আজ বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আয়ুর মরশুমে জল ও সুলাইমান

।। জাকারিয়া প্রীণন ।।

তোমারে ধরতে গেলেই করতাল বাজে নিঃস্ব দুপুরের মতো। আমি এখন শ্মশানঘাটে যাব। ঈশ্বরের চোখে ডুব দিব। তুমি বললা ঈশ্বরের চোখ নাই। অথচ লোকে বলে প্রকাশ্যে বা গোপনে যা হয় আল্লাহ তা দেখেন। আমার বিচার হবে। আমি নরকে যাব। লোকেরা বলে মানুষ বাঁচে আল্লার ইশারাই। আমিও তার মতো আছি। সে যা চায় আমি তার কৃতদাস। ভালোবাসি তার সৃষ্টি। ফুল। যা কিছু তার মতো দেখতে। এবং তার কন্যা সকল। বৃষ্টির পর আম্মা সারাদিন আব্বার অপেক্ষা করেন। তার তাকিয়ে থাকা যেন শেফালি গন্ধের মতো সুন্দর। লাজুক পাতার মতো তার এই অপেক্ষা।


আব্বা বললেন ব্লু-বাতাসের কলহ বুঝতে পারলে তুমি অমর হবে তবে তার জন্যে তোমাকে মানুষ হতে হবে। বড় বেলায় এসে এই কথা মনে পড়ল। কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা কুকুরের দেখা পেলেম; মুনিবের পাশে বসে কোনো কিছু ভাবছে  যেন। মনে হলো সেও হয়তো তার আব্বার কথা ভাবছে। কিন্তু আমাদের বাড়ি যে কুকুরটি ছিল তার আব্বার দেখা মিলেনি কোনোদিন। শুধু জানি কুকুরের কোন ধর্ম নেই কিন্তু তারা প্রভু ভক্ত প্রাণী। মানুষ যখন ঈশ্বর এবং ভগবান নিয়ে রাজনীতি করে। মানুষ মারে। ঘর ভাঙে। দোকানে আগুন লাগায়। ভাবি আল্লাহ তো ইচ্ছে করলে কুকুর থেকে মহিমা শুনতে পারতেন। মানুষ বানানোর কি এমন দরকার ছিল? ওরা জান্নাত জাহান্নাম নিয়ে ফাসাদ করে প্রতিদিন। আমি কুকুরটিকে সারাদিন তার মুনিবের কাছে বসে থাকতে দেখলাম। যেন স্থিরপদ্ম ফুটে আছে জলে। তিরতিরে ঢেউয়ের মতো তাকে অতিক্রম করে যায় কলহ। বিবাদ। নিয়ত দ্বন্দ্ব বাধে মানুষে মানুষে। আমি তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম পাখির গানের মতো নীরবতা নিয়ে। সমাজতন্ত্রের কথা বকছি না; ধরো একটা জল কালারের চিঠি তোমার হাতে, আমার হাতে একটা পানিপত্র। তুমি তার সমীকরণ করবে কই? পঞ্চইন্দ্রিয়ে তাদের ছুঁয়ে দেখেছি তারা সুন্দরের মতো ধর্মহীন, বর্ণহীন। এখন আমার সামনে বিশাল দরিয়া। ঝড়ের মুহূর্তে আমি কার নাম নিয়ে আশ্রয় চাইব? আল্লার নাম নিলে ভগবানের প্রতিপক্ষ হয়ে যাবো; ভগবানের নাম নিলে আল্লার। এমন কলহপূর্ণ সময়ে তুমি কেন জাহান্নের আয়াত পড় মৌলভী? যদি নবী আদমের মতো আজ দিকভ্রান্ত হই তোমার খোদাকে আমায় ক্ষমা করতে বলো। অথবা বলো প্রাচীন গন্দম ফুলের কথা।

