আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আদোনীস ও আপন জগত নির্মাণ

।। শাহাদাৎ তৈয়ব ।।

কবি, সমালোচক, নাট্যকার ও অনুবাদক আদোনীসের জন্ম ১৯৩০ সালে সিরিয়ায়। মূল নাম আলী আহমদ সাঈদ হলেও তিনি আদোনীস নামেই খ্যাত। শিক্ষকতা করেন লেবাননের বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আধুনিক ও সমসাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে আরব সংস্কৃতির নাড়ির শক্তি জাগিয়ে তুলতে তাঁর পাঠ ও বিশ্লেষণ আপোষহীন। বিজ্ঞান, রাজনীতি ও সংস্কৃতির আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার যে পশ্চিমমুখি পরনির্ভরতা সেখান থেকে কবিতাকে আরব প্রকৃতির ভেতরে নিগূঢ়ভাবে যুক্ত করার দুঃসাহসিক কাজ করলেন তিনি। শুধু একা নয় সংগঠিত প্রক্রিয়ায় ঔপনিবেশিক আধুনিক সাহিত্যের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রীতিমতো আন্দোলন গড়ে তুললেন।
পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক জুড়ে মুখর হয়ে ওঠে তাঁর এ আন্দোলন। তাঁর সাথে ছিলেন কবি মুহাম্মদ আল মাগুত, ইউসুফ আল খাল সহ আরো অনেকে। নিজে লিখে প্রচার করে সচেতন করার চেষ্টা করলেন। আর কবিতায় আনলেন সহজ কথার গাঁথুনি ও গভীর বোধের বুনন। কাব্যের পুরো দেহ ও আত্মা জুড়ে প্রবাহিত করলেন ভাবরস। কল্পনার অপার রহস্য। কিন্তু কাজটি করলেন সাধারণের মুখে মুখে ভেসে থাকা শব্দমালা থেকে। লোকের মধ্যে নিহিত অভিজ্ঞতার সম্পদ থেকে। ধর্ম থেকে। উপাখ্যান থেকে। ইতিহাস থেকে। সূফী ভাবজ্ঞান, রূপকের লীলা, আধ্যাত্মিক দর্শন, নান্দনিকতার সরল সৌন্দর্য, মৌলিক কল্পচিত্র, ধর্ম আর লোকজ জ্ঞান, মৃত্যু আর জেগে উঠার গীতলতা– এরকম অসংখ্য বৈচিত্র্য-ব্যাঞ্জনা নাটকীয় ঢঙে সৃষ্টি করলেন আদোনীস। আঙ্গিকে, শব্দের বৈপুল্যে, বাক্যের অভিনব বিন্যাসে, অর্থকাতর উপমার শোভনে আদোনীসের তুলনা সত্যিই বিরল। সাহিত্যে আরবের শ্রেষ্ঠ সম্মাননা সহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। একাধিকবার সাহিত্যে নোবেলের জন্যও মনোনীত হন।
এই আলোচনাটি তাঁর ‘আশ শি’রিআতুল আরাবিয়্যাহ’ বা আরবী কাব্য প্রসঙ্গে। বইটি মূলত ১৯৮৪ সালের মে মাসে প্যারিসের দো ফরান্স কলেজে দেয়া তাঁর বক্তৃতার সংকলন। বইটির প্রথম সংস্করণ ১৯৮৫ সালে বের হয় বৈরুত থেকে। এতে ভূমিকা লিখে দেন ফরাসী কবি ও সমালোচক ইভ বনেফয় (Yves Bonnefoy) পরবর্তীতে বইটির ফরাসী ও ইরেজী সংস্করণও বের হয়।

এখানে বইটির উপর আলোচনা করেছেন শাহাদাৎ তৈয়ব। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে শাহাদাৎ তৈয়ব অনুদিত আদোনীসের কবিতার অনুবাদ সংকলন থেকে কয়েকটি কাব্যাংশ পাঠকের দরবারে পেশ করা হলো।
– সম্পাদকীয় দফতর, প্রতিপক্ষ

আদোনীস ও আপন জগত নির্মাণ প্রসঙ্গে

তুমি কি দেখেছ কোনো নারী
বহন করছে শরতের লাশ?
ফুটপাতের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে মুখ তার
বৃষ্টির সুতো দিয়ে বুনেছিল সে তার
কাপড়
এবং মানুষ
শরতের ছাইয়ের ভেতর
নিভিয়ে যাওয়া একটুকরো অঙ্গার।

(শরতের লাশের আয়না)

এক

লেখাটি শুরুর করার গোড়ার জায়গাটি হলো আরব ও আরবী কবিতা। কিন্তু সেই আলোচনার স্রোত আরব ও আরবীয় প্রবণতার মধ্যে আটকে বা গুলিয়ে যাবে না। সেখান থেকে আদোনিসের বরাতে বেরিয়ে আসবে এই বঙ্গভূমিতে। এই আসাটা নিজের মতো করে আসা। আরবের মতো করে নয়। বরং তুলনা করে নিজেকে আরো সতর্ক ও সচেতন করে তোলা এবং আজকের দুনিয়ায় আধুনিকতাকে মোকাবিলা করার অন্তত ভাষা ও কাব্যের ক্ষেত্রে একটা রাস্তা তালাশ করার চৈতন্য গঠন করা। আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলা যায়–এ লেখাটির মধ্য দিয়ে আমরা টের করবো, কী করে শুধু কবিতা একটি জনগোষ্ঠীর অন্যতম মুখপাত্র হয়ে ওঠলো। একই সাথে কবিতা ও ঐতিহাসিকতা সেই সমাজ, শ্রেণী ও মানুষের বাস্তব দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির ভেতর কী করে নতুন ভাষা, নতুন অর্থ, নতুন আকার ও নতুন মন নিয়ে হাজির হলো। বাংলা কবিতা ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার প্রাসঙ্গিকতা বিচার করে নিজের বরাতে নিজের জগত তৈরির একটি তফসীর হাজির করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আদোনীস নিয়ে বলা কথায় আগেই নিশ্চয়ই আরবের বিষয়টি পরিস্কার। আদোনীস নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনার আকারে আপনাকে তৈরি করার জন্য নিজের ভেতরের চি‎হ্ন-সংকেত আর মাল-মশলাগুলো খুঁটিয়ে দেখবার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। ফলে তাকে আরব ও আরবী কবিতার ইতিহাস পর্যালোচনায় নামতে হলো। ‘আরবী কাব্য’ বা অ্যারাবিক পোয়েট্রি তার রচিত সে পর্যালোচনারই বয়ান।

আমার একাকীত্ব কেবল আমার ও আমার আত্মার মধ্যে
আমার আছে সেই প্রশ্ন যার উত্তর নেই
দেহের ভেতর নড়ে ওঠে অন্য এক শরীর,
আন্দোলিত হয়
আমি সারাক্ষণ বিশ্বাস করি- শুধু আমিই- আমি আছি।

