।। হাসনাত শোয়েব ।।
যখন স্বাধীনতা আর মুক্তির আনন্দে বাংলাদেশের মানুষ বুক ভরে নিশ্বাস নিতে শুরু করেছিল, তখন স্তব্ধ করে দেওয়া হয় কিংবদন্তী এই মানুষটিকে৷ ১৯৭২ নালের ৩০ জানুয়ারি অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের হত্যা রহস্য উন্মোচিত করতে গিয়ে হারিয়ে যান নিজেও। সেই যে হারালেন, আর ফিরলেন না। কখনো আসেনি ছবির মতোই রহস্যময় তাঁর মৃত্যু। প্রতিষ্ঠিত বয়ান আছে বটে। যে বয়ানে জহির রায়হানকে বিহারি রাজাকারদের হাতে হত্যার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পালটা-বয়ানও আছে যে রাষ্ট্রপক্ষ বা বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাই তাঁকে গুম করেছিল। আছে অমীমাংসিত অনেক প্রশ্ন। আমাদের জানা উচিত কেন স্টপ জেনোসাইড নির্মাণের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন৷ কেন বিভিন্ন সেক্টরে তাঁকে শুটিং করতে দেওয়া হয়নি, এমনকী তাঁর সেসব জায়গায় যাওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। আর কেনই বা আওয়ামী লীগের নেতারা এই ছবির ছাড়পত্র না দিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। সঙ্গে এটা জানাও খুব কঠিন ছিল কি, গুম হওয়ার আগে তাঁকে অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোনটা কে করেছিলেন? এমন আরও অনেক প্রশ্ন। এখন এসব প্রশ্ন জহির রায়হানের চাচাতো ভাই এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী শাহরিয়ার কবিরও তুলেছিলেন৷ এখন এত কিছুর পর কেউ যদি জহির রায়হানের প্রতি আওয়ামী নেতাদের ক্ষোভ বা ক্রোধের সঙ্গে তাঁর গুম-খুনকে মিলিয়ে দেখতে চান এবং তৎকালীন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবকে এ জন্য দায়ী করতে চান, তবে আপত্তির সুযোগ সামান্যই থাকে। যা-ই হোক, এগুলো স্রেফ প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা। তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানাও বেশ জরুরি।
চলচ্চিত্র নিজেই মূলত সমালোচনামূলক মাধ্যম। চলচ্চিত্র যখন বাস্তব কিংবা অবাস্তব কোনো বিষয়কে পরদায় নিয়ে আসে, তখন সেটি সেই ঘটনারই এক ধরনের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রতিনিয়ত আমরা নানা ধরনের বাস্তব, অবাস্তব কিংবা পরাবাস্তব ঘটনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এর প্রায় অনেক কিছুকেই চলচ্চিত্র নির্মাতারা নিজেদের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন। তাই চলচ্চিত্র শিল্পকলার সাম্প্রতিকতম মাধ্যম হলেও এর যাত্রা বহুমুখী ও শক্তিও অনেক বেশি। জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যেমনটা বলেছিলেন, “বদলে যাওয়া শিল্প-বাস্তবতায় চলচ্চিত্র হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিনিধি।” তবে অভিমুখ বা যাত্রা বিভিন্নমুখী হলেও এর বড়ো একটি উদ্দেশ্য দর্শকদের বিনোদন দেওয়া। কিন্তু বিনোদনই চলচ্চিত্রের শেষ কথা নয়।
শুরু থেকেই এটি সমাজ এবং রাষ্ট্রের এক ধরনের দর্পণ হিসেবে কাজ করার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। আর এক সময় এটি হয়ে উঠে সমাজের এবং রাষ্ট্রের যাবতীয় অন্যায় ও বৈষম্যের সমালোচক। চলচ্চিত্রের এই সমালোচক কিংবা বিপ্লবী দায়িত্ব গ্রহণের পরিক্রমায় ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে আমরা পাই একজন জহির রায়হানকে। বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়াকে যদি সেলুলয়েডের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তবে জহির রায়হান তার সবচেয়ে বড় পথিকৃৎ। পাশাপাশি জহির রায়হানের চলচ্চিত্রের বিবর্তন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম অনেকটাই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বলা যায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পুরো যাত্রাটাকে কেউ চাইলে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র দিয়েও বুঝে নিতে পারবে। বিশেষ করে ১৯৬০ সালের পর থেকে দুটো বিষয়ই বিবর্তিত হয়েছে অনেকটা একইভাবে।
জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে। তাঁর বাবা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ছিলেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা থেকে পরিবার-সহ তৎকালীন পূর্ববাংলায় স্থানান্তরিত হন জহির রায়হান। ১৯৫০ সালে সোনাগাজির আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময়েই কবিতাচর্চা দিয়ে প্রতিভার জানান দেন জহির রায়হান। এরপর ঢাকায় এসে কলেজ পর্ব শেষ করে কিছু সময় মেডিক্যাল পড়লেও, পরে পড়াশোনার দিক পরিবর্তন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভরতি হন। তাঁর মানসগঠনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে ১৯৫৮ সালে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় নিজেকে প্রমাণ করতে শুরু করেন জহির রায়হান। পাশাপাশি একই সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে জহির রায়হানের অংশগ্রহণও পরবর্তী সময়ে তাঁর সাহিত্য-চলচ্চিত্রকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে কারাবন্দি হয়েছিলেন।
কৈশোর থেকেই যে রাজনীতি ও শিল্প সচেতন মন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি আরও পরিশীলিত ও ক্ষুরধার হয়েছে। এছাড়া তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল আন্দোলনের ধারায় যুক্ত হওয়াও জহির রায়হানের প্রস্তুতিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে এবং দেখার ভঙ্গিকে বিস্তৃত করেছে।
এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় জহির রায়হানের চলচ্চিত্র হলেও, তাঁর সাহিত্যকর্মকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র আলোচনা অপূর্ণাঙ্গই থেকে যাবে। তাই স্বল্প পরিসরে হলেও একনজরে তাঁর সাহিত্যকর্মের বিবরণটা জেনে নেওয়া যাক। ১৯৫৫ সালে জহির রায়হানের প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। মনে রাখা ভালো, একই সময়ে চলচ্চিত্র পরিচালনাতেও হাতেখড়ি হয় তাঁর। এরপর থেকে দুটো শিল্পমাধ্যমেই নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে শেষ বিকেলের মেয়ে, আরেক ফাল্গুন, হাজার বছর ধরে এবং বরফগলার নদী-র মতো কালজয়ী সব উপন্যাসও লেখেন তিনি।
জহির রায়হানের এসব গল্প-উপন্যাসেও তাঁর মানসচেতনার বিবর্তনের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। উপন্যাসে জহির রায়হানের শুরুটা শেষ বিকেলের মেয়ে-র মতো প্রেমের উপাখ্যান দিয়ে হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি তুমুলভাবে রাজনৈতিক হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে আরেক ফাল্গুন ছিল গমগমে রাজনৈতিক উপাখ্যান। জহির রায়হানের পরবর্তী সাহিত্যকর্মগুলো ছিল অনেক বেশি রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। যেমন ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তাঁর লেখা ‘একুশের গল্প’ অনবদ্য এক সাহিত্যকর্ম।
চলচ্চিত্রে জহির রায়হান যাত্রা শুরু করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া জাগো হুয়া সাভেরা-তে আখতার জং কারদারের সহকারী হিসেবে কাজ করেন জহির রায়হান। এরপর আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে হাত মকশো করে অবশেষে হাত দেন নিজের প্রথম চলচ্চিত্র কখনো আসেনি-তে। সেখান থেকেই শুরু হয় অনবদ্য এক চিত্রনির্মাতার অবিস্মরণীয় যাত্রা। যেহেতু কখনো আসেনি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্মাণ, তাই এই ছবিটির আলাপ একটু বিস্তারিত হওয়া আবশ্যক। এই ছবিটি আমাদের নানা ধরনের বার্তা দিয়ে যায়। এটি কেবল সমাজবাস্তবতার নির্মম দলিলই শুধু নয়, জহির রায়হানের শিল্পমানসের চিরস্মরণীয় এক দর্পণও।
কখনো আসেনি ১৯৬১ সালে জহির রায়হান নির্মিত অবিশ্বাস্য এক চলচ্চিত্র। সম্ভবত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে উপেক্ষিত চলচ্চিত্রও বটে৷ অথচ সময় এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেও বলতে হয়, এই ছবি সময়ের চেয়ে অন্তত ৬০-৭০ বছর এগিয়ে থাকা একটি চলচ্চিত্র। কথিত আছে এই ছবির পোস্টারে নাকি লেখা ছিল, “দেশের জনসাধারণ ২০ বছর পর যে ছবি দেখবে বলে আশা করেছিল, ২০ বছর আগেই দেশের তরুণেরা সে ছবি তাদের উপহার দিল।” তবে এখন এসে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের হিসাবে ২০ বছর আসলে কমই ছিল।
