আমার প্রত্যাবর্তন

কবিতাগুচ্ছ

।। ফরহাদ মজহার ।।

প্রত্যাবর্তন: আমার জন্মদিনে

স্মৃতির আম্মা, জগৎতারিনী জননী, আমার অবশিষ্ট তোমার দ্বারে হাজির
তোমার আঁচলেই গচ্ছিত আমার ঘরে ফেরার চাবি, আমার প্রত্যাবর্তন।

শহরে রেস্তোঁরার চুল্লিগুলো নিভে গিয়েছে রাত্রে অনেক আগেই
বাড়তি তরকারিগুলো তুলে রাখা হয়েছে ফ্রিজে। কুকুরগুলো
সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষার পর ফেলে দেওয়া হাড়মাংসের আশায়
লেজ নাড়ছে বৃষ্টিতে। বিধ্বস্ত  শেষ রজনীতে ফিরে এসেছি জননী
কোথায় যাব আর? এখন ভাঙা ঘরে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে 
এসেছি তোমার কাছেই। আমার হৃদপিণ্ডটি ফেরত দাও, মা জননী।

হ্যাঁ, দেখেছি সর্বস্বান্ত মাতালকে, ক্ষীণকটি ল্যাম্পোস্টের আলোয়
নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হয়ে যাওয়া ভূখণ্ড বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে।
সাপের মতো শীর্ণ তার শরীর, যেন খোলস বদলানো পুরুষ সরিসৃপ
দেখেছি শহরকে বন ভেবে আবাস খুঁজছে মিস্টার রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

উন্নয়নের চোটে লুট হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। ভূতের মতো দাঁড়ানো
ব্যাংকগুলোর ভল্টে বাসা বেঁধেছে ইঁদুরদের গভর্নর। নিজ নিজ আবাসগুলো
পেয়ে যাচ্ছে কুট্টুসকুট, সক্কলের ঠিকানা পরিষ্কার, শুধু আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি
ঘরছাড়া উন্মূল উদ্বাস্তু নাম-সাকিন নাই। আম্মা, প্লিজ, হৃদপিণ্ড ফেরত দাও।

এই নাও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট। আমার শহিদ হওয়া লাশের হাড়গোড়
এই নাও আমার বাহাদুর আইডেন্টিটি কার্ড, সেখানে কি আমার নাম নাই?
আমি কি আমার বাবার নাম ভুল লিখেছি? কোথাও কি মায়ের বানান ভুল হোল?
কিন্তু তুমি জানো কোথা থেকে পেয়েছ আমার বীজ, হে জননী, সাক্ষী হও-
বল, কেন মুক্তিযোদ্ধা জন্ম দিয়েছিলে বাংলাদেশে? আমাকে বিসর্জন দিলে ডাস্টবিনে?
কেন আমি দ্বিতীয়বার শহিদ হলাম? কেন  নিজের গুম হওয়া লাশ আমাকে
নিজেই বহন করতে হচ্ছে? কেন আমার বক্ষভেদ করে গুলি? কেন পুলিশ?
কেন বিচার ছাড়া হত্যা? কেন মুখ সেলাই? কেন ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট?
কেন হাতুড়ি? কেন হেলমেট? আম্মা, প্লিজ আম্মা, হৃদপিণ্ড ফেরত দাও।

স্মৃতির জননী, কিভাবে এখন বাড়ি যাবো? কে বহন করবে ইতিহাসের কফিন?
কে এই দুঃসময়ে বেওয়ারিশ লাশের ভাড়া খাটবে? দোকানপাট বেচাকেনা বন্ধ
লকডাউন। শেষ রাতে পুরা শহর মনে হচ্ছে যুদ্ধে বিধ্বস্ত নগরী। শুধু আমি
বৃষ্টিতে হাঁটছি। ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে শহিদদের শোণিত। বিষণ্ণ চাঁদ
আটকে গিয়েছে মাকড়সা ও মানচিত্রে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। আমি
একটি নক্ষত্র লক্ষ্য করে গন্তব্যে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আকাশ
পুলিশের বেনজির গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে আছে। নভোমণ্ডলে ছোট ছোট গর্ত
ঝরছে জন্মদিনের রক্ত। আমি কি তোমার নাড়ি ছিঁড়ে বাংলাদেশে জন্মাইনি?