পর্যালোচনার শুরুটা ছিলো জাহিলী যুগের কবিতা, কবিতার ভাষা, প্রকরণ, বিষয় ও কুরআন। অতএব, ইসলামের দিক থেকে সাধারণ অর্থে কবিতা বিশেষত আরবী কাব্যকে বুঝাপড়ারও ব্যাপার আছে। একইভাবে ইসলামের আগমন কথাটার একটি জনপ্রিয় ভাষা হলো জাহিলী যুগের সমাপ্তি। এটা এক বাস্তব ঘটনা। কিন্তু এ ঘটনা বা সমাপ্তির শাঁস কথাটা এভাবেও আমরা ধরতে পারি যেমন, ইসলাম বা কুরআন সে সময়ের ঐতিহাসিক বিবদমান দ্বন্দ্ব ও শর্তগুলো মোকাবেলা করে পূর্বের অবস্থা থেকে একটি নতুন জমানা সূচনা করার আয়োজন নিয়েই হাজির হয়। এ হাজির হওয়া আদোনীসের ভাবনায় নিছকই একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়। কিম্বা এটা শুধুমাত্র কোনো ধর্মের ব্যাপার নয়। অর্থাৎ ধর্মতত্ত্বের বাইরে গিয়ে যদি দেখি তাহলে দেখবো কুরআনের জন্ম এক নতুন তরিকা, নতুন অর্থ ও নতুন প্রাণের নজরানা দিয়ে আগেকার চর্চিত ধর্মতত্ত্ব, চিন্তা, কাব্য, দর্শন ও যাবতীয় রীতি নীতি ভেঙে নতুন যুগ শুরু করার এক বিপ্লবাত্মক ঘটনা। এটি যেমন নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ভাষা নির্মাণ করেছে তেমনি কাব্য ও শিল্প-সাহিত্যের নতুন ভাব ও ভাষা নিয়ে উপস্থিত হয়। এমনকি জাহিলী আরবের সে সময়কার সবচেয়ে কর্তৃত্বশীল ধারা- কাব্য, সংগীত ও শিল্প সাহিত্যের পুরনো খোলসই শুধু খুলে দেয় নি ভেতর থেকে এক ভিন্ন আত্মা জাগিয়ে তোলে। তাহলে সেই নতুন অর্থ বা ভিন্ন আত্মার ব্যাপারটি কী? কিম্বা অন্তত সাহিত্য বলতে কাব্যের জায়গায় দাঁড়িয়ে জাহিলী যুগ বনাম কুরআনের যুগ এ দুই অবস্থার কালভেদ বা ভেদরেখা টানবো কী করে? কোন বয়ানের ভিত্তিতে? এই প্রশ্নগুলোর জবাব আমরা যেমন আদোনিসের মধ্যে বুঝে পাবো তেমনি এ জবাবগুলো অনুধাবনের ভেতর দিয়ে বাংলা কবিতার ঐতিহাসিক বিকাশ ও তার রূপ বদলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক শর্ত ও অবস্থার স্বরূপ ধরবার তুলনামূলক একটি দিগন্তও বেরিয়ে আসবে। আদোনীস তার আলোচনাকে নানান তর্ক বিতর্ক, প্রশ্ন উত্থাপন ও উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেন। তাতে কুরআন কিংবা ধর্মীয় রূপের মধ্যে কী করে দুনিয়াদারির ভাষা সম্পর্কিত ও নির্মিত হয় তার তাৎপর্যপূর্ণ নমুনা-বয়ানও খুঁজে পাওয়া যায় তার আলোচনায়। সেদিক থেকে এ দেশের আধুনিকতাকাতর কবি সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ধর্মের প্রতি হীনমন্যতায় আক্রান্ত হওয়ার মানসটাও বুঝা যায়।

দুই

খলীল আহমদ ফারাহীদি ছন্দ ও সুর তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে সকলের প্রথম নজরবিন্দু আর জাহিয ভাষা তত্ত্বের মঞ্চে বসে যেমন মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন তেমনি এইকালে আদোনীস তাদেরকে হজম করে শব্দ-ভাষা এবং ভাব ও চিন্তাকে অখণ্ড সত্তায় তৈয়ার করলেন এক নতুন বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে। তাঁর এ ব্যাখ্যা ও তফসীরের জায়গা মূলত কুরআনের ভাষা, টেক্সট, অর্থ-ভাব-মর্ম ও গঠন গুণাগুণ নিয়ে। এর ভেতর দিয়ে তিনি আরবী ভাষার কবিতা, গদ্য ও চিন্তার অনুশীলনে নতুন করে ভাববার, নতুন নতুন দরোজা মুক্ত করার বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হন। সাথে ছিলো আরবের লোকজ্ঞান। কিংবা ধর্মজ্ঞান তার লোকজ্ঞানেরই অংশ হয়ে আসে।

কুরআন জাহিলী কাব্য থেকে মৌলিকভাবে যেখানে ফারাক হয়ে যায় সেটা হলো- ভাব ও কাঠামোকে পাল্টে দেয়া। কুরআনের ভাষা পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে দেখা যায় তার প্রকৃতিই এমন যে, তার নিহিতার্থ খুবই গভীর ও নানামুখি। অসংখ্য ইঙ্গিতময়ত আর বিপুল প্রতীক ও রূপকের ভিন্ন ভিন্ন ধরন ও ভাব সমৃদ্ধ কুরআনের বাক্য ও শব্দ। প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি নতুন পাঠে নতুন সম্ভাবনা, নতুন উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় কুরআন।

কুরআন জাহিলী যুগের মুখের ভাষা বা শ্রুতিরীতি থেকে কাব্যকে প্রবেশ করালেন কলমের জগতে। কিন্তু তাতে কোনো ছেদ ঘটালেন না। ভাষার শ্রুতিময়তা আর কলমের প্রকাশকে এক অভিন্ন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যেখানে শ্রুতি আর কলমের প্রকাশ বা ভাষাকে আলাদা করে দেখা যায় না। অর্থাৎ কবি বা লেখকের ভাব-অভিব্যক্তি যেভাবে বাঙময় হয়ে ওঠে ধ্বনির মধ্য দিয়ে লিখনীর ভেতরেও তার অবিকল অক্ষুণ্নতা রক্ষায় কোনো বিঘ্ন ঘটায় না কুরআনের ভাষা কৌশল। যার বিপরীতে আমরা আধুনিক কবিতা ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখতে পাই যে, মুদ্রণ যন্ত্রের ফলে কবিতা তার স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু কুরআনের এই নিরিখকে নিছক কেরামতি বা মাজেযা হিশাবে দেখলে এর থেকে কিছুই বুঝা বা শেখা যাবে না। এখানেই সতর্ক হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। ফলে এই যে কাহিনী সেটাকে আর সাধারণ কোনো ঘটনা বলা যায় না। এক নতুন বিপ্লবের সূত্রপাত হলো এখান থেকে। কারণ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রথম আরব দুনিয়ায় দেখা গেলো তার সাংস্কৃতিক, মনোগাঠনিক ও উদ্ভাবনী শক্তির তৎপরতার শুরুটা। একই সাথে এর মধ্য দিয়ে জাহিলী কবিতা ও কুরআনের ভাষা-বক্তব্যের মাঝে মিল-অমিলের ঘটনাও ঘটে যায়। এটি যেনো এক অপরিহার্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। কারণ আরব যেখানে এসে স্থির হয়ে গিয়েছিলো তার উদ্ধার কর্তা হয়ে ওঠে কুরআন। যেন কুরআনের কোনো বিকল্প ছিলো না। কিন্তু এটা যতোটাই স্বতঃসিদ্ধ এবং নৈর্ব্যক্তিক ঠিক ততোটাই ঐতিহাসিক কর্তাসত্তা সম্পর্কিত। যা হযরত মুহাম্মদের মধ্য দিয়ে জেগে উঠেছিলো।কুরআন জাহিলী কাব্য থেকে মৌলিকভাবে যেখানে ফারাক হয়ে যায় সেটা হলো- ভাব ও কাঠামোকে পাল্টে দেয়া। কুরআনের ভাষা পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে দেখা যায় তার প্রকৃতিই এমন যে, তার নিহিতার্থ খুবই গভীর ও নানামুখি। অসংখ্য ইঙ্গিতময়ত আর বিপুল প্রতীক ও রূপকের ভিন্ন ভিন্ন ধরন ও ভাব সমৃদ্ধ কুরআনের বাক্য ও শব্দ। প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি নতুন পাঠে নতুন সম্ভাবনা, নতুন উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় কুরআন।

