আজ রবিবার, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সর উত্তোলন প্রযুক্তি

কারুকলা বিষয়ক গদ্য

।। সৌরভ রায় ।।

শ্রমজ্ঞানপন্ডিতেরা বেবিদি’র এই সর উত্তোলন প্রযুক্তিজ্ঞানকে বাহ্যজ্ঞান (explicit knowledge) ও গুহ্যজ্ঞানে (tacit knowledge) ভাগ করে বোঝার চেষ্টা করেন। এই ক্ষেত্রে বাহ্যজ্ঞান হচ্ছে ওপরের ছবিগুলো দেখে মনে হওয়া যে এ ভারি সোজা কাজ, এ এমন কী, ধাপে ধাপে দুধ জ্বাল দেওয়া আর ঠান্ডা করা বই তো নয়? আর গুহ্যজ্ঞান হচ্ছে, বেবি ঘোষের অন্তর্নিহিত ব্যবহারিক জ্ঞান, যা হাতে কলমে না করলে, শত বার দেখে আর হাজার কথা কয়ে-লিখেও বোঝানো যাবে না

‘ক’ বলতেই অনেক সুধীজন যেমন কলকাতা পৌঁছে যান, একবারও ভাবেন না যে ক-য়ে কেষ্টপুরও হতে পারে, তেমনই ‘কৃষ্ণনগরের স…’ বলতেই কোরাস ওঠে , ‘‘কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া-সরভাজা তো? বেমালুম জানি, দেখেছি-খেয়েছি-হাঁড়ি ভরে কলকেতা এনেছি, আরে ওখানেই তো আমার / আমার মাসি / পিসি / মামা / কাকা / সমুন্দি’র বাড়ি…’’ ইত্যাদি-প্রভৃতি। কিন্তু ভাল সরপুরিয়া-সরভাজা আমাদের জিভে যে স্বাদের পিদিম জ্বালে তার সলতে পাকাতে অনেক তরিবত করতে হয়। সেই সলতে হলো ‘সর’।

সেই ‘সর তোলা’কে এই শিরোনামে ‘সর উত্তোলন প্রযুক্তি’ বলেছি সংস্কৃতের ফোড়ন দিয়ে একে জাতে তোলবার জন্য নয়। এই নতুন শব্দবন্ধ গঠনের কারণ, ‘সর তোলা’ কথাটা ব্যবহার করার প্রতি আমার অনীহা থেকে। ‘সর তোলা’ কথাটা আমাদের মনে ‘ফুল তোলার’ অনুসঙ্গ আনে, যেন এটা একটা শৌখিন, হালকা ফুলেল কাজ। থার্মোডায়নামিক্স আর কোলয়ডাল দ্রবণশাস্ত্রের অমোঘ নিয়মে ঠান্ডা হতে থাকা দুধে সর পড়ে আর আমাদের মা-মাসিরা সেটা চামচ দিয়ে আলতো করে, টুক করে তুলে রাখেন, কুয়াশা-কুয়াশা ভোরে বাড়ির বাগান থেকে সাজিতে টগর ফুল তোলার মতো।

আরেক দিকে ‘সর উত্তোলন’ কথাটা আমাদের মনে ঝঙ্কার তোলে ‘ভার উত্তোলন’ কথার। ভার উত্তোলন একটা ভারি কাজ। বেবি ঘোষ আক্ষরিকভাবে উদয়াস্ত খেটে, ঘরের অন্য সব কাজ সামলে রোজ ৭০-৮০ পিস সর-চাকতি গড়েন। এ কাজ তা রীতিমত ভারিই বটে, চোখে দেখে যদিও মনে হয় তা অবলীলায় সাঙ্গ হচ্ছে।

শ্রমজ্ঞানপন্ডিতেরা বেবিদি’র এই সর উত্তোলন প্রযুক্তিজ্ঞানকে বাহ্যজ্ঞান (explicit knowledge) ও গুহ্যজ্ঞানে (tacit knowledge) ভাগ করে বোঝার চেষ্টা করেন। এই ক্ষেত্রে বাহ্যজ্ঞান হচ্ছে ওপরের ছবিগুলো দেখে মনে হওয়া যে এ ভারি সোজা কাজ, এ এমন কী, ধাপে ধাপে দুধ জ্বাল দেওয়া আর ঠান্ডা করা বই তো নয়? আর গুহ্যজ্ঞান হচ্ছে, বেবি ঘোষের অন্তর্নিহিত ব্যবহারিক জ্ঞান, যা হাতে কলমে না করলে, শত বার দেখে আর হাজার কথা কয়ে-লিখেও বোঝানো যাবে না; ঠিক কতোটা গরম করতে হবে, কতটা ঠাণ্ডা করতে হবে, কতোটা ভেজা, কতটা শুকনো, ঋতুভেদে সেই গরম-ঠান্ডা-ভেজা শুকনো কীভাবে কীভাবে সামাল দিতে হবে! আর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নরম পর্দার মতো সরকে ঠিকভাবে গামছার ওপর পরতে পরতে পেতে তাকে চাকতি বা পাঁপড়ের মত শুকিয়ে তোলা যাতে তা সাত দিন বাইরে থাকলেও খারাপ হবে না। দুধ তাজা আর পাতলা থাকতে থাকতে সে সর-চাকতিগুলি তৈরি হয়; তার স্বাদ, কদর, দাম সবই বেশী। বেলা যত বাড়তে থাকে, দুধ তত মোটা, কড়া আর নোনতা হতে থাকে, সর-চাকতি কাঁচা পাঁপড় থেকে ভাজা পাঁপড়ের মতো হতে থাকে, তার বাজারি চাহিদাও কমতে থাকে। তাছাড়াও এই সব কিছুর পেছনে আছে রবি ঘোষের গুরুদায়িত্বপালন- কীরকম দুধ কোথা থেকে কয়টার মধ্যে কতটা আনতে হবে, ঘুঁটে অমিল হলে ব্যবসা বন্ধ হবে তাই ঘুঁটে বেশি করে কিনে রাখতে হবে, আরও অনেক কিছু! গয়লাবাড়ির বৌ বেবি ঘোষ শ্বশুরবাড়ি এসে মন দিয়ে এই হাড়াভাঙা খাটুনির অর্থকরী বিদ্যা শিখে তাই নিয়ে সংসারের খেয়াতরীকে শনৈঃ শনৈঃ বড়ো জাহাজ বানিয়ে তুলেছেন। খোট্টাপাড়ায় খুব কম বাড়িতে তো বটেই, পুরো কৃষ্ণনগরে সর-গড়ার কাজ খুব কম হয়, তাই চাহিদা যেমন বেশি, ছুটি তেমন কম, নেই দম ফেলবার অবসরও।

