এক. চিহ্নের টানে
আমি আগে না জানিয়া সখিরে কইরে পিরীতি আমার দুঃখে দুঃখে জীবন গেলো, সুখ হইলো না এক রতি…।
দিল ঠাণ্ডা করার জন্য অনেকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার শরীফে যান। সেই মাইজভান্ডার শরীফের বার্ষিক ওরছে চট্টগ্রামের দাউদুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয় নেত্রকোনার ছৈয়দ মিজানুর রহমানের । দুজনের মধ্যে কথাবার্তা বেশি দূর এগোয় নাই। সেই সামান্য আলাপেই মিজান জানান তার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। গীতিকবি উকিল মুন্সীর বাড়ির কাছাকাছি। মিজান উকিলের বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছিলেন ২০১১ সালের বর্ষায়। বাড়ির উঠোনে উকিল মুন্সীর কবর। পাশেই বেতাই নদী। নদীর কূল ভেঙ্গে কবর তলিয়ে যাবার অবস্থায় পৌছেছে। খবরটা দাউদের মনে দাগ কাটে। ঠিক করে উকিলের কবর দেখতে যাবে। মিজানের নাম্বার টুকে রাখে।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। কুষ্টিয়ায় লালন আখড়ার দোল পূর্ণিমার অনুষ্ঠান শেষে দাউদ ঢাকা আসে। উকিল মুন্সীর বাড়ি যাওয়া নিয়ে আগেই উঠে ছিলো। এবার সেটা পাকা হলো। হাতে সময় থাকলে সুসং-দুর্গাপুর, গারো পাহাড় ঘুরে আসব। সাথে নেত্রকোনার আদি গয়ানাথের আসল বালিশ মিষ্টি তো আছে। উকিলের বাড়িতে যাবার পরিকল্পনার মূলকথা হলো তার কবর সংরক্ষণের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেটা দেখা। কিন্তু এই বিষয়ে আমার মনে খুঁতখুঁত করছিল। দুইদিন পর তেইশ ফেব্রুয়ারী নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী কাজী এন্টারপ্রাইজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করি, উকিল মুন্সীর ভাব-চিন্তা জানা ও বুঝার জন্য তার গানই তো যথেষ্ট। সেখানে কবর সংরক্ষণের দরকার কি? তার উত্তর, সাধক পুরুষদের রুহানী ক্ষমতা হয়তো কিছু মানুষ তাদের বাণী দিয়ে আর কিছু দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। যদিও দুই ধরণের জানা সমার্থক নয়। তা সত্ত্বেও, তাকে ভালোভাবে বুঝতে গেলে চোখে দেখা চিহ্ন দরকার। তাহলে ভাব মানে ইন্দ্রিয়াতীত নয়! চিহ্ন দিয়ে অতীতের বহমান ধারার সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়। চিহ্ন না থাকলে আমরা কাকে জানতে চাই অথবা কি হারিয়েছি সেই প্রশ্ন তোলারও সুযোগ থাকে না। আরেকটা বিষয়- দাউদের ধারণা উকিল মুন্সী কোন সুফী সিলসিলার অনুসারী না হয়ে পারেন না। গুরুবাদী ধারায় না গিয়ে এই ধরণের গান লেখা যায় না। আমি তার সাথে পুরোপুরি একমত হলাম না।
কিন্তু চিহ্ন কি দেয় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে থাকল। যদি বলি উকিল মুন্সীকে জানতে চাই- তার এক মানে হলো গানের বাণীর মর্ম উদ্ধার। কেন না, এই গান না হলেও তার অন্য কোন তাৎপর্য থাকত কিনা, সেই প্রশ্ন তুলে তো লাভ নাই। অচিন উকিল মুন্সীর দিকে যাত্রার শুরু তো গানকে সামনে রেখে। সে অর্থে নিছক কবরের দেখার মধ্যে তাকে বুঝার সম্পর্ক নাই। এর বাইরে কি আছে সেটাও আমরা নিশ্চিত না। তাহলে কি শুধুমাত্র গানের বাণী দিয়ে বুঝা যাবে নাকি অন্য কিছু!
আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই স্থানের তার সাথে উকিলের বেড়ে উঠার যোগ আছে। যদিও, স্থান ইতিহাস নিরপেক্ষ বিষয়। তার ভূগোলের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। নানাভাবে সে সময়ের সাথে পাল্টেও যায়। কিন্তু সেই স্থানের অতীত বর্তমানের সম্পর্কের রেশ ধরে ঐতিহাসিক উকিল মুন্সীকে নিয়ে নিদেনপক্ষে কিছু অনুমান তো করা যাবে। এর বাইরে মহাপুরুষদের অনুসন্ধানের সাথে সাধারণ মানুষ আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করে, যাকে এক অর্থে চিরায়ত নামে ডাকা যায়। তারা যেভাবে ডাকতে গিয়ে ডাকতে পারেন না- সেই অসম্ভব কি উকিল সম্ভব করেন নাই! যদি করে থাকেন, সেটা কি? শুধুমাত্র বাণীই কি সেই চিরায়ত হৃদয়ঙ্গমের খোরাক যোগাতে পারে? এর সাথে দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক জিজ্ঞাসাও জড়িত। আপাতত এইসব প্রশ্ন নিয়েই আমাদের যাত্রা। উত্তর তো দূর কি বাত, আমরা নিশ্চিত না এই প্রশ্ন বা ভাবনার পরিচ্ছন্ন রূপ আমাদের সামনে হাজির হবে কিনা। দেখা যাক কি হয়। এলাহি ভরসা।
মহাখালি বাস টার্মিনাল থেকে বরাবর সকাল এগারোটায় বাস ছাড়ল। এর আগে কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিলো বিকেল চারটার মধ্যে পৌছে যাবো। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নামলাম মোহনগঞ্জ।এই অঞ্চলের মোহনগঞ্জ, ঠাকুরকোনা, সুসং-দুর্গাপুর সব জায়গায় একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করেছি- গাড়ীতে টিকেট কেটে উঠতে হয়, সময় মতো ছাড়ে কিন্তু পথে কতক্ষণ থামবে তার কোন বাধা-ধরা নিয়ম নাই। একবার তো দুর্গাপুর থেকে শ্যামগঞ্জ যাওয়ার পথিমধ্যে পেছনের গাড়ীর জন্য এক ঘন্টা অপেক্ষা করল। ঢাকার বাইরে গেলে মনে হয় মানুষের হাতে অফুরন্ত সময়!
মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরে নেমে দেখি বিদ্যুৎ নাই। মিজানকে মোবাইল করা হলো। এই অবসরে রুটি আর পরোটা খেয়ে নিলাম। মিজান আসলেন তার বন্ধু ফয়সলকে নিয়ে। দুইজনেই স্থানীয় কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ে। কুশল বিনিময় শেষে প্রথম কাজ হলো থাকার থাকার হোটেল ঠিক করা। মোহনগঞ্জ স্টেশনের পাশে শাপলা হোটেলে উঠলাম। মোহনগঞ্জ স্টেশন চালু হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জগামী নিয়মিত ট্রেন আছে। এইখানকার মাছ বাজার বেশ বিখ্যাত। শাপলা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা খারাপ না। বোর্ডারে ভর্তি।
মিজান জানিয়ে গেলেন পরদিন সকালে আমাদের নিয়ে উকিলের অঞ্চলে যাবেন। চিন্তার বিষয় হলো কিভাবে যাওয়া যায়। মিজান গিয়েছিলেন বর্ষার সময়। বর্ষাকালে পুরো অঞ্চল পানিতে ভেসে উঠে। ট্রলারে করে হাওর হয়ে একেবারে উকিলের ভিটায় উঠা যায়। আমরা জিগেস করলাম- সেখানে এমন কারো সাথে কি দেখা হবে যিনি উকিল মুন্সীকে নিয়ে তথ্য দিবেন। তিনি জানালেন সেখানে দেখা হবে উকিল মুন্সীর মেয়ের সাথে। আমরা অবাক হলাম। উকিল মুন্সী যে সময়ের বলে জানি তাতে তার মেয়ে এতো বছর বেচে থাকার কথা না। হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উকিল মুন্সীর যে তথ্য পেয়েছিলাম- তা ১৯২০ সালের দিকের কাহিনী। সে বইয়ে তাকে নিঃসন্তান বলা হয়েছে। সে সময় তার স্ত্রীও মারা যান। কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যকে মোবাইল করলে জানান, উকির মুন্সী মারা গেছেন একশ বছর আগে। সত্যি বলতে কি- উকিল মুন্সীকে নিয়ে যতটুকু জানা ছিলো সেই সামান্য জ্ঞানের উৎস হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাস ও বারী সিদ্দীকীর গাওয়া কয়েকটা গান। প্রসঙ্গত: এই উপন্যাস ছাড়া উকিলকে নিয়ে কোন লেখাজোখা চোখে পড়ে নাই- কেউ হদিসও দিতে পারেন নাই।
ইতিহাস আর ফিকশনের তফাত মানতেই হবে। এমনও হতে পারে সামনে আমরা যা কিছু আবিষ্কার করব তারও রূপ বিষয়ীগত চাহিদা দ্বারা নির্ধারিত হবে। তাই সত্য দাবির বদলে ন্যুনতম ভরসার আশা হয়তো আমরা করতে পারি- কিছু তথ্য তো জানা যাবে। সে যাই হোক, তখনকার অবস্থা নিয়েই বলি- অজ্ঞতা সংশয় আর উৎকন্ঠার পাখনা মেলে দিলো। আমরা কোন উকিল মুন্সীকে খুঁজতে এসেছি? দাউদকে বললাম, হয়তো নাতনীকে তারা মেয়ে বলছে। সে বলল, হতে পারে।
সকালে পরিচয় হলো মিজানের বাবা ছৈয়দ আছিউর রহমানের সাথে। বেশ মিষ্টি করে কথা বলেন। দাওয়াত করলেন তার বাড়ি ঘুরে দেখার জন্য। পরবর্তীতে শুধু বাড়ি দেখা নয়- দুপুর ও রাতের খাবার খেয়েছি তার বাড়িতে। তিনি মাইজভান্ডার শরীফের ভক্ত। মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ বছর আগে তার পীরের নির্দেশে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তার পিতৃভূমি চট্টগ্রামের টেকনাফ। তার আছে সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। তরীকতের পথে নিবেদিত প্রান মানুষটি আগলে রেখেছেন অনেক অজানা তত্ত্ব ও তথ্য। তার স্ত্রীর সংগ্রহে আছে জালাল উদ্দিন খাঁর জালাল গীতিকার প্রথম সংস্করণসহ বিভিন্ন সাধকের গানের বই।
