।। অতনু সিংহ ।।
‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর কথা হলো অনেক, নিশ্চই ‘অমৃত’ও পান করলেন কোটি কোটি মানুষ। ভালো। অমৃতের বিপরীতে পড়ে থাকা গরলভাণ্ডের কথাও এবার একটু সামনে আসুক। পঁচাত্তর বছর ধরে আমরা যে গরল পান করে আসছি, সে কথাও তো মনে করানো উচিত। আহা গরল! পরিচয়বাদের গরল, রাষ্ট্রবাদের গরল, ‘জাতীয়তাবাদ’-এর গরল! আর এই বিষ পান করার ফলেই পঁচাত্তর বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্পাত আর কাঁটাতারের সীমান্তে বঙ্গবাসীরা বিভক্ত। বিষের নেশায় বড় বাংলার ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধি-সম্ভারের ইতিহাসও বিস্মৃত প্রায়। সেই বিস্মৃতির কুহক সরিয়ে বাংলাভাষীদের তথা বড় বাংলার মানুষের জ্ঞান-কারিগরীবিদ্যা-কলা-সাহিত্য-শিল্প ও অর্থনৈতিক ঐক্যের সম্ভবনা ঘিরে স্বপ্নগাথা রচনার প্রয়োজন হয়েছে আজ। তাই ১৪ ও ১৫ আগস্ট পার করে এসে পঁচাত্তর বছরের বঙ্গ সীমান্ত এবং বড় বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রসঙ্গে কিছু কথা।
পঁচাত্তর বছরের সীমান্ত ও বড় বাংলা
‘স্বাধীনতা’ মোচ্ছবের গানগুলি বিকালবেলা ক্ষীণ হয়ে আসে! বোধহয় লতা মঙ্গেশকর সারাদিন চিৎকার করার পর ১৫ আগস্টের বিকালের দিকে ব্যথা অনুভব করেন কিছুটা! ডিজে পার্টির স্পিকারগুলি মদ-মাংস হজম করার জন্য ঝিমাতে থাকেন! চিবানো মুরগীর ঠ্যাং আর ‘ব্লেন্ডার্স প্রাইড’-এর বোতলগুলো ডাস্টবিনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সারা হয়। আমি তখন ঘুম থেকে উঠি আর জানলাটা অবশেষে খুলি। ১৫ আগস্টের বিষ যেটুকু ধারণ করেছিলাম সারাদিন, ঘুমের ভিতরে হজম হয়ে গেছে নিশ্চয়।
১৫ আগস্ট মানে অঙ্গচ্ছেদের বেদনা আমার। ইতিহাসের বইতে ভারত ভাগের কথা বলা হয়। আসলে ভাগ হয়েছে বাংলা আর পাঞ্জাব, আর কাশ্মীরকে ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল ইংরেজ। বলা হয় ‘দ্বিজাতি’ তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ খণ্ডিত হয়েছে। দুই ‘জাতি’ কেমন? এক জাতির নাম ‘মুসলমান’ আর আরেক জাতির নাম ‘হিন্দু’। ধর্ম কী করে জাতি হয়? কিন্তু হয়, হয়েছে। ফলে একদিকে জাতিবাদী হিন্দুর রাষ্ট্র বানানো নয়, আর উলটো দিকে বানানো হয় মুসলমানদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি ‘পাকিস্তান’। পাকিস্তানকে তার জন্ম লগ্নেই ধর্মীয় জাতিবাদের স্বরূপে আমরা চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু সফট হিন্দুত্ববাদী ভারতের ওপর সেকুলারিজমের ঘোমটা টানা ছিল। ফলে তার রূপদর্শনে সময় লেগেছে। কিন্তু যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবল ও প্রকট হিন্দুত্ববাদী চেহারাটা ফুটে উঠল ততোদিনে দেরি হয়ে গেছে। এর আগে গবেষকরা বলেছিলেন বটে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মূলত হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তার রকমফের মাত্র। আমরা বিশেষ আমলে নেই নি। কিন্তু বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে আমরা টের পেতে শুরু করেছি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মূলত হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানী জাতীয়তাবাদ যার রাজনৈতিক ফল হচ্ছে বাংলাকে দিল্লীর কলোনিতে পরিণত করা এবং আরও নিকৃষ্ট ও বিপজ্জনক দিক হলো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃ্তির নিধন যজ্ঞ সম্পূর্ণ করা। বাংলাকে হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অধীনস্থ করা।
ভারতের হিংস্র হিন্দুত্ববাদী রূপ মোকাবিলা করতে হলে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলার ভূগোল এবং বাংলা ভাষা ছাড়াও সকল ক্ষুদ্র জনজাতির ইতিহাস এবং বাংলায় তাদের অবিসংবাদিত অধিকার ও মর্যাদার হদিস নিতে হবে। বাংলা তাদের আবাবস। সকলকে নিয়েই বাংলা। বাঙালি কোনো বিশুদ্ধ জাতি না। বাঙালি মিশ্র জাতি। প্রায় সকল আদিবাসীর রক্ত বাঙালি শরীরে হাজির। এই মিশ্রণই বাংলার গৌরবের দিক। ‘বাঙালি’ তারাই যারা অশুদ্ধ, নিম্ন জাত ও নিম্নবর্ণের মানুষ। তাদের মধ্যে কোনো ব্রাহ্মণ ছিল না, কারণ বাঙালি স্বভাবদোষে ভাত দিয়ে মাছ খায়, কিংবা মাছ দিয়ে ভাত খায়। এই নৃতাত্ত্বিক ‘ভেজাল’, ‘মিশ্র রক্তের দোষ’ ও ‘নৃতাত্ত্বিক গোলমালের ইতিহাস’ আমাদের আবার নতুন করে পাঠ করতে হবে। এই সংকল্পটাই আমরা ‘বড় বাংলা’ কথাটা দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করি।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বেশী আত্মত্যাগ ছিল বাঙালির। আন্দামান জেলে রাজবন্দীদের সংখ্যা বিচার করুন। শতকরা ৬৮ ভাগ ছিলেন বাঙালি। ১৯৪৭-এ বাঙালি স্বাধীনতা পেল না। পেল ‘দেশভাগ’। কলকাতার ভদ্রলোক বাবুরা ‘দেশভাগ’ করলেন, দোষ চাপালেন মুসলমান আর জিন্নাহ সাহেবের ঘাড়ে। এতে শেষ রক্ষা হয় নি। থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে যাদের বাদ দেবার জন্য কলকাতার বাবুরা দেশ ভাগ করেছিলেন তারা তাদের ভূখণ্ড নিয়ে এখন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। সত্যকে চোখ ঠার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় না। আমরা এখন আগ্রাসী হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্তানের দাপটে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ঋত্বিক ঘটক ঠিকই বলতেন, “দেশের মানুষের পিঠে ছুরি মেনে আনা স্বাধীনতা আমরা সেদিনও মানি নি আজও মানি না”।