আম্মা, হৃদপিণ্ড ফিরিয়ে দে, আমি মরব।

১৬ এপ্রিল ২০২১ ।। ১০ বৈশাখ ১৪২৮।। শ্যামলী

মৃত্যু কিম্বা রতিহর্ষ

এতো কাছে পরস্পর তোমাকে শরীরে মনে পেয়ে যাচ্ছি, দারুণ শীৎকার!
এতোটা নিকটবর্তী, একের ভেতরে দুই, পাচ্ছি কিন্তু হারাচ্ছি আবার।

এত্তো এত্তো আকর্ষণ!  ফর্শা জলে বিকর্ষণ গলে নুন স্ফটিক মধূর
পান করি হলাহল, হে তরল রতিহর্ষ! হে  অমর প্রেমের ঠাকুর।

দুর্দান্ত সহবাস। বাতাসে অগ্নির শ্বাস, ঘেমে যাচ্ছি বারবার গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়  
বেহেশতি বাগান থেকে  সুপুষ্ট  গন্দম খেয়ে সদ্য যেন ফিরেছি ধরায়।

এই রাত সাগুদানা, নখের আঁচড় বসে কামাতুর বক্ষে পিঠে মুখে  
চকিতে খুরের শব্দ শুনি হে ঘোড়সওয়ার, হও সওয়ার নগ্ন বুকে।  


শাওয়াল, তোমার চাঁদ আজ যেন প্রেমের প্রাসাদ ঘিরে বসায় পাহারা
সিংহ দ্বারে সিংহী থাক, চরম শৃঙ্গার কালে নগ্ন হয়ে হবো দিশেহারা।


ছিঁড়েছি তোমারও কোর্তা। সহসা দুর্নিবার উভয়েই আবিষ্কার করেছি
প্রেমে কোন লিঙ্গ নাই, আমরা উলঙ্গ, আহ্‌, আমরা কতো নির্লজ্জ হয়েছি!

অনাদির শৃঙ্গারে ব্রহ্মাণ্ডে টংকার ,বাজিতেছে বিবাহের কামার্ত সানাই
হে শমন, আমাকে গ্রহণ কর, যার দেহ তার ঋণ যেন শোধবোধ করে যাই।

হেন রতি দণ্ড খানেকের সন্ধি,  মহাযোগ, এ মুহূর্ত মধুর হত্যার
রক্তে ভিজুক তবে আরশ ও সমূহ সৃষ্টি, দাও তবে তীব্র শীৎকার।

কামুক হরিণী আমি, নিত্যদিন কামাবেশে তোমাকেই করেছি ভজনা
হে ব্যাধ, পরওয়ারদিগার তোমার ঘাতক তীরে বিদ্ধ হব এই তো কামনা।


এই যদি তুমি তবে হে শিকারি মাসুম বালিকাটির সঙ্গে শেষ রাতে  
পর্দা বিসর্জন দিও, সত্য সে জানুক, তার কাবিন হয়েছে কার সাথে!

১৪ এপ্রিল ২০২১ ।। ৮ বৈশাখ ১৪২৮।। শ্যামলী

শিরিন

শিরিন, তোমার জন্য আমি ফের ইরানে এসেছি
ধাতুদীর্ণ যুদ্ধ শেষে ট্যাংকগুলো নষ্ট ও নিস্তেজ
জীবন্ত কেচ্ছার মতো আদিগন্ত ইতিহাস ব্যাপী
স্মৃতি ভারাতুর। আমি পাণীপ্রার্থী খসরু পারভেজ।

নিজামি গাঞ্জাভিকে বলি উস্তাদ দয়া ভিক্ষা দিন
এই বঙ্গে বাগদেবী সরস্বতী আমার বিশ্বাস
দরদে দরদী হয়ে নদী হবে ফের। খরস্রোতে
সব লাশ ভেসে যাবে। কাব্য তাই মুর্দাফরাস।

