রক্তনদী পেরিয়ে নতুন বাংলাদেশ

।। নাদিয়া ইসলাম ।।

এর মধ্যে ছাত্রদের পক্ষ থেকে যে সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সরকারের মেয়াদ শেষের ৩ মাস আগে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধান বিচারপতির অপসারণ এবং লীগের সমর্থক বিচারপতিদের অপসারণ করতে হবে। আর্মি নেভি এবং এয়ারফোর্স বাদে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনির প্রধানদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বাতিল, সরকারের সকল চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ বাতিল, ছাত্র-নাগরিক হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত, নিহত ও আহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, জুলাই মাসকে জাতীয় শোকের মাস ঘোষণা, বিগত পনেরো বছরের দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা, শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন তাদের দাবীর বাকি অংশ। ইতিমধ্যেই প্রধান বিচারপতিকে অপসারণ করা গেছে। বাকি বিচারপতিরাও ক্ষমতা ছাড়বেন বলেই আশা রাখি।

৫ অগাস্ট ২০২৪। এই দিন শেখ হাসিনা নামক জালিমের লাইলাতুল ইলেকশানের অবৈধ সরকারের চুরির বাটপারির এক যুগ ধরে বিরোধী দল-সহ প্রতিটা বিপক্ষ কণ্ঠস্বরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সমস্ত সংসদীয় পথ রুদ্ধ করার সাধারণ মানুষকে ভোটের অধিকার বঞ্চিত করা— সাধারণ মুসলমানকে নিজ রাষ্ট্রে ‘অপর’ করে দেওয়া— ষষ্ঠীর আগের রাতে সাধারণ হিন্দুর প্রতিমা ভাঙা— সাধারণ মারমা চাকমা রাখ্যাইন তঞ্চ্যগাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে বাঁশের কোড়লে অস্ত্র লুকানো টেরোরিস্ট বানানো প্রতিটা আদিবাসীকে উপজাতি বলে বাঙালি হতে বাধ্য করা এক পাহাড়ে ছ’খান ক্যান্টোনমেন্ট বসিয়ে প্রতিটা জুলহাস অভিজিৎ তনু রাজিব হায়দারের রক্তে প্রতিটা নিখোঁজ কল্পনা চাকমা সাগর রুনির গল্পে সকালসন্ধ্যা জাতীয়তাবাদের ৭ই মার্চের ভাষণে লেফট-রাইট লেফট-রাইট লেফট-রাইট করিয়ে নিজেরা জামাতের কোলে চড়ে হেফাজতের মডেল মসজিদ বানিয়ে কওমী জননীর উপাধি নিয়ে বগল বাজাতে বাজাতে মাঘ মাসের শীতভোরে দেশপ্রেমের জয়-বাংলা বড়ি গেলানো উন্নয়নের লেবেঞ্চুষের হাওয়াই মিঠাই বাতাসার গল্প শুনিয়ে কোটি কোটি টাকার ‘জুয়েল আইচ’ করে দেওয়া নিজ রাষ্ট্রে ট্যাক্স দেওয়া নিজের সাধারণ মানুষের ওপর আয়নাঘরের গুম গণহত্যা এবং ডিভাইড এ্যান্ড রুলের কুৎসিত পোকার নাইট চালানো একদলীয় শাসনের, ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে।

ছাত্ররা বিজয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার জুলুম থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধ এখনও থামেনি।

হ্যাঁ, ছাত্ররা বিজয়ী হয়েছেন, বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছে, কিন্তু আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগের গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের এখনও জন্ম হয়নি।

