শক যখন দেখে তখন প্রতিটা সংলাপ তাদের কানে বেজে উঠে। কমেডি হলেও, কোথাও কোনো এতটুকু ভাঁড়ামি নেই। চরিত্ররা গম্ভীর অথবা রেগে সংলাপ বলে, দর্শক হেসে ওঠে। এই ছবিতে আমরা পাই এক কলহপ্রিয় ঢাকাকে। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া দুই পরিবারের মধ্যে কলহ। বাড়িওয়ালা ( সিরাজুল ইসলাম সিরাজ ) তার শালাকে ( বেবি জামান ) বাড়িতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে বলেন, “ এখানে খাবে, দাবে আর ওদের সাথে (অর্থাৎ ভাড়াটিয়া) ঝগড়া করবে।” অর্থাৎ ঝগড়া করা ছাড়া সেই শালার আর কোনো কাজ নেই। শুধু তা-ই না, ছবির শুরুতেই আমরা দেখি, ভাড়াটিয়ার কাজের ছেলে ( খান জয়নুল ) মাটির কলসিতে পানি নিয়ে বাড়িওয়ালার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে থাকলে, বাড়িওয়ালি ( সুমিতা দেবী ) তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে বলেন, “এ্যাই তুই আমাকে ভেঙচি কাটলি কেনো ?” অর্থাৎ এই শহরের মানুষজন শুধু ঝগড়াই করেনা, একই সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করার অভ্যাসও রাখে। তবু এই ঝগড়ার মাঝেও ভালোবাসার মতো মানবিক সম্পর্কের ঘটনাও ঘটে। যে শালাকে বাড়িওয়ালা ডেকে নিয়ে আসে তার ভাড়াটিয়ার শালীর ( সুজাতা) সাথে ঝগড়া করার জন্য, ঘটক্রমে সেই শালীর সাথে ঝগড়া দূরে থাক, প্রেমময় সম্পর্ক হয়ে যায়। ঝগড়ার সূত্রপাত আরো চিত্তাকর্ষক। ভাড়াটিয়া বাড়ির ভাড়া দিতে চায়না। ভাড়া না দেয়ার বিষয়টিকেই কেন্দ্র করে চলে সারা ছবি জুড়ে বিবাদ। কিন্তু এই ভাড়া না দেয়ার পেছনে, ভাড়াটিয়া পরিবারের যু্ক্তি বাড়িওয়ালা আর তার বউয়ের মাঝের কলহ। যেহেতু বাড়িওয়ালা তার বউয়ের সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া করে তাই ভাড়াটিয়া ভাড়া দিতে অস্বীকার করে। ছবিতে আদি ঢাকার বাইরের রূপটিও চোখে পড়ে। শহরের দালানগুলো তখনও তালগাছ, নারিকেল গাছগুলোকে ছাড়িয়ে উপরে ওঠেনি। চরিত্রদের পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে বাড়ি-বারান্দার গঠনপ্রণালী, ঘরের আসবাবপত্র সব জায়গায় ঢাকার আদি-অকৃত্রিম ছাপ রেখে যায়।
১৩ নম্বরের ঠিক বিপরীতে ঢাকার আরেক রূপ দেখি ১৯৬৮ সালে নির্মিত নারায়ন ঘোষ মিতা পরিচালিত ছবি “ এতটুকু আশা”। গ্রাম এবং শহুরে সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতাবাদের এক গল্প “ এতটুকু আশা”। গ্রাম থেকে উঠে আসা কৃষকের ( কাজী খালেক ) ছেলে ( আনোয়ার হোসেন ) নিজ চেষ্টা ও শ্রমে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত শহরের ধনী পরিবারের মেয়ের ( রোজী ) সঙ্গে বিয়ে হয় এই ছেলের। যে কারণে মেযের বাবা (ফাতে লোহানী) এক সময় বলতে বাধ্য হন, “ কালচার মানে উচ্ছৃঙ্খলতা না”। অর্থাৎ শহরে বেড়ে উঠলেই সবাই সঠিক সংস্কৃতি নিয়ে বড় নাও হতে পারে। শুধু তা-ই না, এসব শহুরে উচ্ছৃঙ্খলতা, বাবা-মা, আপন ভাইবোনকে কীভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সেটাও ছবিতে আমরা পাই। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ১৯৬৮ সালে নির্মিত “ আবির্ভাব ” ছবির ঢাকা এবং তার আশেপাশের এলাকা, আমাদের পাশ্চাত্যের অন্যান্য শহরের কথা মনে করিয়ে দেয়। ছবির শুরুতে নতুন বিবাহিত দম্পতি ( শর্মিলা-আজিম ) ঢাকা থেকে কিছু দূরে বেড়াতে বের হলে, আমাদের মনে পড়ে যায় বার্গম্যানের “ ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭)” ছবির কথা। যেখানে ইসাক বোর্গ লুন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার ডক্টরেট ডিগ্রি নেয়ার জন্যে স্টকহোম থেকে লুন্দ শহরে যাত্রা করেন। অথবা উইলিয়াম ওয়াইলারের বিখ্যাত সেই “ রোমান হলিডে ( ১৯৫৩)” ও পুরনো রোমের কথা মনে পড়ে। ছবির নায়িকা আন রূপী অড্রে হ্যাপবার্নকে যখন দেখি রোমের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে তখন, পুরনো স্টকহোম, রোম বা ঢাকা শহরের মাঝে কোনো পার্থক্য করা যায়না। যে ঢাকাকে একসময় “ তিলোত্তমা ঢাকা ” নামে অভিহিত করা হতো সেই তিলোত্তমাকেই আমরা খুঁজে পাই আমাদের পুরনো চলচ্চিত্রগুলোতে।
সাদা-কালোয় নির্মিত এসব ছবিতে আধুনিক ঢাকা শহরের রঙিন জৌলুস ছিলোনা, ছিলো বাস্তবতার পাশাপাশি আবেগ, অনুভূতি আর সহানুভূতিতে ভরা। জীবনের কৃত্রিমতা না, প্রাকৃতিকতা। ঢাকা শহরের মিথ্যা কাল্পনিক বর্ণনা না, সত্যের কাছাকাছি বয়ান। সিনেমার চরিত্রদের মতোই ছিলো বাস্তব চরিত্ররা। সহজ, সরল আর স্বল্প চাহিদায় ছিলেন তারা তুষ্ট। ছবির নারী চরিত্রদের পর্দায় যেমন সাদাসিধা সাজে দেখা যেতো বাস্তবেও অনেকটাই সেরকম ছিলেন। বাস্তবের পুরুষেরা অনেকটা ছবির পুরুষ চরিত্র – যেমন, “সুতরাং” এর সুভাষ দত্ত বা “দুই দিগন্ত’-এর আনোয়ার হোসেনের মতোই ছিলেন। সততা,আদর্শ আর মানবিকতা তখনও বর্তমানের মতো কলুষিত হবার স্পর্ধা পায় নাই, যেমন স্পর্ধা পায় নাই কলুষিত হতে পুরনো ঢাকার আবহাওয়াও। আর তাই নষ্টালজিয়ার মতো ফটোগ্রাফি, চিত্রকর্ম, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য ইত্যাদির মধ্যে বার বার আমরা ফিরে তাকাই আমাদের পুরনো ঢাকা শহরের দিকে।
[ গত ১১ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে ঢাকা সাহিত্য সম্মেলন উদযাপন পর্ব ২ অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল ‘স্মৃতির শহর’ ঢাকা: ছবি ও অক্ষরে’। ফ্লোরা সরকার সেই উদযাপনে বাংলাদেশের পুরানা ছবিতে কিভাবে পুরানা ঢাকা শহরের চিহ্ন রয়েছে তার হদিস নিতে গিয়ে এই লেখাটি লিখেছেন। চিন্তার পাঠকের জন্য এখানে তা পেশ করা হোল]