আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নানি

গল্প। ছবি- অমৃতা শের-গিল।

।। জেসমিন নাহার ।।

হঠাৎ বিলকিসের বিয়ের পূর্বরাতে তার নানির কাছে রিক্তার বলা গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। সে তার নানির হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘আমার বয়েস বারো, রিক্তা বুর মতো আমি অতো পাগল না’ বলেই তার নানিকে ধাক্কা দিয়ে স্বাধীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে যেতে যেতে বলে, বলি কী ” বুড়ো বয়েসে আমাদের বদলে তুই চৌদ্দ গণ্ডা ভাতার ধর, খায়েশ মিটা তবু আমাদের এবার ছেড়ে দে।”

নানি

নানি, আমার যদি বিয়ে করতি হয় তালি আমি নেহালের বড় ভাই স্বাধীন কে বিয়ে করবো। কারণ আমি একদিন আব্বার জন্যি মাঠে ভাত নিয়ে যাওয়ার পতে স্বাধীন আমার জোর করে জড়িয়ে ধরে দুদ টিপে দিয়েলো। একন তুরা আমার বিয়ে ঠিক করচিস দেকচি নেহালের সাতে। আমি এই বিয়ে কত্তি পারবো না নানি। মেরে ফেললিও না। কিরাম হবে বল দিনি! নেহালের বউ হয়ে কোনদিন আমি স্বাধীনির সামনে বেরোতি পারবো? তোর জন্যি আমার তোদের বাড়ি ছাড়তি হলে। একন দেখচি দুনিয়া ছাড়তি হবে।

রিক্তা আর তার নানি ঘরের খাটের উপরে শুয়ে গল্প করছে। রিক্তার সম্বন্ধ চলছে তাদেরই গ্রাম ছাত্রাপাড়ার ওয়ালীউল্লাহর ছোট ছেলে নেহালের সঙ্গে। ওয়ালীউল্লাহ বেশ অবস্থাপন্ন। তার ছোট ছেলে রিক্তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এটাকে রিক্তার বাবা শফিকুল ভাগ্য বলে প্রতিপন্ন করছে। কিন্তু রিক্তা নারাজ।

ভ্যাপসা গরমের মাঝে পাখার বাতাস টানতে টানতে মৈরম নাতনিকে বোঝাচ্ছে, ওরে তুই থাম দিনি। ছেলে মানুষ যুবক বয়সে এট্টু আধটু ওইরাম করে থাকে। অত ভাবলি দুনিয়া চলে! কবে এট্টু জড়াজড়ি করেচে তার জন্যি  এত ভালো সম্বন্ধ ভেস্তে দিতি হবে! নেয়ালদের বাড়ি কতো কি! তোর বাপের কি আচে?

রিক্তার বয়েস চৌদ্দ বছর। এত ছোট বয়েসে সে নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। তার বয়েস যখন দু মাস তখন তার মা গলায় দঁড়ি দিয়ে মারা গিয়েছে। তখন থেকে সে নানার বাড়িতে নানির দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছে। তার যখন বারো বছর বয়েস তখন তার বড়ো মামার দ্বিতীয় বিয়ে হয়, প্রথম বউটি বালাম চালের ভাত থাকলেও দ্বিতীয় বউটা তাদের মনের মতো নয়। রিক্তার মামা বাবুল যেন তাকে বেশি ভালোবাসতে না পারে সেজন্য রিক্তাকে তার নানি ব্যবহার করতো, বাবুল আর তার স্ত্রী মিনি ঘরে থাকলে রিক্তাকে চেয়ারের উপরে দাঁড় করানো হতো বাবুল তার স্ত্রীর সাথে কি করে দেখবার জন্য। দেখে রিক্তা মামা মামির কার্যাবলীর পুংখানুপুংখ বর্ণনা দিতো।

কথায় আছে, চোরের দশদিন তো গেরস্থের একদিন। মিনি একদিন দেখে ফেলে। এবং নির্দেশ দিয়ে দেয় এক সপ্তাহের মধ্যে রিক্তাকে তার বাবার বাড়ি চলে যেতে হবে। রিক্তা বাবার বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হয়। নানার বাড়ির গ্রামের পরিচিত বন্ধুবান্ধব, পরিচিত মাঠঘাট, অলিগলি ছেড়ে তাকে চলে যেতে হলো ছাত্রাপাড়া গ্রামে। প্রথমদিকে মন না বসলেও আস্তে আস্তে মন বসে গেলো। এবং দুটি বছর কেটে গেলো। সে চৌদ্দ বছরে পা দিয়েছে, নবম শ্রেণিতে উঠেছে মাত্র। দেখতে বেশ সুন্দরী, গ্রামের ছেলেরা তাকে পছন্দ করে। কেউ বিবাহের জন্য আবার কেউ যৌন লালসা মেটানোর জন্য। নেহাল তাদের ই একজন। যে তাকে ভালোবেসে ঘরে নিতে চায়। সেই কথাই হচ্ছে রিক্তার নানি মৈরমের সাথে রিক্তার।

মৈরম বলে, স্বাধীন বেটাছাওয়াল, সুন্দরী মেয়ে সামনে পেয়ে রোক সামলাতি পারিনি, কিন্তুক নেহাল তোকে ভালোবাসে, বিয়ে করতি চায় এ সুযোগ হাতছাড়া হতি দিতি পারিনে আমরা গারজেন হয়ে।

রিক্তার হঠাৎ ওর নানিকে বিরক্ত লাগে। বিরক্ত লাগা মাত্র নানির সারাদিন পান চিবানো গাল আর শরীর টাকে অসহ্য মনে হতে থাকে, বোঁটকা গন্ধ লাগে নাকে ঠিক সেই সময় মাথার উপরে ফ্যান চলতে থাকে, কারেন্ট আসে। সে পাশ ফিরে শোয় আর নানাবাড়ির গ্রামটাকে ভাবতে থাকে। তার বয়েসি চারজন বান্ধবী, তাদের সাথে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করা, গাছে উঠে পুকুরে ঝাপ দেয়া, সাঁতার কেটে এপার থেকে ওপারে যাওয়া, পানির নিচে হৈল খেলা, গোসল সেরে বুনো আমড়ার ঝালাই খাওয়া। তারপর হঠাৎ নানির কাজকর্ম তার মনে পড়ে। অসহ্য মনে হয় তার নানিকে, সে উঠে গিয়ে ঘরের মেঝেতে  শীতল পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।

নানি তখনো পাখার বাতাস টানে। হো হো করে হাসে, বলে, ওলো বুইন রাগ করিচিস, বিয়ের পরে তো নানির খোঁজ ও নিবিনে।

রিক্তা রেগে যায়, দাঁড়িয়ে পড়ে নানির পাশে,।।বলে,  মোহাম্মদ আলী ভাই, শাওন ভাই সই বলতো আমাকে, বুনির মতোন ভালোবাসতো, তুই কি বলতিস মিশপিনে ওদের সাথে, ওরা খারাপ করে দেবে তোর, তারা খারাপ করিনি, আমার খারাপ বানাইছিস তুই, বিনিময়ে গ্রামে আসা লাগলে, নিজ গ্রামের মানুষ কতো খোর তা নিজের শরীর যতো বড়ো হতি থাকলে ততো জানা লাগলে। এখন যে বাড়ির এক ভাই আমার পতে পাওয়ার জন্যি ওত পেতে থাকে সে বাড়িতে তারই ছোট ভাইর বউ হওয়া লাগবে! রুমি, শান্তা, ফজিলা এমনকি আমার সইর জীবন কী এমন?