জহির রায়হানের রাজনৈতিক ও বিপ্লবী চলচ্চিত্র নির্মাণের যে ধারা, এটি তার পূর্ববর্তী কীর্তি। আজ এত বছর পরে এসেও যার তুলনীয় কোনো ছবি বাংলা ভাষায় নির্মিত হয়নি। বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার মিশেলে এই ছবি ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থার চিরন্তন বেদনাবোধের দলিল হয়ে আছে।
এই ছবি শুরু হয় রহস্যময় এক মৃত্যুর দৃশ্য দিয়ে। পাশাপাশি শুইয়ে রাখা দুই নারীর লাশ। আর ওপরের ঘরে অবিকল সেই মৃত্যুর দৃশ্য এঁকে রাখা একটি পেইন্টিং। পরে সেই ঘরে ফিরে আসা এক লোকের মৃত্যু। এসব মৃত্যুর কোনো কূলকিনারা হয় না৷ এরপর সেই বাড়িতে থাকতে আসে দুই বোন, বাবা ও তাদের চিত্রশিল্পী ভাই৷ বাবার আয়ে কোনোরকমে সংসার চলে। বেকার আর্টিস্ট ভাই আর্ট এগজিবিশন দেখে বেড়ায় আর চেষ্টা করে চিত্রকর্ম বিক্রির। সেখানেই শওকত (খান আতা) নামের সেই চিত্রশিল্পীর দেখা হয় মরিয়মের (সুমিতা দেবী) সঙ্গে। পরে জানা যায় মরিয়ম মানুষ হলেও, তাঁকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে কিনে নিয়ে নিজের জাদুঘরে বন্দি করে রেখেছেন চিত্র সমালোচক ও শিল্পপ্রেমী সুলতান। এবং মানুষ হলেও মরিয়ম সুলতানের সবচেয়ে কম দামের সংগ্রহ, যাকে সে করতে চেয়েছে পাথরের মূর্তির মতো মৃত্যুহীন। মরিয়ম নামের এই চরিত্র মনে করিয়ে দেয় ফ্রানৎস কাফকার ‘দ্য হাঙ্গার আর্টিস্ট’ নামের গল্পটিকে, যেখানে বন্দিশালায় না খেয়ে জীবন কাটাত ক্ষুধার্ত শিল্পীরা, আর দর্শনার্থীরা ভিড় করত সে শিল্পীদের দেখতে। এমনকী তাদের নজরে রাখার জন্য নিয়োগ পায় তিনজন পর্যবেক্ষক। এরপর এই গল্প নানাভাবে ডালপালা মেলেছে, সে আলাপ অন্যত্র। সুলতানের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। চিত্রকর্ম সংগ্রহের মতো সংবেদনশীল কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেও সুলতান মূলত পুঁজিবাদী সমাজের কদর্যের এক প্রতীকী রূপ। যার কেবল মোড়কটাই আকর্ষণীয়, আর ভেতরটা পুরোপুরি নোংরামি, ভণ্ডামি এবং অপরাধ বৃত্তিতে পূর্ণ। নিজেকে সৌন্দর্যের পূজারি দাবি করলেও তার আড়ালে সে কেবলই খুনে এবং বীভৎস এক মানুষ। শিল্পী বা শিল্পমনা মানুষ হলেই যে তিনি নিরঙ্কুশ ভালো মানুষ না-ও হতে পারেন, সেটি এই চরিত্র দ্বারা স্পষ্ট করতে চেয়েছেন জহির রায়হান। পাশাপাশি শিল্পী বা শিল্পপ্রেমী হয়েও ব্যক্তিমানুষ যে নোংরামি ও অপরাধী হয়ে উঠতে পারে, সেটিও উঠে এসেছে এই চরিত্রের রূপায়ণে। এই সুলতান চরিত্রকে দিয়েই জহির রায়হান সৌন্দর্য নিয়ে এক জায়গায় বলিয়েছেন, “সুন্দর চিরকাল স্থির থাকবে, মানুষের হাতে সে নড়বে না। তুমি সেই সুন্দর, তুমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো আমার সামনে, আমি দেখি। আমি তোমাকে ছোঁব না, ফুলের গায়ে হাত দিলে পাপড়িগুলো ঝরে যায়। সৌন্দর্যকে কাছে পাওয়া যায় না, অনুভব করা যায় মাত্র।”
সৌন্দর্যের এই সংজ্ঞা আমাদের বিভ্রান্ত করে। আমরা একমত হতে পারি না। এর আগে আমরা কালজয়ী উপন্যাস ব্রাদার্স কারামাজভ-এ মিতিয়া কারামাজভের মুখ দিয়ে ফিওদর দস্তয়েভস্কিকে বলতে শুনেছিলাম, “সৌন্দর্য ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় জিনিস! ভয়ঙ্কর কারণ তা নির্ণয় করা যায় না, আর নির্ণয় করা যায় না এই কারণে যে ঈশ্বর সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন প্রহেলিকারূপে।” হ্যাঁ, সুলতানের সুন্দর ও দস্তয়েভস্কির দেওয়া সংজ্ঞা সত্যিই ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেয় আমাদের সামনে। আমাদের তা বেশ বিপন্নও করে।
