আজ বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অরূপে দ্যাখো রূপমাধুরী (পর্ব-২)

গদ্যসাহিত্য


।। রূপসা।।


মজার কথা হলো, আগমবাগীশের অনেক আগে ত্রয়োদশ শতকের বৃহদ্ধর্ম পুরাণেও কালীর প্রায় একই রকম বর্ণনা। মহাদেবের উপর তার আসন। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে লোলজিহ্বা। এই জিভ কাটা প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছা হয়, স্বামীর গায়ে পা দিয়ে ‘লজ্জা’য় জিভ কাটা আর শবরূপী শিবের উপর পায়ের নখ স্পর্শ করে গোটা সৃষ্টিকে গিলে নিতে চাওয়ার যে লোলজিহ্বা— তার রাজনীতির মধ্যে তফাৎ আছে কী! লোলজিহ্বাকে স্রেফ লজ্জার জিভ কাটাতে পরিণত করতে দরকার হয় ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী রাজনীতির— না হলে ওই রূপের আরশে সংসারের আঁট ভাঙবে অবধারিত।

পর্ব-২

এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম তারার মাজারে শিরনি দেওয়ার কথা। একটি সমকালীন আধুনিক বাঙলা গানে উল্লেখ আছে তারার মাজারের কথা । তারার মাজার কোথায় আছে, ভার্চুয়ালি খুঁজতে গিয়ে তেমন কিছু জানা গেল না। শুধু অন্তর্জালের সার্চ-ইঞ্জিন থেকে সামান্য একটি তথ্যই পেলাম। খুলনা জেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের নোহাট গ্রামে রয়েছে তারার মাজার। অনুমান করে ব্যক্তিগতভাবে মনে হলো, সম্ভবত তারা নামের কোনো সাধিকা (কিংবা সাধক) সমাধি । প্রতিবছর এখানকার ওরশ শরীফে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হন। অন্যদিকে আমরা জানি রাঢ়বঙ্গে মা-তারার মন্দির তারাপীঠের কথা। কিন্তু মূলত তারা হলেন বজ্রযানী বৌদ্ধদের দেবী। অসীম শূন্যতা থেকে দিকভ্রষ্ট মানুষকে যিনি দিকনির্ণয়ে সহায়তা করেন তিনিই তারা।

খুলনায় যে তারার মাজারের কথা শোনা যায়, তাঁর সাথে হয়তো এই তারার কোনো সম্পর্কই নেই। তবু, কোথাও গিয়ে, কোন মন্ত্রবলে যে সব কিছু এসে মেশে সাগরে, ভাবলে আশ্চর্যই লাগে। সনাতনী শক্তিশাস্ত্রে, তন্ত্রের দশমহাবিদ্যাতেও তারার হদিশ পাওয়া যায়। যেমন পাওয়া যায় কালীকে। কালী হলেন সময়ের আদি। তাঁর থেকে সময়ের সৃষ্টি হয়েছে। আর তারা হচ্ছেন সৃষ্টির দিকচেতনা। স্পেসের ধারণা। নিরাকার কালীর স্থানিক রূপ-রূপান্তর। তবে যখন কালী ও তারার রূপকল্পনা তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে মিথ, সেখানে এই দুই দেবীই নগ্নিকা, শিবের উপরে তাঁদের অবস্থান। Woman on the top। আর তারা লম্বোদরী, সুস্তনী। গোটা সৃষ্টিকে গর্ভে ধারণ করার আখ্যান সম্পর্কিত হয়েছে মাতৃময়ী কালীর ডিসকোর্সে। কারণ সৃষ্টিই সাক্ষ্য দেবে তাঁর অস্তিত্বের। কালের গর্ভ থেকেই তো সৃষ্টি। সে তো বিজ্ঞানীরাও বলবেন, চতুর্থমাত্রা কাল। আর আপেক্ষিকতাবাদ বলবে, সময় ছাড়া মাপ নেবে কেমন করে?

কালী

একদিকে শূন্য পরিসরে দিকনির্ণয়ের দেবী করুণাময়ী তারা। তার পাশেই অবস্থান করেন সর্বকামনা সিদ্ধিদায়িনী দেবী কালী— মহাকালের মনমোহিনী।
অসীম কালের মতো নিরাকার সেই কালীকেই আকার দিয়েছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। কালীর যে রূপ আজ বাড়িতে বাড়িতে, মন্দিরে, পূজামণ্ডপে প্রতীয়মান— তা নাকি স্রেফ আগমবাগীশের রূপকল্পনা। একটি লজ্জানত মু্ক্তকেশী আদিবাসী মেয়েকে দেখে যাঁর কালীরূপের কথা মনে হয়েছিল। সে হতে পারে! লজ্জানত হওয়াই তো মেয়েদের ভবিতব্য। আবার সে মিথের রাজনৈতিক আখ্যানও তো রয়েছে। বৈদিক পুরুষতন্ত্র, আর্য অনুপ্রবেশকে প্রতিহত করতে এক ভূমিমানবীর প্রতিরোধের আখ্যানও রয়েছে কালীর রূপকল্পনায়। মজার কথা হলো, আগমবাগীশের অনেক আগে ত্রয়োদশ শতকের বৃহদ্ধর্ম পুরাণেও কালীর প্রায় একই রকম বর্ণনা। মহাদেবের উপর তার আসন। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে লোলজিহ্বা। এই জিভ কাটা প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছা হয়, স্বামীর গায়ে পা দিয়ে ‘লজ্জা’য় জিভ কাটা আর শবরূপী শিবের উপর পায়ের নখ স্পর্শ করে গোটা সৃষ্টিকে গিলে নিতে চাওয়ার যে লোলজিহ্বা— তার রাজনীতির মধ্যে তফাৎ আছে কী! লোলজিহ্বাকে স্রেফ লজ্জার জিভ কাটাতে পরিণত করতে দরকার হয় ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী রাজনীতির— না হলে সংসারে ওই রূপের আরশে সংসারের আঁট ভাঙবে অবধারিত।