মৈরম বলে, সজ্ঞলার জীবন এরম, সজ্ঞলার উঠতি বয়েসে এরম যাতনাময় ঘটনা আছে সোনা, তুমি বলতি পাচ্চাও আমি তোমার নানি তাই জন্যি আর তারা আজীবন মনের মদ্যি নালন পালন করে বেড়াবে।

রিক্তা চিৎকার করে, বলে, তারা এও বোধাই জানে যে ঘরে তাদের মামারা তাদের বউয়ের সাতে কী করে?

মৈরম চুপসে যায়। বলে অতো কতা কইসনে বুন, সপ করা হচ্চে তোর ভালোর জন্যি, আগে যা করা হয়েচ তা তোর মামার ভালোর জন্যি। বলে পাখাটা জোরে  বামপাশে রেখে ডানপাশ ফিরে শোয়।

রিক্তা গরগর করতে করতে হঠাৎ কেঁদে ফেলে। শুতে শুতে বলে মা নেই তা ছার দুঃখ বোজবে কিডা! তোরা আমার মিত্তু!

রিক্তারা ছয় ভাইবোন। মুক্তা আর রিক্তা মৈরমের বড়ো মেয়ে হায়াতনের মেয়ে, হায়াতন মারা যাবার পরে মৈরম তার সেজোমেয়ে সাহাতন কে বিয়ে দিয়েছে তার জামাই শফিকুলের সাথে। সাহাতনের বিলকিস, সনিয়া, তানিয়া এবং রাজন নামে চারজন ছেলেমেয়ে। বড়ো দুই মেয়ে হায়াতন আর রাহাতনের বাড়িতে মৈরমের প্রভাব ছিলো অনেক। প্রভাব থাকবার কারণেই হায়া মারা যাবার সাথে সাথেই সাহার বিয়ে দেয় জামাইর সাথে, রাহাও বেঁচে নেই কিন্তু তখন তার ছোট দুই মেয়ের কেউ ই বড়ো ছিলো না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেজন্য বিয়ে দিতে পারেনি।

রাহার মৃত্যুর জন্য পাড়ার সকলে মৈরম কে দায়ী করে। বাচ্চা হবার সময় রাহা যখন কষ্ট পাচ্ছিলো তখন যেন বাচ্চা তাড়াতাড়ি হয়ে যায় সেজন্য মৈরম রাহার বুকের একটু নিচে পা দিয়ে চাপ দেয়, বাচ্চা স্বাভাবিক নিয়মে দাই আসবার পরেই হয় কিন্তু রাহা মারা যায়। ঘরে সে সময় উপস্থিত থাকা  সকলে বলে মৈরম পা দিয়ে চাপ দেবার সাথে সাথে রাহা জোরে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলো, মা তুই নিজে আমার আজরাইল! মেরে ফেললি মা তুই আমার!

তখন কেউ রাহার কথায় পাত্তা দেয়নি। কারণ তখন বাচ্চা হওয়ানোটাই প্রধান কাজ ছিলো। কিন্তু দাই পৌছে ছেলে বাচ্চা প্রসব করানো মাত্র রাহা যেন প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। সেই ঘুম রাহার আর ভাঙেনি। আর সকলের কানে বাজতেছিলো, “মা তুই আমার আজরাইল।” তো রিক্তার এই,” তোরা আমার মিত্তু ” শুনে পাশের ঘরে স্বামী সন্তান নিয়ে শুয়ে থাকা সাহাতনের মন খারাপ হয়ে যায়। মুক্তা পাশের বাড়ি বহু কান্ড করে বিয়ে করেছে, যা বাংলা সিনেমারই একাংশ, এখন যদি রিক্তাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে কোন কান্ড ঘটায় তো বেশ খারাপ হবে৷ শাশুড়ি এবং মেয়ের সব কথা শোনার পরেও শফিকুল বলে ওঠে, বিয়ে নেহালের সঙ্গেই হবে। ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ এয়েচে, স্বাধীন কবে কি বয়েসের দোষে একটু করেচে তা ভুলে গেলিই চলে।সাহাতন বরের কথা মেনে নেয়, ছেলেকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে নিজেও একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে সবাই ঘুম থেকে ওঠে, চারিদিকে করোনা মহামারী, কেউ কারো বাড়িতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যায় না, মৈরম লকডাউন দেবার আগে মেয়ে-জামাইর বাড়ি এসেছিলো, দুবার বাড়িতে যাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু ছাত্রাপাড়া গ্রাম থেকে কোন মতে বের হতে পারে নি। কিন্তু গ্রামের মানুষের চুরি করে চায়ের দোকানের আড্ডাবাজি চলে চায়ের দোকানদারদের বাড়িতে বাড়িতে৷ কৃষকরা মাঠে যায়, ব্যবসায়ীরা ক্রেতার অপেক্ষায় থাকে, তারা ফোন দিলে যে কোন উপায়ে দোকান খুলে সেই জিনিসটা দিয়ে আসে। এরকম পরিস্থিতিতে রিক্তার বিয়ের প্রস্তাব মাঠেই দিয়েছিল ওয়ালীউল্লাহ৷  নেহাল কে বিয়ে দিতে চায়নি স্বাধীনের আগে, কিন্তু নেহাল বিবাহের জন্য ঘরে দরজা দিয়েছিল। বিয়ে না দিলে মারা যাবে প্রতিজ্ঞা করে ঘরে দরজা দিলে নিরুপায় ওয়ালীউল্লাহ ছেলেকে বাঁচাতে বিয়ে দেবার জন্য রাজি হয়।

মাঠের এই পথ দিয়েই রিক্তা ওর বাবার জন্য ভাত নিয়ে যেতো। আর এই পথেই একদিন স্বাধীন ওকে লজ্জার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো অথচ নানা বাড়িতে অহরহ সে মাঠে ভাত নিয়ে গিয়েছে তার নানা-মামার জন্য কিন্তু রাস্তা কতো আনন্দদায়ক নির্ভয় ছিলো। চারিদিকে মানুষ তাকে দেখে কেউ বউ, কেউ খালা কেউ বোন বলে সম্বোধন করেছে কিন্তু ছেলেদের মাঝে যে লালসা তা সে বুঝেছে তার বাবার গ্রামে এসে। সকালে সব ভাইবোন উঠে গেলেও সে ঘরে ঘুপটি মেরে শুয়ে আছে। তার নানির সামনে সে পড়তে চাচ্ছে না। মনে মনে কোভিড-১৯ কে গালি দিচ্ছে, স্কুল খোলা থাকলে তার এই বয়েসে বিয়ে হতো না। শিক্ষকরা তাকে বাঁচিয়ে দিতেন।ভাবছে বিয়ে করতে তার কোন সমস্যা নাই, কিন্তু নেহাল কেন! স্বাধীন কেন না যে তাকে শারীরিক নির্যাতন করেছে তার বাড়িতে কেন তাকে তারই ছোট ভাইয়ের বউ হয়ে যেতে হবে?

মৈরম ঘরে এসে তার প্রিয় নাতনিকে এভাবে মুখ বালিশে গুঁজে উপুড় হয়ে থাকতে দেখে বলে, উঠরে রিক্তা, যে তোর সনমানে আঘাত করেচে তার বউ ক্যান তুই হতি চাচ্চিস! ওকে দেকিয়ে ওর ভাইর ঘর করবি সুকেশান্তিতে তবে তার জ্বালা বাড়বে। রিক্তা মুখ তুলে বলে পরে পতিদিন আমাকে চোখ দিয়ে ধর্ষণ করবে!

