আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গলে পড়া ঘড়ি

ছোটগল্প

।। অতনু সিংহ ।।

আজকের সময়ের প্রেক্ষিতে নতুন করে গল্পটিকে বিনির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করেছেন অতনু সিংহ। মূল গল্পটি তিনি লিখেছিলেন ২০১০ সালে। ২০২০ দসালের ১৯ ডিসেম্বর সলিল চৌধুরীর জন্মদিনে গল্পটিকে লেখক নিজেই আরেকবার সম্পাদনা করে প্রকাশ করলেন প্রতিপক্ষে।আজকের সময়ের প্রেক্ষিতে নতুন করে ‘দালিকে লেখা মেটামরফো নামের একটি গল্পের বিনির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করেছেন গল্পটির লেখক অতনু সিংহ। মূল গল্পটি তিনি লিখেছিলেন ২০১০ সালে। গল্পটি লেখা হয়েছিল সলিল চৌধুরীর ‘পথে এবার নামো সাথি’ গানটির কথা মাথায় রেখে। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর সলিল চৌধুরীর জন্মদিনে গল্পটিকে লেখক নিজেই আরেকবার সম্পাদনা করে প্রকাশ করলেন প্রতিপক্ষে। পুনর্নির্মিত এই গল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘গলে পড়া ঘড়ি’।


হায় কোন সুদূর সেই স্বপ্নপুর…

সারারাত আমাদের বাগানে ফুল ঝরতো। ভোরবেলা পশ্চিম পাড়া থেকে আয়েশা আসতো ফুল কুড়াতে। সঙ্গে হৃদয়। খুব সকালে বাগানের পাশের বাড়িটায় যারা জানলা খুলে খুশি মুখে ঘুমিয়ে থাকতো, তাদের বিছানায় মুঠো মুঠো ফুল ছুঁড়ে দিয়ে ভীষণ মজা পেতো আয়েশা। হৃদয় এসব দেখে বিড়ি ধরাতো একটা। চলে যেতো রেলব্রিজের দিকে। ঝিক্‌ঝিক্‌ ট্রেন আসতো।
ট্রেন থেকে নামতো একমাত্র একটা বুড়ো। তার হাতে খানদানি লাঠি। মাথা নেড়ে সেই বুড়ো হৃদয়কে জিজ্ঞাসা করতো, ‘আজকাল কি করছো খোকা?’ হৃদয়ের উত্তর, ‘কিছুই করছিনা। শুধু টিক্‌টিক্‌ করা ঘড়িগুলোকে থামিয়ে দিচ্ছি। আপনার ঘড়িটা দেবেন?’ ওদিকে চুলে আর দু’কানে বকুল গুঁজে আয়েশা তখন দু’হাত ভরে শিউলি এসে দাঁড়িয়েছে বুড়ো আর হৃদয়ের মাঝখানে। বুড়োর হাতে একমুঠো শিউলি তুলে দিয়ে বলছে, “আপনার বিছানায় ছড়িয়ে দেবেন।” বুড়ো তখন গান ধরছে, “বৃন্দাবনো বিলাসিনী রাই আমাদের…”ঠিক তখনই ধূমকেতুর মত এসে হাজির অন্ধ কানাই। কানাই বলে, “ওভাবে নয় খুড়ো, সুরে একটু মায়া আনো… রাই আমাদের রাই আমাদের রাই আমাদের, শ্যাম তোমাদের…” গাইতে গাইতেই গলায় ঝোলানো হারমোনিয়ামে আঙুলে আঙুল সুরকে আরো আরো মেলে দিতো কানাই। গান হোতো, “আজ রাই যমুনায় যাবেনা শ্যাম, আজ রাই যমুনায় যাবেনা…”