এই অঞ্চলের মানুষ খুব সহজ করে কথা বলে। প্রশ্নও করে সোজাসুজি- কোন রাখ-ঢাক নাই। কথার মধ্যে কৌতুহল প্রকাশ পায়। শুনতে ভালোই লাগে। পরিচয় হয়েছিলো স্কুল শিক্ষক রইস মনরমের সাথে। রইস মনরম প্রতিভাবান ব্যক্তি। গান ও কবিতা লেখেন। নিজের বাড়িতে বাচ্চাদের নাচ, গান ও আবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের সাথে উকিলের বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি যেতে পারেন নাই। তিনি আমাদের বলেছিলেন সাত্তার পাগলার কথা। সময়ের অভাবে সাত্তার পাগলার সাথে দেখা করতে পারি নাই। তবে ফুটবল নিয়ে তার গানটি পড়েছিলাম। ছেলেকে ফুটবল খেলতে মানা করার ভেতর দিয়ে দুনিয়া নিয়ে কি চমৎকার গান লিখেছেন।
জৈনপুরে বেতাই নদীর ধারে উকিল মুন্সীর বাড়ীটি মোহনগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে। আগেই বলেছি বর্ষাকাল হলে সুবিধা ছিলো ট্রলার নিয়ে হাওড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু ফাল্গুন মাসে সেখানে পানি নাই। আছে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। সেটাও নাকি দেখার মতো দৃশ্য। ব্যাটারীচালিত অটোতে করে যাওয়ার চিন্তা ছিলো। কিন্তু কোন গাড়ীওয়ালাই রাজী হয় না। আক্ষরিক অর্থে সেখানে কোন রাস্তা নাই। পরে দেখেছি আসলে যা আছে তা হলো রাস্তার কংকাল। শেষ পর্যন্ত মুশাবিদা হলো মোটর সাইকেল করে বেতাই নদীর পাড় পর্যন্ত যাবো। সেখান থেকে নদী পার হয়ে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। দুইশ টাকা ভাড়ায় মোটর সাইকেল পাওয়া গেল। ড্রাইভারের নাম কাজল। কাজল ভাই আমাদের তিনজনকে নিয়ে উড়াল দিলেন।
…. …. …. …. …
দুই. দিক ভূলানো পথ
আত্ম সুখে সুখী যারা প্রেম রতন কি চিনে না , পীরিতি সকলেই বুঝেনা । যে মইজাছে রূপের সনে কালির লেখা তার কি মানে মনে, ও সে ভয় করেনা ঝড়-তুফানে পার হয়ে যায় যমুনা। পীরিতি বিষম খেলা চণ্ডীদাস যে রূপে ভুলা গো , তেমনি লাইলির প্রেমে মজনু ভুলা লাইলার নাম আর ছাড়েনা। উকিলে গায় মনরে কানা, প্রেমের ঢেউ কি তোর লাগেনা, ও সে এই জন্মের পীরিতের খেলা ভাঙলে খেলা থাকেনা।
বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় সাহিত্যকীর্তির অন্যতম হলো ময়মনসিংহ বা মৈমনসিংহ গীতিকা। গত দুইশত বছরে সেই ময়মনসিংহ গীতিকা (ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা আর কিশোরগঞ্জ) অঞ্চলে জন্ম নেয়া প্রভিতাধর মানুষদের একজন উকিল মুন্সী। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য গীতিকবিরা হলেন রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চান মিয়া, জামসেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার, খোরশেদ মিয়া, মিরাজ উদ্দিন পাঠান, আব্দুল হাকিম এবং আনোয়ারা বেগম। এই তালিকার শেষ দিকের বেশ কয়েক জন এখনো বেঁচে আছেন। এই গীতিকবিদের রেশ থেকে আলাদা করা যায় না আশেপাশের জেলাগুলোকে, যেমন- সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেখানে জন্মেছেন হাছন রাজা, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিমের মতো গীতিকবিরা।
উকিলের বাড়ীর পথেই ফিরে আসি। ধুলোর রাজ্যে আমরা হারিয়ে যাই নাই- পেছনে রেখে যাচ্ছিলাম ধুলোর ঝড়। পথের দুইপাশে চোখের শান্তির জন্য অনেক কিছূ ছিলো। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। ফসলের মাঠ। এর ভেতর দিয়ে নিঃসঙ্গ রাস্তাটা ঘুমিয়ে থাকা ক্ষত-বিক্ষত পরাজিত এক অজগর যেন। পরাজয়ের ক্ষোভে এই দুনিয়াকে দুইভাগ করে মিলিয়ে গেছে কোন অসীমে। আমরা সাওয়ার হয়েছি সেই অজগরের পিঠে। মাঝে মাঝে ধানের ক্ষেতে দাড়িয়ে থাকা দুই একটা গাছকে অন্য রকম লাগে। এরমধ্যে জঙ্গল মতো দুইটা জায়গা পড়ল। একটাতে শুধুমাত্র এক জাতের গাছ দেখলাম। মিজান জানালেন এই গাছের নাম করচ। বেটে ধরনের মোটা গুড়ির গাছ। মাথায় এলোমেলো চুলের মতো ডাল-পালা। পরে জেনেছি শুধুমাত্র হাওর অঞ্চলে এই গাছ হয়। ফেরার পথে করচ বনে নেমেছিলাম।
কাজল ভাই অভিজ্ঞ ড্রাইভার। দুইপাশের ফসল ক্ষেত আর করচ বন দেখতে দেখতে মিনিট চল্লিশেক পর বেতাই নদীর পাড়ে হাজির হলাম। এই জায়গায় বেতাই নদী দুটি ধারা হয়ে দুই দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নদী পার হতে টাকা লাগে না। এরজন্য আছে এজমালি ব্যবস্থা। নদীর দুই তীরে দুটি খুঁটি পোঁতা। তাতে একটা দড়ি বাধা। দড়ি ধরে টান দিলে নৌকা চলতে থাকে। বেশ মজার অভিজ্ঞতা। কাজল ভাইয়ের ফোন নাম্বার টুকে রেখে জানালাম, ফেরার ঘন্টাখানেক আগে তাকে কল দেয়া হবে।
নদীর ঢালু পার বেয়ে উঠতেই জৈনপুরের কালিবাজার। বিশাল বট গাছের নীচে গোটা কয়েক দোকান। চা-বিড়ি, মুদি আর দর্জি সবই আছে। না থেকে উপায় নাই। এখান থেকে শুকনো মওসমে উপজেলা সদর বা কাছাকাছি অন্য হাটে যেতে তাদের মেলা ঝক্কি পোহাতে হয়। মটর সাইকেল অপ্রতুল, এছাড়া মটর সাইকেলে ছড়ার সামর্থ্য বেশির ভাগ মানুষের নাই। আমরা দয়ালের চায়ের দোকানে ঢুকলাম। দরকার মতো ধুলো-ধূসর হাত মুখ ধোয়া হলো। লাল চা খেয়ে একজন মুরুব্বীকে জিজ্ঞেস করলাম উকিল মুন্সীর বাড়ি কোথায়? জানালেন কাছেই। আরো জানালেন- এই গ্রামের কলম মেম্বার উকিল মুন্সীর নাতনী জামাই। তিনি উকিল মুন্সীর যাবতীয় তথ্য জানাতে পারবেন। আমাদের পথ দেখাতে একজন এগিয়ে এলেন- কামরুল ভাই। কালিবাজারেই তার দর্জির দোকান আছে। স্ত্রীর সাথে মিলে চালান। সেটা আবার তার বসত বাড়িও। আসার সময় তার দোকান কাম বাড়িতে জিরিয়ে ছিলাম। হাটতে হাটতে নানা কথা হচ্ছিল। বর্ষাকালে কেউ মারা গেলে কবরের ব্যবস্থা কি? দাউদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন- বর্ষাকালে এখানে কবর দেয়ার মতো জায়গা খুব কমই থাকে। সবকিছু পানির নীচে তলিয়ে যায়। যাদের নিজস্ব উচু কবরস্থান নাই- তাদের লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়।
রাহবার কামরুল ভাই রাস্তা দেখিয়ে নিলে গেলেন বেতাই নদীর কূলে উকিল মুন্সীর বাড়ি। বাড়ির উঠানে বড়ই গাছের নিচে দুটি কবর। কাচা-পাকা বড়ইয়ের ভারে গাছটি নত। আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের মঞ্জিলে পৌছে গেছি। কিন্তু নিছক কারো কবর কি মঞ্জিল হতে পারে! নাকি একে উপলক্ষ্য করে আরো বড়ো কিছুর প্রত্যাশা করছি। তখন মানে হলো এটা শুধুমাত্র শুরুর নিশানা। দেখা যাক নিশানার নিশানা আমাদের কোন দিকে নিয়ে যায়।
পাশাপাশি দুটি কবর। উকিল মুন্সীর পাশে তার ছেলে সাত্তার মিয়ার (আবদুস সাত্তার, এই অঞ্চলে মোটামুটি সব নামের পেছনে মিয়া যোগ করা হয়) কবর। তিনিও বিখ্যাত কবি ও গায়ক ছিলেন। গীতিকবি আবদুস সাত্তারের নাম জানা ছিলো। তিনি উকিল মুন্সীর ছেলে এই তথ্য আমাদের কাছে একদম নতুন। আবদুস সাত্তারের গানের বই আছে। আবদুস সাত্তারের কথা শাহ আব্দুল করিমের সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে পরে আসছি।
চারদিকে নতুন ইটের অতি সাধারণ গাথুনী। আগের গাথুনী তুলে নতুন করে করা হয়েছে। দেখে মনে হলো আগের গাথুনী ছিলো ডাবল ইটের আর এখন সিঙ্গেল। দেখলেই বুঝা যায় বর্ষায় নদীর পানি বাড়লে পাশের রাস্তা পেরিয়ে কবরও ডুবিয়ে দিতে পারে। বেতাই নদীর সামনে বাঁক নেয়ার কারণে স্রোত এখানে এসে বেশি ধাক্কা দেয়। আমাদের দেখে বাড়ীর লোকজন এগিয়ে এলেন। চার-পাঁচজন মহিলা, একজন তরুন আর অনেকগুলো বাচ্চা। এরপর একজন বৃদ্ধও এগিয়ে এলেন। বৃদ্ধ জানালেন তিনি উকিল মুন্সীকে দেখেছিলেন। উকিল মুন্সী যখন মারা যান এই বৃদ্ধের বয়স ছিলো পয়তাল্লিশ বছর। বর্তমানে তার বয়স ছয়ষট্টি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে উকিল মুন্সী মুক্তিযুদ্ধের পরে মারা গেছেন। তিনি বললেন, না, যুদ্ধের পাচ-ছয় বছর আগে মারা গেছেন। আমাদের আক্কেল গুড়ুম।
এই মুসিবত থেকে উদ্ধারের পথ পেতে দাউদ জানতে চাইল- উকিলের কোন শিষ্য কি বেঁচে আছেন? একজন মহিলা জানালেন, তার শ্বাশুড়ী উকিল মুন্সীর মুরিদ। তার সাথে কথা বলতে চাইলে জানালেন- তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী। কথা বলার অবস্থায় নাই।
বেশিরভাগ সময় মানুষ দরকারি কথাটা পরে বলে। অনেকক্ষণ পর যেন একজনের মনে পড়ল। তিনি বললেন, উকিলের বেটা সাত্তারের বউ এখনো জীবিত আছেন। কোথায় তিনি? এরমধ্যে একজন খবর নিয়ে আসলেন, তিনি গোসল করছেন। এই ফাঁকে আমরা চারপাশটা ঘূরে দেখছিলাম। কবর থেকে দুই কি তিন গজ পরে নদীর ঢালু তীর। এরপর নদী কিছুদূর গিয়ে বাঁক নিয়েছে । নদীতে এখন পানি নাই। কাদা আছে তলদেশে। সেই কাদায় একটা নৌকা নিয়ে বাচ্চারা টানাটানি করছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদীর মতোই এই নদী বর্ষাকালে একদম ফুলেফেপে উঠে।
