আর জি কর ও রাষ্ট্রীয় পেনেট্রেশান: I’m not the only one

।। নাদিয়া ইসলাম ।।

কেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, কেন পিতৃতন্ত্রের ধারকবাহকরা নিজেরা এই আন্দোলনকে সাপ হয়ে কেটে ওঝা হয়ে ঝাড়ার ভঙ্গিতে পেট্রোনাইজ করছেন? কেন হঠাৎ করেই মমতাকে সরানোর এক দফা এক দাবী উঠছে? মমতা খুব ধোওয়া তুলশী পাতা নিশ্চয়ই না, এই আরজিকর ইশ্যুতেই বিভিন্ন ভুলভাল স্টেপ তিনি নিয়েছেন অবশ্যই, কিন্তু তাকে সরাতে সিপিএম-সহ সংসদীয় ও অংসদীয় বামদের বড় অংশ কেন হঠাৎ বিজেপির ভাষায় কথা বলছেন? মমতার সাথে হঠাৎ করেই বাংলাদেশের হাসিনার তুলনা দেওয়া হচ্ছে কেন? হাসিনার সাথে কি মমতার আসলেই কোনো তুলনা হতে পারে? হাসিনা একটা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে গায়ের জোরে গত ১৫ বছর একটা ফ্যাসিস্ট সরকার চালিয়েছেন ভোটচুরির ভেতর দিয়ে মানুষের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে— সবগুলি বিরোধী দলকে গুমখুনের মাধ্যমে, তাদের বাংলার আলক্যাট্রাজ ‘আয়নাঘর’ নামক টর্চারচেম্বারে ঢুকিয়ে, আইন ও বিচারবিভাগ দলীয়করণ বা বলা ভালো আত্মীয়করণের মাধ্যমে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লুট করে প্রতিটা বিপক্ষ কণ্ঠস্বরকে দমন করার সংখ্যালঘু কার্ড, ওয়ার অন টেরোর, জঙ্গিবাদের জুজুর কার্ড খেলে বাংলাদেশের প্রতিটা সংখ্যালঘু নির্যাতনের মাধ্যমে গ্রামের পর হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে জামাত বিএনপি এবং শিবিরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে। তার সাথে ভারত রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গ নামক একটা অঙ্গরাজ্য চালানো মিলিটারিহীন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাহীন মমতাকে কেন তুলনা দেওয়া হবে? আর জি করের ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া হতে পারে, কিন্তু মমতার পদত্যাগ চাওয়া হবে কী কারণে? মমতার সাথে হাসিনারই বা তুলনা দেওয়া হবে কী কারণে?

নাকি মমতাকে সরাতেই এই আন্দোলনের সাথে উন্নাও, হাথরাস, মণিপুর, গুজরাত, কাশ্মীরে লাগাতার গণধর্ষণ ও জেনোসাইড ঘটানো বিজেপিপন্থীদের এত দহরম-মহরম?

আরজিকর ও রাষ্ট্রীয় পেনেট্রেশান: I’m not the only one

আর জি কর হাসপাতালে একটা মেয়ে মারা গেছেন।

“মারা গেছেন”— বাক্যটা একটা আন্ডারস্টেটমেন্ট। ধারণা করা হচ্ছে তাকে গণধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকেই স্বাভাবিক চোখে সত্য বিশ্বাসোৎপাদক এই ধর্ষণ পরবর্তী [বা পূর্ববর্তী] খুনকে কেন আত্মহত্যা বলে ধামাচাপা দেওয়ার হাবভাবপ্রচেষ্টা চলেছে, তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে সমগ্র ভারত রাষ্ট্র ফুঁসে উঠেছে, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে গুজব, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অর্ধসত্য, আইন ভঙ্গ করে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মেয়েটার ছবি, তার নাম— বলা হচ্ছে, ধর্ষণের দৃশ্য নাকি পর্নোগ্রাফিক সাইটে আপলোড দেওয়া হয়েছে! আর সাথে সাথেই পর্নোগ্রাফিক সার্চ-ইঞ্জিনের প্রথম হিটে দেখাচ্ছে মেয়েটার নাম।

