।। ফরিদা আখতার ।।
“ভাওয়াইয়া গান রেকর্ডে, রেডিওতে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রথম পুরুষ কন্ঠেই শোনা গিয়েছে, তাই ধরেই নেয়া হয়, ভাওয়াইয়া গান বুঝি পুরুষের গান। কিন্তু গানের কথা এবং ভাব পুরুষের নয়, নারীর। হিজ মাস্টার্স ভয়েসে রেকর্ডকৃত আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠে গাওয়া ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’ একসময় ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল (আব্বাসউদ্দীন, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৫৩ – ৫৭)। এই গানগুলোর কথা পুরোটাই নারীর। আব্বাসউদ্দীনের কৃতিত্ব ছিল যে নারীর মনের বিরহ সুরের এবং কন্ঠের ভাঁজে ভাঁজে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে এটা পুরুষ কন্ঠের গান হলেও তাতে কারো গানের ভাব বুঝতে অসুবিধা হয় নি। আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠের মাধুর্য এবং গায়কীর কারণে তা হতে পেরেছে, সন্দেহ নেই।”
ভাওয়াইয়া গানে নারীর জীবন ও তার নিজ সত্তা
উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গান সকলের খুব প্রিয়। গানের ভাব ও সুরের দিক থেকে ভাওয়াইয়ার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। আব্বাস উদ্দীনের ভাওয়াইয়া বাংলাদেশীদের মনোগঠনে যেমন একটা ভূমিকা রেখেছে, তেমনি রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে সঙ্গীতচর্চাকে সাংস্কৃতিক জীবনের অন্তর্ভূক্ত করে নেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একইভাবে নজরুলের ভূমিকাকেও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দেয়াল ভাঙার দিক থেকে বোঝার দরকার আছে। তাঁদের দুজনের ভূমিকা গভীর ও সুদূর প্রসারী। তাঁদের অবদান বুঝতে হলে শুধু সঙ্গীতের পরিমণ্ডলে বিচার করলে চলবে না। ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের নজর দিয়েও বুঝতে হবে। (আব্বাসউদ্দীন, ১৯৯১)
গানের ভাব, গায়কী ও আঙ্গিকের দিক থেকে ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গের গান। বিশেষ করে বাংলাদেশের রংপুর , ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং আসামের অবিভক্ত গোয়ালপাড়ার। পরস্পর সন্নিহিত ভূখণ্ডের বিশাল অঞ্চল জুড়ে ভাওয়াইয়া বিস্তৃত। ভাবের দিক থেকে বিরহ ভাওয়াইয়া গানের প্রধান অনুরণন। তবে আধুনিককালে সামাজিক, পারিবারিক কৃষি ও অন্যান্য বিষয়ও ভাওয়াইয়া গানে ঢুকে পড়েছে।
অনেকে দাবি করে ভাওয়াইয়া গ্রামীণ খেটে গাওয়া মানুষের গান, সেটা আংশিক সত্য। আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ গড়ে ওঠার আগে খেটে গাওয়া মানুষের গান হিশাবে না ভেবে ভাওয়াইয়াকে সাধারণ ভাবে বাংলার বিরহ কাতর ভাবজগতের অন্তর্গত গণ্য করলে ভাওয়াইয়ার তাৎপর্য আমরা সহজে ধরতে পারব। সেই দিক থেকে নদিয়ার বৈষ্ণব আন্দোলনের ধর্ম চেতনা ও দার্শনিকতা কিম্বা তার ধারাবাহিকতায় পরবরতীকালে শক্তিশালী ফকিরি ধারা চর্চার মধ্যে নদিয়ার ভাবের যে বিকাশ আমরা দেখি ভাওয়াইয়া গানে ভাবের সেই চিন্তাশীল রূপ আমরা দেখি না। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রেম এবং বিরহকাতর আর্তি ভাওয়াইয়া গানে যতো গভীর ও রপ্ত তার স্বাদ স্বতন্ত্র। সাধারণ মানুষের বিরহবোধ আশ্রয় করে বিরহের কাতরতা এবং যাতনা ভাওয়াইয়ার সুরে ও ভাবে তীব্র ভাবেই হাজির দেখা যায়। এই দিক থেকে থেকে বলা যায় নদিয়ার ভাব পরিমণ্ডলের সঙ্গে ভাওয়াইয়ার আন্তরিক যোগ আছে। কিন্তু ভাওয়াইয়ার মাধুর্য হোলো সাধারণ মানুষের আর্তি ভাওয়াইয়া খুবই সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ধরতে সক্ষম। এখানেই ভাওয়াইয়ার স্বাতন্ত্র। সাধারণ মানুষের গান বোঝাতেই একে অনেকে খেটে খাওয়া মানুষের গান গণ্য করেন, যে শ্রেণী আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী থেকে আলাদা।
ভাওয়াইয়ার নায়ক মাহুত কিংবা মহিষের গাড়ির গাড়িয়াল। উত্তরবঙ্গ, কুচবিহার ও আসামের ভূগোল ভাওয়াইয়ার ভাবের পরিমণ্ডল। ভাওয়াইয়াকে তাই ভৌগলিক ভাবে চিহ্নিত করা যায়। আমরাও বুঝতে পারি ভাওয়াইয়া বৃহত্তর উত্তরবঙ্গ ও আসামের গান। সাধারণ মানুষের আর্তি এখানে একাকী নারীর বিচ্ছিন্নতা, নৈঃসঙ্গ এবং একাকীত্বের বেদনা হিশাবে এই গানে প্রকাশিত হয়।
ভাওয়াইয়া নামটি কীভাবে তৈরি হোলো তার নানান ব্যাখ্যা আছে। ঝোপঝাড় ও অন্যান্য উদ্ভিদে আকীর্ণ নিচু ভূমিকে ‘ভাওয়া’ বলে। যারা এই ধরনের জমিতে মহিষ পালতেন বা চরাতেন তারা তারা লাঙ্গল দিয়ে চাষের সময় এক ধরণের গান গাইতেন। ভাওয়াইয়া নাম সেখান থেকে হতে পারে। অনেকে আবার বলেন, ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দটি ‘বাওয়াইয়া’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। যাতে মনে হয় ‘বাও’ (বাতাস) শব্দধ্বনি থেকে এর উদ্ভব। ভাওয়াইয়া গানের সুলতান আব্বাস উদ্দিনের মতে, ‘ভাওয়াইয়া’ নামের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের এলোমেলো কিন্তু কোমল এবং মনোরম বাতাসের সম্পর্ক আছে। তাই এর নাম ভাওয়াইয়া। সঠিক হোক বা নাহোক এই ব্যাখ্যা ভাওয়াইয়া গানে বিরহের আর্তি ও আবেগকে বিশেষ মান্যতা দেয়। বাংলাদেশের জনগণ ছাড়াও ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গে কোচ রাজবংশীদের গান। এখন অবশ্য সকলেই এই গান করেন।
ভাওয়াইয়াকে ‘পল্লী গান’ বা ‘লোকগীতি’ বলা হয়। আধুনিক গান অগ্রসর ও সামনের সারির নাম, কিন্তু তথাকথিত পল্লীগীতি যেন প্রান্তিক আধুনিকতার বাইরের সংস্কৃতি। আধুনিক গান শহুরে স্মার্ট মানুষদের গান, ভাওয়াইয়া অশিক্ষিত পল্লীর অখ্যাত কবি লেখক গীতিকারদের রচনা। । এই বিভাজন ধর্তব্য নয়। ভাওয়াইয়া গানকে পল্লীগান বা আঞ্চলিক গান হিশেবে দেখা ঠিক না। ভাওয়াইয়া গানের সঙ্গে নারীর জীবনের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাই সেই দিকটা আমরা যারা নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত তাদের বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে। আমার এই নিবন্ধটি লেখার তাগিদও সেখান থেকে তৈরি হয়েছে। সবাই একইরকম ভাবেন কিনা সন্দেহ আছে। কারন আধুনিক নারীবাদ নারীকে সামাজিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক সত্তা হিশাবে বিচার বা করে দ্রুত নারীর দেহকে প্রধান করে তোলে। তাই গবেষক হিশেবে অনেকের কাছে ভাওয়াইয়া গান নারীর বিরহ এবং যৌন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের একটি রূপ। এতে ভাওয়াইয়া গানকে সংকীর্ণভাবে দেখা হয়। নারীকে সামগ্রিকভাবে দেখা বোঝা জানার কাজটা দেহের বিচারে এসে ঠেকে। সমাজ, অর্থনীতি সংস্কৃতি ইত্যাদি থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু নারীর দেহ বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পায়।
ভাওয়াইয়া গান রেকর্ডে, রেডিওতে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রথম পুরুষ কন্ঠেই শোনা গিয়েছে, তাই ধরেই নেয়া হয়, ভাওয়াইয়া গান বুঝি পুরুষের গান। কিন্তু গানের কথা এবং ভাব পুরুষের নয়, নারীর। হিজ মাস্টার্স ভয়েসে রেকর্ডকৃত আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠে গাওয়া ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’ একসময় ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল (আব্বাসউদ্দীন, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৫৩ – ৫৭)। এই গানগুলোর কথা পুরোটাই নারীর। আব্বাসউদ্দীনের কৃতিত্ব ছিল যে নারীর মনের বিরহ সুরের এবং কন্ঠের ভাঁজে ভাঁজে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে এটা পুরুষ কন্ঠের গান হলেও তাতে কারো গানের ভাব বুঝতে অসুবিধা হয় নি। আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠের মাধুর্য এবং গায়কীর কারণে তা হতে পেরেছে, সন্দেহ নেই। আমাদের এও মনে হতে পারে সে সময় নারীদের গান, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের মুসলিম নারীর কন্ঠে গান রেকর্ড করা সম্ভব ছিল না বলেই আব্বাসউদ্দীন এই গান গুলো নিজের কন্ঠে ধারণ করে রেখেছিলেন। যদিও ভারতের উত্তরবঙ্গের হিন্দু নারীর কন্ঠে অনেক আগে থেকেই এই গানগুলো পাওয়া যায়।
ভাওয়াইয়া গানে গ্রামের নারীর আকুতি এক অজানা মৈষাল, গাড়িয়াল, রাখাল, নাইয়া, বৈদ, চেংড়াবন্ধুসহ বিভিন্ন পেশার পুরুষের জন্যে প্রেমের প্রকাশ, মিলনের ব্যাকুলতা বা বিচ্ছেদ বেদনা। কিন্তু তাই বলে এই গানগুলোর রচয়িতা নারী, এমন কোন প্রমাণ নেই। বরং দেখা গেছে ভাওয়াইয়া গানের গায়কও পুরুষ, আর রচয়িতাও পুরুষ। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে “ভাওয়াইয়া গান রচনায় ও চর্চায় নারীর ভুমিকা একেবারেই নেই, একচেটিয়া পুরুষেরই প্রাধান্য” (আহমদ, ১৯৯৫)। এর কারণ হিশাবে বলা হচ্ছে “ইহা স্ত্রী-প্রধান বা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ জীবন হইতে উৎসারিত হইয়াছে (ভট্টাচার্য, ১৯৬৫, পৃষ্ঠা ২৬৩)। অর্থাৎ উত্তরবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের জনজীবন, প্রকৃতি-পরিবেশ ও ভাষা, জীবনযাত্রা প্রণালী, পুরুষদের নানা পেশা ইত্যাদি জড়িত। এটাও গবেষণায় দেখা গেছে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও কোচরা এই ভাওয়াইয়া গানের ধারক ও বাহক। তারা মাতৃতান্ত্রিক ছিল, এই সমাজব্যবস্থায় পরিবারের নারীর কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা বেশী থাকে (আহমদ, ১৯৯৫)।
