আজ রবিবার, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রুয়া

ছোটগল্প

।। অমৃতা সরকার ।।

একজোড়া মাগ ভাতার হাসি মুখে এসে বলে, ‘হাম দো হামারে দো, ছোটা পরিবার সুখী পরিবার’। এরপর ওয়াশিং পাউডার নিরমা, কোলগেট টুথপেস্ট। সব মুখস্থ বোচার। এই সবের পরই আসল জিনিসটা শুরু হয় ওম নমঃ শিবায়। ভাষা বেশীটা না বুঝলেও বেশ ভক্তি নিয়ে শিবের নাচনকোদন দেখে সবাই। খানিক পর কেউ একটা বলে, এইবার বিটিভি ধর না রে, অ্যান্টেনাটা ঘুরা। ভক্তিরসের হিন্দি ডোজের পর সকলের বাংলাদেশের নাটক দেখতে মন চায়। অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে, হালকা কান মোচড়ালেই টেলিভিশন দেখায় বিটিভি। থম মারা ভক্তিভাবটা কেটে গিয়ে সবাই চিলুবিলু করে। মানিকের চোখে পড়ার আগেই সুট করে কেটে পড়ে বোচা।

রুয়া

হাঁটু অবধি জলে ডুবে থাকা শরীরগুলান ধানের ক্ষেতের এধার থেকে ওধার হাওয়ায় তিরতিরাচ্ছে যেন ! এক সুতো হিসাবে ভুল নাই, এমনি করে ধান রুয়া চলে। পায়ের গোছটা অনেকক্ষণ চিনচিন করছে তবু মাজা মোজা করেনি একবারও বোচার মা। চামড়ায় সেঁটে থাকা জোঁকগুলি রক্ত খেয়ে টোবাটোবা হয়ে উঠতেছে। কানের কাছে মুখ এনে সুজিতের বৌ বলে, “হুনসনি বোচার মা, সুলতার আবার প্যাট হইসে”। না শোনার ভান করে সে শোনে সবটাই, ভাবে কখন জল থেকে উঠে জোঁকগুলো ছাড়াবে পা থেকে। দাঁত কিড়মিড়ায় তার, শুইষে নে, কতো শুষবি, ধরব অহন। জলদি হাত চালিয়ে ক্ষেতের অন্য ধারে চলে আসে সে। আলে থ্যাপ করে বসে দুই আঙুলে টেনে টেনে তোলে জোঁক। একটার সাথে আরেকটা পেঁচিয়ে গিঁট মারে। লবনের স্বাদে মরণের স্বাদ পাওয়া জোঁক হকচকানোর আগেই পিচ রাস্তায় পড়ে শুকিয়ে ওঠে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেলাটার মজা নেয় বোচার মা। খালপাড়ের এই দেড় বিঘা জমিতে আর তিনদিনের ভিতর রোয়া গাড়া শেষ করা লাগবে। জলের উপরে সূর্যের সাদাটে ছায়াটা ভেঙে ভেঙে যায়। ঐ ভাঙনের উপর দিয়ে পোকাগুলি কেমন তিরিবিরি করে ক্ষণিকের আল্পনা দেয় যেন। একটা গা জ্বালা পোড়া বাতাস খাল পাড়ের ঘোড়ানিমের গাছটার মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কেমন অস্থির করে তোলে। আর বসে না বোচার মা। ক্ষেতে জল শুকানোর আগে ধান রুয়ে ফেলতে হবে। এই সময়, মালিকও হাজিরা নিয়ে দর কষাকষি করে না। দূর থেকে ক্ষেতের কাজে নজর রাখে রায়ধন। ছাতা নিয়ে নিজে দাঁড়ায় থাকে ঠায়। এইসব কাজে ব্যাটারে খুব একটা ভরসা করে না। নিজে না দেখলে, ব্যাটার হাতে তোলা হয়ে থাকলে, আসাম থেকে খ্যাদা খাওয়া ন্যাঙট সম্বল নমশূদ্র ডুয়ার্সের সাজগোজ করা শহরে এসে বসতি করতে পারত না। শহরে কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। শহরের বাইরেই এই পাড়া। মূল শহরে এক জায়গায় বাড়ি জমি কম দামে পেয়েছিল সে।