… … … … …
তিন. শুয়াচান পাখি আমার
শুয়াচান পাখি আমার শুয়াচান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি। তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি, আজ কেন হইলে নিরব মেলো দুটি আঁখি। বুলবুলি আর তোতা ময়না কত নামে ডাকি, শিকল ভেঙ্গে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি। তোমার আমার এই পিরিতি চন্দ্র সূর্য্ স্বাক্ষী, হঠাৎ করে চলে গেলে বুঝলাম না চালাকিরে পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।
সদ্য ওজু করা এক বৃদ্ধা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পড়নে কচু পাতা রঙের শাড়ী। বয়েস আন্দাজ করা যাচ্ছিল না। তার নাম রহিমা খাতুন। একজন বললেন, ইনি উকিল মুন্সীর বেটার বউ। আমরা সালাম জানালাম। বৃদ্ধা জানতে চাইলেন আমরা কোথা থেকে এসেছি। সে খবর জানানোর পর বললেন- ঠিক আছে নামাজ পরে আদায় করবেন। আগে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিবেন। অদেখা উকিল মুন্সীর অনেক কিছু তার বয়ানে জানা গেলো।
সম্ভবত ১৯৮০-৮১ সালের দিকে উকিল মুন্সীকে অনেক শোক পোহাতে হয়। সে সময় তার স্ত্রী মারা যান। উকিল মুন্সীর স্ত্রীর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পর বড় ছেলে আবদুস সাত্তার মারা যান। রহিমা খাতুনের জবানে জানা যায় এই শোক উকিল ভীষণভাবে দুর্বল করে দেয়।
মোটামুটি আট মাসের ভেতরই বউ আর ছেলের পর উকিল মুন্সীও মারা যান। উকিল মুন্সীর জীবনকাল নিয়ে আগে থেকেই আমরা বিভ্রান্ত ছিলাম। হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসের কাহিনী ধরে ভেবে ছিলাম উকিল মুন্সী মুক্তিযুদ্ধের আগে বা ব্রিটিশ শাসনামলে মারা গেছেন। অথচ উকিলের ছেলের বউয়ের মতে সেই মৃত্যু ঘটেছে ১৯৮০ – ৮১ সালে। সেই প্রসঙ্গে বলে রাখি বারী সিদ্দীকীর বরাতে জানা যায় মৃত বউয়ের শিয়রে বসে উকিল মুন্সী বিখ্যাত শুয়াচান পাখি গানটি রচনা করেন। উকিলের গানের সাথে সাথে শিষ্য রশিদ উদ্দিন এই সুরে উকিলকে সান্ত্বনা দেন। বারী সিদ্দীকী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানের দুটো অংশই গেয়ে থাকেন। আবার কিছু বইয়ে লেখা আছে এই গানটি রশিদ উদ্দিনের।
কিন্তু রহিমা খাতুন এই গানের রোমান্টিক তত্ত্বটি নাকচ করে দিয়ে আধ্যাত্মিকতার দিকে গেলেন। তিনি বললেন, এইসব বানানো কথা। উকিল মুন্সী এই গান বেঁধেছিলেন তার পীর মুর্শীদকে। পীরের ব্যাপারে দাউদ আগে থেকে নিশ্চিত ছিলেন। আমার অবস্থা হলো- কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম।
পীর যখন মারা যান, উকিল মুন্সী তার শিয়রে বসা। পীর নিজ কন্ঠে উকিলের- আতর গোলাপ ছিটাইয়া শুইয়া রইলাম বিছানায়, বন্ধু তোমারি আশায়… গানটি গাওয়ার পর সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজেকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। চাদর ঢাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এই ঘটনা উকিলের মনে বড় প্রভাব ফেলে। সেই উপলক্ষ্যে উকিল গানটি রচনা করেন। উকিল রহিমাকে এই ঘটনা জানিয়েছেন। এভাবে গানের মানে যখন পরিবর্তন হয়ে যায়- তখন অন্য গানগুলো নিয়েও কথা চলে আসে। তার মধ্যে একটা হলো আষাঢ় মাইসা ভাসা পানিরে। তার আগে রহিমার খাতুনের মুখে উকিলের পীরের বৃত্তান্ত জানা যাক।
রহিমা খাতুন জানান, উকিলের পীর ছিলেন হবিগঞ্জের রিচি’র মোজাফফর মিয়া। যিনি সাহেব বাড়ীর মোজাফফর আহমেদ (রঃ) নামে পরিচিত। এই দরবার শরীফ হবিগঞ্জ শহরের কাছাকাছি, জাহাগীর দরবার শরীফ নামে পরিচিত। নেত্রকোনা থেকে হবিগঞ্জের দুরত্ব কম নয়। কিশোরগঞ্জ অথবা সুনামগঞ্জ জেলা পার হয়ে নেত্রকোনা থেকে হবিগঞ্জ যেতে হয়। বর্ষাকালে উকিল মুন্সী হয়তো নৌকা নিয়ে হাওর পার হয়ে আসতেন। কিন্তু শুকানো মওসুমে সেই পীরদর্শন কেমন ছিলো?
এই দরবারে প্রতি বছর মার্চ মাসে বার্ষিক ওরছ হয়। মোজাফফর আহমেদ হযরত শাহজালাল (রঃ) এর তিনশ ষাট জন শিষ্যের একজন সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সিলসিলার উত্তরসূরী। মোজাফফর আহমেদের ছেলে কুতুব শাহও একজন পীর। তাদের তরিকা হলো চিশতিয়া। রহিমা খাতুনের দাদা পীরের আস্তানা চট্টগ্রামের মিজরাইল শরীফ। কক্সবাজারের কাছাকাছি। মিজরাইল শরীফ সম্পর্কিত কোন তথ্য আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাই নাই। তবে কক্সবাজারের কাছাকাছি সাতকানিয়ায় আছে মির্জারখিল দরবার। তবে রহিমা খাতুন মিজরাইল শরীফ বলতে এই দরবারকে বুঝিয়েছেন কিনা সে বিষয়ে আরো অনুসন্ধানের পর আমরা নিশ্চিত হতে পারব। উকিল মুন্সী মোজাফফর আহমেদের পাঁচ খলিফার একজন। উকিলেরও কয়েকজন মুরিদ ছিলো। এখন রহিমা খাতুনের চাচী শাশুড়ী ছাড়া উকিলের কোন মুরিদ জীবিত নাই। পীরের ছেলের কুতুব শাহের কাছে তিনি আর তার স্বামী মুরিদ হন। এই বিষয়ে পরবর্তী অনুসন্ধানের ইচ্ছা আছে। তিনি আরো জানান- পীরের নাতি বলেছেন, উকিল মুন্সীকে আমার দাদা খেলাফত দিয়েছেন। তাকে শুধু উকিল মুন্সী বলবেন না- বলবেন হযরত উকিল মুন্সী।
উকিল মুন্সীর নাতনী জামাই কলম মেম্বার (মতিউর রহমান) পীরের শানে রচিত একটি গান শুনান। এই গানটির রচিয়েতা উকিলের ছেলে আবদুস সাত্তার। আমরা মোবাইল রেকর্ড থেকে যেটুকু গান উদ্ধার করেছি গানটি হলো এই রকম- সরওয়ারে মদিনা তুমি আল্লাহর ওলি কুতুবুল আকতার শাহ পীর বদলে নুরে আলামীন জাহাগীর দরবার শরীফ রিচি করিলা তরাফ….ওহে নিরাশার আশা আসিয়া … ভক্তের আশা।
আষাড় মাইসা ভাসা পানিরে পূবালি বাতাসে, বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি,আমার নি কেউ আসে … এই অঞ্চলের বাইরে উকিলের জনপ্রিয় তিন বা চারটি গানের একটা। এই গানটি বারী সিদ্দীকীর কন্ঠে লেখক হুমায়ুন আহমেদ তার শ্রাবন মেঘের দিন চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। বাংলায় নারী ভাব নিয়ে গান গাওয়ার প্রচলন অনেক পুরানা। সেই ভাব বাংলার সর্বত্র আছে। বিরহী নারী ভাব সংগীতে তীব্র দ্যোতনা তৈয়ার করে, যা পুরুষ দিয়ে বুঝা যায় না। আত্মা-পরমাত্মা ও গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে এই ভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। উকিল মুন্সী ঘাটু গানের দেশের মানুষ। এই গানে পুরুষ রাধা বেশ নিয়ে কৃষ্ণের জন্য বিরহের গান গায়। যেহেতু আমরা পীর-শিষ্যের সম্পর্ক জেনেছি সেই দিক থেকে এই গানের স্বতন্ত্র্য তাৎপর্য হলো আষাঢ় মাসে সবাই নাইওর যায় কিন্তু উকিল যেতে চান কার্তিক মাসে। কেন? তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় পীরের মৃত্যু তারিখ থেকে। কেন না, উকিলের পীর মারা গেছেন কার্তিক মাসের শেষ দিকে। পীর-মুর্শেদের সম্পর্কের মধ্যে এটা খুব সাধারণ বিষয়- ভক্ত তার পীরের মৃত্যু দিনে মৃত্যু বরণ করতে চান। সেই আকুতি এই গানে প্রকাশ পেয়েছে। সব নাইওরী আষাঢ় মাসে বাপের বাড়ী গেলেও উকিলের নাইওর হবে কার্তিক। কিন্তু সেটা হয় নাই। উকিল মুন্সী মারা যান পৌষ মাসের দুই তারিখে।
পরে উকিল মুন্সীর ভক্ত মুক্তিযোদ্ধা দুলাল কমান্ডার আমাদের আরো কয়েকটি গানের লাইন শুনান। যেগুলো পীরের তরফে লেখা এই তথ্য না জানলে সঠিক মর্ম উদ্ধার করা কঠিন। প্রথম গানটি হলো- দক্ষিন হাওয়ারে লাগিস না মোর গায়, গায়ে লাগলে আগুন জ্বলে । দক্ষিনে হাওয়ারে চোখে নাহি দেখা যায়, দ্বিগুন জ্বালা লাগিলে আমার গায় ……। এই গানের দক্ষিন দেশ মানে পীরের দেশ। হবিগঞ্জ এই অঞ্চল থেকে দক্ষিণ দিকে। যে দেশে যেতে হয় হাওরের পর হাওর নৌকা বেয়ে। দক্ষিন দিকের হাওয়া তো পীরের গায়ে লেগে তারপর উকিলের অঞ্চলে আসবে। অথচ উকিল পীরের কাছ থেকে দূরে। এই হাওয়া তার কাছে পীরের পবিত্র স্পর্শ নিয়ে আসে। এই স্পর্শ এই আশেক বুঝতে পারে, যা না দেখার বিরহ আরো বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় গানের কথায় সেটা আরো স্পষ্ট হয়। এই হাওয়ার মতোই পীরের খবর উকিলের বিরহ ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। সে ব্যথা উকিল কেমনে সহ্য করেন!