আমি কিংবা আমার বাবা-মা, কেউই অবশ্য অখণ্ড বাংলা দেখিনি। আমাদের সকলেরই জন্ম খণ্ডিত বাংলায়। আমি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ভুল করে ইতিহাস পড়ে ফেলেছি বলে মনে প্রাণে আমি ‘বড় বাংলা’র মানুষ।
আমি কি তাহলে অখণ্ড ভারত চাইছি বা অখণ্ড বাংলা? না, একটিও না। প্রথমেই চাই যেন সকলে যে বোঝে বাংলার ঔপনিবেশিক শোষণ — যেটা ইংরেজ আমনে শুরু হয়েছিল — সেটা দিল্লী অব্যাহত রেখেছে। তার অবসান ঘটাতে হবে। এই পরাধীনতার অবসান চাই। ভারতের সংবিধানের বড় অংশই আসলে The Government of India Act, 1935-এর অনুলিপি। অসমের বাঙালি বিরোধী ‘দাঙ্গা’ স্বাধীন দিল্লীর অধীনেই ঘটেছে। এনআরসি-র অধীনে প্রায় ১৯ লক্ষ লোক নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। বলা হচ্ছে নাগরিকত্ব আমার জন্মগত অধিকার নয়, হিন্দুত্ববাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্য কাগজপত্র না থাকলে আমি আর ভারতীয় নই। আমি ‘বাংলাদেশী’ (?)। যারা আর ভারতের নাগরিক না তাদের মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ বাঙালি। এদের মধ্যে ১১ লাখ হিন্দু এবং ছয় লাখ বাঙালি মুসলমান। ফলে আমাদের বাংলা নিয়ে নতুনভাবে ভাবা ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। ‘বড় বাংলা’ কথাটা নতুনভাবে ইতিহাস পাঠ এবং নিজেদের নতুন করে বোঝার চেষ্টা। বাংলাকে ইংরেজের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের নামে ভাগ করা হয়েছে, যার ফল হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান। এই ভারত আমরা চাই নি।
দ্বিতীয়ত, বাঙালি বর্ণহিন্দুদের অত্যাচারের ফলে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি নমঃশূদ্রদের যেভাবে ‘অপর’ করে রাখা হয়েছে, আমরা তার অবসান চাই। ১৯২০-১৯৪৭ সালে বর্ণহিন্দুদের প্রতি বৈরিতা মূলত জাতপাতের বিরুদ্ধে শ্রীচতন্যের লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা। রবীন্দ্রনাথও জমিদারি পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেছেন বর্ণহিন্দু প্রজাদের থেকে আলাদাভাবে মুসলমান প্রজাদের জাজিমের একটি দিক তুলে অতিশয় ঘৃণার সঙ্গে জমদারের কাছারিতে একটি কোনায় বসতে দেওয়া হতো। এই হোল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙলির প্রতি বর্ণবাদী উচ্চ বর্ণের হিন্দুর আচরণ। সেই ‘বাঙালি’ এখন নিজেদের স্বাধীন দেশ কায়েম করতে পেরেছে। তারা ইসলামাবাদের গোলামি মেনে নেয় নি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আমরা দিল্লীর গোলামি মেনে নিয়েছি। আমাদের মুসলিম বিদ্বেষ বা ইসলাম ঘৃণা আসলে বর্ণহিন্দুর ঘৃণা, মনুবাদ জারি রাখা বা বহাল রাখার ঘৃণা। চৈতন্য যে লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই পাপের বোঝা এখন ভারি হয়েছে। পশ্চিম বাংলার ইসলাম বিদ্বেষ কিম্বা মুসলমান বাঙালিকে ‘অপর’ ভাবা জাত-পাতের প্রশ্ন অমীমাংসিত রাখা। এর অবসান ঘটতে হবে।
আমাদের ভুল ইতিহাস শেখানো হয়। ত্রিশের দশকে বাঙালি মুসলমানের পার্টি ছিল ফজলুল হকের ‘কৃষক -প্রজা পার্টি’, মুসলিম লীগ নয়। মুসলিম জাতিবাদ একান্তই জাতীয়তাবাদী হিন্দুর প্রতিক্রিয়ার অধিক কিছু কখনই ছিল না। ত্রিশের দশকের গোড়ায় বাংলায় মুসলিম লীগের প্রভাব ছিল সীমিত। ত্রিশের দশকে, কৃষকদের স্বার্থের প্রতিনিধি হয়ে বৃহত্তম পার্টি হিসাবে ‘কৃষক -প্রজা পার্টি’র আবির্ভাব ঘটে। নির্বাচন রেজাল্টের পর, মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য ফজলুল হক ও তাঁর ‘কৃষক-প্রজা পার্টি’ চেয়েছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে, মুসলিম লীগ-এর সঙ্গে নয়! কিন্তু কংগ্রেস-এ জমিদার-জোতদার সুদখোর মহাজনদের শ্রেণীস্বার্থই প্রাধান্য পেলো, সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব, (ততদিনে পরলোকগত) চিত্তরঞ্জন দাশের হিন্দুমুসলিম ঐক্য-ভিত্তিক ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’কে উল্টে দিয়ে, ফজলুল হকের ‘কৃষক-প্রজা পার্টি’র সঙ্গে জোট করতে অস্বীকার করলো। ফলে, মন্ত্রীসভা গঠন করতে, ফজলুল হক দ্বারস্থ হলেন মুসলিম লীগের কাছে। বাংলায় মুসলিম লীগের প্রভাব বৃদ্ধির সেটাই সূত্রপাত। এর থেকেই বাংলায় মুসলিম ও হিন্দুদের পারস্পরিক বৈরিতার শুরু।
হাজার বছর ধরে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে। সহাবস্থানের ইতিহাসে বিষ ঢোকে কর্নওয়ালিসের ১৭৯৩ সালের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ দ্বারা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়েই পূর্ববঙ্গের কৃষকদের উপর বর্ণহিন্দু জমিদারদের শাসন ও অত্যাচার কায়েমী হয়ে যায়। কৃষকদের অধুকাংশই ছিলেন মুসলমান আর বর্ণহিন্দু জমিদার-জোতদারদের অধিকাংশই ছিল বর্ণহিন্দু। ইসলাম ও নিম্নবর্ণের বিদ্বেষ একান্তই বর্ণহিন্দুর তৈরি আর্থ-সামাজিক সম্পর্কে ধারাবাহিকতা। এই অসুখ আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।
১৯২০-৩০-এর দশকে, কংগ্রেস ফজলুল হককে দূরে সরিয়ে দিয়ে – অর্থাৎ জমিদার-জোতদার-মহাজনদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে যে ভূমিকা পালন করেছে তার বিষফল আমরা এখন ভোগ করছি। দিল্লী বা হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান বাংলাদেশকে এক ভাবে শোষণ করছে–আগ্রাসন ও আধিপত্য বজার রাখছে – আবার একই দুষমণ বাঙালিকেও পশ্চিম বাংলায় শোষণ করছে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস স্পষ্টই প্রমাণ করেছে বাংলা বিনাশ করাই হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্তানের প্রকল্প।
বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস তা বাস্তব, কিন্তু সেটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা। যদি ইতিহাস তা তৈরি করে থাকে তাহলে ইতিহাসের পথ ধরেই আমাদের তা মীমাংসা করতে হবে। ‘বড় বাংলা’ সেই মীমাংসার প্রয়োজনীয়তাটুকু সামনে আনতে চায়। বাংলা ও তার মিত্রদের মুখ পরিষ্কার ইতিহাসের আয়নায় বড় বাংলা দেখতে চায়। পারস্পরিক সন্দেহ মোচন করতে চায়। দিল্লী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের বিপরীতে বাংলাভাষীদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থকে সামনে নিয়ে আসতে চায়। বাংলা ভাষীদের আমরা ভূ-রাজনীতির বলী দেখতে চাই না। বাংলা ভাষা এখন দুনিয়ার তৃতীয় বৃহৎ ভাষা যদিও সরকারি ভাবে পাঁচ নম্বরে ধরা হয়। আমরা ইতিহাসের গর্ভে এভাবে হারিয়ে যেতে পারি না।
জিন্নাহ যেভাবেই হোক ভারত ভাগ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন – এটা হিন্দুত্ববাদী প্রপাগাণ্ডা। ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের প্রস্তাব ছিল একটি বিকন্দ্রীকৃত (decentralize) অবিভক্ত ভারত যেখানে কেন্দ্র সরকারের হাতে থাকবে একই মূদ্রা ব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষা — সেই প্রস্তাব কিন্তু জিন্নাহ গ্রহণ করেছিলেন! বাংলার কংগ্রেসও গ্রহণ করেছিল! নেহেরু সেখানে বাদ সেধেছিলেন। তার বিরোধিতার ফলে ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান বানচাল হয়ে যায়।
লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলন করার সময় নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘যাঁরা আত্মবলিদান করেছেন, তাঁদের স্বপ্ন পূরণের সময় এসেছে। মহাত্মা গাঁধী, নেতাজি থেকে সাভারকর, প্রত্যেকের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। নেহরু থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে আজ প্রণাম করার দিন। বীরসা মুণ্ডা, সিধো কানহুর আন্দোলনও ভোলার নয়।’
আত্মবলিদান শুধু ভারতের হিন্দুরা করে নি, মুসলমানও করেছে। হিন্দুত্ববাদীরা তাদের নাম নেবে না সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতির অধিকার নরেন্দ্র মোদীর নাই। ইতিহাসবিদ সুগত বসু ঠিকই বলেছেন ‘ইতিহাসের বিকৃতি বা অপলাপ করছেন মোদি। গাঁধীজি, নেতাজির নেতৃত্বে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। সাভারকর প্রথম জীবনে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলেন, পরে সরে আসেন।’ সুগত বসু পরিষ্কার বলেছেন, ‘শ্যামাপ্রসাদ কখনওই স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না। তিনি ব্রিটিশ গভর্নরকে পরামর্শ দেন, কীভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখা যায়। নেতাজির মেজদা শরৎচন্দ্র বসু বাংলার ঐক্য বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ বাংলাকে ভাগ করার দাবি করেছিলেন। পূর্ব বাংলার হিন্দুদের দুর্দশার জন্য শ্যামাপ্রসাদ সরাসরিভাবে দায়ী।’ ইতিহাস আমরা তাহলে খুব একটা ভুলি নি। (দেখুন, সাভারকর – শ্যামাপ্রসাদকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মোদী সত্যের অপলাপ করেছেন: সুগত)
আমি এক বঙ্গের পশ্চিম অঞ্চল থেকে স্বাধীন পূর্বদেশে যাতায়াত করি সড়ক সীমান্ত দিয়ে– অভিভাষণ প্রক্রিয়া, কাস্টমস চেকিং ও বিএসএফ-এর অতিসক্রিয়তা তথা বাংলাভাষীদের প্রতি দুর্ব্যবহার অতিক্রম করে। পশ্চিম থেকে পূবে যতবার গেছি, কখনও মনে হয়নি ‘বিদেশ’ যাচ্ছি। কেনই বা মনে হবে? দেশ আর রাষ্ট্র তো এক নয় কখনোই। রাষ্ট্রবাদ ভাগ করতে চেয়েছে আমাদের বড় বাংলা-দেশকে (বেঙ্গল প্রভিন্স)। আধুনিক ও ঔপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্র চেতনার কোপে দেশকে জবরদস্তি ভাগ করার চেষ্টা হলেও আমার বা আমার মতো আরও অনেকেরই মনে হয়েছে আমাদের বড় বাংলাকে ভাগ করা যায়নি আসলেই, যাবেও না। পূব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, নৈঋত- বাংলার বৈচিত্র্য অনেক, কিন্তু তারপরেও অনার্য, শূদ্র, মজলুমের বাংলার অন্দরে বাহিরে ঐক্য অটট- এমন অনুভূতিকে বারবার ব্যহত হয়েছে পঁচাত্তর বছর ধরে পূব ও পশ্চিমের মাঝে গেঁড়ে বসে থাকা সীমান্ত ও সীমানা অতিক্রান্তির সময় রাষ্ট্রীয় তৎপরতায়, পাসপোর্টে দুই রাষ্ট্রের স্ট্যাম্পে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অতিসক্রিয়তা তথা বাংলা বিদ্বেষে।
ভারতের বাংলা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে যাতায়াতের সময় যতবার যাতায়াত করেছি পঁচাত্তর বছরের সীমান্তের পশ্চিমপ্রান্তে থাকা বিএসএফের বাংলাভাষীদের প্রতি আচরণ দেখলেই বোঝা যায়, পূব কিংবা পশ্চিমের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে এবং নিরীহ বাংলাভাষী মানুষের ওপর বিএসএফের বিরুদ্ধে জুলুমের যে অভিযোগ, তা নিছকই অভিযোগ নয়। বরং দিল্লির যে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী রাজনীতির ধরণ ও কার্যকলাপেও এটা এমনিতেই বোঝা যায়। এ কথা আলাদা করে বলে দিতে হয় না কাউকে, কেননা, আমাদের চোখের সামনেই বঙ্গদেশের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁটাতারের সীমান্তের উপর লাশ হয়ে ঝুলে থাকেন ফেলানি খাতুন। আধুনিক রিপ্লাবিক অব ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় জাতিবাদী রাজনীতির পিছনে বাংলা সীমান্তের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দীর্ঘ। এই প্রেক্ষাপটে রয়েছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ। এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরও পিছনে আরও এক গুপ্ত হানাদারির ইতিহাস হয়ে আছে বঙ্গে ব্রাহ্মণ আগমন তথা আর্যীয় আগ্রাসনের অতীত। এবং এই বর্ণবাদী-জাতিবাদী ও ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত আধুনিক পরিচয়বাদী রাজনীতির ক্রমপরিণতি পঁচাত্তর বছরের সীমান্ত। পঁচাত্তর বছরের বাংলা ভাগ। যা অফিসিয়ালি দুইটি রাষ্ট্রের (ভারত ও পাকিস্তান) স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