চাচের বেড়ার ঘরে একটা টিকটিকি টিক টিক করে ডেকে ওঠে, বিলকিস ঘরে ঢুকেই বলে, ঠিক ঠিক। সে জানেনা নানি আর বোনের মধ্যে আসলে কি কথা হয়েছে, ঘরে ঢোকামাত্র টিকটিকির শব্দে সে ঠিক ঠিক বলে উঠেছে।

ঘরে ঢুকেই সে রিক্তার মাথার পাশে বসে বলে, বু তুই লাজশরমের মাথা খেয়ে কাইল রাত্তির যা কলি নানির সাথে সপ আমরা শুনিচি। আমিও তো বিটা মানুষদের জন্যি আব্বার ভাত বহুত কষ্টে মাঠের রাস্তা না দিয়ে গিয়ে বিল পেরোয়ে যাই। দোকানে কোন কিছু কিনতি হলি আমি ছেলেপিলেদের দিয়ে কিনাই। তা তোর সত্যি কথায় কোন কাজ হবে না বু৷ আব্বাও শুনেচে, শুনেও তোর বিয়ে ওই নেহালের সাথেই দিব্যানে। চল বু আমরা পালিয়ে এই গিরাম ছেড়ে চলে যাই। সেকেনে যাবো যেকেনে কোন বিটা মানুষ নে।

মৈরম বিলকিসের কথা শুনে বলে এখন ভাল লাগজে না, বিয়ে হোক তখন দ্যাখপানি নাতনিরা আমার বাড়িতেই আসতে চেব্যান না।” 

রিক্তা রেগে গিয়ে যেই নানির কথার প্রতিবাদ করতে যাবে সে সময় সাহাতন ঘরে আসে। হাড়া থেকে চাল বের করতে করতে বলে আমি খালা বলে আমার সঙ্গে মনের কতা কিচ্চু বলিসনে রিক্তা? বিলকিস জবাব দেয়, মেয়ে বলেও তো কিচ্চু বলিনে মা! সাহা হাড়িতে চার কোটো চাল নিয়ে হাড়ার পাশে দাঁড়িয়েই মৈরমের দিকে তাকিয়ে বলে, দেকলি মা  বুর মেয়েদের থেকে আমার মেয়েদের কতো কতা!

রিক্তা হেসে ফেলে বলে, তোমার বুর মেয়ে, তোমার মেয়ে বাদে তোমার মার আরেকটা বিয়ে দ্যাও দিনি মা, তার ও মনের মতো একটা বর হয়, মন শান্ত হয়, মেয়েদের আর নাতনিদের ভালো বরের হাতে বিয়ে দুয়ার সাধ টাও মিটে যায়। সাহা তাড়াতাড়ি চাল নিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে বলে নে মা তুই কতা শিকাইচিস আমার মেয়েদের তুই শোন একন ওদের রঙের ঢঙের কতা, তবে দেকিস আমার মতো মনের অসুখ নিয়ে যেন আমার মেয়েরা চিরদিন মরে না৷ রিক্তা উঠে বাইরে যায়। সাথে বিলকিসও চলে যায়। বারান্দায় বিলকিস তার ভাইকে কোলে নিয়ে,”আমাল সোনা ভাই, আমাল সোনা ভাই” বলে আদর করতে থাকে, পায়ের উপরে শোয়ায়ে মাথায় ছোট সরিষার বালিশ দিয়ে পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে গাইতে থাকে,

ঝা গুড় গুড় ঝাইয়া
পুঁটি মাছের বিইয়া
তাল তলা দে স্রোত যায়
পুটি মাছে গীত গায়
ও দুলালের মা শেয়ানা মেয়ে
ঘরে রাখলে ভালো দেখাই না।

সনিয়া আর তানিয়া এসেও বোনের সাথে গাইতে থাকে। গাওয়া শেষ হলে শিশু ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করে সোনার ঘাটে যাবা না রুপার ঘাটে যাবা ভাই?

ভাই খিলখিল করে হাসে, ছোট দুই বোন চিৎকার করে বলে সোনার ঘাটে যাবে, সোনার ঘাটে।

বিলকিস ভাইকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে ওলে বাবালে, ওলে বাবালে ভাইকে সোনাল ঘাটে দিয়ে দিলাম লে।

বোনদের আনন্দ রিক্তা কলে দাঁড়িয়ে ব্রাশ মুখে দিয়ে দেখতে দেখতে হাসে, মৈরম মুখে পান দিয়ে ঘর থেকে বের হয়। বের হয়ে সনিয়ার হাতে দশ টাকা দিয়ে বলে যা বু পান কিনে আনগে দিন দশ টাকার৷

সনিয়া বলে না না আমি যাবো না, পান ওয়ালা শুধু আমাকে কোলে বসিয়ে বুকে হাত দেয় আর বলে এগুলো বড়ো হলি তোরে ধরে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আমি পুষতাম। মৈরম  নাতনির মুখ চেপে বলে চুপ যা মেয়ে, লিটন না তোর চাচা হয়। এসব বলতি আচে চাচার নামে! আর চাচা তোর মেয়ের মতো পুষতি পারে না?

রিক্তা মুখ ধুয়ে তখন ঘরে চলে আসে, বলে দেখলি নানি, যা আমাদের অপছন্দ তাই তোর পছন্দ।কি মনে হয় জানিস, মুক্তা বু নিজের পছন্দে বিয়ে করে বেঁচেচে, আর আমাদের চারবোনের কপালে যে তোকে তোয়াক্কা না করবে সে বাঁচপে আর নয়তো সপ কয়ডার কপালে আত্মঘাতীর চিহ্ন আছে। বলে ব্রাশ টা টিনের চালের বাতায় গুজে মুখ টা ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে একঘর পেরিয়ে তার বোন মুক্তার বাড়িতে চলে যায়।

মুক্তার মাটির ঘর, মাটির রান্নাঘর৷ রান্নাঘরে বসে সেমাই রান্না করছে, পাশে মুক্তার বর রফিক তাদের ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছে, বউয়ের রান্না হয়ে গেলে খাবে। সকাল সকাল শালি যে!  আমার বাড়ি, বলে রফিক পিঁড়ি এগিয়ে দেয় বসবার জন্য।

রিক্তা বসেই কেঁদে ফেলে, মুক্তা হেসে দেয়, বলে বিয়ে হবে সেজন্য কানচিস! কান্দিস নে, এক গিরামেই তো দুই বোন থাকপো। মজা হবে। রিক্তা বুঝতে পারে তার মনের বেদনা কেউ বুঝতে পারবে না। তাই সে চোখ মুছে ভাগ্নে কোলে নেয়। ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে বলে এট্টা চুমু ও দেয়া যাবে না, সোনা মামার মুখি এট্টা চুমুও দেয়া যাবে না! যদি আমি মরে যায় তো কেউ তোমাকে খালার আদর দেবে না কেউ না! মুক্তা আবার হাসে, বলে আমরা মার আদর পাইনি কিন্তু আমাদের ছেলে মা খালা দুটোর আদর ই পাচ্চে।

মুক্তা চুলা থেকে সেমাই নামায়, রফিক চামস আর প্লেট তার দিকে এগিয়ে দেয়। রিক্তা তার ভাগ্নেকে বোনের কোলে দিয়ে দোলাভাইকে সেমাই বেড়ে দেয়, সেমাই নিয়ে রফিক বলে এই প্লেট আব্বাকে দিয়ে আসি, রফিক উঠে গেলে রিক্তা বলে, বু তুই আমার বিয়েটা যে কোন মতে ঠেকাই দে, আমি ওই বাড়ি বিয়ে করতি চাইনে, আব্বা, খালা আর নানির বহুত পছন্দ। বিয়ে যেন ভেঙে যায় সেজন্যি আমি স্বাধীন কে বিয়ে করতি চালাম কিন্তু নানির মন তাতেও গলে না। আর শুদু আমি না বু, বিলকিস আর সনিয়াও মানুষের চোখে পড়া শুরু করেচে, ক্যান জানি মনে হচ্চে বু তুই আর বিলকিস বাদে সনিয়া, তানিয়া আর আমার মৃত্যু আমাদের নিজেদের হাতে৷  বিলকিস তোর মতো চেহারা নিয়ে জন্মেচে অথচ আমরা তিনবোন মার চেহারা নিয়ে জন্মাইচি।