রাষ্ট্র নামক শিশু ভূমিষ্ট হবার আগে বাংলাদেশকে এখন জেস্টেশান পিরিয়ডের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এবং সেই যাত্রার শুরু হবে ছাত্রদের হাত ধরে, কোনো সেনাশাসকের মাধ্যমে না। ২০১৮ সালে প্রাথমিকভাবে শুরু হয়ে প্রিম্যাচিওরভাবে থেমে গিয়ে আবার ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই ছাত্র আন্দোলন মূলত একটা ডিসেন্ট্রালাইজড আন্দোলন ছিল। এই আন্দোলনে কোনও সক্রিয় বা সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি নেতৃত্ব দেয়নি। এই আন্দোলনকে সিআইএর ফান্ডিংয়ে চলা আমেরিকার জামাত শিবির রাজাকারের আন্দোলন বলে চালানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে। এবং সত্য কথা বলতে জামাত শিবির ইসলামপন্থীরা অন্যের বাড়ির আগুনে আলু পুড়িয়ে খেতে চেয়েছে হয়তো, র বা সিআইএ হয়তো মোংলা বন্দর পরিচালনার ক্ষমতা বা আইএমএফের বদলে চীন থেকে লোন নেওয়ার ফলশ্রুতিতে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে এখানে যুক্ত হয়েছেও টু সাম এক্সটেন্ট, কিন্তু এই আন্দোলন আক্ষরিক অর্থেই শুধু ছাত্রজনতা থেকে সাধারণ মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এক সময়— অর্গানিকভাবে বায়োলজিক্যালিই। এই আন্দোলনে সাধারণ মুসলমান যোগ দিয়েছেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি শিক্ষক গৃহিনী ‘আই হেইট পলিটিক্স’-এর জেন-জির বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রিক্সাওয়ালারা কমিউনিস্ট পার্টি বাম গণতান্ত্রিক জোট ডান মধ্যপন্থী কিছুই-না-পন্থী সকলে ধর্ম মতাদর্শ রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে যোগ দিয়েছেন স্বতস্ফূর্তভাবে, কারণ গত ষোলো বছর ধরে তাদের সবাইকে মুখ আটকে ইচ্ছামতো ঝাঁকানো হয়েছে লীগের কাচের বোতলে ভরে।

এবার সোডার বোতল থেকে তারা ফসফসিয়ে বের হয়ে এসেছেন তীব্র রাগে ক্ষোভে এবং উষ্মায়— নিজেদের নাগরিক অধিকার ফিরে পেতে।

তবে হ্যাঁ, হাসিনার পতন হয়েছে, তিনি বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বটে, কিন্তু তিনি ক্ষমতা দিয়ে গেছেন নিজের চাচাতো বোনের স্বামী আর্মি চিফের হাতে, কিন্তু তার সোনার ছাত্রলীগের গুণ্ডারা, গত এক যুগে প্রতি সেক্টরে রেখে যাওয়া তার প্রতিটা সুবিধাভোগী দালাল সিভিল সার্ভেন্ট মিডিয়াকর্মীরা মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে আছেন ছাব্বিশ হাজার বর্গমাইল জুড়ে। সেটা ভালো না খারাপ খবর তা পরিস্থিতিসাপেক্ষ আলাপ, তবে এই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, বলাই বাহুল্য। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরপরই আমরা দেখছি বাংলাদেশ জুড়ে নৈরাজ্যের লুটপাটের গাড়িতে আগুন লাগানোর শেখ মুজিবের শামীম আযাদের ময়মনসিংহের শশী লজের ভাস্কর্য্য ভেঙে ফেলার ঘৃণ্য ঘটনা, গণভবনে লুটপাট চালিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর শাড়ি চুরি করে নিয়ে ফেইসবুকে প্রকাশ্যে কদর্য উল্লাস আর রাহুল আনন্দের সব বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলে সব চিহ্নিত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মন্ত্রীদের এমপিদের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে সংখ্যালঘুদের মন্দির ভাঙচুর করে থানা লুট করে আসামীদের অস্ত্রসমেত বেরোতে দিয়ে এলাকায় এলাকায় ডাকাতি করে জামাত এবং হেফাজত সহ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি গর্ত থেকে বেরিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠে সব ব্ল্যাকলিস্টেড নাস্তিক ব্লগারদের ডেথ থ্রেট দিয়ে দাঙ্গা লাগানোর প্রচেষ্টায় আছে। এর কতদূর কে করছেন, কে নিপাট সুযোগসন্ধানী, কে এতোদিন অত্যাচারিত হয়ে লীগের ওপর প্রতিশোধ নিতে গেছেন, এসব ঘটনার কতদূর সত্য কতদূর প্রপাগান্ডা, কে কার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন তা এই মুহূর্তে বলা শক্ত। হ্যাঁ, যুদ্ধ বা গণঅভ্যুত্থান শেষের স্বাধীনতা উদযাপনের উল্লাস সবসময়ই কদর্য কুৎসিত অশ্লীল তা আমরা দেখে এসেছি ফ্রেঞ্চ রেভোলুশানে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মিত্রপক্ষের মাধ্যমে জার্মানির ওপর চালানো গণহত্যায়, এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিহারীদের যেভাবে খুন করা হয়েছে তার কোনোটাই যে কখনও সুখকর দৃশ্য ছিল না আমরা জানি, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় বিজয়ীর বয়ানে গণহত্যার বর্ণনা পড়া আর চোখের সামনের সেই কুইনাইনের দৃশ্য গেলা তো দুই জিনিস, নয় কি?

