আজ রবিবার, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্রীয় খুন

।। ফ্লোরা সরকার ।।

চিন্তা পাঠচক্রের নির্ধারিত কর্মসূচীর মধ্যে ছবি দেখাকেও আমরা চিন্তাচর্চার মাধ্যম হিশাবে মানি। সম্প্রতি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ছবি দেখেছি আমরা । উদ্দেশ্য সিনেমায় তথাকথিত ‘ইসলামি সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে গ্লোবাল ওয়ার কিভাবে বিধৃত হচ্ছে এবং জনমতকে প্রভাবিত করছে সেটা বোঝা। আমাদের সেই ছবি দেখা জারি রয়েছে।

এবার ২ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে পোল্যান্ডের বিখ্যাত চিত্রনির্মাতা ক্রিস্টভ কিয়েস্লোস্কির, A short film about killing ” ছবিটা সবাই মিলে দেখলাম। ছবিটা মূলত ১৯৮৮ সালে কিয়েস্লোস্কির দশটা টিভি সিরিজ ” Dekalog ” এর সমন্বয়ে নির্মিত পঞ্চম সিরিজের গল্প। নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৮৯ সালে। হযরত মুসার ( আ:) টেন কম্যান্ডমেন্ডস বা দশ নির্দেশনার পঞ্চম নির্দেশনা ছিল, কাউকে খুন করা নিষিদ্ধ। এই নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে ছবির গল্প আবর্তিত। ছবির শেষে ছবি নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা বা সমালোচনা হয়, যা আমরা নিচে তুলে ধরছি। এই আলোচনা আমরা আরও চালিয়ে যাব। অন্যরাও লিখবেন আশা করব।

প্রথমত মোটা দাগে এক কথায় ছবির মূল কেন্দ্রীয় বিষয় খুন এবং দ্বিতীয়ত ব্যক্তিগত বনাম রাষ্ট্রীয় খুন। খুন বা হত্যা, যে-ই ( ব্যক্তি বা রাষ্ট্র ) করুক না কেন, সেটা কখনই রাষ্ট্রের জন্যে কোন কল্যাণ দূরে থাক, বরং বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। যে কারণে ছবিতে দড়ি ভীষণ রকম প্রতীকী ব্যবহার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যে দড়ি দিয়ে একদিকে মানুষ খুন করা যায় অন্যদিকে সেই একই দড়ি দিয়ে হত্যাকারীকেও ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়।

ছবির গল্প খুবই সাদামাটা। জাসেক লাজার নামে এক একুশ বছর বয়সের যুবক, একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুন করে। পিটর বালিস্কি নামে অত্যন্ত সৎ এবং নীতিবান, সদ্য আইন বিদ্যায় পাশ করা আইনজীবী জাসেক লাজারের পক্ষ নিয়ে সেই খুনের বিচার কাজ সম্পন্ন করে।

গল্পের বিষয় যতই সাদাসিদা হোক না কেন, কিয়েস্লোস্কির নিপুণ গাঁথুনি এবং চিত্রনাট্যের ডিটেইল, খুব মনোযোগ দিয়ে না দেখলে, ছবির অর্থও যেমন বোঝা যায়না, ছবি দেখার মজাটাও হারিয়ে যায়। যে কারণে ছবিটা শুরু হয়, ছবির তিন কেন্দ্রীয় চরিত্র ট্যাক্সি ড্রাইভার, জাসেক এবং পিটরের সমান্তরাল কাহিনি দিয়ে। ছবির সময়কাল এক বছর হলেও, মাত্র একদিনের ঘটনায় আমরা অনেক ঘটনা দেখি। প্রথমেই আসা যাক ট্যাক্সি ড্রাইভারের ঘটনায়, যাকে দিয়ে ছবি শুরু করা হয়। সকালে সে তার গাড়ি পরিষ্কার শুরু করে এবং এর ফাঁকে ছোট ছোট কিছু ঘটনা ঘটে, যা খুব উল্লেখ করার মতো না। কারণ, এই ড্রাইভার আর দশটা ড্রাইভারের মতই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। যদিও সুন্দরী নারী দেখলে, সেও বেশ উৎসুক এবং লোভী দৃষ্টি দিতে ভুলেনা। সেই ড্রাইভারের গাড়ি পরিষ্কার করার পাশাপাশি আমরা জাসেককে এদিক ওদিক খামোখা ঘুরতে দেখি। তবে তার নির্দিষ্ট খোঁজের জায়গা হলো castle square নামে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, যেখান থেকে সে একটা ট্যাক্সিতে উঠবে এবং সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুন করবে, যা ছবি চলার বেশ পরে আমরা দেখতে পাই। এখানে পরিচালক খুব কৌশলে দর্শকদের কাছে জাসেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। যাকে আমরা খুনির মতো প্রচলিত ভিলেইন হিসেবে দেখিনা আবার কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখি। যেমন:

১. সে যখন ঘুরে বেড়ায়, একটা গলিতে হঠাৎ দুজন লোককে দেখতে পায় তৃতীয় একজনকে ধাওয়া করছে এবং মেরে ফেলছে, জাসেক সেটা দেখেও নির্বিকার হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়, সামান্য সাহায্যের হাত বাড়ায় না, ওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে, অনর্থক একটা পাথর ছুড়ে মারে, নিচের গাড়িগুলো উপর, যেকারণে কারোর গাড়ির কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাই, পাবলিক টয়লেটে পিসু করার সময় অনর্থক প্রস্রাবরত এক যুবককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, ক্যাফেটরিয়ায় অর্ধেক খাওয়া কফির উপর থুতু ফেলে ইত্যাদি।

২. রাস্তা দিয়ে চলার সময়, ঠিক বারো বছর বয়সী কিশোরীদের উপর তার দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়। এই কিশোরীদের উপর তার মমতাময় দৃষ্টির অর্থ ছবির একেবারে শেষে পরিচালক আমাদের বুঝিয়ে দেন। সেই প্রসঙ্গে পরে আসবো। এই দুই চরিত্রের পাশাপাশি আমরা তৃতীয় চরিত্র অর্থাৎ পিটর বালিস্কিকে দেখতে পাই, তার আইন পাশ করার চুড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষা কেন্দ্রে। এই মৌখিক পরীক্ষা দেয়ার সময় পিটর দুর্দান্ত একটা মিথ বা ধর্মীয় পুরাণ কাহিনী  উত্থাপন করে, যা ছবির সাথে একেবারে সামঞ্জস্য হয়ে দেখা দেয় জাসেকের খুন করার একটা পর্যায়ে। মিথটা হলো – হিব্রু বাইবেল, ওল্ড টেস্টামেন্ট, কোরআন, ইত্যাদি ধর্ম গ্রন্থে বর্ণিত আদম ( আ: ) এর দুই পুত্র হাবিল-কাবিল সংক্রান্ত। যে গল্পে আমরা জানতে পারি, বড় ভাই কাবিল হিংসা বা রাগের বশে ( একেক বইয়ে একেকটা কারণ বর্ণনা করা হয়েছে ) ছোট ভাই হাবিলকে হত্যা করে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে বলা হয়ে থাকে যা প্রথম ঘটিত হত্যাকাণ্ড, যার মীমাংসা এখনো মানুষ করতে পারে নাই। এই যুক্তিতে পিটর, তার মৌখিক পরীক্ষার আইনজীবীদের বলেন, যেখানে কাবিলের এই হত্যাকাণ্ডের মীমাংসা আমরা এখনো করতে পারি নাই, সেখানে কোন্ যুক্তিতে কোনো খুনিকে হত্যার আদেশ আমরা দিতে পারি? বিষয়টা বিতর্কিত থাকলেও, পিটর তার পরীক্ষায় পাশ করে। বলাই বাহুল্য, মিথে বর্ণিত কাবিল, হাবিলকে পাথর দিয়ে হত্যা করে )। এর একটু পরেই আমরা ছবির সব থেকে লোমহর্ষক দৃশ্য অর্থাৎ সেই খুনের দৃশ্য দেখতে পাই।

