।। বিশ্বেন্দু নন্দ।।
আজ পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের আজকের দিনেই পলাশীর আমবাগানে স্বাধীন বৃহৎ বঙ্গের সূর্য অস্তাচলে গিয়েছিল। একদল বিশ্বাসঘাতকের চক্রান্তে। তারপর থেকে বড় বাংলা নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বাংলার স্বাধীন নবাবের শাহাদতের স্মৃতিকে লালন করে, পলাশী দিবসে নিজের বেশ কিছু ভাবনা ব্যক্ত করেছেন বড় বাংলার অভদ্রবিত্তজনের লেখক, তাত্ত্বিক, অনুবাদক ও ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বিশ্বেন্দু নন্দ। লেখকের ভাবনাগুলো আমরা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম।
পলাশী দিবসের ভাবনা
কেন আজ পলাশীকে ঘুরে দেখা?
শুধুই কি অতীতাচার? পলাশী দিবসের আগে বিষয়ে তিনটে মূল ধরতাই দেওয়া দরকার, পলাশীর ২৬৫ বছর পরেও আমরা কেন সেই সময়টা ছুঁতে চাইছি।
এক।
পলাশী বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের সময় সারণিতে গুরুত্বতম বিন্দু, যে বিন্দুকে ব্যবহার করে ইওরোপ, এশিয়া/আফ্রিকার সঙ্গে কয়েক হাজার বছরের ঘাটতি বাণিজ্যের হেঁটমুণ্ড ঊর্ধপদ করল, যে বাংলা সে সময় ছিল বিশ্ব ধনসম্পদের সিঙ্ক, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ – এই সাত বছর বাংলার সেই অমিত সম্পদ লুঠে পশ্চিম ইওরোপের ধনসম্পদে অপুষ্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটি সম্পদশালী হল এবং বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ লুঠেরা অত্যাচারী খুনি সামরিক রাষ্ট্র হয়ে উঠল।
১৭৫৭তে কার্যত তার দখলে চলে যাওয়া সোনার বাংলায় সে ক্রমশ নামিয়ে আনল অমিয় কুমার বাগচী কথিত ২০০ বছর ধরে স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসি, যে নীতিগুলির মধ্যে প্রধানতমগুলি ছিল নুন সুপুরি আফিম চট বাঁশের মত হাজারো নগণ্য ব্যবসার একচেটিয়া করণ, বাংলার রাজস্বকে ব্যবহার করে বিনামূল্যে বা অর্ধমূল্যে বাংলায় পণ্য সংগ্রহ এবং সেই আর্থিক এবং ধনসম্বল নিজের দেশে লুঠেরা এককেন্দ্রিক শিল্পতে বিনিয়োগ করা, ১১৭৬তে পরিকল্পিত গণহত্যা করে বাংলার জনসংখ্যা একতৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা যাতে নিয়মিত বাংলার ব্যবসায়িক গঞ্জ হাট এবং বাজার দখল করা যায়, কম মূল্যে বিনামূল্যে নিজের দেশের শিল্পের জন্যে কাঁচামাল রপ্তানি করা যায়, বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থার বিশিল্পায়ণ করা হল, ১৭৯৩তে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হল যার ফলে বাংলার জমির বাজার তৈরি হয় এবং এর সঙ্গে শিল্প ধংসের ফলে বিশাল কারিগর দিন মজুর এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত নানান দেশে দাস খাটতে যেতে বাধ্য হয়। সাম্রাজ্য একই সঙ্গে রেনেলকে দিয়ে মুঘল মানচিত্র আর সমীক্ষা জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সম্পদ লুঠের জন্যে মানচিত্র আর কোলব্রুককে কাজে লাগিয়ে পণ্য উতপাদন সমীক্ষা করায়, যে নীতি, জ্ঞান হাতিয়ারগুলি ব্যবহার করে শুরুতে বাংলা পরে গোটা উপমহাদেশকে অধমর্ণ করবে চিরকালের মত আর ইওরোপকে বসবে চালকের আসনে, হবে উত্তমর্ণ। আজকে ইওরোপিয় যে সব সেবা বা প্রযুক্তি পাই তার সলতে পাকানো বিভিন্ন উপনিবেশের জ্ঞান ধার করে, মেট্রোপলিটনে নয়।
দুই।
এই সামগ্রিক ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে উতপাদক কারিগর আর হকারদেরে চাষীদের নিষ্ক্রমণ ঘটল। পলাশীর আগে যে জ্ঞান দক্ষতা বাজার নির্ভর করে কারিগরেরা এই উপমহাদেশকে সোনার বাংলা বানিয়েছিলেন, ইওরোপকে নতুন ফ্যাশান দিয়েছিল, উপনিবেশের কবল থেকে মুক্তির পরও কারিগরদের তো পুনর্বাসন ঘটলই না, একই সঙ্গে উপমহাদেশিয় তিনটি প্রধানতম দেশের অধমর্ণতাও ঘুচল না উপমহাদেশ ভাগের আট দশক পরেও।