হ্যাঁ, পুরো উপমহাদেশবাসী এতোটাই কুৎসিত, এতোটাই বিকারগ্রস্থ অসুস্থ নৃশংস— এতটাই নারীবিদ্বেষী, এতটাই যৌন অবদমিত যে একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করতে করতে তাকে পিটিয়ে মেরা ফেলার দৃশ্যই আমাদের জীবনের একমাত্র যৌন উত্তেজনা হয়ে উঠেছে।

ধর্ষণ কী বা কেন, সেই আলাপে পরে আসা যাবে। তার আগে আর জি করের রাজনীতিটা বুঝে নেওয়া ভালো। ৩১ বছর বয়সের যেই মেয়েটা খুন হয়েছেন, তিনি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেরই একজন ডাক্তার। ওই রাতে ডিউটির ফাঁকে সেমিনার রুমে গিয়েছিলেন বিশ্রাম নিতে। তার লাশ পাওয়া যায় পরদিন, ৯ অগাস্ট সকালে। মৃতর আত্মীয়দের খবর দিয়ে জানানো হয় তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা অবশ্য এই হাসপাতালের ইতিহাসে নতুন কিছু না। ২০২০ সালে এই হাসপাতালের শিক্ষার্থী একজন নারী [সূত্র-০১] এবং ২০০১ সালে এই হাসপাতালেরই চতুর্থ বর্ষের একজন পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন বলে খবরে প্রকাশ হয় [সূত্র-০২]। অবশ্য আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইলেও ধারণা করা হয় এর প্রতিটাই খুন, এবং এই হাসপাতালের বা হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের সাথে পর্নোগ্রাফিক চক্রের কোনোরকম যোগাযোগ আছে। সেই যোগ আছে কী নাই তা প্রমাণসাপেক্ষ নিশ্চয়ই, কিন্তু কোনো না কোনো পর্যায়ের ওপর-মহলের যোগাযোগ যে আছে তা নিশ্চিত। এই ঘটনা পরবর্তী কলেজের অধ্যক্ষ ‘মুখ্যমন্ত্রীর চাইতেও ক্ষমতাশালী’ সন্দীপ ঘোষকে বরখাস্ত না করে বরং ৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করাই সেই যোগাযোগের চাক্ষুষ প্রমাণ। অথচ এই সন্দীপ ঘোষই মেয়েটা অত রাতে ঐ জায়গায় গিয়েছিলেন কেন বলে অশ্লীল ভিকটিম ব্লেইমিং করেছিলেন।

ভিকটিম ব্লেইমিং আমাদের লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদী অঞ্চলের মানুষদের জন্য অবশ্য নতুন বিষয় না। একটা মানুষ [পড়ুন— একটা মেয়ে] ধর্ষিত বা নির্যাতিত হলেই তার পোশাকের মাপ, তার চালচলন চরিত্র তার প্রেমিকের স্বামীর সংখ্যা তার বিড়ি-ফোঁকার মদ্যপানের ইতিহাস নিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা উৎসব বসে যায়। ধর্ষণ কেন হয়, ধর্ষণ কেন হচ্ছে, ধর্ষণে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী— এই প্রশ্ন বাদ দিয়ে প্রধান প্রশ্ন হয়ে ওঠে, “মেয়েটা অত রাতে অমুক জায়গায় গিয়েছিল কেন?”

