।। সুপর্ণা ভট্টাচার্য ।।
সুমেধার ওই ছেলে দুটির মুখ মনে পড়লো। এতটুকু বয়সেই লড়াই শুরু করে দিয়েছে। পরম মমতায় সামান্য স্ফীত পেটের ওপর হাত রাখে। মনে মনে বলে, এমন পৃথিবীতে আসছিস, যেখানে যুদ্ধ করতে হবে প্রতি মুহূর্তে!
চরৈবেতি
কোর্ট চত্বর তেতে ছিল আজ, গত কয়েকদিনের অসন্তোষ আজ বড় নগ্নভাবে প্রকট হলো। এপ্রিল মাসেই প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি। তার ওপর এই সারাদিনের অশান্তি। উকিলদের তরজা। প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সুমেধা খুব ভালো করেই জানে, সব উকিলরাই জানেন, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়। বিচারপতি অনিমেষ চট্টোপাধ্যায় সত্যের পথে চলতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, সেটা নিয়ে এতো সমস্যা কেন যে! সে অনিমেষকে অসীম শ্রদ্ধা করে। সুমেধার ক্লান্ত লাগে আজকাল। তাই একদম নীরব ছিল। ট্রেনে জানলার ধারে জায়গা পায়, ফিরতি পথে। বমি পাচ্ছে দুপুর থেকেই। খোলা হাওয়ার ঝাপটা মুখে লাগবে। সুরজিৎ বলছে প্রায়ই, কাজ বন্ধ করে দিতে। মানসিক আর শারীরিক দুইয়ের চাপ সুমেধা নিতে পারছে না, সেটা সুমেধা মুখে স্বীকার না করলেও, সুরজিৎ বুঝতে পারে। শাশুড়ি মা ও বেশ উদ্বিগ্ন। ঠাণ্ডা মানুষ, জোর করে কিছু বলেন না। পাশে এসে বসে ক্ষীণকায় এক অল্প বয়সী বউ, কোলে বছর খানেকের মেয়ে, গোলাপি ফ্রক। বউয়ের মুখেও কেমন এক অপার ক্লান্তি। সুমেধা আশেপাশে তাকায়। ক্লান্তিহীন মুখ দেখতে পায়না। এমন কী ছোট বাচ্চা মেয়েটির মুখও কেমন বিষণ্ণ,চোখ দুটিও হাসছে না। সুমেধা বাইরে তাকায়। এখনও কিছু কিছু জায়গা ফাঁকা, বুনোফুলের ঝাড় ঘন হয়ে আছে। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে এসব জায়গা আর ফাঁকা থাকবে না। কালকেই খবরে বলছিল, দশ-বারো বছরের মধ্যে কলকাতার বহু অংশ ডুবে যাবে। ডুবে যাক, যাক ডুবে সব।
সুমেধা শিউরে ওঠে, এসব কী ভাবছে সে! পাগল হয়ে গেছে নাকি ! উল্টোদিকে এক বৃদ্ধা বসে। সুমেধার দিকে তাকিয়ে কি হাসলেন? গতকালের মিসেস নবনীতা বিশ্বাসের কথা মনে পড়লো, নাতনী আর মেয়ে সেঁজুতিকে নিয়ে এসেছিলেন, অনুরাধাদির কাছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন সেঁজুতির ওপর নিত্যদিন মানসিক অত্যাচার চলে সঙ্গে শ্বশুর বাড়িতে, শুধুমাত্র সেঁজুতির মেয়ে হয়েছে বলে। অবশেষে মিসেস বিশ্বাস মেয়ের ডিভোর্সের জন্য এসেছেন। সিনিয়র অনুরাধাদি সুমেধাকে ওনারা চলে যাওয়ার পর বললেন, ”সমাজ কোথাও এগোয় নি সুমেধা, স্বাধীনতা অর্জন করা হয়নি সামগ্রিকভাবে, সাম্যবাদ আদতে সোনার পাথরবাটি, তবু তো মিসেস বিশ্বাস সমাজকে উপেক্ষা করে মেয়েকে নিয়ে আসতে পেরেছেন, আমার কাছে!”