দু’দিন আগে আমার পরিচিত আওয়ামী লীগের খুব সুপরিচিত একজন কল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জানালেন ওনার ঢাকার বাসায় আগুন দেওয়া হচ্ছে। বাড়িতে ওনার বৃদ্ধ বাবা আর তেরো বছরের ভাগ্নে। আমি ওনাকে বলতে চাইলাম, এই ফ্রাংকেনস্টাইন আপনার তৈরি করা, এই বাংলাদেশ আপনার তৈরি করা, এর কনসেকোয়েন্সেস আপনার বহন করারই কথা, এই কোলেট্যারেল ড্যামেজ, এই রিপার্কাশান— এই জিনিস আমার বন্ধু তাসনিম খলিল, মুয়াজ খলিল আর লুবাবার মা নাজনীন খলিল গত দশ বছর ভোগ করে এসেছেন, এই জিনিস আমার বন্ধু নাদির আহমেদ আজ থেকে এক যুগ আগে মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিশ হাজার কাল্পনিক জঙ্গীর ট্রেইনারের ট্যাগ নিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে রিফিউজি জীবনের প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছেন, এই জিনিস অভিজিৎয়ের প্রাণে বেঁচে যাওয়া স্ত্রী বন্যা আহমেদ দেখে এসেছেন, আয়নাঘরে আটকা পড়া বিএনপির নেতাকর্মী, সবেমাত্র আয়নাঘর থেকে বের হওয়া রোমেল চাকমার স্ত্রী সন্তানরা, এই জিনিস ক্রসফায়ারে হত্যা হওয়া একরামুলের কন্যা সারাজীবনের পিটিএসডি সমেত লালন করতে বাধ্য হয়েছেন, এই শাস্তি আপনারই প্রাপ্য, একান্তই আপনার প্রাপ্য, এই নির্যাতনের দায় আপনার নিজেরই— কিন্তু আমি সেটা বলতে পারিনি। ওনার সাথে কথা বলতে আমার খুব মিশ্র অনুভূতি হল, আমার নিজের চিন্তার জন্য নিজের কাছেই নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হলো, আমি ভাবলাম, যেই অপরাধের দায় আমি এত বছর আওয়ামী লীগকে দিয়েছি, সেই একই প্রতিহিংসার রাজনীতির অপরাধে আমি যুক্ত থাকলে নৈতিকভাবে আমি কোনওভাবেই আওয়ামী লীগকে দায়ী করার যোগ্যতা রাখি না, কোনওপ্রকারে এই ভাঙচুর লুটপাটকে ‘মব মেন্টালিটি’ বলে জাস্টিফাই করলে আমি নিজেই নিজের নৈতিক মানদণ্ড রক্ষা করতে পারি না।