এই প্রশ্নের সাথে নিরুচ্চারিত যে আলাপ, তা হচ্ছে, শুধু রাতের বেলাতেই খুব সম্ভব ধর্ষণ হয়, দিনের বেলায় সব ধর্ষণেচ্ছু পুংদণ্ডরা আলোর আধিক্যে উচ্চ তাপমাত্রায় ধ্বজভঙ্গে পাজামা লুঙ্গি-ধুতির গর্তে লুকিয়ে থাকে এবং রাত হলেই তারা বেরিয়ে পরে; ফলতঃ রাতের বেলা মেয়েদের নিজেদের দু’পায়ের মাঝখানে জমানো সম্ভ্রম এবং শ্লীলতা রক্ষার্থে বাড়িতে নিরাপদে বাবার ছায়ায় স্বামীর ছায়ায় পুত্রের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী ঘরের বায়ে জীবন কাটানো উচিত, কারণ রাত— অনিরাপদ, কারণ রাত— নিষিদ্ধ, কারণ রাতে ‘ভালো’ মেয়েরা বাইরে যান না, কারণ ভালোমেয়ে অর্থ লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদী নীতিবাগিশ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ধর্ম আর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বয়ানে যে লজ্জাবনত পুত্রপ্রসবযোগিনী বিদুষী পরপুরুষের নজর আর বাসের পাশের সিটে বসা মধ্যবয়সী বুভুক্ষু কাকুর স্তন বরাবর কনুই আড়াল করা নবশরীরধারিণী মুকুলিত ম্যাডোনাদের মাথাভর্তি যে সতীত্বের অহংকারের আঁচল, তার বিপরীতের সকলেই বিবসনা ‘হোর’, সকলে বেশ্যা, নির্লজ্জ কামাচারী বারাঙ্গনা, তাদের সকলকেই ব্যবহার করা যায়, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের শরীরকে যত্রতত্র ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া যায় আবজর্নার মতো, রাতের বেলা বিশ্রাম নিতে যাওয়া একজন শ্রান্ত চিকিৎসকের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলা যায় তারই চেয়ারে।

কিন্তু আজকে, এই একবিংশ শতকের চৌকাঠ পেরিয়ে মাঝরাস্তায় এসে ভারতীয় উপমহাদেশের অর্ধপ্রলম্বিত পুংলিঙ্গবাজদের প্রলম্বিত অন্ধকার যুগের ফ্রেমকরা আধিপত্যবাদ তো আজকের মেয়েরা টানতে নারাজ। তারা বললেন, এই মন্ত্যবের প্রতিবাদে তারা রাতেই বেরোবেন। ১৫ অগাস্ট রাতে ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ বা ‘রাত দখল’ করলেন পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরা। বাংলাদেশের মেয়েরাও তাতে যোগ দিলেন তার পরদিন। তবে এখানে মজার বিষয় হচ্ছে, পিতৃতন্ত্রের মতাদর্শীয় যে রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধে, যে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষের এই আন্দোলন জেহাদ ঘোষণা করতে পারত, সেই বিজেপির হিন্দুত্ববাদী জয় শ্রীরাম ব্রাহ্মণ্যবাদী পার্টিও হুট করে বসন্তপুষ্পাভরণময়ী সাজে এমন ভঙ্গিতে ঢুকে পড়লেন এই আন্দোলনে, যেন আন্দোলনটা কাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে তা স্পষ্ট না, যেন তারা জানেনই না নির্ভয়া কে, যেন তারা জানেনই না মণিপুরে কারা গণধর্ষণ চালাচ্ছেন, যেন ৩০ জুলাই উত্তরখন্ডের ধর্ষিত মৃত নার্সের অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা একেবারেই ওয়াকিবহাল না [সূত্র-০৩], যেন ৬ অগাস্ট উত্তরপ্রদেশের বাল্লিয়াতে ১১ বছর বয়সী একজন শিশুকে ধর্ষণ করে অনলাইনে ভিডিও আপলোড করা ব্যক্তিকে তারা চেনেন না [সূত্র-০৪], যেন ৮ অগাস্ট আমেথিতে নিজের বাবার মাধ্যমে ধর্ষিত হওয়া ১৩ বছরের শিশুর কথা তারা খবরে পড়েননি, যেন তারা বিলকিস বানুরও নাম শোনেননি, যেন তারা উন্নাও-হাথরাস-গুজরাত-কাশ্মীরের কোনো ঘটনা জানেন না। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, মেয়েদের আন্দোলনে সংহতি চালাতে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে কলকাতা মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ তারা আবার সারারাত মেট্রোরেল চালু করে দিলেন। হাহা।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন দিচ্ছেন?

কেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, কেন পিতৃতন্ত্রের ধারকবাহকরা নিজেরা এই আন্দলোনকে সাপ হয়ে কেটে ওঝা হয়ে ঝাড়ার ভঙ্গিতে পেট্রোনাইজ করছেন? কেন হঠাৎ করেই মমতাকে সরানোর এক দফা এক দাবী উঠছে? মমতা খুব ধোওয়া তুলশী পাতা নিশ্চয়ই না, এই আরজিকর ইশ্যুতেই বিভিন্ন ভুলভাল স্টেপ তিনি নিয়েছেন অবশ্যই, কিন্তু তাকে সরাতে সিপিএম-সহ সংসদীয় ও অংসদীয় বামেদের বড় অংশ কেন হঠাৎ বিজেপির ভাষায় কথা বলছেন? মমতার সাথে হঠাৎ করেই বাংলাদেশের হাসিনার তুলনা দেওয়া হচ্ছে কেন? হাসিনার সাথে কি মমতার আসলেই কোনো তুলনা হতে পারে? হাসিনা একটা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে গায়ের জোরে গত ১৫ বছর একটা ফ্যাসিস্ট সরকার চালিয়েছেন ভোটচুরির ভেতর দিয়ে মানুষের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে— সবগুলি বিরোধী দলকে গুমখুনের মাধ্যমে, তাদের বাংলার আলক্যাট্রাজ ‘আয়নাঘর’ নামক টর্চারচেম্বারে ঢুকিয়ে, আইন ও বিচারবিভাগ দলীয়করণ বা বলা ভালো আত্মীয়করণের মাধ্যমে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লুট করে প্রতিটা বিপক্ষ কণ্ঠস্বরকে দমন করার সংখ্যালঘু কার্ড, ওয়ার অন টেরোর, জঙ্গিবাদের জুজুর কার্ড খেলে বাংলাদেশের প্রতিটা সংখ্যালঘু নির্যাতনের মাধ্যমে গ্রামের পর হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে জামাত বিএনপি এবং শিবিরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে। তার সাথে ভারত রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গ নামক একটা অঙ্গরাজ্য চালানো মিলিটারিহীন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাহীন মমতাকে কেন তুলনা দেওয়া হবে? আর জি করের ঘটনায় বড়জোর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া হতে পারে, কিন্তু মমতার পদত্যাগ চাওয়া হবে কী কারণে? মমতার সাথে হাসিনারই বা তুলনা দেওয়া হবে কী কারণে?

নাকি মমতাকে সরাতেই এই আন্দোলনের সাথে বিজেপিপন্থীদের এত দহরম-মহরম?

