আজ বৃহস্পতিবার, ৮ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

অভিনয়: ইতিহাসের নির্মাণকাণ্ডে নাকি নাটকের মঞ্চে?

Author : ফরহাদ মজহার

ঢাকা শহরে বা মফস্বলের আধা-গ্রাম আধা-শহরগুলোতে যাঁরা গানবাদ্য থিয়েটার নাটক পদ্য আবৃত্তি করেন আমি তাঁদের খুব নিকট থেকে দেখতে ভালবাসি, পর্যবেক্ষণ করি; কিন্তু কাছে ঘেঁষতে ভরসা পাই না। সংস্কৃতির প্রতি এদের আগ্রহ এবং উদ্দীপনার শেষ নাই। এরা পকেটের টাকা খরচ করে নাটক করেন, কবিতা পাঠের চর্চার জন্যে স্বরসাধনের দারুণ পরিশ্রম করেন। নাটকে এঁদের বৃন্দ আবৃত্তি যখন প্রথম শুনি তখন ভয়ানক ভড়কে গিয়েছিলাম। এই যদি কবিতার দশা হয় তাহলে আদৌ কবিতা লিখা ভাল কাজ কিনা সে ব্যাপারে দীর্ঘদিন মনে ধন্দ ছিল। তবুও তাঁদের সমবায়িক মেহনতকে খাটো করে দেখার উপায় নাই। নাটকের রিহার্সাল করার জন্য এরা যে পরিমাণ শারিরীক প্ররিশ্রম করেন, মাসের পর মাস — বোধহয় বাংলাদেশের মিলিটারি এতো দৈহিক প্ররিশ্রম করে না। আমি প্ররিশ্রমী তরুণ তরুণীদের ভালবাসি। ফলে, বলতে বাধা নাই, প্রধান শহরে বা মফস্বলের আধা কিংবা সিকি শহরে যাঁরা এই কাজে লিপ্ত রয়েছেন তাঁদের আমি পছন্দ করি।

কিন্তু তবু কেন কাছে ঘেঁষতে পারি না ? এই বিষয়ে অনেকদিন ভেবেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় এটা আমার ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স। অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে নিশ্চয়ই একটা হীনমন্যতাবোধ আছে। হয়তো আমি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বড়ো কিছু করতে চেয়েছিলাম। ফেল মেরেছি। অতএব অন্যদের সাফল্যে চোখ টা টা করছে। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও বন্ধু সেলিম আল দীন, মামুনুর রশিদ কিংবা অগ্রজ, সৈয়দ শামসুল হকের প্রতি মনে ঈর্ষা জাগিয়ে তুলতে পারলাম না। কসম করে বলি, চেষ্টা করেছি। কারণ হঠাৎ একবার আমার ধারণা হলো যদি এঁদের বিরুদ্ধে নিজের মধ্যে একটা ঈর্ষা জাগাতে পারি তাহলে আমার আবার নাটকে লিখবার সাধ এবং জিদ জেগে উঠতে পারে। মুশকিল হলো এই যে, আমি এঁদের নাটক পছন্দ করি। সম্প্রতি সৈয়দ হক ‘খাট্টা তামাশা’র প্রিভিউ শুরু হওয়ার আগে কাহিনীটার সরকথা আমাকে শুনিয়েছিলেন। শুনেই ভাল লেগেছিল। আমি নজির হিসেবে শুধু অল্প কয়জনের কথাই বললাম। তরুণদের প্রডাকশান আমি দেখি। খায়রুল বাশারের ‘চাঁদবণিকের পালা’ কিংবা সোলায়মানের ‘কোর্টমার্শাল’-এর কথাও মনে পড়ছে। তাহলে হীনমন্যতা নয়, কারণ অন্যত্র খুঁজতে হবে।

স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশের প্রথম নতুন ধারার নাটক যখন শুরু হয় তখন প্রথম একটি পরীক্ষামূলক নাটক লিখি, ‘প্রজাপতির লীলালাস্য’। বহুবচন সেটা মঞ্চস্থ করে (১) । গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু রাজা কেবল পোশাক বদলাচ্ছে — শাসক এবং শাসিতের সম্পর্কে কোন মৌলিক রূপান্তর ঘটছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না রাষ্ট্রের ভিত্তিটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রজাপতির এই লীলালাস্য চলবে, ইতিহাসে, মৌলিক কোন রূপান্তর ঘটবে না। এই ছিল থিম। স্বাধীনতার পর আজ প্রায় তেইশ বছর আগে এই কথাগুলো বলা দারুণ দুঃসাহসের কাজ ছিল।