অবশ্য এই আলোচনা মোটেও কুরআনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত নয়। এখানে অনুসন্ধানের বিষয় হলো কুরআন কি আসলে আরব মন ও তার ভাষার পরিবর্তিত ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে? এসব পাঠ ও অনুসন্ধানে আরো টের করা যাবে, কী করে সবার অলক্ষে কুরআনের ভেতর দিয়ে আরবের নানান কারিগররা নিজেদের ভাষা ও ভূমিকা তৈয়ার করলেন। যেমন- আবু যায়দ আল কারশীর কবিতা সংকলন, জারীর, ফারযদাক, আবু যায়দের বিতর্কমূলক কবিতা, আশনানদানীর কবিতার অর্থ ও ভাব এবং আবু হেলাল আল আসকারীর কবিতার নির্মাণ, শিল্প-সৌন্দর্য ও এর গঠন সম্পর্কিত গ্রন্থগুলোতে কুরআনের কাব্য গুণাগুণ এবং জাহিলী কবিতার সমন্বিত রূপ ধরা পড়ে।

সড়ক কি নারী?
দুঃখ পেলেও সে আলহামদুলিল্লাহ বলে
কিংবা ইশারায় ফুটিয়ে তোলে ক্রুশের ছবি
তার উঁচু স্তনের নিচে
অচিন অসহায় কুজোঁ হয়ে আছে অন্ধকার

(বৈরুতের দর্পন)

এই পাঠ থেকে দুটি বিষয়ে কুরআনের মৌলিক অবদান চিহ্নিত করা যায়:

১.

কুরআন প্রথমেই একটি পদ্ধতি তৈরিতে তৎপর হয়। যেখানে আমরা দেখবো তার প্রথম কাজ হয়ে ওঠে লিখন রীতিতে আরবের একটি বিশেষ তরিকা নির্ধারণ করা একই সাথে আরবী কবিতার গোড়ায় এবং এর খুঁটিতে যেসব উপাদান রয়েছে সেগুলোকে নির্ণয় করে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করা। আসলে এই তরিকার ভাষা পর্যালোচনা ও গঠন শনাক্ত করেই কুরআনের টেক্সট ও তার গতিশীল বয়ান নিজের অভিমুখে ধাবিত হয়।

২.

এরপরের অবদান হলো- কুরাআন আরবী কবিতা বা আরবী ভাষা চর্চার গতিমুখ একেবারে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং জাহিলী যুগের মৌখিক কাব্যরীতি থেকে আরব মন, চিন্তা ও তার ভাষা অনুশীলনকে লেখালিখি, বই ও সচেতন সৃজনশীলতার অবারিত পথে নিয়ে আসে।

এই পাঠোদ্ধারের অভিজ্ঞতায় আমাদের সামনে আরো দুটি টেক্সট হাজির হয়। একটি- কুরআনের টেক্সট, যা ধর্মের উপস্থাপনে ধরা দেয়। এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো- ইসলাম যে ধারাবাহিকতায় এসেছে, তার আগেকার ধর্মগ্রন্থগুলোর ভাষা, চিন্তা, বক্তব্য ও বলবার ধরনের দিক থেকে কুরআন সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে মৌলিক রূপে নিজেকে হাজির করে। ধর্ম অর্থাৎ ইসলামকে নতুন চিন্তায়, দর্শনে, নতুন ভাষায় পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসে। দ্বিতীয় হলো- জাহিলী আরব কবিতার ভাষা ও রূপ থেকে বেরিয়ে আসা। এটি নিশ্চয়ই জাহিলী কবিতার রূপ নয়। নতুন রূপে প্রকাশিত হয় আরব কবিতা। যার মূলে কুরআন মানুষের প্রাকৃতিক মন, উৎপাদনমুখি কাতরতা, অর্থব্যঞ্জনা, নাগরিকতার বাইরে বেদুইন বা আদি আরবের বিশুদ্ধতা, মৌলিকত্ব, অকৃত্রিমতা ও স্বভাব ভাবুকতার শক্তি গেঁথে দেয়। এই বিশ্লেষণে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, আরব মানসের সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক তৎপরতার ভিত্তিপাটাতন ও ভবিষ্যত নির্দেশক হয়ে ওঠে কুরআন।

ফলে দেখা যাচ্ছে আদোনীস কুরআনকে তাঁর নিজেরই অর্জন বলে বিশ্বাস করছেন। শুধুমাত্র সেক্যুলারিজমের দোহাই দিয়ে নিজের ইতিহাসকে অস্বীকার করার যে সুযোগ নেই, একজন খাঁটি দুনিয়াদার লোকবাদি মানুষ হিশাবে আদোনীস থেকে এ শিক্ষাটা আমরা পাই। ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঐতিহ্য সম্পর্কে বাংলাদেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের অবস্থান একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে। তাদের চিন্তায় কেবল একাত্তরেই এ জাতি বিশুদ্ধ স্বাধীনতা লাভ করে। কারণ এর আগের ইতিহাস ধর্মের ইতিহাস ছিলো, ‘সাম্প্রদায়িকতা’র ইতিহাস ছিলো। অতএব সেক্যুলার হতে হলে ‘ধর্মে’র সংশ্লিষ্ট ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে মুক্ত হতে হবে। তবে সেটা আবার সাধারণ অর্থে নয়, বিশেষ অর্থে কেবল একটা ধর্মের বেলায়। সেটা যে নিজেরই কামাই করা, নিজেরই সত্তাকে তৈরি করার ব্যাপার ছিলো সেটাকে অবশ্যই অস্বীকার করতে হবে। মুছে দিতে হবে। আসলে এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক সচেতন সিদ্ধান্ত এবং বিবর্তনের ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হয় মাত্র। সেই রূপান্তরের ঐতিহাসিক চি‎হ্নগুলোকেই অস্বীকার করা হয়; ‘ধর্মতান্ত্রিকতা’ থেকে সাফসুতরো হয়ে কাল্পনিক ধর্মনিরপেক্ষ সাজার প্রতিক্রিয়াশীল প্রকল্পে। ইওরোপের অভিজ্ঞতার সাথে মিল কিংবা বুনিয়াদি অর্থে এরা আদৌ সেক্যুলার? এই গোমরও ফাঁক হয়ে গিয়েছে। কারণ ধর্মের বিরোধীতার নামে কেবল ইসলামের বিরোধিতা?। ইসলাম থেকে মুক্ত হওয়াই বাংলাদেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাধনা–নিশিদিন ঘৃণার আগুন জ্বলে মনে। একইভাবে এখানকার নানান কিসিমের বামপন্থার সাংস্কৃতিক বীক্ষা ও শিক্ষা বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের থেকে মোটেই আলাদা কিছু নয়। এক্ষেত্রে প্রশ্নহীনভাবে একে অপরের দেহ তুলে ধরে সংস্কৃতির দেবালয় বানিয়েছে! আদোনীস থেকে আরেকটি বিষয়ে এখানকার আধুুনিক ও সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের শিক্ষার বিষয় আছে। সেটা হলো ধর্ম আর ধর্মতত্ত্ব এক জিনিস নয়। ফলে ধর্মতত্ত্বের পর্দার ভেতরে থেকে ঐতিহাসিকভাবে মানুষের যে ভূমিকা দেখা যায় সেটাকে আলাদা করে দেখতে হবে। দুটোকে এক মনে করলেই বিপদটা দেখা দেবে। সব গুলিয়ে যাবে। সবকিছুই তখন ধর্মতত্ত্বের নামে দেখা হবে। এখানে অবশ্যই সতর্ক থাকার ব্যাপার আছে। সুতরাং আদোনীস কুরআনের ভাষা ও ভাবের গঠন সম্পর্কে যে আলোচনা হাজির করেছেন তাতে তাঁর সম্পর্কে অবাক হওয়ারও কিছুই থাকবে না। এই নির্মোহ পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে তিনি আসলে তাঁর কাজটাই সেরে ফেললেন। সামনের আলোচনায় এটি আরো পরিস্কার হয়ে উঠবে।

