।। অরূপশঙ্কর মৈত্র ।।
সে যুগে অবস্থাপন্ন লোকের বাড়িতেই গ্রামোফোন রেকর্ড থাকতো। মানে এলিট বাড়িতে। আর বেশিরভাগ এলিট ছিল বর্ণহিন্দু জমিদার। ‘মাস’ সেই জমিদার বাড়ির বৈঠকখানার বাইরে থেকে গান শুনতো ‘দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে’। শিল্পীর নাম? তপনকুমার। তপনকুমার। তপনকুমার কে? তাঁর আদতে নাম তালাত মামুদ। কিন্তু মুসলমান নামে হিন্দু জমিদাররা হয়তো রেকর্ড নাও কিনতে পারে। তাই একটা হিন্দু নাম। এই নামকরণের পিছনে বাণিজ্য। বাণিজ্যের পিছনে জমিদারি। জমিদারির পিছনে হিন্দুত্ব।
বিষয় আশয়
ইংরেজিতে যাদের জেন্টলম্যান বলা হয় বাংলায় তারা কী?
একটা উত্তর হল, বাংলায় জেন্টলম্যান নেই। এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। তো ঠিক আছে ধরা যাক, বাংলায় তারা ভদ্রলোক। বাবু। ইংরেজিতে জেন্টলম্যানের বিপরীতার্থক শব্দ কী? রিচের বিপরীত পুওর, কিন্তু জেন্টলম্যানের বিপরীত? সবচেয়ে জনপ্রিয় হল কমোনার্স। সাধারণ। আমরাও এই সাধারণ শব্দটা অবিরাম ব্যবহার করি। সাধারণ মানুষের ভালো লাগা, সাধারণ মানুষের মনের কথা, সাধারণ মানুষ কী ভাবছে ইত্যাদি। এই সাধারণ মানুষ কথাটা যারা ব্যবহার করেন, তারা কি অসাধারণ? হয়ত তারা মনে মনে তাই ভাবেন। তাহলে বাইনারিটা কী দাঁড়াল? ভদ্রলোক-সাধারণ। নাহ। এটা ঠিক জমছে না। ভদ্রলোক বললেই ছোটলোক এসে যায়। কেউ কেউ বলে আম+জনতা= পাবলিক বললে কেমন হয়। ঠিক আছে। সেটা বাইনারি হিসেবে মন্দ নয়। কিন্তু ভদ্রলোক-পাবলিক ঠিক খাপে খাপ হচ্ছে না। আশির দশকে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ জনপ্রিয় হতেই আর একটা বাইনারি ডিসকোর্সে জায়গা পেয়ে গেল এলিট-সাব অল্টার্ন। ততদিনে মার্ক্সবাদ ম্রিয়মান। শ্রেনী বিশ্লেষণ বা মালিক শ্রমিক বুর্জোয়া-প্রোলেটারিয়েট একটু ক্লিশে হয়ে গেছে। মার্ক্সের জায়গা দখল করছে ফুকো, দেরিদারা। এপার বাংলায় গৌতম ভদ্র রণজিৎ গুহ, গায়ত্রী স্পিভাকেরা। তারা বললেন উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ। তবে আমার বন্ধু বাংলাদেশের বিশিষ্ট অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেবের বাইনারিটাই বেশি পছন্দ। এলিট আর মাস। দুটোই ইংরেজি শব্দ। তা হোক কিন্তু মাস শব্দটার বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য অনেক বেশি। সে নিয়ে না হয় পরে আলোচনা করা যাবে।
বরাবর আমার বিষয় আশয় বাংলা আর বাঙালি। বাংলা আমার বিষয়, আমার প্রপার্টি, সম্পদ। আশয়, অর্থাৎ আমার মনে জায়গা দখল করে রেখেছে বাঙালি। এবার বাংলার ট্রাঙ্ক খুলে মালপত্তর গুলো ঘেঁটে দেখা যাক। শুরুতেই বেরোল হিন্দু মুসলমান। শান্তিপুরী নীলাম্বরি আর ঢাকাই জামদানি। শাড়ি। আটপৌরে শাড়ি। তার পরনের কায়দা অনেক হতে পারে কিন্তু শাড়ি। সেখানে হিন্দু মুসলমান নেই। লুঙ্গি। সেখানে হিন্দু মুসলমান