সংবাদে কি অঙ্গ জুড়ায় সখি বিনা দরশনে, শিশিরে না ভিজে মাটি বিনা বরিষনে। যে যাহারে ভালোবাসে নয়নে নয়নেরই কোণে, তারে কি যাইরে ভোলা থাকিতে জীবনে। না দেখিয়া সংবাদ পাইলে দ্বিগুন দুঃখ বায়, যেমন কাটা গায়ে লেবুর রসে ধরে তার গায়…।
তৃতীয় গানটি হলো- এসো হে কাঙ্গালের বন্ধু তুমি দেখা দাও আসিয়া। আমার পুরা অঙ্গ জুরাইতাম তোমার চান্দ মুখ দেখিয়া।
এভাবে আরো কয়েকটি গান শুনেছিলাম যেগুলোর দ্বৈত অর্থ প্রকাশ পায়। কিন্তু আশেক-মাশুকের ভাব ছাড়া এই গানগুলো শিক্ষিত মানুষের কাছে যতই আদরণীয় হয়ে উঠুক- এর মর্ম না বুঝতে পারলে উকিল মুন্সীর গান, উপমা আর সেই হাওর অঞ্চলের উদাসী প্রকৃতিকে বুঝা সম্ভব না। হয়তো উকিলকে বুঝতে হলে আমাদের তাই করতে হবে। কিছুটা স্পষ্ট হয় যেন- এই গানের পেছনের মানুষটার হদিস জানা বড়ো প্রয়োজন। তাকে চিনতেন এমন সব মানুষের সাথে কথা বলার জরুরত তৈয়ার হলো। গানের ভাব নিয়ে যা বলছিলাম, সেই বিষয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো শাহ আবদুল করিমের গান। তার গান নিয়ে ব্যবসা হয়েছে বেশ। বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের বাহারী আয়োজন, বাদ্যযান্ত্রের ঝংকার ও গায়কীতে কূলহারা কলঙ্কীনি বা কৃষ্ণ আইলো রাধার কুঞ্জে মানব-মানবীর সাধারণ প্রেমের আইল টপকাতে পারে নাই। ক্ষেত্র বিশেষে সেই প্রেম শরীরের ভেতরের হৃদয়েরও খবর রাখে না। এর সাথে পরম সত্য খোঁজার বা সাধনার কোন যোগ পাওয়া যায় না। এতে অনেকের লাভ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভাবচর্চার দিক থেকে লোকসান হয়েছে ঢের।
উকিল মুন্সী এবং পীরকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা জানিয়ে ছিলেন উকিল মুন্সীর ছোট মেয়ে রাজিয়া খাতুন। কাছেই তার বাড়ি। বাড়িতে খুজতে গেয়ে শুনি তিনি ডাক্তারের কাছে গেছেন। পথে উকিলের নাতনী জামাই (ছেলের দিক থেকে) ও রাজিয়া খাতুনের সাথে দেখা। আমাদের প্রশ্ন ছিলো, উকিল পীরের মুরিদ হবার পর শরিয়তের সাথে তার যোগাযোগ কেমন ছিলো?
সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন- বাবা আল্লাহওয়ালা মানুষ। নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। ছিলেন। তার সাথে পীরের সম্পর্ক ছিলো অন্য ভক্তদের চেয়ে আলাদা। পীর সাহেব নিজে গান না করলেও গানের কারণে উবিলকে বেশি স্নেহ করতেন। একবার পীরের দরগায় ওরছ ছিলো। শরীর খারাপ থাকায় উকিল যেতে পারেন নাই। পীর সাহেব বেজায় রেগে গেলেন। ভক্তদের বললেন- উকিল মুন্সী আসলে তাকে ভিতরে ঢুকতে দিবা না। তার জন্য ওরছটাই নষ্ট হলো। কয়েকদিন পর উকিল মুন্সী পীরের সাথে দেখা করতে গেলেন।তিনি পীরের ঘরে ঢোকার আগেই গানে টান দেন- নিঃদুনিয়ার ধনরে…। এই গান শুনে পীর ঘর থেকে বের হয়ে উকিলকে হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভক্তরা অনুযোগ করে বলল, আমাদের বললেন তারে যেন ঘরে উঠতে না দিই। আর এখন আপনি নিজেই তপস্যা ভেঙ্গে তারে নিয়ে যেতে আসলেন। পীর সাহেব কিছুই বললেন না।
এই কাহিনী বলতে গিয়ে রাজিয়া খাতুনের চেহারা ঝলমল করে উঠে। সেই মুখ আবার অশ্রুতে ভরে উঠবে।
… … … … …
চার. উদাসী জীবন
মনের দুঃখ মনে রইলোরে বুঝলিনারে সোনার চান। চন্দ্র সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান।
রহিমা খাতুন বললেন, ‘তিনি তো উদাসী মানুষ ছিলেন’। কিন্তু এই উদাসী মানুষের জীবন সহজ ছিলো না। দুলাল কমান্ডারের মতে- ভবঘুরে যাকে বলে তাই হলো উকিল মুন্সী। বয়সকালে তিনি ছিলেন লম্বা চাওড়া। দেখতে রবীন্দ্রনাথের মতো সুন্দর। গলা ছিলো বেশ চড়া। তার গান রেকর্ড করা নিয়ে একটা গল্প আছে। একবার তিনি গান রেকর্ড করতে কলকাতা গিয়েছিলেন। গান রেকর্ড হয় না। কারণ চড়া গলায় যখন টান দেন রেকর্ড ফেটে যায়। তারা জানান, উকিলের আযান অনেক দূর থেকে শুনা যেতো। ঠিক এখনকার মাইকের আযানের মতো। বেতাই নদীর দুই কূলের দুটি মসজিদে তিনি ইমামতি করেছিলেন। রাজিয়া খাতুন জানান, তিনি আব্বাস উদ্দিনের সময়ের মানুষ।তার গান গাওয়ার আলাদা কোন মেজাজ ছিলো না। তিনি যেকোন জায়গায় গিয়ে গান গাইতে পারতেন।
দুলাল কমান্ডারের বরাতে জানা যায় উকিল মুন্সী জীবদ্দশায় বেশ সম্মান পেয়েছিলেন। তিনি একটা ঘটনা উল্লেখ করেন। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জনসমাবেশে উকিল মুন্সী গান গেয়েছেন। নেত্রকোনায় একবার মাওলানা মনজুর হকের বিরাট মাহফিল হয়। সেখানে হক সাহেব উকিল মুন্সীকে দিয়ে মোনাজাত করান।
উকিল মুন্সীর মূল নাম আবদুল হক। তার মাকে বলা হতো উকিলের মা। কেউ কেউ বলে তার মায়ের ইচ্ছে ছিলো ছেলেকে উকিল বানাবেন। সেই থেকে উকিলের মা। আর যেহেতু মসজিদে ইমামতি ও মক্তবে পড়াতেন তাই মুন্সী। এইভাবে তার নাম উকিল মুন্সী। তার জন্ম সাল জানা যায় না। হাওর বেষ্টিত উপজেলা খালিয়াজুরির বোয়াইলে উকিল মুন্সীর জম্ম। এই খালিয়াজুরি হলো ময়মনসিংহ গীতিকার বিখ্যাত চরিত্র মহুয়া মলুয়ার আদি বাসস্থান। অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলও ঐতিহ্যিকভাবে শিল্প সংস্কৃতি ও খেলাধূলায় সবসময় প্রাণবন্ত। জারি সারি ভাটিয়ালীর সাথে এই অঞ্চলের কুস্তি-নৌকাবাইচও বিখ্যাত। সেই সাংস্কৃতিক আলো-হাওয়ায় উকিলের বেড়ে উঠা। উকিল প্রায় একশ বছরের বেশি সময় বেঁচে ছিলেন।
দুলাল কমান্ডার, ছোটখাট এই মানুষটি এসেছেন মোহনগঞ্জের পাশের উপজেলা মদন থেকে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যুদ্ধে তার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী বারী সিদ্দিকীর বড়ো ভাই হাসেম। তিনি বলেন-তিনি উকিল মুন্সীর বিষয়ে কোন মিথ্যা বলছেন না। হামে চ্যায়হে সাচ বাত বলতা হ্যায়, কিসিকা লোকসান নেহি। মদন খালিয়াজুরিরও পাশের উপজেলা।
উকিলের বাবার নাম মওলানা গোলাম রসুল। তার বেশ নাম ডাক ও টাকা পয়সা ছিলো। উকিলের মায়ের বাড়ি জালালপুরের ধলা চৌধুরীর বাড়ি নামে পরিচিত। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা কাজলীর মেজর জে. মতিন উকিলের মামাতো ভাই। উকিল নিজেও বিয়ে করে জালালপুর থাকতেন। বিয়ে নিয়ে প্রচলিত আছে, উকিল মুন্সী বিয়ের আগেই সেই অসাধারণ রূপসী নারী লাবুশের মা-র প্রেমে পড়েন। তিনি বিরহকাতর হয়ে গান বাঁধেন- ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে, সোনার জালালপুর। সেখানেতে বসত করে, উকিলের মনচোর।
জালালপুরে উকিল প্রায় চল্লিশ বছর ছিলেন। রতন চেয়ারম্যানের বন্ধুত্বের সুত্র ধরে উকিল মুন্সী মোহনগঞ্জ থানার জৈনপুরে আসেন। জালাল পুরের সেই বাড়িটি এখনো আছে। উকিল মুন্সীর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। আবদুস সাত্তার বা সাত্তার মিয়া ও নুর ইসলাম বা পুলিশ মিয়া। দুই ছেলে মারা গেছেন। দুই মেয়ে এই পাড়াতেই থাকেন। আয়েশা আক্তার ও রাজিয়া খাতুন। বড় মেয়ের সাথে দেখা হয় নাই। তিনি অসুস্থ্য। ছোট মেয়ের কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
খুবই অল্প বয়সে উকিলের বাবা মারা যান। এরপর মামারা তার মাকে আবার বিয়ে দেন। তখন থেকে উকিল মুন্সী ভবঘুরে হয়ে যান। সেই সময় কিছুদিন ঘাটুগানের দলেও ছিলেন। এই তথ্য অবশ্যই তার পরিজনরা দেন নাই। ভবঘুরে উকিল বাবার সম্পত্তির দিকে না তাকিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতেন। সেই থেকে গানের দিকে তার ঝোক বাড়ে। আস্তে আস্তে পৈতৃক সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যায়। প্রথম জীবনে পীরের বাইয়ত নেয়ার আগে পর্যন্ত তিনি পালা গান গাইতেন। পরে পীরের নির্দেশে পালা গান ছেড়ে দেন। তিনি শুধুমাত্র একতারা দিয়ে গান গাইতেন। পীরের কাছে কখন বাইয়াত নিয়ে ছিলেন তা জানা যায় না। সম্ভত ১৯৫০ সালের আগের ঘটনা এটি।
দুলাল কমান্ডার জানান-১৯৫৪ বা তারও আগে থেকে তিনি উকিল মুন্সীর কাছে পড়েছেন। মহারাণীর ভিক্টোরিয়ার ছবি আঁকা বাল্য শিক্ষার হাতে খড়ি হয় উকিলের হাতেই। তিনি অনেক শ্লোক পড়াতেন। তিনি উকিলের আশি বছর বয়স থেকে দেখেছেন। দুলাল কমান্ডার উকিলের ছেলে সাত্তারের বন্ধু। আবদুস সাত্তার ছিলেন পাকিস্থান আমলের মেট্রিক পাশ, ময়মনসিংহের বাউল সম্মেলনে গোল্ড মেডেলিষ্ট। দুলাল কমান্ডার সাত্তারের বউ রহিমা খাতুনকে বোন বলে ডাকেন।
রহিমা খাতুনের বাপের বাড়িও বোয়ালীতে। তিনি সাত বছর বয়স থেকে মক্তব্যে উকিল মুন্সীর কাছে পড়তেন। উকিল মুন্সী তাকে ভালো ভালো কিতাব উপহার দিতেন। এসব বলতে বলতে তার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। এক সময় উকিল রহিমা খাতুনকে তার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলে তার মা-বাবা আপত্তি জানায়। কেন না আবদুস সাত্তার ছিলেন বিবাহিত। নানা ঘটনার পর পরবর্তীতে রহিমা খাতুনের বিয়ে হয় আবদুস সাত্তারের সাথে।
রহিমা খাতুনের মতে, বিয়ে হয়েছে সংগ্রামের পরে। রহিমা খাতুনের বিয়ে যদি সংগ্রামের পরে হয় তাহলে উকিল মুন্সীর পীর মারা যান সংগ্রামের পরে। কেন না উকিল মুন্সী সেখান থেকে এসেই তার পীরের মারা যাওয়ার খবর রহিমা খাতুনকে দেন। তাহলে শুয়াচান পাখি গানটি মুক্তিযুদ্ধের পরে লেখা।কিন্তু মুশকিল হলো এই অঞ্চলের মানুষের সময় নিয়ে হিসেবে গণ্ডগোল আছে। সুতরাং, সেই প্রসঙ্গ আপাতত থাক।
১৯৮০-৮১ সালে উকিল মুন্সীর বউ মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর ছেলে আবদুস সাত্তার জ্বরের শরীর নিয়ে দূরে কোথাও গান গাইতে যান। অসুস্থ্যতা বাড়লে তিনি সেখানে মারা যান। পর পর দুটো শোকে উকিল মুন্সী মুষড়ে পড়েন। এই সময় উকিল মুন্সী বাড়ির বাইরে যেতেন না। শরীরের বেগতিক দশার কারণে ততদিনে ইমামতি ছেড়ে দিয়েছেন। সারাক্ষণ বাড়ির উঠানে ছেলের কবরের কাছে বসে থাকতেন। কখনো কখনো বড় নাতি বুলবুলকে বলতেন- সাত্তারের কবরের কাছে বসে বেহেলা বাজাতে। রহিমা খাতুন আপত্তি করতেন- কবরের কাছে বসে বেহেলা বাজানো কেন?