একইভাবে শওকত চরিত্রটিও মূলত ধূসর এক সৃষ্টি। নায়ককে এমন অবয়ব দিয়ে তৈরি করা তখনকার বিবেচনায় সত্যিই অবিশ্বাস্যই। শওকতের শিল্পের প্রতি নিবেদন আমাদের মনে তার জন্য মায়ার জন্ম দেয়। তার শিল্পমন আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু সেই মানুষটিই যখন অসহায় দু’টি বোনকে মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়ে যায়, তখন আমরা ক্ষুব্ধ হই। একই সঙ্গে আমাদের মনে সমান্তরালে জন্ম নেয় ঘৃণা। পলায়নপর ও অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে থাকা আধুনিক মানুষের প্রতিনিধি শওকত। নিজের অস্তিত্ব ও স্বার্থের ঊর্ধ্বে যে কখনো উঠতে পারেনি। তাই শওকত কখনো শেষ পর্যন্ত নায়ক হয়ে উঠতে পারে না। সে হয় আমাদের মতোই সাধারণ একজন মানুষের প্রতিনিধি। যার সমাপ্তিও হয় ট্র্যাজিক এক মৃত্যু বা আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে, যেখানে চলচ্চিত্রের শুরুর দৃশ্যের মতোই মৃত্যু হয় দুই বোনের এবং পরবর্তীতে ভাইয়ের। তবে গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এরপর আমরা দেখব সেই রহস্যময় ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আবারও তেমন একটি পরিবারের আগমন এবং যথারীতি সেই বন্দি মরিয়ম। মানুষের ক্ষুধা, অস্তিত্বের যন্ত্রণা এবং নৈরাশ্য যে প্রতিনিয়ত একটি চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটিই স্পষ্ট হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। ফলে চিত্রনাট্য হয়ে উঠেছে জহির রায়হানের এই গল্পের নায়ক। যে কোনো বিবেচনায় জহির রায়হানের এই ছবি অভিনব। এমন জনরার চলচ্চিত্র জহির রায়হান আর নির্মাণ করেননি এবং পরবর্তীতে অন্য কেউও এমন ছবি নির্মাণ করেননি। ছবিটির ব্যবসায়িক ব্যর্থতা সম্ভবত তাঁকে নিরুৎসাহিত করেছে৷ সঙ্গে দেশে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতাও ছিল। যা ক্রমে জহির রায়হানকে অনেক বেশি বাস্তববাদী ও রাজনৈতিক করে তুলেছে। কিন্তু জহির রায়হানের পরবর্তী রাজনৈতিক চলচ্চিত্রগুলোর গুরুত্ব মাথায় রেখেও বলতে হয়, শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে জহির রায়হানের এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পরিক্রমায় একটি বিশেষ মাইলফলক।
এরপর ১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে আরও দু’টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন জহির রায়হান। সোনার কাজল ও কাচের দেয়াল। সোনার কাজল চলচ্চিত্রটি কলিম শরাফির সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন। যেটি প্রখ্যাত অভিনেতা খলিলউল্লাহ খানের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল। এই ছবিটি ১৯৬৩ সালে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছায়াছবি হিসেবে চলচ্চিত্রে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’-ও লাভ করে।
জহির রায়হানের একক পরিচালনায় দ্বিতীয় চলচ্চিত্র কাচের দেয়াল। “আমি তোমাদের দাসী নয়, বাঁদি নয়, কেনা গোলামও নয়”— মামার উদ্দেশ্যে বলা হাসির এই কথাটিই বোধহয় কাচের দেয়াল ছবির সারমর্ম, যা অবশ্য চিরকালীন এক আর্তিও বটে। মূলত পারিবারিক সম্পর্কের ফাঁদে লুকিয়ে থাকা ভয়ঙ্কর চিত্রগুলোকে এই ছবির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন জহির রায়হান। কখনো আসেনি-র সঙ্গে তুলনায় এ ছবিটি বেশ সরল ও স্পষ্ট বার্তাবহ। এখানে গল্পে ঘনঘটা কম, দুর্বোধ্যতাও বিশেষ নয়। হয়তো আগের ছবির বাণিজ্যিক পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে এখানে নিজের গল্প বলার ভাষায় এ পরিবর্তনটুকু এনেছেন জহির রায়হান। তবে এরপরও কাচের দেয়াল গড়পড়তা কোনো চলচ্চিত্র নয়। জহির রায়হানের বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনা, ক্রাফট্সম্যানশিপ এবং অভিনয় দক্ষতার কারণে শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনাপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে কাচের দেয়াল।
সঙ্গম ছবিটিতে ভিন্ন এক বিপ্লব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন জহির রায়হান। এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। এই ছবি গল্পে নয়, নির্মাণেই সৃষ্টি করে ভিন্ন এক ইতিহাস। এটি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। এই ছবি দিয়েই রঙিন ছবির দ্বার উন্মোচিত হয় এ দেশে। উর্দু ভাষায় নির্মিত এই ছবিটি। তাই ইতিহাসে এই ছবিটির অবস্থান একেবারেই ভিন্ন। একই কথা বলা যায় ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া উর্দু ভাষার আরেকটি ছবি বাহানা নিয়েও। বাণিজ্যিক ঘরানার এই চলচ্চিত্রটি ছিল দুই পাকিস্তান মিলিয়ে প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র। ফলে সঙ্গম–এর মতো এটিও চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাসে বিশেষ এক মাইলফলক হয়ে আছে।