নেই। কিন্তু হিন্দু মুসলমান ছিল। কিরকম? সে যুগে অবস্থাপন্ন লোকের বাড়িতেই গ্রামোফোন রেকর্ড থাকতো। মানে এলিট বাড়িতে। আর বেশিরভাগ এলিট ছিল বর্ণহিন্দু জমিদার। ‘মাস’ সেই জমিদার বাড়ির বৈঠকখানার বাইরে থেকে গান শুনতো ‘দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে’। শিল্পীর নাম? তপনকুমার। তপনকুমার। তপনকুমার কে? তাঁর আদতে নাম তালাত মামুদ। কিন্তু মুসলমান নামে হিন্দু জমিদাররা হয়তো রেকর্ড নাও কিনতে পারে। তাই একটা হিন্দু নাম। এই নামকরণের পিছনে বাণিজ্য। বাণিজ্যের পিছনে জমিদারি। জমিদারির পিছনে হিন্দুত্ব। মুসলমান জমিদার ছিল না? কে বলে ছিল না? ছিল কিন্তু তারা সংখ্যায় খুব কম। বিজনেসে খদ্দেরের চাহিদা বুঝতে হয়। তাই শ্যামা সংগীত, কীর্তন শিল্পী কে মল্লিক গান গাইতে ‘কে’ ব্যবহার করতেন, কেননা মুন্সী মহম্মদ কাসেম নাম ব্যবহার করলে কি তাঁর কীর্তন বিক্রি হবে?
অথচ আব্বাসউদ্দীন ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’ গান গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন নামেই। কেন? হয়তো ওই আল্লাহ আর পানি এই দুটো শব্দের জন্য। এখন প্রশ্ন হল, আল্লাহ নাহয় আরবি শব্দ। কিন্তু পানি? পানির কি ধর্ম হয়? এক বালক পানি খেতে একটি মন্দিরে প্রবেশ করেছিল বলে তাঁকে মেরে পাটপাট করে দেওয়া হয়েছে ইউপিতে এই সেদিন। এই ন্যারেটিভ বুঝতে সুবিধে হবে একটা মজার ঘটনা বললে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার কোনও একটা স্টেশনে একদল ছাত্র, হয়ত, যাদবপুরের ছাত্র, অপেক্ষা করছে শিয়ালদার ট্রেনের জন্য। ওরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চুটিয়ে আড্ডা মারছে। এমন সময় ওই প্ল্যাটফর্মের এক পানবিড়ির দোকানে রেডিওতে গান বেজে উঠল, ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’। অমনি একটা ছেলে বলে উঠল, দ্যাখ, দ্যাখ, বাংলাদেশের গান, ওরা আমাদের এখানকার গানের সুর ঝেড়ে দিয়েছে। তো, অপর ছেলেটি বলল, কোন গানের সুর ঝেড়েছেরে? কেন? ‘মুঝে পেয়ার দে, পেয়ার দে পেয়ারদে মুঝে… ‘শুনিস নি? এই ‘ওরা আমরা’ বাইনারি এখন বাঙালিকে ক্ষতবিক্ষত করছে, প্রতি মুহূর্তে। অল্পের জন্য এবার বেঁচে গেছি। কিন্তু সাবধান না হলে আমার মন, আমার আশয়ের বাঙালি বাঁচবে না। অনেকদিন আগে একবার পরিচিতদের মধ্যে একটা সার্ভে করেছিলাম। পথের পাঁচালী কজন দেখেছে? প্রায় সবাই দেখেছে। পরিচালক কে? সত্যজিত রায়। হিট করেছিল? না, শুরুতে একেবারেই পাবলিক নেয়নি, পরে বিদেশের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পাবার পরে জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে এমন একটা ফিল্ম যা বাংলার চলচিত্র শিল্পকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। তাহলে জনপ্রিয়তার জন্য বিদেশের পুরস্কারের অপেক্ষায় থাকতে হল কেন?