পুরুষের রচনায়, পুরুষের কন্ঠে গাওয়া ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে নারীর আকুতি ফুটিয়ে তোলার অর্থ হতে পারে যে পুরুষ নিজেই কল্পনা করতে চায় নারী তার জন্যে কেমন ভাবে প্রেম প্রকাশ করছে, বিরহে ভুগছে। এটা হয়তো পুরুষেরই আকুতি নারীর প্রেম পাওয়ার জন্যে। যারা ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’ বা ‘তোরষা নদীর উতাল পাথাল’ গানের মধ্যে নারীর সাহসী প্রেম প্রকাশিত বলে মনে করেন তাদের আরও একটু গবেষণার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মুসলমান সমাজে এক পর্যায়ে নারীর কন্ঠে ভাওয়াইয়া গান অনেক গাওয়া হয়েছে। ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’ আব্বাসউদ্দীনের কন্ঠে যেমন ছিল, তাঁর কন্যা ফেরদৌসী রহমানের কন্ঠে এসে বোঝা গেছে আসলেই গাড়িয়াল ভাইয়ের জন্যে নারীর আকুতিটা কেমন ছিল। অনেক ভাওয়াইয়া গানের রচয়িতা আব্দুল করিম। তাঁর কন্যা নাদিরা বেগম ভাওয়াইয়া গান গাওয়ার মধ্যে নারীর আর্তি ফোটাতে পেরেছেন। একে একে আরও অনেক নারীর ভাওয়াইয়া গান রেডিও, টেলিভিশন এবং রেকর্ডে আছে।
কিছু কিছু গানে নারীর স্পষ্ট উচ্চারণ মেলে, সন্দেহ নাই। আমি পুরা গান উদ্ধৃত করছি। বিশেষত গানের অন্তর্গত অনেক প্রতীক ও উপমার মানে সরাসরি বোঝার সুবিধার জন্য।
বাপুই চেংঙ্গারে গাছোত উঠিয়া দুইডা হা,
ও মোক জলপই পাড়িয়া দে
তুইও দুইডা নেরে বাপু মোক দুইডা দে
আরও দুইটা দেরে বাপুই আচারের বাদে
ওরে আরও দুইটা দেরে বাপুই ছাওয়ালের বাদে।।
তুই তো বাপুই চেংড়া মানুষ
কিছুই জানিস না হায় হায় [ কিছুই বুঝিস না]।
ওরে মুইও যে অবলা নারী
ও মোর মনটা মানে না।
তুই যে বাপু চেংড়া মানুষ চিকন কালা
হায়রে চিকন কালা
ওরে মুইও যে অবলা নারী
আলাভোলা হা।
তুই রে বাপুই বাজাছ বাঁশি
ঐ না কদমতলা
ওরে মুই নারীটা আসুম জলে
ঐ না সাঁঝের বেলা।
জলপাই গাছ বেশ উঁচু, জলাপাই পাড়তে হলে ছেলেদের সাহায্য লাগছে। কিন্তু মেয়েটি এখানে ছেলেটিকে জলপাই পাড়ার অনুরোধ করতে গিয়ে সমান ভাগের প্রস্তাব দিচ্ছে। ‘তুইও দুইডা নেরে বাপু মোক দুইডা দে’ সহ জ হিশাব। গানের শুরুটা এতোই কাজের কথায় ভরা যে বোঝার উপায় নাই যে মেয়েটি বাঁশী বাজানো চেংড়া ছেলেটিকে আসলে ভালবাসে এবং তার জন্যে সাঁঝের বেলা সে জলের ঘাটে আসবে।
পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে নারী অবস্থা বোঝার জন্য এই গানটি অতুলনীয়।
ওরে দোলা মাটির মন বথুয়ারে শাক বথুয়া হলফল করে
ও মোর বথুয়া হলফল করে।
ওরে সেই শাক তুলিবার গেনু ছাওয়া কোলত নিয়া
শাক তোলা মোর যেমন তেমন ফাটিয়া যায় মোর হিয়া।
ওরে সেই শাক আন্দি মুই তাইতে না দেও মরিচ
ওরে মরা কমর ঝোলা ছাওয়াটা মোর ধরিস।।
ওরে সেই শাক আন্দিয়ে মই তাইতে না দেও নুন
হামার বাড়ির বুড়াটার গুদুরগুদুর শুন।।
ওরে সেই শাক আন্দি মুই তাইতে না দেও জিরা
পেন্টি দিয়া এককে ডাঙ্গে ভাংলো হাতের গিরা।।
এতা করি আন্দিনু শাক তাহ না মুর নাম
ছাড়ি দে গোলামের বেটা বাপের বাড়ি যাং।।