মুক্তা হেসে উড়িয়ে দেয় রিক্তার কথা। রফিক রান্নাঘরে এসে বলে তো নানিকে ডেকে আনি মুক্তা। একসাথে খাই সবাই। দুবোনেই মাথা নাড়ে, বলে যাও। রফিক শ্বশুর বাড়িতে নিজে না গিয়ে ভাইপো পাঠায়, মৈরম চলে আসে তীরবেগে তার বাড়িতে৷ এসেই বলে ভাই রফিক এক তাড়া পান এনে দ্যাও আগে তারপর সকালের খাওয়া৷ মুক্তা বলে সেমাই খেয়ে তারপর যাক নানি। মৈরম বলে জোয়ান ভাই আমার খাওয়ার আগে পান আনবে, খেয়ে পান খাবো মচ্চিমুলামে৷

রফিক পান আনতে চলে যায় সাইকেল নিয়ে। রিক্তা তার নানিকে বলে নানি ওয়াদা কর, বিয়ে তুই ভাঙবি নয়তো আমি মরে যাবো। দুটো মেয়ের পর যার কবর দিবি সে নিশ্চিত আমি। রিক্তার কথাই কেউ পাত্তা দেয় না৷ তবে মুক্তা তরকারি গরম করতে করতে উদাসীন হয়ে যায়।

রিক্তা তখন প্রথম প্রথম গ্রামে এসেছে। বাড়িতে আসতো আগে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে, আর তখন থেকে নিয়মিত থাকবে বাড়িতে।তার ও মন টেকে না বাড়িতে তার মা বাবাও তাকে সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে তার বাবারই যেন একজন বাড়তি সদস্য মেনে নিতে বেশি অসুবিধা। রিক্তা তখন বাড়িতেই বসে থাকতো বেশি।

একদিন সাহাতন আর শফিকুল ঝগড়া বাঁধায়। কিন্তু সেদিন রিক্তা মুক্তার বাড়িতে ছিলো। দু বোন বাড়িতে ফেরে একসাথে, ফিরে ঘরের বারান্দায় ওঠে শোনে তারা ঝগড়া করছে,তাদের ঝগড়া ঘরের ভেতর থেকে বারান্দায় আসছিলো কিন্তু বারান্দার বাহিরে যাচ্ছিলো না।

শফিকুল বলছে রিক্তাকে ওর নানি বাড়িতে আবার পাঠিয়ে দে সাহা, সাহাতন বলছে আমি পারবো না, জন্ম দিইচিস খাওয়াতি পারবি নে? শফিকুল বলে মাগি বেশি কথা বললে একেবারে বুনির মতো মেরে গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে দোব, কেউ জানতি পারবে না, তখন মেয়ের গুষ্টি সব নানার বাড়িতেই থাকপে, আর তোর আচে না একটা ছেড়ে দেয়া বুন রেশমা ঐডা তোর মা আমার বাড়ি পাঠায়ে দেবে।

সাহাতন কেঁদে ফেলে, কাঁদতে কাঁদতে বাইরে বের হয়ে দেখে বারান্দায় রিক্তা আর মুক্তা, তাদের দেখে আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি চলে যায়, রিক্তা মুক্তাকে বাড়ি পাঠায়ে দেয়, মুক্তা বাড়িতে বসে কাঁদতে থাকে আর রিক্তা নিজের মাঝে নিজে সান্ত্বনা নেয়, যে তাকে পরিবারে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করে নিতে হবে। মায়ের খুনি বাবা, বাবার মেয়ে সে, নানি বাড়িতে মামি তাকে শত্রু জ্ঞান করে, দোষ নানির থাকা সত্ত্বেও। সুতরাং বাড়িতে থেকেই  বাড়ির সবটুকু, গ্রামের সবটুকু ভালোবেসে নিতে হবে।

আর সাহাতন বাবার বাড়িতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো মৈরম কে যে মা, হায়া বুকে শফিকুল মেরেছিলো কিন্তু মৈরম মেয়ের মুখ চেপে ধরেছিলো। মুখ চারজনই বন্ধ রেখেছে। হঠাৎ অতীত মনে পড়ে মুক্তা কাঁদতে থাকে, মৈরম বলে ওঠে তোদের জ্বালাই মলাম দেখছি। একজন করে ঝগড়া আরেকজন করে কান্না।

ওদিকে শফিক পান আনতে গিয়ে রাস্তার অর্ধেকের বেশি যেতে পারে না। পুব পাড়ার নূর হক মল্লিকের বাড়ি তার স্ত্রী এবং ছোট মেয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত। তারা ঘরে আবদ্ধ থাকলেও বাড়ির অন্য সদস্যরা মাঠে, ঘাটে দরকারি কাজে বাজারে যাচ্ছে। সেজন্য পাড়ার মানুষ গ্রামের ফাঁড়িতে জানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ এসে নূর হক মল্লিকের বাড়ি ঘেরাও করেছে যেন তারা পরিবারের সকল সদস্য খুনি। পুলিশ একটা পর্দা টাঙিয়েছে নূর হকের বাড়ি ঢোকবার রাস্তায়, পর্দার একপাশ থেকে নূর হকের বাড়ির সদস্যারা আর অন্যপাশ দিয়ে পুলিশের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে। পুলিশ বলছে, আপনারা কেউ বের হতে পারবেন না, গ্রাম পুলিশ পাঠিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না, তাই আমরা আসলাম। নূর হক বলছে, না বেরোলি খাবো কি করে! আমরা না হয় আলু ভর্তা ডাইল খালাম কিছুদিন, আমাদের গরু ছাগলের খৈল ভুসি কিনা লাগে, মাঠে ঘাস কাটতি যাওয়া লাগে, বউ মেয়ের ঔষুধ পত্তর কিনা লাগে, আপনারা তো দেখচি খালি হাতে আসলেন, কেউ তো বলছেন না টাকা দেন কিনে এনে দিচ্চি, কাঁচি দেন ঘাস কেটে দিচ্চি, এগুলো আমরা করব না তো কি গার বাউনে করে দেবে? আমার মেয়ে বউ ঘরে বন্দী করে রাকিচি, আমাদেরও দরকার পড়লি কোভিড পরিক্ষা করেন নয়তো কাজ করতি দেন। আর নয়তো একজন মানুষ দেন যে সাহায্য করতি পারে। পুলিশ রা রেগে যায়, বলে বাহারে, করোনা বাড়ি পুষেচেন আবার মানুষ চাচ্ছেন কাজের!