এই দুটি ঘটনার মধ্যে আমরা মনে করি বিপুল যোগসূত্র আছে। আজও পশ্চিমের ধারের জ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, বিদ্যায় বলীয়ান হয়েও উপমহাদেশিয় ত্রয়ী অধমর্ণই থেকে গেলাম। পলাশীর ৪ দশক পরেও যে উপমহাদেশিয় ভৌগোলিক ভূখণ্ডর জিডিপি ছিল ২৫, যে উপমহাদেশের পূবভাগের জিডিপি ছিল ৬, আজকের ভারত ভূখণ্ড তদানীন্তন বাংলার ৬ জিডিপি ছুঁতেই হিমিশিম।
তিন।
যে নিজের দেশের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না সে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গী। যার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ইতিহাস চর্চা নেই সে খড়ের মানুষ।
পলাশী পূর্ব বাংলার ইতিহাস কেমনভাবে পড়ব
সিরাজ চরিত্র যাঁদের লেখা দিয়ে বিচার হয় দুই গোলাম হোসেন, খান এবং সেলিম, আর করম আলিদের ইতিহাস কেন মান্য নয়, সে সব নিয়ে সুশীল চৌধুরী বিশদে লিখেছেন।
‘সিরাজদ্দৌল্লা সত্যি সত্যিই ভিলেন জাতীয় নিকৃষ্ট জীব ছিলেন কি না তা বিচার করার আগে যাঁরা তাঁর সম্বন্ধে এ অভিযোগ করেছেন তাঁদের সম্যক পরিচয় জানার একান্ত প্রয়োজন।এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার বেশিরভাগ ফারসি ইতিহাসই পলাশীর প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরে লেখা, যখন ঐ ঘটনাবলী সম্বন্ধে উক্ত লেখকদের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল যে ফারসি ইতিহাসগুলির বেশিরভাগই লেখা হয়েছিল ওইসব লেখকদের ইংরেজ প্রভু বা মনিবদের আদেশে বা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাই এগুলিকে সে যুগের ঐতিহাসিক তথ্যের প্রকৃত সূত্র হিসেবে গণ্য করা যায় কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ বা দুর্বৃত্ত প্রমান করা গেলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যথার্থ্য প্রমান করা সহজ হয় অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বলা যায় যে ইংরেজরা বাংলা জয় করে এক স্বেচ্ছাচারীর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করেছে। এতে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা মিলবে। ফলে পলাশী ষড়যন্ত্রের চক্তান্ত করা সত্ত্বেও ইংরেজদের ভূমিকা ততটা নিন্দনীয় হবে না।’
(সুশীল চৌধুরী, পলাশীর অজানা কাহিনী)
সিরাজের বিষয় নিয়ে আমরা এর আগে একটা লেখা দিয়েছিলাম। সেটাও সুশীলবাবুর বয়ানে। সিরাজের চরিত্র সেখানে তিনি বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন, নবাব হওয়ার আগে এবং পরে সিরাজ দুটি ভিন্ন মানুষ। অথচ সিরাজের ভিলেনি সম্বন্ধে প্রায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ঐক্যমত্য দ্যাখা যায়। সিয়ারেমুতক্ষরিণ-এর লেখক গোলাম হোসেন খান সব থেকে বেশি সোচার। তাঁর সম্বন্ধে প্রচুর কটুক্তি করেছেন। রিয়াজেও গোলাম হোসেন সেলিমও কড়া সমালোচনা করেছেন। বিপুল সমালোচনা করেছেন ফরাসি কুঠের প্রধান জাঁ ল, ইংরেজ কুঠিয়াল লুক স্ক্রাফটনও।
সিররেমুতক্ষরিণের প্রণেতা গোলাম হোসেন খান
সেযুগের নামি ঐতিহাসিক এবং সিরাজের কট্টর সমালোচক। আলিবর্দির বাড়ির হাজি বা বাড়ির সরকার। প্রথম থেকেই গোঁড়া ইংরেজ ভক্ত এবং সিরাজ বিরোধী। করম আলির ভাষায় ইংরেজদের বন্ধু হিসেবে তাদের ওকালতি করায় তাঁর চাকরি খুইয়েছিলেন এবং সিরাজ তাঁকে প্রাণে না মেরে বাংলা থেকে বহিষ্কার করেন। এই গোলাম হোসেন খানই শওকত জঙ্গকে প্ররোচিত করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে এ-ব্যাপারে(পলাশী) অগ্রসর হতে কারণ শোনা যাচ্ছে যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করতে চায়।পরে মীর কাশেমের প্রিয়পাত্র হিসেবে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন।