মনে আছে, তখন খুব মনোযোগ দিয়ে লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বইটি পড়ছিলাম। পড়ার পর মনে হয়েছিল লেনিন রাষ্ট্রকে শুধু শ্রেণী শোষণের ‘হাতিয়ার’ বলেন নি। যদিও এইরকম হাতিয়ারমূলক ব্যাখ্যাই কমিউনিস্টরা দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রের প্রশ্নে আরো গভীরতর ইঙ্গিত আছে তাঁর গ্রন্থে। যাকে শুধু অর্থনীতির নিয়ম দিয়ে বা কোন হাতিয়ারবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার ইঙ্গিত একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিচার বিবেচনা বা বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা বা সংকটের দিকেও ইশারা প্রসার করে। তখন সেই ইশারাটাকে ধরতে চেয়েছি। কারণ লেনিনের চিন্তার প্রথাগত ব্যাখ্যাগুলো তো আমাদের সকলেরই জানা। বোঝাতে চেয়েছি, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, নতুন ‘রাজা’ ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু সেটা কেবল পোশাকের বদল। রাজার শরীর বা body politic কিন্তু ঠিকই আছে। এরপর কমিউনিস্টরা যদি ক্ষমতায় যায় তাহলেও একই ঘটবে। তাহলে উপায় কি? রাষ্ট্রকে যদি তার পোশাক বা বাইরের রূপ দিয়ে দেখি তাহলে তার শরীর বদলানো যাবে না। ইতিহাসের রূপান্তর মানে শরীরের রূপান্তর। পোশাকের বদল নয়।

কবি এবং প্রজাপ্রতির সম্পর্কে নিরসনের মধ্য দিয়ে সেই উপায় বের করতে হবে। ইতিহাস একই সঙ্গে ভাষা সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা, কিংবা আমাদের ধ্যান-ধারণার বিবর্তনেরও ইতিহাস। ওখানে প্রজাপতিকে গ্রেফতার এবং তার লীলালাস্য বন্ধ্ করা না গেলে শুধু বাংলাদেশ কেন মানুষের সামগ্রিক ইতিহাসের মধ্যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিই ঘটাতে থাকবে। যে ‘মুক্তি’র কথা আমরা গাল ফুলিয়ে বলি সেগুলো গাল ফোলা বাচালতা হয়ে ফুলঝুরি ফুটিয়ে যাবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। আসলে আমাদের প্রথাগত ধ্যান-ধারণা, ভাবনা-চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করার তাগিদ ছিল সেই নাটকে। মোদ্দা কথায়া রাষ্ট্রের প্রশ্নকে সংস্কৃতি ও প্রজ্ঞার পরিমণ্ডলে বিচার করার ইঙ্গিত করা হয়েছিল, সেটা আমরা কখনোই করি না। আমরা ধরেই নেই আমাদের ভাষা, প্রতীক ব্যবহার এবং সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে রাষ্ট গঠনের কোন সম্পর্ক নাই। সেটা ভুল, এতোটুকু বুদ্ধি সেই সময় – ষাটের শেষ বাহাত্তরের শুরূ সময় কালে হয়েছিল।

আমি এরপর বিদেশে চলে যাই। কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যুক্ত থাকতে না পারলে নিজেকে অসুস্থ মনে হতো। ফলে অতি অচিরেই নিউইয়র্কে নিকারাগুয়ান সলিডারিটি মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। সান্দিনিস্তা তখন দারুণ খবর। পল স্যুইজির Monthly Review এবং Review of Radical Political Economy প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কারণে বহু প্রগতিশীল ল্যাটিন আমেরিকার বন্ধুদের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সান্দিনিস্তা’র সংগ্রাম সহ নিকারাগুয়ার জনগণের সংগ্রাম প্রচারের কাজে তাঁরা সহযোগিতা চাইলে আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। New School for Social Research-এ যখন অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়ব বলে আসা যাওয়া শুরু করলাম তখন সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এই সময় ইরানের শাহের বিরুদ্ধেও আন্দোলন দানা বাঁধছে। বড়ো শহর হবার কারণে নিউইয়র্কে নানান দেশের প্রগতিশীল শিল্পী সাহিত্যিক কবিদের বিভিন্ন আখড়া। তাঁরা নানানভাবে জড়িত। আমিও কারো না কারো সঙ্গে জড়িত হয়ে আছি।