চাই আশেকানি। শুদ্ধ প্রেমে যুদ্ধে নিত্য জিতি
শিরিন শিরিন ডেকে। প্রেম আছে সর্বদাই পাশে
আছে নিকষিত হেম। কবিও প্রেমে ও পদ্যে আছে
জঙ্গী বলে মর্গে মর্গে ফেলে যাওয়া লাশের তালাশে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। জীবন্ত মুর্দা প্রেমে বাঁচে বারমাস
প্রেমই পারস্যের খোশবু, শিরিনের নিঃশ্বাস ও বিশ্বাস।

১২ এপ্রিল ২০২১ ।। ৬ বৈশাখ ১৪২৮।। শ্যামলী

প্রতিচ্ছবি

বেয়াকুব তুই, পাগল, বদের হাড্ডি বদমায়েশ
কাম লিপ্সায় শরীর নষ্ট কলিজাতে তোর ক্ষত
আছে অনুতাপ সঙ্গম স্মৃতি প্রেমনখ দিয়ে তুই
খুঁটে খুটে খেলি নিজের ময়লা চিরদিন অবিরত। 

এ গুনাহ ক্ষমার অযোগ্য, তোর দয়াভিক্ষাও ল্যাংড়া
যদি ক্ষমা করি ফের তুই গিয়ে পড়বি পাপের ড্রেনে
হুঁশ নাই, তোর বিবেক লোভের দাস হয়ে থাকে কেনা
কোত্থাও তোর স্থান নাই যারা  অন্তত তোকে চেনে!

চুলের জটার চাষবাসে বাড়ে উকুনের মহাবংশ
বেশবাসে তোর উলঙ্গপনা মুখে অবিরত খিস্তি
শয়নে স্বপনে এক বিছানায় তুই ও খবিস ইবলিস
সঙ্গমে রত দুই জনে মিলে চলছে কুস্তাকুস্তি।

ট্রাফিক পুলিশ দাজ্জাল তোর ভুল গন্তব্যদাতা
সক্কলে যেটা ঘৃণা করে তুই তাতেই পরম তৃপ্ত
দিনে দিনে তুই দুর্গন্ধের ছিদ্রে বানালি রাস্তা
ফোঁটায় ফোঁটায় মরলি, দোজখ হোল আরো পরিব্যাপ্ত।

কুসঙ্গ দোষে গলে যায় তোর ইচ্ছার মেরুদণ্ড
কবে কে শুনেছে শূয়রের পাল উঠে আসে কাদা থুয়ে
কবে কে শুনেছে বুড়ি বেশ্যার শুকনা স্তনের বোঁটা
ক্ষুধা  মেটালোনা বলে লম্পট প্রেমিকার কাছে ফেরে?

তোকে আমি তাই আরশি বানাই তুই সকলের আয়না
যেন নিজেকেও মেপে নিতে পারি তুই আমাদের বুদ্ধ
নিজেকে সতত ধোঁকা দিয়ে যাই, চোখ দুটো সমাহিত
কপট ভড়ং দেখে  যেন হই যারপরনাই ক্রুদ্ধ।

যদি তাতে কিছু নিস্তার মেলে যদি নিজে বরবাদ
হবার আগেই কিছুটা হলেও জীবনের পাই স্বাদ।

১২ এপ্রিল ২০২১ ।। ৬ বৈশাখ ১৪২৮।। শ্যামলী

গোলাপ

পাপড়ি ভর্তি কীট তবে বাচ্চাগুলা সাদা
বাগানে তবু কিলবিলিয়ে প্রজাপতির হাসি
কাঁটার ঘায়ে মরতে চাই না হুমড়ি খেয়ে ফুলে
মরছি, মরে লাশ হয়েছি, লাশ হয়েছে বাসি
ফুলের সঙ্গে আশেকানি যায় না কেন তবে!
বল্‌ গোলাপ মোরে বল্‌ তুই ফুটিবি সখী কবে?