আয়েশা মুগ্ধ হয়ে কানাই-এর বুজে আসা দু’চোখে হাত ছুঁয়ে দিয়েছিলো। আর কী এক নাম না জানা ফুল তার হাতে দিয়ে বলেছিল, “সাঁঝের বেলা গন্ধ হবে দেখো। আর তুমি যেখানে থাকো, তার উত্তর দিকে যে পুকুর, ওখানে গিয়ে কদমডাল ধরে জলে নেমে যাবে। কোমর জলে নেমে একহাত হাত বাড়ালেই তোমার হাতে এসে ঠেকবে একটা কড়ে আঙুল…” কানাই এসব শুনে জোরে জোরে গাইতো, “আর শ্যাম যমুনায় যাবেন রাই, শ্যাম যমুনায় যাবে না…”

এই গান শুনে আমার ঘুম ভাঙতো। আমি বাগানের পাশেই আড়াইতলা বাড়ির চিলেকোঠায় ঘুম থেকে উঠে দেখতাম নীচে সবুজে সবুজ… আগের রাতের বৃষ্টির গন্ধ…আর আয়েশার খিলখিল হাসি, কানাই-এর গান, হৃদয়ের হুল্লোড়, বুড়োর মস্করায় বাগানে বর্ষামঙ্গল শুরু হয়েছে। আমি একটা ড্রইং খাতা আর প্যাস্টেল নিয়ে এসে হৃদয়কে বলতাম, ”আমায় একটা বন্ধ ঘড়ি এঁকে দেবে?”
হৃদয়ের উত্তর, “আঁকলে সব ঘড়িই বন্ধ থাকে!”
আয়েশাকে কিছুই বলছিনা দেখে সে খুব ক্ষেপে যেত!
”তোর ব্যাপারটা কি রে অতনু, খুব দেমাক বেড়েছে… নাকি তোকে ফুল দিইনি বলে… কী করে তোর বিছানায় ফুল ছুঁড়বো বল, তুই তো মিনারের মাথায় শুয়ে থাকিস…”
মুচকি হেসে আয়েশার হাতটা ধরতাম। চোখে বাঁধতাম একটা সাদা রুমাল। শুরু হোতো বাগানের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে আ্মাদের কানামছি খেলা।
কানাই আর বুড়ো হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ গাইতো।
হৃদয় খাতা ভর্তি করে বন্ধ ঘড়ি আঁকত।

হৃদয় ঘড়ি আঁকে, সময় পেরোয় না, সুর্য স্থির, রোদ্দুর গাছের ফাঁক দিয়ে একটাই অ্যাঙ্গেলে…

অল উই আর ইন আ স্ট্যাটিক ফ্রেম!

এই গান শুনে আমার ঘুম ভাঙতো। আমি বাগানের পাশেই আড়াইতলা বাড়ির চিলেকোঠায় ঘুম থেকে উঠে দেখতাম নীচে সবুজে সবুজ… আগের রাতের বৃষ্টির গন্ধ…আর আয়েশার খিলখিল হাসি, কানাই-এর গান, হৃদয়ের হুল্লোড়, বুড়োর মস্করায় বাগানে বর্ষামঙ্গল শুরু হয়েছে। আমি একটা ড্রইং খাতা আর প্যাস্টেল নিয়ে এসে হৃদয়কে বলতাম, ”আমায় একটা বন্ধ ঘড়ি এঁকে দেবে?”
হৃদয়ের উত্তর, “আঁকলে সব ঘড়িই বন্ধ থাকে!”

তবে, আগের এই লাইনটা বাদে এতক্ষণ ধরে কেন ভাষার কালচেতনায় ছিল অতীত? কেন অতীত কালের ন্যারেশন? কেন অতীতের এই কথন ক্রিয়া, ‘হোতো’, ‘করত’, ‘বলতো’…! সময় যদি বন্ধ ঘড়ির কাচের আড়ালে থেমেই থাকে, তাহলে কোথায় আয়েশা? কোথায় হৃদয়? কোথায় কানাই? কোথায় সেই বুড়ো? কোথায় আমাদের বকুল, টগর, জুঁই, কামিনী, জুঁই, পলাশ… কোথায়? কোথায় সেই রেলব্রিজ?

