।। সুমনা রহমান চৌধুরী ।।
ভাসানী নিজেই জানিয়েছেন, পলোবিদ্রোহের গল্প তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি তা নিয়ে জমিদারদের গালিগালাজ করে কবিগানও বেঁধেছিলেন। সেসব গল্পে পরে আসা যাবে। কিন্তু মূলকথা এই যে পলোবিদ্রোহের চেতনা, রণকৌশল, অভিজ্ঞতা যেভাবে অসমের লাইনপ্রথা, বাঙালখেদা বিরোধী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিলো, ঠিক সেভাবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বা আগামীর কৃষক আন্দোলনগুলোকে, গোটা রাষ্ট্রের এনআরসি বিরোধী আন্দোলনগুলোকে অসমের বঙ্গীয় মূলের কৃষকদের আন্দোলন অথবা বঙ্গদেশ-সহ ভারতবর্ষের নানাপ্রান্তের অতীতের কৃষি-মজুর আন্দোলন বা বিদ্রোহগুলো পথ দেখাতে পারে, অনুপ্রাণিত করতে পারে। তাই অতীতকে আবার নতুন করে জানাটা সময়ের দাবীও।
১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দ। অসমের ধুবড়ি জেলার একটি চর ভাসান। চর ভাসান শব্দটি পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে এখানে একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। চর শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ জলে ঘেরা উঁচু ভুখণ্ড। আরো সহজ করে বললে জল দিয়ে ঘেরা ক্ষুদ্র সমতলভূমি। অসম নদীমাতৃক দেশ। ব্রহ্মপুত্র নদ এবং তার বিভিন্ন অববাহিকা মিলে এরকম অসংখ্য চর সৃষ্টি করে চলে গোটা নিম্ন অসম জুড়ে। এই চরগুলির আবার বেশীরভাগটাই অস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল। ভাঙে, গড়ে আবার ভাঙে। উপনিবেশিক অসমে বৃটিশ শাসকগণ এইসব চর অঞ্চলগুলোকে পতিত আখ্যা দিয়ে পূর্ববঙ্গীয় কৃষকদের বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়। এরকমই ব্রহ্মপুত্রের এক ভেসে ওঠা চরে ১৯২৯ সালের কোনো এক দিনে হাজারে হাজারে পূর্ববঙ্গীয় কৃষকেরা জমায়েত হয়েছেন। লাইনপ্রথা, বাঙালখেদা, ওজনের কারুচুপি, জমিদার মহাজন জোতদারদের অত্যাচার, শোষন ইত্যাদির বিরুদ্ধে ডাকা কৃষক সম্মেলনে। ঔপনিবেশিক অসমে সম্ভবত প্রথম কৃষক সন্মেলন ছিল এটাই। সন্মেলনের আহ্বায়ক মওলানা আব্দুল হামিদ খান। পূর্ববাংলার সিরাজগঞ্জের এক আধ্যাত্মিক পীর। ততদিনে অবশ্য পূর্ববাংলা ছেড়ে ব্রহ্মপুত্রের ঘাঘমারি চরে একটাকা চৌদ্দ আনার কুঁড়েঘর তুলে পাকাপাকিভাবে অসমের বাসিন্দা তিনি। কৃষকদের নিয়ে জমিদারের নাকের ডগায় সন্মেলন, তাও জমিদার ভূস্বামীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে! সুতরাং জমিদার শ্রেণী জেলা প্রশাসনকে দিয়ে সন্মেলনে নিষেধাজ্ঞা, ১৪৪ ধারা জার-সহ মওলানা সাহেবকে জেলা থেকে বের করে দেওয়ার আদেশও জারি করালো।
সেসময়ে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ এবং অসম ছিল কলকাতা হাইকোর্টের অধীনে। মওলানা সাহেব তাঁর বন্ধু এডভোকেট এ.কে ফজলুল হককে দিয়ে এই আদেশের চ্যালেঞ্জ করে মামলা করালেন কলকাতা হাইকোর্টে। হাইকোর্টের রায়ে সন্মেলনে নিষেধাজ্ঞা জারী করা সরকারী আদেশ অবৈধ ঘোষনা করা হয়। যথা দিনে হাজার হাজার কৃষকদের যোগদানে সফলভাবে সন্মেলন অনুষ্ঠিত হল ধুবড়ির চর ভাসানে। সন্মেলনের প্রধান বক্তা মওলানা সাহেব। নিপীড়িত শোষিত বঙ্গীয় কৃষকেরা তাঁকে সাদরে গ্রহন করলেন। মূলত এই সন্মেলনের মধ্যে দিয়েই মওলানা সাহেবের নাম এবং কর্মপন্থা সমগ্র আসামে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গীয় কৃষকদের কাছে তাঁর নতুন পরিচয় হয়ে উঠে ‘ভাসান চরের মওলানা’। চর ভাসানের কৃষক নেতা। মজলুমের নেতা। ক্রমে নামের শেষে ভাসানী শব্দ যোগ হয়ে উপমহাদেশ জুড়েও তিনি পরিচিত হলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী হিসেবে। আধ্যাত্মিক পীর থেকে হয়ে উঠলেন একজন দুর্বিনীত কৃষক নেতা। আবার তারও বহু পরে আমরা তাঁকে দেখবো বাংলাদেশ নামক বাংলা রাষ্ট্রটি গড়ে তোলার এক অন্যতম কুশীলব ‘রেড মওলানা’ হিসেবে। আদতে কে ছিলেন মওলানা ভাসানী? একজন আধ্যাত্মিক পীর না কি কৃষক নেতা নাকি ইসলামপন্থী নাকি সমাজতন্ত্রী? নাকি একজন পীর-মুর্শিদ কৃষক নেতা যিনি ‘ইসলাম’ প্রশ্নটিকে সম্প্রদায়গত পরিচয়ের জায়গার থেকে বড় করে মানুষের মুক্তির প্রশ্ন থেকে আমলে আনতে পেরেছেন এবং সেই কারণেই কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছে!