…কবি বা লেখকের ভাব-অভিব্যক্তি যেভাবে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ধ্বনির মধ্য দিয়ে লিখনীর ভেতরেও তার অবিকল অক্ষুণ্নতা রক্ষায় কোনো বিঘ্ন ঘটায় না কুরআনের ভাষা কৌশল। যার বিপরীতে আমরা আধুনিক কবিতা ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখতে পাই যে, মুদ্রণ যন্ত্রের ফলে কবিতা তার স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কুরআনের এই নিরিখকে নিছক কেরামতি বা মাজেযা হিশাবে দেখলে এর থেকে কিছুই বুঝা বা শেখা যাবে না। এখানেই সতর্ক হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। ফলে এই যে কাহিনী সেটাকে আর সাধারণ কোনো ঘটনা বলা যায় না। এক নতুন বিপ্লবের সূত্রপাত হলো এখান থেকে। কারণ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রথম আরব দুনিয়ায় দেখা গেলো তার সাংস্কৃতিক, মনোগাঠনিক ও উদ্ভাবনী শক্তির তৎপরতার শুরুটা। একই সাথে এর মধ্য দিয়ে জাহিলী কবিতা ও কুরআনের ভাষা-বক্তব্যের মাঝে মিল-অমিলের ঘটনাও ঘটে যায়। এটি যেনো এক অপরিহার্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। কারণ আরব যেখানে এসে স্থির হয়ে গিয়েছিলো তার উদ্ধার কর্তা হয়ে ওঠে কুরআন…

তিন

এই পর্বে আরবী কবিতার তিনটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা হবে। একটি কাব্য সমালোচনা, দ্বিতীয়টি- নাহু-ছরফ (কারক চি‎হ্ন, বাক্যে শব্দের অবস্থান ও বাক্যের গঠন এবং শব্দের রূপান্তর সম্পর্কিত শাস্ত্র), অলংকার, ভাষাতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব ও অর্থশাস্ত্রের উপর দাঁড়ানো ভাব ও জ্ঞান প্রক্রিয়া এবং তৃতীয়টি- দার্শনিক জ্ঞান প্রক্রিয়া সম্পর্কিত আলোচনা।

আদোনিসের এ তিনটি পয়েন্টের পর্যালোচনার নজরবিন্দু ভাব ও কর্মের আলাদাকরণের মতো চিন্তা ও কাব্যের আলাদাকরণ। নিচের আলোচনায় আমরা সে দিকটিই বুঝবার চেষ্টা করবো। বাংলা সাহিত্যে বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতার নামে পশ্চিমের গোলামী করতে গিয়ে যে কাণ্ডটা ঘটেছে সেটাও পরিস্কার হয়ে যাবে। লক্ষ রাখার বিষয় হলো, এই আলোচনাটি আদোনীসের একটি বইয়ের পাঠ পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে যেকারণে এখানে সবকথা আলাদাভাবে বলা সম্ভব না। কিন্তু আদোনীসকে পাঠ করার সুযোগে নিজের দিকে তাকাবার একটা চেষ্টা নিয়ে কিছু বলার মওকা নেওয়া।

আমি হয়ে গেছি আয়না:
প্রতিটি বস্তুই প্রতিফলিত করেছি, ভাসিয়ে তুলেছি
তোমার আগুনের ভেতর আমি বদলে দিয়েছি পানি এবং উদ্ভিদের প্রথা
বদলে দিয়েছি কন্ঠ আর ধ্বনি রূপ

(প্রাচ্যের বৃক্ষ)

প্রথমত আদোনীস আরবী সাহিত্যে কাব্য সমালোচনার সনাতন এবং কর্তৃত্বশীল ধারার নীতি ও পদ্ধতিগত অবস্থান আলোচনা করেন।