তোমার গ্রামে রেলব্রিজের তলে, ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার…

ব্রিজ দিয়ে বাস চলে, এসি বাস চলে, ট্রাক চলে, লড়ি চলে, স্করপিও-সুমো চলে, অডি, হুন্ডাই, বিএমডব্লিউ… চে’র মুখ প্রিন্ট করা টিশার্ট গায়ে পালসার চালিয়ে ব্রিজ দিয়ে মাচো যায়, মাচো পিছনে হাড়-জিরজিরে জিরোফিগার, তার টি শার্টে ম্যারলিন মনর‍্যোর মুখ, মুখ থেকে সিগারের ধোঁয়া…ব্রিজ দিয়ে বাস চলে, এসি বাস চলে, ট্রাক চলে, লড়ি চলে, স্করপিও-সুমো চলে, অডি, হুন্ডাই, বিএমডব্লিউ….. ব্রিজ দিয়ে পতাকা চলে, ঘাষ ফুল, কাস্তে হাতুড়ি তারা, ব্রিজ দিয়ে আচ্ছে দিন ছুটে যায়, ব্রিজের মাথায় গেরুয়া পতাকা ওড়ে, তাতে আঁকা হনুমানের মুখ, মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে ব্রিজ দিয়ে বাইকে বাইকে ছুটে যায় প্রজন্মান্তর!
ব্রিজ মানে আকাশ ব্রিজ, এর পেটের ওপর দিয়ে তার পেটের নীচ দিয়ে, এর ঘাড় তার পিঠ ওর কাঁধ ছুঁয়ে কংক্রিট পাইথন, যেন ব্রিজের গ্যাংব্যাং চলছে। তার পাশে ভার্টিক্যাল ও হরাইজেন্টাল স্কাইস্ক্র্যাপার!
আমার জানলার পাশে আজ এনিমেটেড পৃথিবী! আমি জানলা খুলে চেয়ে থাকি আমার ফ্ল্যাটে! আমি রেডিও কোয়ারেন্টিন শুনি! টেবিলে চা ঠাণ্ডা, মিয়ানো বিস্কুট। টিভি চলে… টিভিতে ‘নেশন ওয়ান্টস টু নো’! টিভিতে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউজ থেকে সরানোর তৎপরতা”, টিভিতে ব্রেকিং নিউজ: ‘মধ্যাহ্নভোজ সারতে আদিবাসী বাড়িতে অমিত শাহ’! টিভিতে ‘দলিত মেয়েকে গণধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারা হলো, অভিযোগের তির গেরুয়া শিবিরের দিকে!’ টিভিতে ‘ডিটেইনশন ক্যাম্পে মারা গেলেন বৃদ্ধ!’ টিভিতে ‘সিপিএমের রিঙ্কু নস্কর যোগ দিলেন বিজেপিতে’! টিভিতে, ‘ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক শীতল হচ্ছে’! টিভিতে ‘শুভেন্দুর বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে গুঞ্জন’! টিভিতে, ‘অর্ণবকে জামিন দিলো সুপ্রিম কোর্ট!’ টিভিতে ‘আওয়ামী লীগকে একশো বছর ক্ষমতায় দেখতে চায় হেফাজত!’ টিভিতে ‘সারদা নিয়ে ফের সিবিআইকে ব্যবহার করে তৃণমূল্কে চাপে রাখতে চাইছে দিল্লি! টিভিতে, খ্যাক খ্যাক হাসি, লাচাগানা। ওদিকে স্মার্টফোনে গান বাজছে, ‘ও টুম্পা সোনা, দুটো হাম্পি দে না, আমি মাইরি বলছি আর খৈনি খাবো না…’
ডোরবেল বাজে।

– হ্যাঁ বলুন
– স্যার কুরিয়ার
-এখানে একটা সই করতে হবে।
– ও সিওর
– থ্যাঙ্কস স্যার
– মোস্ট ওয়েলকাম

আমার লোনটা পাশ হয়ে গ্যাছে। অল্প ঝঞ্ছাটেই… জিও মামা… একটু মস্তি হতেই পারে…মোবাইল বাজে। রিং টোন: ‘…পথে এবার নামো সাথি, পথে হবে এ পথ চেনা…