সিরাজ ইংরেজদের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে বিবাদ করছে এই তত্ত্বটা গোলাম হোসেন খান-এর তৈরি। ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব এবং চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন তিনি লেখেন – ‘এই জাতির(ইংরেজ)… শক্তি, সাহস ও মনোবলের কোনও তুলনা হয় না’, বা ‘এই জাতির সেনাপতিরা অত্যন্ত দক্ষ, সতর্ক ও সব ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এরা অসম সাহসী।’ তিনি আরও লেখেন, ‘এই জাতি কোনও সঙ্গত কারণ ছাড়া কারও সঙ্গে বিরোধ বাধায় না। তিনি আলিনগরের চুক্তি ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইংরেজদের দায় ছাড় দিয়ে লেখেন, …সম্ভবত কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণে নবাবের সঙ্গে বিরোধ করা ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না। …অবশ্য এ বিষয়ে আমার কাছে সঠিক কোনও তথ্য নেই তবে মনে হয় সম্ভবত নবাব(শর্ত অনুযায়ী) টাকা পয়সা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং অকারন দেরি করছিলেন।’
পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের সঙ্গে বিজয়ী হয়ে সিরাজ মোহনলালকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন গোলাম হোসেনে আর তার পরিবারের কোনও অনিষ্ট না হয়, তারা যেন নির্বিঘ্নে, নিরাপদে চলে যেতে পারেন। সিরাজের নির্দেশে তিনি নিরাপদে বেনারস তাঁর মামা ও ভাইদের সঙ্গে মিলিত হন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো দূরস্থান এই বদান্যতার জন্য গোলাম হোসেন সিরাজকে ধন্যবাদ তো জানানই নি এ প্রসঙ্গে তিনি পরে লেখেন, তাঁরা অত্যাচারী নবাবের হাত থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর আরও অভিযোগ সিরাজ নাকি জগতশেঠকে খৎনা করার হুমকি দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন কোনও তথ্যেই সমর্থিত নয়। বিশদে লেখার এখানে অবকাশ নেই, উতসাহীরা সুশীলবাবুর বইটা আরও বিশদের জন্য পড়ে নিতে পারেন।
গোলাম হোসেন সালিম এবং করম আলি
গোলাম হোসেন সালিমের রিয়াজউসসালাতিন প্রকাশ পায় ১৭৮৬তে. তাঁর ইংরেজ মনিব জর্জ উডনির নির্দেশে. উডনি ‘এই অধম ব্যক্তিকে’ ওই গ্রন্থ রচনা করতে নির্দেশ দেন। আরেক করম আলি ছিলেন গোলাম হোসেনের মতই তিনি ইংরেজ অনুরক্ত, এবং এ জন্য সিরাজ তাঁকেও রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। ইংরেজদের প্রতি তাঁর চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন, ‘তারা (ইংরেজ) কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করতে এমনই বদ্ধ পরিকর হয় যে নিজেদের প্রাণসংশয় করেও তাতে অবিচল থাকে। মিথ্যাবাদীকে তারা সমাজে বরদাস্ত করে না। তারা উদার, বিশ্বস্ত, সহনশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি। প্রতারণা কাকে বলে তারা জানে না। শঠতা ব্যাপারতাই তাদের কাছে অজানা।’ এই মানুষটা সিরাজ সম্বন্ধে বলেছেন তিনি বদমেজাজি এবং রূঢ়ভাষী ছিলেন। সব অভিজাত ব্যক্তি ও সেনাপতিদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেন।
করম আলির মুজফফরনামা ১৭৭২ সালে লেখা এবং তথ্যের ঠিক ঠিকানা নেই। তিনিও ইংরেজদের অনুকূলে সমান পক্ষপাতদুষ্ট। ঘোড়াঘাটার ফৌজদার ছিলেন কিন্তু তিনি সেখানে না থেকে প্রায়ই পূর্ণিয়াতে কাটাতেন। শওকত জঙ্গের পতনের পরে ঘোড়াঘাটার চাকরিচ্যুত হন এবং কারারুদ্ধ হন। সিরাজ তাঁকেও প্রাণে না মেরে পাটনায় নির্বাসিত করেন।
ফরাসীদের বিরোধিতা এবং ইংরেজদের চাটুকারিতার প্রমান হয় যখন তিনি বলেন, আল্লার ইচ্ছা, ফরাসিরা (ইংরেজদের দ্বারা) বাংলা থেকে বিতাড়িত হোক।
উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা: সিরাজ ও পলাশি