এত দূর চলে আসার পর যে সব কথার অপচয় হল। তারা আমাদের কাছে ফিরতে চাইল না। আমি তবু একবার পিছন ফিরে তাকাই। দেখি রক্ত। আব্বা বললেন তুমি রসাতলে যাবে। অথচ অই দুইটি পথে একটি বাড়ির সন্ধান পেলাম আমি। ওখানের মেয়েগুলোর চোখে প্রমিলার মুখ; তাদের মুখে মরিয়মের হাসি। হুজুর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন— বললেন ,”তুমি জাকারিয়া প্রীণন নামে অর্ধেক মুসলিম অর্ধেক হিন্দু…”। আমি বেকুবের হাসি দিয়ে ফিরে এলাম। নবী ইব্রাহীমের কথা ভাবি; তার নামে কোন ধর্ম লেগে আছে? যেহেতু শব্দটি অনারবী। আয়নায় দাঁড়িয়ে বারবার নিজেকে দেখি আমাকে আসলে কার মতো লাগে? শরীর ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না—তারা যেন আল্লার মতোই নিরাকার। নাকি আমিই পালিয়েছি কোথাও? হয়তো আমার এই পালয়ন লিখাছিল গন্দমফুলের ঘ্রাণে। এখন শিমুল ফুলের মৌসুম। রক্তের লালে আতংকিত সব সুন্দর ফোটে আছে রাস্তার ধারে। যেন সিঁদুর মাথায় দাঁড়ানো যুবতি অপেক্ষা করছে কারো। এই পথেই তুমি কলেজ যাও। আমার ভীষণ মায়া হয়। দুপুরে এমন গাঙঢুপির মতো কথা কয়ে উঠ যে; ইচ্ছে হয় সুরের মাঝে লয় হয়ে বসে থাকি—শুকনা বাতাসের মতন। হাওয়াই রুমালে লিখি তোমার নাম। প্রত্নতাত্ত্বিক সকালে আলোর গোলযোগ নিয়ে তুমি হাসো। বিব্রত। ওরম করে তাকাও যেন গোপন চিঠিতে বেদনার মতো মৃদু তার ভাষা। কথার পিঠে কথা লেগে থাকাটা জামায় কাজ করা চুমকির মতো সুন্দর। অথচ কথার শেষে মানুষ একলা পড়ে থাকে পাতাঝরার মতো। তাই বলি শিমুল অত সুন্দর নাম হয় কি করে! যেন ভাঙা ঘড়িটির পাশে  আয়ূবের আত্মজীবনী জোড়া দিচ্ছে কেউ। আব্বা বলতেন ব্লু বাতাসের কথা। লোকের কথার বাহানা ধরে কলহ করে। অতঃপর নানান রঙের আদলে যেই সব কথার জন্ম হয় তাই মূলত  জীবন। আমি অনেকগুলা ফুল গাছ বুনেছি—যাতে করে মানুষের বাহিরে কিছু সুন্দর দেখা যায়। এবং যাতে করে মানুষ খুব সহজে প্রেমে পড়তে পারে। পাড়ার লোকেরা একদিন মিছিল দিল—”আমার নেতার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র”। আমি সে পবিত্র মানুষের দেখা পাই পত্রিকায় খুনের দায়ে লোকটিকে আটক করেছে পুলিশ। কিন্তু ফুলগাছ কাটার দায়ে কেউ কিছুই বলতে পারেনি তাকে। শুধু একজন কবি; বাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনলেন—ফুলগুলো মালি-বউকে মা বলে ডাকছে। অথচ মালি-বউ হাসতে হাসতে কেটে নিচ্ছে ওদের গলা। কিছু প্রাণের দায়ীত্ব হয়তো ঈশ্বর নেননি যা আমাদের হাতে দিয়ে ছিলেন সুন্দরের বিনিময়ে। নাকি ঈশ্বর একটি ধারণা মাত্র? কেবল কথার যবনিকা ধরে ফুটেন। তবু বিরহ মরশুমে তারে প্রার্থনায় ডাকি। পাশের বাড়ির নন্দিতা প্রতিদিন ফুল ছিঁড়ে ভগবানের কাছে যায়। ফুলকে বিশ্বাস করে গোলাপের গ্রাফিক্স করা কাগজে তাকে যে প্রেম পত্র দিয়ে ছিলাম তার উত্তর মিলেনি। নাকি কৃত্রিমতা পছন্দ করে না সে! তবে কেন কৃত্রিম বগভানের কাছে প্রার্থনা করে? আমাকে অভিশাপ দেয় কবি জন্মের। দুর্গা ঘরের পাশে একদিন চুমু দিয়ে বলেছিল কবিদের ধর্ম থাকতে নেই। আমি সেই কুকুরটির কথা ভাবি—ভাবি এই চুম্বনের অর্থ কী? কেনই বা ফুলের মতো সুন্দর প্রাণ ভগবানের পছন্দ? বুঝি এই সব কথা থেকেই ইতিহাসে জন্ম নিলো কুমারের ছেলে ইব্রাহীম।