“টেহাপয়সা বিষয় না। ব্যাপার অইছিলো ঐহানের বামুন কায়েত বাবু’গোর লগে থাকা সম্ভব আছিলো না। ওগোর চোক্ষে নিজেরে দেইখ্যা খুব ছোট লাগতেছিলো। এর চাইতে নিজের জ্ঞাতিগুষ্টির মাইনষের লগে থাহাই ভালা”। গ্রামের লোকেরা অনেক শুনেছে রায়ধন বুড়ার এই পিরিতের কথা। নিজের জাতের লোকের প্রতি বাড়তি কোনো দরদ সে দেখায় না। বিশেষত কামলা নেওয়ার সময় মজুরি নিয়ে খ্যাচখ্যাচ কম করে না বুড়া। দরদ দেখায় নাই বলেই বিঘার কে বিঘা জমি তার নিজের নামে করতে পেরেছে। গ্রামের লোকেদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো না কোনো ভাবে তার জমিতে কামলা খাটে বছরভর। বোচার মাও ঝাঁকের কই, দেড়টা তো পেট, গায়ে গতরে খেটে গুজরান করে নেয়।

“ঐ গুদমারানির পো, সইরা বস, কান্ধে উঠবি নাহি?”

“সইরাই তো বইসি। “

“যাহ্‌ ঐ কোনাত গিয়া ব। “

“ক্যান ?”

“ভ্যাদা মারাম মুহে কতা ক’বি তো “

বোচার মুখে উদ্যত লাথিটা সুনীল মাষ্টারকে দেখা মাত্র নামিয়ে ফেলে মানিক। তবু দু’ চার সেকেন্ড দেরী হয়েই যায় এবং মাষ্টার ঘটনাটা দেখেই ফেলে।

“কি রে হারুর পোলা, ঠ্যাং খুব লম্বা হইসে? কাটন লাগব? কতা কইস না কী লিইগ্যা?”

মানিক চুপ থাকে। কথা কইলেই অহন নীল ডাউন। জানে সে।

 সুনীল মাষ্টারের জোরাজুরিতেই মা তাকে প্রাইমারি ইস্কুলে ভর্তি করেছে নইলে বোচা কোনোদিন ইস্কুলের দশ হাতের মধ্যেও আসত না। পড়তে ওর ভালো লাগে না। তার চেয়ে ঘরের পাশের জিগা গাছটায় উঠলে সে দেখতে পায় পাড়ার খাপছাড়া বাড়িগুলান, তার পরে বাঁশঝাড়, তার পরে রাসমেলার মাঠ, মাঠের কোনে রাখালের দোকান। দোকানে বুটভাজা কিনতে আসা হাফ প্যাডেল সাইকেলে সবিতা, ওর মা পিছনে হাত পা নেড়ে কি বলতে বলতে এগোয়। দূর থেকে শুনতে কিছুই পায় না বোচা, কিন্তু গাছের ওপর থেকে এইসব দেখে টেলিভিশন দেখার মত আমোদ হয়। আসল টেলিভিশনের মজা অবশ্য এর ধারে কাছে আসে না। সন্ধ্যা হতে না হতে ইস্কুলের গালাগালি গুলা ভুলে যায় সে। ল্যাজ তুলে দৌঁড়ায় মানিকদের বাড়ির দিকে। আর খালি সে কেন, পাড়ার সবাই জড়ো হয় মানিকদের বাড়িতে। ঘরে ঢুকতে পায় বুড়া বুড়ি পালের গোদারা, বারান্দার মাদুরে পাছা ঠেকাতে পারে তাদের বৌ ঝি-রা। পোলাপানগুলা উঠানে হরির লুটের বাতাসার মতো ছড়ায় ছিটায়ে থাকে। এরই মধ্যে কোনো কোনা কানচিতে প্রায় অদৃশ্য হয়ে থাকার চেষ্টা করে বোচা। প্রথমে কাঠের বাক্সের কপাট খোলে তারপর কানে মোচড় দিয়ে টেলিভিশন চালু করে মানিক। সকলে তার দিকে ড্যাবাড্যাবা অবাক চোখে, প্রশংসার চোখে তাকায়। দূরদর্শনে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। প্রথম কিছুক্ষণ অ্যাডবারটিস হয়। একজোড়া মাগ ভাতার হাসি মুখে এসে বলে, ‘হাম দো হামারে দো, ছোটা পরিবার সুখী পরিবার’। এরপর ওয়াশিং পাউডার নিরমা, কোলগেট টুথপেস্ট। সব মুখস্থ বোচার। এই সবের পরই আসল জিনিসটা শুরু হয় ওম নমঃ শিবায়। ভাষা বেশীটা না বুঝলেও বেশ ভক্তি নিয়ে শিবের নাচনকোদন দেখে সবাই। খানিক পর কেউ একটা বলে, এইবার বিটিভি ধর না রে, অ্যান্টেনাটা ঘুরা। ভক্তিরসের হিন্দি ডোজের পর সকলের বাংলাদেশের নাটক দেখতে মন চায়। অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে, হালকা কান মোচড়ালেই টেলিভিশন দেখায় বিটিভি। থম মারা ভক্তিভাবটা কেটে গিয়ে সবাই চিলুবিলু করে। মানিকের চোখে পড়ার আগেই সুট করে কেটে পড়ে বোচা।