সদাই আমি যুদ্ধক্ষেত্রে বুলেট বিদ্ধ খুলি
নিজের হৃদপিণ্ড কেটে সাজাচ্ছি তশতরি
নিত্য যিনি মেহমান, হায়, শত্রু তিনিই বটে
নিত্য তাঁর হাতেই আমি শহিদ হয়ে মরি!
আজব তোর মেহমানি কি শেষ হবে এই ভবে?
বল্‌ গোলাপ মোরে বল্‌ তুই ফুটিবি সখি কবে?

থানায় লাশের সুরতহাল রিপোর্ট লেখা নাই
মর্গে লাশ পোঁতে কি কেউ? কিম্বা মাংস পোড়ায়?
তাহলে কি মৃত্যু মিথ্যা? কেন গোরস্থানে
গোলাপ গাছ বুনছি আবার বৃষ্টি দিচ্ছি গোড়ায়
বেঁচে আছি? বাঁচব কীসের গল্পে বা গৌরবে?
বল্‌ গোলাপ মোরে বল্‌ তুই ফুটিবি সখি কবে!

বৃষ্টি পড়ছে বৃষ্টি পড়ছে  শ্রাবন প্রতিদিন
এই বৃষ্টির সাধ্য নয় কো স্নান করাবে লাশ?
আমি নিজেই নিজের লাশটি পুঁতেছি উদ্যানে
খাটছি গোলাপ সুন্দরীর ফাই ও ফরমাশ
আকাশ ডাকুক, বৃষ্টি পড়ুক বজ্রপাতেই হবে
বল্‌ গোলাপ মোরে বল্‌ তুই ফুটিবি সখি কবে!

লাশ পঁচাচ্ছি লাশ পঁচিয়ে বানাচ্ছি কম্পোস্ট
আহা আমার মৃত মধূর শহর ঢাকা ফাঁকা!
লাশের গুলিস্তানের যিনি পত্নী তিনি আমার
যত্নে শুধু হাসেন তাঁর কাফনে মুখ ঢাকা

মিনতি তুই ফুটিস নইলে অখ্যাতি তোর হবে
বল্‌ গোলাপ মোরে বল্‌ তুই ফুটিবি সখী কবে!

২২ শ্রাবণ ১৪২৪। ৬ অগাস্ট ২০১৭। শ্যামলী

নদীতে ফেলে দেওয়া লাশ


যারা আর ফিরবে না যমুনায় তাদের ছায়া ব্রিজের নীচে এসে আছড়ে পড়ে। এটা আমাদের কারণেই ঘটে কারন আমরাই দুই ভাগে বিভক্ত। কেউ চায় তারা ফিরে আসুক, আর কেউ তাদের ভুলে যেতে পারলে বাঁচে। এ দ্বন্দ্বের খবর অবিভক্ত যমুনার পানিও টের পায়। ব্রিজের তলে হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো ফিস ফিস করে, তারপর নদীর ঢেউ হয়ে যে জলে তাদের জন্ম সেই জলেই বিলীন হয়ে যায়। নদীতে গলে যেতে তাদের মোটেও বেগ পেতে হয় না। বঙ্গোপসাগর থেকে এতোদূর অবধি উজানে পাড়ি দিতে তারা পারে, কারণ সমুদ্রের লবন দিয়ে তাদের স্মৃতিগুলো তৈরি। আর কে না জানে, লবন গলে।

যমুনা কুঁকড়ে যায়, এর জন্য তার প্রস্তুতি নাই। এমনকি সে গতি পরিবর্তনের সংকল্পও করে বসে। যাতে মৃতদের সে আবার বহন করে সাগরে নিতে পারে।

এতে ছায়াগুলো খুশি। গুম হয়ে যাওয়া লাশগুলো জাতীয় সঙ্গীত গায় এবং বাংলাদেশকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলে না।

২১  শ্রাবণ ১৪২৪। ৫ অগাস্ট ২০১৭। শ্যামলী

চুপ

ফেরা কি তবুও ভাল? কিম্বা যারা ফেরে নাই তাদের মৃত্যুর গল্পগুলো
বলার জন্যই তবে ফিরে আসা? রে কংকাল, তবু তোর বিধ্বস্ত চোয়াল
আপাতত সামলে রাখ। ঠাণ্ডা ফ্রিজে জিহ্বাখানি জমা থাক হিমের আশ্রয়ে
উত্তাপের চেয়ে আজ বরফ কি ভাল নয়? চতুর্দিক হিমে বোবা শীতের উৎসব!