ছিয়াত্তর সালের দিকে দেশে এসেছিলাম। তখন আমার আরেকটি নাটক বহুবচন মঞ্চস্থ করে। ইতোমধ্যে ঢাকার নাটকের পরিবেশ বদলে গেছে। সেলিম (সেলিম আল দীন) নাটক লিখছে। ভাল লাগলো। কারণ শরিফ মিয়ার কেন্টিনে ছাত্রাবস্থায় ওর একটি গল্প পড়ে নাটক লিখতে বলেছিলাম। সেলিম কবিতা লিখতে চাইত কিন্তু কবিতা ওর একদমই ভাল হোত না। আশা করি সেলিমের মনে আছে। নাটকে ও মনোযোগী হয়েছে সেটা ভাল লেগেছিলো। ছিয়াত্তরের দিকে এসে সেই সময় লিখি, ‘ঘাতক দেশকাল’। গোপন সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে নিজের ‘কমরেড’দের যে ‘লাশ’ জমিয়ে তুলেছে তার বোঝা কি তারা ইতিহাসে টেনে নিয়ে যেতে পারবে? এটা কি সম্ভব? এই ছিল আমার প্রশ্ন। আমার ধারণা এই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরায় নি।

সে যাই হোক। আসল কথা বলি। নিউইয়র্কে ফিরে ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছি। সম্ভবত ছিয়াত্তর সালের শেষ কিংবা সাতাত্তর সালের শুরুর কথা। তখন অতি উৎসাহে ঢাকার মহিলা সমিতি মঞ্চে দেখা তরুণদের চমৎকার নাটকের বর্ণনা দিচ্ছি। হঠাৎ করে লক্ষ্য করি সকলেরই মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। আমি খুশি, হাসছি, বাংলাদেশের তরুণ্রা ভাল নাটক লিখছে তাই নাটকের প্রশংসা করছি, কিন্তু কাউকেই তেমন উৎসাহিত দেখলাম না। তখন নিকারাগুয়ার একজন বন্ধু আমার অবস্থা বুঝে খুবই দরদের সঙ্গে বলল, কমরেড, থামো। তোমাদের দেশ তো সবে তিরিশ লাখ লোকের রক্তের সরোবরের ওপর দিয়ে পদ্মফুলের মতো ভেসে উঠেছে, তাই না? আমি বললাম, অবশ্যই। তাহলে তার গলা এবার কঠোর হলো।

দেখো, জনগণ ইতিহাস সৃষ্টি করতে জানে, এটা তোমাদের নতুন জেনারেশনের তরুণদের কাছে স্পষ্ট। এটা গল্প কিম্বা নাটক তো না। ঠিক না? অর্থাৎ যারা নাটক অভিনয় করছে তাদের কাছে এই দিকটা পরিষ্কার? আমি আবারো বললাম, আলবৎ। এবার সে আরো কঠোর কণ্ঠে আমাকে বলল, কমরেড, যে দেশে এতো রক্তপাতের পরে এবং চোখের সামনে জনগণের বিজয়ের উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও তরুণরা বা তথাকথিত সংস্কৃতিসেবীরা ইতহাসের মঞ্চে অভিনয় করার চেয়েও নাটকের মঞ্চে অভিনয় করতে ভালবাসে তাদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। তুমি অযথাই উত্তোজিত হয়ে এদের প্রশংসা করছো। এরা কিছুদিনের মধ্যেই তোমাদের প্রগতিশীল রাজনীতির বোঝা হয়ে উঠবে। তোমাদের তরুণরা ইতিহাসের লেজে তাদের ঘোড়া জুড়ে দিয়ে পেছন দিকে চলা শুরু করেছ্, বন্ধু। দুঃখিত।

এই আকস্মিক সমলোচনায় আমি থতমত খেয়ে যাই। আমার কানের কাছে আজো মেঘের গর্জনের মতো বাজে, যারা ইতিহাসের মঞ্চে অভিনয়ের চেয়ে নাটকের মঞ্চে অভিনয় করতে ভালবাসে সেই তরুণদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না, ইতিহাসের লেজে ঘোড়া জুড়ে দিয়ে পেছন দিকেই তারা দৌড়াবে। এই প্রথম আমার নান্দনিক অহংকার মস্ত বড়ো একটা লাথি খেল। আমি কিছুটা অপমানিত হয়ে চুপ হয়ে যাই।