 মানুষের সমবেত নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় উঠানের বাতাস থম ধরে থাকে। উশখুশ করে লেবু ঝোপে একটা দু’টা ফুল অন্ধকারে পাপড়ি খোলে। কুয়োর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বোচা ভাবে, একদিন এই টেলিভিশনটা চুরি করবে। বড় হয়ে। বড় হলে সে বুরুদার মত হবে। বুরুদার ঘরের বেড়ায় চাদ্দিকে খালি বচ্চন আর মিঠুনের ছবি আটকানো। বাড়িতে থাকত না বেশী। মাসে এক কি দুইবার পয়সা দিতে আসত। তখনি ময়দা গুলে মন দিয়ে ছবির পর ছবি বেড়ার

ফুটোগুলোর উপর আটকে দিত। ওদের ছাপরার ঘরের মেঝে পাকা হচ্ছিল। আধাআধি হওয়ার পর কাজ বন্ধ হয়ে যায় টাকা আসে না। বুরুদাও আসে না। আড়াই মাস পর নতুন রাস্তার কালভার্টের নীচে একটা বস্তার ভিতর পাওয়া যায় পিস পিস করে কাটা বুরুদাকে। গোটা পাড়ার লোক গেছিল ঘটনা দেখতে। শনিবার বিকালে মানিকদের বাড়ি বচ্চনের বই দেখতে যাওয়ার সময় যেমন ভাব হত সবার মুখে,সেই একই ভাব  দেখেছিল বোচা সেদিন। বুরু হতে অনেক দেরী, বড় হতেও, মরতে যে কত দেরী সে হিসাবও করতে পারে না।