জাহিলী কিংবা প্রাচীন আরবী কবিতাই দৃষ্টিভঙ্গির বরাতের দিক থেকে এধারার মূল পাটাতন। যা আধুনিক ও সৃষ্টিশীল কবিতার মূল্যায়ন ও বিচারের একমাত্র মানদণ্ড আকারে অনুসরণ করা হয়। জাহিলী কবিতার ধারণা ও ভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে যে কোনো কবিতার টেক্সটই প্রত্যাখ্যানযোগ্য। শুধু ধারণাগত দিক থেকেই নয় বরং আরবী ক্ল্যাসিক কাব্যের আঙ্গিক, রীতি ও পদ্ধতিরও খেলাফ হলে তা গ্রহণগোগ্য নয় বলে বিবেচিত হবে। এ নীতিগত অবস্থানের ফলে তাদের সমালোচনায় কবি আবু তাম্মাম, আবুল আলা আল মাআরী ও মুতানাব্বী উপেক্ষিত হন। কারণ তাদের কবিতায় চিন্তা ও বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। অভিযোগটা হলো, আঙ্গিক বা কাব্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তা ও বিষয়ই হয়ে ওঠে তাদের কবিতা। একই সাথে দর্শন ও ভাবের অতি প্রাবল্য থাকায় তাদের কবিতা দুর্বোধ্য ও রহস্যময় হয়ে ওঠে। এমনকি প্রাচীন শ্রুতিরীতি ও কাব্যভাষার বিপরীত হওয়ায় তাদের কবিতা দ্বিমুখি অর্থ, জটিলতা, দুর্বোধ্যতা ও প্রতীক-রূপকের পিচ্ছিলতায় বিমূর্ত কবিতার কাতারে শামিল করা হয়। সাথে সাথে কবিতা ও চিন্তা বা বিষয়ের প্রতি পক্ষপাত ছিলো তাদের কবিতার সাধারণ স্বভাব। যা কবিতার ভাষা ও আঙ্গিকের তুলনায় খুবই কম গুরুত্ব পায়। ফলে সমালোচক এবং ঐতিহাসিকদের কাছে জাহিলী কবিতা নিছক আবেগ, সংবেদনা, গীতিময়তা ও অলংকার সর্বস্ব হওয়া সত্ত্বেও যতো জ্ঞান, রহস্য, ইংগিত ও চিন্তার উৎস হিশাবে একতরফা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট শৈল্পিক কাঠামো, বহিরাবরণ, নান্দনিকতা ও শাব্দিক বর্ণনা ভঙ্গির উপর দাঁড়ানো প্রাচীন আরবী কবিতা দুই খলীফার পরবর্তী যুগে আবার ফিরে আসতে শুরু করে। জাহিলী কবিতাই তখন কবিদের একমাত্র আরাধ্য হয়ে ওঠে ভাষা, অলংকার ও আঙ্গিকের দিক থেকে। এখানে স্মরণ রাখার বিষয় হলো, ইসলামের শরীয়াপন্থীদেরও অভিযোগ ছিলো আরবী কবিতা আবার জাহিলী যুগে ফিরে যাচ্ছে। তাদের এই উদ্বেগের ভিত্তি ছিলো নিছক জাহিলী নীতি, নৈতিকতার ফিরে আসার সমস্যা। কিন্তু আদোনীসের প্রশ্ন হলো, সামগ্রিক বিষয়। বিশেষত কবিতার ভাব ও কাঠামোর দিক থেকে জাহিলী চর্চার প্রাদুর্ভাব। এমনকি পুরনো ধারা নতুন করে ফিরে আসার মধ্যে কোনো রকম হেরফের ঘটে নি। খুব ব্যতিক্রমভাবে ফিরে আসে নি। শুধুমাত্র সমসাময়িক নানা ঘটনার আঁচটুকু প্রতিফলিত হয়–তাতে কোনো নতুন বেদনা, যন্ত্রণা, নতুন জানান অথবা ভিন্ন কোনো অর্থ তৈরি বা তৈরির কোনো রকম ইংগিতও দেখা যায় না। অথচ কুরআনের মধ্য দিয়ে যে ভাব-অভিমুখ বা বিচিত্র সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে যে রাস্তায় হাঁটা শুরু করছিলো মধ্য যুগের কবিরা এর ফলে আরবী কবিতাকে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে হয়েছে। কিংবা সে সময় কুরআন ছাড়াও লোকজ্ঞানের আরো কাঁচামাল ছিলো যা আশ্রয় করে তারা নতুন পথ তালাশ করতে পারতো। কিন্তু তারা ধর্মতত্ত্বের উপর খাড়া হওয়া এমন এক জ্ঞান প্রক্রিয়া ধারণ করলো যা আদতেই চিন্তা ও কাব্যকে ফারাক করে ফেলে। ধর্মতত্ত্ব যে স্থির ও শ্বাশত মানদণ্ড নির্দেশ করে এবং যে ধ্বনি বা শ্রুতিরীতির দৃষ্টিভঙ্গিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় তার মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠে সেসব কবি ও সমালোচকরা। তাদের একমাত্র গুরুত্ব ও তাৎপর্যের মনোভূমি হয়ে ওঠে ধর্মতত্ত্বের বাতলানো তরিকা অথবা প্রচলিত ধর্মতত্ত্ব বাদ দিলেও তারা যা করতো সেটা ধর্মতত্ত্ব ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। একইভাবে তাদের আরেকটি ঝোঁক ছিলো যেটাকে দার্শনিক বলা যায়। আগাপাশতলা দার্শনিক বটে কিন্তু তাতে আর কবিতা থাকলো না। ধর্মতাত্ত্বিক ও সমালোচনাবাদী জ্ঞানপ্রক্রিয়ার সাথে সাথে যে দার্শনিক ভাষা তাদের মধ্যে উঁকি দিলো সেটা একই অর্থে এমন এক জ্ঞানতত্ত্বের জন্ম দিলো যার সাধারণ ভূমিকা হয়ে ওঠে কবিতা থেকে চিন্তাকে আলাদা করে ফেলা। তাহলে এর ভেতর কবিতা বা শিল্প যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় সেখানে তাদের চৈতন্য ও জীবন যাপনের মধ্যে দ্বৈতবাদের চেহারা পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব বিচ্ছিন্নতাবোধক নানান পরিভাষা ও ভাবকাঠামোর অধীনে তাদের দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড সক্রিয় থাকে। কিন্তু নিছক অলংকার ও নন্দন কাঠামো দিয়ে কবিতায় সত্যের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। ধর্মতত্ত্বের মধ্য দিয়ে আরো বেশি দেহ সর্বস্ব হয়ে ওঠে কবির চিন্তা ও কবিতা। সেখানে এর গতি মারাত্মকভাবে থেমে যায় এবং স্থির হয়ে যায়। একই রকমের সীমাবদ্ধতার মধ্যে কবিতার বসবাস আটকে থাকে।

কিন্তু নতুন রূপে নতুন অর্থে নতুন সম্ভাবনায় কবিতার যে উল্লম্ফন এই স্থির প্রক্রিয়ার মধ্যে সেটা সম্ভব নয়। এটা ধর্মের দিক থেকে কিংবা দর্শনের দিক থেকে হোক তাতে একই ঘটনাই ঘটবে। দর্শনের দিক থেকে কথাটা একারণে যে, কবিতার ক্ষেত্রে সে সময় যে দার্শনিক ধারা গড়ে ওঠে সেখানে ধর্মতত্ত্বের মতোই দর্শন হাজির হয়। ধর্মের উপস্থিতি যেভাবে হয়েছে তার উল্টো করতে গিয়ে দর্শন বুদ্ধি সর্বস্ব হয়ে ওঠে। ফলে একই রকম সংকট তৈরি হয়। শুধু অবস্থানগত পার্থক্য। কিন্তু পদ্ধতির দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। এ উভয় ধারাই কবিতাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ধর্ম আকার সর্বস্ব হয়ে প্রাণ থেকে আলাদা করে দেহকে গ্রহণ করে ঠিক একইভাবে দর্শন ধর্মের এ অবস্থানের বিরোধিতা করতে গিয়ে উল্টোভাবে ভাবসর্বস্ব হয়ে দেহ থেকে আলাদা করে শুধু আত্মাকে গ্রহণ করে। তবে দর্শনের এ চর্চাটা স্থির ছিল না। এক জায়গায় আটকে থাকে নি। এক সময় বেরিয়ে যাবার তাগিদ অনুভব করে।

ধর্ম সাধারণত ভাবপ্রবণ হয়। বস্তু সর্বস্ব হওয়ার চেয়ে ধর্ম ভাবকে আপন করে নিতে পারে সহজে। এটাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। কিন্তু আরবী কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই উল্টা। এটা এক অদ্ভূত ঘটনা। আরবী কবিতা যেভাবে ইসলাম পরবর্তী সময়ে বিকশিত হয়েছে সেখানে কবিতার আঙ্গিক, ছন্দ কাঠামো, অলংকারের প্রয়োগ, শব্দ বিন্যাস, বাক্য গঠন ও কাব্য প্রকরণ ও রীতি প্রবলভাবে প্রাধান্য পায়। বিষয়ের দিকে সেভাবে নজরটা জোরদার হয়ে ওঠে নি। ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে এটাই ছিলো ভাববাদী মানসের ফলাফল। কিন্তু ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিষয় এবং আঙ্গিক উভয়ের দিকেই মনোযোগ থাকলেও উল্লেখযোগ্য কোনো নিশানা তৈরি হয় নি। তারপরও সেটা ছিলো জাহিলী চৈতন্যকে মোকাবেলা করার তাগিদে। এ প্রচেষ্টা একটা মৌলিক ও ইতিবাচক পরিবর্তনের ইশারা তৈরি করে। পরে এই অভিমুখ থেকে কোনো সিলসিলার চলন দেখা যায় নি।