পরে এই বিষয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আরো কথা হয়। আসলে কি ইতিহাসের বৈপ্লবিক রূপান্তরে নাটকের বা সংস্কৃতির কোন ভূমিকা নাই? অবশ্যই আছে। অবস্থা এবং ইতিহাসের পর্যায় ভেদে সেই ভূমিকায় তারতম্য ঘটে। একটি রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে যে জেনারেশন বেরিয়ে এসেছে সে কি করে তার ‘অভিনয়’ এর ক্ষেত্র হিসাবে মঞ্চকে বেছে নিতে পারে? বাংলাদেশের জনগণ একটি যুদ্ধে জিতেছে, কিন্তু যে সমাজ ও রাষ্ট্র তারা বানাবার স্বপ্ন দেখেছে তার কোন কাজই তো হয় নি। যখন সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বা নতুন ধ্যান-ধারণা স্তিমিত তখন নাটক বা সংস্কৃতি সমাজের রাজনীতিকরণের ভূমিকা পালন করে। সেই ভূমিকার লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের বৈপ্লবিক ইচ্ছাকে জাগিয়ে তোলা এবং সেই ইচ্ছাকে এরপর নাটকের মঞ্চ থেকে নামিয়ে ইতিহাসের মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া। ইতিহাসের মঞ্চ আর মহিলা সমিতির মঞ্চের ভেদ রেখা মুছে দেয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। কিন্তু যখন ইতিহাসের মঞ্চে জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে, যখন দাবি হচ্ছে, ইতিহাস যেখানে তৈয়ার হয় সেই মঞ্চে অভিনয় করার, যখন নাটকের মঞ্চ বিলুপ্ত, যখন একমাত্র ইতিহাসের মঞ্চে অভিনয় করবার জন্য তরুণদের ডাক পড়ছে, যখন যুদ্ধের ক্ষত এবং গায়ে রক্তের দাগ শুকায় নি — তখন নাটকের মঞ্চকে শক্তিশালী করা মানে জনগণের সঙ্গে বেঈমানী করা, বিশ্বাসঘাতকতা করা। সংস্কৃতি আমাদের অজান্তে এই বদমায়েশিগুলো করে যায়। আমরা সুশোভন বদমায়েশের হাতে ধরা খেয়ে যাই। টেরও পাই না। আশ্চর্য!!

এই ঘটনার পর আমি আর নাটকে ফিরে আসতে পারি নি। এটা আমার নাট্য প্রতিভার দুর্দান্ত ঘাটতিও হতে পারে। কিন্তু সত্যি কথা হলো মঞ্চ সম্পর্কে এই উক্তি আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। আমার ধারণা, সংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের পছন্দ করলেও কাছে ঘেঁষতে না পারার যে অনীহা তার পেছনে এই উক্তিটি অবচেতনে আমার মধ্যে কাজ করে। গত কয়েকবছর ধরে আমি তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। অন্যান্য কারণ ছাড়াও এই চেষ্টার পেছনে একটি কারণ হোল নাটককে আমি শক্তিশালী মাধ্যম বলে গণ্য করি। অতএব ইদানিং মনস্থ করেছি আমি নাটক লিখবো।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একাত্তর সালের পরে বাংলাদেশের নাটক ও সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিভার সন্ধান আমরা পেয়েছি। কিন্তু আমি যতোই এই বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছি ততই লক্ষ্য করছি একটা প্রচন্ড প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক এবং গরীব জনগণের স্বার্থের বিরোধী ধ্যান-ধারণা কাজ করে গেছে। অথচ বাইরে থেকে মনে হচ্ছে আমরা খুব ‘বিপ্লবী’; কথাবার্তায় বিস্তর বিপ্লব। কিন্তু অন্দরে অন্য জিনিস। দুটো উদাহরণ দেই।

মুক্তিদুদ্ধ সংক্রান্ত প্রতিটি নাটকেই আমি লক্ষ্য করি, রাজাকার বা আলবদর মানেই একজন জোকার, এক ধরনের ক্লাউন। তার দাঁড়ি আছে,টুপি আছে। দাঁড়ি এবং টুপি বাংলাদেশের রাজাকার বা আলবদরদের পোশাক নয় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরীব সাধারণ মানুষেরও পোশাক। সত্যি বলতে কি যুদ্ধের সময় আমি দাঁড়ি আর টুপি-পরা রাজাকার যতো না দেখছি, তার চেয়ে বেশি দেখেছি প্যান্ট শার্ট-পরা রাজাকার কিংবা টাইস্যুট পরা শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান। আজকাল টেলিভিশনে লক্ষ্য করছি স্যুটটাই পরে অতি ‘আধুনিক’ মোল্লা ইসলাম প্রচার করছে। মানুষের সাধারণ অনুভূতিকে আহত করে প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা এবং একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পোশাককে চিহ্নিত করে পুরো ধর্মকে ঠাট্টা করার নাম আর যাই হোক প্রগতিশীলতা নয়। এই টুপি পাঞ্জাবি বা লুঙ্গি পরেই বাংলাদেশের কৃষক যুদ্ধ করেছে। এই পোশাক, গরীবেরও পোশাক। ক্রমাগত এই ধরনের ইমেজ গরীব কৃষকের মনে এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি করেছে। তেমনি ধুতি ফতুয়াও এই দেশের মানুষের পোশাক। এই পোশাক বিতর্কিত নয় বলে এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই।