‘ছোটলোকি জ্ঞানদীপিকা ১’ বইতে ছো-শিরোমণি নেপাল সূত্রধরের ছোটলোকি জ্ঞান সম্বন্ধে যা লিখেছিলাম, তার খানিকটা বেবি ঘোষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য— এই জ্ঞান ও প্রযুক্তি কায়িক। কিন্তু কায়িক মানে তা শুধু গতরের পরিশ্রম নয়, তা বৌদ্ধিকও বটে, কিন্তু আমরা বৌদ্ধিক বলতে যা বুঝি, ঠিক তা নয়। বুদ্ধি ও কায়ার বাগার্থবৎ সম্পৃক্তি।

যদিও এই সর-উত্তোলন প্রযুক্তি অনেক জটিল সুতো দিয়ে সামাজিক উৎপাদনব্যবস্থা, গ্রামীণ-শহুরে-দেশী-বিদেশী অর্থনীতির সাথে যুক্ত, কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে তা অনেক বেশী জোর দেয় কাঁচামাল (এ ক্ষেত্রে দুধ ও ঘুঁটে) ও তার সাথে যন্ত্রপাতির (কড়াই, হাতা, উনুন ও সর্বোপরি সর-উত্তোলনকারীর বহু-প্র্যাক্টিস-লব্ধ দেহ চালনা করার স্বশক্তি) সম্পর্ক স্থাপনের প্রতি।

কারণ সেই সম্পর্কের রোজকার টানাপোড়েনে রোজ সকাল থেকে সন্ধে নিপুণ ও সৎ ভাবে সর-গড়া না হলে সরভাজা রসে ছাড়লে তার পরত খুলে যাবে, সরপুরিয়ার হাল্কা বালি-বালি খোলসের মধ্যে মোলায়েম নরম সরের পুর শান্ত হয়ে বসবে না, উঠবে না সেই সরপুরিয়া-সরভাজা পাড়া, গ্রাম, দেশ, আর বিদেশের মানুষের সতৃপ্ত মুখে। সেই সরের মিষ্টির লাভের গুড়ের ভাগ যদিও ময়রা-মহোদয়দের পাতেই বেশী পড়ে, তবু বেবি ঘোষ আর রবি ঘোষ কাল ভোরে উঠবেন, কাল বার-তারিখ-মাস যাই হোক না কেন!

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
ড. ঈশিতা দে  (http://www.sau.int/faculty/faculty-profile.html?staff_id=86)
www.sahapedia.org
তথ্যসূত্র:‘ছোটলোকি জ্ঞানদীপিকা ১’, নেপাল সূত্রধর, সৌরভ রায়, কলাবতী মুদ্রা, ২০১৯
https://www.sahapedia.org/sweets-crafted-bengal
https://www.sahapedia.org/importance-of-sar-sweets-of-bengal
https://www.sahapedia.org/process-of-sar-making
https://itiriti.wordpress.com/2011/12/29/invisible-hands-behind-sweet-industry-what-does-it-take-to-prepare-sar/
ছবি: লেখক
লেখক পরিচিতি:
সৌরভ রায়

বাংলা ও ইংরিজি এই দুই ভাষার লেখালেখিতে রত আছেন সৌরভ রায়, এছাড়া বাংলা থেকে ইংরাজিতে নিয়মিত নানা কিছু তিনি অনুবাদ করে থাকেন। তাঁর প্রথম দিকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। প্রায় এক দশক বিজ্ঞাপনী জগতে চাকরি করেছেন। তার পরে চিত্রবিদ্যায় দুটি স্নাতক (Dr. Bhau Daji Lad Museum – Mumbai 2012-13, School of Arts & Aesthetics, Jawaharlal Nehru University – New Delhi , 2014-16) করেছেন এবং Tasveer Ghar Fellowship 2017-18 পেয়েছেন। বর্তমানে দুটি গবেষণাপ্রকল্পের (স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের সেক্যুলারিজম বিষয়ক চিত্রজগত, আন্তর্জালে ভারতীয় Queer পুরুষদের চিত্রজগত) সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া লন্ডনের Stimulus -> Respond Magazine-এর সাহিত্য সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top