আরও আগে একবার ২৫শে বৈশাখের আগের দিন দূরদর্শনের পঙ্কজ সাহা সাধারণ মানুষের মধ্যে রবীন্দ্রসচেতনতা কতটা বোঝার জন্য ডালহাউসি স্কোয়ারে বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। একজন মধ্যবয়স্ক লোক, দেখে মনে হল, কোনও অফিসের হেডক্লার্ক হয়তো, সাড়েপাঁচটার বনগাঁ লোকাল ধরার জন্য একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে পরেছেন, ফেরার পথে নিউব্যারাকপুর স্টেশনের পাশের বাজার থেকে সবজি কিনে বাড়ি ঢুকবেন হয়তো। তো কথোপকথন অনেকটা এইরকম হয়েছিল। (স্মৃতি থেকে)
– কাল তো ছুটি।
– হ্যাঁ।
– কেন ছুটি নিশ্চয়ই জানেন।
– হ্যাঁ হ্যাঁ, কাল ২৫শে বৈশাখ।
– হ্যাঁ, ২৫শে বৈশাখ। ২৫শে বৈশাখের জন্য ছুটি কেন?
– বাহ, ছুটি হবেনা? কাল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন।
– আপানাদের পাড়ায় অনুষ্ঠান হবে?
– অবশ্যই। আমাদের পাড়ার নেতাজী ক্লাবে প্রত্যেক বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়।
– বাহ। আমাদের দর্শকদের একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতার কয়েকটা লাইন বলুন না।
– দূর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার…
– এটাতো নজরুল ইসলাম …
– ও হ্যাঁ হ্যাঁ…
ভাগ্যিস জীবনানন্দ বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা শুনতে চাওয়া হয়নি। (জিজ্ঞেস করলে কজন শিক্ষিত পারবে বলা মুশকিল। আমিতো পারব না। বিষ্ণু দে কিম্বা শঙ্খ ঘোষ বললে এক্কেবারে চিত্তির। কিন্তু এদের সবার নাম জানি, আমজনতা কিন্তু জানেনা।)
আমজনতা। সাধারণ মানুষ। আমরা জানি সাধারণ মানুষ শিক্ষিত লোকেদের বিচারের ওপরেই ভরসা করে। সেই শিক্ষিত মানুষ যদি বিলেত ফেরত হন, তাহলে তো কথাই নেই। বিলেতে যদি কোনও পুরস্কার পান, তাহলেতো মাথায় তুলে নৃত্য। অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ ব্যানার্জি, রবীন্দ্রনাথ। অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ ব্যানার্জি আমজনতার অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করলেও আমজনতার জন্য লেখেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? গান কবিতা গল্প তো আমজনতার জন্যেই লেখেন, নাকি? নোবেল পাওয়ার পরে আমজনতার মধ্যে তাঁর রচনার পাঠক বেড়েছিল কিনা জানিনা, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও বেড়েছিল কিনা জানা নেই, কিন্তু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল (সূত্রঃ নীরোদ চৌধুরী) তাতে তিতিবিরক্ত রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বলেছিলেন, একটা কুকুরের লেজে একটা টিন বেঁধে দিয়ে একদল ছেলে সেই টিনের ওপর ঢিল মারতে মারতে যাচ্ছে। তো তাই বিদেশি সাদা সাহেবরা যখন বলল পথের পাঁচালি শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল, অমনি সিনেমা হলে দর্শকের ঢল নামল।
স্বাভাবিক। আমজনতা বা সাধারণ মানুষ বা পাবলিক বা মাস ভালো জিনিসের কদর করতে জানেনা, মর্যাদা দিতে পারে না। ওরা ভালো জিনিসের মর্মই বোঝে না। আমরা বুঝি। আমরা কারা? আমরা এলিট, আমরা ভদ্রলোক, আমরা শিক্ষিত সমাজ। আবার সেই ওরা আমরা। বাটার টোস্ট আর পান্তাভাত। নাস্তা আর টিফিন। অথচ আমরা জানিই না, পথের পাঁচালি পুরস্কার পাবার অনেক আগেই জনপ্রিয় হয়েছিল। শুধু জনপ্রিয় নয় টানা ১৩ সপ্তাহ চলেছিল। এমনকি জনপ্রিয়তায় উত্তম সুচিত্রার সেই বছরের রিলিজকেও হারিয়ে দিয়েছিল। পুরস্কার পাবার পরে অপরাজিত তৈরি করেন সত্যজিত রায়। সেটি বিদেশে আরও বেশি পুরস্কৃত হয়। কিন্তু সুপার ফ্লপ হয়েছিল। ওদের আমরা চিনি? ওই ওরা, মাস, কিম্বা আমপাবলিককে? চিনি? আমরা?