এই পর্বে ১৯৬৬ সালে মনসামঙ্গল কাব্যের প্রেক্ষিতে নির্মিত বেহুলা-ও একটি উল্লেখযোগ্য ছবি। বেহুলা ও লখিন্দরের পুরাণকে চলচ্চিত্রে রূপায়ণের উদ্যোগ নিয়ে সে সময় বেশ আলোচনারও জন্ম দিয়েছিলেন জহির রায়হান। এখানে বেহুলা রূপে সুচন্দা এবং লখিন্দর চরিত্রে রাজ্জাক ছিলেন অনবদ্য। এটি পরবর্তী সময়ে কিংবদন্তীর মর্যাদা পাওয়া রাজ্জাকের প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ও বটে। মিথ বা পুরাণকে কীভাবে সার্থক উপায়ে পরদায় তুলে আনতে হয়, এটি ছিল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই ছবিকে আদর্শ মেনে পরবর্তী সময়ে প্রচুর পুরাণ-নির্ভর ছবি হয়েছে। তবে পথিকৃৎ হয়েছে বেহুলা, এর সৌন্দর্য ও নান্দনিকতাকে মলিন করতে পারেনি কোনোটিই। এক বছর পর জহির রায়হান উপহার দেন আনোয়ারা।
এরপরই আসে জীবন থেকে নেওয়া। এটিকে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র যাত্রার দ্বিতীয় পর্বের শুরু হয়েছে ধরা যেতে পারে। এই ছবি পর্যন্ত আসতেই নিজের চলচ্চিত্রের ভাষা অনেকটুকুই বদলে ফেলেন বরেণ্য এ চিত্র পরিচালক। এমনকী এ সময় বদলে যায় গল্প বলার প্রেক্ষাপটও।
জীবন থেকে নেওয়া জহির রায়হানের সবচেয়ে আলোচিত ও ট্রেডমার্ক চলচ্চিত্র। এযাবৎ ছবিটি নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। যখন আপনার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যখন আপনার প্রতিটি পদক্ষেপে রাখা হয় নজরদারি, তখন কীভাবে আপনি নিজের কথা বলবেন, তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত এই ছবিটি। নিছক সাধারণ এক পারিবারিক গল্পের আবহে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধাক্কা দিয়ে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো ছবি এটা। প্রথম ছবি কখনো আসেনি-র মতো এই ছবির পোস্টারও ছিল চমকপ্রদ। যেখানে লেখা ছিল, ‘একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন’। এইটুকুই সম্ভবত পুরো ছবিটি নিয়ে বড়ো একটি বার্তা দিয়ে দেয়। রূপককে কোনো টেক্সটের কেন্দ্রে নিয়ে এসে কীভাবে মূল গল্পটাকে প্রান্তে ঠেলে দিয়ে নিজের বক্তব্য বলে ফেলা যায়, সেটি দুর্দান্ত মুনশিয়ানায় দেখিয়ে দিয়েছেন জহির রায়হান। এই যে কৌশলী অবস্থান, এটা আমরা এর কয়েক বছর আগে আরেকটি উপন্যাসে দেখি, সেটি ছিল শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি। আরব্য রজনীর মতো গল্প বলার ভঙ্গিতে স্বৈরশাসক ও নিপীড়নকারীদের দাঁত-ভাঙা জবাব দিয়েছিলেন শওকত ওসমান। আর চলচ্চিত্রে একই কাজটা বুদ্ধিদীপ্তভাবে করেছেন জহির রায়হান।
পাশাপাশি পূর্বের কাজগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ছবিটা সাধারণ দর্শকদের কাছে যেন উপভোগ্য হয় সেদিকেও দৃষ্টি ছিল তাঁর। এই ছবিতে গল্প বলার এমন অভিনব একটা উপায় জহির রায়হান খুঁজে নিয়েছিলেন, কেউ যদি রাজনৈতিক সচেতনতাকে দূরে সরিয়ে রেখে এই ছবিটি দেখে, তবু সে কোনো বিরক্তি ছাড়াই দারুণভাবে ছবিটি উপভোগ করতে পারে। আর এ কারণেই ছবিটি নিজের সময়কে ছাপিয়ে গিয়ে এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তবে সত্যি কথা হচ্ছে, আড়ালে থাকা রাজনৈতিক ভাষ্যই এই ছবিকে ধ্রুপদী মর্যাদায় উন্নীত করেছে। এই ছবি নিয়ে চিত্রনায়িকা ও স্ত্রী সুচন্দাকে জহির রায়হান বলেছিলেন, “আমি এমন একটা ছবি বানাতে চাই যেখানে দেশের কথা থাকবে; থাকবে ভাষা দিবসের কথা। ছবিটা দেখে মানুষ উপলব্ধি করবে আমাদের স্বাধিকার দরকার, কিন্তু আমি সেটা বলতে চাই একটা সুন্দর গল্পের মধ্যে দিয়ে।”