নূর হক ও উত্তেজিত হবে এরকম সময় নূর হকের বড়ো মেয়ে বলে, সমস্যা নেই আমি কোভিড পরিক্ষা করতে দিইচি, তিন দিনির মদ্যি রিপোর্ট দেবে, এই তিনদিন বাজারের চৌকিদার হানেপ ভাইকে বলেন আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবস্থা করবার জন্যি, আর পাড়ার মানুষ কে বলেন যে হারে তাদের ঠান্ডা সদ্দি লেগেলো তা ওই কোভিড-১৯ ই,  আমরা পরিক্ষা করাইচি আর তারা করাইনি। কি একটা  অবস্থা! আমাদের গরু ছাগল গুলোর কথাও কেউ চিন্তা করচে না। নিষ্ঠুর মানুষ হয়, এতো হয় যে  তা অজানা৷ বাড়ির যারা আক্রান্ত তারা বন্দী, বিষয় টা কেউ বুঝার চেষ্টা করচে না।

না বেরোলি খাবো কী করে! আমরা না হয় আলু ভর্তা ডাইল খালাম কিছুদিন, আমাদের গরু ছাগলের খৈল ভুসি কিনা লাগে, মাঠে ঘাস কাটতি যাওয়া লাগে, বউ মেয়ের ঔষুধ পত্তর কিনা লাগে, আপনারা তো দেখছি খালি হাতে আসলেন, কেউ তো বলছেন না টাকা দেন কিনে এনে দিচ্চি, কাঁচি দেন ঘাস কেটে দিচ্চি, এগুলো আমরা করব না তো কি গার বাউনে করে দেবে? আমার মেয়ে বউ ঘরে বন্দী করে রাকিচি, আমাদেরও দরকার পড়লি কোভিড পরীক্ষা করেন নয় তো কাজ করতি দেন। আর নয়তো একজন মানুষ দেন যে সাহায্য করতি পারে।

এরকম বাক বিতন্ডার মাঝে শফিক ফিরে বাড়ি চলে আসে, সব ঘটনা বলে, মুক্তা তাদের খেতে দিতে দিতে বলে তুমি বলতে তুমি তাদের কাজ গুলো করে দুবা। ছেলে নেই একটাও চাচার। দুই মেয়ে খালি। রোজিনা তো ঠিক কথাই বলেচে, মানুষ নিষ্ঠুর। শফিক বলে কিচু তো বলিনি তুমি যদি আবার ঘরে ঢুকতি না দ্যাও সেই ভয়ে। তা কচ্চ যখন তখন যাবানি চাচার গরু ছাগলের ঘাসগুলো কেটে দুবানি। বাজার ডা করে দিয়াসপানি।

তাদের খাওয়া শেষ হলে মৈরম খালি চুন সুপারি গালে দেয়, তা দেখে রিক্তা রেগে যায়, বলে গিরামের এরকম একটা করুন ঘটনা শুনেও নানি তোর পান চাবাতি ইচ্চে করচে? চাবা বেশি বেশি পান চাবা। বেশি বেশি চাবাতি থাক। সে সময় বিলকিস দৌড়ে রান্নাঘরে ঢোকে, রিক্তার একেবারে গায়ের সাথে মিশে বেশ জোরে তার কানে কানে বলে বু আজ রাত্তির তোর বিয়ে। নেহালের বাপ ফোন করেলো আব্বার কাচে। আব্বা বললে গভীর রাত, প্রায় বারোটার দিকে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করতি হবে।রিক্তা বিলকিস কে জড়িয়ে ধরে, বলে তাহলে তো আজ রাতে বিলকিসের ভালো ভালো খাওয়া। বিলকিস বলে মানে বু রাজি…

রাতে রিক্তার বিয়ের আয়োজন চলে। শফিকুল গিয়ে মুক্তা আর রফিক কে নিয়ে আসে বাড়িতে, নিজেদের ভাইদের জানিয়ে রাখে, ধরা বিয়ে। নেহাল ভালোবেসে রিক্তাকে বিয়ে করলেও স্বাধীন এইটা শুনে মেজাজ খারাপ করে। সে বুঝতেও পারেনি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজন করা হবে। সে কাউকে বলতেও পারছে না রিক্তাকে সে নির্যাতন করেছিলো, ভালোবাসে না কিন্তু রিক্তার শরীরের প্রতি তার আকর্ষণ আছে। বিয়ের পরে নিজের ভাইয়ের স্ত্রীর প্রতি না হলেও নিজের ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করা হবে। ভাবলো নেহালকে বলবে যে ভাই তুই রিক্তাকে বিয়ে করিসনে৷ রিক্তার থেকেও অনেক ভালো মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দেয়া হবে। তারপরেই ভাবে রিক্তারো তো দোষ নেই। যা হবার হবে বলে সে চুপ থাকে। বাবার সাথে ছোট ভাইয়ের বিবাহের আয়োজন করতে থাকে, ঠিক হয় মায়ের কানের দুল, মায়ের নাকফুল আর চুড়ি আর গ্রামের শাড়ির দোকান থেকে ভালো শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ কিনে বিয়ে করতে যাওয়া হবে। রিক্তা বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলে আর বাঁধা দেয় না।

মুক্তাকে বলে চারিদিকে লকডাউন তুই আমার বিয়েতে কী দিবি? কোন দোকান থেকে কিনবি আমার বিয়ের উপহার? বলি কি পাড়ার দোকান থেকে এক কৌটা বিষ উপহার দে। মুক্তা হেসে বলে, বিষ তো আজ রাতে বর খাওয়াবে। মৈরম বিবি ছোট নাতনিদের নিয়ে ঘর বাড়ি পরিস্কার করে ফেলে। সে খুশি নাতনি বড়োলোক বাড়ি বিয়ে হচ্ছে। রিক্তার বিয়ে সারা পাড়া জেনে গেলো৷ তার পাড়ার বান্ধবীরা এসে আনন্দ করতে শুরু করলো। রিক্তা বান্ধবীদের নিয়ে পেয়ারা গাছে বসে বসে একটার পরে একটা পেয়ারা খেতে শুরু করলো। তারা প্রায় দু ঘন্টা ধরে পেয়ারা খেয়েই চলে৷ সাহাতন দেখে বলে ওরে অতো পেয়ারা খাসনে আজ, পেট খারাপ করবে৷ তারা কোন কথাই কান দেয় না৷ দূরে দূরে বসে যেন কোয়ারেন্টাইন মেইনটেইন করছে এভাবে পেয়ারা খেতে থাকে৷ বেলা বাড়তেই বান্ধবী রা একে একে রাতে আসবে বলে বাড়ি ফিরতে শুরু করে৷ একজন কে রিক্তা বলে, জলি আমার একটা কাজ করে দে, দোকান থেকে ইন্দুর মারা ঔষধ কিনে এনে দে, ঘরে অনেক ইন্দুর হয়েচে। জলি বলে আইচ্চা, টাকা দিতি হবে না তোর, ইন্দুর মরা বিষ তোর বিয়ের দিন আমি দিলাম। বিষ নিয়ে রিক্তা ঘরে বসে থাকে। সারাদিন বোনদের হুড়োহুড়ির মাঝে দিন কেটে যায়। রাতে বিলকিস বাদে সনিয়া আর তানিয়া ঘুমিয়ে যায়। শফিকুলের বাড়ির আর পাড়ার মানুষ আর বরযাত্রী দশজনের জন্য খাদ্যের আয়োজন করা হয়। রাত এগারোটার দিকে চারিদিক নির্জন হলে বরযাত্রী আসে, বিয়ে হয়ে যায় বারোটার আগে, সব আয়োজন শেষ করে ওয়ালীউল্লাহর বাড়িতে পৌছাতে রাত দুটো বেজে যায়। ওয়ালীউল্লাহ অবস্থাপন্ন মানুষ। তার ঘরবাড়ি সুন্দর। সবকিছু দু’ ছেলের জন্য আলাদা আলাদা। রিক্তাকে নেহালের ঘরে বসানো হয়। নেহাল ঘরে ঢুকে বরের সাজ খুলে বলে, বসে আচো যে, শুয়ে পড়ো। রিক্তা শুয়ে পড়ে। রিক্তার সাথে যায় মৈরম বিবি। মনের আনন্দে সে ঘুমায়। বলাবাহুল্য রিক্তা তার আদরের নাতনি, তার আনন্দে সে সুখী।

সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে গোসল সেরে রিক্তা ওর শাশুড়ির কাছে রান্নাঘরে গিয়ে বসে। শাশুড়ি বেশ খুশি হয়। রান্নাঘরে রিক্তা ঢোকামাত্র তার ভাসুর স্বাধীন ও ঢোকে। রিক্তা কোন প্রকার লজ্জা পায় না৷ মাথার ঘোমটা একটু টেনে দেয়। শাশুড়ি কে বলে, মা আমি কিচু করব। শাশুড়ি বলে ঝাল পেয়াজ রসুন বেছে বেছে ধামায় তুলে রাখতে। আর জিজ্ঞাসা করে, তোমার নানি কী একটু খবরদারি পচন্দ করে? সকালে উঠেই স্বাধীনকে নানান কথা বললো।

রিক্তা লজ্জা পায় সাথে বিব্রত হয়। স্বাধীন রিক্তার দিকে তাকিয়ে হেসে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, থাক মা, ও কিচু না। রিক্তা স্বাধীনের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ লাল টকটকে। যেন লালসা ঠিকরে বেরোচ্ছে। নেহাল কাজ ভালোবাসে, কাজের প্রতি ভালোবাসার জন্য সে  লেখাপড়া ভালো মতো করেনি। ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়েছে৷ আর স্বাধীন অনার্স পাশ করে বাড়িতে আছে প্রায় দশ মাস হলো। রেজাল্টের আশায় বসে আছে৷ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নাকি এরকম দেরিতেই রেজাল্ট দেয়! নেহাল নতুন বউয়ের প্রতি ভালোবাসায় কাজ ফেলে বউয়ের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায় না। এইটা রিক্তার জন্য আরো কাল হয়ে দাঁড়ায়৷ স্বাধীন তাকে নানান ভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। রিক্তা বুদ্ধিমতী তাকে বাঁচিয়ে চলে। খেতে বসে শ্বশুর-শাশুড়িকে বলে বড়ো ভাইয়াকে একটা বিয়ে দেয়া হোক এইবার। নেহাল বলে হ্যাঁ, ভাইতো প্রেম করে, মা এইবার মিতানুরের সাথে ভাইর বিয়ে ডা দিয়ে দ্যাও। মিতানুর তাদের মামাতো বোন। স্বাধীন বলে সে মাস্টার্স পাশ করে বিয়ে করবে। তখনই নেহাল বলে ফেলে তালি আমার বউয়ের দিকে কু-দৃষ্টি দিসনে। আজ সকালে রিক্তার গোসলের সময় তুই অনেকবার কলে ঢুকবার চেষ্টা করেচিস। নানি আমার সাতে বলেচে৷ মৈরম অপ্রস্তুত হয় না, গালে ভাত নিয়ে চাবাতে চাবাতেই হেসে বলে, দেকো দিনি বলিচি নাই একটু তাই তুই বলবি সজ্ঞলার সামনে! সবাই চুপ হয়ে যায়। নিরবে খেয়ে উঠে যায়। পরেরদিন তারা বাবার বাড়িতে চলে আসে।

বাড়ি ফিরে রিক্তা নেহালের যত্ন নেয়, নেহালেরও বাড়ি বা মাঠে যাবার তাড়া নাই। সেও বউকে সময় দিতে পেরে আনন্দিত হয়। রফিক আর মুক্তা তাদের সাথে গল্প করে, বিলকিস, সনিয়া আর তানিয়া দুলাভাইদের গায়ের উপরে উঠে বসে থাকে। শ্বশুরবাড়িতে এসে নেহাল রফিককে বলে চলো ভাই নিজের গিরামে নতুন শ্বশুরবাড়ির এলাকায় ঘুরে আসি একটু। রফিক তাড়াতাড়ি সাইকেল বের করে নেহালকে নিয়ে বের হয়ে যায়। পথে যেতে যেতে নূর হকের বাড়ির গল্প করে দুজন। রফিক বলে কিডা জাইনতো তুমি আমার ভাইরা হবা!  তোমাকে সাইকেলে চড়ায়ে নূর হক কাকার গল্প বলবো। নূর হকের গল্প বলতে বলতে নূর হকের বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসে। তারা দুজনেই নূর হকের বাড়ি ঢুকে যায়, দেখে নূর হকের স্ত্রী জরিনা খাতুন মারা যাবার মতো পড়ে আছে, তাকে বাইরে রাখা। দুই মেয়ে আর নূর হক কাঁদছে, পাড়ার অনেক কে ফোন দিয়েও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ নেহাল বলে পাগল নাকি, সে ৯৯৯ তে ফোন দেয়, তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্সের ব্যাবস্থা করে, এম্বুলেন্স পথে থাকা অবস্থায় জরিনা বিবিকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে, নেহালের বাবা এই খবর শুনে রাস্তায় ছেলের জন্য আকুপাকু করতে থাকে, পাড়ার মানুষ রাস্তায় জড়ো হয়, হঠাৎ তারা কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা ভুলে যায়। লকডাউন ভুলে যায়। নূর হক আর তার বড়ো মেয়ে অথর্ব হয়ে যায়, তারা কিছুই করতে পারে না। রাস্তায় থাকা অনেকে বলে দূর যা, মানুষ আগে নাকি করো না! হুড় হুড় করে কয়েকজন মহিলা চলে আসে তার বাড়িতে। ঘরে গিয়ে শাড়ি শায়া ব্লাউজ খাটের পাশে রাখা ব্যাগে ভরে দেয়। এম্বুলেন্স চলে আসে, জরিনা খাতুন কে তুলে দেওয়া হয়। নূর হকের বাড়ির সমস্ত কাজ তারা দুই ভাইরা করা শুরু করে। এই খবর সমস্ত গ্রাম রটে যায়, পুলিশ খবর পেয়ে এসে দেখে বাড়ির সামনে অনেক মানুষ, তারা তাদের বাড়ি পাঠায়, নেহাল আর রফিককে বকা দেয়, বলে নিজের জীবন এভাবে বিপদের মাঝে ফেলে কেউ! তারা পুলিশের কথায় কান দেয় না।

এই খবর শফিকুলের বাড়ি পৌছায়৷ শফিকুল তখন বাজারে, তার বাড়িতে তখন ঝগড়া চলছে। রিক্তা এবং মুক্তা তাদের নানির সাথে ঝগড়া করছে। কেন সে নেহালকে স্বাধীনের কথা জানাতে গেছে। তার নানি মৈরম বিবি হার মানে না। সে বোঝাতে চায় সবকিছু রিক্তার ভালোর কথা ভেবে করেছে। বলে সব তোর ভালোর জন্য করেচি, বলেচি যেন তারা দু ভাই তাড়াতাড়ি আলাদা হয়ে যায়, তোর কাজ কম হয়, সংসার হয়। রিক্তা তখন বলে ফেলে বাহারে, আমার মার সংসার ভেঙে তুই আমার সংসার গড়ে দিতি চাস? আমার মা তোর পতিযোগি হয়ে গিয়েলো বলে প্রাণ দিতি হলে, আর তুই আমার মমতা দেখাস, তোর নোংরা মমতা দেখাতি গিয়ে পতি পদে পদে বিপদে পড়লাম৷ মুক্তা বোঝে না আসলে রিক্তা কি বলছে, অন্য বোনেরা এবং সাহাতন নূর হকের বাড়ির দিকে ছুটেছে। রিক্তা বলে ফেলে যে আব্বার সাথে ওকে মা এটুকু উচ্চারণ মাত্র মৈরম রিক্তার মুখে থাবা মারে। রিক্তা চুপ করে হেসে ফেলে বলে দূর কিসব বানানো কতা বলচি, মৈরম বিবিকে জড়িয়ে ধরে বলে যা দিনি নানি দোলাভাই আর নেহালকে ডেকে আন। আমরা সেজেগুজে ছবি তুলবানি।