ইসলামের শরীয়াপন্থীদেরও অভিযোগ ছিলো আরবী কবিতা আবার জাহিলী যুগে ফিরে যাচ্ছে। তাদের এই উদ্বেগের ভিত্তি ছিলো নিছক জাহিলী নীতি, নৈতিকতার ফিরে আসার সমস্যা। কিন্তু আদোনীসের প্রশ্ন হলো, সামগ্রিক বিষয়। বিশেষত কবিতার ভাব ও কাঠামোর দিক থেকে জাহিলী চর্চার প্রাদুর্ভাব। এমনকি পুরনো ধারা নতুন করে ফিরে আসার মধ্যে কোনো রকম হেরফের ঘটে নি। খুব ব্যতিক্রমভাবে ফিরে আসে নি। শুধুমাত্র সমসাময়িক নানা ঘটনার আঁচটুকু প্রতিফলিত হয়–তাতে কোনো নতুন বেদনা, যন্ত্রণা, নতুন জানান অথবা ভিন্ন কোনো অর্থ তৈরি বা তৈরির কোনো রকম ইংগিতও দেখা যায় না। অথচ কুরআনের মধ্য দিয়ে যে ভাব-অভিমুখ বা বিচিত্র সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে যে রাস্তায় হাঁটা শুরু করছিলো মধ্য যুগের কবিরা এর ফলে আরবী কবিতাকে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে হয়েছে। কিংবা সে সময় কুরআন ছাড়াও লোকজ্ঞানের আরো কাঁচামাল ছিলো যা আশ্রয় করে তারা নতুন পথ তালাশ করতে পারতো। কিন্তু তারা ধর্মতত্ত্বের উপর খাড়া হওয়া এমন এক জ্ঞান প্রক্রিয়া ধারণ করলো যা আদতেই চিন্তা ও কাব্যকে ফারাক করে ফেলে। ধর্মতত্ত্ব যে স্থির ও শ্বাশত মানদণ্ড নির্দেশ করে এবং যে ধ্বনি বা শ্রুতিরীতির দৃষ্টিভঙ্গিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় তার মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠে সেসব কবি ও সমালোচকরা।

এই একতরফা অবস্থার আরেকটি কারণ হলো- কুরআন থেকে বালাগাত বা অলংকার ও ব্যাকরণ শাস্ত্র যেভাবে ব্যাপকভাবে বিকশিত হয় ঠিক সেভাবে আরবী কবিতার বিকাশ ঘটে নি। কিছু কাজ হয়েছে বাক্য বা অর্থ শাস্ত্র নিয়ে কিন্তু সেটার উপর ভিত্তি করে আরবী ভাষায় বিশেষ কোনো সংগঠিত পরিবর্তন বা এর কোনো প্রভাব পড়ে নি। ফলে উল্টা একতরফাভাবে যে চরম বিকাশ হয়েছে অলংকার শাস্ত্রের তার মারাত্মক একটা প্রভাব পড়ে আরব চিন্তা চর্চা, কাব্য ও শিল্পের জগতে। কবিতা তখন হয়ে ওঠে অলংকার সর্বস্ব। আকার সর্বস্ব। এ ধারণা আগলে নিয়েই দ্বৈতবাদী সমালোচকগোষ্ঠী সংগঠিত হয়। এতোসবের মধ্য দিয়েও তখন যারা ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের খণ্ডবাদী ধারাকে মোকাবেলা করে মাথা সিধা করে দাঁড়িয়ে যান তাদের মধ্যে ছিলো আবু নুয়াস, আবুল আ’লা আল মাআ’রী, আন নাফারী, আবু তাম্মাম ও মুতানাব্বী কবি প্রমুখ। আর তাদের মুখোমুখি ছিলো বিপক্ষ সমালোচকগোষ্ঠী। তারা যে জায়গায় খাড়া হয়ে উল্টো স্রোতে চলতে শুরু করেন সে মোকাবেলার জায়গাটি হলো- কর্তা ও কর্মের একবাদী অখণ্ড ধারা। যেখানে আপাত বস্তু ও ভাবের, উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের বিভাজনকে অতিক্রম করে যাবার এক নতুন প্রস্তাবনা নিয়ে তারা আরব চিন্তার জগতে মজবুত হয়ে উঠেন। প্রথম দিকে তাদেরকে সূফী, আত্মাবাদী বা ভাববাদী বলা হতো। কবিদের সারিতে তাদের প্রবেশাধিকার ছিলো না। অলংকারের বালাই ছিলো না তাদের কবিতায়- এছিলো তাদের দোষ। এই অভিযোগ আসলে কতোখানি সত্যি সেটা আল্লাহই মালুম। ফলে শতকের পর শতক তারা আলোচনায় ছিলো না। সাহিত্যের ইতিহাসে ছিলো না। নতুন করে আধুনিক জমানায় আরবী সাহিত্যের ইতিহাস রচনার প্রেক্ষাপটে তারা নানান সমালোচকের চোখে গুরুত্বের সাথে ধরা পড়ে। যদিও নাফারী সাহিত্যের ইতিহাসে এখনো বলা যায় অনুপস্থিত। তবে এখনো পর্যন্ত তাদের চিন্তা ও মানসকে যে ভাষায় তুলে ধরা হয় তাতে তাদেরকে ভাববাদী, আত্মাবাদী, সূফীবাদী, নৈরাশ্যবাদী এবং কখনো বস্তুবাদী কথনেই পর্যবসিত করা হয়।

ধর্ম সাধারণত ভাবপ্রবণ হয়। বস্তু সর্বস্ব হওয়ার চেয়ে ধর্ম ভাবকে আপন করে নিতে পারে সহজে। এটাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। কিন্তু আরবী কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই উল্টা। এটা এক অদ্ভূত ঘটনা। আরবী কবিতা যেভাবে ইসলাম পরবর্তী সময়ে বিকশিত হয়েছে সেখানে কবিতার আঙ্গিক, ছন্দ কাঠামো, অলংকারের প্রয়োগ, শব্দ বিন্যাস, বাক্য গঠন ও কাব্য প্রকরণ ও রীতি প্রবলভাবে প্রাধান্য পায়। বিষয়ের দিকে সেভাবে নজরটা জোরদার হয়ে ওঠে নি। ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে এটাই ছিলো ভাববাদী মানসের ফলাফল। কিন্তু ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিষয় এবং আঙ্গিক উভয়ের দিকেই মনোযোগ থাকলেও উল্লেখযোগ্য কোনো নিশানা তৈরি হয় নি। তারপরও সেটা ছিলো জাহিলী চৈতন্যকে মোকাবেলা করার তাগিদে। এ প্রচেষ্টা একটা মৌলিক ও ইতিবাচক পরিবর্তনের ইশারা তৈরি করে। পরে এই অভিমুখ থেকে কোনো সিলসিলার চলন দেখা যায় নি।

সেসময় ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান ছিলো এক চির শাশ্বত বিশ্বাসের সত্যের নিশ্চিতি প্রমাণ করার স্থির চিন্তার দিকে এবং দর্শন ছিলো ক্রমাগত স্পষ্টতা, নিশ্চিতি ও অনুসন্ধানের জগত খোঁজার দিকে। একই সাথে এ দুই জ্ঞান প্রক্রিয়ার আরেকটি প্রবণতা ছিলো ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয়। এ দুইয়ের মধ্যে যে সংকটের প্রশ্ন ছিলো তার মোকাবেলার জবাবই মূলত হাজির করেছিল আল মা’আরী, নাফারী, নুয়াস ও মুতানাব্বী। ধর্মতত্ত্বের আইনী বৈধতা ও নিষিদ্ধতার সীমা মোকাবেলা, মৃত্যুর মোকাবেলা, সন্দেহ ও নৈরাশ্য মোকাবেলা, সমাজের নানান শ্রেণীর আশরাফ-আতরাফের ফেরে পড়ে গড়ে ওঠা নিচু শ্রেণীর হীনমন্যতার মোকাবেলা, খুদি শক্তির বিকাশ, ধর্মতত্ত্ব ও বিবদমান ক্ষমতা চর্চার ভরকেন্দ্রের ধারণাগত শক্তিকে মোকাবেলার নানা প্রশ্ন তাদের কবিতায় হাজির হয় প্রবলভাবে। সমসাময়িকতার বিদ্যমান ধারায় রচিত না হওয়ায় এবং সমালোচকদের বিরোধিতাসহ নানাভাবে উপেক্ষিত হওয়ায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় দীর্ঘকাল। এর আরেকটি কারণ হলো তাদের এসব প্রশ্নের মর্ম ধরার জন্য বিদ্যমান জ্ঞানপ্রক্রিয়া প্রস্তুত ছিলো না কিংবা সমাজ মানসে উপযুক্ত শর্ত হাজির ছিলো না। তদুপরি তাদের কবিতা ছিলো রূপক, প্রতীক ও নিরাকার জ্ঞানের সাকার ভাষায় সমৃদ্ধ। ফলে