 কুয়ার রিঙয়ের ভিতর মুখ বাড়িয়ে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে সে। বড় গোলটায় যে কাঁপা কাঁপা ছায়া পড়ে, তার মুখে থুঃ করে ছ্যাপ ফেলে বোচা। থুতুটা থপ করে ছোট একটা আওয়াজ করে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে জলের বৃত্তে। ভাঙা চোরা ছায়া নড়ে ওঠে আরও, বোচার মনে হয় ঐ মাথাটা অন্য মানুষের। ভয় লাগে তার। ভয়টাকে দুই দাঁতের মধ্যে চেপে কিড়মিড়ায়, খা শালা মানিক, গুষ্টিসুদ্দা গুদমারানির ব্যাটার ছ্যাপ খা। লেবু ঝোপ থেকে দুটা ডবকা দেখে লেবু ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ীর দিকে হাঁটা দেয় বোচা। মনটা ফুরফুর লাগে। কালো নুনিয়া ক্ষেত বরাবর আল দিয়ে এগোয়। দুইদিকের ধান গাছের ব্লেডের মতো পাতা পায়ে ঝাপট মারে তার।তাড়াতাড়ি চলতে গিয়ে চোখ পড়ে রায়ধন বুড়ার জমির দক্ষিণের উচু ঢিবিটায়, ঢিবির মন্দিরে, মন্দিরের গায়ে ঝামড়ানো বেল গাছে। বুকের ভিতরটা ধরাস ধরাস করে, রাম রাম বলতে থাকে বোচা। কোনোমতে এই আলটা পার করলেই তাদের বাড়ি।রান্নাঘর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডুলী বেরিয়ে এসে ধান ক্ষেতের উপর সাদা চাদরের মত ঝোলে, নুনিয়া আতপের গন্ধও লেপ্টে থাকে ঐ চাদরে। এই সব সময় রায়ধন নিজের খলানে উবুত হয়ে বসে। অন্ধকারে ক্ষেতের ধান চোখে আসে না তার। নাক সরু করে গন্ধ নেয়। মনে মনে ধন্যবাদ দেয় ভগবানকে। দেশ ভাগ না হলে সে আসামে ঢুকতো না, আসাম থেকে বাঙালি খেদাও না হলে সে জলপাইগুড়ি আসত না আর জলপাইগুড়ি না আসলে চৌধুরী পাড়ার মিঞাদের এই বাড়ি জমি খলানও অত সস্তায় পেত না। দিনরাত এক করে জমি বহরে বাড়িয়েছে। এখন এর ভবিষ্যৎ ভেবে ঘুম আসে না রাতে। “কৃষ্ণধনের দুই ছেড়ি, বউডা পোয়াতি হইসে আবার কিন্তু এইবারও যদি ছ্যাড়া না হয়, তাইলে উপায় কি ইহব ! আতঙ্কে দিশাহারা লাগে তার। সে চোখ বুজলে কৃষ্ণধন এই জমি টিকায়ে রাখতে পারব?তার ভাই হারাধন, হ্যার ব্যাটাগুলান থাবা বসানির লাইগ্যা আঁকুপাঁকু করতাসে না! বেবাক লুট হইয়া যাইব। বেহাত হইয়া যাইব। একটা ছ্যাড়ার লাইগ্যা এত ভেজাল! কিন্তু পোলা কি নাই? ব্যাটাচ্ছেলে নিজের ঘরের মাগরে চুইদ্যা একডা ছ্যাড়ার জন্ম দিতে পারো নাই, খানকিরে চুইদ্যা ব্যাটার বাপ হইসো !”

ঐ খানকির ব্যাটা বোচা তার সাধের ক্ষ্যাত খলিয়ানের মালিক হবে এই কথাটা ভাবতেও তার বুক ফেটে যায়। এই অনাচার সে দেখতে পারবে না। বিড়বিড় করে বুড়া অভিশাপ দেয়, “শতেক খোয়ারি চুত মারানিরা মরে য্যান”। সে টুলি বুলির মায়ের মৃত্যু কামনা করে না বোচার মায়ের; বোঝা যায় না।

নুনিয়া ধানের ক্ষেতে সরসর করে বাতাস বয়। ধানের পায়ের গোছ মিহি কাদায় আরো ডুবতে থাকে। পায়ের উপর দিয়ে টাকিমাছ দলকে দল চলা ফেরা করে। বাতাস আর টাকিমাছের এই খেলা চলে রাতভর। ঝামড় ঝামড় ধানগুলাকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলে। কার্তিকের রাতে ঝরতে থাকা ওস বুকে নিতে আনচান করে উদাম ধানের ক্ষেত।

মনে মনে ধন্যবাদ দেয় ভগবানকে। দেশ ভাগ না হলে সে আসামে ঢুকতো না, আসাম থেকে বাঙালি খেদাও না হলে সে জলপাইগুড়ি আসত না আর জলপাইগুড়ি না আসলে চৌধুরী পাড়ার মিঞাদের এই বাড়ি জমি খলানও অত সস্তায় পেত না। দিনরাত এক করে জমি বহরে বাড়িয়েছে। এখন এর ভবিষ্যৎ ভেবে ঘুম আসে না রাতে।