সত্য কিন্তু বোবা নয়। চুপ থাকা ভাষা বটে। লক্ষকোটি মিথ্যার আঁধারে
ক্ষুদ্র জোনাকিটিও যুদ্ধের সৈনিক হয়ে জেগে থাকে নিজের আগুনে
অপেক্ষায় কাল যদি কাটে, যাক। ফিরলো না যারা তবু তাদের উত্তাপে
আবার জিহ্বা জাগবে। না ফেরার গল্পগুলো বলবার যথার্থ দরকারে।

১৯ জুলাই  ২০১৭

সুন্দরবন

আজকাল প্রতিদিন সকালবেলা আমি বাঘের ডাক শুনি
সুন্দরবন মোহাম্মদপুরের এত্তো কাছে আমি জানতাম না!
বাঘ ডাকছে ঘর্ঘর ঘর্ঘর
ঘর্ঘর ঘর্ঘর
আমি জানালা খুলি।
আমার ঘর থেকে পোষা বিড়ালের দঙ্গল গুলো পালিয়ে যায়
অথচ এতোদিন ভাবতাম এরা সব বাঘের ছানা।

রাস্তায় কয়লা ভর্তি ভারী যানবাহন হুংকার করতে করতে ছুটে যাচ্ছে
ঐতো পশুর নদী!
কই যাচ্ছো নদী? কই যাচ্ছিস বেইমান পানি?
আমরা যাচ্ছি রামপাল
কালো কয়লার ধোঁয়া আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে
তবু আমি জানালা বন্ধ করি না

কারণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

জানালা খুলতেই ধোঁয়াচ্ছন্ন মোহাম্মদপুর
আমার ঘরে ঢুকে পড়তে চায়

কোথায় যাচ্ছ কয়লা ভর্তি ট্রাক? কতোদূর?
‘আমরা যাচ্ছি আকরাম পয়েন্ট’!!
দুই লেইনের রিং রোড দিয়ে
লক্ষ লক্ষ কয়লা চালিত ট্রাক আজকাল সকালবেলা
মাস্তুলে দিল্লীর পতাকা উড়িয়ে
গর্বের সঙ্গে ভেসে ভেসে যায়।

রাস্তায় ড্রেজিং চলছে
এরা কারা?

রয়েল বেঙ্গল রাগে ঘর্ঘর করে
আমি জানালার কাছে বাঘ দেখার জন্য আসি

গরান, কেওড়া ও গোলপাতার ফাঁক দিয়ে
রয়েন বেঙ্গল টাইগার ও আমি
পরস্পরের দিকে তাকাই।
পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করি।

কসম টাইগার, আমি জানতাম না
সুন্দরবন এতো কাছে!

১ অগাস্ট ২০১৭। ১৭ শ্রাবন ১৪২৪। শ্যামলী।

অপেক্ষা

কবি মাত্রই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে
কবিতায় এসে থাকেন
তাই
কোন কবিতা না লিখলেও
শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে আমরা অবতার বলি।

তবে বাংলাদেশের কবিগণ চাইলে
উনসত্তরের গণ অভ্যূত্থান ভুলে যেতে পারেন
কিম্বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
সব ভুলে গিয়ে
হিল্লি বিল্লি দিল্লি হয়ে কবিতায় আসতে পারেন।
আলবৎ পারেন। অবশ্যই পারেন
তবে
সেইসব কবিতার সবসময়
নাকে সর্দি থাকে।