এই গানের কথা পুরুষ লিখেছেন কিনা জানি না। খুব সম্ভব নারীদের গাওয়া গান সংগ্রহ করে কোন পুরুষ গানের রূপ দিতে পারেন। এই গান বাংলাদেশে ইউটিউবে রেকর্ডকৃত পাওয়া যায় নি, তবে ভারতের শিল্পীদের গাওয়া এই গান ইউটিবে (একটু কথার হেরফের আছে) পাওয়া যাচ্ছে। বথুয়া শাক তোলা থেকে শুরু করে রান্না পর্যন্ত বর্ণনায় গরিব পরিবারের নারীর কাজের একটি চিত্র পাওয়া যায়। হয়তো তার নিজস্ব জমি নেই, কিন্তু বথুয়া শাক অন্যের জমি থেকেও তুলে আনা যায় কারণ এই শাক অনাবাদী। অন্য ফসলের জমিতে বিশেষ করে গমের ক্ষেতে কিংবা অন্যান্য শীতকালীন সব্জি ফসলের সাথে বেড়ে ওঠে। গরিব মানুষ ভাতের সাথে এই অনাবাদী শাক খেয়েই থাকে। তবে গানটি শুধু শাকের কথায় কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এই নারীর বিয়ে হয়েছে একজন ‘বুড়া’র সাথে (বলা যায় দুই জনের বয়সের বড় পার্থক্য আছে, যা খুবই দেখা যায়), কাজের মধ্যে সন্তান দেখাশোনা, রান্নাবাড়া করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হচ্ছে নারী নির্যাতন মানসিকভাবে (গুদুর গুদুর শোনা) এবং শারিরীক (পেন্টি দিয়া হাতের গিরা ভেঙ্গে দেয়া) নির্যাতন। এতো নির্যাতনের পরে কিন্তু নারী চুপ করে থাকে নি। সে তার মতো করে সংসারের কাজ করার চেষ্টা করেছে যদিও নুন, মরিচ ও জিরা না দেয়ার মতো ভুল হয়েছে। অর্থাৎ সংসারের কাজের নারীর ভুলও থাকতে পারে, তাই বলে এতো নির্যাতন মেনে নেয়া যায় না। তাই গানের শেষ অন্তরায় সে বলে দিতে পেরেছে ‘ছাড়ি দে গোলামের বেটা বাপের বাড়ি যাং’। স্বামীর নির্যাতনে তার বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেয়েছে স্বামীকে ‘গোলামের বেটা’ বলে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে। এই বিষয়টি শহরে মধ্যবিত্ত নারীবাদীদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে, কারণ তারা এই পর্যায়ের নারীদের নির্যাতনের ভিক্টিম হিশেবে দেখতে চায়। অথচ নারীর এই ঘুরে দাঁড়ানোর ধারা গ্রামের নারীদের মধ্যে যথেষ্ট প্রবল। তারা নির্যাতন সহ্য করে ঠিকই, কিন্তু রুখে দাঁড়ানোটাও ঘটে। সে কেবল একজন ভিক্টিম নয়।
কিছু বিষয় ভাওয়াইয়া গানে উঠে আসে যা আমরা সাধারণত ভাবি না। যেমন বাবা ও মেয়ের কথা কিম্বা মেয়ের প্রতি বাবার স্নেহ। এই গানটি যেমন।
আজি বিহানে উঠিয়া, বাসি কাম সারিয়া
গোবর ফেলায় মোর ময়নামতি মাইয়া
থালি খোরা মাঞ্জিয়া গা’ও খানা খান ধুইয়া
যায় মাইয়া মোর আন্ধোন ঘর লাগিয়া।।
আকালি পুড়িয়া পিঁয়াজ ও কাটিয়া
পন্তা দেয় মোক শুক্তা বর্তা দিয়া ।।
পানে তে চুন মাখি গুয়ায় দেয় মোক ফাকি ফাকি
হুক্কা দেয় মোক ভুতের আগুন দিয়া।।
হাল বাম মুই মাঠেতে গরু চড়াও মুই ঘাটেতে
দোম নেও মুই ছিয়াতে বসিয়া ।।