কোন তকমায় তাঁকে সঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষন করা যায় সেসব নিয়ে চুলচেরা বিচার ঐতিহাসিকগণ, গবেষকগণ, সমাজবিজ্ঞানীগণ করবেন নিশ্চয়ই। আমরা বরং সেই আলোচনায় না গিয়ে এই লাওচনায় তাঁকে পর্যালোচনা করব অসমের বঙ্গীয় মূলের ভূমিহীন কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে লাইনপ্রথা নামক কালো আইন প্রত্যাহার, অথবা বাঙালখেদা নামক অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠার যে দুর্বার কৃষক আন্দোলন ৪৭ পূর্ববর্তী অসমে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সে সম্পর্ক বিশ্লেষনের ভিতর দিয়ে। ২০১৮ থেকে ২০২০ – যে সময়ে কৃষক আন্দোলন ‘নতুন ভারত’ জুড়ে ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে, আগামীর ইতিহাস রচনা করছে, ঠিক সে সময়টাতে দাঁড়িয়ে এটা জরুরীও। কেননা উপনিবেশিক অসমের লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলন অথবা বাঙাল খেদা বিরোধী আন্দোলনের মডেল, রণকৌশল বা চেতনা পূর্ববর্তী সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহ বা পলো বিদ্রোহ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
মওলানা ভাসানী নিজে ছিলেন সিরাজগঞ্জের এক কৃষক পরিবারের সন্তান। আবার আধ্যাত্মিক পীর হিসেবে তাঁর মুরিদদের বেশীরভাগই হতদরিদ্র কৃষক, যাঁরা হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের। সুতরাং খুব কাছ থেকে তিনি কৃষক সমাজ, তাদের দুর্দশা, নিপীড়ন অনুভব করতে পেরেছিলেন। সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহ বা পলোবিদ্রোহের গল্প শুনে শুনে তাঁর বড় হয়ে উঠা। ভাসানী নিজেই জানিয়েছেন, পলোবিদ্রোহের গল্প তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি তা নিয়ে জমিদারদের গালিগালাজ করে কবিগানও বেঁধেছিলেন। সেসব গল্পে পরে আসা যাবে। কিন্তু মূলকথা এই যে পলোবিদ্রোহের চেতনা, রণকৌশল, অভিজ্ঞতা যেভাবে অসমের লাইনপ্রথা, বাঙালখেদা বিরোধী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিলো, ঠিক সেভাবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বা আগামীর কৃষক আন্দোলনগুলোকে, গোটা রাষ্ট্রের এনআরসি বিরোধী আন্দোলনগুলোকে অসমের বঙ্গীয় মূলের কৃষকদের আন্দোলন অথবা বঙ্গদেশ-সহ ভারতবর্ষের নানাপ্রান্তের অতীতের কৃষি-মজুর আন্দোলন বা বিদ্রোহগুলো পথ দেখাতে পারে, অনুপ্রাণিত করতে পারে। তাই অতীতকে আবার নতুন করে জানাটা সময়ের দাবীও।
ভাসানী এবং ঔ পনিবেশিক অসমের লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলন বা বাঙাল খেদা বিরোধী আন্দোলন বুঝতে গেলে সর্বপ্রথম আমাদের ফিরে যেতে হবে অসমে পূর্ববঙ্গীয় মূলের কৃষকদের প্রব্রজনের ইতিহাসে। কেননা সেই ইতিহাসেই আমরা খুঁজে পাবো উপনিবেশিক অসমের বাঙালখেদা, লাইনপ্রথা থেকে শুরু করে হালের এনআরসি এবং ডিটেনশন ক্যাম্প-সহ যাবতীয় ভাষিক এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্তর। মানবসভ্যতার ইতিহাস প্রব্রজনের ইতিহাস। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন কোনে বসতি স্থাপন করেছে। অসমও এর ব্যতিক্রম নয়। আহোম রাজা চুকাফাও ছিলেন শান জাতির মানুষ। ১২২৮ সালে চুকাফা পাটকাই পর্বত অতিক্রম করে অসমে প্রবেশ করেন এবং স্থানীয় বিভিন্ন আদিবাসী শাসনকর্তাদের পরাজিত করে আহোম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অসমের রাজ্যসীমাও আহোমদের হাত ধরে কামরূপ অবধি বিস্তৃত হয়। ১২৫৩ সনে শিবসাগর জেলার চরাইদেউয়ে চুকাফা স্থায়ী ভাবে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাচীনকাল থেকেই অসমের রাজনৈতিক সীমানা বারবার বদল হয়েছে, ফলত জনসংখ্যা এবং জনবিন্যাস ও বারবার পাল্টেছে। ষোড়শ শতকে আজকের উত্তরবঙ্গ, বাংলাদেশ ও নিম্ন অসমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল কোচ সাম্রাজ্য। ১৫৮১ সালে কোচ সাম্রাজ্য বিভক্ত হয় দুইভাগে। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং রংপুর নিয়ে একভাগ এবং অন্যভাগে কামরূপ বা কোচ-হাজো। ১৬০৯ থেকে ১৬১৩ সালের মধ্যে মোঘলদের অধীনে চলে যায় কোচ সাম্রাজ্য। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে এক ফরম্যানের মাধ্যমে মোঘলদের অধীন থেকে ইংরেজদের অধীনে আসে করিমগঞ্জ, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বঙ্গাইগাঁও, কোকরাঝাড় এবং চিরাং জেলার কিছু অংশ এবং করিমগঞ্জ জেলাকে বাদ দিয়ে বাদবাকি সব অঞ্চল ইংরেজরা অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার সাথে একত্রিত করে। ১৮২৬ সালে আহোম রাজা এবং ইংরেজদের মধ্যে ইয়ান্ডাবু চুক্তি হয় এবং করিমগঞ্জ বাদ দিয়ে উপরিক্ত সব অঞ্চল নয়া গোয়ালপাড়া জেলা হিসেবে ঔপনিবেশিক অসমে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬৭ সালে নয়া গোয়ালপাড়া জেলাকে কোচবিহারের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৫৬২ সাল অব্দি কাছাড় এবং হাইলাকান্দি জেলা ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর পরে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত এই দুই জেলাই কোচ রাজ্যের অংশ এবং তারপর ১৮৩২ সাল পর্যন্ত কাছাড়ি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৭৪ সালে সিলেট, কাছাড়, গোয়ালপাড়া— তিনটি বাংলাভাষী জেলাকে ঢাকা ডিভিশন থেকে কেটে এনে অসমের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। আবার ১৯০৫ সালে বৃটিশ সরকার বাংলাকে দুভাগ করে পূর্ববাংলাকে জুড়ে দেয় আসামের সঙ্গে। একই রাজ্য হয়ে যাওয়ার দরুন প্রব্রজনের ঢল আরো বাড়ে অসমে। আবার ১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর অসমকে পুনরায় আলাদা চিফ কমিশনার ইউনিট করা হয় এবং সিলেট ও কাছাড় জেলাকে অসমের সাথে সংযুক্ত করা হয়।
অসমের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো সমৃদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রব্রজন আর বসতি স্থাপনের মাধ্যমেই৷ উপনিবেশিক সময় থেকে আজ অবধি অসমে প্রব্রজন ঘটেছে মূলত চারটি পর্যায়ে। বৃটিশদের হাত ধরে অসমে প্রথম প্রব্রজন ঘটে চা-শ্রমিকদের। অসমে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রব্রজকগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গীয় মূলের ভূমিহীন মুসলমান কৃষকেরা। অসমে তৃতীয় ব্যপক প্রব্রজন ঘটে ‘৪৭-এ দেশভাগের সময়। কয়েক লক্ষ মুসলমান কৃষক-মজুর, যারা দেশভাগের উত্তাল সময়ে ওপারে চলে গিয়েছিলেন, নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি অনুসারে তাদের এপারে ফিরিয়ে আনা হয়। অসমে চতুর্থ তথা সর্বশেষ প্রব্রজন ঘটে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়। পাকিস্তানি সেনা এবং স্থানীয় রাজাকারদের অত্যাচারে পূর্ববঙ্গীয় বহু হিন্দু পরিবার অসমে পালিয়ে আসেন।
এবারে বাকি প্রব্রজকগোষ্ঠিগুলোর নিয়ে আলোচনা এখানে মুলতুবি রেখে ফিরে যাওয়া যাক পূর্ববঙ্গীয় মূলের ভূমিহীন মুসলমান কৃষকদের অসমে আগমনের ইতিহাসে। উনিশ শতকের শেষদিকে বৃটিশরা রাজস্ব বৃদ্ধির স্বার্থে অসমের অনাবাদী জমিগুলোকে চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এদিকে বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ সমস্যা, বর্মীদের আক্রমণ, কলেরা- বসন্ত – কালাজ্বরের প্রকোপে তৎকালীন অসমের জনসংখ্যা ভীষণভাবে হ্রাস পায়৷ জঙ্গল, জলাভূমি সাফ করে বসত তথা চাষাবাদ করার মতো কঠোর পরিশ্রমী জনবলের অভাব তো ছিলই, তারসাথে ওইসব অনাবাদী জমি আবাদ করার মতো দক্ষ চাষীরও অভাব ছিলো। অপরদিকে পূর্ববঙ্গের চাষীরা ছিল পরিশ্রমী এবং তাদের জলাভূমিতে চাষবাসের বিশেষ দক্ষতা ছিল, যা স্থানীয় জনজাতির ছিল না। সুতরাং ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যে বৃটিশ সরকার এই চাষীদের প্রব্রজনে আর অভিবাসনে উৎসাহিত করতে থাকেন। ১৮৭২ সালে অসমে নিয়োজিত বৃটিশ সরকারের এজেন্ট কর্নেল হপকিসন বাংলার বৃটিশ সরকারের সেক্রেটারিকে চিঠিযোগে জানিয়েছিলেন জনবহুল পূর্ববাংলা থেকে অসমে জনবল পাঠাতে। অসমের অনাবাদি জমিগুলোতে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এই চিঠি থেকেই সহজে অনুমেয় বৃটিশ সরকার একান্তভাবেই চাইছিলেন এই চাষীদের অসমে আগমন ঘটুক। অপরদিকে পূর্ববঙ্গের নিঃস্ব, সর্বহারা শ্রেণীর কৃষকদের বৃটিশ সরকারের এই প্রস্তাবে সন্মত হয়ে না আসা ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না। কেন তার কারনগুলোকে মোটামুটি পাঁচটে ভাগে ভাগ করা যায় –
