।। অর্ক চট্টোপাধ্যায় ।।
“তাজমহল কি তেজো মহালয়া নামের শিবমন্দির? পি এন ওকের বই তাজ মহল: দ্য ট্রু স্টোরি লোকটাকে প্রভাবিত করেছিল। তারপর থেকেই ইউটিউব খুলে এইসব ভিডিও দেখতো। সব ভিডিও যে তাজমহল ভেঙে ফেলার ডাক দিচ্ছিল এমনটা নয় কিন্তু লোকটা অবসেসড হয়ে ‘ব্রিঙ ব্যাক দ্য হিন্দু তাজ’ বলে একটা প্রাইভেট ফেসবুক গ্রুপ তৈরী করে ফেলল। বন্ধুদের ডাকতে লাগল সেখানে এক এক করে। ভিডিও পোস্ট করতে শুরু করলো ইউটিউব থেকে। তারপর ফেসবুক গ্রুপে লাইভ হয়ে তাজমহল ভেঙে ফেলার হুঙ্কার দিতে লাগলো।”
তাজমহল কিম্বা অপ্সরাদের স্নানাগার
অনেককিছু থাকেনা বলে তাদের দেখা যায়না। আবার অনেককিছু দেখা যায়না বলেই তারা থাকে। কেউ কেউ মনে করে, তারা, সেসবকিছু, থাকে, আছে।
লোকটা সেই উইকেন্ডে তাহমুর বলে এক জায়গায় গেছিল ট্রেনে চেপে। আজকাল উইকেন্ডগুলো হাইক করে কাটায়। পিএইচডি শেষ করছে। সারা সপ্তাহ অসম্ভব কাজের চাপ। সপ্তাহান্তের এই ট্রেকগুলো হিলিং-এর মতো। মাথার গোপনে তখন আরেকটা থিসিস লেখা হয়ে চলেছে।
সন্ধ্যারাত্রি। চৌখুপি ঘর। অন্ধকার বাড়ছে। উঠে আলো জ্বালায়নি কেউ। স্মার্টফোনের আলোই যথেষ্ট। লোকটা বুঁদ হয়ে আছে ইউটিউবে। রহস্যোন্মোচন ভিডিও। তাজমহল কা সচ। সত্যান্বেষী বক্সী খেলছে মগজে।
লোকটার অস্ট্রেলিয়ান ফ্ল্যাটমেট ওকে মারমেইডস পুল বলে এক জায়গার কথা বলেছিল। এলাকার নাম তাহমুর। শনিবার সিডনী থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে দুটো ট্রেন বদলে ঘন্টা দুয়েকে পৌঁছে গেল তাহমুর স্টেশন।
তাজমহলের জমিতে মকবরা তৈরির আগে কি সেখানে হিন্দু মন্দির ছিল? কেন বুজিয়ে দেওয়া হল মহলের বেসমেন্টে ঢোকার ঐ সুপ্রাচীন দরজা? কী আছে ওখানে? হিন্দু দেবদেবী? অনেককিছু দেখা যায়না বলেই থাকে। থেকে যায় কিন্তু দেখা যায়না।
স্টেশন থেকে লম্বা হাঁটা। খাবার জল সঙ্গে নিল। ট্রেক কঠিন নয় কিন্তু ফ্ল্যাটমেট বলেছিল, পরিষ্কার করে বলা নেই রাস্তা। নদীর ধার ধরে যেতে হবে পাথরের গায়ে অ্যারো দেখে দেখে। ট্রেক স্পট হিসাবে মারমেইডস পুল একটু ইনফরমাল। আসলে জলে দুর্ঘটনা তো ঘটেই থাকে। মারমেইডস পুলে সাঁতরাতে এসে জলে ডুবে মারা গেছে এমন লোকের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। তাই অফিশিয়াল মার্কার নেই। হাইকার ট্রেকারদের ভাষায় মারমেইডস পুল হল এক হিডেন স্পটের মতো।
লোকটা মন দিয়ে শুনছে। যত শুনছে ততই তার চোয়াল শক্ত হচ্ছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা নাকি কার্বন ডেটিং করিয়েছিল তাজমহলের ঐ বুনিয়াদি দরজার। তা থেকে জানা যায় যে তাজমহলের বেসমেন্টের বয়স মকবরার থেকে ২৫০ বছর বেশি। তবে কি কোনো হিন্দু মন্দির ছিল ওখানে? ভিডিওটা যে বানিয়েছে সে দেখাচ্ছিল কি কি হিন্দু ছাপ রয়েছে তাজমহলের গায়ে। তাজমহলের মাথায় কি ত্রিশূল? একাধিক ফুলের ডিজাইন যাকে ভিডিওর মেকার ওম চিহ্ন বলে দাবি করছিল। ঐ ছবিগুলো কি ডক্টরড না আসল? লোকটা কি আদৌ কোন সন্দেহসূচক প্রশ্ন করছিল নাকি যা দেখছিল, শুনছিল, তাই বিশ্বাস করে নিচ্ছিল? ওর মাথার ভিতর তখন কেবল ওম ঘুরঘুর করছে।
পাথরের ফাটল বরাবর ঝর্ণা নামছে। লোকটা ছবি দেখে এসেছে। অপ্সরারা স্নান করে বলেই কি জায়গাখান গুপ্ত? পৃথিবীর বাইরে চলে এসেছে। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। নেট থেকে কিছু জিনিস নোট করে এনেছিল লোকটা। সূর্য তখন মধ্যগগনে। জঙ্গলের মধ্যে নদীর ধার দিয়ে পাথুরে রাস্তা। কোথাও লাল রুমাল বাঁধা, কোথাও আবার পাথরের ওপর খড়ি দিয়ে আঁকা অ্যারো সাইন। লোকটা যেন ছোটি সি বাতের অমল পালেকর! আত্ম-অনুশীলনের পথে যেতে যেতে আকাশের দিকে তাক করা ভুল অ্যারো ঠিক করে নিচ্ছে।
ভিডিওর ভয়েস ওভারে বলা হচ্ছিল সরকার কীভাবে সিল করে দিয়েছে ঐ দরজা যাতে ঢোকা না যায় তাজমহলের ভিতে। বোঝা না যায় কী বাস্তু ছিল ওখানে! কালিক পৌর্বাপর্য দিয়ে কি মহত্ব প্রমাণ হয়? হিন্দু মন্দির আগে ছিল নাকি মকবরা? যা আগে ছিল তাই কি ঠিক আর পরে যা যা এসেছে, সব ভুল? আগে ছিল বলে পরেরটা ভেঙে ফেলতে হবে? লোকটা কি আদৌ এই প্রশ্নগুলো করছিল নাকি তার মাথায় কেবলই ওম খেলা করছিল?