স্বামী মারা যাবার সাত মাস পর রহিমা খাতুন বাপের বাড়ি বোয়ালীর জালালপুর চলে যান। যাবার কালে উকিল মুন্সী তাকে বলেন- দাবি রাইখও না। বাচ্চাদের কষ্ট দিও না। তুমি আর বিয়ে কইর না। এই জীবন মেনে নাও। তোমার সাথে এই শেষ দেখা। এর আটদিন পর রহিমা খাতুনের কাছে খবর গেলো তার শ্বশুর মারা গেছেন। এর আরো পরে রহিমা খাতুন এই বাড়িতে ফিরে আসেন। তার চার মেয়ে, দুই ছেলে। এরা কেউ এখানে থাকে না। উকিলের ভিটায় এখন তিনি একা থাকেন। উকিলের কথা মতো অল্প বয়সের সেই বৈধব্য তিনি মেনে নিয়েছেন। ভেজা চোখে বললেন- তারা খুব গরীব। উকিলের স্মৃতি রক্ষার জন্য কিছু করার সামর্থ্য তাদের নাই।
উকিলের মৃত্যুর বছর একদম নিশ্চিত হওয়া যায় নাই। দুলাল কমান্ডার আর কলম মেম্বারের মতে-এটা বঙ্গবন্ধু বা এরশাদের শাসনামল না।এর মাঝামাঝি সময়। উকিলের মেয়ে রাজিয়া জানিয়েছিলেন তার এক ছেলের বয়স ত্রিশ বছর। যার জন্ম উকিলের মৃত্যুর এক বছর আগে।
উকিলের গানের সংখ্যা কারো জানা নাই। উকিল মুন্সী প্রায় অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় সংগীত সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। সেই হিসেব তার গানের সংখ্যা বিপুল হবার কথা। রহিমা খাতুন নিজেও গীতিকার। তিনি উকিল মুন্সী ও আবদুস সাত্তারের গান সংগ্রহ করছেন। তার কাছে উকিল মুন্সীর বাষট্টিটি গান আছে। দুলাল কমান্ডারও উকিলের গান সংগ্রহ করছেন। তার কাছে আছে চল্লিশটির বেশি গান। দুলাল কমান্ডারের কাছে গান সংগ্রহের খাতাটি সবসময় থাকে। তিনি যেখানে যান সাথে করে নিয়ে যান, যদি উকিলের গান জানে এমন কারো সাথে দেখা হয়ে যায়। তাদের ইচ্ছে একদিন উকিল মুন্সীর গানের সংকলন বই আকারে বের হবে।
… … … … …
পাঁচ. সঙ্গের সাথী
রজনী প্রভাত হলো ডাকে কোকিলা, কার কুঞ্জে ভূলিয়া রইলাম শ্যাম চিকন কালা। আতর গোলাপ দিয়া সাজাইলাম বাসর, ফুলের শয্যা হইল বাসি, নইলে প্রাণেশ্বর, কি করি এখন কোন দুশমনে, বাঁকে বাঁধে আমার প্রানধন…।
রহিমা খাতুন বা দুলাল কমান্ডার দুই জনেই বললেন, উকিলের কোন শিষ্য বেচে নাই। শিষ্যদের কোন শিষ্যের কথাও তাদের জানা নাই। কিন্তু এটা যে একেবারে নিশ্চিত তথ্য তা মেনে নেয়া কঠিন। তার শিষ্যের কি শিষ্য নাই! উকিলের চিন্তার কোন পরম্পরা বা সিলসিলা না থাকলে এই কালে তাকে বুঝা মুশকিল। এছাড়া তার সমসাময়িকতা ঠিক করতে না পারলে এই অঞ্চলের ইতিহাস ও নানা পথ-মতের সম্পর্কের ধরণের দিক থেকে তাকে স্পষ্ট করে তোলা যাবে না। সে দিক থেকে তার সমসাময়িক গীতিকবিদের সাথে তার সম্পর্ক জানার জরুরত তৈরি হয়। পর্যাপ্ত তথ্যসুত্র হাতে না থাকায় এবং আমাদের অনুসন্ধান অসম্পূর্ণ হওয়ায় সে প্রসঙ্গে আপাতত দুই একটি কথা তোলা হলো।
রহিমা খাতুনের বরাতে জানা যায় সুনামগঞ্জের ধলের শাহ আবদুল করিমের (ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৯১৬ – সেপ্টেম্বর ১২, ২০০৯) সাথে উকিল মুন্সীর পরিচয় ছিলো। তারা এক সাথে গান করেছেন। মোহনগঞ্জ নেত্রকোনার সীমানা ঘেষা। এরপরেই সুনামগঞ্জ জেলা। উকিলের ছেলে আবদুস সাত্তার ছিলেন আবদুল করিমের সমবয়েসী। রহিমা জানান শাহ আবদুল করিমের সাথে উকিলের বেশ সখ্যতা ছিলো।
কবি টি এম আহমেদ কায়সারের নেয়া শাহ আবদুল করিমের সাক্ষাৎকার ছোট কাগজ খোয়াবে (সেপ্টেম্বর ১৯৯৭) ছাপা হয়েছিলো। করিম তার সমসাময়িকদের সম্পর্কে সেই সাক্ষাৎকারে জানান- আমার সমসাময়িক কেউ এখন আর বেঁচে নেই। যাদের সঙ্গে গান করেছি তাদের মধ্যে সাত্তার মিয়া, কামালুদ্দিন, আবেদ আলী, মিরাজ আলী, বারেক মিয়া, মজিদ তালুকদার, দূর্বিন শাহ এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিলো। এছাড়া ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গান করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে,তাদের সবার নাম এখন আর মনে নেই। তুলনামুলক ভাবে আমার গাঢ় হৃদ্যতা ছিলো নেত্রকোনার সাত্তার মিয়ার সঙ্গে। মজিদ একদা অন্যের গান নিজের নামে গাইতো। কারন জিজ্ঞেস করলে বলতো -গানটা গাইতেছে কে? হোক অন্যের; আমি যখন অন্যের গান করি তখন আমিও তো একই ভাবের ভাবুক থাকি। আমার কথা আমি বলবোনা কেনো? জালালউদ্দিন, উকিল মুন্সী আমার চাইতে বয়সে যদিও অনেক বড় ছিলেন তাদের সঙ্গেও আমি দু-এক আসরে গান করেছি।
উকিল মুন্সীর সাথে সুসম্পর্ক ছিলো নেত্রকোনার আরেকজন বিখ্যাত গীতিকবি রশিদ উদ্দিনের (জানুয়ারি ২১, ১৮৮৯ – ১৯৬৪) । শুয়াচান পাখি গানটির একটা অংশ তার লেখা। তার জনপ্রিয় একটি গান হলো- মানুষ ধরো মানুষ ভজ, শোন বলিরে পাগল মন। আরেক খ্যাতনামা গীতিকবি জালাল উদ্দিন খাঁ (এপ্রিল ২৫ এপ্রিল ১৮৯৪- আগস্ট ০১, ১৯৭২)ছিলেন রশিদ উদ্দিনের সাগরেদ। সারা জীবনের সংগীতের পেছনে ছোটা রশিদ উদ্দিন তার বাড়িকে বাউল তত্ত্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করেন। ফলে নানা চিন্তা ও মতের গীতিকবিরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন।। এ কেন্দ্রে সহযোগী হিসেবে সাধক উকিল মুন্সী সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তার সাথে আরো ছিলেন মোহনগঞ্জ থানার হাসলার চান খাঁ, মদন থানার হাজরাগাতির পিতাম্বর রবিদাস। মধ্যাহ্ন উপন্যাসে হুমায়ুন আহমেদ জালাল উদ্দিন খাঁ-কে উকিলের শিষ্য বলে দাবি করেছেন। তিনি সিরাজ আলী নামে আরেক শিষ্যের নাম উল্লেখ করেন। রশিদ উদ্দিন ও জালাল উদ্দিন খাঁকে ধরে এই অঞ্চলের গানের ধরণ, তত্ত্ব জিজ্ঞাসা ও সাধনার ধারা সম্পর্কে এবার সামান্য কিছু তথ্য জুড়ে দিলাম।
বাংলার ভাব গানের মূল নিমিত্ত হলো এই জীবন ও জগত নিয়ে অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানে অন্তর্ভুক্ত আছে মানুষ-মানবদেহ-প্রকৃতি, সৃষ্টিরহস্য, গুরু সাধন, নিঘোর তত্ত্ব, আত্না-পরমাত্না প্রভৃতি। এইসব চিন্তা গুরু ও ঘারাণাকেন্দ্রিক সাধনার সিলসিলা দ্বারা জারিত। এই ধরণের গানের বিকাশ যেখানে ঘটেছে, সব জায়গায় এই গানগুলো এক ধরণের সার্বজনীনতা হাসিল করে নিয়েছে। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ সেখানে থাকে না। সেই সব গানের উপাদান আকারে যেমন থাকত হিন্দু শাস্ত্রের মহাভারত, রামায়ণ ও গীতা, একইভাবে থাকত ইসলাম ধর্মের নানা বাহাস, কোরান-হাদিস, জঙ্গনামার পুঁথি ও শহীদি কারবালাসহ প্রভৃতি। এইসব গানের বিভিন্ন ধরণ আছে। এর মধ্যে একটি হলো লড়াই। কবিগানের সেই সিলসিলা এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান। এখানে মোটাদাগে কবিগান বললেও এর আছে নানান ধরণ ও ধরণভেদে নামও আলাদা।
বাউল গান পরিবেশনের একটি বিশেষ রীতি ‘মালজোড়া’ গানের আসরে অংশগ্রহণ জালাল উদ্দিন খাঁ বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বাসাটি গ্রামে এক মালজোড়া গানের আসরে জালাল উদ্দীন খাঁ ধরাট বা প্রশ্ন রেখেছিলেন আল্লা বলতে কেউ নাই এ সংসারে, মিশে গেছে আলো হাওয়ায় বিশ্বজুড়ে তালাশ কর কারে? তার প্রতিপক্ষ বাউল ইদ্রিস এই ধরাটের উত্তর দিয়েছিলেন রশিদ উদ্দিনের একটি গানের সাহায্য নিয়ে – জালাল তুমি ভাবের দেশে চল-আল্লাকে দেখবে যদি চর্মচক্ষের পর্দা খোল, গিয়া তুমি ভাবনগরে চেয়ে থাকো রূপ নেহারে, সজল নয়নে ফটোগ্রাফ তোল, মনরঙে প্রেমতরঙ্গে তোমার দিলের কপাট খোল, দেখবে তোমার মাবুদ আল্লা সামনে করে ঝলমল। গায়ক আবদুল আলিমের কন্ঠে জনপ্রিয় হওয়া এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া, এতো যত্মে গড়িয়াছেন সাই… গানটির গীতিকার রশিদ উদ্দিন। এই তর্কের গান দুটিতে মনোযোগ দিলে বুঝা যায়, তাদের চিন্তা-চেতনা ও ভাব কত উচ্চমূল্য ধারণ করে।
রশিদ উদ্দিন ছিলেন এক লেংটা ফকিরের শিষ্য। অন্যদিকে জালাল উদ্দিন খায়েঁর সংগীত সাধনায় রয়েছে শাক্ত প্রভাব। তিনি কোনো এক শাক্ত সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন। জালাল উদ্দিন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চার খণ্ডের জালাল-গীতিকা গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় জালাল-গীতিকা পঞ্চম খণ্ড। মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে জালাল-গীতিকা সমগ্র। জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন তত্ত্বতে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নাম- আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। জালাল উদ্দিন খাঁ ও রশিদ উদ্দিন প্রমুখের গান বইয়ে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া তাদের গান নিয়ে অনেক কথাবার্তা আছে। সেদিক থেকে উকিলকে নিয়ে তেমন কোন কাজ হয় নাই।