 সারাটা দিন ধানের ডুলি সাফা করেছে সুলতা। বাড়ীর কাজ কামের জন্য ঝি চাকর রাখে না শ্বশুর। শাশুড়ি মরার পর বেবাক কাজ তাকেই সামলাতে হয়। সংসারের একশো ঝুট ঝামেলার পর বুলি টুলির খোঁজ রাখতেও পারে না ঠিকমত। মেয়েগুলা ডাংগর হইতেছে নজর রাখা লাগে অহন। নিজের শরীর নিয়েও নাজেহাল সে। ভারী শরীর আলসেমি করতে চায়। গরম তেলে তেজপাতা লাল মরিচ ছাড়তেই কাশি ওঠে তার। খুন্তি নাড়ায় কড়াইয়ে, ভয়ে তার হাত আলগা হয়ে আসে। যদি এইবারও পোলা না হয়। কৃষ্ণধন আবার বিয়া বসবে। না ঐ মাগীর কাছে যাবে?  কার্তিকের অস্পষ্ট জোছনা রাত গড়াতে স্পষ্ট হয়। তাদের ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় ধান ক্ষেত। তারও পরে বাঁশঝাড়, বাঁশ ঝাড়ের কোল ঘেষা পুকুর, পুকুরের পাড়ে কাউকে বসে থাকতে দেখা যায়। পরনের কাপড় এত সাদা। জোছনায় ঠাহর পাওয়া যায় না। বাঁশ ঝাড়ের অন্ধকারে মিশে যায় না যেন আবার বাইর হইয়া আসে। পাশে শুয়ে থাকা সোয়ামির মনের কথাই কিছু ঠাহর পাওয়া যায় না। রাগে গা জ্বালাপোড়া করে তার। শরীরের উপর থেকে কৃষ্ণধনের হাতটা ঝটকা দিয়ে ফেলে দেয় সুলতা

“অহনও যাও ঐ মাগীর বাসায়? “

“কী কও তুমি? হ্যার ঘরের দিকে মুখ কইরা মুতিও না”

“তাইলে থাকতে দিসো ক্যান নিজের জমিতে ? কামলা ন্যাও ক্যান?”

“আমি দিসি ! দিসে তো বাপে। বাপের উপর কথা কওয়ার সহবত শিখি নাই। “

“উঁ উঁ উঁ, ঘরে বউ থাকতে অন্য মেয়ে মানুষের সঙ্গে শোয়ার সহমত শিখসো ! “

“একি মুহের ভাষা। বাড়ির বউ না তুমি? দেহি, এই দিকে আসো . . . “

এই মাগীরে কী করে জব্দ করতে হয় জানা আছে কৃষ্ণধনের। ডান হাত দিয়ে সে সুলতার ঈষৎ ফুলে থাকা বুকটা টিপতে থাকে। সুলতার বুজে আসা গলা থেকে ফিসফিসে শব্দ বেরোয়, – “দাও…” পিঠের উপর থেকে সুলতার খিমচে ধরা হাতটা আস্তে আস্তে সরায় কৃষ্ণধন।

“হগলই তো তোমার ! কিন্তু অহন আনসান কিছু হয়ে গেলে, বাপে আস্তা রাখত না। “

“যদি না বাঁচি আর ! বিয়া করব না ঐ মাগীরেই ঘরে তুলবা ? “

“ছিঃ ছিঃ ! মরবা ক্যান ! তুমি মরলে আমিও বাঁচতাম না ! ছেঁড়ি দুইটা ভাইস্যা যাইব “

সুলতা ঘন হয়ে আসে সোয়ামির শরীরে। ন্যাতানো বাঁড়াটা  শক্ত মুঠায় ধরে ঘুমায় নিশ্চিন্তে। রাতটুকু । মুঠি আলগা হলে, নিঃশব্দে উঠে আসে কৃষ্ণধন। পাতলা জোছনায় চারদিক কেমন অচেনা ঠেকে। তাদের ক্ষেত খলান পার করে জমির শেষ সীমানায় জিগা গাছটা বেঢপ – দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশের ছাপরা ঘরটাও অস্পষ্ট দেখা যায়। ঘরের ভিতরের প্রাণীদের দেখা যায় না শুধু। সেই দিকে তাকিয়ে বিড়ি ধরায় কৃষ্ণধন।