অমল পালেকর তো তাও অশোক কুমারের বাড়ি খুঁজে পেয়েছিল, লোকটা কিন্তু তাহমুরের জঙ্গলে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নানা অ্যারোর দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে হারিয়ে গেল। মারমেইডস পুল পৌঁছতে পারলো না, শেষে জঙ্গলে সন্ধ্যা নামার ভয়ে পালিয়ে এল ফিরতি পথে। ফেরার পথ চেনাও নেহাত সহজ কাজ ছিল না। লোকটা রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরে ফ্ল্যাটমেটকে মিথ্যেকথা বললো, সে মারমেইডস পুল দেখে এসেছে।
তাজমহল কি তেজো মহালয়া নামের শিবমন্দির? পি এন ওকের বই তাজ মহল: দ্য ট্রু স্টোরি লোকটাকে প্রভাবিত করেছিল। তারপর থেকেই ইউটিউব খুলে এইসব ভিডিও দেখত। সব ভিডিও যে তাজমহল ভেঙে ফেলার ডাক দিচ্ছিল এমনটা নয় কিন্তু লোকটা অবসেসড হয়ে ‘ব্রিঙ ব্যাক দ্য হিন্দু তাজ’ বলে একটা প্রাইভেট ফেসবুক গ্রুপ তৈরী করে ফেলল। বন্ধুদের ডাকতে লাগল সেখানে এক এক করে। ভিডিও পোস্ট করতে শুরু করলো ইউটিউব থেকে। তারপর ফেসবুক গ্রুপে লাইভ হয়ে তাজমহল ভেঙে ফেলার হুঙ্কার দিতে লাগলো! কী একটা ওটিটি সিরিজে লোকটা দেখেছে ২০৫০ সালের ভারত। সেখানে কোনো তাজমহল নেই। লোকটা জানে না অতদিন বাঁচবে কিনা! হাতে সময় কম তাই!
অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে আসার পর যেন তাহমুর জেগে উঠল লোকটার মনের মধ্যে। মারমেইডস পুল এক প্রহেলিকা হয়ে উঠল। বারবার ওয়েবসাইটে পুলের ছবি, রাস্তা সব দেখেও তার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মালো জায়গাটা আসলে নেই। থাকতে পারে না! নিউ সাউথ ওয়েলসের পাথুরে সন্ধ্যার জঙ্গুলে আলো সাক্ষী আছে, লোকটা ঐসব রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে। ওখানে অমন কোনো পুল নেই। থাকলেও এখন আর নেই, অপ্সরারা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। অনেককিছু দেখা যায় তাও থাকে না। থাকে না অথচ দেখা যায়। সিডনী আনকাভারড-এর ওয়েবসাইটে গিয়ে মারমেইডস পুলের পেজে লোকটা কমেন্ট করে এলো: “I have walked these tracks. There is no such place as the Mermaid’s Pool. Stop spreading lies!” কমেন্টের উত্তরে কিছু গালাগাল, হাল্কা হাসি আর শেষে অ্যাডমিন কর্তৃক কমেন্ট ডিলিট।
অনেককিছু থাকে বলে তাদের দেখা যায়না। আবার অনেককিছু দেখা যায়না বলেই তারা থাকে না। কেউ কেউ মনে করে, তারা, সেসবকিছু, থাকে, আছে। কেউ কেউ আবার গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। সবার অলক্ষ্যে এমন করে একেকটি রাষ্ট্রযন্ত্র মান্যতা পেয়ে যায়।
অর্ক চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কথাসাহিত্যিক। পেশায় অধ্যাপক। জন্ম ১৯৮৫ সালে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। আই,আই,টি গান্ধীনগরের মানববিদ্যা বিভাগে সাহিত্য এবং দর্শন পড়ান। পেশাসূত্রে বসবাস করেন গুজরাতের গান্ধীনগরে। সম্পাদনা করেছেন ‘অ্যাশট্রে’ পত্রিকা। প্রকাশিত বই: ‘পিং পং গন্ধ’ (গল্পগ্রন্থ, ২০০৯), ‘সাইজ জিরো’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৫), ‘অলিখিত হ্রস্বস্বরের সন্ধানে’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৮), ‘উপন্যস্ত’ (উপন্যাস, ২০১৮), ‘আতশবাজি ছায়াপথে ফিরে যাও’ (গল্পগ্রন্থ, ২০২১)