রশিদ উদ্দন ও জালাল উদ্দিন খায়েঁর সাথে সম্পর্কের কারণে উকিলের সময়কালটি বুঝা যায়। তিনি সম্ভবত জালাল উদ্দিন খায়েঁর সমবয়েসী। তবে তার বংশধরদের মতে তিনি একশ বছরের বেশি বেঁচেছিলেন। এই তথ্য সঠিক হলে উকিল মুন্সীর জন্ম ১৮৮০ সালের আগে। রশিদ উদ্দিন ও জালাল উদ্দিন খায়েঁর গানের সম্পর্কে বলার কারণ হলো- একই অঞ্চল এবং গুরু-শিষ্য হবার কারণে এই দুইজনের গানের ধরণ ও চিন্তার মাঝে নানা মিল থাকে পারে। আবার তন্ত্র-মন্ত্রগত পার্থক্য থাকতে পারে। উকিলের গানগুলো সংকলিত হলে উকিলের গানের ধরণ স্পষ্ট হওয়া যেতো। সেই ক্ষেত্রে অঞ্চলগত এবং সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সাথে সাথে মিল-অমিল জায়গাগুলো ফুটে উঠত।
এই কথা সহজে বলা যায় এই গীতিকবিদের গান ভাবের দিক থেকে উচ্চমানের। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলের চিন্তাভাবনার স্বাধীন-স্বতন্ত্র্য রূপ আছে। মধ্যযুগের ময়মনসিংহ গীতিকা সেই স্বাধীন-স্বাতন্ত্র্য জীবন চেতনার কথাই বলে। বিশেষ করে যখন বলা হয়ে থাকে উকিলের জন্মভূমিতে মহুয়া, মলুয়ার জন্ম। সেই সময় এখনকার মানুষ কেন্দ্রের শাসন ও ধর্মীয় গোড়ামী থেকে এক প্রকার মুক্ত ছিলো। সেই প্রভাব কি পরবর্তীতে পড়ে নাই! এই অঞ্চলে টিপু পাগলার নেতৃত্বে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ১৮২৭ সালে পরিচালিত হয় ফকির বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।কিন্তু এর বিশাল সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে যায়। এর পরে এই অঞ্চলে লেংটা ফকিরদের জলসা হতো নিয়মিত। এর প্রভাব কম নয়। আবার আমরা উকিলের দিকে ফিরলে দেখি- তিনি নেত্রকোনা বা ময়মনসিংহ অঞ্চলে স্থিতু ছিলেন না। তিনি নিজ সাধন অন্বষণে সুদূর হবিগঞ্জের রিচি’র দরবারের মোজাফফর আহমেদের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছেন। সেই দিক থেকে তিনি সম- সাময়িক অন্যদের সাথে ভেদ রচনা করেছেন। সেখানেও বুঝার বিষয় আছে।
একই সাথে হাওর অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও জীবন আচরনের আলাদা একটা দিক তো আছে। বর্ষায় এই অঞ্চলের মানুষ আক্ষরিক অর্থে পানি বন্দী। এখনো সেই অবস্থা বিশেষ উন্নতি হয় নাই। বছরে কেবলমাত্র একটি মাত্র শস্য উৎপাদন, মৌসুমি বেকারত্ব, অবসর, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যোগাযোগের অভাব, সারা বছর কাজের অনিশ্চয়তা কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা সমস্যা সেখানে ছিলো্। এই ধরণের অঞ্চলে উচ্চতর ভাবের গানগুলো একই সাথে সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক অনুসঙ্গ বটে।
এইসব ঐতিহাসিক সম্পর্ক সুত্র ও ব্যক্তিক অভিমুখ উকিলের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গকে সমৃদ্ধ করেছে। অন্য গীতিকবিদের সাথে কিছুটা দুরত্ব রেখেই যেন উকিল মুন্সীর গানে সাধারণ মানুষের প্রত্যাহিক অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে। তার গানে প্রেম বিরহ, প্রকৃতি কাতরতা মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক অন্বেষা ফুটে উঠে। ভাটি অঞ্চলের উদাসী প্রকৃতির ভেতর দিয়ে তিনি জগতকে আবিষ্কারের চেষ্ঠায় রত যেন। সেই কাতররূপ শ্রোতাকে তার দিকে টানে। একজন গীতিকবি কি সেই কাতরতায় ডুব দেয়- যে পথ সে একাকী পাড়ি দিতে পারে না। দার্শনিক, পরমার্থিক জিজ্ঞাসা সে পথ চলায় ভর করে। সে পথ জিজ্ঞাসাকে আরো কষ্টকর করে তোলে। সেই জিজ্ঞাসার শেষ কোথায়!
ঢাকায় জেনেছি জালাল উদ্দিন খাঁয়ের সাথে পালা গানের আসরে উকিল মুন্সীর লড়াই হতো। এরমধ্যে বিখ্যাত হলো শরীয়ত-মারেফাত পালা। এই পালায় উকিল মুন্সী নিতেন শরীয়তের পক্ষে আর জালালউদ্দিন খাঁ নিতেন মারেফতের পক্ষে। তার বংশধররা নিশ্চিত করছেন তিনি ব্যক্তিগত জীবনের শেষ পর্যায়েও একনিষ্ট শরীয়তী জীবন-যাপন করেছেন। সেই দিক থেকে তার গানের মেজাজের ভিন্নতা তো ঢের রয়েছে। মসজিদের ইমামতি থেকে বুঝা যায়- তার গানের ন্যুনতম সামাজিক-ধর্মীয় স্বীকৃতি ছিলো। এখানে ইসলামের মারেফতি বয়ানের সাথে শরীয়তি চর্চার যোগ- যা তার গানকে আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। আমার সফরসঙ্গী দাউদের ভাষায় দৃশ্যমান শরীয়তী জীবন। সেই চিহ্ন ধরে হাটলে আমরা হয়তো আরো অজানা অনেক কথা আবিষ্কার করব।
… … … … …
ছয়. চিহ্ন
আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়।নিঠুর বন্ধুরে বলেছিলে আমার হবে মন দিয়াছি এই না ভেবে স্বাক্ষী কেউ ছিলো না সে সময় ও বন্ধুরে। স্বাক্ষী শুধু চন্দ্র তারা একদিন তুমি পড়বে ধররে বন্ধু ত্রিভূবনের বিচার যেদিন হয় রে বন্ধু।নিঠুর বন্ধুরে দুঃখ দিয়া হিয়ার ভেতর একদিনও না লইলে খবর একি তোমার প্রেমের পরিচয় ও বন্ধুরে। মিছামিছি আশা দিয়া কেন বা প্রেম শিখাইয়া দূরে থাকা উচিত কি আর হয়। নিঠুর বন্ধুরে বিচ্ছেদের বাজারে গিয়া তোমার প্রেম বিকি দিয়া করব না প্রেম আর যদি কেউ কয় ও বন্ধুরে পাষাণ বন্ধুরে। উকিলের হয়েছে জানা কেবলি চোরের কারখানা বন্ধু চোরে চোরে বেয়াইয়ালা হয় রে বন্ধু।
দুলাল কমান্ডারের চোখের জল দেখে সকলের মন খারাপ হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছেন- এই গ্রামের মানুষ যদি উকিলের জন্য কিছু করতে না পারেন বা সম্মান দেখাতে না পারে তবে তিনি উকিলের কবর তার গ্রামে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশের মানুষ যদি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ট মতিউর রহমানের কবর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারে, তিনি কেন উকিলের কবর তার গ্রামে নিয়ে যেতে পারবেন না। আরো জানালেন এখানে মাজার গড়ার পরিকল্পনা করেছেন। উকিলের ছোট মেয়ে রাজিয়া খাতুনের প্রথম কথা ছিলো- আমার বাবার কবরটা যেন মাজার হয় সেজন্য তোমরা কিছু কর।
দুলাল কমান্ডার নিজ গ্রাম মদনে প্রতিষ্ঠা করেছেন উকিল মুন্সী স্মৃতি সংসদ। তিনি সেই সংসদের সভাপতি। সেখানকার এমপি তাদের সংগঠনকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। সেই সংগঠনের প্রায় এক লক্ষ টাকার বাদ্যযন্ত্র আছে। তিনি উকিল মুন্সীর কবর সংরক্ষনের জন্য জৈনপুরের জনৈক মতি মিয়াকে তিরিশ হাজার টাকা দেন। সেই লোক কবরের পুরানা ভিত উপড়ে নামমাত্র ইট দিয়ে চারপাশের কবরের চারপাশ চিহ্ন দিয়ে রাখেন। সেখানে আবার পুরানো ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এটা নিয়ে দুলাল কমান্ডারের আক্ষেপের অন্ত নেই। তাকে বার বার অশ্রুসিক্ত করছিলো।
সেই শুক্রবারে দুলাল কমান্ডার এসেছিলেন উকিল মুন্সীর ওরছ বিষয়ে কথা বলতে। তিনি জানান ফাল্গুন মাসের ঊনত্রিশ তারিখ ওরছ হবে। উকিলের মৃত্যুর পরের বছর থেকে না হলেও এই ওরছ অনেক বছর ধরে হয়ে আসছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোক আসে। ওরছ উপলক্ষ্যে সারারাত গান বাজনা হয়।
আমরা জানতে চাইলাম- উকিল মুন্সী মারা গেছেন পৌষ মাসে আর ওরছ ফাল্গুন মাসে? জানালেন- পৌষ মাসে এই অঞ্চলে মারাত্বক শীত থাকে। ফাল্গুন মাসে গরম-শীত মাঝামাঝি থাকে। সারারাত গান-বাজনা হয়। তাই মানুষের সুবিধা হয় এই সময়ে। কথা প্রসঙ্গে জানা গেলো ওরছ নিয়ে উকিল মুন্সীর কোন আদেশ নিষেধ ছিলো না। তবে তার পীর মেয়েদের গান করতে মানা করেছিলেন। মেয়েরা পুরুষদের মতো আসরে নয়, নিজেদের মাঝে গান করবে। তার নাতনী আলেয়া এক সময় নেত্রকোনার নাম করা গায়িকা ছিলেন। পীরের নিষেধের কারণে তিনি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে অনেকের মধ্যে নেত্রকোনায় স্থানীয়ভাবে সালাম ও গোলাম মওলা উকিলের গান গেয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
বারী সিদ্দীকী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কলম মেম্বার বলেন- তিনি তো মাত্র চারটা গান গেয়েছেন। রহিমা খাতুন বলেন- তার গায়কী ঠিক আছে। দুলাল কমান্ডার বলেন- কিন্তু তিনি তো উকিলের এখানে আসার সময় পান না। বারী সিদ্দীকী ও হুমায়ুন আহমেদ চাইলে উকিল মুন্সীকে পরিচিত করানো জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। অথচ কিছুই করলেন না। নিজেদের লাভটুকুই দেখেছেন। তবে দুলাল কমান্ডারকে বারী সিদ্দীকী কথা দিয়েছেন- উকিলের গানের বই প্রকাশ করার ব্যবস্থা করে দিবেন। মোহনগঞ্জ থাকতেই জেনেছিলাম লেখক হুমায়ুন আহমেদের নানার বাড়ি মোহনগঞ্জে। আরো জানলাম তার মামা এখন মোহনগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান।