সর্দি লাগা কবিতা গুলো
সদা সর্বদাই বালিকা বিদ্যালয়গুলোর মাঠে
ফ্রক পরে জাতীয় সঙ্গীত গায়
এতে কোন কাজ হয় না
এরপর কবিতাগুলো ধানমণ্ডি  বত্রিশ নম্বরে
বাদাম বিক্রি করে পড়ে থাকে।

কবিতার ঠোঙ্গা কাগজগুলো পড়ে থাকে রাস্তায়।

অথবা
কবিতার মধ্য দিয়েও আপনারা
বাংলাদেশে আসতে পারেন।

হ্যাঁ পারেন
কারন নিদেনপক্ষে একজন কবিকে খুঁজছে বাংলাদেশ
যার হাতে হাতুড়ি
কিম্বা মাথায় হেলমেট নাই।

বাংলাদেশ কবিতার অপেক্ষায়।

১ অগাস্ট ২০১৭। ১৭ শ্রাবন ১৪২৪। শ্যামলী।

লেনিন

আমার দেয়ালে এখনো লেনিনের ছবি আছে
তোমরা তার মূর্তি ভেঙে ফেলেছ।
মূর্তি ভাঙা ভাল
একদিন তোমাদের তৈরি মূর্তিগুলিও ভাঙা হবে।

কিন্তু আমি লেনিনের ছবি নামাবো না
কারন আমি কোনদিন লেনিন হতে চাই নি
আমি যা আমি তাই হতে চেয়েছি।

আমি আগেও যা ছিলাম এখনও তাই আছি
লেনিনও দেয়ালে
ঠিক যেখানে আছেন
সেখানেই থাকবেন

আমি মূর্তাপূজা করি না।


১ অগাস্ট ২০১৭। ১৭ শ্রাবন ১৪২৪। শ্যামলী

ইতিহাস

ইতিহাস হচ্ছে শেয়ার বাজার লুট করা ব্যবসায়ী
যারা জাতীয় সংসদের অনির্বাচিত সদস্য
ইতিহাস হচ্ছে বন্যার পানিতে ভাসতে থাকা বাংলাদেশে
স্থাপত্যবিদ লুই কানের চমৎকার মার্কিন স্থাপত্য।
হাওয়া আসে বাতাস যায়
বাতাস যায় হাওয়া আসে
বাংলাদেশ আসে না।


কোথায় বাংলাদেশ?
কক্সবাজারে বেড়ায়।

বঙ্গোপসাগরের পাশে ক্যান্টনমেন্ট
জলপাই রঙের পোশাক খুলে 
দাড়ি শেইভ করছেন সেনাপতি!
তিনি শান্তি মিশনে যাবেন।
হাওয়া আসে বাতাস যায়
বাতাস যায় হাওয়া আসে
বাংলাদেশ আসে না।


ঘড়িগুলো তবুও কুচকাওয়াজ করে
করতে করতে সময় ঘোষণা করে
সময়গুলো বৃদ্ধ,  অন্ধ এবং কুঁজো
তবুও সেকেন্ড মিনিট ঘন্টার কাঁটা
বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে
ইতিহাসও লাটিম
বৃত্তাকারে ঘোরে
তরুন প্রজন্মের ভীড় জমে যায়
সবাই বৃত্তাকারে ঘোরে
কেউ কাউকে আর চেনে না।
হাওয়া আসে বাতাস যায়
বাতাস যায় হাওয়া আসে
বাংলাদেশ আসে না।

১ অগাস্ট ২০১৭। ১৭ শ্রাবন ১৪২৪। শ্যামলী

জঙ্গী

তারও মা আছে
পড়াশোনার ফাঁকে
মায়ের ফরমাস মেটাতে সেও বাজারে যায়
মায়ের কাজ করে দিতে তার প্রভুত আনন্দ
বাবা সংসারের ব্যয় সামলাতে হিমশিম খান।

যে কোন গোঁফ ওঠা কিশোরের মতো
সেও বাবাকে ভয় পায়
শুক্রবারে বাবা ছেলে একসঙ্গে মসজিদে
জুম্মা পড়ে
কারন ছেলে বাবাকে আর বাবা ছেলেকে
ভালবাসে।