৩. পরিচালক কিয়েস্লোস্কি ইচ্ছে করেই খুনের দৃশ্যটা বেশ অনেকটা সময় ধরে দেখান, যাতে করে খুনির ( জাসেক ) প্রতি দর্শকের ভেতরে ভীষণ রাগ আর ঘৃণার জন্ম হয় । প্রথমে দড়ি এবং তারপর মাথায় পাথর দিয়ে, জাসেক, উল্লেখিত ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুন করে। এখানে এসে প্রথমত পাথর দিয়ে মারার ক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারি, পিটর তার মৌখিক পরিক্ষায় কেন হাবিল-কাবিলের উল্লেখ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, দড়ির ব্যবহারের যৌক্তিকতা, তার পরের দৃশ্যের কোর্টরুমে আমরা দেখতে পাই। পরের দৃশ্য হলেও জাসেকের খুনের বিচার কাজ সংঘটিত হয়, খুন করার পরের বছরে অর্থাৎ এক বছর পর। যেখানে দেখা যায়, বিচার কাজ শেষ হয়েছে এবং জাসেককে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে।



কিয়েস্লোস্কির সিনেমার সঙ্গে দর্শনে সম্বন্ধ নিয়ে এই ডকুমেন্টারি ভাবনা উসকিয়ে দেবার সহায়ক হতে পারে।


ফাঁসি কার্যকরের আধাঘন্টা আগে, পিটরের সাথে জাসেকের যে কথোপকথন হয়, সেই দৃশ্যটা ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। এই দৃশ্যেই কিয়েস্লোস্কি, ব্যক্তিগত হত্যা এবং রাষ্ট্রীয় হত্যাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। সারা ছবিতে জাসেককে আমরা অত্যন্ত নির্বিকার থাকতে দেখি। এমনকি, খুনের পরেও তার কোনো বিকার দেখিনা, উল্টো সে, সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুন করে তারই গাড়িতে বসে গান শোনে। কিন্তু ফাঁসির আসামির নির্দিষ্ট ঘরে, প্রথম আমরা জাসেককে অনুতপ্ত এবং ভীষণ আবেগপ্রবণ হতে দেখি। সংক্ষেপে, পিটরকে দেয়া সেই ঘরে, জাসেকের জবানবন্দিতে যা জানতে পারি, সেটা হলো, তার তিন ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র বোন, বারো বছর বয়সি মারিসিয়াকে, পাঁচ বছর আগে, জাসেকের এক বন্ধু ট্রাকটারের নিচে চাপা দেয় এবং সে মারা যায়। এই বোনটা ছিল তার একমাত্র দুর্বল জায়গা। এখানে এসে আমরা বুঝতে পারি, ছবির শুরুতে, জাসেক কেন, মমতাভরা দৃষ্টিতে, বারো বছর বয়সের কিশোরীদের দিকে তাকিয়ে থাকতো। জাসেকের ভাষ্য হলো, তার সেই আদরের বোনটা যদি এভাবে মারা না যেতো, সে হয়তো তার গ্রামেই থেকে যেতো এবং এই খুনের ঘটনা ঘটতোনা। দর্শকের দরদ বা সহানুভূতি নিজেদের অজান্তেই জাসেকের উপর ধীরে ধীরে পড়তে থাকে। একটু আগেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুন করার সময়, যে জাসেকের উপর আমাদের ক্রোধ আর ঘৃণার জন্ম হয়েছিল, সেটা ক্রমেই মুছে যেয়ে সহানুভূতি জাগতে থাকে এবং মনে হতে থাকে, জাসেকের ফাঁসি যেন না হয়। ছবির ঠিক এই বিন্দুতে এসে নির্মাতা কিয়েস্লোস্কি, ব্যক্তিগত হত্যা এবং রাষ্ট্রীয় হত্যাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। কিন্তু তার উপরে যে বিষয়টাকে দাঁড় করান এবং ছবির যে মূল মেসেজ, সেটা হলো, হত্যা বা খুনের বিষয়। যার দ্বারাই এই খুন ঘটানো হোক, সেটা অবশ্যই ঘৃণার বিষয়। একমাত্র এই খুনকে কেন্দ্র করেই, সমাজে অনাচার আর অবিচার শুরু হয়। আমরা চলে যাই, সেই দশ নির্দেশনার পঞ্চম নির্দেশনার দিকে। বিচার কার্যকর করার রায়ে, শেষ পর্যন্ত জাসেকের ফাঁসি হয়ে গেলেও, আমরা সেই ফাঁসিকে আইনজীবী পিটরের মতো মেনে নিতে পারিনা।

আমরা খুন এবং ফাঁসি নিয়ে আবার নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top