মৈরম বিবির সব ঘটনা স্বাভাবিক করে নেওয়া স্বভাব। সে মুহুর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাও স্বাভাবিক করে নেয়। ডাকতে যায় নাত জামাইদের। রিক্তা তার বোনকে বলে বু তুই যা নুডলস রান্না করে আনগে বাড়ি থেকে,মামার আমার কোলে দিয়ে যা। আমরা তো কাইলকে সকালে বাড়ি যাবো আইচকে আনন্দ করবো। মুক্তা বাড়ি যায়। রিক্তা একা একা তার ব্যাগ গুছায়, ব্যাগের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সকল জিনিস গোছানোর সময় ইদুর মারা বিষ টাও ঢুকিয়ে নেয়। সে সময় শফিকুল ঘরে আসে বলে ও বিষ কী হবে? রিক্তা জবাব দেয় শ্বশুরবাড়িতে অনেক ইন্দুর। ব্যাগ গুছিয়ে বাবার পাশে বারান্দায় এসে বসে।শফিকুল তার দুই জামাইয়ের পাগলামির কথা বলে আবার আনান্দিত হয় এবং নিজেদের জন্য ভয় ও পায়। রিক্তা এসব কথা শোনে না। সে তার মার কথা জিজ্ঞাসা করে, বলে যে রাতে তাদের স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া হচ্ছিলো সে রাতে তার বাবা ঝগড়া শেষে কোথায় গিয়েছিল? মা ঝুলে ছিল কিন্তু রাতে সে আর দুধ খাবার জন্য কাঁদেনি কেন? ওই রাতে মার ওম তাকে কে দিয়েছিল! এরকম সময় বাড়ির সকলে ফিরে আসে। নেহাল আর রফিককে গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে তোলা হয়। নেহাল রিক্তাকে বলে কিচু হব্যানে না। রিক্তা বলে, আচ্চা। তারা সাজগোজ করে ছবি তোলে ফোনে। নেহাল সে ছবি ফেইসবুকে দেয়। রিক্তা বেশ খুশি হয়। তাদের আনন্দচিত্তে খেতে দেখে, ঘুমাতে যেতে দেখে মৈরম বিবি শান্তি পায়, ভাবে নাতনি সুখী হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে রিক্তা তার সব বান্ধবী কে ডেকে জড়ো করে পেয়ারা গাছে ওঠে। পেয়ারা খেতে খেতে সকাল দশ টা পার হয়। সাহাতন বলে এইবার খ্যান্ত দে, ভাত খাতি আয়, আয় তোরা সজ্ঞলাই আয়। ওর বান্ধবীরা বানরের মতো লাফাতে লাফাতে নিচে নেমে চলে যেতে যেতে বলে রিক্তা তোর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পরশু তরশু সারাদিন থাকব। রিক্তা বলে ঠিক আচে। বর বউ খাওয়া দাওয়া করে বাড়ি চলে যায়।

বিয়ের বিশতম দিন, নেহাল ভোরে উঠে মাঠে চলে যায়, মাঠে কেবল ধানের শিষ বের হচ্ছে, ছোলা দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সবজি গুলোর বিশেষ যত্ন নিতে হয়। বাড়িতে রিক্তার শাশুড়ি আর ভাশুর ছিলো। শাশুড়ি দ্বিতীয়বার রিক্তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। মৈরম বিবির অপরাধের শাস্তি তাকে দিচ্ছে।

রিক্তা রান্নাঘরে সকালের খাবার তৈরি করছিলো, তার শাশুড়ি পাড়ার ছোট বাচ্চাদের দিয়ে গোলার মধ্যে রাখা নারিকেল বের করে নিচ্ছিলো। হলুদ নিতে রিক্তা শাশুড়ির ঘরে যায়৷ স্বাধীন পাকে পাকে তাকে নির্জনে পেয়ে যায়। হঠাৎ রিক্তাকে জড়িয়ে ধরতে দেখে রিক্তা ভাবে নেহাল। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুল ভেঙে যায়, সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। হাতের হলুদের বৈয়াম দিয়ে মুখে বাড়ি দেয়, কিন্তু হলুদ সব তার গায়েই পড়ে, সে তার গায়ের হলুদ স্বাধীনের চোখে ঘষে দেয়, স্বাধীন তাকে কুত্তারবাচ্চা বলে ছেড়ে দিয়ে চোখ পরিস্কার করতে থাকে, সে সময় শাশুড়ি ঘরে ঢোকে, ঘরে মানুষ ঢুকেছে বোঝামাত্র স্বাধীন বলে ও আমার প্ররোচিত করেচে, স্বাধীনের মা বলে সেডাতো নিজ চোকে দ্যাকলাম। আমার পেট দে বেরোলিও চরিত্রডা বাপের পাইচিস ছেলে! রিক্তা মা ছেলের মাঝ থেকে নিজের ঘরে চলে যায়,ব্যাগ থেকে বিষ বের করে টেবিলে রাখা পানির গ্লাসে বিষ মেশায়। ঢক ঢক করে গিলে ফেলে৷ খেয়ে রান্নাঘরে রান্না করতে চলে যায়।

ছবি- অমৃতা শের-গিল। Painting- Amrita Sher-Gil

বাড়ি ফেরে তখন নেহাল। রান্নাঘরে বউকে দেখে মাকে ডাকে, বলে ও মা! এই দ্যাখ, নতুন গিন্নির কাণ্ডডা দ্যাখ, হলদি এক্কেবারে তরকারিতে যেমন দিয়েচ গায়েও তেমন মেখেচ। রিক্তার এরকম সরল একজন বরের জন্য মায়া হয়, সে বাইরে বেরিয়ে নেহালকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

নেহালের মা রিক্তাকে কাঁদতে দেখে নেহালের ঘরে চলে যায়। দেখে টেবিলে বিষের কৌটা। সে চিৎকার করতে করতে বাইরে বের হয়। বউ বিষ খেয়েচে, বিষ খেয়েচে। সারাদেশে কঠোর লকডাউন দুমাসের। জেলা শহরে এম্বুলেন্স ছাড়া কোন যানবাহন চলে না। নেহাল রিক্তাকে কোলে করেই বড়ো ঘরের বারান্দায় চলে যায়, সেখানে বসিয়ে ঘরে গিয়ে ফোনে এম্বুলেন্স ডাকে, এম্বুলেন্স আসতে আসতে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, নেহাল শুধু প্রশ্ন করে আমি কী ভুল করেচি যার কারণে তুমি বিষ খেলে?