 ধান কাটার পরের মাস গুলায় খালের জল উঠতে থাকে। ক্ষেতে পরে থাকা ধানের মো মায়ে তাড়ানো বাপে খ্যাদানো ছেলের মত অভিমানে রুখাসুখা। তার উপর দিয়ে হনহন করে হেঁটে আসলে পা কেটে ছড়ে যায়। তাও গতি কমে না বোচার মায়ের। খেসারি কলাই বোনা শুরু হতে এখনো দেরী আছে। ততদিন সে সুনীল মাষ্টারের বাড়ী বাসন মাজার কাজ করে। প্রতি বছর এমনই চলে। এই বারটা একার পেটের জন্য কাজ না ধরলেও চলতো। অভ্যাসবশে তবু সে যায়, ছাইয়ের গাদার পাশে ডাঁই করা বাসন একটা একটা করে মাজে। কড়াইয়ের কালি তুলতে, ঘষতেই থাকে সে বালি দিয়ে, ছাই দিয়ে, তেঁতুল দিয়ে। একফোঁটা কালিও যেন না থাকে। ড্যানা খুইলে আসতে চায় কিন্তু হাত থামে না। এক এক সময় পাট শোলার বেড়ায় লকলকা মাকালফলের লতায়, ঝোলা লাল ফলগুলিতে চোখ আটকায় তার। থোপা থোপা ফল, কাকে ঠোকরায়ে ভিতরের ছাই বার করে ফেলে। দলা দলা গুয়ের মত, ফলের ভিতরটা দেখে গা গোলায় বোচার মার। থুক করে থুতু ফেলে সে।

এই বাড়িতে কাজ করতে করতেই এক সন্ধ্যায় সে শুনেছিল সুলতার আবার মেয়ে হওয়ার কথা। দিনটা তার মনে আছে কারণ একখান কাপ সেদিন সে ভেঙে ফেলেছিল মায়নাও কাটা গেছিল তাই। আসলে বোচার মা হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছিল। সে তো উপেন ওঝার বউয়ের কাছে তখনও গিয়ে উঠতে পারে নাই। যাওয়ার কথা ভাবছিল খালি। বাণ মারার কথা ভেবেছিল খালি, উপেনের বৌয়ের হাতে পায়ে ধরে, কিন্তু মারে তো নাই। টাকার জোগাড় হয় নাই। জিনিসপত্রের জোগাড়ও করতে পারে নাই। সে কিছুই করতে পারে নাই। তাও বৌটার আবার মেয়েই হল।

এই মাগীরে কী করে জব্দ করতে হয় জানা আছে কৃষ্ণধনের। ডান হাত দিয়ে সে সুলতার ঈষৎ ফুলে থাকা বুকটা টিপতে থাকে। সুলতার বুজে আসা গলা থেকে ফিসফিসে শব্দ বেরোয়, – “দাও…” পিঠের উপর থেকে সুলতার খিমচে ধরা হাতটা আস্তে আস্তে সরায় কৃষ্ণধন।