কিন্তু আমার কাছে হেঁয়ালি হল, “শুরুতে সিনেমাটা একেবারেই জনপ্রিয় হয়নি, ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পাবার পরেই জনপ্রিয় হয়েছিল“ এমন একটা গুজব বহু শিক্ষিত বুদ্ধিমানদের মধ্যে কী করে চালু হয়ে গেল? চালু না বলে বলি জনপ্রিয় হয়ে গেল? হ্যাঁ, জনপ্রিয় বলছি এই কারণে যে এমন একটা যুগান্তকারী সিনেমা প্রথমে যে আমজনতা দেখতে রিফিউজ করল তারজন্য দুঃখ নয়, বরং কোথায় যেন একটা আত্মতৃপ্তি। এমনই তো হবার কথা। অথচ একদিকে পুরস্কার ছাড়াই পথের পাঁচালি আমজনতার মধ্যে জনপ্রিয় হল, আর অন্যদিকে একটা ভুল ধারণা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয় হল। কেন? যে কোনও গুজবের জনপ্রিয় হবার আড়ালেও কিন্তু একটা কারণ লুকিয়ে থাকে। এই গুজব জনপ্রিয় হল কেন?
জনপ্রিয় হল, কেননা শিল্পের ভালোমন্দ আর আমজনতার শিল্পবোধ নিয়ে আমাদের ধারণার সঙ্গে এই গুজব হুবহু মিলে যাচ্ছে যে। পথের পাঁচালি যখন স্যুটিং শুরু হয়, তখন টালিগঞ্জ সিনেমাপাড়াতেও হাসির রোল উঠেছিল। স্টুডিও ছেড়ে গাঁয়ে গিয়ে ছবির স্যুটিং হচ্ছে, দুই মধ্যবয়সি অনামি অভিনেতা অভিনেত্রী, করুণা এবং কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক বৃদ্ধা চুনীবালা আর দুটো বাচ্চা। না আছে প্রেমের গল্প, না সাসপেন্স, এ ছবি তো মুখ থুবড়ে পরবেই। হতে পারে সত্যজিত রায় সুকুমার রায়ের ছেলে, বিদেশি চলচিত্র পরিচালক রেনোয়ার সঙ্গে ছিলেন, বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেছেন, প্রেসিডেন্সী, শান্তিনিকেতন ঘোরা, বিলেতে অজস্র বিলিতি ছবি দেখেছেন, তাতে কি? আমজনতা ছবি দেখে তার গল্পের জন্য। গল্প তালগাছে ওঠার মত ধীরে ধীরে ক্লাইম্যাক্সে উঠবে, মাঝখানে দুএকবার স্লিপ করে যাবে, কোনওমতে সামলে নিয়ে আবার উঠবে, অবশেষে একদম ডগায় উঠে পাকা তাল, ধা ধিন ধিন ধা। অ্যান্টিক্লাইমেক্স। গাছের পাতা চুইয়ে একফোটা জল, ঘটি গড়িয়ে গড়িয়ে পুকুরে ফুচুৎ, পুণ্যিপুকুর ব্রত, এইসব হাইথট আমজনতা খায় না। আর্ট ফিল্ম আমজনতার হজম হয়না, পেট ফেঁপে যায়।
তাহলে? পথের পাঁচালি পুরস্কার পাবার আগেই জনপ্রিয় হল কি করে? পথের পাঁচালি কি আর্ট ফিল্ম ছিলনা? রহস্য এইখানেই।