এই কথাটুকুই স্পষ্ট করে দেয়, জহির রায়হান মূলত ছবিটা নিছক স্লোগানসর্বস্ব কিছু করে তুলতে চাননি। হ্যাঁ, রাজনৈতিক বিধিনিষেধ কিংবা সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু সেটাই সম্ভবত এই ছবিটির জন্য শাপে বর হয়ে এসেছে। আমরা যদি জহির রায়হানের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করি, তবে এই ছবিটি জহির রায়হানের পুরো রাজনৈতিক জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গির চক্রও পূরণ করেছে। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাভাস। সবটাই যেন এই ছবিতে পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে তিনি যা বলেছিলেন, ‘সুন্দর গল্পের মধ্য দিয়ে ছবিটা বানানো’, যা সম্ভবত তিনি সব সময় করতে চেয়েছেন। প্রথম চলচ্চিত্রেই যার শুরুটা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা উপেক্ষা করে কেবলই নান্দনিকতায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো মানুষও তিনি ছিলেন না। ফলে দুটোর মাঝামাঝি একটা অবস্থানই হয়তো তিনি খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন। যা তিনি খুঁজে পান জীবন থেকে নেওয়া–এ এসে। আর এই মিথস্ক্রিয়া আমাদের উপহার দেয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা ছবিটি। যার নতুনত্ব ও রেশ এখনও অমলিন।
জীবন থেকে নেওয়া–র পরই শুরু হয় কঠিন লড়াইয়ের এক বাস্তব গল্পের। মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন কবিতার সৌন্দর্য, গানের সুর, চিত্রকর্মের মাধুর্য কিংবা চলচ্চিত্রের তৈরি করা বিহব্বলতার কোনো আবেদন থাকে না। তখন সবকিছুর কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায় কেবল অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। মানবিকতা তখন ধুলোয় লুটাতে থাকে এবং মানুষের কদর্যতা সকল মানবিক সীমাকে ভেঙেচুরে দিয়ে আঘাত করে তীব্রভাবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমনই একটি সময় ছিল ১৯৭১। যা ইতিহাসের বর্বরতম এবং নৃশংস এক সময়ের দলিলও। ২৬ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট দিয়ে শুরু হয় এই নৃশংস অধ্যায়ের। শুরু হয় মানবিকতাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে অবিশ্বাস্য এক গণহত্যার। যার জবাব দিতে অবশ্য দেরি করেনি স্বাধীনতাকামী জনগণ। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একটি যুদ্ধ মানে কেবল অস্ত্র হাতে লড়াই করা নয় কিংবা রূপকথাময় এককেন্দ্রিক কোনো বয়ান নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও অনেক লড়াই। তেমনই একটি লড়াই জহির রায়হান করেছিলেন স্টপ জেনোসাইড দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের অসামান্য এক উদ্যোগ ছিল এটি। একটি দেশের লড়াই এবং তারও পর হয়ে যাওয়া নিকৃষ্টতর নিপীড়নকে ধরে রাখার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো মাধ্যম আর হতে পারত না। ক্যামেরাকে অস্ত্র বানিয়ে ঠিক সেই কাজটাই করেছেন জহির রায়হান। একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী কতটা বর্বর হয়ে উঠতে পারে, তা সম্ভবত স্টপ জেনোসাইড না দেখলে উপলব্ধি করা যেত না। প্রথমত এটি ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করে রাখার একটি প্রক্রিয়া, যার প্রভাব অনেক দূর অবধি বিস্তৃত। এর বাইরে আছে এটির তাৎক্ষণিকতা বা সময়ের প্রয়োজনীয়তাও। তাৎক্ষণিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরনের কাজের প্রভাব হয় বিস্ফোরণের মতো। জীবন থেকে নেওয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। মানুষের ওপর নির্মমতা কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং মানুষ মানবিকতার সমস্ত দেয়াল ভেঙে নিজেকে কতটা বর্বর করে তুলতে পারে, এটি ছিল তার দলিল। এই চলচ্চিত্র বানাতে জহির রায়হানকে যেতে হয়েছিল ভয়ঙ্কর এক সময়ের ভেতর দিয়ে। ছবিটি বানাতে জহির রায়হানকে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছিল, তা উঠেছে আরেক প্রখ্যাত নির্মাতা আলমগীর কবিরের এক লেখায়, “ঘরে স্ত্রী সুচন্দা অজ্ঞান। বড় ছেলে অপুও অসুস্থ। জহির ঘরে নেই। স্টুডিওতে। দিন নেই, রাত নেই, ঘুম নেই— স্টপ জেনোসাইড তৈরি করছে। ও জানত স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রচারই যথেষ্ট নয়। বিশ্বের সকল পরাধীন শোষিত মানুষের সংগ্রামের সাথে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের একাত্মতা বোঝাতে হবে এই ছবির মাধ্যমে।”
