কৃষ্ণ সমাচার

কবিতা সিরিজ

।। হিমালয় জানা ।।

মাটির তপ্ত সরা এই পৃথিবী নাভির কুয়োর মধ্যে
ডুবিয়েছিলাম কিন্তু তুলে আনলাম একটা পাকানো গিঁটখোলা দড়ি একটা রজ্জুভ্রম
শূন্যের তামাম মাঠে উড়ন্ত এই জনপদ অলিগলি খুলে দিচ্ছে নাটবল্টু
ঝনঝন করে ছিটকে পড়ছে সমস্ত গন্তব্য থেকে দূরে

সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে
এখন আমি নিজের বয়স
বদলে নিতে চাই গাছ আর পাথরের সঙ্গে,
চিহ্ন আর সংকেতের সঙ্গে, ঘন্টা আর মিনিটের কাঁটার সঙ্গে—কেমন হবে
সেই জীবনবদল, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
ইতিহাসের ছায়ায় ব’সে কেমন নিশ্চিন্ত মনে থাবা চাটছে বেড়াল—তার আধখানা হাসির মতো
মিলিয়ে গেছে কত স্বপ্ন আলোর ছিবড়েটুকু ফেলে রেখে পাথরে পাথরে রোদ
ডালে ডালে পাখি আর পাতায় পাতায় রক্ত ওরে যাস না ওদিকে যাস না ওখানে জলের শুরু
অন্ধকার মীমাংসা, ওখানে
কথা হচ্ছে
চপিং বোর্ড আর ছুরির সম্পর্ক নিয়ে মাদল আর ধামসা
বেজে উঠছে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুম ভেঙে
উঠে খুব চোখ কচলে দেখে নিচ্ছে কেউ তার ভাঙাচোরা মুখের আয়নায়
এই পুরোনো পৃথিবীর রস্তাঘাট

কে আমাকে লাঠি দিয়ে খোঁচাচ্ছে লাঠি নয়
লাঠি নয় একটা খড়কে কাঠি দাঁতের ফাঁক থেকে খুঁটে বের করছে
খণ্ড খণ্ড দিন নানা রঙের আমি
টান মেরে সব
আজ ফেলে দেওয়ার সময় চোখে পড়ল সেই একটা শুক্রবার হাওয়া ছিল সেদিন খুব
আকাশের এক কোণ থেকে অন্য কোণে ছুটে যাচ্ছিল মেঘ কষ্টের না মুক্তির
না ভয়ের না লজ্জার একটা আলো
এসে পড়ছিল কালো সেই বাক্সের ওপর
সেই কৃষ্ণ সমাচার জলের ভেতরে মাছ হয়ে মাছের সন্তান হয়ে
শ্যাওলা খাচ্ছে এখন তোমার অনাগত ঠোঁট
আমার রোমের সঙ্গে বিরলতা বিনিময় করে রোজ সন্ধেবেলা যখন কর্কশ
ধাতব রঙের একটি জন্মরহস্য এসে উঁকি দেয় চোখ মটকে বলে
তোর জিভের দিব্যি জাহাজের দিব্যি ভালোবাস আমাকে
মাটির তপ্ত সরা এই পৃথিবী নাভির কুয়োর মধ্যে
ডুবিয়েছিলাম কিন্তু তুলে আনলাম একটা পাকানো গিঁটখোলা দড়ি একটা রজ্জুভ্রম
শূন্যের তামাম মাঠে উড়ন্ত এই জনপদ অলিগলি খুলে দিচ্ছে নাটবল্টু
ঝনঝন করে ছিটকে পড়ছে সমস্ত গন্তব্য থেকে দূরে

এই শেষ রক্তের নিশান। এর পর তোমাদের
আর কনো প্রাণের সামনে
বালির কণায় জ্বলে-ওঠা শত শত ব্যর্থ উচ্চারণের সামনে
দাঁড়াতে হবে না দূরে একটি দিনের কঙ্কাল
শুয়ে আছে
আধখানা আকাশে আর আধখানা জলে
নেমে গিয়ে তুলে আনব কি তার দু-একটি হাওয়ার টুকরো
লোহা-ভাঙা স্টোভ-ভাঙা গান-ভাঙা নিভৃতে তাকানো ঝাঁঝিদের
ভেসে থাকা উজ্জ্বল শান্ত এক স্রোত
আকাশের পর আকাশ পার হয়ে এখন
তোমার দু-চোখে এসে টলমল

ফিরে এসো এই জলে, নিভে-আসা দিনের ডাঙায়

দ্যাখো পৃথিবীর শেষ
দিগন্তে সূর্যাস্ত
যখন আমার পাশে একটি খর্জুর গাছ, বামনাকৃতি, এবং খচ্চর আছে বিষণ্ণ দাঁড়িয়ে

ট্রেনের মতো ঝমঝম ক’রে এসে পড়ল রক্ত আজ
দ্বিপ্রহরে, আগুনের বনে

ক্রিং ক্রিং শব্দে ভালোবাসার অজস্র নীলাভ এপিটাফ
উঠে দাঁড়াল ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে

ছাদে, জামাকাপড় উড়িয়ে নিল বাতাস

জানি না, এ-সবের শেষ কোথায়

বড় বড় শহরের তলা দিয়ে, আদিগন্ত জলরাশির ওপর দিয়ে,
মানুষের চিরকালীন আর্তনাদের ওপর দিয়ে
এই সব ডালপালা আর শেকড়বাকড় চলে গেছে কোন অতিকায় হৃদয়ের দিকে

যে এখনও শুরু করেনি তার স্পন্দন

হিমালয় জানা


পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কবি। গদ্যও লেখেন। ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক। জন্ম ১৯৮২। কাব্যগ্রন্থ: ‘ভূতের শহর থেকে’ (২০১০); ‘ভুলে যাওয়ার আগে’ (২০১৪); ‘হারানো জন্তুরা’ (২০১৮)

Share