তারও বোন আছে
সে টুইশানির টাকা দিয়ে বোনকে
ঈদে স্মার্ট ফোন কিনে দেবে বলে
টাকা জমায়।
গতবার বোন তাকে গ্রীষ্মের ছুটিতে
নিজ হাতে উলের সোয়েটার
বানিয়ে দিয়েছিল।

তারও একটি ছোট ভাই আছে
যাকে সে কাঁধে নিয়ে বেড়াতে ভালবাসে
ঠিক, তার বন্ধু সংখ্যাও কম নয়
তাদের সঙ্গে সারাক্ষণই সে আড্ডা মারতে চায়
কিন্তু মা-বাবার ভয়ে
অতোটা পারে না।

নিম্ন মধ্যবত্ত তার ছোট্ট ঘর
অথচ বিশ্ব মানচিত্রের পুরাটাই
তার ঘর দখল করে নিতে চায়
প্যালেস্টাইন, ইরাক সিরিয়া লিবিয়া মিশর কাশ্মির
সবগুলো ভূখন্ড একসঙ্গে তার ঘরে ঢুকে পড়ে
যে কোন চিন্তাশীল তরুণের মতো
সেও নিরীহ মানুষের লাশের সংখ্যা গোনে।

ভয় পায়
একদিন বাংলাদেশও যুদ্ধক্ষেত্র হবে।

সে এখন কারাগারে
ক্রসফায়ারে নাকি এখনও দেওয়া হয় নি।


সে জঙ্গী।
পত্রিকার খবরে তাইতো পড়লাম!


১ অগাস্ট ২০১৭। ১৭ শ্রাবন ১৪২৪। শ্যামলী


চার্জশিট

আমি ভোট চোর না, টাকা লুট করি না
সুইস ব্যাংকে একাউন্ট নাই
কারো কোন ক্ষতি করি নাই।
চাষাবাদ করে খাই।
জঙ্গী না।
শুধু
গুম হয়ে যাওয়া লাশগুলো
সারা বাংলাদেশে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াই।
 
ইন্সপেক্টার জেনারেল অব পুলিশ
আমার বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ?
 কি আপনার চার্জ শিট?

১ অগাস্ট ২০১৭। ১৭ শ্রাবন ১৪২৪। শ্যামলী

আরশোলা

জীবনটা রসিকতা না
রসিকতা করে জীবন কাটিয়ে দিও না
কিন্তু রসিকতা ছাড়া জীবনের কোন মানে নাই।

জীবন পাকা কদবেলের মতো
গাছের তলায় জীবন অনেক সময়
কুড়িয়ে পাওয়া যায়।
কিন্তু তার কঠিন আবরণ ভেঙ্গে
ভেতর দেখতে হলে
দেখবে সেখানে শক্ত শক্ত পাথর
কিন্তু জীবনের রস চাই।
কারন জীবন সিরিয়াস ব্যাপার।

জীবন রসিকতা না
জীবন সিরিয়াস।

ধরো, আরশোলা।
প্রাকৃতিক বিবর্তনে
অন্য প্রাণীদের টেক্কা দিয়ে
আরশোলা দারুন বেঁচে আছে
আরশোলা সিরিয়াস প্রাণী
কিন্তু রসিক না।

জীবন নিয়ে হাজার হাজার বছর
আরশোলা কাটিয়ে দিল
কিন্তু আরশোলা
আরশোলাই  হয়ে রইল।

এতে প্রমাণিত
জীবন খুবই সিরিয়াস ব্যাপার
কিন্তু তার রস চাই।

তোমার বয়স হয়েছে
আজ তুমি একটি গাছের চারা রোপন করেছ
তুমি বেশীদিন দুনিয়ায় আর নাই
কিন্তু এই গাছ রোপন করেছ
কার জন্য?

যার জন্য
সে যখন এই গাছের ছায়ায় বসবে
তখন ভাববে আর বলবে
জীবন সিরিয়াস ব্যাপার
কিন্তু কোন্‌ রসিক বুনে গেলো এই বৃক্ষ

তার রসিকতা চমৎকার !


Share