টিভিতে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউজ থেকে সরানোর তৎপরতা”, টিভিতে ব্রেকিং নিউজ: ‘মধ্যাহ্নভোজ সারতে আদিবাসী বাড়িতে অমিত শাহ’! টিভিতে ‘দলিত মেয়েকে গণধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারা হলো, অভিযোগের তির গেরুয়া শিবিরের দিকে!’ টিভিতে ‘ডিটেইনশন ক্যাম্পে মারা গেলেন বৃদ্ধ!’ টিভিতে ‘সিপিএমের রিঙ্কু নস্কর যোগ দিলেন বিজেপিতে’! টিভিতে, ‘ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক শীতল হচ্ছে’! টিভিতে ‘শুভেন্দুর বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে গুঞ্জন’! টিভিতে, ‘অর্ণবকে জামিন দিলো সুপ্রিম কোর্ট!’ টিভিতে ‘আওয়ামী লীগকে একশো বছর ক্ষমতায় দেখতে চায় হেফাজত!’

.পথে এবার নামো সাথি, পথে হবে এ পথ চেনা

সলিল চৌধুরীর কথা ও সুর। সলিলবাবুর কম্পোজিশনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের এই গণসঙ্গীতগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। গণনাট্য সংঘের কথা বললেই বলতে হয় বিগত শতাব্দীর দেশভাগের আগের দশক থেকে শুরু করে দেশভাগের পরের দশক বা পঞ্চাশের দশকের কথা। পিসি যোশী তখন ভারতের অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে সারা ভারতের কালচারাল একটিভিস্টদের এক ছাতার তলায় জড়ো করেছিলেন। ঋত্বিক ঘটক, কাঈফি আজমি, বিজয় তেণ্ডুলকার, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (৪৭-এর আগে), রবিশঙ্কর, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র… কতো কতো নাম। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র এই সময় ‘নবজীবনের গান’ লিখেছিলেন। কিন্তু গণনাট্য আন্দোলন ভেঙ্গে যায়! যেভাবে ভেঙেছিল বাংলা আর পাঞ্জাব।
পার্টি হেজিমনি কালচারাল স্পেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিল আর পাতিবুর্জোয়া রোম্যান্টিসজম গ্রাস করেছিল আরবান কমিউনিস্টনাম্নী মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যেও। ঋত্বিক এসব নিয়ে ‘কোমলগান্ধার’ বানালেন। পার্টি থেকে ঘাড় ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি, দেশভাগের ধাক্কা খেয়েছিলেন, এবার সিনেমার পুঁজিবাদী-আফিমে নিমজ্জিত পশ্চিমবঙ্গীয় দর্শকদের থেকেও গলা ধাক্কা খেলেন। ঋত্বিকের একসময়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও কমরেড সলিল চৌধুরি ষাটের দশকে গণনাট্য ছেড়েছিলেন মতান্তর ও মনান্তরে। লিখেছিলেন, “পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি / সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি…”। মজার বিষয়, বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন একবার মোহাম্মদ সেলিমের লোকসভা ভোটে জয়ের আনন্দে বেলেঘাটা অঞ্চলের সিপিএম লোকাল কমিটি জোরে এই গানটা বাজিয়েছিল! “নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখেঢেকে, সে কখন গ্যাছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে…” বিপ্লব ডেকে ডেকে ফিরে গেছে, আর সংসদীয় বামেরা ক্ষমতা ভোগ করেছে! আর এখন তারা ক্ষমতা হারানোর প্রতিশোধ স্পৃহায় আর সুপ্ত নিম্নবর্গ বিদ্বেষের কারণে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনতে চাইছে, নিজেদের নাক কেটে তৃণমূল কংগ্রেসের যাত্রা ভঙ্গ করতে চাইছে! হিহি!
যাইহোক্‌,’পথে এবার নামো সাথি…’ গানটা আমার মোবাইলের রিংটোন… আপনিও রিংটোন করতেই পারেন। যদিও পথে নামতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি, বাংলা যতই চুলোয় যাক না কেন আপনি ওয়েব সিরিজ দেখে আর পাস্তা-চিকেন ফ্রাই খেয়ে দিন কাটাতেই পারেন।