হ্যাঁ, এটাও সত্য যে বাংলাদেশ আর্মির আপাত ক্ষমতায় উগ্র ডানপন্থী জাতিবাদীরা দিল্লি, বিজেপি ও আওয়ামীর স্বার্থ চরিতার্থ করতেই অনেক জায়গায় সহিংসতা ঘটিয়ে তার দায় চাপাচ্ছে ছাত্রদের বা ইসলামী জোটগুলির কাঁধে যাতে হাসিনাকে আবার ফেরত আনতে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা যায়, আবার তার উল্টাপাশে যে অতি উৎসাহী মুসলিম জাতিবাদীরাও ফেইসবুকে ঘোষণা দিয়ে রাস্তার সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার বা শরিয়া আইন বলবৎ করে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার লীগিয় পার্পাস সার্ভ করছেন, তাও মিথ্যা না। যদিও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জানমাল তাদের মন্দির মণ্ডপের নিরাপত্তায় ছাত্রদের প্রশংসনীয় ভূমিকা আমরা অনলাইনে দেখছি, কিন্তু তারপরেও আমি বিশ্বাস করি সংখ্যালঘু, পোলিস বাহিনী এবং আওয়ামী সমর্থকদের ওপর সব রকমের হামলার ঘটনা অনতিবিলম্বে বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ আর্মিকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া এই মূহুর্তে অন্য করণীয় নাই।

এর মধ্যে ছাত্রদের পক্ষ থেকে যে সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সরকারের মেয়াদ শেষের ৩ মাস আগে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধান বিচারপতির অপসারণ এবং লীগের সমর্থক বিচারপতিদের অপসারণ করতে হবে। আর্মি নেভি এবং এয়ারফোর্স বাদে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনির প্রধানদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বাতিল, সরকারের সকল চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ বাতিল, ছাত্র-নাগরিক হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত, নিহত ও আহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, জুলাই মাসকে জাতীয় শোকের মাস ঘোষণা, বিগত পনেরো বছরের দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা, শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন তাদের দাবীর বাকি অংশ। ইতিমধ্যেই প্রধান বিচারপতিকে অপরাসরণ করা গেছে। বাকি বিচারপতিরাও ক্ষমতা ছাড়বেন বলেই আশা রাখি।

এই সবকিছুই শুনতে সুন্দর। অন্ততঃ আপাত দৃষ্টিতে। এর কতখানি বাংলাদেশের বর্তমান উত্তাল রাজনৈতিক সমুদ্রে বাস্তবায়ন সম্ভব, কতখানি আদৌ বাস্তবায়ন হবে তা সময় বলবে। তবে আরও একটা প্রশ্নও তো উঠে আসছে। যে প্রশ্ন তুলছেন ফরহাদ মজহার, সেটা হলো যে সংবিধানকে সামনে রেখে সরকার গঠন হচ্ছে, সেই সংবিধানই তো বিপ্লবপূর্ববর্তী। সেই সংবিধান বাতিল করে নয়া সংবিধান গঠন করা কেন হবে না? কেন ফ্যাসিবাদের তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো অবলুপ্ত করে নতুন জাতীয় বিপ্লবী সরকার তৈরি হচ্ছে না? আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আমাদের অনতিবিলম্বেই সংবিধান সংস্কার বা প্রয়োজনে তা বাতিল করে নয়া গণমুখী সংবিধান প্রণয়ন করা সময়ের দাবি।