আমাদের মাথায় রাখা প্রয়োজন ধর্ষণ, বা যৌন নির্যাতন শুধুমাত্র কোনো একটা নির্দিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে ঘটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। বরং ধর্ষণ বা লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদী যেকোনো নির্যাতন রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে যুক্ত ক্ষমতাচর্চার অংশ। ‘টুয়ার্ড আ ফেমিনিস্ট থিওরি অফ দ্যা স্টেট’ (১৯৮৯) এ লেখক ক্যাথেরিন ম্যাকিনোন রাষ্ট্রকেই ধর্ষক হিসাবে দাবী করেছেন। মূলতঃ রাষ্ট্রের লিগাল এবং ইনস্টিটিউশনাল ফ্রেমওয়ার্ক এবং পোলিসিং ও মিলিটারিজেশানের মাধ্যমে মার্জিনালাইজড জনগোষ্ঠীর ওপর যৌন নির্যাতনকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ানোর মাধ্যমে জনমানসে লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদের বৈধতা দেওয়া হয় বলে লেখক দাবী করেন। আমি একইসাথে এই চিহ্ন থাকলে অমুকে পুরুষ, এবং এই এই চিহ্ন থাকলে অমুকে নারী বলে সরলরৈখিকভাবে বর্গে ভাগ করা লিঙ্গ বিভাজনকারী বিজ্ঞানবাদীদেরও দায়ী করি। আমি নিজে হার্ডকোর বিজ্ঞানের, বায়োলজির লোক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, বিজ্ঞান দিয়ে আমাদের লিঙ্গের বিভাজনের রাজনীতি সমস্যাজনক। কারণ আমাদের বাইনারি বর্গের বাইরেও নন-বাইনারি মানুষ আছেন, শুধুমাত্র লিঙ্গ দিয়ে, শুধুমাত্র হরমোন দিয়ে, শুধুমাত্র চরিত্র দিয়ে, নীল-গোলাপী রঙ দিয়ে যাদের কোনো বর্গে ফেলা যায় না। এছাড়াও জেনে রাখা ভালো, সমাজের বিচারে একজন ‘পুরুষের’ শরীরেও ‘নারী’ হরমোন থাকে, সমাজের বিচারে একজন ‘নারীর’ শরীরেও ‘পুরুষ’ হরমোন থাকে। তাহলে এই বিভাজন কেন প্রয়োজন? তাহলে প্রশ্ন আসে— আমাদের ইস্কুল কলেজে নারী এবং পুরুষ নামের আলাদা আলাদা শৌচাগার কি আমাদের প্রয়োজন না উদ্দেশ্য? আমাদের পোশাকের দোকানে নারীর জামা পুরুষের জামার আলাদা আইল কি আমাদের প্রয়োজন না উদ্দেশ্য? আমাদের এই এই শিশু জন্মদানের পতিসেবার ঘরকন্যার রুটি বেলার এই এই দায়িত্ব নারীর, এই এই হালচাষের মাঠে লাঙল দেওয়া যুদ্ধে যাওয়ার স্ত্রী পুত্রের ভরণপোষনের এই এই দায়িত্ব পুরুষের— এই বিভাজন কি আমাদের প্রয়োজন না উদ্দেশ্য? আমি বিশ্বাস করি, এর প্রতিটাই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর উদ্দেশ্য, এর প্রতিটাই উদ্বৃত্ত সম্পদ নির্ভর অর্থনীতির ধর্মীয় মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী ইসলামিক খ্রিশ্চিয়ান জিউইশ বয়ান। নারী পুরুষের ক্ষমতার ডায়নামিক্স তো শুধুমাত্র সরলরৈখিক জেন্ডার স্টেরিওটাইপে সীমাবদ্ধ না, গোলাপী রঙ আর সমাজের চোখে নারী সৌন্দর্য্যের নির্ধারিত চোখের বিস্তৃত আয়তন আর গ্রীবার দৈর্ঘ্য আর স্থূল কোমল পীবরোন্নত বক্ষের সংজ্ঞায় আবদ্ধ না; বরং নারী পুরুষের ক্ষমতার ডায়নামিক্স সিস্টেম্যাটিক ইন্টারজেনেরেশনাল কনসেকোয়েন্সযুক্ত ইন্টারসেকশনাল রাজনৈতিক উদ্বৃত্ত সম্পদ নির্ভর অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদী ক্ষমতার কাঠামোয় ব্যাপৃত। নারী পুরুষের এমন বাইনারি ধর্মীয়-সামাজিক বিভাজন একমাত্রই ক্ষমতার রাজনীতিতে নির্দিষ্ট গোষ্টিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই, ঐতিহাসিকভাবে সামন্তবাদী, রাজতন্ত্রী এবং বর্তমানে গণতন্ত্রী ব্যবস্থায় বিভাজনসূত্রে ট্র্যানজ্যাকশানমূলক আধিপত্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, ফানোর ভাষায় ঔপনিবেশিকতাবাদকে টিকিয়ে রাখার অস্ত্র হিসাবে কাজ করে (দ্যা রেচেড অফ দ্যা আর্থ, ১৯৬১)। ধর্ষণ, এ কারণেই শুধুমাত্র এক বা একাধিক ব্যক্তির ঘটানো কোনো নিপাট যৌন সন্ত্রাস না, এই ধর্ষণ রাষ্ট্রের মারফত চালানো ধর্ষণও। এই ঘটনার সাথে জড়িতদের শাস্তির দাবীর সাথে সাথে আমাদের এ কারণেই অতি অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে, আমাদের গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও।