আজ রাই যমুনায় যাবে না শ্যাম

– আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি না রে! এবার সিরিয়াসলি ডায়াট শুরু করবো!
মাঝরাতে শ্রীলেখা আমায় ফোন করে তার শরীরে বাড়তি মেদ জমে যাওয়া নিয়ে উদ্‌বেগ প্রকাশ করলো! আমি তার কথাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে তাকে জানালাম যে আমার লোনটা পাশ হয়ে গ্যাছে।

এখন বিকেল। যীষ্ণুর সঙ্গে গড়িয়াহাটে দেখা। যীষ্ণু বললো, ‘মন্দারমনি যাবি?’

গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। মার্সিডিযে যীষ্ণু, প্রিয়াঙ্কা, আমি আর দুটো লাগেজ ব্যাগ। একটা ওল্ড মঙ্ক গোল্ড রিজার্ভ ১ লিটার, একটা বিপি ১ লিটার আর স্মার্ন অফ ১ লিটার।

ওদিকে দেখি যীষ্ণু কাকে একটা ফোন করতে করতে সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছে, ” ভাই ওটা তুই দু’দিনের মধ্যে পেয়ে যাবি। প্রিয়াঙ্কার ব্যাগে ওটা সিকিওরড আছে। রাতে হোটেলে ফিরে ওটাকে একটু ফ্রিজে রেখে দেবো। চিন্তার কোনো কারণ নেই বস্‌!”

সোনালী, লাল, সাদা পানীয়, ডাবের শাঁস আর ইলিশ মাছ ভাজায় মন্দারমণি সী-বিচে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে।
আমি যীষ্ণুকে জিজ্ঞাসা করি, “যীষ্ণু, তুই বন্ধ ঘড়ি আঁকতে পারিস?”
”ফাক! ওসব আমার কম্ম নয়, আমি খালি ফুর্তি করতে এসেছি। আঁতলামোতে আমি নেই…!” যীষ্ণু বললো।
কিন্তু প্রিয়াঙ্কা খুব উৎসাহের সঙ্গে জানালো যে ও ট্রাই করছে। আমি প্রিয়াঙ্কাকে একটা সাদা পাতা দিই। কিন্তু পেন কোথায়? পেন্সিল? প্রিয়াঙ্কা ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করতে যায়। আমি বলি, পেন্সিল আছে? প্রিয়াঙ্কা বলে “নোপ্‌, লিপস্টিক হ্যাজ…”

প্রিয়াঙ্কা ব্যাগ খোলে। একি! প্রিয়াঙ্কা লিপস্টিক বের করতে গিয়ে যেটা বের করেছে সেটা লিপস্টিক নয়, পেন নয়, রং পেন্সিল বা কাঠ পেন্সিল নয়। এমনকি ডিলডো নয়। একটা আস্ত পুং-লিঙ্গ!!!
প্রিয়াঙ্কা লজ্জায় পড়ে গিয়ে বলে, ”সরি! ভেরি সরি! আসলে এটা অর্ণব গত পরশু রাতে ফেলে গেছে! আমরা ইন্টিমেট হওয়ার পরে অর্ণব ওর ইয়েটাকে খুলে একটু ওয়াস করে শুকাচ্ছিলো। সেই সময় অর্ণবের অফিস থেকে হঠাত ফোন আসে। ওকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে হয়। তাই ও ওর যন্ত্রটাকে ওর জায়গা মতো না লাগিয়েই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। সেই থেকে ওটা আমার ভ্যানিটি ব্যাগে রয়ে গেছে…”
আমি বলি, “ওকে নো প্রবস্‌! ইটস্‌ কোয়াইট ন্যাচারাল!’
বন্ধ ঘড়ির বদলে আমার মনে পরে যায় সালভাদোর দালির বিখ্যাত গলে পড়া ঘড়ি ছবিটার কথা।

ওদিকে দেখি যীষ্ণু কাকে একটা ফোন করতে করতে সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছে, ” ভাই ওটা তুই দু’দিনের মধ্যে পেয়ে যাবি। প্রিয়াঙ্কার ব্যাগে ওটা সিকিওরড আছে। রাতে হোটেলে ফিরে ওটাকে একটু ফ্রিজে রেখে দেবো। চিন্তার কোনো কারণ নেই বস্‌!”