পোশাক নিয়ে এখানে ঝগড়া হচ্ছে না, পোশাকের মধ্য দিয়ে একটি সম্প্রদায় এবং ধর্মকে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদি একটি নাটকে এটা থাকতো তাহলে সে সম্পর্কে বলার কোন প্রয়োজন হতো না। কিন্তু এটা ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র বাতিক হয়ে গিয়েছে। আমি এই ধারাকে সাম্প্রদায়িক বলে গণ্য করি। যাঁরা নাটক অভিনয় গল্প কবিতা সংস্কৃতি করেন তাঁদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কতো ক্ষীণ এই ক্ষেত্রে এটা প্রমাণিত হয়।

দ্বিতীয় উদাহরণ। গ্রামের সকল সংঘাত, হিংস্রতার খলনায়ক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান’ — এটাও আমাদের সংস্কৃতির একটা টিপিক্যাল চরিত্র। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউনিয়ন পরিদষ। এই নাটকগুলোতে দেখানো হয় যে, চেয়ারম্যান বদলোক, তিনি রাজনীতি করেন এবং গ্রামের দুর্ধশার মূলে এই লোক ছাড়া যেন আর কোন কারণ নাই। এর মধ্য দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় সরকার মূলক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটা ইমেজ গড়ে তোলার অর্থ সাদাহ্রণ ভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। জনগণের যতোটুকু ক্ষমতা শক্তিশালী শ্রেণিগুলো বরদাশত করতো সেটা রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া। নাটকের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াই জোরদার হয়েছে। ভেবে দেখার দরকার আছে এই সকল নাটক এরশাদ আমলের রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভবন বা শহরের আমলা আর সামরিক বাহিনীর হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটাবার কাজ সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে কতোটা সম্পন্ন করেছে। যার ফলে আজ বিএনপি সরকার স্থানীয় সরকার কাঠামো বিলুপ্ত করে দেবার পরেও এ নিয়ে কোনই উচ্চবাচ্যই হচ্ছে না। এই ধরনের নাটক প্রচণ্ড গণবিরোধী এবং গণতান্ত্রিক প্রকিষ্ঠান নির্মাণের বিপক্ষে। একদিকে জনগণের পক্ষে কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা এই নাটকগুলো কখনোই তুলে ধরতে পারে নি, অন্যদিকে রাষ্ট্রের সামরিকায়ন এবং জনগণের হাতের কাছের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ভাঙা ও ক্ষয়ে ফেলাবার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। গ্রামের ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা শ্রেণীর বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কথা অনেকে বলতে চেয়েছেন, বুঝতে পারি। কিন্তু তাঁরা শিশুর গা ধোয়াতে গিয়ে গামলার সঙ্গে শিশুটিকেও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। অর্থাৎ চেয়ারম্যানের খারাপ ছবি তুলে ধরতে গিয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের একটি বদ ছবি এঁকেছেন। এতে ক্ষতি হয়েছে।

শহরে আর আধা শহরে যাঁরা সংস্কৃতি করেছেন তাঁদের কাছে পারফরমেন্স বা একটা কিছু করে আত্মপ্রসাদ লাভ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতির শক্তি বা ভূমিকা সম্পর্কে তাঁরা বিশেষ সচেতন বলে মনে হয় না। অনেকে হয়তো টেলিভিশনে একদিন সুযোগ পাবার বা ঢাকার নাট্য জগতের মুরুব্বিদের মতো একটা প্রচারণা সংস্থা গড়ে তেলার স্বপ্ন দেখেন। যে শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা সংস্কৃতি করছে এরা বড়লোকের ছেলে-মেয়ে নয়, আবার গরীব বা খেটে-খাওয়া পরিবারের ছেলেমেয়েও না। এই দিকটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আধাখেঁচড়া চিন্তা-ভাবনার শ্রেণীগণ দিকটা পরিস্কার হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়াটা না-গরীব না-ধনী হাফ-মিডল ক্লাসের জন্য একটা ষ্ট্যাটাস রক্ষার ব্যাপারও বটে। এরা না ঘরকা না ঘাটকা। এদের প্রয়াসকে ক্ষুদ্র করার জন্য এই কথা বলছি না, তাঁরা নিজেরা যেন নিজেদের চিন্তা-চেতনা নান্দনিক ধ্যান-ধারণার উৎস চিনতে পারেন তার জন্য মনে করিয়ে দিচ্ছি।