আমার এই আলোচনার বিষয় বিভূতিভুষন বা সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালি নয়। বাঙালি ভদ্রলোকদের যাতায়াতের যে পথ, তিনশবছর আগে যা ছিল শক্ত মাটির, পিছলে যাবার মত এঁটেল নয়, দেড়শবছর আগে সুন্দর সাজানো ইটের, হোঁচট খাবার কোনও চান্স নেই, আজকের শহরে বিশমিটার চওড়া মেটাল রোডের পাশে ওয়াকিং ফুটপাথ, বিরক্তিকর ওই হকারদের দখল করে রাখা, সেই যাত্রাপথের পাঁচালি আমার বিষয়। সুধীর চক্রবর্তীর লেখায় পড়েছিলাম, শহরের এক উচ্চশিক্ষিত যুবক নকশাল হয়ে গেল, গ্রামে দিয়ে শহর ঘিরবে বলে দরিদ্র কৃষকের কাছে পৌছে গেল, শেষে বিয়ে করে বসল এক ফকিরের মেয়েকে। বর নকশাল থেকে প্রাক্তন নকশাল হয়ে গেল। বাচ্চা নিয়ে বৌ বাপের বাড়িতেই থাকে। কাজের জন্য শহরেই থাকে। মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়ী আসে। সেদিন একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাড়ি এসে প্রাক্তনী দেখে বাড়ির উঠোনে কাদায় মাখামাখি করছে তার তিনবছরের বাচ্চা। খেলার ছলে। প্রাক্তনী বিরক্ত হয়ে বৌকে বলল, আরেহ কি হচ্ছে, পুচকু নোংরায় গড়াগড়ি যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছনা? বৌ বেশ কিছুক্ষণ বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর অবাক বিস্ময়ে প্রাক্তনীকে বলল, নোংরা বলছ কী? ওটা তো মাটি।
মাটি
(এরসঙ্গে যদি মুখ ফসকে মা আর মানুষ বলে ফেলি তাহলে প্রাক্তনীদের মুখের দিকে তাকাতেই ভয় করবে। তবু বলে রাখি সত্তরদশকের জনপ্রিয় একটি বামপন্থী নাটকের নাম ছিল “মা মাটি মানুষ”। লিখেছিলেন মার্ক্সবাদী পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধায়।
ধুস। ওটাতো যাত্রা। ভৈরব গঙ্গোপাধায় না হয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হলেও নাহয় একটা কথা ছিল)
আমাদের শান্তিনিকেতনী প্রাক্তনী, প্রেসিডেন্সী প্রাক্তনী, যাদবপুরিয়ান প্রাক্তনী, জেএনইউ প্রাক্তনী, নকশাল প্রাক্তনী, মার্ক্সবাদী প্রাক্তনী, এরা কেউই মাটি চেনে না।
সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মাটির লড়াই চলছে। দিল্লির রাজপথে অজস্র মাটিমাখা পা।
ধনঞ্জয়ের একটা বিখ্যাত গান ছিল, মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে…
এ মাটির গান গেয়ে ভাই জীবন কেটেছে…।
আজকাল আর কেউ মাটির গান গায়না। পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরুনের ঘটি গড়াতে গড়াতে পুকুরে ডুবে গেছে।
চলুন না, যাই, দেখি ডুব সাঁতার দিয়ে ওই পুকুরের নিচে কাদামাটি থেকে ঘটিটা তুলে আনা যায় কিনা। বাঙালি ওখানেই আছে যে।
প্রচ্ছদের ছবি- বিয়াস চট্টোপাধ্যায়
অরূপশঙ্কর মৈত্র
নাট্যকার, নাট্য পরিচালক ও লেখক। নিবাস: দক্ষিণ কলকাতা।