 সেই রাতে তার ঘরের বেড়ার ওই ধারে মসমস আওয়াজে সে টের পায় ঘরের ভিতরে ঢুকতে চায় কেউ। এ আওয়াজ, তার কান পুরোনো অভ্যাসবশেই চিনতে ভুল করে না। মুখ দিয়ে একটা গোঙানি বার হওয়ার আগে কৃষ্ণধন পেড়ে ফেলে তাকে। ঝটাপটি করার কোনো চেষ্টাও অবশ্য সে করে না। মুলি বাঁশের বেড়ার নামমাত্র আড়ালে, জ্বরে কাহিল বোচা ঘুমাচ্ছিল। তার চুপ করে থাকার কারণ তা হতেও পারে। নাকের রন্ধ্রগুলায় তামাক আর ঘামের চেনা গন্ধটা রা রা করে ঢুকছিল আর তার কান শুনতে পাচ্ছিল চাপা হিসহিসানি – “বোচারে আমি নিবাম, বোচা আমার ব্যাটা। আমার। আমার।” প্রতিটা ঠাপের সঙ্গে আমার শব্দটা জোড়ালো হয়ে উঠছিল। অন্ধকারে ঠোঁট ফাঁক হচ্ছিল বোচার মার। নিঃশব্দে।

বাসনগুলা রান্না ঘরের পীড়ায় সাজিয়ে রাখে বোচার মা, সন্ধ্যার আগেই ফিরবে আজকে। মাষ্টারের বাসা থেকে তার ঘর কম দূর না। মানিকদের খলানটা দেখা যায়। বুলি টুলিরা পিট্টুর চাদ্দিকে ঘূর্ণি পাক খায়। মানিক ওদের দিকে তাক করেই ঘুঁটি ছুড়ে দেয়। পেট মোটা ধানের ডুলির পিছনে হুড়পাড় করে লুকায় মেয়ে দুইটা। বিকালের আকাশ নাছোড় লাল হয়ে কুল গাছের মাথায় আটকে থাকে। কুল ফুলের গন্ধে গায়ে কাঁটা দেয় বোচার মার! কেন জানি ! খাল পাড়ের রাস্তা পার হয়ে আসে সে আর একটা বক ডানা সরসরায়ে খালের দিকে উড়াল দেয়। বকটার হলুদ চকচকে চোখ খালের কাদায় বিঁধে থাকে। টাকিমাছগুলাও খলখল বন্ধ করে কাদার নীচে ঝিম মেরে থাকে।

খালি মাঠের উপর দিয়ে যেতে যেতে বোচার মার কানে আসে বিনবিনানি সুর। “মনসার পালা চলে নাকি কুথাও ! চাঁদবেনের ছয় পোলা ডুবলো নাকি একে একে ! সপ্তডিঙা মধুকর! লখিন্দরের লোহার বাসর তয়ের হইসে!!”

 সুরটা গলায় আনার চেষ্টা করে বোচার মা। রাসমেলার মাঠে মনসার পালা শুনেছিল সে। একবারই। বোচা তখন পেটে। কৃষ্ণধন এক সন্ধ্যায় মনসার গান শুনবে বলে নিয়ে গেছিল তারে। “ছুডো একটা কাগজের পুরিয়া হাতে গুঁইজ্যা কইসিল,’ খায়া নিস, প্যাট হইব না তাইলে। পাপটারে নিকেশ কইরা ফ্যালা।’না খায় নাই সে। কাউরে কিসু কয়ও নাই।” আজকে, এইখানে মাঠের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে তার হঠাৎ খুব আমোদ হয়। সে, বোচার মা কেমন করে যেন রায়ধন বুড়ার ক্ষেতের দক্ষিণ কোণে ঢিবির উপর এসে দাঁড়ায়। “এই জায়গায় মুসলাদের কবর আসিল। রায়ধন এইখানে মন্দির বানাইসে। বৌ মরার পর তার চিতার ছাই কলসের ভিত্রে এই মন্দিরে রাখসে।” সেই কলসের পাশে আরেকটা ছোট কলস রাখা আছে।

অলঙ্করণ: শংকর কর্মকার

অমৃতা সরকার

গল্পকার, প্রাবন্ধিক। অনুবাদও করে থাকেন। পেশায় অধ্যাপক। ইংরাজি সাহিত্য পড়ান। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায়। দলিত সাহিত্য, মানবীবিদ্যা, লোকসংস্কৃতি এবং ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। ইমেইল আইডি- aruvi01@gmail.com

Share

4 thoughts on “রুয়া”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top