আমি শুধু আবাবিল পাখির মতো উড়ে উড়ে তারে খুঁজি। তাই বুঝি প্রেমের মাল্যপরে দেবদাস বনেছি। প্রতিদিন যেই দুর্গাঘরের পাশ দিয়ে যাই। ওখানে যে মেয়ে বাতাসে চুল ছেড়ে হাঁটে আড় চোখে আমারে দেখে। আমি তার ধর্ম জানি না। তারে মানুষির মতো লাগে। ঈশ্বরের কন্যার মতো লাগে। সে কি প্রমিলা না মরিয়ম কেমনে জিগাই। তারে ভালোলাগে। তার চোখে দুষ্টমির প্রশ্রয়। ভাবি হাওয়া নামের ভেতর আমি কোন ধর্মের কথা ভাববো?


সুলেমান, সুলেমান। এখানে আসো এবং বুঝতে শিখো বাতাসের ভাষা। আব্বা আমাকে বলেছিলেন ব্লু বাতাসের কথা। কলেজ থেকে ফিরবার পথে আমি শুধু একটা কুকুরের দেখা পেলাম। মনে হলো সে মানুষের থেকে অধিক মানুষ। কুকুরের থেকে অধিক কুকুর। শীতের সকালে টং-দোকানে কড়া মিষ্টি দিয়ে চা পান করছিল যেই লোকটি। তার ডান হাতে ডার্বি সিগারেট। সুখ-টান দিয়ে বাতাসে ধোয়া ছাড়ার ভঙিমা দেখলে মনে হয়। ডান হাতে আমল নামা নিয়ে লোকটি চলে যাচ্ছে জান্নাতে। অথচ মওলানা জানালেন লোকটির হাতে জ্বলতে  থাকা সিগারেটে জাহান্নামের নিশান হয়ে থেকে গেল তার অস্তগামীতা অবধি। তাহলে জাহান্নাম পুড়িয়েই কি জান্নাতের সৃষ্টি হয়? আর সৃষ্টি? সে তো এক বিভ্রম। রং দিয়ে রঙের বাহাদুরি। কাঠেখড়ে কানালাপি যেমন। আমি তবে শূদ্রের ঘরে জন্মালাম? কুলগাছের নিচে যেই মেয়েটি বসে থাকে তারে কেন অতটা ভালো লাগবে আমার! আমি এখন আগুন-পানির গোল্লাছুটের সাঁতারু অথবা কমলা রঙের মারবেল কেবল গড়িয়ে পড়ি হাজারো হাতের ইশারাই। যা শুধু রূপ ও রসের কারিগর—জেগে থাকা পিচুটির মতো গোল। আমরা যেই স্ফূরণ থেকে ওঠে আসলাম তাকে কমলা লেবুর মতন দেখা যায়। যেন নত মুখে তুমি ললিপপ চুষছ। চপচপ শব্দ হয়। আমি বাতাবি লেবুর মতো চুইষা চুইষা কমলা খাই। আটার দলার মতো টিইপা টিইপা গরম করি; তারা নরম হয় যেন শীতকালের রোদে আচার খাচ্ছে একদল পোয়াতি মহিলা। তার যত ইশারা সব গিরিপথের দিকে। আব্বা ঐ পথ দিয়া আসছেন। আমিও আসলাম। তুমি ইস্তাম্বুল যাবা। লেউড়া পাড়ার দিকে যে উত্থান তোমার। সাত সতিনের ঘর কেমনে করবা। আমি কমলা লেবু খাই। গাছ বদল করি। যেমন তুমি আলগোছে খুলে রাখ ব্রা। তুমি ললিপপ চুষতে ভালো পাও ভীষণ। তোমারে ধরতে গেলেই করতাল বাজে নিঃস্ব দুপুরের মতো। আমি এখন শ্মশানঘাটে যাব। ঈশ্বরের চোখে ডুব দিব। তুমি বললা ঈশ্বরের চোখ নাই। অথচ লোকে বলে প্রকাশ্যে বা গোপনে যা হয় আল্লাহ তা দেখেন। আমার বিচার হবে। আমি নরকে যাব। লোকেরা বলে মানুষ বাঁচে আল্লার ইশারাই। আমিও তার মতো আছি। সে যা চায় আমি তার কৃতদাস। ভালোবাসি তার সৃষ্টি। ফুল। যা কিছু তার মতো দেখতে। এবং তার কন্যা সকল। বৃষ্টির পর আম্মা সারাদিন আব্বার অপেক্ষা করেন। তার তাকিয়ে থাকা যেন শেফালি গন্ধের মতো সুন্দর। লাজুক পাতার মতো তার এই অপেক্ষা। আমি তোমার কথা বলতে ছিলাম অতসি। তুমি রোজ কেন তুলসি পাতার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় থাক? মেরুন কালার শেমিজ পিনলে তোমারে দারুণ লাগে। যেন আশ্রম থেকে কোনো পুরোহিত আমার সামনে। তুমি কি জীবনানন্দের কবিতা? যার প্রতিটা শব্দ হীম বাতাসের মতো মৃদু। যেমন বন্যার পানিতে সৌখিন হয়ে ওঠে মাছ। আমিও উতরে যেতে চাই সীমা-অসীমা-প্রতিসীমার প্রতিটা ছক। এই সব ঘূর্ণিতে যেই সব কবিতা হয় তারা নিরাকার। তারাও প্রবাহিত হয় ইশারাই।