হ্যাঁ, জহির রায়হান তা করতে পেরেছেন। মানুষের কোনো কিছু করতে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছা জহির রায়হানকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে এই কাজটি। যা আরও কয়েকশো বছর পরও এ দেশের মানুষের ওপর হয়ে যাওয়া এক নারকীয় অধ্যায়ের বিবরণ হয়ে নিজের ভাষাতেই কথা বলবে।
এই পর্যায়েরই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারত লেট দেয়ার বি লাইট। এই চলচ্চিত্রের কাজ জহির রায়হান শেষ করে যেতে পারেননি। ১৯৭০ সালে এই ছবির নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন জহির রায়হান। ধর্ম, জাতি, বর্ণের অজুহাতে বিশ্বব্যাপী হয়ে যাওয়া নারকীয়তার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে একটি আখ্যান রচনা করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই ছবির কাজ যখন চলমান, তখনই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের কাজের অভিমুখ বদলাতে হয় জহির রায়হানকে। অসম্পূর্ণ থেকে যায় আরেকটি ধ্রুপদী হয়ে ওঠার মতো চলচ্চিত্র। সেটি না হওয়ার আক্ষেপ আমাদের চিরন্তন। যেমন আক্ষেপ আছে একুশে ফেব্রুয়ারি নামের কাজটি শেষ করতে না পারার। তবে নিখোঁজ হওয়ার আগে এ স্টেট ইজ বর্ন, লিবারেশন ফাইটার্স এবং ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স-এর মতো কাজ দিয়ে পরবর্তী সম্ভাব্য কর্মযজ্ঞের একটা ধারণাও দিয়ে রাখেন তিনি। এছাড়া এমন অসংখ্য নাম না-জানা চলচ্চিত্রের কথা আমরা ভাবতে পারি যা বেঁচে থাকলে জহির রায়হান বানাতেন।
আমরা জানি না সেসব কাজ কেমন হত। কারণ, নানা বৈচিত্র্যময়তার ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের চূড়া স্পর্শের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। পরবর্তী কাজগুলোও তেমন বৈচিত্র্যময় হত। পাশাপাশি আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, তিনি তাঁর সব চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন একটি পরাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁর ছবি নিশ্চয়ই ভিন্ন কিছু নিয়ে আসত আমাদের সামনে। স্বাধীন দেশের আত্মপরিচয় খোঁজার যে সংকট, পঁচাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, দীর্ঘমেয়াদি সেনা শাসন-সহ বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো নিশ্চয়ই ধরা দিত তাঁর কাজে।
এটা অবশ্য বলা বাহুল্য যে, জহির রায়হানের পুরো সিনেমাযজ্ঞের অভিমুখ ছিল রাজনীতিকে উদ্দেশ করে। কিন্তু সেই রাজনীতি ছিল একান্ত জহিরীয়। চেনা যে বয়ান এবং প্রতিষ্ঠিত ‘সত্য’-এর বাইরে গিয়ে নিজের এই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন দেখতে চেয়েছেন তিনি। ফলে সে সময় যাঁরা ইতিহাসের রূপরেখা ঠিক করতে বসেছিলেন, তাঁদের জন্য জহির রায়হান মোটেই স্বস্তিদায়ক কোনো চরিত্র ছিলেন না। কারণ, জহির রায়হানের যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিলাষ ছিল, সেটা পুরোপুরি চাওয়াপাওয়ার কাঠামোর ভেতর আবদ্ধ ছিল না। তাঁর ক্যামেরায় এমন কিছুও নাকি ধরা পড়ছিল, যা তখনকার এস্টাব্লিশমেন্টের জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। তাই জহির ক্রমশ অস্বস্তির নাম হয়ে উঠছিলেন।
এর বাইরে সিনেমা এবং লেখায় জহিরের ক্রমাগত ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার যে ‘বদভ্যাস’, সেটা যে পরবর্তীতে ক্ষমতাকাঠামোর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠতে যাচ্ছে, তা আমরা আন্দাজ করতে পারি। যদিও এগুলো স্রেফ ‘ইফ্স অ্যান্ড বাট’। তাছাড়া জহির রায়হানের রেখে যাওয়া কীর্তিগুলো ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে কম ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র নয়। ক’দিন আগে আমরা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হয়েছি, সে সময়েও আমরা জহিরীয় বয়ানকে হাজির থাকতে দেখেছি পূর্ণ অবয়ব নিয়ে। এমনকী পরবর্তীতে সময়ের প্রয়োজনে আমরা আবার উদ্ভাসিত হতে দেখব জহির রায়হানকে। আমাদের জাতীয় চেতনায় জহির রায়হান এতটাই অপরিহার্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রেও আমাদের সামনে অজানা কোনো অধ্যায়কে হয়তো উন্মোচিত করতেন জহির রায়হান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত বেশিরভাগ দুর্বল চলচ্চিত্রও আমাদের মধ্যে সেই আক্ষেপকে উসকে দেয়৷ যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতা নিয়ে নির্মিত হয়েছে লাইফ ইজ বিউটিফুল কিংবা শিন্ডলার্স লিস্ট–এর মতো অসংখ্য ক্লাসিক চলচ্চিত্র। জহির রায়হান বেঁচে থাকলে তাঁর নতুন শুরুটা যে সেই পথেই হত তা অনুমান করাই যায়। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশে যে খুব বেশি উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হল না, এই জায়গাতে বড়ো একটি দীর্ঘশ্বাসেরই নাম জহির রায়হান। চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর মতো করে মুক্তিযুদ্ধকে কে আর বুঝতে পেরেছিল! কেউ পারেনি! ফলে তাঁর হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের যে স্বরূপ আমাদের সামনে উন্মোচিত হত, সেটা আমাদের অধরাই থেকে গেল।
কিন্তু এসব কিছুই শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। সবচেয়ে বড়ো আক্ষেপ হচ্ছে, তিনি প্রাণ দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশে। যখন স্বাধীনতা আর মুক্তির আনন্দে এ দেশের মানুষ বুক ভরে নিশ্বাস নিতে শুরু করেছিল, তখন স্তব্ধ করে দেওয়া হয় কিংবদন্তী এই মানুষটিকে৷ ১৯৭২ নালের ৩০ জানুয়ারি অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের হত্যা রহস্য উন্মোচিত করতে গিয়ে হারিয়ে যান নিজেও। সেই যে হারালেন, আর ফিরলেন না। কখনো আসেনি ছবির মতোই রহস্যময় তাঁর মৃত্যু। প্রতিষ্ঠিত বয়ান আছে বটে। যে বয়ানে জহির রায়হানকে বিহারি রাজাকারদের হাতে হত্যার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পালটা-বয়ানও আছে যে রাষ্ট্রপক্ষ বা বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাই তাঁকে গুম করেছিল। আছে অমীমাংসিত অনেক প্রশ্ন। আমাদের জানা উচিত কেন স্টপ জেনোসাইড নির্মাণের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন৷ কেন বিভিন্ন সেক্টরে তাঁকে শুটিং করতে দেওয়া হয়নি, এমনকী তাঁর সেসব জায়গায় যাওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। আর কেনই বা আওয়ামী লীগের নেতারা এই ছবির ছাড়পত্র না দিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। সঙ্গে এটা জানাও খুব কঠিন ছিল কি, গুম হওয়ার আগে তাঁকে অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোনটা কে করেছিলেন? এমন আরও অনেক প্রশ্ন। এখন এসব প্রশ্ন জহির রায়হানের চাচাতো ভাই এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী শাহরিয়ার কবিরও তুলেছিলেন৷ এখন এত কিছুর পর কেউ যদি জহির রায়হানের প্রতি আওয়ামী নেতাদের ক্ষোভ বা ক্রোধের সঙ্গে তাঁর গুম-খুনকে মিলিয়ে দেখতে চান এবং তৎকালীন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবকে এ জন্য দায়ী করতে চান, তবে আপত্তির সুযোগ সামান্যই থাকে। যা-ই হোক, এগুলো স্রেফ প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা। তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানাও বেশ জরুরি।
জহির রায়হানকে অকালে হারানোর আক্ষেপ নিয়ে আলমগীর কবির লিখেছেন, “আজ আমাদের দুর্দশা দেখে বারবার মনে হয়, জহিরের কাছে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প কতটা পেতে পারত—যদি না স্বাধীন বাংলারই বুকের উপর এমন একজন তেজস্বী দেশপ্রেমিককে হত্যা করতে দিতে পারতাম।”
এত কিছুর পরও আমরা সৌভাগ্যবান যে একজন জহির রায়হানকে পেয়েছিলাম। কিন্তু একবার পেয়ে হারিয়ে ফেললাম চিরতরে। জীবনানন্দ দাশ ‘শঙ্খমালা’ কবিতায় যেমনটা বলেছিলেন, “এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর”। আমরাও আরেকজন জহির রায়হানকে আর কখনো পাব না।
হাসনাত শোয়েব
জন্ম ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮। স্নাতকোত্তর (দর্শন), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা : সাংবাদিকতা। প্রকাশিত বই : সূর্যাস্তগামী মাছ (কবিতা, মেঘনাদ প্রকাশনী, ২০১৫) ব্রায়ান এডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার [কবিতা, জেব্রাক্রসিং, ২০১৭