আজ বৃহস্পতিবার, ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

রাজা বেবুদ ও চম্পারাণী কাহিনী

(কাহিনী কাব্য)

।। চঞ্চল বাশার ।।

দিঘির গভীরে যত নামে চম্পারাণী
ততই উঠছে আবে হায়াতের পানি!
ধন্য ধন্য করছে প্রজা চম্পা নাম ধরে
এদিকে ভাসছে রে চম্পা ঢেউয়ের তোড়ে!

রাজা বেবুদ ও চম্পারাণী কাহিনী
(কাহিনী কাব্য)

জনশ্রুতি আছে , তেরো শতকের দিকে এগারসিন্দুর শাসন করতেন বেবুদ নামে এক আদিবাসী রাজা । প্রজাহিতৈষী রাজা হিসেবে তিনি ঐ অঞ্চলে সুবিদিত। বেবুদ রাজার শাসনামলে একবার এগারসিন্দুরে প্রচণ্ড খরা দেখা দিয়েছিলো। তিনি প্রজাদের পানির অভাব দূর করার জন্য প্রাসাদ সম্মুখে এক বিরাট ও সুগভীর দিঘি খনন করেছিলেন। প্রজার কল্যাণ সাধনে দিঘিকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় বেবুদ রাজা ও চম্পারাণীর আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী কাহিনী,যা আজও মানষের মুখে মুখে ফেরে

দুর্বিষহ সূর্যজ্বলা খরার বছর
যতদূর দৃষ্টি যায় ধু ধু বালুচর
মেঘ শূন্য অগ্নিঝরা গোটা আসমান;
ফসলের মাঠ খা খা, ধূসর, বিরান।
বৃত্তাকারে শূন্যে ওড়ে ডানাপোড়া চিল,
তীব্র দাবদাহে ফাটা খাল আর বিল
এগার নদীর ধারা উজান-ভাটির,
শিমুল ফলের মতো ফাটিয়া চৌচির!
দিকে দিকে পানি চেয়ে আর্ত হাহাকার
তৃষ্ণাকাতর প্রজারা চেয়ে প্রতিকার
আসে বেবুদ রাজার কাছে, ‘একি হায়
হাবিয়াদোজখবাসী অশ্রু চেটে খায়!–
মেঘ নাই, বৃষ্টি নাই, রোদের শাসানি!’–
কান পাতলেই শুনতে পান রাজা–
‘পানি! পানি! পানি!’

প্রজাসাধারণের পানির অভাব দূরীকরণের উপায় নিয়ে চিন্তা করতে করতে অবসন্ন রাজা এক রাতে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ভেতর বেবুদ রাজা জলদেবী কর্তৃক স্বপ্নাদেশ পেলেন, প্রাসাদ সম্মুখে দিঘি খনন করলে পানির অভাব দূর হবে। জলদেবীর স্বপ্নাদেশ মোতাবেক রাজা দিঘি খননের সিদ্ধান্ত নিলেন।

জলদেবীর সম্মানে পুরোহিত দ্বারা
করে নিয়ে পুজাপাঠ-স্তুতি আর মন্ত্র–
সূর্যের উদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত
খনন করেন দিঘি, সহস্র শ্রমিক–
উঠে আসে মাটি আর বালি চিকচিক।
সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, পেরোয় রে মাস
খনন করছে দিঘি, পানির তিয়াস।
মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তারা চলছে পাতালে
এক ফোঁটা জল আহা কভু নাহি মেলে!
রাজ্য জুড়ে কানাঘুষা, অধম সে রাজা
রাজার কারণে যদি প্রজা পায় সাজা!
খাওয়া নেই দাওয়া নেই চিন্তিত বেবুদ
পাতাল খুঁড়েও নাই জলের বুদবুদ!
পুনশ্চ, দেখেন রাজা ঘুমেতে স্বপন
জলদেবী করলেন নির্দেশ, ‘যখন
থেকে চম্পা নামবে ঐ দিঘির গভীরে
স্বচ্ছজল উঠে আসবে বন্ধা মাটি চিড়ে,
দিঘিতে উঠবে পানি দরিয়া সমান
চিরতরে জলে রাণী হবে অন্তর্ধান!’

রাজা রাণীর কাছে জলদেবী কর্তৃক পাওয়া স্বপ্নাদেশ বর্ণনা করলেন। দেবীর স্বপ্নাদেশে রাজা দুঃখ কষ্টে মুষড়ে পড়লেন। একদিকে প্রিয়তমা রাণীকে চিরতরে হারানোর বেদনা আর অপরদিকে বিপদগ্রস্ত প্রজাদের প্রতি রাজার কর্তব্যের স্বীয় অঙ্গীকার রক্ষার দায়! এমতবস্থায় এগিয়ে আসলেন স্বয়ং রাণী, রাজাকে অভয় দিয়ে রাণী জানালেন রাজার রাজকর্তব্য রক্ষা ও বিপদগ্রস্থ প্রজাদের মঙ্গলার্থে আগামীকাল প্রতুষ্যেই কলসি কাঁখে রাণী দিঘিতে নামবেন।

চারদিক গুমগুম, বেজে ওঠে ঢাক
কুলবধু যারা দিচ্ছে উলুধ্বনি, হাঁক–
সালাম করলেন রাণী হৃদয় পতিকে
ত্রস্ত্র রাজা, চম্পা চলে পাতালের মুখে!
পিছনে রইল পড়ে জগৎ সংসার
নিয়তি পাষান হল, কেমন বিচার!
এক পা দুই পা করে চম্পা চলছে পাতালে
দুগ্ধপুষ্য শিশু কাঁদে ধাইমা’র কোলে!
দিঘির গভীরে যত নামে চম্পারাণী
ততই উঠছে আবে হায়াতের পানি!
ধন্য ধন্য করছে প্রজা চম্পা নাম ধরে
এদিকে ভাসছে রে চম্পা ঢেউয়ের তোড়ে!
মেঘকালো কেশগুচ্ছ পাক খায় জলে
হারিয়ে গেলেন রাণী দিঘির অতলে!
কোথা গেল চম্পারাণী জনমের তরে
মূর্ছিত বেবুদ রাজা দিঘিরও পাড়ে
হায় হায় রব ওঠে গগন বিদারী
প্রজার কল্যাণে কোরবান, চম্পারাণী!
রাজা নাই রাণী নাই দিঘি বর্তমান
লোকসমাজে চম্পারাণী হলেন মহান।

চিত্রাঙ্কন- সাইদ উজ্জ্বল

চঞ্চল বাশার

জন্ম ১৯৮৭ সালের ১৯ এপ্রিল হাওরের দেশ হিসেবে খ্যাত কিশোরগঞ্জের গচিহাটায়| প্রকাশিত কবিতাকিতাব ‘স্বেদে ও শোণিতে’ (২০১৮) তিনি কবিতাচর্চার পাশাপাশি গান রচনা করেন ও সুর দেন|

Share

1 thought on “রাজা বেবুদ ও চম্পারাণী কাহিনী”

  1. গৌরাঙ্গ হালদার

    সরল ও সুগভীর! ছন্দের দোলা অনবদ্য। জাতির ভাবসম্পদ হিসেবে এই কাহিনিকাব্য অতুলনীয়। কাহিনির বর্ননায় হিন্দু মুসলমানের মেটাফোরগুলোর মিলন ঘটানো অপূর্ব সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিকভাবে তো বটেই।
    কবিকে সালাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top