না। ধান ভানতে আমি শীবের গীত গাইছি না। আমি বলছি, শীবের গীতের সাথেই ধান ভানার যোগ আছে। শীবের গীতকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। আমরা আরজিকর ঘটনার সাথে জড়িতদের রাষ্ট্রীয় আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করব অবশ্যই। আমি ব্যক্তিগতভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিপক্ষে, ফাঁসির বিপক্ষে। কিন্তু ভারত রাষ্ট্র এইক্ষেত্রে যুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের জন্য যা শাস্তি নির্ধারণ করবে, তাতে আমার আপত্তি থাকবে না নিশ্চয়ই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর জি করের দোষীদের চিহ্নিত করতে পদক্ষেপ করছে, দেখছি। পুলিশ প্রাথমিকভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে একে আত্মহত্যা বলে বসলেও শেষমেশ সিবিআই তদন্তও শুরু হয়েছে রাজ্য সরকারের সম্মতিতেই, দেখছি। সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতে সঞ্জয় রায় নামে পোলিসের সাথে যুক্ত একজন সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে উড়ো খবর প্রাপ্ত কিছু পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে, নেক্রোফিলিয়া নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হলেও এই মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপধ্যায় পুলিশকে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার নির্দেশ দিয়ে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দেখছি। সেক্ষেত্রে বিচারের রায় হবার আগে আর কিছুই বলা যাবে না সঙ্গত কারণে অবশ্যই। কিন্তু আমার আশা থাকবে, এই ঘটনা থেকে মানুষ প্রশ্ন করা শুরু করবেন। আমি আশা করবো শুধু সঞ্জয় রায় নামের একজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একজন অধ্যক্ষকে চাকরিচ্যুত করেই যেন আমরা থেমে না যাই। আজকেই, এই লেখাটা লিখতে লিখতেই নন্দীগ্রামে বিজেপি নেতৃত্বে একজন নারীকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটানোর কুৎসিত ঘটনার খবর পেলাম [সূত্র-০৬]। আমি আশা করব, এই ঘটনাগুলিকে আমরা যেন বিচ্ছিন্নভাবে না দেখি, আমরা যেন বুঝতে শিখি একা একজন হ্যাংলাপাতলা সঞ্জয় বা একা একজন বিজেপির পাণ্ডার কিছু সময়ের রক্তপ্রবাহের কয়েক ইঞ্চি পুরুষাঙ্গের ক্ষমতার জোর এসব না; বরং এই ক্ষমতার উৎস লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদের রাষ্ট্রে, ধর্মে এবং লগ্নিপুঁজির অর্থনীতিতে। আমি আশা করব, শুধু পিতৃতন্ত্র পিতৃতন্ত্র বলে চ্যেঁচিয়ে আমরা যেন শুধু আমাদের বেচারা ভালোমানুষ বাবাদের অপরাধবোধের মুখে ফেলে না দেই, বরং আমরা যেন লৈঙ্গিক আধিপত্যবাদের মূলে বিরোধিতা করার, কেন্দ্রীয় ফ্যাশিস্টদের মনুবাদী ওয়াহাবি কাঠামোর কেন্দ্রিয় ‘পুরুষ’ মস্তিষ্কের প্রবল পেনেট্রেশানের মুখে এতো শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করি যেন পৃথিবীর তাবৎ প্রোভার্বিয়াল পুরুষাঙ্গ আমাদের সাহসের সামনে, আমাদের মেরুদণ্ডের সামনে, আমাদের প্রতিরোধের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর তাকত অর্জন না করতে পারে, যেন আমাদের মেয়েদের, আমাদের শিশুদের, আমাদের সেবা দেওয়া শ্রান্ত চিকিৎসকদের, আমাদের আদিবাসীদের, সংখ্যালঘুদের আর কোনোদিন, আর কোনোদিন, আর কোনোদিন এই কুৎসিতভাবে পর্নোগ্রাফিক সাইটে পৃথিবীর সকলের সামনে বিবস্ত্র হয়ে শরীরের হাড় ভেঙে এভাবে মৃত্যু বরণ করতে না হয় যেখানে চোখ থেকে গড়ানো রক্ত দেখে আপনার মনে হয় আপনার এবং আমার চোখ থেকে গড়ানো এই পানি আমাদের সৌভাগ্য।