কী টুলটুলে মিসেস বিশ্বাসের নাতনী। নাম জিজ্ঞাসা করতে নরম স্বরে বলেছিল, ‘বহ্নিশিখা’। থমকে গিয়েছিল সুমেধা। সকলের নাম জানতে বড়ো আকুল হয় সে। জানে না কেন! সন্তোষপুর আসছে। ভিড় ঠেলে দরজার কাছে পৌঁছায় সুমেধা। ঘাম আর পোশাকের মিশ্রিত গন্ধে আবার শরীর গুলায়। স্টেশনে নেমে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। মিনিট পাঁচেক হাঁটাপথ পা টেনে টেনে পার করে।
– ঘেমে নেয়ে গেছ তো!
– একটু কোল্ড কফি বানিয়ে দিতে পারবে মা?
– হ্যাঁ, স্নান করে এসো, দিচ্ছি।
– তবে দু’জন ছেলে এসেছিল, একটূ আগে, আবার আসবে, বলে গেছে’।
বাথরুমে ঢুকে বমি করে সুমেধা। তারপর স্নান করে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে। এভাবে আর কতদিন চালাতে পারবে, বুঝতে পারেনা।ঘরে ঢুকে হালকা করে এসি চালিয়ে কোল্ড কফিতে চুমুক দেয়। সুরজিৎ ট্যুরে গেছে। দিন তিনেক পর ফিরবে। আজকাল সুরজিৎ ট্যুরে গেলে বেশ চিন্তা হয়, চারিদিকের অবস্থা একটুও ভালো নয়। সুরজিৎ হেসে উড়িয়ে দেয় সুমেধার আশঙ্কা। ”অকারণ ভয় পাও আজকাল। বরং তোমার জন্যই আমার চিন্তা থাকে”। সুরজিৎ বেশ শান্ত, ভদ্র। সুমেধার কোনো অভিযোগ নেই সুরজিৎকে নিয়ে। এরকম নিস্তরঙ্গ জীবন এক একসময় বেশ একঘেয়ে লাগে। ঘুম ঘুম আসছে, তখনই ছেলে দুটি এলো। হাউজ কোট চাপিয়ে বসার ঘরে এসে দেখল, দুটি বছর বাইশ, তেইশের ছেলে জড়োসড়ো হয়ে বসে।
– বলো
– একটা বিপদে পড়ে এসেছি।
একটু বড়োসড়ো ছেলেটি বলে। অন্য ছেলেটি নিতান্তই ভীতু, দেখে মনে হচ্ছে।
– হুম, বলো।
– আসলে আমরা দুজন একটা স্টল দিয়েছি। স্ন্যাক্সের, ওই রোল, মোমো, পোড়া, এইসবের…
– ‘পাকা দোকান?
– না, না, অস্থায়ী। মানে ওই গাড়ি মতো, যেমন হয়না?
– ও,, তা কি সমস্যা?
– আমাদের পাড়ার মোড়ে , গাড়ি রেখে, বিক্রি করছি। সন্ধ্যার সময়, এই সপ্তাহ খানেক হলো।
সুমেধা মনে করতে পারেনা, আসার পথে দেখেছে কিনা। খেয়াল করেনি।
– তোমরাই রান্না করো?
– না, কুক আছেন একজন। আমরা দু’জন মিলে ইনভেস্ট করেছি।
সুমেধা চুপ থাকে। ছেলেটি সেন্টার টেবিলে রাখা বোতল থেকে জল খায়।
– পাড়ার দুজন, মানে ‘দাদা’ টাইপের,কাল সন্ধ্যায় এসে দোকান বন্ধ করে দিয়েছে, বলেছে, পাঁচ লাখ টাকা ওদের দিতে হবে, নাহলে ওখানে বিক্রি করতে দেবেনা, এত টাকা কোথা থেকে পাব! বাবার থেকে এই দোকান করতে যা লেগেছে, নিয়েছি, আর বাবা কোথা থেকেই বা দেবে?