সাধারণত মনে করা হয়, কৃষক পরিবারে কন্যা সন্তানের কোনো গুরুত্ব নাই। বিশেষ করে কৃষি কাজে মেয়েরা বুঝি বাবাকে কোনো সাহায্য করতে পারে না। তাই তাদের পুত্র সন্তানের খুব দরকার হয়। ভাওয়াইয়া গানের বৈশিষ্ট্য অনুযায় গানটিতে একদিন সকালে গরিব কৃষক এবং তার মেয়ে কী করছে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। গানটির কথা বাবার দিক থেকে আসছে। সে তার কন্যার কাজগুলো দেখছে এবং তার ‘ময়নামতি মাইয়া’ কতভাবে তাকে সাহায্য করছে তার একটি স্নেহমাখা বিবরণ ফুটে উঠেছে। কন্যা সন্তানের প্রতি বাবার আচরণ নিয়ে উন্নয়ন মহলে অনেক নেতিবাচক ধারণা তৈরি করা হয়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অধিক কন্যাসন্তান জন্মদানের অপরাধে অনেক নারীকে সংসার হারাতে হয়েছে। সেটা একটা চিত্র, কিন্তু অন্য চিত্রও যে আছে তা কদাচিত তুলে ধরা হয়। এই গান এখানেই শক্তিশালী যে বাবার কাজে মেয়ে এতো গভীর ভাবে জড়িত তা নানা উপমা দিয়ে বোঝানো হয়েছে, এবং শেষে বাবা মেয়ের কারণেই ‘ছিয়াতে’ বসে দম নিচ্ছেন। এক শান্তির পরিবেশ।
বিবাহিত নারী তার ভাই বাড়িতে এলে বাবার বাড়ি যাবার জন্য তার আকুতিটুকু এই গানে ব্যক্ত।
উটুতকার আসিছে বাড়ি শুত করিয়া কং
দাদা আসছে নিয়া যাবার নাইওর যাবার চাং
ওরে মজার দিনে আচ্চে দাদা যদি বা না যাং
গোসা হয়ে যাইবে দাদা কথাটা কেমন করিয়ে কং।
মনটা মোর একবার আগাই সাতবার পাচায়
হলুকচুলুক করে মন মোর যাবারে না চায়
ওরে সকাল থাকে বড় দাদায় খেচখেচেয়া আছে
চটকরি বেরাম নাউয়র বেলাটা ভাটিত পরিছে।
ডেলস করি একবতল তেল মাথাত দিলুং ডালি
তেল মাখিয়া সিতা ফারিয়া খোপা বাধিলং তুলি
আলতা সনো পাউডার দিলুং আয়না হাতত নিয়া
কামিসেদুনে ফটা দিলং কপালত নেলভেল করিয়া।
হাটিয়া যায় ফিরে যায় টেরচোখে দেখং
মাথার ঘোগর ফেলেয়া দিয়ে এশারা করি কং
ছল করিয়া দাদা কলুং আটিক ধিরে ধিরে
গোয়াপানের টোপলা কোনা চারিচ বিচিনার উপরে ।
আন্নাছলায় তাকে কয়া ঘুরি আসিলং বাড়িত
ঘরত সনদায়া বিচিনাত আছে পড়ি
গাও ঝকাইয়া কয়ডা কথা কলং ধিরে ধিরে
চোখ মুজিয়া দুইটা রাতি থাকে কোন রখমে
গ্রামের বিয়ে হয়ে যাওয়া নারীর নিজের ইচ্ছায় বা নিজ উদ্যোগে বাবার বাড়ি নাইয়র যাওয়ার সুযোগ কম। তার ভাই (দাদা) নিতে না আসলে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় না। আগেভাগে খবর দিয়ে ভাই বোনের শ্বশুর বাড়ীতে আসতে পারেন না। তাই ‘হঠাৎ’ করেই আসা হয়ে যায়। এই গানে দেখছি সে সময় নারী কি করে স্বামীর কাছে নাইয়র যাওয়ার ব্যাপারটি তুলে ধরছে। দাদা হঠাৎ আসলেও তার সাথে নাইওর যেতে হবে, নইলে দাদা ‘গোসা’ হয়ে যেতে পারে।
এক হিশেবে দেখা যায় নারী কিন্তু স্বামীর কাছে অনুমতি চাইছে না, কারণ নাইয়র যাওয়া তার অধিকার। যদিও স্বামীর বাড়ীর কাজ, স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার তাকে দেখতে হয়। নারী সেই সব বিষয় মাথায় রেখেই তার দাদার সাথে যাবার কথা স্বামীকে বলছে। তবে অনুমতির অপেক্ষা না করেই ইতিমধ্যে তার প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে; মাথায় তেল মাখা, আলতা স্নো পাউডার দেয়াও হয়েছে। কপালে সিঁদুর দেয়া বাপের বাড়ী যাবার সময় তার অহংকার। একজন মুসলিম নারী হলে সেও তার নাকের নাকফুলটি আরো ভাল করে পরে নেয়, হাতের বালা পরতেও ভোলে না। স্বামীর ঘরে ভাল আছে এই কথা বাপের বাড়িতে তুলে ধরতে হয়, তাই দাদাকেও বলা যাবে না স্বামীর কোনো আপত্তির কথা। সব কিছু মিলিয়ে স্বামীর বাড়ীতে দাদা আসা নারীর জন্যে কতো বড় ব্যাপার এবং দাদা আসছে অতএব তাকে যেতেই হবে এটাও খুব প্রতিষ্ঠা করার বিষয়। আবার দাদাকেও দেখাতে হবে স্বামী তাকে যেতে দিতে চাইছে না, তার অর্থ হচ্ছে সে কত ভাল রেখেছে।