নির্ভানার একটা গান আছে, “Rape me” নামের। এই গানটা আমি যতবার শুনি, আমার ততবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনির সেনাসদস্যদের মারফর ধর্ষিত তনুর কথা মনে হয়, জুনকো ফুরুতার ১৭ বছর বয়সী শিশু শরীরের কথা মনে হয়, মণিপুরের দুইজন কুকি নারীকে গণধর্ষণের পর একদল মৈতৈ পুরুষের তাদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য করার দৃশ্য মনে হয়, আমার কানে বাজে আর জি করের নির্যাতিত ডাক্তারের আত্মীয়র বয়ানে একজন মেয়ের দুই পা দুই দিকে নিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলার দৃশ্যের বর্ণনা, ভদ্রমহিলা বলছেন মৃতের মা বাচ্চার লাশ দেখতে চাইছেন, বলছেন, “হামে বাচ্চিকা মু একবার দিখাও, হামে বাচ্চিকা মু একবার দিখাও”— আর আমার মনে হতে থাকে আমিই ধর্ষিত হয়েছি, আমিই ধর্ষিত হচ্ছি, আমাকেই টেনে ছেঁড়া হচ্ছে, আমার গলার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আমার পাকস্থলী আমার ভেতরের সব কিছু টেনে ছিঁড়ে নিয়ে আসা হচ্ছে, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আমি ভাবছি, I’m not the only one,

I’m not the only one.

I’m not the only one.

]

গ্রাফিক্স: দেবাশিস চক্রবর্তী

তথ্যসূত্র

০১https://indianexpress.com/article/cities/kolkata/kolkata-junior-doctor-suicide-r-g-kar-medical-college-hospital-covid-19-6388954/?fbclid=IwY2xjawEtYsZleHRuA2FlbQIxMAABHWEhgG4xCmd075rxLLvlvXrDqE0U8fXJ5e2qrtCmpy4J1k_Emay_F2g1qQ_aem_Ggur2LSzQG5-a8gSDk7mIw

০২ https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/porn-ring-behind-students-murder-at-r-g-kar-medical-college-in-kolkata/articleshow/1900044424.cms?fbclid=IwY2xjawEtYRlleHRuA2FlbQIxMAABHcNJi4fDWX_UH5ecP75owMRitBzAchQwbSR50jCN-WkxOEndVJCROlgN1g_aem_5Jb7_1bsaJMPPJhznU775w

০৩ https://www.ndtv.com/india-news/nurse-raped-killed-on-way-to-home-from-uttarakhand-hospital-body-found-8-days-later-in-up-6345740

০৪ https://www.thehindu.com/news/national…

০৫https://www.indiatvnews.com/crime/uttar-pradesh-horror-man-rapes-13-year-old-daughter-in-amethi-crime-news-up-police-investigation-fir-registered-latest-updates-2024-08-15-947089

০৬- https://tv9bangla.com/west-bengal/purba-medinipur/a-woman-allegedly-tortured-in-nandigram-one-arrested-1109826.html?fbclid=IwY2xjawEtmYJleHRuA2FlbQIxMQABHQ0Q5XP6ZBX8B6xXxOw1GWY48Z515FVpg_oejC9obUN9Ytdz662cT5lqkA_aem_raXu8Y1pFxRssn4rPrUyRA

নাদিয়া ইসলাম

লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।

Share