আমরা তো পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা – অগাবগা মানুষ – মানুষও বলা যায় না – লোকফোক বলাই ভাল। সবার থেকে একটু দেরিতে বুঝি, জানি… সুশীল চৌধুরীর পলাশি নিয়ে লেখাটা খুঁজছিলাম বহুদিন – পেলাম বাড়ির পুরোনো দেশ পত্রিকার ১৮ মে ১৯৯১ সংখ্যায়। কুড়িয়ে বাড়িয়ে সুশীলবাবুকেই খুঁটি ধরা গেল –
স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে শুধু নয়, লব্ধপ্রতিষ্ঠ ঐতিহাসিকদের গবেষণা সম্বন্ধে কতগুলো বক্তব্য স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে বহুদিন ধরে চলে আসছে। সাধারণভাবে এ বক্তব্য হলো সিরাজউদ্দৌলা এতই দুর্বিনীত, দুশ্চরিত্র এবং নিষ্ঠুর ছিল যে তাতে রাজ্যের অমাত্যবর্গ শুধু নয়, সাধারণ মানুূষ পর্যন্ত কোম্পানির সঙ্গে যে সংঘর্ষের পরিণতি হিসেবে সিরাজ বাংলার মসনদ পর্যন্ত হারাল, তার জন্য দায়ী সে নিজেই; মীর জাফরই পলাশী চক্রান্তের নায়ক এবং তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই পতন হয়েছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবীর। কোনো কোনো ঐতিহাসিক আবার এতেই ক্ষান্ত নন, ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যতার্থ প্রমাণে ব্যস্ত এসব ঐতিহাসিক প্রাক পলাশী বাঙালি সমাজের একটি দ্বিধাবিভক্ত চিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টায় খুবই সচেষ্ট। এদের বক্তব্য পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বিভক্ত ছিল। মুসলমান শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান নবাবের হাত থেকে অব্যাহতির জন্য কোনো ত্রাণকর্তার প্রত্যাশ্যায় অধীর হয়ে পড়েছিল এবং ইংরেজদের জালিয়েছিল সাদর অভ্যর্থনা। অতিসম্প্রতি আবার কিছু ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ইংরেজদের বাংলা বিজয় একটি আকস্মিক ঘটনা, এর পেছনে ইংরেজদের কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। পলাশী বিপ্লবের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হচ্ছে, সিরাজউদ্দৌলা নবাব হয়ে প্রভাবশালী শাসকগোষ্ঠীর তার প্রতি বিরূপ করে তোলার ফলে বাংলায় যে অভ্যন্তরীণ সঙ্কট দেখা দেয়, তার শেষ পরিণতিই পলাশী বিপ্লব।
উপরোক্ত বক্তব্যগুলো কতোটা সঠিক এবং তথ্য ও যুক্তিনির্ভর তার সূক্ষ্ম এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন মহাফেজখানায় যেসব নতুন তথ্যের সুন্ধান পেয়েছি, তার পাশাপাশি আগের জানা তথ্য ও সমসাময়িক ফার্সি ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের পুনর্বিচার করে সমগ্র বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন সম্ভব। বর্তমান আলোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যাবে উপরের অধিকাংশ বক্তব্যই সঠিক নয় এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে এই বক্তব্যগুলোকে খণ্ডন করা যায়। (পৃ. ৬৫)।
…নবাব হওয়ার আগে তার চরিত্র যেমনই থাক, নবাব হওয়ার পর সিরাজের চরিত্রদোষের কোনো প্রমাণ নেই। পনের মাসের স্বল্প রাজত্বকালে সিরাজ কোনো পাগলামি, অর্বাচীনতা বা নিষ্ঠুরতার পরিচয় যে দেয়নি, ঐতিহাসিক দলির-দস্তাবেজ থেকে তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা যায়। (পৃ. ৬৬)।
পলাশীর বিশ্বাসঘাতকদের সম্পর্কে সুশীলবাবু বলছেন …সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতার দায় শুধু মীর জাফরের নয় জগৎশেঠদের দায় মীর জাফরের চাইতে বেশি বৈ কম নয়। ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পিছিয়ে গেলেই দেখা যাবে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব কটা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য অংশ নিয়েছে। এ সময়কার রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদের হাতে। রবার্ট ক্লাইভের লেখা চিঠিপত্র দেখার পর সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, পলাশী চক্রান্তের পেছনে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদদ পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে।
… সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়েছিল শাসক শ্রেণীর এক চক্রীদল ও ইংরেজদের মিলিত ষড়যন্ত্রে, সম্প্রদায়ভিত্তিক দ্বিধাবিভক্ত বাঙালি সমাজের জন্য নয়। … লন্ডনের রাজকীয় মহাফেজখানায় ঠিক প্রাক-পলাশী বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকা আমি পেয়েছি। প্রথমটিতে (রবার্ট ওরমের তালিকা) দেখা যাচ্ছে আলিবর্দীর সময় (১৭৫৪ তে) দেওয়ান, তন-দেওয়ান, সাব দেওয়ান, বকসী প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুরা অলংকৃত করেছে একমাত্র মুসলমান বকসী হলো মীর জাফর। আবার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই হিন্দু। বাংলার ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুমের (Ian kerseboom)) তালিকাতেও (১৭৫৫ সালে) নায়েব দেওয়ান রায় রায়ান উমিদ রায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদের একচ্ছত্র প্রাধান্য। ১৭৫৪/৫৫’র এই যে চিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময় তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় মুসলমান রাজত্বে হিন্দুরা মুসলমানদের চাইতেও অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল।
… বাংলার সমাজ যদি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত হতো, তাহলে সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য ও ফার্সি ইতিহাসে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু সে রকম কোনো নির্দিষ্ট ইঙ্গিত আমরা তৎকালীন সাহিত্য বা ইতিহাসে পাই না।.. বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বিশেষ করে এ দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ, বহুদিন ধরে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। (পৃ. ৬৯, ৭০)।
আর ইংরেজদের সুবে বাংলার কর্তৃত্ব হস্তগত করার পূর্ব পরিকল্পনার বিষয়ে উপনিবেশমন্য সুশীল পরিসর থেকে বলা হচ্ছে, পলাশী সম্বন্ধে ইংরেজদের নাকি কোনো পূর্ব পরিকল্পনাই ছিল না; পলাশী চক্রান্তে ইংরেজদের ভূমিকাই ছিল না এবং নবাব দরবারের অন্তর্দ্বন্দ্বই নির্যাতিত মানুষদের মুক্তির লক্ষ্যে ইংরেজদের বাংলার রাজনীতিতে টেনে এনেছিল। কিন্তু সুশীলবাবু ভিন্ন কথা বলছেন। পলাশী প্রাক্কালের যেসব ঘটনাবলী এবং আমাদের কাছে যেসব নতুন তথ্য-প্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট দেখা যাবে ইংরেজরাই পলাশীর মূল ষড়যন্ত্রকারী। সিরাজউদ্দৌলাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার ব্যাপারে তারাই সবচেয়ে বেশি উৎসাহ যুগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পলাশী যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত প্রধান প্রধান দেশীয় চক্রান্তকারীরা যাতে শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকে, তার জন্য ইংরেজরা বারবার চেষ্টা করে গেছে। (পৃ. ৭০)।
১৬৯০ সালের চুক্তিতে কোম্পানিকে দস্তক প্রদানের অধিকার অনুমোদনের কথা এখানে আমরা আবার স্মরণ করতে পারি। স্মরণ করতে পারি ১৭১৭ সালের চুক্তির কথা। কোম্পানি কর্মচারীদের ব্যক্তিগত গোপন ব্যবসায়ে দস্তকের যথেচ্ছ ব্যবহারে বাধা আসছিল প্রথম থেকেই। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ, নবাব আলীওয়ার্দী খাঁ এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানি কর্মচারীদের এই কাজে বাধা দিয়ে আসছিলেন। তাতে আঁতে ঘা লাগছিল কোম্পানি কর্মচারী-কর্মকর্তা সকলেরই। ইংরেজরা দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিল যে, এই বিশাল ভারতবর্ষে মুসলিম মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘনিয়ে আসছে। মারাঠা নায়ক শিবাজীর মৃত্যুর পর মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল না। এমনি অবস্থায় ক্রমবর্ধমান শক্তির অধিকারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অদূর ভবিষ্যতে মস্ত বড় কোনো কিছুরই আশা করবে বা না কেন? বস্তুত কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার স্কট পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে বাংলা বিজয়ের এক বিশদ পরিকল্পনা পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছিল। তাতে এ গৌরবময় ঘটনায় কোম্পানি কি পরিমাণ লাভবান হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা ছিল। স্কট এটাও জোর দিয়ে বলেছিল যে, বাংলা জয় করতে পারলে immense gains would accrue to the English nation … … রাজ্য বিজয় সম্বন্ধে বাংলায় কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে একটা স্পষ্ট মতলব ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়। আসলে ১৭৪০ দশকের শেষ দিকে ও পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য চরম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়, ফলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার স্বার্থে তারা বাংলা বিজয় চাইছিল। অবশ্য এই সময় কোম্পানির বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত ব্যবসার মতোই সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে পড়েছিল। কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্কটাপন্ন ব্যক্তিগত বাণিজ্য স্বার্থকে পুনরুদ্ধার করার জন্য ফরাসীদের বিতাড়ন এবং রাজ্য জয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন ঘটেছিল তাতে শুধু যে আন্তঃএশীয় এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যবসার স্বার্থ রক্ষার উন্নতি ঘটবে তা না, উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ, বাজারহাট, ব্যবসায়ী তাঁতী অন্যান্য কারিগরদের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ কথা যে শুধু পশ্চাৎ সমীক্ষাতেই ধরা পড়ছে তা নয়, তৎকালীন কোম্পানির কর্মচারীদের বিবৃতি ও কাজকর্মের মধ্য দিয়েও প্রকাশ পেয়েছে। স্কটের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা, ফ্যাম্বল্যান্ড ও ম্যানিংহামের ক্লাইভকে লেখা চিঠি (১ সেপ্টেম্বর ১৭৫৩) যাতে ইংরেজ বাণিজ্যের বিশেষ করে ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্রমাবনতির কথা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কোম্পানির বেচাকেনায় দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থার পরিবর্তন, নবাবের প্রতিফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল, গবর্নর ও গবর্নর ড্রেকের অনমনীয় এবং মারমুখো মনোভাব এ সবই ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যে অভিপ্রায় তারই নির্দেশক। (পৃ. ৬৭)
‘কেন এই পলাশী চক্রান্ত? প্রসঙ্গে তিনি দেশে লিখছেন, “মুর্শিদাবাদের শাসকগোষ্ঠীর একটি অংশ এবং ইংরেজরা সিরাজউদ্দৌলার অপসারণ চেয়েছিল বলেই পলাশী চক্রান্তের উদ্ভব। উভয়ের কায়েমী স্বার্থের পক্ষে সিরাজ ছিল অত্যন্ত এটা স্পষ্ট যে বাংলার সামরিক অভিজাত শ্রেণী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও জমিদারদের নিবিড় জোটবদ্ধতা বাংলার নবাবের পূর্ণ ক্ষমতার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল, সিরাজউদ্দৌলা তা মেনে নিতে মোটেই রাজি ছিলেন না। নবাব হয়েই সিরাজউদ্দৌলা সামরিক ও বেসামরিক উভয় শাসন ব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজাতে শুরু করল। মোহনলাল, মীর মদন ও খাজা আব্দুল হাদি খানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ এই নতুন ব্যবস্থার ইঙ্গিত বহন করে।