ভাইয়ের সাথে বিবাহিত বোনের সম্পর্ক অনেক দিক থেকেই দেখা যায়। মা-বাবা বেঁচে না থাকলেও বাপের বাড়ীর বোনকে নাইওর আনার কাজ মূলত ভাইকেই করতে হয়। এর জন্যে বাবার সম্পত্তিতে বোনের যতোটুকু অংশ আছে সেটার দাবীতেই মেয়েরা যেতে পারে এবং তার এবং তার স্বামী সন্তানের যত্ন-আত্তিও পাওয়ার অধিকার থাকে। মুসলিম পরিবারগুলোতে উত্তারাধিকার সম্পত্তিতে মেয়েরা ভাইয়ের অর্ধেক পেলেও সেটা তারা নেয় না, কখনো ভাইয়েরাও দেয় না। যারা নেয় না তাদের একটি যুক্তি হচ্ছে তারা চায় বাবার বাড়ীতে তাদের আসা-যাওয়ার অধিকার বজায় থাকুক। এমনকি কোনো মেয়ের যদি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, কিংবা স্বামীর মৃত্যু হয় তাহলে আবার যদি বাপের বাড়িতে ফিরতে হয়, তাহলে এই সম্পত্তির অধিকার তার কাজে লাগে। সেদিক থেকে ভাওয়াইয়া গান এবং অন্যান্য পল্লীগীতিতে ভাইয়ের জন্যে বিবাহিত নারীর যে আকুতি সেটা খুব লক্ষণীয়। শচিন দেব বর্মনের বিখ্যাত গান “কে যাসরে, ভাটি গাং বাইয়া, আমার ভাই ধনরে কইও নাইওর নিত বইলা” শুনে কে না কেঁদেছে। কে না চেয়েছে তার ভাইটি আসুক, তাকে একটু নিয়ে যাক। আবার আব্দুল আলীমের গাওয়া “নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা। অচেনা সায়ওরের মাঝি সেই কথা বইলা। ভাটির দেশে যাও যদি তুমি, হিজল তলীর ঘাটে, সেথায় আমার ভাইজান থাকে, আমার কথা কইও তাকে, মইলাম দুঃখে জ্বইলা…
ভাই নিজেই বোনকে অবহেলা করে আসছে না, এমনও হতে পারে। কিন্তু তবুও বোনের পথ চাওয়া ফুরায় না। মাঝিকে উদ্দেশ্য করে তাই এই সব গান নারী এই গানের মধ্যে অসহায়ত্ব থাকলেও নারীর নিজ সত্তাও ফুটে উঠছে। নারীকে যে বলা হয়, বিয়ের পর তার ঠিকানা শুধু স্বামীর বাড়ী এটা নারী মানে না। যেখানে তার জন্ম, যে পরিবারে তার বেড়ে ওঠা, সেটা সে ফেলে দিয়ে আসে না। ভাই-বোনের সম্পর্ক অনেক গভীর মমতার সম্পর্ক, সাথে আছে অধিকারের বিষয়। কেন সে বাপের বাড়ী বা তার নিজের বাড়ীর স্মৃতি মুছে ফেলবে?
এই গানগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে নারী স্রেফ ভিক্টিম না, তার অধিকারের অবস্থান থেকে সে কখনো সরে আসে নি। অন্তত ভাওয়াইয়া গানে নারীর কর্তাসত্তার একটা স্বীকৃতি আমরা দেখি।
তথ্যসুত্র:
১। আমার শিল্পী জবিনের কথা, আব্বাসউদ্দীন, প্রতিপক্ষ প্রকাশনা, ১৯৯১ পৃ। ৫৩ – ৫৭
২। বাংলা লোকসঙ্গীতঃ ভাওয়াইয়া, ড. ওয়াকিল আহমদ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ১৯৯৫
৩। আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকসাহিত্য, ৩য় খন্ড, কলিকাতা , ১৯৬৫, পৃ. ২৬৩
৪। বাংলা লোকসঙ্গীতঃ ভাওয়াইয়া, ড. ওয়াকিল আহমদ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ১৯৯৫
ফরিদা আখতার
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ-সহ গোটা উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও তাত্ত্বিক, সমাজকর্মী, লেখক ও চিন্তক।