১) জমিদার এবং ভূস্বামীদের অধীনে দীর্ঘযুগ থেকে ভোগ করে আসা অবর্ণনীয় কষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে।
২) ভাগচাষ প্রথার মাধ্যমে যে ব্যাপক শোষন তাদের করা হচ্ছিলো তা থেকে পরিত্রান পেতে।
৩) পূর্ববঙ্গের চেয়ে অসমে জমির খাজনা তুলনামূলকভাবে অনেক কম থাকায়।
৪) অসমের তৎকালীন জনসংখ্যা কম থাকার দরুন চাষবাসে বিশেষ কোনো প্রতিযোগীতা থাকবে না ভেবে। এবং
৫) নদী তীরবর্তী উর্বর জমি এবং মাছের আকর্ষনে।
পূর্ববঙ্গীয় কৃষকেরা অসমে এসে হিংস্র জীবজন্তু, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, কলেরা ইত্যাদি অতিমারির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এখানকার দুর্গম অঞ্চলগুলিকে মানুষের আবাসযোগ্য করে তোলে। অনাবাদী অনুর্বর জমিগুলোও তাদের ছোঁয়ায় শস্যশ্যামল হয়ে উঠে। কৃষিও যে ব্যবসা-কর্মে পরিণত হতে পারে অসমে সর্বপ্রথম এই কৃষকেরাই সে ধারনার জন্ম দিয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রকার শস্যের চাষও অসমে এরাই প্রবর্তন করেন। মূলত এদেরই অদম্য পরিশ্রমের ফলে অসমে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় কয়েকগুন। চাষবাসে পূর্ববঙ্গীয় কৃষকদের এহেন দক্ষতা দেখে অসমীয়া মধ্যবিত্ত এবং অভিজাত সমাজও তাদের পতিত জমি আবাদ করে তোলার লক্ষ্যে একান্তভাবে চাইছিলেন এদের আরো বেশী আনয়ন করা হোক। অপরদিকে পূর্ববঙ্গের ভূমিহীন কৃষকেরা জমির কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজই তেমন জানতেন না। সুতরাং তারা যখন দেখলেন অসমে গেলেই জমি মেলে, তখন অসমে তাদের আগমনের হিড়িক পড়ে যায়। এবং সরকার ও স্থানীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তাতে উৎসাহও ছিল বিস্তর। পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর প্রভৃতি জেলা নিম্ন অসমের সংলগ্ন হওয়ার দরুন নদীপথে সহজেই তাদের অসমে প্রবেশ ঘটে।
১৯১১ সালের লোকগণনায় অসমে প্রব্রজনকারী জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫৪ হাজার। এবং তাদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিলেন পূর্ববঙ্গীয় মূলের মুসলমান কৃষক-মজুর। ১৯২১ সাল পর্যন্ত যেহেতু অসমে প্রব্রজনের বিরুদ্ধে কোনও বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না, প্রব্রজনকারীরা ধীরে ধীরে সমতলেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। এবং অভিবাসী এই কৃষকদের জনসংখ্যা ১৯২১-এ দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লক্ষে। প্রথম অবস্থায় এই প্রব্রজকগোষ্ঠীকে নিয়ে অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের তেমন কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু ধীরে ধীরে ভূমি দখল কেন্দ্র করে অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হয়। স্থানীয়দের উৎকন্ঠা এবং ক্ষোভ দূরীকরণের লক্ষ্যে তৎকালীন বৃটিশ সরকার ১৯২০ সালে অসমে ‘লাইনপ্রথা’ (Line system) নামে একটি বিধি প্রবর্তন করে। এই বিধি অনুযায়ী একটা নিদির্ষ্ট সময়ের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত গরীব ভূমিহীন বাঙালি কৃষক মজুরদের জমিবাড়ি উচ্ছেদের যে অভিযান, তা ই ‘বাঙাল খেদা’ নামে পরিচিত। যেসব স্থানে প্রব্রজনের চাপ বেশী সেখানে লাইন কেটে পূর্ববঙ্গীয় প্রব্রজনকারী এবং স্থানীয় অসমিয়া জনজাতির মধ্যে এলাকা নিদির্ষ্ট করে দেওয়া হয়। আবার ‘মিক্সড এরিয়া’ বলে কিছু অঞ্চল পূর্ববঙ্গীয় প্রব্রজক এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের নির্ধারন করে দেওয়া হয়, যেখানে দুই জনগোষ্ঠীই বসতি স্থাপন করতে পারেন। এই লাইনপ্রথা