চিন্তার দিক থেকে তাদেরকে ভাববাদী বা সূফীবাদী যে নামেই ডাকা হোক না কেন তারা যে কাজটি করে গিয়েছেন সেটা ছিলো আরবী কবিতা ও চিন্তার জগতে এক বিপ্লবী ঘটনা। কবিতার আঙ্গিক, ছন্দ, অলংকার, ভাব-ভাষা সব দিক থেকেই ইতিপূর্বেকার ও তাদের সময়কার বিবদমান ধারাকে পুরা পাল্টে দেন। বস্তুত নতুন আরবী কাব্য ও সাহিত্যের যুগ তাদের হাতেই তৈরি হয়। পরবর্তীকালে যে আধুনিক আরবী কাব্যের ইতিহাস আমরা পড়ি এর প্রায় অধিকাংশই ঔপনিবেশিক আরবী কাব্য ও সাহিত্যের ইতিহাস। সেটা মর্মের দিক থেকে ঠিক আরবী কাব্যের ইতিহাস না।

তাহলে এই আলোচনায় এই কথাটি খুবই পরিস্কার যে, শুধুমাত্র নন্দন ও অলংকার সর্বস্ব কবিতা দিয়ে কিংবা কবিতাকে চিন্তা ও আঙ্গিকের মধ্যে ছেদ ঘটিয়ে আগানো যায় না। কিন্তু এই চর্চা আজকে আধুনিকতার নামে এখনো কর্তৃত্বপরায়ণ। নিজের ঐতিহাসিক বিবর্তনের স্বভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ত্রিশের দশকের কবিরা যে কাব্য ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিলো সেখান থেকে বাংলা কবিতার এখনো নাজাত ঘটে নি। ফিরে তাকাতে পারে নি তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার ঐতিহাসিক চিহ্নগুলোর দিকে। উৎসগুলোর দিকে। সে অভিজ্ঞতার খাঁচায় যেমন সৈয়দ সুলতান, কৃষ্ণদাস কবিরাজ বন্দী তেমনি সহজ করে কাব্য চর্চার জালালুদ্দীন খাঁ ও আব্দুল হালিম বন্দী। শুধু দর্শন বা ভাবের কারণেই আল মা’আরী ও নাফারী আরবী কবিতায় উপেক্ষিত হন নি। নাফারী ও জন্মান্ধ মা’আরী ছিলো নিম্ন বর্গের। ফলে সে সময়ের শিক্ষিত ও শাসক শ্রেণীর কবিদের তোপে তারা বরাবরই উপেক্ষিত হন। এই একই চিত্র আমাদের এখানেও ঘটে যায়। শুধু ভাষা আর ভূগোলের পার্থক্য। আর কোনো পার্র্থক্য নেই। আদোনীস সেদিকটায় সতর্ক হবার জন্যই আমাদের সামনে আঙুল তুললেন। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্মাণ করার মালমশলা আপনকার মাটিতেই খুঁজতে হবে- এই বোধে তাড়িত হয়ে আদোনীসকে গভীরভাবে নিজের দিকে তাকাতে হয়েছে। নিজের উপেক্ষিত ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার দিকে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু তিনি নিজে কতোটা সেদিক থেকে তৈরি হলেন সে বিচারের সুযোগ এখানে নেই। আমাদের শুধু তার পর্যালোচনার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারলেই আপাতত যথেষ্ঠ। সেটাই আমাদের জন্য কাজের কাজ হবে।

চার

আদোনীসের মতে অষ্টম শতকে আবু নুয়াস, আবু তাম্মাম ও আবু হাইয়্যান তাওহীদীর হাত ধরে আরবী আধুনিক কবিতার প্রকাশ ঘটে। একইভাবে মোঙ্গলদের হাতে বাগদাদের পতন, ক্রুসেডারদের তীব্র আক্রমণ ও উসমানীয়দের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার মধ্য দিয়ে এই আধুনিকতা অন্যভাবে ফিরে আসতে পারতো সেটা হয়ে ওঠে নি। এর নানা কারণ হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু প্রচলিত অর্থে যে প্রগতি ও আধুনিকতা তার রূপে রূপায়িত হয়ে আরবী কবিতা নতুন করে হাজির হয় ঊনিশ শতকের শুরু থেকে বিশ শতক পর্যন্ত আরব রেনেসাঁর সময়কালে।

এ রেনেসাঁসের পর্যালোচনা ও চিত্রগুলো থেকে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি বেরিয়ে আসে। একটি হলো–মূলপন্থী। যারা অতীতের সাথে সম্পর্কিত অর্থাৎ ঐতিহ্যবাদী। এ ধারার ধারণাগত ভিত্তি হলো প্রকৃতপক্ষে আধুনিকতা আরবী ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।

আরেকটি ধারণা হলো–অপরমুখি ধারা। এর ধারণাগত জায়গা হলো–ইওরোপীয় সেক্যুলারিজমের ঐতিহাসিক অর্জন ও বাস্তবতার মধ্যেই আধুনিকতা।

