আজ শনিবার, ৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ক্রসফায়ার

গুচ্ছ কবিতা

।। চিনু কবির ।।

“আমার যত দার্শনিক প্রশ্ন তার সবই অসমাপ্ত থেকে গেল, হাঁটতে হাঁটতে দাবনা
ভেঙে নেমে যাচ্ছে, মিথ্যুকের মতো জলরাশি গড়িয়ে পড়ছে, দাবার চালে বড়
হচ্ছে অবৈধ ক্ষমতা আর দখল করে নিচ্ছে সব… বোধহয় আমাদের আর কোনো
গল্প থাকবেনা। ভোঁদড়ের নাচন থেকে ঝরে পড়ছে সন্ধ্যার মহুয়া, কাকে যেন ওরা
ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ঢালপার।”

সাতমাথার মোড়

সাত প্রকারের সত্য সাত রাস্তা ধরে চলে যায়
আমরা সাতমাথার মোড়ে চা খুঁজি, পুনো
প্রেমের মোড়— দেখা হয়ে গেলে সেই উড়ন্ত গাভীর সঙ্গে—

উড়নচণ্ডীদের খাঁটি দুধের চা, অক্টোবরের
গাভীমেঘ ধীর লয়ে উড়ে যাচ্ছে—
আমরা হাসির মতো এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাই,

গাভীর ধাবমান পথ ধরে যেতে যেতে
তিস্তাবৃত্তান্তের তীরে এসে পৌঁছে যাই,

দুধ চায়ের ভাষায়— আমরা মৎসদের ডাকি
দুধ চায়ের ভাষায়—আমরা জলকে ডাকি

সবাই কাঁধ বেঁয়ে অতি নিকটে চলে আসে
কেন যে বিভূতি ছলে আনালহক হয়ে যাই—

সন্ধ্যা নেমে এলে গাভীমেঘের দল ঘনঘন ডাকে
প্রবল বর্ষনে তিস্তার স্রোতে—
অনন্ত ভাসিয়ে দিলাম, ফিরে যাচ্ছিনা
বৃত্তান্ত নদীই আমাদের ঠিকানা হয়ে রইলো

নিজেকে ফেলে দেই

তোমার কথা ফেলতে পারিনা
কখনো কখনো নিজেকে ফেলে দেই
কী হবে ফিরে এসে?

আমাদের ভুঁইবাড়ি গোল্লাছুট খেলা
কলমিলতার বিল মনে পড়লেই গান খুলে যায়
নিজেকে আর খুলতে পারি না;

তোমার কথা ফেলতে পারিনা
কখনো কখনো নিজেকে ফেলে দেই;

খুব ভালো হয়, যদি ভূমিকম্প হয়
তোমার হাতটা শক্ত করে ধরতে চাই

যদি বাতাস ওঠে, হাতির শুঁড় নামে
ভালোই হবে
তোমার নামে ঘুর্নিঝড়ের আরেকটা নাম হবে—

এবার আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বো
আর কখনো ফিরে আসবোনা
কী হবে ফিরে এসে?

তোমার কথা ফেলতে পারিনা
কখনো কখনো নিজেকে ফেলে দেই।


মাড়াইতে পারতেছিনা

তোমার জন্য শুধু গালি খাইতেছি
কিছুই তো খাওয়াইতে পারলা না—
বুকের উপর দিয়া সাপ গড়ায় দিলেও
আঠার মতো লেগে থাকতে পারি,
খালি পায়ে আগুন দিয়া
হাঁইটা যেতে পারি
পুলসিরাতও পাড়ি দিতে পারি।