অসমের মধ্যে প্রথম প্রয়োগ করা হয় নগাঁও জেলায়। পরে অন্যান্য জেলাকেও এই প্রথার আওতায় আনা হয়। অর্থাৎ অনুন্নত অসমকে শস্যশ্যামলা করে তুলতে, সরকারের রাজস্ব ভান্ডার এবং জমিদার শ্রেণীর তহবিল ও শস্যভাঁড়ার পরিপূর্ণ করতে যে ভূমিহীন উদ্যমী ও দক্ষ কৃষকদের একদিন সাদরে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেই তাদেরকেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করে, অসমীয়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভাষিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী ভেবে নির্বিচারে উচ্ছেদ করা শুরু হয়।
মওলানা ভাসানীর অসমে প্রথম আগমন কৃষক নেতা হিসেবে নয়। তিনি এসেছিলেন জলেশ্বরের পীর নাসিরউদ্দিন বোগদাদির মুরিদ হয়ে। সেটা সম্ভবত ১৯০৪ সালের কথা। তারপর আবার তিনি দেশে ফিরেও যান। দুর্দমনীয় কৃষক নেতা হিসেবে তাঁর উত্থান আরো বহু পরে। পূর্ববাংলার জমিদার মহাজনেরা ততদিনে ভাসানীকে ভয় পেতে শুরু করেছেন। জমিদারি প্রথা বিরোধী আন্দোলন, কৃষকদের জোট বাঁধানো, অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম – এইসবকিছুতে জমিদার- মহাজনশ্রেণী দেখলো এই লোকটা এখানে থাকলে তাদের সমূহ বিপদ। সুতরাং বৃটিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ভাসানীকে পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়ন করা হলো। সেসময়েই তিনি আবার আসামে ফিরে আসেন। ব্রহ্মপুত্রের ঘাঘমারি চরে একটাকা চৌদ্দ আনার কুঁড়েঘর তুলে পাকাপাকিভাবে অসমের বাসিন্দা তখন তিনি। আগেই বলেছি মওলানা ভাসানী নিজে ছিলেন সিরাজগঞ্জের এক কৃষক পরিবারের সন্তান। আবার আধ্যাত্মিক পীর হিসেবে তাঁর মুরিদদের বেশীরভাগই ছিলেন হতদরিদ্র কৃষক। সুতরাং খুব কাছ থেকে তিনি কৃষক সমাজ, তাদের দুর্দশা, নিপীড়ন অনুভব করতে পেরেছিলেন। কৃষকদের দুঃখ দুর্দশার সাথে নিজেকে জড়াতে পেরেছিলেন। সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহ বা পলোবিদ্রোহের গল্প শুনে শুনে তাঁর বড় হয়ে উঠা। ভাসানী যখন পীরের মুরিদ হয়ে অসমে এলেন বা তারপর আবার যখন পাকাপাকিভাবে এসে এখানে বসতি স্থাপন করলেন, তিনি দেখলেন তাঁর মুরিদেরা, পূর্ববাংলা থেকে আগত কৃষকেরা লাইনপ্রথা আর বাঙাল খেদার নির্যাতনের জ্বালায় জর্জরিত। গ্রাম কে গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মানুষ বাড়ি ঘরদোর লহমায় ছাই হয়ে যাচ্ছে। শস্য পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে গ্রামের পর গ্রামে। এহেন পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী সক্রিয়ভাবে লাইনপ্রথা এবং বাঙাল খেদা বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। সে সময়েই, ১৯২৯ সালে ধুবড়ির ভাসান চরে ‘আসাম-বাংলা প্রজা সম্মেলন’ আহ্বান করেন তিনি। এই সন্মেলনে লাইনপ্রথা রদ, বাঙালখেদা অভিযান বন্ধ সহ ওজন কারচুপি বন্ধ, জমিদারদের অত্যাচার বন্ধের দাবি জানান। আন্দোলনকে গতিশীল করতে তিনি অভিবাসী কৃষকদের সংগঠিত করে ‘আসাম চাষী মজুর সমিতি’ গঠন করেন। এই সমিতি পরবর্তীতে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সমগ্র আসাম জুড়ে লাইন প্রথা, বাঙাল খেদা বিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
১৯৩৭ সালে প্রথমবারের মতো আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েই তিনি পার্লামেন্টে ‘লাইন প্রথা বিরোধী’ বিল উত্থাপন করেন। ১৯৩৯ সালের ১৯ নভেম্বর আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তিনি কংগ্রেস সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের বৈঠকে পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হয়। ওই প্রস্তাবে অসমকেও পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির বিষয় ঠিক হয়। অসম মুসলিম লীগ এবং তারসাথে মৌলানা ভাসানী লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনকে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে ফেলায় সম্পূর্ণ লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনটি হঠাৎ করেই ‘সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতির রঙে চাপা পড়ে যেতে থাকে। মুসলিম লীগ নেতারা এই আন্দোলনকে হাতিয়ার করে অসম দখলের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। অপরদিকে অসমের কংগ্রেস নেতারা লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদাকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে থাকেন। অসমের জনমানসে তারা প্রচার করতে থাকেন বহিরাগত মুসলমান কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে তাদের দ্বারা অসম দখল করার উদ্দেশ্যেই লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো অভিবাসী চাষী মজুরদের নিপীড়ন অত্যাচার থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সেটারই অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলে চরম প্রতিক্রিয়াশীল রঙ চড়ানো হতে থাকলো। অসমে মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য কখনোই পুরোপুরি ভাবে লাইনপ্রথা বা বাঙাল খেদা বন্ধের পক্ষে ছিলো না। আর এখানেই মওলানা ভাসানী মুসলিম লিগের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকেও এইক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। হিন্দু-মুসলমান, অসমীয়া-বাঙালি এসবের উর্ধ্বে উঠে তিনি সমস্ত নিপীড়িত কৃষক-প্রজার মুক্তি চেয়েছেন। এবং একান্তভাবেই তা চেয়েছেন। ১৯৪২ সালের ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি অসমের ঘাগমারিতে তিনি দ্বিতীয়বার ‘বাংলা-আসাম প্রজা সম্মেলনে’ আহ্বান করেন। এবং এই সন্মেলনেই তিনি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন ৩১ মার্চের মধ্যে ‘লাইন প্রথা’ বিলুপ্ত করা না হলে এপ্রিল থেকে তিনি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জাপানী বোমায় লন্ডন ক্ষতবিক্ষত। গান্ধিজীরা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সুভাষ বসু তাঁর ফৌজ নিয়ে ভারতে এলেন বলে। তারমাঝে লীগ নেতা মৌলানা ভাসানীর এই হুঁশিয়ারিতে প্রমাদ গুনলো বৃটিশ সরকার। পরবর্তী এক বছর মওলানা ভাসানীর সমস্ত সভা-সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। এর মাঝেও ভাসানী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকলেন। চাপে পড়ে ১৯৪৩ সালের ২৪ আগস্ট এক সরকারি নির্দেশে ‘লাইন প্রথা’কে খানিকটা শিথিল করা হলো। ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে মওলানা ভাসানী বাজেট অধিবেশনের বক্তব্যে অসমের অতিরিক্ত আবাদি-অনাবাদি জমি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী, হিন্দু ভূমিহীন কৃষক ও অভিবাসী বঙ্গীয় মূলের কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের দাবি জানান।
১৯৪৫ সাল, ‘অহোম জাতীয় মহাসভা’র উসকানিতে ‘বাঙাল খেদা অভিযান’ চুড়ান্ত রূপ ধারন করে। ওই বছরেরই ১৩ জুলাই ত্রিদলীয় চুক্তির শর্তমতে ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৩৭ সালের পর থেকে অসমে প্রবেশকারি প্রত্যেকজন বাঙালি মাত্রেই অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তারই ফলস্বরূপ অহোম জাতীয় মহাসভার ডাকে চলে হত্যা ও উচ্ছেদ যজ্ঞ। ধর্ষন, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালানো, ফসল জ্বালানো সবই নারকীয়ভাবে চলতে থাকলো। নৃশংশ এই হত্যা আর উচ্ছেদ যজ্ঞের প্রতিবাদে মঙ্গলদৈ থেকে বরপেটা- সর্বত্র বাঙাল খেদা বিরোধী আন্দোলনের ডাক দেন ভাসানী। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ভাসানী কৃষকদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ জারি করলেন যে জমি থেকে অভিবাসী কৃষকদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তা পুর্নদখলের লড়াই জারি রাখতে। এরই মাঝে অসমে নির্বাচন সম্পন্ন হল। মুসলিম লিগ সমস্ত মুসলিম সিটে জয়ী হয়েও মন্ত্রীসভা গঠন করতে পারলো না। কংগ্রেসের কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হলো এবং গোপীনাথ বরদলৈ হলেন প্রধানমন্ত্রী। বাঙাল খেদা অভিযান তখনো দ্বিগুণ জোরে চলছে। মে মাসে বাঙাল খেদা বন্ধের দাবীতে ভাসানী অনশন শুরু করলেন। মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতার তাঁকে অনশন ভঙ্গের অনুরোধ করলে তিনি উত্তর দেন, ‘যতক্ষণ উচ্ছেদ হওয়া মানুষেরা অনাহারে আছে, আমি কী করে খাবার খেতে পারি!’ ভাসানীর অনশনে বাঙাল খেদা বিরোধী আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে উঠে। ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে সরকার উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হল। ৬১ দিন পর অনশন ভাঙলেন মওলানা ভাসানী। উচ্ছেদ হওয়া জমিতে পুর্নদখলের লড়াই অব্যাহত রাখতে শারীরিক অসুবিধা সহ সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তিনি ছুটে বেড়ালেন ধুবড়ি মঙ্গলদৈ ঘাগমারা সহ সমস্ত নিম্ন আসাম। স্থানে স্থানে তীব্রভাষায় বক্তৃতা দিয়ে কৃষকদের লড়াইয়ে উৎসাহ যোগাতে থাকলেন। অসম সরকার এইসব বক্তৃতাকে প্রভোকেটিভ, হিংসায় মদতকারী ইত্যাদি তকমায় ভূষিত করে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারির আদেশ জারি করে। সরকারে গ্রেফতারির চেষ্টা যখন চরম রূপ ধারন করে তখন পাহাড়ে আত্মগোপন করেন ভাসানী। সারা আসাম জুড়ে তখন চলছে অসহায় নিরন্ন মানুষের টিকে থাকার লড়াই।
‘৪৬ এর দাঙ্গা। কলকাতার অবস্থা ভয়াবহ। ভাসানি অসমে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি রেখে লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান অর্জন, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য, জমিদারি প্রথা বাতিল সহ মহাজনী জোতদারী শোষন উচ্ছেদের দাবীতে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে চলার আহ্বান জানালেন। দাবী আদায়ের লক্ষ্যে তিনি খাজনা বন্ধ, কৃষিপণ্য কেনা বেঁচা বন্ধ সহ অফিস আদালত রেল বাস সমস্ত কিছু বয়কটের ডাক দিলেন। জোরদার প্রতিরোধের জন্যে ভলান্টিয়ার বাহিনী নিয়োগ করলেন স্থানে স্থানে।
১৯৪৭ সাল। আন্দোলনকে আরো জোরদার করে তুলতে মওলানা ভাসানী চলমান আন্দোলনের প্রথাগত উদ্বোধনের দিন ঘোষনা করলেন ১০ ই মার্চ তেজপুর টাউন হল্-এ। ভাসানীর এহেন ঘোষনায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসলেন। ১৪৪ ধারা জারি, গ্রেফতারি পরোয়ানা সহ পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী, আই.বি মোতায়েন করা হলো। ভাসানীকে তেজপুর টাউন হল্ এ আসার আগেই গ্রেফতার করার উদ্দেশ্যে। অথচ অদ্ভুতভাবে আই.বি’র চোখ এড়িয়ে নৌকার মাঝি সেজে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে গাড়োয়ান সেজে গরুর গাড়িতে করে সঠিক সময়ে তিনি টাউন হলে পৌছালেন। সরকার কতৃক জারি করা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে আগে থেকেই চলমান আন্দোলনের নতুন উদ্বোধন করলেন। যদিও দিনটি মুসলিম লিগের অন্যান্য নেতাদের তরফ থেকে মুসলিম স্বার্থকে উপস্থাপন এবং পাকিস্তান কায়েমের দাবীর উপর বেশী জোর দেওয়ার উদ্দেশ্যে স্পনসর করা হয়েছিলো, কিন্তু মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিলো সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক বিষমুক্ত। তিনি তাঁর বক্তব্যে সব সম্প্রদায়ের নিপীড়িত, নিগৃহিত, অত্যাচারিত মানুষের অধিকার রক্ষার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘‘এই আন্দোলন হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নিপীড়িত দরিদ্র কৃষকদের উদ্যোগে গড়ে উঠা একটি অহিংস এবং অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন। তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেছিলেন আমাদের আন্দোলন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়’’।