প্রিয়াঙ্কা আমায় বলে, ”একটা গান ধরো প্লিজ, আমি রিফার বানাচ্ছি।” গীটারটা বাড়িয়ে দেয়। আমি খানিকক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে গান ধরি, “আজ রাই যমুনায় যাবে না শ্যাম, আজ শ্যাম যমুনায় যাবে না রাই…”
প্রিয়াঙ্কা ব্যাগ থেকে এবার লিপস্টিক বের করে ভদকার বোতলে লিখে দ্যায়, ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ…’

একটু দূরে যীষ্ণু বালিতে ঘড়ি আঁকছে। সমুদ্রের চিকমিকে ঢেউ এসে মুছে দিচ্ছে সেই ঘড়ি। যীষ্ণু ফের আঁকছে। ফের মুছে যাচ্ছে। আঁকছে, মুছে যাচ্ছে, আঁকছে, মুছে যাচ্ছে, আঁকছে…

https://www.youtube.com/watch?v=yj5STDkQSgs

ছবি: Melting Watch, 1954 by Salvador Dali

লেখক পরিচিতি
অতনু সিংহ

শূন্য দশকের কবি ও গদ্যকার। জন্ম ১৯৮২ সালের ২২ আগষ্ট। স্থায়ী বসবাস পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। পড়াশুনা, পেশা ও বন্ধুসঙ্গের কারণে নানা সময় অস্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে এবং ঢাকার মিরপুরে। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ছিলেন প্রায় দুই বছর। এখনও মিরপুর-সহ গোটা ঢাকা শহরটাকে তিনি তাঁর নিজের শহর বলেই মনে করেন। কবিতা ও ভাব-যাপনের দিক থেকে অতনু বৃহৎ বঙ্গের। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণজ্ঞাপন (মাসকমিউনিকেশন) বিষয়ে স্নাতকোত্তর। কিছুদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশুনা করেছেন। এখন অবধি কবিতার বই মোট ৪টি। ‘নেভানো অডিটোরিয়াম’(২০০৯ সাল, ‘লালন’ প্রকাশনা, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ), ‘ঈশ্বর ও ভিডিও গেম’ ( ২০১৪ সাল, ‘হুডিনির তাঁবু’ প্রকাশনা, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ), ‘বন-পাহাড় থেকে সে কেনই-বা ফিরবে এ কারখানায়’ (২০১৭ সাল, ‘কবীরা’ প্রকাশনা, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ) এবং অবধি সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ঘুমের চেয়ে প্রার্থনা শ্রেয়’(২০১৯ সাল, ‘বেহুলা বাংলা’ প্রকাশনা, ঢাকা, বাংলাদেশ)। কবিতা লেখার পাশাপাশি নানা বিষয়ে নিয়মিত গদ্য লেখালেখি করেন। একটি ছোটগল্প সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে প্রায় এক দশক আগে, নাম ‘অপর লিখিত মনোলগ ও কয়েকটি প্যারালাল কাট’ (‘হুডিনির তাঁবু’ প্রকাশনা, ২০১০ সাল) কাব্যচর্চার পাশাপাশি চলচ্চিত্রচর্চা ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। ২০১২ সালে নির্মাণ করেন ‘প্রিয় মরফিন’ নামক পূর্ণদৈর্ঘ্যের একটি স্বাধীন চলচ্চিত্র। এক সময় কবিতা পত্রিকা ‘লালন’-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে অনলাইন ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। আরেকটি পরিচয়, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় একজন সমাজকর্মী। পেশা মূলত সাংবাদিকতা। আগ্রহ বঙ্গের ভাবান্দোলন পরম্পরায়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top