বজ্রযানী তারার একটি রূপকল্পনা

সেখান থেকে তারার মাজারের যাত্রাটা কেমন? অথবা তারার মাজার থেকে তারার থানে আসা? কোনটা মাজার আর কোনটা ভবতারিনীর মন্দির— সে পথ গুলিয়ে যায় নিশ্চিত। যে ভাবে সত্যনারায়ণ যে সত্যপীরের বৈদিক রূপান্তর, তা অস্বীকার করা অসম্ভব। আর সেই সত্যপীরের গল্প শুনতে গেলে চলে যেতে হবে মনসুর হাল্লাজের কাছে। যিনি বলেছিলেন, আমিই সত্য সত্য। সে অবশ্য এক অন্য গল্প

কিন্তু শূন্যতা ও তাঁর থেকে সৃষ্ট সময়ের আখ্যানে একদিন স্থানিক সকল দিকচিহ্নের মহাকাশ ও ভূগোলবিদ্যার ডিসকোর্সের ভিতরে যদি পরম মহাশূন্য একমাত্র উপাস্য, তবে ইচ্ছাময়ী তারা থেকে ব্রহ্মময়ী কালী হয়ে শূন্যতার সবুজ বা নীলাভ তারায় ফিরতে হবে বৈকি! এমনকী পর্দানসীনের সুরতও দৃশ্যমান ওই শূন্যতায়। রূপ থেকে অরূপ— কিংবা অরূপের মধ্যেই গুণবাচক রূপের আস্বাদ।

কালী অনার্যা। জল-জমি-জঙ্গলে ঢাকা এই বঙ্গীয় সভ্যতার রূপকল্পের সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল। শবকে শিব করার যে আশ্চর্য উপায় তাঁর পায়ের তলায়, সভ্যতাকে প্রাণময় করে তোলার যে জাদু তিনি জানেন- তার সূচনা মুহূর্ত তিনি। তাঁর গর্ভেই রুহুর খেলা। জন্মদাত্রী তিনি, প্রতিপালিকাও তিনি। আর মৃত্যুতে তাঁর হাত ধরেই তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া, কালের গর্ভে থেকে যাওয়াটুকু থেকে যায় শাশ্বত হয়ে।

সময়ের আদি-অন্ত নির্ধারণ সহজ নয়। বরং অসম্ভব। আর সেখানেই রহস্যভরা তাঁর অস্তিত্ব। যে ভাবে শূন্যের বিস্তার। শূন্যের গর্ভে তিনি ভরে দেন তাঁর রূপরস শব্দগন্ধ। তাঁর কৃষ্ণজ্যোতিতেই আলোকিত সত্ত্বা। সেই রূপের আরশ দেখা বড় সহজ নয়। যেভাবে বাংলার গানে গানে শোনা যায়, মওলা আলী (আঃ) তাঁর স্ত্রী বিবি ফাতেমা (রাঃ)’র নিগূঢ় রূপদর্শন করতে চেয়েছিলেন বলেই নাকি তাঁর আওলাতের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়! এই আখ্যানের গভীর দার্শনিক তাৎপর্য আছে। ইসলামে গায়েব বা অদৃশ্যের দার্শনিক তাৎপর্য গভীর।

গায়েবী রূপের চিত্রকল্পনা

তবু নিরাকার পরম থেকে সৃষ্ট ও স্থান ও কালের গল্পে যখন আমরা সাকারের রূপভজনা করি, সেই রূপমাধুরীর চর্চায় কোনও না কোনও ভাবে এসে পড়ে কালকেতু ফুল্লরার উপাখ্যান, কমলাকান্তের পদ। আর সেই চরণ ধরেই রূপ বদলাতে থাকেন দেবী। আর দেবী সর্বমঙ্গলা শুধু কমলাকান্তের গান শুনতেই পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন গঙ্গার পাড়ে। আর তার সঙ্গে মিশে যায় রঘুডাকাত আর চিতে ডাকাতের কাহিনি। ঈশ্বরের জনজীবন বড় বিচিত্র। কখনও শ্মশানতারা হয়ে তাঁর মদ্যমাংসরতিক্রিয়া, আর কখনও বা মঙ্গলময়ী মা হয়ে ভক্তের সকল কর্মফল গ্রহণ করেন তিনি নিজে। সাধে কি আর, কোরানের আয়াত অভয় দেয়, তোমার চেয়েও তোমাকে নিয়ে বেশি ভাবনা তাঁর?
ভক্তি গ্রহণ করে ভক্তি। লীলা বিচিত্রতর হয়।

অরূপ লীলার পায়ে মাথা নোয়ায় মানুষ। মোমের শিখা আর শ্রমের শিরনিতে জেগে থাকে প্রেম। অনন্ত, অসীম প্রেম। আহ্লাদিনীর লীলা হয়ে।

রাঢ়বঙ্গের তারা

পর্ব-১ অরূপে দ্যাখো রূপমাধুরী

লেখক পরিচিতি:
রূপসা
লেখক, গবেষক, সাংবাদিক। জন্ম ১৯৮৭ সালের ৫ আগস্ট৷ এক সময়ে বিপ্লবী কমিউনিস্ট ধারার ছাত্র রাজনীতি ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন৷ পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে৷ এমফিল-এর কাজ চটকল শ্রমিকদের মৌখিক ইতিহাস নিয়ে, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস, আন্দোলনের ইতিহাস, সত্তার ইতিহাস। প্রিয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর সুদানের তায়েব সালিহ।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top