জনসভা শেষে সেদিনই ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয়। অসমে যদিও এই তাঁর প্রথম জেল যাওয়া নয়। এর আগেও বহুবার তাঁকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। তবে এই সময়ের তাঁর গ্রেফতার হওয়া লাইন প্রথা বিরোধী তথা সামগ্রিকভাবে অভিবাসী কৃষকদের যাবতীয় নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে ছিলো আত্মঘাতী। সারা ভারতের রাজনৈতিক দাবার চাল তখন আরেক রকমের। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে উপমহাদেশের ভাগ্য নির্ধারনের খেলা চলছিলো। ঠিক এইসময়েই মওলানা ভাসানীর গ্রেফতারির দরুন সঠিক নেতৃত্বের অভাবে লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। এবং তাঁর অনুপস্থিতে গোটা আন্দোলন সরাসরি দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই ভারতকে দুইভাগে ভাগ করে ‘স্বাধীনতা’ ঘোষনা করা হয়। ভাসানী তখনও জেলে। অসম থেকে করিমগঞ্জ জেলার একটা অংশ-সহ বাকি সিলেটকে গণভোটের মাধ্যমে কেটে নিয়ে নবনির্মিত পূর্বপাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। বাকি অসম থেকে গেলো ভারতেই। মুসলিম লীগ নেতারাও এই ঘোষনা মেনে নেন। শুধু জেলে থেকেও মওলানা ভাসানী তা মেনে নিতে পারলেন না। তিনি তো আজীবন চেয়েছিলেন গোটা বাঙালির একত্রিত একটি ভূমি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অসমে যদিও লাইন প্রথা’র অবলুপ্তি ঘটে, কিন্তু স্থানীয় অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মন থেকে প্রব্রজন বিরোধী আবেগ অথবা পূর্ববঙ্গীয় মূলের এই জনগোষ্ঠীর উপর ক্ষোভ, বিদ্বেষ প্রশমিত হয় নি। তার প্রমাণ অতীতের নেলী, চাউলখোয়া সহ বিভিন্ন সময়ে ঘটা গণহত্যাগুলো। তার প্রমাণ অসম আন্দোলন। হালের এনআরসি। ডিটেনশন ক্যাম্প। তার প্রমাণ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পূর্ববঙ্গীয় মূলের মিঞা জনগোষ্ঠীর মানুষের উপর এখনো তীব্রভাবে ঘটে চলা দমন পীড়ন।
মুসলিম লীগের অন্যান্য রাজনীতিবিদদের থেকে মওলানা ভাসানীর চিন্তা চেতনা ছিলো অনেকটাই আলাদাো। ১৯৪৪ সালে, যখন তিনি দলীয় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই সভায় লীগের সাধারণ সম্পাদক স্যার সাদুল্লাহকে আবেদন করেছিলেন, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের জন্য ‘পোস্টবক্স’ হিসাবে কাজ না করতে। আধ্যাত্মিক পীর এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে ভাসানী তাঁর অবস্থানকে চিরকাল কৃষকদের প্রতি নিপীড়ন রোখার উদ্দেশ্যে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর ‘রবুবিয়াত’ এর নীতিমালার উপর রচিত প্রবন্ধটি পড়লে বুঝা যায় যে, ১৯৪৬ সাল থেকে রবুবিয়াত তাঁর পথনির্দেশক আদর্শ হিসেবে কাজ করে গেছে। রবুবিয়াত মতে, মানুষের বর্ণ, জাতিগত পরিচয়, ধর্ম যাই হোক না কেন, মানুষ হিসেবে সকলেই সমান। সকলেরই সমান অধিকার। বিশ্বাসের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা বিলোপের পক্ষের অবস্থানই রাবুবিয়াতকে ধর্মের অন্যান্য আঙ্গিক বা নীতিগুলো থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। মওলানা ভাসানী বলেছেন, ‘‘মানুষ কেবলমাত্র একজন হেফাজতকারী, যেখানে বিদ্যমান সমস্ত সম্পত্তির উপরে আল্লাহ মালিকানা রাখেন। সুতরাং, রাষ্ট্রের উচিত সমস্ত বেসরকারী মালিকানা বাতিল করা, এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমান অনুপাতে সবার মাঝে বিতরণ করা’’।
গ্রন্থঋণ : ১) আসাম ও মওলানা ভাসানী এবং লাইনপ্রথা – বাঙাল খেদা। লেখক- সাইফুল ইসলাম
২) The Indian Economic and Social History Review (IESHR) April-June 2010 issue, Vol.XLVII no.2, p.231: Peter Custers, ‘Maulana Bhashani and the Transition to Secular Politics in East Bengal’.
৩) The Line System in Assam : A Study of The Role of Maulana Bhasani,- Bimal J Dev & Dilip K Lahiri,
৪) চর-কথা, সংকলন ও সম্পাদনা – প্রসূন বর্মন।
সুমনা রহমান চৌধুরী
সুমনা অসমের বাসিন্দা। লেখক, সমাজকর্মী। পেশায় শিক্ষক।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হুজুরের আসাম জীবনের বৈচিত্র্যময় কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পেরে ভালো লাগছে। তথ্য সমৃদ্ধ এ প্রবন্ধটির জন্যে সুমনা রহমান চৌধুরীকে অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।