সেদিন ছিলো হাটবার। আমরা বেতাই নদীর পাড়ের কালীবাজারে সেই দয়ালের দোকানে আবার চা খেলাম। ততক্ষনে হাট জমে উঠেছে। অনেক সবজি দেখলাম যেগুলো সচরাচর আমরা দেখি না। আমরা পেয়াজু কিনলাম।চা শেষে কামরুল ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এজমালি নৌকায় নদী পার হলাম। কাজল ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মোহনগঞ্জে রওয়ানা দিলাম। বিকেলের মরা আলোয় আমরা হয়তো উকিল মুন্সীর কথা ভাবছিলাম। জানি না। আমরা তো অন্যের মনের কথা ধরতে পারি না। কিন্তু হাওর অঞ্চলের একটা বিবাগী রূপ আছে। সে রূপ হয়তো দেখা রূপের বাইরের আরো অনেক খবর রাখে। মন বলছিলো, আমি জানি আমার বন্ধূরা কি বলতে চাইবে।
উকিলের গানে আছে …আমারে নিলো না নাইওর পানি থাকতে তাজা। এই আকুতি কি শুধু গুরু-শিষ্যের মিলন না আরো বেশি কিছু! লেখাজোখায় না থাকলেও এই অঞ্চলে উকিল মুন্সীর চিহ্ন এখনো অনেকটা তাজা আছে। যদিও জানি না এই জল-মাটি-বায়ুতে তার আর কোন ছোঁয়া লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই অঞ্চলের জল মাটি বায়ু উকিলের ভাবকে ধারণ করেছে, উকিলকে কথা কইতে দিয়েছে। উকিল যখন কথা বলেছেন ভাটির সুরে বলেছেন। তার কথার রেশ তো সুদূর হিমালয় থেকে আসা জলস্রোতের মতো দুই কূল চাপিয়ে প্রকাশ করেছে নিজেকে। যেমন এই প্রকৃতি নিজেকে প্রকাশ করে। সেই প্রকাশ আমাদেরও আপ্লুত করেছে। তাই এতোদূর ছুটে আসা। তিনি গানের মধ্য দিয়ে পরিচয়ে বেঁধেছেন আমাদের অদেখা ও অচেনা ভূবনকে। সেখানে আমরাও কি নাই! আছি বলেই তো এই ক্লান্ত বিকেলে তাকে আমরা ভাবছি।
আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো উকিলের চিহ্নের খোজে। চিহ্ন সাজিয়ে রাখার নমস্যবস্তু নয়, এর ভেতরে আছে মর্মকে বুঝতে পারার অন্বেষন। কি সেই মর্ম তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তারপরও সেই মর্ম নিরেট প্রশ্ন হয়ে আমাদের সামনে হাজির। কি সেই প্রশ্ন তাও স্পষ্ট নয়- হয়তো চিহ্ন ও ভাবের ভেদ আত্নজিজ্ঞাসার মতো করেই আমাদের গলায় ঝুলে থাকে। নিয়তির মতো। হয়তো এই যাত্রার শেষে আমাদের ভেতরকার সেইসব প্রশ্নকে পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠবে। এখনো আমরা হিসেবে মিলাতে বসি নাই- প্রশ্ন পরিচ্ছন্ন হবার আগের আর পরের কথার তফাত কি? কিন্তু এতটুকু জানি আমরা খালি হাতে ফিরছি না।
এই যাত্রায় আমরা হয়তো উকিলের ছড়িয়ে থাকা চিহ্নের সামান্য স্পর্শ করেছি। আমাদের সামনে যা হাজির হয়ে ছিলো – তা দিয়ে উকিল মুন্সীকে বুঝতে পারা যায় না- জানি। শুধু তাই নয়- আমাদের চৈতন্যের মধ্যে থাকা পূর্ব সংস্কার ও অনুমান তাকে বুঝার ক্ষেত্রে নিদারুন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো ইতিমধ্যে সেই পূর্ব সংস্কার ও অনুমানের ফাঁদে আমরা পড়ে গেছি। আমাদের যাত্রাও সেই পথের। কিন্তু দুলাল কমান্ডার বা রাজিয়া বা রহিমার জীবনে যে স্পর্শ আছে অথবা এখনো আমরা চিনি না বা জানি না এমন অনেকের কাছে উকিলের স্মৃতি মূল্যবান হয়ে আছে। আরো আছে এই অঞ্চলের অসংখ্য শিল্পীর মুখে উকিলের গান। আদি সুরে আদি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গাওয়া সেই গান। এদের পীর বা গুরুভক্তি আছে কিনা জানি না কিন্তু শিল্পের নিষ্ঠা নিশ্চয় কম নয়। তারা পুরোপুরি না হলেও আদি-অকৃত্রিম হৃদয় দিয়ে গান করেন- যা আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। সেই স্পর্শ দিয়ে হয়তো আমাদের প্রশ্নেরা নিজেদের হাজির করবে। হয়তো আমরা নিজেদের সামনে হাজির হবো। এটা এক ধরণের আশাবাদ- সম্পর্কের ভেতর দিয়ে নিজেকে হাজির করা, চেখে দেখা।
কিন্তু একটা গুরুতর জায়গায় এখনো আটকে আছি। আমাদের প্রাথমিক প্রশ্নের একটা ছিলো- চিহ্নের দরকার কেন? উপরের কথাগুলোর মধ্য দিয়ে তার ধর্মতাত্ত্বিক চর্চা ও দার্শনিক দিকটা পুরোপুরি ফরসা হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না। হয়তো কিছু বিষয় আমাদের চিন্তায় টোকা দিয়েছে মাত্র। সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য চিন্তার নিজের পরিধির মধ্যে কি ধরণের জবাব তৈরি থাকে- সেটা জানা যেমন জরুরী, একই সাথে জরুরী এই চর্চার সাথে যারা জড়িত তাদের সাথে মোলাকাত করা। যেহেতু সাধনার আছে নিজস্ব ধারা আর ভিন্ন ভিন্ন মোকাম। সেই মোকামে আমি আগন্তুক মাত্র। সেখানে দীর্ঘ পথ পরিক্রমাকে প্রকাশ করার বিষয়টা কি? তারপরও নিজের আশাবাদটুকু বাচিয়ে রাখতে দোষ কি! সেই খোঁজে আমাদের পরবর্তী মঞ্জিল ঠিক হয়ে যায়- হবিগঞ্জের রিচি-র দরবার। সেখানে কি পাওয়া যাবে- তা বলা মুশকিল। কিন্তু তার জন্য কিছুটা প্রাথমিক প্রস্তুতি তো দরকার। আশা করি সেই মকসুদ এলাহি পূরণ করবেন।
ভবিষ্যত কর্মপন্থা থেকে বর্তমানে ফিরে আসা যাক। এইসব কিছু আমাদের যেভাবে স্পর্শ করে- তাকে আমরা নিশ্চয় কোন নাম দিয়ে ডাকব। নিজেদের ভেতর অন্বেষন বলে কোন মূল্য চাইব। সচরাচর যাই হয় আর কি- তারপর কথা তুলব আসুন উকিল মুন্সীর মূল্যায়ন করি। কিন্তু যে স্পর্শের কথা বলছি আসলেই সেখানে কি কোন ঋণশোধ বা তাকে মূল্যায়নের কথা তোলা যায়! সে স্পর্শ তো মানব স্বভাবের চিরন্তনতাকে বুঝাপড়ার মামলা। সেখানে উকিলের মূল্যায়ন- এমন গালভরা কথার কোন মানে হয় না। বেকুবী মাত্র। উকিল যা ছিলেন তা তো হয়েও আছেন। তাকে নতুন করে কিছু বানানোর নাই। সেটা করতে গেলে নিজেদের প্রতি বেইনসাফ হবে। আমরা শুধুমাত্র ইনসাফী চাইতে পারি। এর সাথে যোগ আছে-জানতে পারার, বুঝতে পারার, স্পর্শ করতে পারার।
মানব জীবন যাপনের ভেতর নিরন্তন যে সাধনার ধারায় মানুষ বৈচিত্র্যভাবে জগতকে প্লাবিত করছে সেটা আমরা উপলব্দি করতে চাই। সেই উপলব্দি থেকে আজ শুধু এইটুকুই বলা যায়- বেতাই কূলে বসে উকিলের মুখে আমরা গান শুনতে চাই।
সোনা বন্ধুয়ারে, এতো দুঃখ দিলি তুই আমারে, তোর কারণে লোকের নিন্দন, করেছি অঙ্গের বসনরে। কুমারিয়ার ঘটিবাটি, কুমার করে পরিপাটি, মাটি দিয়া লেপ দেয় উপরে। ভিতরে আগুন দিয়া কুমার থাকে লুকাইয়া, তেমনি দশা করলি তুই আমারে।
নেত্রকোণা থেকে আসার দুই মাস পর দুটি বইয়ের খোঁজ পাই, যেখানে উকিল মুন্সীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া আছে। বই দুটি হলো- নেত্রকোণা মুখশ্রী এবং নেত্রকোণার লেখক পরিচিতি। রইস মনরমের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বই দুটির উকিল মুন্সীর জীবনী অংশটির বৈদ্যুতিক অনুলিপি পাঠিয়েছেন মিজান। তার থেকে নেত্রকোণা মুখশ্রীতে অন্তর্ভুক্ত পরিচিতি এখানে সরাসরি তুলে দেয়া হলো। উল্লেখ যে, আমরা উকিল মুন্সী লিখলেও এই দুই বই মতে উকিল মুনশি, লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আমরা উকিল মুন্সীই বহাল রাখলাম। এছাড়া পরবর্তীতে উপরের আলোচনায় কিছু তথ্যগত ভুল চোখে পড়েছে। যেমন- উকিলের জম্ম-মৃত্যুর সন তারিখ। এছাড়া আমাদের লেখায় বাউল শব্দটি সচেতনেই পরিহার করা হলো। যেহেতু আমাদের যাত্রা অচীন থেকে চিন পরিচয়ের দিকে, তাই কোন তথ্য সংশোধন করা হলো না।
… … … … …
এক. উকিল মুন্সী, বিরহী বাউল (১৮৮৫-১৯৭৮)
মোহনগঞ্জ, জালালপুর গ্রাম। প্রখ্যাত বাউল সাধক। বিরহী উকিল নামে পরিচিত। প্রকৃত নাম আবদুল হক আকন্দ। ডাক নাম উকিল। বাউল গানের পাশাপাশি দীর্ঘকাল মসজিদে ইমামতিও করেন। সে সময় গ্রামের মসজিদের ইমামদের সাধারণত ‘মুন্সী সাহেব’ বলে ডাকা হত। আর এ কারণেই ‘উকিল মুন্সী’ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে, ঢাকা পড়ে যায় যায় প্রকৃত নাম। জম্ম ১১ জুন ১৮৮৫ খ্রিঃ। পিতা- গোলাম রসূল আকন্দ। পিতার বাড়ি খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামে। পূর্ব-আত্মীয়তা এবং বৈবাহিকতা সূত্রে তিনি জালালপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটে। এক সময় পিতৃহারা এই ববঘুরে তরুণ আসেন মোহনগঞ্জ থানার জালালপুর গ্রামে তার চাচা কাজী আলিম উদ্দিনের বাড়িতে। উকিল মুন্সীর বাবা বোয়ালীর গোলাম রসূল আকন্দ এবং জালালপুরের কাজী আলিম উদ্দিন পরস্পর মামাত-ফুফাত ভাই। জালালপুরে এসেই তিনি গ্রামের এক সাধারণ কৃষক লবু হোসেনের অপরূপা সুন্দরী কন্যা ষোড়শী ‘লাবুশের মা’ এর প্রেমে পড়েন এবং এই প্রেম নিয়ে একটি গান রচনা করেন-
ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে, সোনার জালালপুর। সেখানেতে বসত করে, উকিলের মনচোর।