এই অবস্থা থেকে বেরুবোর পথ খুঁজতে হবে। এই কাজ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সংস্কৃতির মুরুব্বি হিসেবে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ নামে যে সংস্থাটি খাড়া রয়েছে সেটা যে সম্মিলিত ব্যাপারে নয় এবং শহরের আধাখেঁচড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমিত একটি বিশেষ শ্রেণির গণবিরোধী রাজনীতি – এই উপলব্ধিটুক আগে আমাদের হওয়া দরকার। আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে সামনের পথ পরিষ্কার হবে।

ইতিহাসের মঞ্চে অভিনয়ের চেয়ে নাটকের মঞ্চে অভিনয় করাই যদি কারো জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে থাকে তাদের জন্য এতো কথা বলি নি। যাঁদের উদ্দেশে বলেছি, জানি, তাঁদের কাছে আমি পৌছাতে পারবো। কারণ শিঙা ফুঁকার আওয়াজ উঠবেই, হাওয়া আবার বদলাতে শুরু করবে!!

৬ শ্রাবণ ১৪০২ শ্যামলী।

(দেশচিন্তা, বর্ষ ১ সংখ্যা ৬; ১-৭ অগাস্ট ১৯৯৫)

… … …

(১) স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে জুনের ৩ তারখে সর্বপ্রথম বহুবচনই এদেশে এককভাবে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু করে। এই দিন দর্শনীর বিনিময়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘প্রজাপতির লীলালাস্য’ নাটকটির মঞ্চায়ন হয়। নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন মোতাহার হোসেন। সেই সময় মঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে মেয়েরা এখনকার মতো সক্রিয় ছিলেন না। আনোয়ারা তখন চলচ্চিত্রে অভিনয় করছিলেন। তিনি নাটকটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর অভনিয়ে ছিলেন করেছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী আনোয়ারা, নৃত্যশিল্পী দীপা খন্দকার, শিখা, মুজিব বিন হক, আরহাম আলো , প্রমুখ।

মুজিব বিন হক ও মোতাহার হোসেন, আরহাম আলো আমার নাট্য জীবনের ইতিহাসে বন্ধু ও প্রেরণাদাতা হিসাবে কাজ করেন । তরুণ কবি রফিক নওশাদের ভূমিকাও ভুলবার নয়। মুজিব এখন দেশান্তরী — নিউইয়র্কে। মোতাহার কোথায় আছেন জানি না। সাহিত্যিক বন্ধুদের মধ্যে শাহনূর খান, সাযযাদ কাদির আর সেলিম আল দীন এই সাফল্যে দারুন উৎসাহিত হয় এবং তারাও নাটকে মনোযোগ দেয়। ‘প্রজাপতির লীলালাস্য’ এই কাজটি করতে পেরেছিল। সেলিম এখন সবার পরিচিত। এই নাটোক্টির পরপরই সে কবি হবার নিস্ফল চেষ্টা পরিত্যাগ করে, কিন্তু লিখে ফেলে নাটক: ‘সর্প বিষয় গল্প’ (১৯৭২) । শাহনূর খান লেখে, ‘সভাপতি বলবেন’।(১৯৭২), তারপর সাযযাদ কাদিরের ‘সাড়ে সাতশো সিংহ’ (১৯৭৪)। তেয়াত্তর-চুয়াত্তরের দিকে আমি ‘ঘাতক দেশকাল’ লেখা শেষ করি। বহুবচন এটা মঞ্চস্থ করে ১৯৭৮ সালে। নির্দেশক ছিলেন মুজিব বিন হক।

কবি শাহনূর খান আর আমাদের মধ্যে নাই। আজকাল তার অল্প বয়সে টাক পড়ে যাওয়া মাথা আর অনর্গল ঘামতে থাকা সরল মুখখানা খুব মনে পড়ে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top