এছাড়াও আমি মনে করি এই মূহূর্তে আমাদের কর্তব্য নির্ধারণের মধ্যে সকল মানুষের, এবং আই রিপিট, রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপরে উঠে সকল মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরেই দ্বিতীয় কর্তব্য হচ্ছে, সকল প্রকার গণমাধ্যমে, বিশেষতঃ ভারতীয় গণমাধ্যমে বিজেপি-আওয়ামী প্রোপাগান্ডা বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া, গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী হাসিনার পাশে যেন পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রের সরকার না দাঁড়ায়, ভারত সরকার যেন বাংলাদেশ-ভারত রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বাংলাদেশের ছাত্র-নাগরিকের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিতে পারে সেই বিষয়ে সামাজিক সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নেওয়ার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে প্যানিক থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া। পাশপাশি পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি, সংখ্যালঘুদের উপর হামলার প্রেক্ষিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ বলেছেন, “ছাত্রজনতাকে আমরা অনুরোধ করছি সকল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বকদের পক্ষ থেকে যেন তারা ছোট ছোট দল গঠন করে নিজ নিজ এলাকার ধর্মীয় উপাসনালয় গুলো রক্ষা ও পাহারার ব্যবস্থা করেন এই মুহুর্ত থেকেই।” এছাড়াও জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ প্রামাণিক বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে এক ভিডিও বিবৃতিতে জানান, “হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশের হিন্দুরা মনে করেছিলেন তাদের ওপর অত্যাচার হবে, লুটপাট চলবে, অগ্নিসংযোগ হবে। কিন্তু সোমবার বিএনপি ও জামাতের নেতারা তাদের নেতৃবন্দকে নির্দেশ দেন যাতে হিন্দুদের বাড়িতে অত্যাচার লুটপাট অগ্নিসংযোগ না হয়, প্রত্যেক মন্দিরে যাতে পাহারা দেওয়া হয়।” তিনি আরও বলেছেন, মূলতঃ আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপরই আঘাত করা হচ্ছে, যারা কোইনসিডেনশিয়ালি ধর্মসূত্রে সনাতনী। ব্যক্তিগতভাবে আমি গোবিন্দ প্রামাণিকের বক্তব্য সম্পূর্ণ সমর্থন করি না। আমি সবকিছুই মিথ্যা প্রপাগান্ডা বলে এক বাক্যে এক ফুঃয়ে এসব উড়িয়ে দিতে রাজি না, আমি বিশ্বাস করি, পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় পাহারার পরেও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, পোলিস সদস্য এবং লীগের নেতাকর্মীদের ওপরও বিচ্ছিন্নভাবে নির্যাতন হচ্ছে।

আমি সেকারণে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, অন্তর্বতীকালীন সরকার এবং আর্মির প্রতি অনুরোধ করবো, যেন তারা বাংলাদেশে সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেয়, যেই ‘অপর পক্ষের’ মৃত্যুকে লীগের সরকার এতোদিন ঘাড় ঝাঁকিয়ে ফেলে দিয়ে এসেছে, যেই মানুষদের লীগ এতোদিন শুধুমাত্র সংখ্যা বলে বিবেচনা করেছে, সেই বিচারহীনতার প্রতিহিংসার রাজনীতির জিনেটিক ত্রুটি যেন বাংলাদেশ নামক নতুন ভ্রূণ রাষ্ট্র না নিয়ে জন্মায়। অমি রহমান পিয়াল বা নিঝুম মজুমদার বা হোচিমিন ইসলাম বা সৈয়দ বোরহান কবির বা নইমুল ইসলাম খান বা মিথিলা ফারজানাদের মতো ডাইহার্ড লীগারদের বাসাতেও, তাদের আত্মীয়দের ওপরও যেন হামলা না হয়। আমার এক বন্ধু আজকেই বলছিলেন বিএনপি আমলে তারা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন করতেও ভয় পেতেন। সেই ভয় যেন তারা আজকে না পান, যারা আজকেও, এতো কিছুর পরেও আওয়ামী লীগকেই জীবনের ধ্রুবতারা করে রাখার আমৃত্যু পণ করেছেন, তারাও যেন নিগৃহিত না হন, তারাও যেন বাকস্বাধীনতা না হারান, তারাও যেন নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সমেত যাপনের নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত না হন— তা নিশ্চিত করা এই গর্ভাবস্থার দায়িত্ব। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী চিত্র সবসময়ই কুৎসিত আগেই বলেছি। কিন্তু আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো এতোদিনের পুঞ্জিভূত ঘৃণা উদ্গীরণ যেন আমরা চুইংগামের মতো টেনে লম্বা না করি, আমরা যেন লীগের এ্যান্টিথিসিস হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা না করি, আমরা যেন দ্বিতীয় আওয়ামী লীগ হিসাবে নিজেদের জন্ম না দিই তা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের জাতীয় দায়িত্ব।