পরবর্তীকালে এই গানটি উকিলের কন্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। গান রচনার মাধ্যমে উকিল মুন্সীর এই প্রেমের কথা জানাজানি হলে আভিজাত্যের প্রশ্ন তুলে কাজী বাড়ির লোকেরা বাধা দেয়। কারণ লবু হোসেন গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ। আর উকিল মুন্সী কাজী বাড়ির ঘনিআত্মীয়। আর তাই এ অসম বিয়ে ছিল কাজী বাড়ির জন্য অপমানজনক। ফলে জালালপুর গ্রামে উকিল মুন্সীর থাকা বা যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। প্রেমে বাধা পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত উকিল কিছুদিন জালালপুরের আশেপাশে শ্যামপুর, পাগলাজোড়, জৈনপুর গ্রামে পাগলের মত ঘুরাঘুরি করেন। অবশেষে তিনি জালালপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে বরান্তর গ্রামের মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। এ সময় তিনি ইমামতির পাশাপাশি সারারাত স্বরচিত গজল গেয়ে সময় কাটান। অবশেষে ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে লাবুশের মা-এর একান্ত ইচ্ছায় এবং তাঁর পিতা লবু হোসের তত্ত্বাবধানে খুব গোপনে কাজী বাড়ির মানুষের অগোচরে উকিল মুন্সীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়েতে লবু হোসনে উকিল মুন্সীকে একটি বসতবাড়ি সহ তিন একর জমি দান করেন। কাজী বাড়ির মুরুব্বীরা শেষ পর্যন্ত এই বিয়ে মেনে নেন। আর তখন থেকেই তিনি জালালপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বিয়ের পর উকিল মুন্সী গজল রচনায় নিমগ্ন হয়ে উঠেন। ধীরে ধীরে তাঁর গানের প্রশংসা ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছুকাল পর তিনি হবিগঞ্জের প্রখ্যাত পীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তারপর থেকেই একতারা বাজিয়ে গান করতে শুরু করেন। একদিকে গ্রামের মুসল্লিদের পছন্দের ইমাম, অন্যদিকে একতারা হাতে মানুষের প্রিয় বিরহী বাউল ভাটি বাংলার গ্রামীণ সমাজে এ রকমটি ছিল এক অচিন্তনীয় ও অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু উকিল মুন্সী তার বিনয়গুণ, চরিত্র মাধুর্য, মানবপ্রেমী হৃদয়, দরাজ গলা, ভরাট ও মিষ্টি কন্ঠস্বর, সবোর্পরি তাঁর সৌম্যকান্তি অবয়ব, সঙ্গীত ও ধর্ম প্রতিভার অপূর্ব সমন্বয়ের কারণেই তাঁর জীবনে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছিল। নামাজ বা মিলাদ মাহফিল বা অন্য কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাঁর মোনাজাত শুনে ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন কেঁদেছেন- ঠিক তেমনি ভাটিয়ালি সুরে একতারাতে তাঁর বিরহ বিচ্ছেদের আর্তনাদে মুখর মরমি গান শুনেও কেঁদেছন সঙ্গীত পিয়াসী সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। তাঁর একটি বিখ্যাত গান হচ্ছে-
পিরীত ও মধুর পিরীত, পিরীত করা কি সহজ ব্যাপর। তুমি ধর গুরুর সঙ্গ, তোমার পাপে ভরা অঙ্গ, ভিতর বাহির কর পরিষ্কার।
লেখক ও চিত্রপরিচালক হুমায়ুন আহমদ এর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় উকিল মুন্সীর বিরহ ব্যথিত বাণী সমৃদ্ধ নিচের গানটি ব্যবহার করা হয়েছে-
আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি, পূবালী বাতাসে বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি, আমার নি কেউ আসে রে…..।
শরিয়তপন্থী এই মরমি সাধক তাঁর বাউল গানে শুধু একতারা ও চেটিয়া ব্যতীত অন্য কোন বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করেননি। পীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) এর জলসায় নিয়মিত অংশগ্রহণ ছাড়াও বারহাট্টার চন্দ্রপুরের পীর মোফাজল হক চিশতী, ঝিমটির চান মিয়া শাহ ফকির, পূর্বধলার লেটিরকান্দা পাগলা বাড়িসহ অত্র এলাকার বিশিষ্ট পীর-ফকিরগণ তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন। উকিল মুন্সীও তাঁদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন। বিরহ-বেদনায় হাহাকারে ভরা তার একটি গান-
বন্ধু আমার নিঃদুনিয়ার ধনরে… তোরে দেখলে জুড়ায় জীবন আমার, না দেখলে মরণ রে…।
ব্যর্থ হৃদয়ের সকরুণ আর্তনাদে ক্রন্দসিত এই গানের একটি অপূর্ব উপমা হচ্ছে, ‘চিতার অনল জ্বলে চিত্তে’। হৃদয়তন্ত্রী ছেঁড়া বিরহী উকিলের গানে এ জাতীয় অপূর্ব উপমা বাংলার লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। বিরহী উকিল তার মোনাজাতে ও গানে উপস্থিত মুসল্লি ও দর্শক-শ্রোতদের যেমন নয়ন জলে ভাসিয়েছেন- তেমনি এক অন্তর্লীন প্রার্থনায় নিজেও কেঁদেছেন অঝোর ধারায়। উকিল মুন্সী কুলিয়াটি, পালগাঁও, বরান্তর গ্রামের মসজিদে ইমামতি করেও যখনই নিজ গ্রাম জালালপুর আসতেন তখন গ্রামের মুসল্লিদের অনুরোধে এখানেও তিনি ইমামতি করতেন। কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনরা জানাজার নামাযে ইমামতি করার জন্য উকিল মুন্সীকে মনে প্রাণে চাইতেন। এমনও হয়েছে যে, বাউল গানের আসরে বিরতি দিয়ে তাঁকে জানাজার নামাজে ইমামতি করতে হয়েছে।
বাউল গানের এই তাপস পুরুষ সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তাঁর বই ও গানের বেশিরভাগেরই কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। ১৯৭৮ সালে তাঁর ছেলে বিখ্যাত বাউল আবদুস সাত্তার এর মৃত্যুর কিছুকাল পর পুত্রশোকে মুহ্যমান বিরহী উকিল মুন্সী নিজেও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দুই. এমদাদ সম্পাদিত নেত্রকোণার লেখক পরিচিতি
নতুন কোন তথ্য নাই। উকিল মুন্সী সম্পর্কে এই বইয়ের মূল্যায়ন হল-
উকিল মুন্সী নিজে ছিলেন শরীয়তপন্থী এবং নেত্রকোণার অন্যান্য বাউলদের থেকে ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি মারেফাত এবং শরীয়ত বিষয়ে অনেক গান রচনা করেছেন। নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলের মনোরম প্রকৃতি ও জলাবায়ুর প্রভাব ছিল তার গানে ও সুরে। হৃদয়ের পরশ দিয়ে ভাটিয়ালি সুরে অসংখ্য বাউলগান রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমুদ্ধ করে গেছেন।
*পড়ার সুবিধার্থে ও প্রামান্য সুত্রের অভাবে ব্যবহৃত গানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র টেক্সট দেয়া হলো। এই ক্ষেত্রে গানের গায়কীর সংগতি রক্ষা হয় নাই। আশা করছি ভবিষ্যতে উকিল মুন্সীর গানের সংকলনে এটি যথাযথভাবে রক্ষিত হবে।
কৃতজ্ঞতা:
১. রহিমা খাতুন (উকিল মুন্সীর ছেলে আবদুস সাত্তারের বউ), রাজিয়া খাতুন (উকিল মুন্সীর মেয়ে), মতিউর রহমান (কলম মেম্বার, উকিল মুন্সীর নাতনী জামাই)।
২. দুলাল কমান্ডার (উকিল মুন্সীর ভক্ত ও উকিল মুন্সী স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা।
৩. সৈয়দ মিজানুর রহমান, মোহনগঞ্জ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাকে ছাড়া উকিল মুন্সীর বাড়ির হদিস জানার আপাতত কোন পথ দেখছি না। পরবর্তীতে নেত্রকোনার লেখক পরিচিতি পাঠিয়ে সাহায্য করেছে।
৪. রইস মনরম, কবি, গীতিকার ও মোহনগঞ্জের সংস্কৃতিক সংগঠক ।
৫. হুমায়ুন আহমেদ, শ্রাবন মেঘের দিন চলচ্চিত্র ও মধ্যাহ্ন উপন্যাসের মাধ্যমে উকিল মুন্সীর নাম ও গান ছড়িয়ে দিয়েছেন।
৬. বারী সিদ্দীকী, তার গায়কীতে উকিল মুন্সীর গানের সাথে নেত্রকোনার বাইরে সাধারণ মানুষে পরিচয় ঘটিয়েছেন।
৭. তুহিন ও কামাল, হবিগঞ্জ- রিচি-র মোজাফফর আহমেদ (রঃ)-র দরবারের তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন।
তথ্যসুত্র
মৈমনসিংহ বা ময়মনসিংহ গীতিকা এবং উকিল মুন্সী সময়কার গীতি কবিদের প্রসঙ্গে:
১. টি এম আহমেদ কায়সার, শাহ আবদুল করিমের সাক্ষাৎকার, ছোট কাগজ খোয়াব, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭।
২. রশিদ উদ্দিন ও শাহ আবদুল করিমের উইকিপিডিয়া পাতা।
৩. মোজাম্মেল হক তুহিন, মুক্তচিন্তার বাউল সাধক জালাল খাঁ, দৈনিক সকালের খবর। অনলাইন লিংক: (http://www.shokalerkhabor.com/online/details_news.php?id=20568&&%20page_id=%2015)
৪. মোহাম্মদ নুরুল হুদা, মৈমনসিংহ গীতিকা প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য (দ্বিতীয় খন্ড), বাংলা একাডেমী, ২০০৭, ঢাকা, পৃষ্টা ৮০।
৫. যতীন সরকার, জালাল উদ্দীন খাঁ ও তার সঙ্গীত, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯।
৬. আলী আহাম্মদ খান আইয়োব, নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস, গতিধারা, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৯৯, ২০৬।
৭. নেত্রকোণা মুখশ্রী, প্রকাশক- নেত্রকোণা জেলা সমস্বয় পরিষদ ঢাকা, ঢাকা, ২০০৫, পৃষ্টা ৯৪-৯৫।
৮. এমদাদ খান সম্পা., নেত্রকোণার লেখক পরিচিতি, পলল প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৬, পৃষ্টা ৯৪-৯৫।