দেখো, আমি তো মরতেছি তোমার জন্য—
অন্যেরা জেলখানাতে হুদাই মরতেছে

আমি কিন্তু রাজনীতি করি না
তবু তোমার আম্মা
খালি খালি মেশিনগান ফিট করতাছে,

এতো এতো দণ্ড লইয়া খাড়ায় আছি যে—
কিছুইতো মাড়াইতে পারতেছিনা…

ক্রসফায়ার

ক্যাপ্টেন! আমাকে কোথায় ভাষার আড়ালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে— পিছমোড়া
আস্কন্দিত। ঘিরে আছে কোনো ছদ্মবিড়াল ; এতো সুড়ঙ্গ তার সবই গোপন?
বন্ধুদের ছেড়ে উঠে আসি। বহেড়া তলার পাঠচক্র, রাষ্ট্রপ্রশ্ন আর রৌদ্রদাগে
জড়িয়ে পড়া কথা ও কাহিনীর মধ্যে ক্রমে হারিয়ে যাওয়া ধূলিময় এক পৃথিবী।
চোখবাঁধা গাঢ় অন্ধকার। চারিদিকে মৃত্যু ইশারা। পায়ের নীচে মুথাঘাস, তৃণলতা,
ধু-ধু জনপদে ভেসে যাচ্ছে কোন এক মাতৃসদন, চক্রাকারে মানুষের ছায়া আর
আমার যত দার্শনিক প্রশ্ন তার সবই অসমাপ্ত থেকে গেল, হাঁটতে হাঁটতে দাবনা
ভেঙে নেমে যাচ্ছে, মিথ্যুকের মতো জলরাশি গড়িয়ে পড়ছে, দাবার চালে বড়
হচ্ছে অবৈধ ক্ষমতা আর দখল করে নিচ্ছে সব… বোধহয় আমাদের আর কোনো
গল্প থাকবে না। ভোঁদড়ের নাচন থেকে ঝরে পড়ছে সন্ধ্যার মহুয়া, কাকে যেন ওরা
ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ঢালপার। ক্রমাগত নামতে নামতে অচেনা গহ্বরে পাল্টে যেতে
থাকি, আদিম বৃত্তের মতো পৃথিবীটা গোল তাইতো উদগ্রীব বাসনায় দুলে উঠি।
কম্পমান সাইকেলে হুইসেল বাজাতে বাজাতে ক্রমে পার হয়ে যাই বিলাপচিহ্নের
মতো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, বিমর্ষ পশ্চিমে কেউ একজন বৃষ্টি ও কান্নার মধ্যে
মা বু দ, মা বু দ বলে ডেকে যাচ্ছে।

ক্যাপ্টেন! আমাকে কোথায় ভাষার আঁড়ালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- পিছমোড়া
আস্কন্দিত।

নক্ষত্রবিথীর রাতে কেউ একজন ব্রিজে দাঁড়িয়ে নিজের কন্ঠ ফেরত চাইছে,
পথরোধ করে দাঁড়াচ্ছে নিশিতবৃক্ষ, চাকা এসে খুলে নিচ্ছে হাওয়ার নিষাদ,
অথচ খুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেন হঠাৎ অস্থির হয়ে সামরিক সংকেতে
কি যেন নির্দেশ দিয়ে যায় আর অমনি ঠা-ঠা গুলির শব্দে অবয়ব ফুরিয়ে গেলে রাত্রি
শেষে নীরবে ঝরে পড়ে পৃথিবীর সবটুকু আলো, ভারী হয়ে আসে, অন্যরকম ভেঙ্গে
যাই প্রসূতি ব্যাথা নিয়ে উগরে আসা রক্তের ফিনকি ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আর
অনবরত গলিত লাভায় আমি মানুষকে খুঁজে ফিরি।

প্রচ্ছদের ছবি: Hounddogs

চিনু কবির

চিনু কবির, কবি ও সম্পাদক। জন্মস্থান ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র  তীরবর্তী গাইবান্ধা শহরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। সরকারি কলেজে দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘসময়। লেখালেখির শুরু হয় ছোটকাগজ দিয়ে। দুই দশক ধরে ছোটকাগজ ক্যাথারসিস [১৯৮৩-২০০৩] সম্পাদনা করেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top