এই যে এতোগুলি প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদ থেকে আমাদের মুক্তির স্বাধীনতা, এই কালেক্টিভ ত্যাগ তা একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার জন্য খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য শরিয়া কায়েমের জন্য নির্দিষ্ট একটা ধর্মের জন্য নির্দিষ্ট একটা মতাদর্শের জন্য আমরা করিনি। আমরা রাষ্ট্রের সমস্ত ভাস্কর্য ভেঙে ফেলতে, বাংলাদেশকে কোনো দূর দেশ আফগানিস্তান বানাতে, আমরা দাঁড়িটুপিহিজাববোরখা স্লিভলেস টিপ শাঁখাসিঁদুরধুতিপাঞ্জাবি কোনো পোশাকের সাথেই বেশ্যার বা জঙ্গীর ডিভাইড এ্যান্ড রুলের রাজনীতি যুক্ত করে নিজেদের হিন্দু মুসলমান নাস্তিক অজ্ঞেয়বাদী খ্রিশ্চান বৌদ্ধ নারী পুরুষ ট্রান্সজেন্ডার ননবাইনারি লীগ বিএনপি জামাত হেফাজত ইত্যাদি ইত্যাদি দলে ভাগ করে, নিজেদের ভাণ্ডবাটি আলাদা আলাদা করে আমবাগিচার তলায় চড়ুইভাতি খেলতে এই এই এই যন্ত্রণার উৎকণ্ঠার কঠিন সময় পার করিনি। একজন শিশুকে নিজের শরীরে ধারণের সময় তীব্র যন্ত্রণার। সেই শিশু জন্মদানের দৃশ্য কুৎসিত। কিন্তু সেই রক্ত ক্লেদ চিৎকার ঘাম হৈচৈ গর্ভস্রাব উচ্চশব্দ শেষ হলে, পশ্চিম রণাঙ্গন সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হলে— ফুটপাথের ফাঁটল ধরে উঠে আসা অবাধ্য আগাছার শক্তির দিকে তাকালে টিএসসির দেয়ালে আবার ফেরত আসা সুবোধের লাথিতে পড়ে যাওয়া চেয়ারের সংসদের ভিড়ের ধুলায় বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যিতে প্রেমিক প্রেমিকার ছবির মতোন আমাদের কোলের পরিচ্ছন্ন ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে তাকালে আমরা দেখবো—

যেকোনো নতুনের জন্ম সংগ্রামের কষ্টের বেদনার রিস্কটেকিংয়ের ভেতর দিয়ে, স্থিরতার জন্ম অস্থিরতার ভেতর দিয়ে, কর্মহীনতার এবং অকর্মের জন্মও কর্মের ভেতর দিয়ে, এই সুন্দরের জন্ম আমার আপনার কান্নার ভেতর দিয়ে, হাত থেকে মগজ থেকে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া আবু সাঈদের মীর মুগ্ধের হৃদয় থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের পতাকার লাল রঙের ভেতর দিয়ে।

আমরা এই লালের ভেতর দিয়ে উজানে সাঁতরাচ্ছি, আমরা— আমাদের শিশু রাষ্ট্রের জন্মের প্রতীক্ষায় আছি।

নাদিয়া ইসলাম

লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।

Share