রিক্তা জবাব দেয় না। স্বাধীন ততোক্ষণে নিজেকে পরিস্কার করে বাড়ির সকল কে সামলাচ্ছে,  তার মাকেও। রিক্তাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর পরই ওয়াশ করানো হয়, দুবার ওয়াশ করানোর পরে সে তার নানিকে বলে নানি যতোটুকু বিষ খেয়ে না কষ্ট পাচ্চি ততো বেশি কষ্ট পাচ্চি ওয়াশ করানোর সুমায়, ওয়াশ করাতি বারণ কর। তৃতীয়বার ওয়াশ করানোর সময় সে মারা যায় এবং তার মলদ্বার দিয়ে অটোমেটিক্যালি পায়খানা বের হতে থাকে। সে পায়খানা খালি পেয়ারার বীচি।

মৈরম বিবি রিক্তার লাশ  ছাত্রাপাড়ায়  নিয়ে যেতে দেয় না। নিজের বাড়িতে নিয়ে ওঠে৷ ছাত্রাপাড়ার মানুষ চুরি করে গ্রাম দিয়ে গ্রাম হেঁটে হেঁটে চুরি করে শিকেরপুর গ্রামে মৈরম বিবির বাড়িতে পৌছে। তখন রিক্তার লাশ দেখতে তার নানাবাড়ির পাড়ার মানুষের ঢল নামে৷ শৈশবে মা হারা রিক্তাকে তারা অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু মৈরম বিবির কাজের শাস্তিস্বরুপ তাকে মৃত্যুর দ্বারে পৌছে যেতে হয়। রিক্তার জানাজায় উপস্থিত হয় অনেক মানুষ। নিষ্পাপ বাচ্চার জন্য কাঁদে সকলে, নেহাল পাগলের মতো হয়ে যায়। তার জানাজায় যখন সকলে দাঁড়িয়ে তখন দূরে শেষ লাইনে ভীতুর ন্যায় সাইকেল থেকে নেমে স্বাধীন দাঁড়ায়।

মানুষ মারা গেলেও সকল কাজ চলে নিয়মমাফিক, অন্তত মৈরমের ন্যায় মানুষের, রিক্তার গোসল করাতে গিয়ে মহিলারা যখন হয়রান হয়ে যাচ্ছিলো তখন মৈরম বিবি খেয়াল রাখে নেহালের। যেন সে পাড়ার যে ঘরে মেয়ে আছে সে ঘরে না যায়, নাতনি মৃত তার যখন সৎকার বাকি,  যখন মহিলারা হয়রান হয়ে যাচ্ছে রিক্তার মলদ্বারের কি ব্যবস্থা করা যায় তখন ই সে বিলকিস কে নেহালের সাথে বিয়ে দেবার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবং তাকে যে বাবার মেয়ে আছে সে বাবার বাড়িতে যেন  না যায় সেজন্য খেয়াল রাখছে। রিক্তাকে তার নানাবাড়ির পাশে একটি হেলানো আম গাছের নিচে গোসল করানো হয়, যে গাছটাতে উঠে বান্ধবীদের সাথে বসে সে খেলতো। মহিলারা পথ খুঁজে বের করে অবশেষে সারে কাগজ দিয়ে তার মলদ্বার বন্ধ করা হবে৷ তাই ই করা হয়। তাকে বাগানের একটা আম গাছের নিচে মাটি দেয়া হয়, যে আমগাছের নিচে সে ভোরে আম খুটতে যেতো, তাদের গাছের নিচে আম খুটতে অন্যেরা এলে ঝগড়া বাঁধাতো।

রিক্তা মারা যাবার দশদিন পরে নেহাল অপ্রকৃতিস্থ, সে কোন কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পায়নি তখনো, মৈরম বিবি খুব করে সাজায় বিলকিস কে। সাজিয়ে নেহালদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে নেহালের সাথে বিলকিস কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, নেহালের মা বলে বের হও তুমি বাড়ি থেকে বলে ঘরে চলে যায়, নেহাল বলে ফেলে অমানুষ নাকি এ মহিলা!! বলে উঠে রাস্তায় চলে যায়।

তখন দড়াম করে দরজা খুলে যায়, স্বাধীন ঘর থেকে বের হয়ে বিলকিস কে চেয়ে দেখে বলে তা মন্দ না! সুন্দর বটে। মৈরম বিবি পান চাবাতে চাবাতে নির্লজ্জের মতো তাকায় নেহালের বাবা এবং ভাইয়ের দিকে, হঠাৎ বিলকিসের বিয়ের পূর্বরাতে তার নানির কাছে রিক্তার বলা গল্পের কথা মনে পড়ে যায়, সে তার নানির হাত থেকে হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আমার বয়েস বারো,  রিক্তা বুর মতো আমি অতো পাগল না বলেই তার নানিকে ধাক্কা দিয়ে স্বাধীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে যেতে যেতে বলে, বলি কী

” বুড়ো বয়েসে আমাদের বদলে তুই চৌদ্দ গুন্ডা ভাতার ধর , খায়েশ মিটা তবু আমাদের এবার ছেড়ে দে।”

রাস্তায় দাঁড়ানো নেহাল বিলকিসের হাত ধরে ফেলে, বলে কি হয়েচে! বিলকিস জবাব দেয় দুলাভাই তোমার ভাই স্বাধীনের জন্য বু মারা গেচে, একন আবার তোমার সাতে আমার বিয়ে দুয়ার পায়তারা বানাচ্চে, নেহালের মৈরম বিবির বলা সেই গোসলখানার কথা মনে পড়ে, রিক্তা বিষ খেয়ে যখন ছটফট করছিলো তখন তার ভাইয়ের মুখেও হলুদ ছিলো যা ধুয়ার পরেও যায় নি। সে বিলকিসের হাত ছেড়ে দেয়, মৈরমও তার সামনে চলে আসে, সে তাদের রেখে বাড়ি চলে যায়, ঘরে গিয়ে ভাইকে শাস্তি দেবার বদলে ঘরের কৌটায় রাখা বাকি অর্ধেক বিষ খেয়ে শুয়ে থাকে। সকালে তাকে ডাকতে গিয়ে দেখে সে মৃত। মৃত্যুর কোন কারণ এবং কিভাবে মরলো তা কেউ খুঁজে পায় না। সকলে ভেবে নিলো কষ্টে স্ট্রোক করেছে। স্ত্রীর শোকে স্ট্রোক করে তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে যখন জানাজা পড়ানো হচ্ছে তখন রাস্তা দিয়ে একটা এম্বুলেন্স এসে তাদের পাড়ায় থামে। এম্বুলেন্স থেকে নূর হক তার বউ মেয়েকে হাত ধরে সুস্থ নামাচ্ছে, কিছু শিশু জড়ো হয়েছে রাস্তায়, নূর হকের স্ত্রী তাদের বলছে,

” যাতো বাবা নেহাল আর রফিক ওদের দু ভাইরাকে বউ সহ ডেকে আন, পরাণ ভরে দেখি ওদের।”

শিশুরা কি ভেবে নেহালের বাড়ির দিকে দৌড়ে গেলো যেন সত্যিই তারা তাদের ডাকতে যাচ্ছে, যেন  ডাকলে তারা আসবে। শিশুরা এরকমই হয়।

রিক্তাকে তার নানাবাড়ির পাশে একটি হেলানো আম গাছের নিচে গোসল করানো হয়, যে গাছটাতে উঠে বান্ধবীদের সাথে বসে সে খেলতো। মহিলারা পথ খুঁজে বের করে অবশেষে সারে কাগজ দিয়ে তার মলদ্বার বন্ধ করা হবে৷ তাই ই করা হয়। তাকে বাগানের একটা আম গাছের নিচে মাটি দেয়া হয়, যে আমগাছের নিচে সে ভোরে আম খুঁটতে যেতো, তাদের গাছের নিচে আম খুঁটতে অন্যেরা এলে ঝগড়া বাঁধাতো।

ছবি- অমৃতা শের-গিল। Painting: Amrita Shre-Gil

জেসমিন নাহার

তরুণ গল্পকার। উপন্যাস লিখনেও হাত দিয়েছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকাতেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যশোহর জেলার শার্শা উপজেলায় বাড়ি। গোরপাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম (রহঃ) চিশতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। সেই কারণে ফকিরি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। মা রওশানারা বেগমের সঙ্গে বাস করেন জেসমিন। আধুনিকতার মধ্যে নামসাকিন হারিয়ে বিমূর্ত হতে চান না। প্রকৃতির মাঝে যাপিত জীবনকে মূর্তভাবে পরখ করতে চান। গদ্যেও জীবনের মূর্তভাবকে প্রকাশ করার ইচ্ছায় লেখালেখি করেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top