কিন্তু মূলধারার ডিসকোর্সের দাবি হলো–আরব সমাজে নিজস্ব অর্জনের দিক থেকে বিবদমান কর্তৃত্বশীল সংস্কৃতিই হলো মূলধারার সংস্কৃতি। কিংবা মূলধারাই হলো প্রধান ধারা। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির সমস্ত উপায় উপাদানের কারণেই এই ধারার গ্রহণযোগ্যতা স্বতঃপ্রমাণিত। ফলে মূলধারার যে শক্তি তা ঐতিহ্য ও ভাষার দিকটিকে আরো বেশি পুষ্টিময় করে তোলে। একইসাথে পশ্চিমের চিন্তাধারার সাথে তার মোকাবেলা ও দ্বন্দ্বের জায়গা তৈরি হয় খুব স্বাভাবিকভাবেই। কারণ পশ্চিমের সাধারণ অবস্থান হলো- ঐতিহ্যের পরিবর্তন বা পূর্বের অবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়া, গণতন্ত্র, আধুনিকতা ও পূর্ব থেকে চলে আসা বিবদমান রাজনীতি, শাসন ও ক্ষমতার সকল ভরকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসা। যারা এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আধুনিকতার প্রত্যাশা করে চিন্তাভাবনা করে তাদের এই দাঁড়ানো ও চলনের জায়গাটা আসলে বাহিরের বা অপর থেকে ধার করে নিয়ে আসা একটি অবস্থান। এই বাহির হওয়াটার মানে হলো তার ঐতিহাসিকভাবে গড়ে তোলা নিজের ভূরাজনৈতিকতা, বুদ্ধিবৃত্তি, ভাবুকতা, উত্তরাধিকারের সংস্কৃতির বিকাশ, আদর্শ ও মূল্যবোধগুলোকে নাকচ করে দেওয়া। অর্থাৎ নিজের ঐতিহাসিকতা বলে যে জায়গাটা ছিলো সেটাকে বুঝে হোক বা না বুঝে হোক অস্বীকার করা। কাজেই এদিক থেকে আদোনীসের এই পর্যালোচনায় আধুনিকতা একটি ঘেঁটেঘুটে দেখে বুঝাবুঝিরও ব্যাপার। তিনি মনে করেন ইওরোপীয় যে আধুনিকতা সেটি মোটেও কোনো পরম ও শাশ্বত বিষয় নয়। তার ভাষায় আধুনিকতা হলো একটি পরস্পরের প্রশ্ন, পর্যালোচনা, বাহাস, ইনকিলাব-গণজাগরণ, প্রত্যাখ্যান, পরিবর্তন ও চৈতন্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো। আবার একইসাথে আধুনিকতা মানে এই নয় যে, আবহমান ঐতিহ্যবাদী তরিকায় অতীতের মধ্যে ডুবে থাকা। পশ্চিমের উদ্ভাবন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিন্তা ও সংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়াও নিজের জায়গা থেকে কোনো অবস্থান হতে পারে না। সেদিক থেকে ঐতিহ্যের মানে আবহমান নয়। ঐতিহ্যকে পর্যালোচনায় হাজির করা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির নানা শর্ত ও ঐতিহাসিকতার মধ্যে নির্মোহ বিচারে নিজেকে সম্মুখিন করা। আরেক দিকে আধুনিকতার যাবতীয় দিককে ঘেঁটেঘুটে দেখা। তার আলোকিত অধ্যায় বা এ্যানলাইটেনমেন্টকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। এরপরের কাজটি হলো নিজের কাণ্ডজ্ঞানের ছাকনী দিয়ে ছেকে ছেকে নেয়া। এভাবে গ্রহণ করার মতো লোকমাগুলো বুঝেশুনে আহরণ করা। আদোনীসের ভাষায় আপন কাব্য, ভাব ও জ্ঞানের ঐতিহ্যের মধ্যেই নতুন অর্থ উৎপাদন করার সাধনার চল শুরু করতে হবে। এতে সহজেই বিবদমান সংকট, আটকে যাওয়া, সীমাবদ্ধতা ও অপরমুখিতা অতিক্রম করে যাবার মন তৈরি করা যায়। আবু নুয়াস, আবু তাম্মাম, নাফারী ও আবু হাইয়ান তাওহীদির দরবারে গেলে আপনার এই স্বাদ ও বাসনা পূর্ণ হবে নিশ্চয়ই।

আপনি আপনকার জায়গায় দেখবেন একটি কাল। সময়। অর্থ। সেটাই আপনার বেড়ে উঠার ইতিহাস। আপনার সময়ে কোন শর্তে কী সম্ভাবনা আছে সেটাকে কী করে কোন ভাষায় অভিব্যক্ত করা যায় তার কাণ্ডজ্ঞান ও ইলহামটা ধরে ফেলতে পারবেন।

সেগুলো পাঠ করলে একটা সময় থেকে আরেকটি সময়ে যাবার ভাষা ও জ্ঞান কী করে তৈরি হয়, দুটি অবস্থার সন্ধিক্ষণটা কী সেটা টের করতে পারবেন। ফলে কী করে পুরনো সময়, পুরনো, অর্থ, কাঠামো ও নিয়ম ভেঙ্গে আপনার সত্তা হতে ভাব, ভাষা, নতুন কাব্য তৈরি হয় তার আন্দাজটুকু বুঝতে পারবেন। যা আজকের বিদ্যমান দুনিয়ায় বুঝতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আরবের কবিতা, চিন্তা ও জ্ঞান কোন জায়গায় কীভাবে আলাদা সেটাও তাদের কবিতায় বুঝা যায় সহসায়। ফলে বাংলা কবিতার দিক থেকে একটি তুলনামূলক ও পর্যালোচনামূলক একটি মন আপনি খুঁজে পাবেন। অর্থাৎ পশ্চিমা কবিতাই পৃথিবীর সকল ভাষার কাব্যের একচেটিয়া মানদণ্ড, শ্রেষ্ঠ মডেল। পশ্চিমই আধুনিকতার একমাত্র জায়গা এর বাইরে আর কিছুই নেই। এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতো করে ভাববার, নির্মাণ করবার মন খুঁজে পাবেন।

কাব্যের সৃজনকাতরতা হলো একটি মানবিক উৎপাদন। যা আধুনিকতা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ভবিষ্যতবাদী প্রগতি ও অতীতমুখি ঐতিহ্যবাদিতাকে অতিক্রম করতে পারে। আধুনিকতা কোনো দেশকালের নাম নয়। আধুনিকতা ‘না-সময়’, ‘না-দেশ’ আবার একইসাথে দেশকাল। নতুন কল্পনা, স্থিরতা থেকে মুক্তির তাগাদা, পরিবর্তন, মোকাবেলা, উৎপাদন–এই হলো আধুনিকতা। এটাই মানব স্বভাব, মানব ধর্ম যা রচিত, চর্চিত ও গ্রন্থবদ্ধতাকে ভেঙ্গে দেয়ার উপর দাঁড়ানো। কবিতার ভাষাকে ভেঙ্গে ফেলে উন্মোচন করে দেয়। জাহের আর বাতেনের, সাকার আর নিরাকারের ভেদ ঘুচিয়ে দেয়ার উপর দাঁড়ানো এই মানব প্রকৃতি এবং তাই ‘আধুনিকতা’। আদোনীসের ভাষায় এটাই প্রাচ্যের দাবি। আধুনিকতা মানে অস্পষ্টতা, গারাবাত (যা এখনো ঘটে নি), দুর্বোধ্যতা (কারণ এখনো যা বোধগম্য হয় নি), অনিশ্চিতি (কারণ এখনো তা অধরা), রহস্যময়তা, দ্যর্থকতা, রূপক, কাশফের ভাষা, অশেষ, অক্ষয় এবং মানব প্রকৃতি ও কল্পউপাখ্যান বা ইওটোপিয়ার দিকে ফিরে আসা।

মাঝে মাঝে
আমরা যা কিছু প্রদীপ্ত করি
তাই সবচেয়ে সুন্দর আলোর আঁধার
আমরা নূর দর্শন করতে তা করি না
বরং করি যেন আমরা দেখি তার ছায়া

এই হলো আদোনীসের সারকথা। নতুন ভাব ও কবিতার প্রস্তাবনা। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই। অতএব একই কথা আবার ঘুরেফিরে বলতে হয়–উপনিবেশোত্তর সময়ে এই দেশে যে পশ্চিমের অনুকরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধির চিন্তার চল শুরু হয়েছে সেটি আসলে গোলামী ছাড়া আর কিছু নয়। তা থেকে আপনাকে উদ্ধার করার কাজ শুরু করতে হবে। একথা শুধু আদোনীস নিছক কবিতার বেলায়ই বলেন নি। তাঁর জোর দেবার জায়গাটি ছিলো একইসাথে ‘আপনার’ চৈতন্য ও মন তৈরি করার উপর। তবেই যথার্র্থ অর্থে আপনার মুক্তি ও গড়ে ওঠার কথাটা পরিস্কার হবে। সেজন্য ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ধ্বংসাত্মক তৎপরতা থেকে পাশ ফিরে নিজের নাড়ির সাথে মিশে যাবার প্রয়াশই হবে এই আলোচনার সত্যিকার সার্থকতা।

শাহাদাৎ তৈয়ব

কবি, গদ্যকার, অনুবাদক। আদোনীসের কবিতার অনুবাদ সংকলন গ্রন্থ হিসাবে প্রকাশ করেছেন। রয়েছে একাধিক কাব্যগ্রন্থ। বসবাস ঢাকায়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top