এ বছর ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে ‘স্বাধীনতা’র পঁচাত্তর বছর পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে দিল্লির শাসক একরকমভাবে রাজনৈতিক ফতোয়া জারি করেছিল ‘ঘর ঘর তিরাঙ্গা’ তোলার জন্যে। সেই মতো এবারে মধ্যবিত্ত পশ্চিমবঙ্গবাসীর বড় অংশের ঘরে ঘরে পতপত করে উড়লো তেরাঙ্গা পতাকা। যদিও সেইসব পতাকা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের। একদিকে পলিথিন বর্জনের কথা বলা হচ্ছে, বিভিন্ন রাজ্য সরকার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পলিথিন বর্জনের কথা বলছে, অন্যদিকে প্লাস্টিকের পতাকায় ছেয়ে যেতে দেখা গেছে ‘ভারতীয়’ খুচরো বাজার। পশ্চিমবঙ্গে ডান, বাম, মধ্য-সহ সকল প্রকার রাজনৈতিক দল ও সংগঠনই রাষ্ট্রের পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস পালন করেছে পরম উৎসাহে। যদিও বিজেপির নিয়ন্ত্রক যে সংগঠন সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক বা আরএসএস তাদের সদর দফতরে এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ‘তেরাঙ্গা’ উত্তোলন করেনি। কেননা, আরএসএস তাদের রাজনৈতিক দল বিজেপির মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী স্লোগানে প্রবল ‘দেশপ্রেম’-এর হুল্লোড় ছড়ালেও ভিতরে ভিতরে তারা ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার বিরুদ্ধে। কেননা, গৈরিক-সাদা-সবুজের ত্রিবর্ণের বৈচিত্র্য-ঐক্যে বা একই সঙ্গে বহু ও একের সমন্বয়ের চিন্তাপ্রস্তাবনা। কিন্তু সংঘ পরিবার কল্পিত ‘এক জাতি, এক দেশ, এক পতাকা, এক সরকার, এক ভাষা, এক ধর্ম’র মতাদর্শ লালন করে। সেখানে সাদা কিংবা সবুজের ঠাঁই নাই কোনো, ঠাঁই নাই নীল বর্ণের অশোক চক্রের। মাথার রাখা উচিত, নীল কিন্তু শূদ্রের রঙ, দলিতের, অনার্যের। আরএসএস-এর সদর দফতর-সহ সকল প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক দফতরে সারা বছর পতপত করে ওড়ে গৈরিক পতাকা। যে পতাকা হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি রাষ্ট্রবাদের, যে পতাকা মনুবাদের। আসলে বিজেপিও ওই পতাকারই পক্ষে। কিন্তু আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা ও বিশ্ব জুলুমশাহী ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সঙ্গে ডিল করতে গিয়ে তাকে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকাকেই সামনে রেখে হিডেন এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে হচ্ছে, যে এজেন্ডা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে ওই হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি পরিচয়ে পুনর্গঠন করা। আর তাই, শোনা যাচ্ছে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি জাতিরাষ্ট্রে চেহারা দিতে ভারতে নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের কাজও নাকি বিজেপি শুরু করে দিয়েছে! সাধুসন্তের ভেকধারী আরএসএস-এর কিছু নেতা এই সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব রচনার কাজও নাকি শুরু করে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বারানসীর শঙ্করাচার্য পরিষদের কর্ণধার আনন্দ স্বরূপ। ৬৫০ পাতার এই খসড়া প্রস্তাবটি ২০২৩ সালে প্রয়াগের মাঘ মেলায় প্রকাশ হবে বলেও জানিয়েছেন স্বামী আনন্দ স্বরূপ। আরএসএস-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনটির আরও দাবি, ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়ে কাশীতে নিয়ে যাওয়া হবে। ‘হিন্দু’ রাষ্ট্র গঠনের নয়া সংবিধানে রাষ্ট্রের অহিন্দু নাগরিকদের নাগরিক অধিকার থাকলেও ভোটাধিকার থাকবে না বলেও জানানো হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় পতাকা, ‘জাতীয়’ সংগীত ইত্যাদিও পরিবর্তন করবে বলে তাদের তরফে জানানো হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের পঁচাত্তর বছরেই, যখন বিজেপির মোদী-শাহ সরকার ‘ঘর ঘর তিরাঙ্গা’ উত্তোলনের ফতোয়া দিয়েছে, স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ পালন করেছে, রাষ্ট্রপ্রেমের উগ্র স্লোগান দেদার বিকিয়েছে গণমাধ্যমে, ঠিক তখনই এই কাণ্ড খোদ বিজেপির মাদার অর্গানাইজেশনের সঙ্গে সমৃক্ত ধর্মীয় পরিচয়বাদী উগ্র হিন্দুত্বপন্থী সংগঠনের।
আসলে বিজেপি আজ যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কথা বলছে সেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আদতেই হিন্দু জাতীয়তাবাদ। আর এই হিন্দু জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে কলকাতার বাবু বাঙালিদের সংগঠিত সোকল্ড নবজাগরণ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তা হলেও ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত হিন্দু পরিচিতির ভিত্তি বৈদিক ধর্ম তাই হিন্দুত্বের রাজনৈতিক বিকাশ উত্তর ও পশ্চিম ভারতেই। হিন্দুত্বের রাজনৈতিক নির্মাণে বিনিয়োগকৃত পুঁজি হলো বানিয়া পুঁজি ও হিন্দি পুঁজি। তাই যুক্তরাষ্ট্র, গণতন্ত্র, বহুত্ব ও সোকল্ড সেক্যুলারিজমের বুলি আউড়ানো হলেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যেই রয়েছে হিন্দুত্ববাদ। এবং এর সাহায্যেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কোনোভাবেই বিকশিত হতে দেওয়া হয়নি। বরং ‘ভারতীয়’ নামে এক ‘নেশন’ কল্পনাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু বর্ণ ও বহু দেশীয় অঞ্চলের সমন্বয়ে নির্মিত যুক্তরাষ্ট্রকে ‘দেশ’ হিশাবে প্রচার করা হয়েছে। আর এই রাষ্ট্রনৈতিক কৃত্রিম ‘দেশ’ কল্পনার চাপে ও পঁচাত্তর বছরের সীমান্তে বড় বাংলার ভারতীয় অংশগুলির একটা অংশের বঙ্গীয় জনতার কাছে ১৫ আগস্ট শুধুই উৎসবের দিন, স্বাধীনতার দিন, বিজয়ের দিন! পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বড় অংশের মধ্যবিত্তের চৈতন্য থেকে বিস্ময়করভাবে হারিয়ে গেছে বাংলা ভাগের স্মৃতি। কেবল ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার কথা বললে তাঁর চলচ্চিত্রের বাকি অনেক কিছুর প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে কলকাতার বাবু সমাজ বাংলা ভাগের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করলেও তা ক্ষণিকের ‘প্রলাপ’ হয়েই থেকে যায়। জয়া চট্টোপাধ্যায় কিংবা জনম মুখোপাধ্যায়ের মতো দুয়েকজন প্রবীন ও নবীন বাঙালি হিন্দু সমাজতাত্ত্বিক বাংলা ভাগের ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও বেশিরভাগ আকাদেমিশিয়ানই বাংলা ভাগের ব্যাপারে যে ন্যারেটিভে গলা মেলায়, তা অবশ্যই বাবু বাঙালি হিন্দুর ন্যারেটিভ যা আসলে হিন্দু-হিন্দু-হিন্দুস্তানি ন্যারেটিভ, তথা জাতিরাষ্ট্রবাদী ভারতীয় জাতীয়তার অভিসন্দর্ভের সহায়ক বৈ আর কিছু নয়। এই আত্মহননমুখী পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি হিন্দুর শিকড়ে টান যে পড়তে শুরু করেছে তা অসমের এনআরসি চালু করা এবং তারপরে পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি লাগু করার দিল্লির শাসকের চেষ্টা থেকেই স্পষ্ট।
আগেই উল্লেখ করেছি যে অসমে এনআরসির ফলে যত সংখ্যক বাঙালি নাগরিকত্ব হারিয়েছিল, তার মধ্যে হিন্দু বাঙালি হিন্দু বাঙালির সংখ্যা ম্যসলিম বাঙালির তুলনায় অনেকটাই বেশি। অর্থাৎ অসমের এনআরসি প্রমাণ করেছিল, এনআরসির লক্ষ্য বাঙালিদের নতুন করে বিপাকে ফেলা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের বাঙালির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রনৈতিক ভারতীয় জাতিবাদী তথা হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি নিপীড়ন ও আধিপত্যের খেলা শুরু হয়েছে। একদিকে গোটা ভারতে যেমন ইসলামবিদ্বেষ বড় আকার নিয়েছে, তেমনই ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির ওপর ভারতের হিন্দি-হিন্দু জাতিবাদের নিপীড়ন ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজনীতির নয়া প্রবণতা। এর কারণ, বঙ্গদেশ মূলত অবৈদিক, অনার্য ভূমি। এনআরসি বিরোধী আন্দোলন সাময়িকভাবে পশ্চিমবঙ্গের সোকল্ড প্রগতিশীল ও তথাকথিত সেক্যুলারদের দ্বারা দানা বাঁধলেও তা এখন স্তিমিত। কেননা, নিপীড়নের চরিত্রটাই কলকাতার বাঙালি বাবু সমাজ বুঝতে অক্ষম। তাদের ভাবনার নিগূঢ়েও বেসিক্যালি প্যান ইন্ডিয়ান জাতিবাদী রাজনীতিই যুক্তিক্রম তৈরি করেছে, ফলত তারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ‘অপর’ হিসাবে রোল প্লে করছে, যেহেতু ‘অপর’ তাই আ সাথে ভিতরের সম্পর্ক স্বাভাবিক। পঁচাত্তরের ‘স্বাধীনতা’ দিবসকে তাই বুনিয়াদি প্রশ্ন ছাড়াই প্রগতীবাদীদেরও নিজেদের ‘ভারতীয়’ প্রমাণ করার একটা প্রয়াস হিসাবেই হাজির হতে দেখা গেল। ভারতের বিদ্যমান সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় বিকাশের বদলে ঔপনিবেশিক ‘নেশন’ কল্পনাতেই বুঁদ হয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত প্রগতীবাদীরা। তারা নিজেরা নিজেদের জাতি পরিচিতিতে ‘ভারতীয়’ বলে পরিচয় দিতে খুবই গর্ব বোধ করেন।
ভারতীয় বলে নাগরিকত্ব পরিচয়ে কেউ গর্ব বোধ করতেই পারেন। কিন্তু ‘ভারতীয় জাতি’ ব্যাপারটা কী? ইহা খায় নাকি মাথায় দেয়? কলকাতার বাবু বাঙালিরা যদি তাদের জাতীয় কল্পনায় ‘ভারতীয়’ হতে চান, সেটা তাদের ব্যাপার, তারা হতেই পারেন, সেই হতে চাওয়া যতই ঔপনিবেশিক হোক না কেন! সেক্ষেত্রে উচিত হবে তারা নিজেদের বাঙালি পরিচয় দেওয়া ছাড়ুন। প্রথমত ভারতীয় বলে কোনো জাতি হয় না, দ্বিতীয়ত, বড় বাংলাকে নানাভাবে ক্ষত-বিক্ষত করে যে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রনৈতিক কৃত্রিম জাতি পরিচিতি, সেই পরিচিতিকে যারা নিজের ভাষা ও সাংস্কৃতিক সত্তার থেকে আগে স্থান দেয়, সেক্ষেত্রে তাদের নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে পরিচয় দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। বরং বাংলা ভাষার জন্যে যারা জান-প্রাণ দিয়েছে, যারা বাংলা জবানকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র গঠন করেছে তারাই রাজনৈতিকভাবে বাঙালি। এবং ভারতেও যারা নিজের মাতৃভাষা বাঙলার জন্যে, বাঙলার মানুষের জন্যে লড়াই করছে, যারা বাংলায় স্বপ্ন দেখছেন, শিল্প-সাহিত্যে পথ বাতলাচ্ছেন উত্তরমুখের, তারাও রাজনৈতিকভাবে বাঙালি। কিন্তু যে ভদ্রলোক সমাজ, যে বাবু সমাজ ভিতরে কৃষ্ণচন্দ্র রায় কিংবা নবকৃষ্ণ দেবের নবপ্রজন্মের সত্তা লালন করছেন তারা জগত শেঠ আর মিরজাফরের উত্তরসূরী। তাদের পূর্বপ্রজন্মই পলাশীতে ব্রিটিশের সঙ্গ দিয়েছিল। তারাই বাংলার স্বাধীন নবাবের পতনকে সেলিব্রেট করতে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিল!