… আসলে সিরাজউদ্দৌলার মতো বেপরোয়া তরুণ নবাব হওয়ায় শাসকশ্রেণীর একটি গোষ্ঠী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আগের নবাবদের আমলে এই বিশেষ গোষ্ঠীই সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত ছিল। এখন তাদের ত্রাসের কারণ সিরাজউদ্দৌলা হয়তো তাদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের পথগুলো বন্ধ করে দেবে। সৈন্যাধ্যাক্ষের পদ থেকে মীর জাফরের অপসারণ, রাজা মানিকচাঁদের কারাদণ্ড এবং সর্বোপরি আলিবর্দীর একান্ত বিশ্বস্ত ও প্রভূত ক্ষমতাশালী হুকুম বেগের দেশ থেকে বিতাড়নের মধ্যে শাসক শ্রেণীর চক্রীদল বিপদ সঙ্কেত পেয়ে যায়। এসব সত্ত্বেও ইংরেজদের সক্রিয় সংযোগ ছাড়া পলাশী বিপ্লব সম্ভব হতো না। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হওয়ায় ইংরেজদের কায়েমী স্বার্থও বিঘ্নিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। সিরাজ নবাব হওয়ার পর ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারিরা ভীষণভাবে শঙ্কিত হয়ে উঠল, পাছে নতুন নবাব তাদের দুই কল্পতরুকে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার সমূলে বিনাশ করে বসে” (পৃ. ৭২)।
তাই এই তরুণ নবাকে ধ্বংস করার জন্যই পলাশীর এই চক্রান্ত। এই চক্রান্তের প্রদান হোতা ইংরেজ এবং এ দেশীয়রা তাদের সহযোগী।
দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করার সুযোগটাই ছিল কোম্পানিওলাদের স্বার্থের ক্ষেত্রে আসল ব্যাপার। ১৭৫৬ সালের ১লা জুন ইংরেজদের কাছে নবাবের বিশেষ দূত খাজা ওয়াজেদের কাছে লিখিত নির্দেশে অন্যাণ্য কারণের মধ্যে দস্তক সম্পর্কিত ব্যাপারটাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। নির্দেশে নবাব তার মনোভাব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, ইংরেজদের আমার রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করার তিনটি প্রকৃত কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, দেশের প্রচলিত নিয়মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাজ্যের মধ্যে তারা সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ ও পরিখা খনন করেছে। দ্বিতীয়ত, তারা দস্তকের সুযোগ-সুবিধার যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে এবং যারা কোনোভাবেই এই দস্তক ব্যবহারের অধিকারী নয়, তাদেরও বাণিজ্য শুল্ক বাবদ নবাবের রাজস্বের প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। তৃতীয়ত, ইংরেজরা নবাবের এমন সব প্রজাকে আশ্রয় দেয় যারা বিভিন্ন প্রকার বিশ্বাসভঙ্গকারী কার্যকলাপ ও অন্যায় ব্যবহারের জন্য নবাবের নিকট কৈফিয়ত দিতে বাধ্য।
সুশীলবাবু যা বলছেন, সে বিষয়ে আমরা একমত – শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এ ব্যক্তিগত ব্যবসাই ছিল রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ এটা যতো অন্যায়ই হোক না কেন, তারা ছাড়তে মোটেই রাজি ছিল না। গবর্নর ড্রেক থেকে শুরু করে সব ইংরেজ কর্মচারীই এই ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল এবং কেউই এটার মতো লোভীয় জিনিস ছাড়তে চায় না। সুতরাং ইংরেজরাও চাইছিলো সিরাজউদ্দৌলাকে হঠাতে। তাই শাসক শ্রেণীর চক্রীদলের সঙ্গে হাত মেলাতে এগিয়ে এলো ইংরেজরা।
এভাবে বাংলা লুঠের রাস্তায় পলাশী চক্রান্ত সফল হলো। সফল হলো প্রধানত এদেশীয় বেইমানদের বিশ্বাসঘাকতার জন্যই এবং আশ্চর্যই বলতে হবে দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের অনেকেরই জীবনের অবসান হয়েছিল খুই নির্মমভাবে।
বিশ্বেন্দু নন্দ
লেখক, গবেষক, সংগঠক, প্রকাশক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা।