রিমেম্বারিং

ছোটগল্প

।। রহিমা আফরোজ মুন্নী ।।

জিল্লুর আপ্রাণ চেষ্টা করে ভাববার যে আর কী কী বলা যায়, সে এখানেই থামিয়ে দিতে চায় না এই প্রসঙ্গ, আজ এই মুহূর্তেই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে, হারানো সন্তানকে কিছুতেই দ্বিতীয়বার আর হারাতে চায় না সে, বাচ্চাটা বান্দর অনেক, সবসময় লেগপুলিং করতো, মজা লইতো বাপেরে লইয়া, সে স্যারের চোখে চোখ রেখে দ্রুত বলতে থাকে,
“বিশ্বাস করেন স্যার, ওভার নাইট রুমের ভাড়া আমি দিমুনে, আপনে একটু সময় দ্যান। আপনে আমার ডিএনএ টেস্ট করানোর ব্যবস্থা কইরা দ্যান, প্রমাণ হইয়া যাইবো”



বিশাল হলঘর, বেশ কিছু লোকজন, বড় টেবিলের একপাশে ভাঁড়ের সাজে এক ব্যাটা, আরিব্বাস এইটার দেখি হাতেও হাতুড়ি, আররে…টিভিতে দেখা আদালত রুম টাইপ না? জিল্লুর ভাবতে ভাবতে চোখ কচলায় দুইহাত দিয়া, সামান্য আবছা মতোন সব ধীরে স্পষ্ট, হ, আদালত টাইপ কিন্তু আসলের মতোন না, কেমন যেন নাটকের শ্যুটিং চলতেছে ভাব, ধুরোও, যাকগা, কিন্তু আমি কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া ক্যান? হঠাৎ তার চোখ গেল সামনেই বসা মুসিবতের দিকে; আরে মুসিবত, সিনেমা করবা করো কিন্তু আমারে এইসব খচ্চরপনায় ঢুকাইতেছ ক্যান? ভাবতে ভাবতে খাটের পাশের সাইড টেবিল থেইকা চশমা নেয়ার ভঙ্গিতে হাত বাড়াইতে গিয়াও মনে পড়ায় এইখানের টেবিল কই এমন জিজ্ঞাসায় মাঝপথে ঝুলন্ত অবস্থায় হাত যন্ত্রের মতো ঠায় কইরা রাখলো, চোখজোড়া সেই মুসিবতের পানে, মুসিবত ক্যাচাং শব্দে চেয়ার ঠেইলা হিলের খটাখট আওয়াজে চারপাশে মহা মুসিবত বানাইয়া কানের গোড়ার তল বরাবর দাঁড়াইয়া বাজখাঁই কণ্ঠে ‘তোরে খাইছি’ টাইপ কইরা বলে,
“এইটা জনাবের বেডরুম না, হোশে আসেন কইলাম, গড়বড়ি হইলে…”,
বাকিটা জিল্লুর কানে পৌঁছায় না, সে মুসিবতের হাতের খামচি হজম করতে করতে দ্রুত চশমাটা কব্জা করবার ধান্দায় লিপ্ত। ঘাড় সহ মাথা এমন সায় দিতেছে যে মুসিবত, ভাঁড়-সহ আর সকলেরই মনে হইলো গর্দান থেইকা আলগা না হইয়া পড়ে।
“আপনের সময় নেয়া শেষ হয়েছে জিল্লুর রহমান সাহেব?”    

ভাঁড়ের গলা থেইকা এমন স্বর যে জিল্লুর লোম খাড়াইয়া গেল, এরে আণ্ডারেস্টিমেট করা ঠিক হয় নাই, এ বুইঝা ফেলছে জিল্লুর চোখ পইড়া, ধুরো, ব্যাডার চোখে চোখ ফালানো ঠিক হয় নাই, এখন সে তারে সেইরকমই ট্রিট দিবো, আল্লারে, সুদ য্যান দেয়া না লাগে। কাঠগড়ার রেলিঙ্গে দুইহাতে মোনাজতের ভঙ্গি কইরা জিল্লুর নিজেরে অভয় দিতে থাকলো। ভাঁড়ের মতো স্যার নাকি স্যারের মতো ভাঁড়? জিল্লুর ভাবছে তো ভাবছেই। ভাঁড়, নো, সরি স্যার হবে, তার দিকে তাকিয়ে হুতুম প্যাঁচা মুখ, বলে উঠলো,
“শুরু করা যাক; জিল্লুর সাহেব, সামনের মানুষটার দিকে স্পষ্ট তাকিয়ে বলুন, আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন ইনিই আপনার হারিয়ে যাওয়া সন্তান?”


জিল্লুর রুমের চাইরপাশে তাকাইয়া নিল এক পলক, একটাই টেবিল আর তার ওইপাশে একটাই যখন বইসা আছে সেইটাই সম্ভাব্য প্রধান স্যার, সে কিছুক্ষন গলা খাঁতখুঁত করার অছিলায় কথা সাজাইলো, আবেগের টাচ দিতে একটু নাকি নাকি স্বর বাইর কইরা বললো,
“স্যার, ১ নম্বর- তার সাথে ওই মুসি… মানে ওর মায়ের চেহারার মিল আছে, সে তার সাথে হাইসা হাইসা পুরান দিনের আলাপ করছে, তখন সে স্বীকারে আসছে মানে তার সব মনে পড়ছে।“
“কী সেইসব স্বীকারোক্তি?”
“স্যার, আমি সব লেইখা আনছি, ক্রমানুসারে আপনের যাবতীয় আগ্রহের আহার পরিবেশিত হবে, আপনে শুধু সবর করেন, দেখেন কত সহজে আপনারে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে আছি।“
“জিল্লুর সাহেব, আপনি অপ্রয়োজনীয় কথায় এই বিশেষ রুমের সময় নষ্ট করছেন, আমাদের ভাড়া গুনতে হয়, আপনি কি চান সেইসবের দাম আমার অংশ থেকে কাটা হোক?”
“না না স্যার, ভুল বুইঝা শূলে…মানে সুদের হার বাড়াইয়েন না।“
“আবার আবোলতাবোল! স্মৃতিভ্রম আপনার সন্তানের না, আপনার হয়েছে।“
“ঠিক স্যার, এই জায়গায় আইসাই আমার সন্দেহ নিরসন হইছে যে আমার কথা যথাক্রমে না শুনলে আপনে এইটাই বলবেন, তবে আর যেন না বলেন তার পূর্বপ্রস্তুতি স্বরূপ আমি সঞ্চালক সাহেব কে অনুরোধ করবো আপনারে যেন মিউট কইরা রাখা হয়।“
জিল্লুর এইরকম একটা ভাবনা ভাইবা পেশ করতে যাবে এমন সময় স্যার বললেন,
“ওনার স্ত্রী মুন্নুজান রহমানকে ডাকা হোক, যেহেতু তিনিই বেশি সময় কাটিয়েছেন সন্তানের সাথে”
জিল্লুর প্রায় আহাজারির স্বরে চিৎকার করে বললো,“স্যার, স্যার, আর একটাও অপ্রয়োজনীয় কথা বাইর হবে না, আমি গুরত্ব বিবেচনায় ১০টা পয়েন্ট লিখছিলাম, আপনের সুবিধার্থেই আসলে, তা হোক, আপনে যে ঋণী হইতে চাইলেন না এইটাও একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে পরিগণিত হবে পাতিহাঁস পালায়…মানে ইতিহাস পালনে বুঝাইতে চাইতেছিলাম”

রুমজুড়ে ফিসফিস শব্দের আওয়াজ আর হালকা হাসির ছটা, স্যার যথাসম্ভব মুখ গম্ভীর রেখে জিল্লুরকে বললেন,
“নিজের মাকে চিনতে পারলে আপনাকে কেন চিনবে না? তাছাড়া ডাক্তারও তাকে স্বাভাবিক বলেছেন, আর একটা কথা, কারও মায়ের স্বামী হলেই প্রমাণ হয় না তার পিতৃত্ব।”

দড়াম করে উঠে দাঁড়ালেন স্যার, হাত তুলে জিল্লুর কে থামতে বলার ইঙ্গিত করতেই সে দুইহাতে মুখ ঢেকে হতাশার ভঙ্গিতে হেলান দিলো কাঠগড়ায়, অস্ফুটে বলতে থাকলো,
“স্যার, দাঁড়াইয়েন না প্লিজ, ওই চেয়ারের অসন্মান আপনের অসন্মান, দুনিয়ার আসল বিচারক যদি দয়াবান হয় আপনে কোন ছার আইছেন স্যার”
স্যার হতাশ হবার ভঙ্গী করে বসে পড়লেন চেয়ারে, পানি দিতে ইশারা করলেন, জিল্লুর আঙ্গুলে গুনে তিন ঢোকে পানি খেলো, বললো,
“ধর্মাবতার, আমি ১০ পয়েন্টের উপসংহারে চলে যাইতেছি আপনার প্রতি দয়াপরবশত, আপনে ঠিক সময়ে পানির অর্ডার করছিলেন বইলাই গলা শুকাইয়া এখনও মরি নাই”
“জিল্লুর সাহেব, আপনার কাছে হাতজোড় করছি, আসল কথাটি বলেন?”
“ও ইয়েস ইয়েস স্যার, বলতেছি, কথা একটাই, যদিও তার ভিতরে আরও একশ একটা কথা আছে, কিন্তু খেয়ালে রাখবেন যে আমি ওই একশটা বাদ দিয়া বাকি একটা বলতেছি তা না, আমি একশ একটা জোড়া দিয়া আসল একটা কথাই বলবো- আমার সন্তান তার মা কে চিনছে, আর তার মা যেহেতু আমার স্ত্রী তাই স্বভাবতই আমি তার বাবা”

রুমজুড়ে ফিসফিস শব্দের আওয়াজ আর হালকা হাসির ছটা, স্যার যথাসম্ভব মুখ গম্ভীর রেখে জিল্লুরকে বললেন,
“নিজের মাকে চিনতে পারলে আপনাকে কেন চিনবে না? তাছাড়া ডাক্তারও তাকে স্বাভাবিক বলেছেন, আর একটা কথা, কারও মায়ের স্বামী হলেই প্রমাণ হয় না তার পিতৃত্ব।”

জিল্লুর আপ্রাণ চেষ্টা করে ভাববার যে আর কী কী বলা যায়, সে এখানেই থামিয়ে দিতে চায় না এই প্রসঙ্গ, আজ এই মুহূর্তেই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে, হারানো সন্তানকে কিছুতেই দ্বিতীয়বার আর হারাতে চায় না সে, বাচ্চাটা বান্দর অনেক, সবসময় লেগপুলিং করতো, মজা লইতো বাপেরে লইয়া, সে স্যারের চোখে চোখ রেখে দ্রুত বলতে থাকে,
“বিশ্বাস করেন স্যার, ওভার নাইট রুমের ভাড়া আমি দিমুনে, আপনে একটু সময় দ্যান। আপনে আমার ডিএনএ টেস্ট করানোর ব্যবস্থা কইরা দ্যান, প্রমাণ হইয়া যাইবো”

রুমজুড়ে ফিসফিস আর মৃদু হাসির শব্দ, কেউ চেপে চেপে বলছে, এইসব পয়সা হইলেই করানো যায়, জিল্লুর হাতজোড়া অজান্তে নিজের দুই কান চেপে ধরলো, সে উঁচু স্বরে বলতেই থাকলো,
“আমার ডিএনএ টেস্ট করানো হোক। আমার ডিএনএ টেস্ট করানো হোক”,

দমাদম দরজায় ধাক্কার সাথে জিল্লুর তাকালো রুমের দরজার দিকে, কাউকে খুলতে বলে তাকিয়ে দেখে টেবিল সহ রুমের লোকজন হাওয়া, নিজেই কাঠগড়া থেকে নেমে দরজা খুললো,
“ওহ মুসি…মানে মুন্নুজান, এইটা কাঠের দরজা না, প্লাইউড, এইটারে মাইরা আমারে মারার সুখ পাইবা না, কাঠের হইলেও কথা ছিল”
মুন্নুজান কাষ্ঠ হাসি মাইরা বললো,
“মুসি তো খারাপ না, মুতি তো কও নাই আফটার অল, কথা হইলো চিল্লাইতেছ ক্যান!”

জিল্লুর ঝিম মেরে বসে থাকে খাটের উপর, এতক্ষন ধরে ঘটা করে যেই ঘটনায় চিল্লাইতেছিল সেইটা কই ঘটছে ঠাহর করার চেষ্টা করতেছে, মাথায় এখনও সেই কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বাচ্চাটার মুখ। গভীর কষ্টের বোধ গলার স্বর থেকে যেন টুপটাপ কইরা ঝইরা পড়া শুরু করলো সে বলা শুরু করতেই,
“বাচ্চাটারে স্বপ্নে দেখছি, হারাইয়া গেছিল দূরে কোথাও, খুঁইজা পাইছি কিন্তু সে আমারে চিনে না, আমি আদালতে দাঁড়াইয়া চিল্লাইতেছি আমার ডিএনএ টেস্ট করানোর জন্য।“
মুন্নুজান গভীর মমতায় জিল্লুর হাতে কফির কাপ তুইলা দ্যায়, ধীরে বলে,
“যারে নিজের হাতে মাটি ভইরা পুইতা রাইখা আসছো সে আবার পাওয়া গ্যাছে এমন ফ্যান্টাসি তুমি কেমনে করো? এই যে তার নাম থেকে শুরু কইরা সমস্ত কিছু আদাজল খাইয়া মুছতে শুরু করছো, আড়ালে রাখতে চাইতেছ, এইটা তার নতিজা, বড় একটা ফটোগ্রাফ বাঁধাইয়া আনো, মরা মানুষের ছবি যেমন ঝুলাইয়া রাখে, তেমন কইরা রাখো, ক্যাপশন দিও ‘রিমেম্বারিং’।“

প্রচ্ছদের ফটোগ্রাফ: Judiciary: Farewell Appearance, published in the June 7, 1937, edition of Time magazine, within an article.
অলঙ্করণ: বৈশালী

রহিমা আফরোজ মুন্নী
রহিমা আফরোজ মুন্নী


কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক। জন্ম ২৬ এপ্রিল, ১৯৭৪, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলায়। ইডেন কলেজ থেকে ইতিহাসে এমএ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আলিলুয়েভার বাগান’ (২০১৪), উড্ডীন নদীর গান’ (২০১৫), ‘দি নিউ রহিমা পদ্যবিতান’ (২০১৬), ‘মগজে ছাতা’ (২০২০)। উপন্যাস ‘কালো মানুষের কারনামা’ (২০১৮)।

Share