উল্লেখ্য, এই ‘স্বাধীনতা’ নামক ভারতের যে ডোমেনিয়ন স্ট্যাটাস (পূর্ণ স্বরাজ তো আসে নি ১৯৪৭-এ), তা হাশিল হয়েছিল কেবলমাত্র বাংলা আর পঞ্জাব বিভাজনের মধ্যে দিয়ে। বেঙ্গল প্রভিন্স আর অখণ্ড পঞ্জাবকে দুই টুকরো তার মাঝে স্থাপন করা হয়েছিল কাঁটাতারের সীমান্ত। বেঙ্গল প্রভিন্স দুই টুকরো হওয়ারও অনেক আগেই বড় বাংলা থেকে অসমকে আলাদা প্রদেশ হিসাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। আবার সাতচল্লিশের পরেও ভারতের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ থেকে মানভূমের একটা অংশকে আলাদা প্রদেশ হিসাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে হটিয়ে পূর্ণ স্বরাজ কায়েম এবং সামাজিক সমানাধিকারপূর্ণ, যুক্তরাষ্ট্রীয়-গণতান্ত্রিক এবং সাম্যের যে ভারতবর্ষ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন সুভাষ বসুরা তা চুরমার করে বঙ্গবিভাজন ও পঞ্জাববিভাজনের মাধ্যমে যে ঔপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্রের ধাঁচে ইন্ডিয়ান রিপাবলিক তৈরি হলো, তার মধ্যে গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও ভিতরে ভিতরে ভিতরে লুকিয়ে ছিল হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি জাতিরাষ্ট্রের ভ্রূণ! এবং এই জাতিরাষ্ট্র কায়েমের জন্য খেসারত দিতে হলো বড় বাংলাকে। সাতচল্লিশের বেশ কিছুটা আগে থেকেই বড় বাংলাকে ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু অসম থেকে। বানিয়া, মাড়োয়ারি পুঁজির দ্বারা বঙ্গে তেতাল্লিশের মন্বন্তর এবং ছেচল্লিশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা লাগানোর পর সাতচল্লিশে বেঙ্গল প্রভিন্সকে ভেঙে দুইটি ঔপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্রের অন্দরে মিশিয়ে দেওয়া হলো। এই বিভাজন রাজনৈতিকভাবে উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে বিরাট এক ক্ষত।
১৯৪৭-এর প্রসঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে, বাংলা ভাগ প্রসঙ্গে ১৯০৫-এর কথাও অবশ্য উল্লেখ্য। ১৯০৫-এ রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গদেশকে এক রেখে দুটি বঙ্গপ্রদেশ প্রস্তাবের বিরোধিতা যারা যে কারণে করেছিল, ঠিক সেই একই কারণে তারা বা তাদের মতাদর্শ ও মতাদর্শের ধারক-বাহক উত্তরসূরীরা হিন্দু মহাসভা, কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গ বিভাজনের৷ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান মতাদর্শ ও বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদ যা গত শতকের এক ও দুইয়ের দশকে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসাবে বিকশিত হয়েছিল- যার অন্দরে ছিল হিন্দু চেতনার সহিংস উন্মেষ- এই দুই মতাদর্শই ভারত ভাগের নামে বাংলা ও পঞ্জাব ভাগের সহায়ক শক্তি হিসাবে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করেছিল৷ ১৯০৫-এ যদি ঢাকা আরেকটি রাজধানী হয়ে উঠত কলকাতার সমান্তরালে, যদি বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি নমঃশূদ্রের ক্ষমতায়নের প্রশ্নের মীমাংসা হতো, যদি তাতে বাধ না সাধতেন বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, ঠাকুর, বসু, মিত্র, রায়, সেন, সিংহরা তাহলে দুইটি প্রদেশ সম্বলিত স্বাধীন বঙ্গীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন ছিল ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী ইতিবাচক পরিণতি। তা হয় নাই, পূর্ববাংলাকে আলাদা প্রদেশ ও ঢাকাকে সমান্তরাল রাজধানী হতে দেয়নি সো-কল্ড স্বদেশীরা৷ এই স্বদেশীরা কতটা হিপোক্রিট, মিসোজিনিস্ট ও বর্ণবাদী- তা রবীন্দ্রনাথও টের পেয়েছিলেন, তাঁর উপন্যাসে সে ইঙ্গিত রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীতে এটা টের পেলেও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নামে বাবু জমিদার বর্ণহিন্দু বাঙালির বর্ণবাদী ও বিত্তবাদী রাজনৈতিক সক্রিয়তায় তাঁরও ইনপুট ছিল, দায় ছিল। ইতিহাসের শবব্যবচ্ছেদ থেকে তাঁর সেই দায়ও প্রকাশ্য হয়, আজও। যদিও রবীন্দ্রনাথ সেইটা ঠারেঠুরে স্বীকার করে গেছেন৷ কিন্তু বাবু বাঙালি রাজনীতিকরা ভুল স্বীকার তো দূরের কথা, আজও ইতিহাসের নেতিবাচকতায়, নিজেদের ইগোর পলিটিতে আচ্ছন্ন এবং এরা প্রত্যেকেই প্যানইন্ডিয়ানিজম ও তার অন্তরালে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষে, পরোক্ষভাবে।
পাকিস্তান আন্দোলনের কথা এ প্রসঙ্গে আবারও উল্লেখযোগ্য। বাবু বর্ণহিন্দু বাঙালি ও ভারতীয় জাতিবাদীদের একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে যে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, তা হিন্দু জাতিবাদের পালটা উত্তর ভারতীয় মুসলমানের পরিচয়বাদী প্রস্তাব যতটা না ছিল, তার চেয়েও বড়ভাবে হাজির হয়েছিল বাংলার ভূমিহীন বাঙালি কৃষকের শ্রেণীভাষ্য ও শ্রেণীর ক্ষমতায়ণ হিসাবে। বাংলার ভূমিহীন কৃষকের বড় অংশই ছিল বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি নমঃশূদ্র, তারা হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার, শোষণ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন থেকে থেকে মুক্তি পেতেই পাকিস্তান প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল বাধ্য হয়েই। কিন্তু সম্পূর্ণভাবেও নয়। কেননা, পাকিস্তান প্রস্তাবের পাশাপাশিই ভারত ও পাকিস্তানের সমান্তরালে যুক্ত-বাংলা রাষ্ট্র প্রস্তাব পেশ হয়েছিল বাংলার আইনসভায়। পেশ করেছিলেন শহীদ হোসেইন, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বসু ও কিরনশঙ্কর রায়। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও তাঁর বেঙ্গল প্যাক্টের রাজনৈতিক উত্তরসূরী। ভারত-পাকিস্তানের সমান্তরালে স্বাধীন, সমাজতান্ত্রিক বাংলা রাষ্ট্র গঠনের এই প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল গোটা বাঙালি মুসলিম সমাজ ও বাঙালি নমঃশূদ্র সমাজ। কিন্তু বর্ণহিন্দু বাঙালিদের বড় অংশ ও তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় হিন্দু মহাসভা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল চরমভাবে। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের সমর্থন দিয়েছিলেন যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তিনি ফের চরমভাবে এই প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেন। এবং প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল বা আরএসপি বাদে অন্য কমিউনিস্ট পার্টি-সহ অন্য কোনো কাস্তে-হাতুড়িওয়ালাদেরও এই প্রস্তাবের পক্ষে সায় দিতে দেখা যায়নি। একমাত্র অ-স্তালিনীয় বামপন্থী শিবির আরএসপি সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বোসদের পক্ষে সায় দিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় সোহরাওয়ার্দীকে এক তরফা দায়ী করেন কলকাতার বাবু প্রগতীবাদী সমাজ। অথচ সোহরাওয়ার্দী কলকাতার লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে বসে দাঙ্গা থামানোর সবরকম চেষ্টা করেন। পুলিশ ব্রিটিশের যেহেতু, সোহরাওয়ার্দী তাই ফেইল করেছিলেন বলা যায়। ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাকও হিন্দু নিধনের জন্য দেওয়া হয় নাই। বরং প্রত্যক্ষ সক্রিয়তার স্লোগান ছিল ব্রিটিশ বিরোধী এবং কংগ্রেস বিরোধী রাজনৈতিক স্লোগান এবং তা হিংসাকে উস্কে দেওয়ার জন্যে ছিল না। কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী অংশ, হিন্দু মহাসভা, হিন্দুস্তানি ও বিহারী মুসলিমদের বড় অংশ এবং সুভাষের মতাদর্শ থেকে চ্যুত ফরোয়ার্ড ব্লকের দক্ষিণপন্থী অংশের দ্বারাই দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করে। এছাড়া, ছেচল্লিশের এই ঘটনা, পাকিস্তান প্রস্তাব এগুলো নিয়ে আলাপের আগে মাথায় রাখা উচিত বিড়লা গোষ্ঠী, জোতদার-জমিদার এবং অতি অবশ্যই ব্রিটিশ প্রভুদের সৌজন্যে বঙ্গে ঘটে যাওয়া তেতাল্লিশের মন্বন্তুরের প্রসঙ্গও। তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ছেচল্লিশ এবং স্বাধীন যুক্ত-বাংলা রাষ্ট্র গঠন প্রস্তাব নাকচ হওয়া ইত্যাদি পার করে সাতচল্লিশের যে চোদ্দ এবং পনেরো আগস্ট এসেছিল, তার উপযোগীতা শুধুই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রনৈতিকতাতেই পর্যবসিত ক্রমে, তার উপযোগীতা পূব ও পশ্চিমের বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শত ফেলানী খাতুনের মতো শহীদের রক্তস্নাত রাষ্ট্রসীমান্ত।
আর তাই পনেরোই আগস্টে বিজয়ের বিউগল নয়। পঁচাত্তর বছরের বেদনার বাঁশি বুকে মোচড় দেওয়ার কথা ছিল গোটা বড় বাংলা জুড়ে। কিন্তু রাষ্ট্রকল্পনা ও রাষ্ট্রনৈতিক পরিচয়বাদের আফিম আমাদের মশগুল করে রেখেছে অনন্ত এক ঘুমে। এ আফিম পান করেছে বিশেষত বড় অংশের পশ্চিমবঙ্গবাসী। যারা বৃহৎ বঙ্গের বঙ্গবাসী হওয়ার বদলে রাষ্ট্রনৈতিক পরিচয়কে ‘জাতি’ হিশাবে কল্পনা করতে শিখেছে। তবুও বিশ্বাস, আচ্ছন্নতা একদিন কেটে যায়, নাড়িতে টান পড়লে মূক-বধিরও বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। একদিন নিজের মাটি আর নিজের অস্তিত্বের কথা পশ্চিমবঙ্গবাসী ঠিকই টের পারে। সেদিন বড় বাংলার মজলুম-নিপীড়িতের সাথে একাত্ম হবে পশ্চিমবঙ্গও। জানালা খুলে যাবে। খুলে যাবে সদর দরজা। বিভাজনের ক্ষত সারিয়ে গঙ্গা আর পদ্মার জল-পানি থেকে আবারও জ্ঞান-মৈত্রী-কলা-কৌশলের নৌবহর ভেসে যাবে দুনিয়া জয় করতে। পাল যুগে, সুলতান আমলে, নবাবী আমলে যেমন বাংলা ছিল গোটা বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য জ্ঞান, কারিগরীবিদ্যা, দর্শন, শিল্প-সাহিত্য-কাব্য ও বাণিজ্যের কেন্দ্র। বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে আমার বিশ্বাস। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরবঙ্গ এবং ঈশানবঙ্গও একদিন প্রস্তুত হবে। সেই সুদিনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাংলা ভাগের পঁচাত্তর বছর পার করছি।
হ্যাঁ বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে, এ কথা ঠিক। বাংলাদেশের তরুণ লেখক, এক্টিভিস্ট, চিন্তক, ভাবুক, শিল্পী সমাজ পরিচ্যবাদের উর্দ্ধে উঠে বড় বাংলার ইতিহাসকে নতুন করে পর্যালোচনা করে এক গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত কায়েম করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু, বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে এক লুঠেরা সমাজ, জাতিবাদী সমাজ। যে সমাজ হিন্দুত্ববাদের, হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি সম্প্রসারণবাদের নানা কিসিমের সহায়ক শক্তি। কখনো তা বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে, কখনো আবার মুসলিম জাতিবাদের নামে।
আমি ঢাকায় থেকেছি কিছুকাল৷ সেখানেও ১৫ আগস্ট দেখেছি! তবে আগস্টের ১৫ মানে সেখানে রক্তাক্ত ইতিহাসের দিন এক৷ শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের খতম করা হয়েছিল এই দিনেই৷ সেই হেতু আমার পূর্ববঙ্গে বা অন্য সকলের বাংলাদেশে ১৫ আগস্ট মানে শোকের দিন৷ মানে শোকের দিন হওয়ার কথা ছিল! শোকেরও বৃহৎ আড়ম্বর হয়!! ইয়া আল্লাহ! ঢাকায় দেখেছি ১৫ আগস্ট সারা দিন রক্তাক্ত শেখ মুজিবের লাশের মুখে কারা যেন মাইক আটকায়ে দিয়েছে! ১৫ আগস্ট এলেই বলপূর্বক কারা যেন বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে ভাষণ দেওয়াচ্ছেন ভোর থেকে দুপুর অবধি৷ পাড়ায় পাড়ায় সেই ভাষণ চলছে৷ এবং প্যান্ডেল বেঁধে চলছে বিরিয়ানি খানাদানা! এবং দুপুর থেকে মাইকে তেড়ে বাজানো হচ্ছে বলিউডের নাচানেওয়ালা গান! আহা মুজিবপ্রেম! আহা শোক! তাই, ১৫ আগস্ট আমার কাছে যন্ত্রণার দিন! তা আমি পূবে অথবা পশ্চিমে যেখানেই থাকি না কেন! আমি তাই ১৫ আগস্ট সারাদিন ঘুমাই অথবা বিচ্ছিন্ন থাকি দুনিয়াদারি থেকে৷ সন্ধ্যার মুখে জানলা খুলি। দেখি একটি শালিক পাখি দিব্যি বসে আছে পাঁচিলের ওপর! একটি বেড়াল পাশের বাড়ির উঠানে ল্যাটকা মেরে বসে আরাম করছেন! আমি শান্ত হই।
মাথায় রাখা দরকার, বাংলাদেশের কৃষকেরা, ‘ছোটলোকেরা’, ভূমিনিবিড় মানুষেরা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়ণে দুই-দু’বার দুটি রাষ্ট্র গঠন করেছে। যুক্ত-বাংলা গঠন প্রস্তাব বাতিল হতে তারা জান-প্রাণ লড়িয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেও তাদের লড়াই থেমে থাকে নি। অখণ্ড পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানেরর আধিপত্য, বাঙালি মুসলমানের বাঙালি সত্তাকে খারিজ করার চেষ্টা, বাংলা ভাষার ওপর উর্দু আধিপত্য- এসবের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল পূর্বের ‘নিম্নবর্গের’ বাঙালিরা। যার পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু মুক্তযুদ্ধের সাম্য, গণতন্ত্র ও মানবিক মর্যাদার আদর্শকে সঙ্কুচিত করে রাষ্ট্রনৈতিক জাতিবাদী চেতনা ধীরে ধীরে কায়েম হয়েছে বাংলাদেশে, দিল্লির স্বার্থবাহী রাজনৈতিক পক্ষ প্রবল পরাক্রমে সেখানের ক্ষমতায় আসীন। যারা একই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিম জাতিবাদের পৃষ্ঠপোষক। আবার এর কাউন্টার করতে গিয়ে প্যান-ইসলামিজমের বা সৌদি রাজতন্ত্র দ্বারা সূচিত আধুনিক জাতিবাদী, রাষ্ট্রবাদী ইসলামপন্থার ঝাণ্ডা নিয়ে হাজির হয়েছে আরেক দল। মনে রাখা উচিত, বঙ্গের ইসলামের চরিত্র একই সাথে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, বর্ণবাদ বিরোধী, শ্রেণী বৈষম্য বিরোধী ও লৈঙ্গিক বিভাজন বিরোধী বুনিয়াদি প্রস্তাবনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেমন, ঠিক তেমনই এখানের ইসলামের রূপলাবণ্য বিকশিত হয়েছে বঙ্গের জল-আবহাওয়া-মাটি ও আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বঙ্গের অবৈদিক সনাতনী ধর্মীয় স্কুলগুলোর সঙ্গে অকাতরে আদান-প্রদান চলেছে।
তাই বাংলা বাংলাই। বাংলা আরব নয় তুর্কি নয়, ইরান নয়। এই কথাটা মাথায় রেখেই বড় বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্য ও গণঐক্যের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা ও সক্রিয়তা আগাচ্ছে বাংলাদেশে, এটা এগোচ্ছে বাংলাদেশের জুলুমশাহী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সংগঠিত করার ভিতর দিয়েই। আসলে, মাতৃভাষার প্রশ্ন, নিজ মাটির সংস্কৃতির প্রশ্ন কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক নয়। এটা একেবারেই শরীরবৃত্তিয়। মায়ের ভাষা বাচ্চা মায়ের গর্ভ থেকেই শিখতে শুরু করে, মায়ের কালচারাল অভ্যাস রপ্ত করার প্রক্রিয়াও মাতৃগর্ভ থেকেই। এবং এই ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্ন ক্রমশ জীবনযাপন ও জীবিকানির্বাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এটা বাংলাদেশের মানুষ বুঝেছে তাদের জীবন দিয়ে। তাই ভাষা প্রশ্নকে সামনে রেখে তারা তাদের লড়াই সংগঠিত করেছে ১৯৫২-৭১ অবধি। এখন তাদের লড়াই, গণতন্ত্র, সমানাধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে। একই সঙ্গে সীমান্ত-রাজনীতি তথা রাষ্ট্রবাদী ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক বয়ান যে বৃহৎ গণঐক্যের বিরুদ্ধে গিয়ে বিশ্ব জুলুমশাহী পুঁজির পক্ষে খাড়ায়, এটা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বুঝতে শিখেছে। তাই বড় বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্যের ব্যাপারে আলাপ শুরু হয়েছে। না বড় বাংলার স্লোগান কোনো পরিচয়বাদী রাষ্ট্রনৈতিক স্লোগান নয়, এটা কোনো নতুন করে যুক্ত বাংলা গঠনের স্লোগান নয়, বরং ইহা উপমহাদেশের বাংলাভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক, কারিগরী, জ্ঞানতাত্ত্বিক ঐক্যের আহ্বান।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে আজকে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধুয়া উঠেছে, গর্গ চ্যাটার্জি-সহ আমার বহু বন্ধুবান্ধব যেভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, তাও আসলে বাবু বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদ (যদিও প্যান-ইন্ডিয়ান মনুবাদীরা গর্গের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাঁকে অসমের জেলে বন্দি করার পাঁয়তারা করছে আমরা তারও বিরোধিতা করি)। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সবসময়েই বাঙালি মুসলিম, বাঙালি নমঃশূদ্র ও নৃতাত্ত্বিক বঙ্গীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিপক্ষেই যাবে৷ তাই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান, বানিয়া পুঁজি ও বহুজাতিক ভুবনায়িত গায়েবি লগ্নিপুঁজির বিরোধিতা করতে হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমান্তরালে বাংলার সকল ভূমিসন্তানের গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারের পক্ষে কথা বলতে হবে এবং তাকেও কোনো জাতীয়তাবাদী বয়ানে ফেললে চলবে না, কেননা নিপীড়িত জাতিসত্তা সমূহের গণতান্ত্রিক লড়াই বা নিপীড়িত জাতীয়তাবাদের লড়াই কখনোই জাতিবাদ বা জাতীয়তাবাদ নয়৷ এবং এই লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাসের নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ দরকার। দরকার হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি অতীতের জাতিবাদী রাজনীতির বহমানতাকে পর্যুদস্ত করা। গর্গদের ন্যারেটিভ জাতিবাদী হলেও, এর বাইরে গিয়ে জাতীয় বাংলা সম্মেলন নামে অপর আরেকটি সংগঠন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, সাঁওতালি, রাজবংশী-সহ সকল নিপীড়িত জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকারের পক্ষে লড়াই করছে, যা অনেকাংশেই গণতান্ত্রিক (জাতিবাদী নয়)।
আমরা বড় বাংলার কথা বলছি। ৭৫ বছরের বাংলা সীমান্তের সমান্তরালে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ঈশানবঙ্গ (শিলচর-কাছাড়), ত্রিপুরবঙ্গ, মানভূম ও ধলভূমের যে অপার সম্ভাবনা, তার কথা বলছি। কোনো রাষ্ট্র প্রস্তাবনা আমাদের বয়ানে হাজির নেই। কিন্তু আমরা বলছি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষত সরিয়ে জ্ঞান-কারিগরীবিদ্যা-কলা-সাহিত্য-শিল্প ও অর্থনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে বড় বাংলার গণঐক্য সম্ভব। আমরা সেই সম্ভাবনার দিক নিয়ে আলাপ করছি। এ আলাপ সীমান্তবাদী নয়, এ আলাপ বড় বাংলার মানুষের ঐক্যের আলাপ। বড় বাংলার প্রাণ-প্রকৃতির সমন্বয়ের মাধ্যমে গণ-এর ভিতরে যে পরমের বাস, তাঁর এবাদতের কথা বলছি।
ঋণ-
১। ‘Bengal divided (Hindu communalism and partition- 1932-1947)’- জয়া চট্টোপাধ্যায়
২। ‘ The Spoils of partition (Bengal and India- 1947-1967’- জয়া চট্টোপাধ্যায়
৩। ‘HUNGRY BENGAL (War, famine and the end of empire)’- জনম মুখোপাধ্যায়
৪। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’- শেখ মুজিবুর রহমান
৫। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’
৬। ‘দ্য হিন্দু’
৭। গর্গ চট্টোপাধ্যায় ও সিদ্ধব্রত দাস
৮। অরূপশঙ্কর মৈত্র ও বিশ্বেন্দু নন্দ
বিশেষ কৃতজ্ঞতা-
ফরহাদ মজহার
অতনু সিংহ
কবি, গদ্যকার। ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৮২ সালে জন্ম। বসবাস পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। প্রকাশিত চারটি কাব্যগ্রন্থ ও একটি ছোটগল্প সংকলন রয়েছে।