সুমেধা বুঝতে পারেনা কী বলবে।এদের দৌরাত্ম্য যে তাদের পাড়া তেও আছে, শুনে, অবাক হলো। গত দু’বছর এখানে থেকেও কিছুই জানেনা সে।
– আমার কাছে এসেছ কেন! আমি তো এ বিষয়ে কিছু করতে পারব না ভাই। তোমরা এতো কম বয়সে কি আইনি ভাবে লড়তে পারবে? এক কাজ করো, আমাদের যিনি কাউন্সিলর, তার কাছে যাও, বলে দেখো। দরকার হলে বাবাকে নিয়ে যাও।
ভীরু মুখ, শান্ত ছেলেটি এতোক্ষণ পর বলে-
– ওরা কাউন্সিলরের কাছের লোক দিদি। আমরা দিশা না পেয়ে আপনি উকিল জেনে এসেছিলাম’বলেই, উঠে দাঁড়ায়।
অন্য ছেলেটিও ওঠে।
– তোমরা তাহলে থানায় যাও।
দু’জনেই খানিক চুপ করে থাকে। নিঃশব্দে চলে যায় তারপর। সুমেধা মাথা এলিয়ে বসে থাকে। ফ্যানের শব্দ বড়ো বেশি কানে লাগছে।
– শরীর ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ।
– আমি পরশু ফিরছি, কাজ মোটামুটি কমপ্লিট’।
– আচ্ছা রাখি?
– হ্যাঁ
সুরজিৎ ফোন রাখার পর সুমেধার খারাপ লাগে। সে একবারও সুরজিতের শরীরের খোঁজ নেয়না। মনেরও নেয় কি?
মা কেমন ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতো, ”সকলকে ভালো রেখো ঠাকুর, সুখে, শান্তিতে রেখো। সুস্থ রেখো।” সুমেধার ওই ছেলে দুটির মুখ মনে পড়লো। এতটুকু বয়সেই লড়াই শুরু করে দিয়েছে। পরম মমতায় সামান্য স্ফীত পেটের ওপর হাত রাখে। মনে মনে বলে, এমন পৃথিবীতে আসছিস, যেখানে যুদ্ধ করতে হবে প্রতি মুহূর্তে!
পরদিন সন্ধ্যায় পাড়ার মোড়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে অস্থায়ী দোকানটি। ছেলে দুটি খাবার দিচ্ছে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকে গোটা পাঁচ ছয় মানুষকে। সুমেধা গিয়ে ইশারায় ডাকে ওদের। রোগা ছেলেটি আসে। একটু দূরে নিয়ে সুমেধা তাকে বলে-
– শোনো, কাল আমি কোর্ট যাবনা, তোমরা সকাল দশটায় এসো, আমি তোমাদের নিয়ে থানায় যাব, তারপর দেখছি, কী করা যায়।
ছেলেটি খুশি গলায় বলে, ”আমরা আজ ভয় না পেয়ে দোকান খুলেছি দিদি। ঠিক করেছি, দোকান না ভেঙে দেওয়া অবধি, বা আমাদের মেরে ফেলা না অবধি এ দোকান বন্ধ থাকবে না। মানছি, আমরা পাবলিক রাস্তার ধারে গাড়ি-দোকান করছি, তার জন্য যা আইন মাফিক ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটা নেবো।”
সুমেধা কাঁধে হাত রাখে ছেলেটির। নাম কী তোমার? ‘
– বিপ্লব আর বন্ধুর নাম জয়ন্ত, আমি ডাকি জয়।
সুমেধা হঠাৎ অনুভব করে কেমন ঝোড়ো হাওয়া বইছে। কালবৈশাখী হবে কি?
ঘরে ঢুকতেই শাশুড়ি বলেন, আজ একটু পায়েস করেছি, তুমি ভালোবাসো, ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি দিচ্ছি।
– তোমারটাও এনো, একসঙ্গে খাবো।
স্নানধারার জলে আশরীরভিজে যায় সুমেধার। গর্ভ জলে ভাসা ক্ষুদ্র প্রাণের কাছে অঙ্গীকার করে, ‘দুর্বল হয়ে নতি স্বীকার না করার’। সুরজিতের ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে রাতের বেলা বৃষ্টি নামল। মাটি এবার শীতল হবে।
সুপর্ণা ভট্টাচার্য
নাট্যশিল্পী। জীববিদ্যায় স্নাতক। লেখার প্রতি ভালোবাসা ছোটো থেকেই। সংসার এবং থিয়েটারের অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক লেখা, এবং সেগুলি মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশ। এ বছর কলকাতা বইমেলায় ‘ছাপাখানা’ প্রকাশনা থেকে ‘বিম্বিত মুকুর’ নামাঙ্কিত তাঁর থিয়েটার যাপনের গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।