আমি মরে যাবার পর যেই সব ফুল ফোটবে তার বয়স কাল নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই। বানুরে ভেঙচি কোনো অর্থ রাখে না। আমি তো কাকপক্ষীর প্রেমে পড়েছি। সে প্রেমিক এবং পুরুষের থেকে অধিক পুরুষ। পাখিজগতে সেই একমাত্র পক্ষী যার সঙ্গী মরে গেলে জোড়া বাঁধে না। একা থেকে যায়। কালো আবরণের নিচে পেকে উঠে বিরহ। যেমন সমস্ত ফুলের মাঝে বিরহ করি জেসমিন ফুলের গন্ধ। আমি জানি মাটির মতো দীর্ঘমেয়াদী আর কিছু নেই পৃথিবীতে। খুব সহজে খেয়ে নিতে পারে পুরো একটা মানুষ এমন কি লৌহছুরি। আবার জন্মাতে পারে তরু-লতা, ফল ও ফসল। এমন সমান্তরাল ভালোবাসা যিনি দিয়েছেন। আমি তারে বিশ্বাস করি। ভালোবাসি। লোকে তারে বলে ভ্রান্তিবিলাস। আমি শুধু আবাবিল পাখির মতো উড়ে উড়ে তারে খুঁজি। তাই বুঝি প্রেমের মাল্যপরে দেবদাস বনেছি। প্রতিদিন যেই দুর্গাঘরের পাশ দিয়ে যাই। ওখানে যে মেয়ে বাতাসে চুল ছেড়ে হাঁটে আড় চোখে আমারে দেখে। আমি তার ধর্ম জানি না। তারে মানুষির মতো লাগে। ঈশ্বরের কন্যার মতো লাগে। সে কি প্রমিলা না মরিয়ম কেমনে জিগাই। তারে ভালোলাগে। তার চোখে দুষ্টমির প্রশ্রয়। ভাবি হাওয়া নামের ভেতর আমি কোন ধর্মের কথা ভাববো? ইউসুফের দুনিয়াই একজন করে জুলেখা বসত করে। এমন কি একজন ঘসেটি বেগম। ইউসুফের দুনিয়াই একজন মীরজাফর জন্মে। তারে দেখি না তবু বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি বাতাস সত্য; সত্য তার আর্দ্রতা। তারে কেন ভালোবাসবো না বলো? সে মিথ্যা। মিথ্যা তার প্রতিশ্রুতি। মৃত্যুর পর সে অদেখা বাতাসের মতো সত্য হলে আমার উপায় কী? আমি তখন কার কাছে ভুলের মার্জনাপ্রাপ্ত হব। বিশ্বাস যেন মাটির মতো সত্য-দীর্ঘ মেয়াদি-ফসল দাতা—কিন্তু সেখানেও জন্মাতে পারে কীট।

জাকারিয়া প্রীণন

কবি। জন্ম ১৫ জুন, ১৯৯৭।বসবাস ধোবাউড়া, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top